চট্টগ্রাম বন্দরে নেতৃত্বের এক বছর: অগ্রযাত্রা, দায়বদ্ধতা ও রূপান্তরের অনন্য অধ্যায়

রিয়ার এডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত চট্টগ্রাম বন্দর দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। বঙ্গোপসাগরের তীরে কৌশলগতভাবে অবস্থিত এই বন্দরটি দেশের আমদানি-রপ্তানির ৯০ শতাংশ এবং কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ৯৮ শতাংশ পরিচালনা করে। আধুনিক কনটেইনার টার্মিনাল ও দক্ষ কার্গো হ্যান্ডলিং সিস্টেমসহ উন্নত অবকাঠামো সমৃদ্ধ বন্দরটি আঞ্চলিক বাণিজ্যে অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এর অবদান অনস্বীকার্য। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের সংযুক্তি এই বন্দর ঘিরেই বিকশিত। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) ১৩৮ বছরের গৌরবময় যাত্রা অতিক্রম করেছে। প্রতিশ্রুতি, সমৃদ্ধি ও দায়িত্বশীলতার ধারক এই প্রতিষ্ঠান আজ আধুনিকতা, টেকসই উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার মুখোমুখি।


২০২৪ সালের জুলাইয়ে জাতীয় অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে যখন চট্টগ্রাম বন্দর পুলিশ ও আনসার বাহিনীর অনুপস্থিতিতে ঝুঁকির মুখে পড়ে যায়, তখন রিয়ার এডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান বন্দরের দৃঢ় নেতৃত্ব নিশ্চিতে বন্দর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার কৌশলগত ও গতিশীল পদক্ষেপের ফলে বন্দর পরিচালনায় অবিলম্বে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে এবং দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম চলমান থাকে। এই দুঃসময়ে তার নেতৃত্ব প্রমাণ করে, সঙ্কট মুহূর্তেই প্রকাশিত হয় প্রকৃত নেতৃত্বের সার্থকতা।
বন্দর চেয়ারম্যানের দূরদর্শী নেতৃত্বে চবক আজ বিশ্বমানের, স্বচ্ছ, দক্ষ ও নির্ভরযোগ্য বন্দর ব্যবস্থার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। গত এক বছরে নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বন্দর কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ও সাফল্য অর্জিত হয়েছে। নিচে এ সময়ে চবক-এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির কথা তুলে ধরা হলো:


কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে নতুন রেকর্ড
২০২৪-২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) কনটেইনার হ্যান্ডলিং ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক অতিক্রম করেছে। ৪৮ বছরের পথচলায় এই প্রথম বছরে ৩২,৯৬,০৬৭ টিইইউ (২০ ফুট সমতুল্য ইউনিট) হ্যান্ডলিং করে পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৪% প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই সংখ্যা ছিল ৩১,৬৮,৬৯০ টিইইউ, অর্থাৎ অতিরিক্ত ১,২৭,৩৭৭ টিইইউ হ্যান্ডলিং হয়েছে এ বছরে।


২০২৪ সালেও বন্দরের কার্যক্রম ছিল চমকপ্রদ। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ৭.৪২% এবং মোট কার্গো থ্রুপুটে ৩.১১% প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়ে এ সময়ে- দুটোই বন্দরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। উল্লেখ্য, জুলাইয়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা, বন্যা, পরিবহন ধর্মঘট ও কাস্টমস কার্যক্রমে নানা বিঘœ সত্ত্বেও জাহাজের গড় অপেক্ষার কাল কমে এসেছে মাত্র একদিনে, যা বন্দর ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।


রাজস্ব ও মুনাফায় প্রবৃদ্ধি
২০২৪-২৫ অর্থবছরে চবক বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় আর্থিক সক্ষমতার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমধর্মী অগ্রগতি অর্জন করেছে। মোট রাজস্ব আয় ৮.২২% বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫,২২৭.৫৫ কোটি টাকায়, যা আগের বছরের ৪,৮৩০.৩৭ কোটি টাকা থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি। যদিও ব্যয় ৯.৪৫% বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২,৩১৪.৮৬ কোটি টাকা, তারপরও বন্দর রাজস্ব উদ্বৃত্তে ৭.২৭% প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে; ২,৭১৫.৩৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে উঠেছে ২,৯১২.৬৯ কোটি টাকায়। এ অর্জন প্রতিষ্ঠানটির শক্তিশালী আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং রাজস্ব উৎপাদনের সক্ষমতাকে প্রতিফলিত করে।


জাতীয় কোষাগারে উল্লেখযোগ্য অবদান
গত পাঁচ বছরে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সরকারের রাজস্ব খাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। এই সময়ে জাতীয় কোষাগারে মোট ৭,২০৩.০৬ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে, যা ক্রমবর্ধমান হারে প্রতিবছর বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ১,৭৬৫.২৬ কোটি টাকা প্রদান করে চবক নিজেকে সরকারের অন্যতম বৃহৎ রাজস্ব প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে।

মানবসম্পদ উন্নয়নে যুগান্তকারী পদক্ষেপ
মানবসম্পদ উন্নয়নে দীর্ঘদিন পর, ২০২৫ সালের এপ্রিল-মে মাসে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি বড় ধরনের নিয়োগ কার্যক্রম শুরু করে। এ সময় বন্দরের ৩৬৫টি শূন্য পদের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এবং একসাথে ৬৬৩ জন বিদ্যমান কর্মচারীর পদোন্নতি- দুটি উদ্যোগই বন্দরের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এছাড়া, কর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পোর্ট টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় একটি বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গঠনের উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে, যেখানে অপারেটর ও কারিগরি কর্মীদের আন্তর্জাতিক মানে দক্ষ করে তোলা হবে, যাতে তারা বাংলাদেশের বন্দর খাতের কার্যকর নেতৃত্ব হাতে নিতে সক্ষম হয়।


টেকসই কল্যাণ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি সমাজসচেতন ও মানবকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেও কাজ করে যাচ্ছে। বন্দরের কর্মী ও আশেপাশের জনগোষ্ঠীর জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ ৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২টি কলেজ এবং একটি মাদ্রাসা পরিচালনা করে আসছে।
নারী কল্যাণে ‘সিপিএ মহিলা সংঘ’ পরিচালিত ‘ঘাসফুল প্রাথমিক বিদ্যালয়’ এবং ‘নতুন কুঁড়ি কিন্ডারগার্টেন’ নারী সম্পৃক্ততা ও শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি সজ্জিত বন্দর হাসপাতাল বন্দরের কর্মী ও স্থানীয় জনগণের জন্য উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করছে। ‘পোর্ট রিপাবলিক ক্লাব’ বছরের নানা সময়ে সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে কম্যুনিটির মধ্যে সম্প্রীতি এবং অংশগ্রহণমূলক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাচ্ছে। ধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য চবক মসজিদ, মন্দির ও অন্যান্য উপাসনালয় নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে। এছাড়া, কর্মীদের অনুপ্রাণিত রাখতে বার্ষিক প্রণোদনা বোনাস প্রদান করা হচ্ছে, যা বন্দর কর্তৃপক্ষের অন্তর্ভুক্তিমূলক, মানবিক এবং দায়িত্বশীলতার বহিঃপ্রকাশ।


অবকাঠামো উন্নয়নে রূপান্তর ও গতিশীলতা
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) দেশের সামুদ্রিক সক্ষমতা ও আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিস্তৃত অবকাঠামোগত উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। একটি আঞ্চলিক বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে বন্দরের অবস্থান সুদৃঢ় করতে আধুনিক কার্গো হ্যান্ডলিং, উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং স্মার্ট টার্মিনাল স্থাপনের মতো বহুমাত্রিক প্রকল্প দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। নিচে এসব প্রধান প্রকল্পের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো:


ক. বে টার্মিনাল
বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় বাস্তবায়নাধীন বে টার্মিনাল প্রকল্পকে বাংলাদেশের অগ্রগতির পথে একটি ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এটি বন্দরে সুবৃহৎ জাহাজ ভেড়ানোর সক্ষমতা তৈরি করবে, জাহাজের টার্নঅ্যারাউন্ড সময় হ্রাস করবে এবং আমদানি-রপ্তানির খরচ কমিয়ে আনবে। ২০৩১ সালে চালু হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে নির্মিত এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের নৌবাণিজ্যে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে আবির্ভূত হবে।


খ. মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর
২০২৫ সালের এপ্রিলে চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দরের অংশ হিসেবে মাতারবাড়িতে দুটি জেটি নির্মাণে পেন্টা-ওশান ও টিওএ কর্পোরেশনের সঙ্গে ৬,২০০ কোটি টাকার জাইকা-অর্থায়িত চুক্তি স্বাক্ষর করে। ২০২৯ সালের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার পরিকল্পনাধীন এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৮,০০০ টিইইউ ধারণক্ষমতার জাহাজও পরিচালনা করা সম্ভব হবে, যা বাংলাদেশের বৈশ্বিক সংযোগকে এক নতুন মাত্রায় উন্নীত করবে।


গ. লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল (এলসিটি)
দীর্ঘদিন অনুন্নত থাকা লালদিয়া টার্মিনালকে আধুনিকায়নের জন্য একটি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় এর উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে। বিশ্বখ্যাত এপিএম টার্মিনালসহ আন্তর্জাতিক অপারেটররা এতে যুক্ত হয়েছে। বছরে ০.৯ মিলিয়ন টিইইউ হ্যান্ডলিং সক্ষমতা যুক্ত করে এটি বন্দরের কনটেইনার ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য গতি নিশ্চিত করবে।

ঘ. নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)
সাইফ পাওয়ারটেকের সঙ্গে ১৭ বছরের চুক্তির মেয়াদ শেষে, গত ৭ জুলাই ২০২৫-এ চট্টগ্রাম ড্রাই ডক লিমিটেড (সিডিডিএল)-এর কাছে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত সিডিডিএল কার্যক্রমের প্রথম মাসেই ধারাবাহিক কনটেইনার হ্যান্ডলিং প্রবৃদ্ধি প্রদর্শন করেছে।


ঙ. গ্রিন চ্যানেল
স্মার্ট, স্বয়ংক্রিয় ও ডিজিটালাইজড অপারেশনের অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরে চালু করা ‘গ্রিন চ্যানেল’ ব্যবস্থাটি বিশ্বস্ত অনুমোদিত ব্যবসায়িক সত্তাগুলির জন্য দ্রুত হ্যান্ডলিং নিশ্চিত করছে। এটি যানজট, অপচয় ও খরচ কমিয়ে বন্দরের সামগ্রিক দক্ষতা বৃদ্ধি করছে এবং বাণিজ্য পরিবেশকে আরও স্বচ্ছ ও গ্রাহকবান্ধব করে তুলছে।


চ. মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল
প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বন্দরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় একটি আধুনিক ‘মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই অঞ্চলে বন্ডেড গুদামজাতকরণ, মূল্য সংযোজন কার্যক্রম ও উৎপাদন ব্যবস্থা চালু হবে, যার মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং দেশের রপ্তানি প্রতিযোগিতা আরও জোরদার হবে।


দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিকীকরণ
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় বহুমুখী দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বন্দর কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় রেকর্ডসংখ্যক কনটেইনার হ্যান্ডলিং, দ্রুত জাহাজ বার্থিং এবং কর্মপ্রক্রিয়ার সরলীকরণ এরই প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
গৃহীত মূল উদ্যোগগুলো হলো:
ই-গেট পাস ও অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম চালু, যা বন্দরের অটোমেশন প্রক্রিয়াকে গতিশীল করেছে।
নতুন ক্রেন সংগ্রহ এবং ড্রাফট গভীরতা বৃদ্ধি, যার ফলে এখন ৬০-৬৫% জাহাজ বন্দরে আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই বার্থিং করতে পারছে।
জাহাজের গড় অপেক্ষাকাল মাত্র একদিনে নামিয়ে আনা, যা বন্দরের অনন্য দক্ষতার নিদর্শন।
‘অনলাইন এজেন্ট ডেস্ক’ চালু করা, যা ঝামেলামুক্ত ডকুমেন্টেশন এবং গ্রাহকসেবাকে আরো সহজ ও সময়-সাশ্রয়ী করেছে।
এসব আধুনিকীকরণ পদক্ষেপ চট্টগ্রাম বন্দরকে শুধুই একটি কর্মক্ষম বন্দর নয়, বরং একটি উদ্ভাবনী, দক্ষ ও ব্যবসাবান্ধব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করছে।


ডিজিটাল রূপান্তর ও অটোমেশন
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) ধারাবাহিকভাবে অটোমেশন ও ডিজিটালাইজেশনের পথে অগ্রসর হচ্ছে। আধুনিকায়িত টার্মিনাল অপারেটিং সিস্টেম (টিওএস), যা পূর্বে সিটিএমএস নামে পরিচিত ছিল, বর্তমানে অনলাইন গেট পাস ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। এই নতুন ব্যবস্থায় ড্রাইভাররা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রবেশ ফি পরিশোধ করে কিউআর কোড স্ক্যানের মাধ্যমে নিরাপদ ও দ্রুত ই-গেট প্রবেশাধিকার পাচ্ছেন। ম্যানুয়াল কিউর পরিবর্তে এ প্রযুক্তি ট্রাফিক প্রবাহ সচল রাখছে এবং কার্গোর রিয়েল-টাইম ট্র্যাকিং সুবিধা নিশ্চিত করছে। একইসাথে চালু হয়েছে যানবাহন ট্র্যাকিং ও স্বয়ংক্রিয় বার্থ বরাদ্দ পদ্ধতি, যা অপারেশনাল দক্ষতা ও কার্গো ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনছে। এসব প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ‘মেরিটাইম সিঙ্গেল উইন্ডো’ চালু হয়েছে, যা বাণিজ্য ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়াকে আরো সহজ করছে। পাশাপাশি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইওআরআইএস প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সংযুক্তির মাধ্যমে এফএএল কনভেনশনের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা প্রোটোকলের সাথে বন্দর কার্যক্রমের সামঞ্জস্য দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্কার ও অংশীজন সমন্বয়
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্কার খাতে গুরুত্ব দিচ্ছে। সরলীকৃত শুল্ক প্রক্রিয়া এবং স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি আরও স্বচ্ছ ও কার্যকর বন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে ডিজি কার্গো ও নিলামযোগ্য কনটেইনার দ্রুত অপসারণ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে, যা যানজট নিরসনে অতীব সহায়ক। বিপজ্জনক কার্গোর ধ্বংসে তারা কাস্টমসকে কার্যকর সহযোগিতা করেছে এবং পুলিশসহ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সংস্থার অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য জমিও বরাদ্দ দিয়েছে।


কৌশলগত পুনর্গঠন ও মাস্টার প্ল্যান
জাতীয় উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চবক একটি দীর্ঘমেয়াদী মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন করছে, যার লক্ষ্য বন্দর অবকাঠামো ও ডিজিটাল কার্যক্রম আধুনিকীকরণ। এই পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বে টার্মিনাল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর ও লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল-এর মতো মেগা প্রকল্প, যেগুলো বন্দরের বড় জাহাজ হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। একইসাথে টিওএস এবং ভিটিএমআইএস সিস্টেম-এর মাধ্যমে কার্গো ট্র্যাকিং, বার্থ বরাদ্দ ও নেভিগেশন নিরাপত্তা উন্নত করা হচ্ছে। পাশাপাশি, বাংলাদেশ সরকার চট্টগ্রাম বন্দরের দূরদর্শী চেয়ারম্যানকে ‘ফোকাল পয়েন্ট’ হিসেবে রেখে ‘মেরিটাইম সিঙ্গেল উইন্ডো’ প্ল্যাটফর্ম ধারণার ভিত্তিতে চট্টগ্রাম, মোংলা, পায়রা এবং দেশের অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরগুলিকে একীভূত করে একটি সমন্বিত জাতীয় সমুদ্র বন্দর কৌশল (এনপিএমএস) প্রণয়নের কাজ করছে।


গ্রিন মেরিটাইম ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন
পরিবেশ সচেতনতা ও টেকসই উন্নয়নের অংশ হিসেবে নিজেকে গ্রিন মেরিটাইম সেক্টর বা ‘সবুজ সমুদ্রবন্দর’ হিসেবে রূপান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। বে টার্মিনাল ও মাতারবাড়ী উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে জলবায়ু-সহনশীল ব্রেকওয়াটার এবং ড্রেজিংকৃত অ্যাক্সেস চ্যানেল ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে বন্দর কার্যক্রম আগামী দিনে আরো টেকসই হবে এবং জাহাজ চলাচলের দক্ষতা ও নিরাপত্তা আরো বৃদ্ধি পাবে।


আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও বৈশ্বিক সংযুক্তি
আন্তর্জাতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এপিএম টার্মিনাল, ডিপি ওয়ার্ল্ড, পিএসএ সিঙ্গাপুর, এবং জাইকার মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলছে চট্টগ্রাম বন্দর। পাশাপাশি, থাইল্যান্ডের রানং বন্দর এবং ক্রোয়েশিয়ার রেজিকা গেটওয়ে বন্দরের সঙ্গে সহযোগিতা স্থাপনের মধ্য দিয়ে নতুন শিপিং রুট ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনা উন্মোচিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই আন্তর্জাতিক সহযোগিতাগুলো বন্দরের সক্ষমতা সম্প্রসারণে সহায়তা করবে এবং চট্টগ্রামকে বৈশ্বিক বাণিজ্য নেটওয়ার্কে আরও কার্যকরভাবে সংযুক্ত করবে।


আইএসপিএস কোডের কঠোর প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক জাহাজ ও বন্দর সুরক্ষা কোড (আইএসপিএস কোড)-এর সাথে নিখুঁত সামঞ্জস্য ও সঙ্গতি বজায় রেখেছে। এর প্রমাণ ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন কোস্ট গার্ড বাহিনী পরিচালিত নিরীক্ষা, যেখানে এই প্রথমবারের মতো “কোনো ত্রুটি নেই” কথাটি উল্লেখ করা হয়েছে। এটি চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য এক অনন্য সাফল্য।


এই নিরীক্ষায় প্রতিনিধিদল আইএসপিএস মনিটরিং সেল, সিসিটিভি কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল রুম, রপ্তানি কনটেইনার স্ক্যানার এবং ইস্পাহানি-সামিট অ্যালায়েন্স ও পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সরেজমিন পরিদর্শন ও মূল্যায়ন করে। তারা বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং নিরাপত্তাকর্মীদের পেশাদারিত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে সন্তোষ প্রকাশ করেন।


ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি: বিশ্বমানের সমুদ্র বন্দর
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য এই বন্দরকে একটি বিশ্বমানের মেরিটাইম লজিস্টিক হাব, বা সামুদ্রিক সরবরাহ কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আঞ্চলিক সংযোগকে ত্বরান্বিত করবে। এ লক্ষ্যে কৌশলগত অবকাঠামো উন্নয়ন, নীতিগত সংস্কার এবং বৈশ্বিক অংশীদারিত্বের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আগামী দিনের চাহিদা মেটাতে বন্দর কর্তৃপক্ষ যেসব রূপান্তরমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে তা নিচে উপস্থাপন করা হলো:

ক. রপ্তানিমুখী ডকইয়ার্ড: মাতারবাড়ী কেন্দ্র করে
চট্টগ্রাম বন্দরের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কেন্দ্রে রয়েছে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরের আওতায় একটি রপ্তানিমুখী ডকইয়ার্ড নির্মাণ করা। বৃহৎ জাহাজ পরিচালনার উপযোগী এই ডকইয়ার্ড বাংলাদেশের জন্য বৈশ্বিক সামুদ্রিক বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। বিশেষ করে জাহাজ নির্মাণ ও রপ্তানি খাতে এটি দেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্লেয়ারে রূপান্তরিত করবে।


খ. বন্দরের জমির সর্বোত্তম ব্যবহার
টেকসই এবং কার্যকর সম্পদ ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দর তার বিদ্যমান ভূমি সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের লক্ষ্য নিয়েছে। এর আওতায় গুদামজাতকরণ, সরবরাহ চেইন, বন্দর পরিচালনা ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য কৌশলগত জোনিং করে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং বৃহত্তর অর্থনৈতিক পরিবেশে ইতিবাচক অবদান রাখা হচ্ছে।


গ. পোর্ট-টু-পোর্ট, বা বন্দর-থেকে-বন্দর সহযোগিতা
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বন্দরগুলোর সঙ্গে সরাসরি শিপিং লাইন স্থাপন এবং যৌথ উদ্যোগে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ চট্টগ্রাম বন্দর। এর মাধ্যমে কাস্টমস ও ডকুমেন্টেশন প্রক্রিয়া সহজতর হবে, যৌথ লজিস্টিক করিডোর তৈরি হবে এবং নতুন গন্তব্যে পণ্য চলাচল আরো বৃদ্ধি পাবে। আঞ্চলিক বাণিজ্যে আরো গতিশীলতা নিশ্চিত করবে।


ঘ. কাঠামোগত সংস্কার ও আধুনিকীকরণ
চট্টগ্রাম বন্দর তার প্রবৃদ্ধিকে টেকসই ও কার্যকর রাখতে কাঠামোগত সংস্কারে মনোনিবেশ করেছে। এই সংস্কারের মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল রূপান্তর, স্বয়ংক্রিয় বন্দর পরিচালনা, উন্নত প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং জনবল উন্নয়ন। এসব উদ্যোগ বন্দর ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।


ঙ. স্যাটেলাইট বন্দর শহর উন্নয়ন
চট্টগ্রাম বন্দরের অন্যতম দূরদর্শী উদ্যোগ হলো একটি স্যাটেলাইট পোর্ট সিটি, বা বন্দর শহর গড়ে তোলা, যা মূল বন্দর এলাকার ওপর তৈরি হওয়া চাপ হ্রাস করবে এবং বন্দর কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করবে। এই পরিকল্পিত শহরে আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্পাঞ্চল থাকবে, যা এলাকাটিকে একটি আধুনিক অর্থনৈতিক ও লজিস্টিক হাবে পরিণত করবে। এটি চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যানের প্রগতিশীল নেতৃত্বের প্রতিফলন, যা শুধু প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতাই বৃদ্ধিই করবে না, বরং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনোবলকেও উজ্জীবিত করবে।


উপসংহার
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) জন্য গত বছরটি ছিল শুধু অগ্রগতিরই নয়, বরং এক রূপান্তরের বছর। এ সময়ে বন্দরের স্থিতিস্থাপকতা, আধুনিকায়ন এবং জাতীয় অর্থনীতিতে এর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব আরো সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। রেকর্ড ভাঙা কার্গো হ্যান্ডলিং, বে টার্মিনাল ও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পসহ দূরদর্শী অবকাঠামোর বিকাশ, এই বন্দরকে শুধু একটি বাণিজ্যিক প্রবেশদ্বার নয়, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রার কৌশলগত চালিকাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মধ্যেও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি, আর্থিক ভারসাম্য এবং পরিচালনগত উৎকর্ষতা ধরে রেখেছে। ডিজিটাল রূপান্তর, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন ও আধুনিক সরবরাহ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি নিজের ভেতরেই এক নতুন দক্ষতা ও গতিশীলতার অধ্যায় সূচনা করেছে, যা আন্তর্জাতিক মানদ-ের সাথে বাংলাদেশের সামুদ্রিক খাতকে সংযুক্ত করেছে আরো নিবিড় ও কার্যকরভাবে।
নেতৃত্বের দূরদর্শী পরিকল্পনা ও অগ্রণী মনোভাবের প্রতিফলন ঘটিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর আজ বাংলাদেশের নতুন অর্থনৈতিক যুগের পথপ্রদর্শক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখছে বৈশ্বিক বাণিজ্যে একটি নেতৃস্থানীয় অবস্থানে উঠে আসার; আর তার সেই স্বপ্নেরই এক বিশুদ্ধ প্রতিফলন চট্টগ্রাম বন্দরের মাস্টারপ্ল্যান। এই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে বন্দর চেয়ারম্যানের সুদক্ষ নেতৃত্বে চলমান অগ্রগতি অব্যাহত রেখেছে চট্টগ্রাম বন্দর- আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিক দক্ষ, অধিক স্বচ্ছ, আরো জবাবদিহিমূলক এবং আরো বেশি উচ্চাভিলাষী।
আগামী দিনের প্রত্যাশা-কেবল প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করাই নয়, বরং একটি টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং উদ্ভাবননির্ভর সামুদ্রিক অর্থনীতি নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি বিশ্বমানের বাণিজ্যিক শক্তিতে পরিণত করা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here