বন্দরকে জনবান্ধব করতে চাই

রিয়ার এডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান

রিয়ার এডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান, ওএসপি, এনডিসি, এনসিসি, পিএসসি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন ১১ আগস্ট। সাড়ে তিন দশকের কর্মজীবনে তিনি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বিভিন্ন জাহাজ, প্রতিষ্ঠান ও নৌসদর দপ্তরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডিইডব্লিউ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সেনা কল্যাণ সংস্থার ডিজিএমআইএস, কমান্ডার চট্টগ্রাম নৌঅঞ্চলের চিফ স্টাফ অফিসার হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতাও রয়েছে তার। সর্বশেষ বন্দর চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদানের আগে তিনি বিএন ফ্লিটের কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন। জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত ও ব্যবহারবান্ধব বন্দর গড়ে তোলার যে আকাক্সক্ষা, সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। সেসব কার্যক্রম ও অগ্রগতির কথা উঠে এসেছে বন্দরবার্তার সাথে তার একান্ত সাক্ষাৎকারে।

দীর্ঘ সাড়ে তিন দশকের বর্ণাঢ্য কর্মজীবন আপনার। দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও। এখন দায়িত্ব পালন করছেন দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে। বন্দরকেন্দ্রিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা কেমন দেখছেন এবং জাতীয় অর্থনীতিতে তা কীভাবে অবদান রাখছে?

এস. এম. মনিরুজ্জামান: সমুদ্র বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ দুটি অনুষঙ্গ হচ্ছে বন্দর এবং শিপিং। দেশের সমুদ্র বাণিজ্য প্রধানত চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কনটেইনারের প্রায় ৯৮ শতাংশ এবং দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ৯২ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সম্পন্ন হয়। এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে এই বন্দরের ভূমিকা ও অবস্থান কোথায়।
হিন্টারল্যান্ডের সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরীণ নৌপথ, সড়কপথ ও রেলপথÑতিন মাধ্যমেই সংযোগ রয়েছে। বন্দরটি কেবল স্থানীয় পণ্য পরিবহনের সেবাই দিচ্ছে না; আঞ্চলিক দেশগুলোকেও সেবা দিচ্ছে। ভবিষ্যতে চীনের ল্যান্ডলক ইউনান প্রদেশকে সেবা দিতেও সক্ষম হবে। একই সাথে আমাদের পূর্বদিকের প্রতিবেশী মিয়ানমারকেও সেবা দিতে পারবে।
বে টার্মিনাল নির্মিত হলে ১২ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ৪,০০০-৫,০০০ টিইইউ কনটেইনার নিয়ে বন্দরে ভিড়তে পারবে। এতে পরিবহন ব্যয় কমে আসবে। আর মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রস্তুত হয়ে গেলে ৮ হাজার টিইইউ পণ্য নিয়ে ১৮ মিটার ড্রাফটের জাহাজ সরাসরি এখানে আসতে পারবে। এর ফলে পরিবহন খরচ প্রায় এক-তৃতীয়াংশে নেমে আসবে। অর্থাৎ জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন সুযোগ এনে দেবে। একই সাথে পুরো উপমহাদেশ ও বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে এই বন্দর।
বিশেষ করে রিজিওয়াল কমপ্রিহেন্সিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি), ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (ইপিএ) এবং ইইউ এর সাথে ফি ট্রেড এগ্রিমেন্ট আগামী ২০২৬/২৭ এর মধ্যেই সম্পন্ন হবে। তাছাড়া এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় হাই-অ্যান্ড প্রোডাক্টের ওপর বাংলাদেশকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য বন্দর আমদানি-রপ্তানির পাশাপাশি এফডিআই, কর্মসংস্থান ও দেশের অর্থনীতিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।

এমন একসময় এই দায়িত্ব নিয়েছেন যখন সবকিছুর মতো বন্দরেও এক ধরনের অচলাবস্থা চলছিল। দায়িত্ব গ্রহণের অল্প দিনের মধ্যেই বন্দরকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছেন। কীভাবে এটা সম্ভব হলো?

এস. এম. মনিরুজ্জামান: ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ৫ আগস্ট বিগত সরকারের যখন পতন হয় পুরো দেশে তখন অস্থির পরিস্থিতি। সব প্রতিষ্ঠান বলতে গেলে অচল হয়ে পড়ে। ভেঙে পড়ে সব সিস্টেম। ঠিক সেই মুহূর্তে ১১ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান হিসেবে আমাকে দায়িত্ব দেয় সরকার। এ রকম একটি অস্থির সময়ে দায়িত্ব নিয়েই আমাকে দুটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, যা মোকাবিলা করা মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। একটি ছিল বন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কারণ, সে সময় দেশে পুলিশ বাহিনী সক্রিয় ছিল না। বন্দরে পর্যাপ্ত শ্রমিক ছিল না। বন্দর পাহারায় যেসব আনসার ছিল, পরবর্তী সময়ে অন্যান্য আনসারদের সাথে তারাও বিদ্রোহ করেছে। এর মধ্যে বন্দরের স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন মহল নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সেসব ম্যানেজ করে বন্দরের অভ্যন্তরে নাশকতা ও চুরি ঠেকানোর চেষ্টা করেছি। তা না হলে বন্দর লুটপাট হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। নৌবাহিনী, সেনাবাহিনী, কোস্ট গার্ড, গোয়েন্দা সংস্থা, বিজিবিসহ যৌথ বাহিনীর সদস্যদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বন্দরের সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি ছিল বন্দরের অপারেশন সচল রাখা। জুলাইয়ের গণ-আন্দোলন, ইন্টারনেট সংক্রান্ত সমস্যা এবং আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির কারণে বন্দরের অপারেশন প্রায় ১ মাস বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। এ সময় কার্যত কোনো পণ্য পরিবহন হয়নি। তাছাড়া জাহাজের ওয়েটিং টাইম বেড়ে যায় এবং পণ্য খালাস করতে দেরি হয়। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় প্রায় পঞ্চাশ হাজার কনটেইনার জমা হয়ে যায়। বন্দরের স্বাভাবিক অপারেশন এবং তার সাথে বাড়তি কনটেইনার হ্যান্ডেল করে স্বাভাবিক পর্যায় নিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়ে। তখন মনে হচ্ছিল এই জট ছাড়িয়ে বন্দরের কার্যক্রমের গতি স্বাভাবিক করতে হয়তো বছর পার হয়ে যাবে। কিছু উদ্ভাবনীমূলক কাজের মাধ্যমে সেই দীর্ঘজট ছাড়িয়ে মাত্র দুই-তিন মাসের মধ্যে বন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক গতিতে নিয়ে আসতে পারাটা বড় রকমের অর্জন। এই অর্জনের পেছনে এনবিআর, জেলা প্রশাসন, রেলওয়ে আর বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরের সকল স্তরের কর্মকর্তা, কর্মচারী, শ্রমিকসহ সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সম্মিলিত শক্তিটা কাজে লাগানো সম্ভব হয়েছে বলেই অল্প সময়ে এই সফলতা এসেছে।

জুলাই অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা পূরণের চাপও রয়েছে। সেটা হলো সব ধরনের বৈষম্য দূর করে বন্দরকে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া। এই আকাক্সক্ষা পূরণ এখন পর্যন্ত কতটা সম্ভব হলো?

এস. এম. মনিরুজ্জামান: জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের যে আকাক্সক্ষা তার প্রতিফলন চট্টগ্রাম বন্দরের সব কার্যক্রমেই দেখতে পাবেন। বন্দরে আগত জাহাজ একদিনেই বার্থিং সুবিধা পাচ্ছে। বর্তমানে গিয়ারলেস এবং গিয়ারড ভেসেল সমন্বয় করে শতভাগ জেটি বা বার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে, যাতে যেকোনো জাহাজ এলে সহজে ভিড়তে পারে। এখন আমরা আমদানিকারকদের সিসি এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতার জাহাজ আনতে উদ্বুদ্ধ করছি। ফলে বড় জাহাজে অনেক বেশি কার্গো আসে। এজন্য জাহাজের সংখ্যা কমছে, ক্যাপাসিটি বেড়েছে, খরচ কমেছে এবং ব্যবস্থাপনায় পেয়েছে গতি। আন্তরিক প্রচেষ্টায় আমরা বন্দর অপারেশন সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম প্রায় শতভাগ শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে পেরেছি। ভেতরে অনেক কনটেইনার দীর্ঘদিন পড়ে ছিল, সেগুলো অপসারণ করা হয়েছে। চারটি ট্যাংকারে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল দাহ্য পদার্থ আইনি জটিলতায় দীর্ঘদিন পড়ে ছিল, যেগুলো যেকোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারত। এটা দ্রুততম সময়ে সরিয়ে ফেলি এবং সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ে এটা নিলামের ব্যবস্থা করি। ফলে সরকার রাজস্ব পেয়েছে। বন্দর এখন বিপজ্জনক কার্গো থেকে ঝুঁকিমুক্ত। ১২০টি রিফার কনটেইনার প্রায় ৯ মাস ধরে প্লাগ-ইন ছিল। এগুলোর মাধ্যমে মাংস এবং ফলমূল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন পড়ে থাকার ফলে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এগুলো ডিসপোজ করা কঠিন। পাশাপাশি পরিবেশের ছাড়পত্রের ব্যাপার ছিল। জেলা প্রশাসনের সহায়তায় সেগুলো ডিসপোজ করি। এজন্য বিদেশে মেইন লাইন অপারেটররা আমাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন। যে কাজ বিগত ১০-১৫ বছরে হয়নি, সেটা আমরা ৩-৪ মাসের মধ্যে করতে পেরেছি, যা আন্তর্জাতিক পরিম-লে প্রশংসিত হয়েছে। কনটেইনার অপসারণের ফলে বন্দরের ভেতরে জায়গা বেড়েছে। আগে কনটেইনার রাখার জন্য জায়গার সংকুলান হতো না। তাই এফিসিয়েন্সি অনেক কমে যেত। এখন সমন্বয়ের ফলে শৃঙ্খলা ফিরেছে, হ্যান্ডলিংয়ে গতি বেড়েছে। রমজানকে কেন্দ্র করে বহির্নোঙরে লাইটার জাহাজে পণ্য মজুদ করে ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হতো। তাই আমরা আইএসপিএস কোডের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পণ্য বোঝাইয়ের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এসব লাইটার জাহাজকে বহির্নোঙর ত্যাগ করতে বলেছি এবং এটি বাস্তবায়নে নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডসহ বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায় নিয়মিত মনিটরিং করেছি। ফলে বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্থিতিশীল ছিল।

চট্টগ্রাম বন্দরে গত ১৬-১৭ বছরে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল। বন্দর ব্যবসায় তাদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল। এতে বঞ্চিত হতেন অন্যরা। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে কতটা সফল হয়েছেন?

এস. এম. মনিরুজ্জামান: গত সরকারের আমলে বন্দর নানা সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি ছিল। কখনো কখনো এসব সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রতিযোগিতাহীন দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে। কখনো আবার সরাসরি দরপত্র পদ্ধতিতে কাজ দেওয়া হয়েছে। প্রতিযোগিতা না থাকায় বন্দরে কনটেইনার ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন সেবা এবং যন্ত্রপাতি ক্রয়, মেরামত ও সংরক্ষণ ব্যয় বেড়ে গেছে। বাড়তি এ ব্যয় পণ্যের দামের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে সাধারণ মানুষের ওপর পড়েছে। দায়িত্ব গ্রহণের পরই এই সিন্ডিকেট ভাঙার উদ্যোগ নিয়েছি এবং তাতে আমরা সফলও হয়েছি। সিন্ডিকেট প্রথা বিলুপ্তির ফলে বন্দরের পরিবহন খরচ ২৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যার সুফল ইতিমধ্যে বন্দর ব্যবহারকারীরা পেতে শুরু করেছেন।
এ ছাড়া নিয়ম না মেনে অনেক লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল, যেগুলোর ব্যাপারে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। বিগত সরকারের আমলে বন্দরের বহির্নোঙরে বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে পণ্য স্থানান্তর কাজের জন্য ২৩টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। যাচাই-বাছাই করে সেগুলো এসব লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।
বন্দরে সব দরপত্র উন্মুক্ত পদ্ধতিতে এবং ই-টেন্ডারিংয়ের মাধ্যমে হচ্ছে। ৫ আগস্টের পর বন্দরে স্বচ্ছতা আনার যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, সেটি আমরা হারাতে চাই না। সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতি, অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরে সব ধরনের সিন্ডিকেট, মনোপলি ভেঙে ব্যবসার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার কার্যক্রম জোরদার করা হচ্ছে। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে বন্দরকে একটি দুর্নীতিমুক্ত, ব্যবসায়ীবান্ধব ও প্রতিযোগিতামূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করাই আমার লক্ষ্য।

করাচি-চট্টগ্রাম বন্দর সরাসরি রুট চালু হয়েছে। এই রুটের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?
এস. এম. মনিরুজ্জামান: পাকিস্তান থেকে আগে সিঙ্গাপুর এবং কলম্বো বন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশের পণ্য আমদানি-রপ্তানি হতো। গত ১১ নভেম্বর একটি কনটেইনারবাহী জাহাজ আমদানি পণ্য নিয়ে দুবাইয়ের জেবল আলি বন্দর থেকে পাকিস্তানের করাচি বন্দর হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে। নতুন এই রুট চালুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এতে আমদানি-রপ্তানি ব্যয় ও সময় দুটোই কমে আসবে। দুই দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য আরও গতিশীল হবে। আমদানি পণ্যের পর্যাপ্ত কনটেইনার পাওয়া গেলে ভবিষ্যতে এই রুটে নিয়মিত জাহাজ পরিচালনা করতে জাহাজমালিকরা আগ্রহী হবেন।

বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের ব্যাপারে আপনার ভাবনা কী?
এস. এম. মনিরুজ্জামান: দেশে বিনিয়োগের জন্য বন্দর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগকে আমরা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছি। কারণ, এর মাধ্যমে বিদেশ থেকে কেবল বিনিয়োগই আসে না; দক্ষতা ও প্রযুক্তি ট্রান্সফারেরও একটি সুযোগ তৈরি হয়। একই সাথে নতুন নতুন রুট তৈরির পাশাপাশি বিদেশি জাহাজ, এমএলও ও বিনিয়োগকারীগণ প্রতিযোগিতায় আগ্রহী হবেন।
বে টার্মিনালে বিদেশি প্রতিষ্ঠান পিএসএ সিঙ্গাপুর ও ডিপি ওয়ার্ল্ডের দুটি কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করবে। দুই প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ হবে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার। তাদের বিনিয়োগের প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। আর চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণের পরিকল্পনাধীন মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে আবুধাবি পোর্টস গ্রুপ, যেখানে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে চায় তারা। এ ছাড়া বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সাথে গ্যাস ও তেল খালাসের টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার প্রস্তাব দিয়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান ইস্ট কোস্ট গ্রুপ। তারা ৩৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে চায়।
এ ছাড়া পতেঙ্গায় লালদিয়ার চরে লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনালে বিনিয়োগ ও পরিচালনার জন্য ডেনমার্কের এপি-মুলার মেয়ার্স্কের (এপিএম) সাথে চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগে চট্টগ্রাম বন্দরের এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বন্দরের সক্ষমতা ও দক্ষতা অনেক বেড়ে যাবে। পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আমদানি-রপ্তানির বর্ধিত চাহিদা পূরণ করে অর্থনীতিতে আরও বেশি অবদান রাখতে পারবে। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের বিষয়ে ইতিমধ্যেই জাইকার সাথে চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে।
একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে আমরা একা চলতে পারব না। একা হয়তো চলা যাবে, কিন্তু অথনৈতিক সক্ষমতা বাড়বে না, আশানুরূপ উন্নতি করা যাবে না। সুতরাং, বন্দরের ধারাবাহিক উন্নতির জন্য বিদেশি বিনিয়োগ ও অংশীজনদের অন্তর্ভুক্তি লাগবে।

বে টার্মিনালের কাজ কবে নাগাদ শুরু হচ্ছে?

এস. এম. মনিরুজ্জামান: প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার বে টার্মিনাল মেরিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট অনুমোদনের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পেয়েছে। এখন বিশ^ব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি সই হবে। এর মাধ্যমে প্রকল্পের মাঠপর্যায়ের কাজ শুরু হওয়ার পথ তৈরি হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান টার্মিনাল এলাকাগুলোর মধ্যে এটি হবে সবচেয়ে বড়। বন্দর জলসীমার শেষ প্রান্তে চট্টগ্রাম ইপিজেডের পেছনের সাগরপাড় থেকে শুরু হবে বে টার্মিনাল প্রকল্পের সীমানা, যা গিয়ে শেষ হবে বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান ক্রিকেট স্টেডিয়ামের অদূরে রাসমণি ঘাটে। বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা প্রকল্প এলাকাটি প্রায় ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার লম্বা।
বে টার্মিনাল প্রকল্প দেশের অর্থনীতির জন্য একটি গেম চেঞ্জার। এই প্রকল্পের জন্য রেলপথ, সড়কপথ এবং নদী যোগাযোগব্যবস্থা নতুন করে নির্মাণের প্রয়োজন নেই। কারণ, সেগুলো ইতিমধ্যেই বিদ্যমান রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম বন্দরের হান্ডলিং ক্ষমতা প্রায় ৩ গুণ বৃদ্ধি পাবে এবং চট্টগ্রাম শহর যানজট মুক্ত হবে।

মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের অগ্রগতি কতদূর? সমুদ্র বাণিজ্যে এই বন্দর কী ভূমিকা রাখবে?

এস. এম. মনিরুজ্জামান: মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর শুরু করতে এতদিন ধরে যে অপেক্ষা, তার অবসান হচ্ছে। জাপানের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘পেন্টা ওশান লিমিটেড’ এবং ‘টিওএ কর্পোরেশন’-এর সাথে চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। শিগগিরই ২৪ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হবে।
বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দরের যে অভাব ছিল মাতারবাড়ীর মাধ্যমে তা পুরোপুরি পূরণ হবে। বন্দরটি নির্মিত হলে ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টিইইউর ১৪ মিটার ড্রাফটের জাহাজ এখানে ভিড়তে পারবে। এতে করে আমদানি-রপ্তানির সময় ও ব্যয় দুটোই কমে আসবে। কারণ, বড় জাহাজ ভেড়ার অর্থই হলো পণ্য পরিবহনের সময় ও খরচ কমে যাওয়া। দেশে আমদানি পণ্যের সিংহভাগই যেহেতু চীন থেকে আসে এবং আমদানি পণ্যবাহী বড় জাহাজ সরাসরি মাতারবাড়ীতে ভিড়বে তাই আমদানিকারকরা আরও বেশি উৎসাহিত হবেন। এ ছাড়া মাতারবাড়ী থেকে ফিডার ভেসেল চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে যেতে পারবে। অর্থাৎ ফিডার ভেসেলের নতুন রুট তৈরির সুযোগ তৈরি হবে। এ ছাড়া জোয়ার-ভাটার প্রভাব না থাকায় চ্যানেলটিতে ২৪ ঘণ্টাই জাহাজ ভেড়ানো যাবে।
এ ছাড়া মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে আমাদের প্রতিবেশী দেশসমূহও এ বন্দর ব্যবহার করতে পারবে, যা ‘আঞ্চলিক হাব পোর্ট’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।

পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনালের প্রতি ব্যবসায়ীদের আগ্রহ বাড়াতে কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?

এস. এম. মনিরুজ্জামান: পানগাঁও ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনালের হ্যান্ডলিং বৃদ্ধি ও টার্মিনালের অপারেশনাল কার্যক্রম গতিশীল করতে ছয়টি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগের অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম-পানগাঁও-চট্টগ্রাম রুটে জাহাজের ভাড়া প্রতিযোগিতামূলক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে অতিরিক্তি আরেকটি জেটি পানগাঁওগামী জাহাজের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই অগ্রাধিকারের ফলে আগের চেয়ে দ্বিগুণ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম-পানগাঁও-চট্টগ্রাম নৌরুটে নিবন্ধিত জাহাজগুলো নিয়মিত চলাচলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক কনটেইনার অপারটেরসহ অন্যান্য শিপিং লাইনগুলো নদীপথে কনটেইনার পরিবহনের জন্য পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল ব্যবহারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি আমদানি পণ্যের কনটেইনারের গন্তব্য পানগাঁও টার্মিনালের নাম উল্লেখ করে ইমপোর্ট জেনারেল মেনিফেস্ট, বিল অব ল্যাডিং এবং এলসি খুলতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। পণ্য শুল্কায়নে কাস্টমসের জটিলতা নিরসন করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ফলে জটিলতা ছাড়াই পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনালে শুল্কায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করার ব্যবস্থা থাকছে।
আশা করছি এসব উদ্যোগের ফলে পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনাল ব্যবহারে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আগ্রহ বাড়বে। এতে সড়ক ও রেলের ওপর চাপ কমবে। নৌপথে পণ্য পরিবহনের ফলে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য আমদানি-রপ্তানির পথ সুগম হবে।

দায়িত্ব গ্রহণের পর আপনাকে একদিকে বন্দরে অনিয়ম, দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হয়েছে, অন্যদিকে অপারেশনাল কার্যক্রম গতিশীল রাখার চ্যালেঞ্জও ছিল। অপারেশনাল কার্যক্রমের গতি কতটা বৃদ্ধি করতে পেরেছেন?

এস. এম. মনিরুজ্জামান: নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। দায়িত্ব নেওয়ার পর গত চার মাসে বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছি। তার ফলও পাওয়া গেছে। ২০২৪ সালে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ৭.৪২% ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে ৩.১১% প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে। আমরা যেটাকে ১২ মাসের অর্জন বলছি, সেটি মূলত ১১ মাসের। কারণ, ছাত্র-জনতার আন্দোলন, বন্যা ও সাতদিন ইন্টারনেট ছিল না। সেসব হিসাবে নিলে কাজ হয়েছে ১১ মাস। এক বছরের হলে আরও বেশি হতো।
বন্দরের এই অগ্রগতির পেছনে ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বন্দরের ভেতরে শৃঙ্খলা আছে, কোনো যানজট নেই। এর বাইরে আমরা জাহাজের ব্যবস্থাপনাও করেছি। গিয়ারলেস ও গিয়ারড ভ্যাসেল ব্যবস্থাপনা করে শতভাগ বার্থ ব্যবহার করে কার্গো হ্যান্ডলিং করা হয়েছে। বন্দরের ভেতরে জায়গা বেড়েছে। এজন্য হ্যান্ডলিং দ্রুত হয়েছে।
কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে বন্দরের রাজস্বে। গেল বছর বন্দর কর্তৃপক্ষের রাজস্ব আয়ে ২১.৩৯% প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ ছাড়া সেবার মান অক্ষুণœ রেখে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনার ফলে রাজস্ব উদ্বৃত্তও বেড়েছে।
গত বছরের আগস্ট মাসে জাহাজের অপেক্ষমাণ সময় ছয় থেকে আটদিন পর্যন্ত ছিল, সেটা আমরা একদিনে নামিয়ে আনতে পেরেছি। জাহাজ সরাসরি বন্দরে চলে আসতে পারছে, যা বন্দরের ইতিহাসে আগে কখনো হয়নি।

দায়িত্ব গ্রহণের আট মাস হয়েছে। সময়টা খুব বেশি নয়। এই স্বল্প সময়েও বন্দরের কার্যক্রমে গতিশীলতা বাড়াতে গৃহীত আপনার পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে জানতে চাই।

এস. এম. মনিরুজ্জামান: দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করতে নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছি। বন্দরে আমদানি ও রপ্তানি পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলের জন্য অনলাইনে গেইট পাস চালু করেছি। এর ফলে বন্দরে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় পণ্য ও কনটেইনারবাহী যানবাহনগুলোকে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না। এতে সময় সাশ্রয় হওয়ার পাশাপাশি সড়কে যানজট কমবে এবং বন্দরের কাজে গতিশীলতা আসবে। এ ছাড়া বন্দরের ভেতরের নিরাপত্তাও আরও জোরদার হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরে আসা কেমিক্যাল আইএমডিজি কোড অনুযায়ী সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বন্দর ১ নং জেটি গেইট সংলগ্ন জায়গায় ২৩ হাজার বর্গফুট ফ্লোর এরিয়াবিশিষ্ট দ্বিতল আধুনিক কেমিক্যাল শেড নির্মাণ করা হয়েছে। শেডটিতে আধুনিক ফায়ার ফাইটিং সিস্টেমসহ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ক্লাসিফিকেশন অনুযায়ী আলাদাভাবে কেমিক্যাল সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে।
বন্দরে নিলামযোগ্য পণ্যের জট দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা। যথাসময়ে নিলাম অনুষ্ঠিত না হওয়ায় একদিকে সরকার প্রাপ্য রাজস্ব থেকে যেমন বঞ্চিত হচ্ছে; অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা কনটেইনারের কারণে বন্দরে স্থান সংকট তৈরি হচ্ছে। নিলামযোগ্য পণ্যের এই জট কমাতে কাস্টমসের সহায়তায় বন্দরের অভ্যন্তরে রক্ষিত অনেক দিনের পুরনো গাড়ির অকশন দ্রুত শেষ করা হচ্ছে। এ ছাড়া কাস্টমস গোলায় রক্ষিত দীর্ঘদিনের পুরনো স্ক্র্যাপ সরবরাহ ও নিলাম করা সম্ভব হচ্ছে। এতে বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা খালি হয়ে যাওয়ায় বন্দরের রাজস্ব আদায়ের পথ সুগম হয়েছে। যাবতীয় নিলাম কার্যক্রম দ্রুততার সাথে শেষ করতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মহোদয় ও এনবিআর চেয়ারম্যানের নির্দেশ অনুযায়ী ইতিমধ্যে প্রায় ১০০ জন কাস্টমস কর্মকর্তাকে মালামাল ইনভেন্ট্রি ও ডেলিভারি কাজে নিয়োগ করা হয়েছে।
স্টোর রেন্টস্বল্পতার সুযোগ নিয়ে আমদানিকারক অনেক সময় কনটেইনার ডেলিভারি নিতে বিলম্ব করেন। এতে কনটেইনার জট তৈরি হয়। কনটেইনার জট কমাতে ও বন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে স্টোর রেন্ট যৌক্তিকীকরণ করা হচ্ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় মেরিটাইম তথ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ ও মেরিটাইম সংক্রান্ত সিঙ্গেল উইন্ডো খ্যাত আইওআরআইএস প্ল্যাটফর্ম চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের নৌ নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও আধুনিক ও কার্যকর হবে।

আর কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন, যেগুলো বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে?

এস. এম. মনিরুজ্জামান: দেশে হেভি লিফট কার্গো (ভারী পণ্য) আমদানির পরিমাণ বাড়লেও এসব কার্গো খালাসে ডেডিকেটেড জেটি নেই। বন্দরের প্রডাক্টিভিটি বাড়ানোর স্বার্থেই স্বয়ংসম্পূর্ণ হেভি লিফট কার্গো জেটি থাকা জরুরি এবং এই জেটি আমরা করতে চাই। সে লক্ষ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বিশেষায়িত হেভি লিফট জেটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন করার জন্য লালদিয়া-২ এলাকাকে হেভি লিফট জেটির জন্য নির্ধারণ করা হয়। প্রকল্পের স্থান পরিবর্তন হওয়ায় ডিপিপি সংশোধন হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে জেটি নির্মাণ কাজ শুরু হবে।
আমদানি/রপ্তানিসহ খালি কনটেইনার সংরক্ষণ, আন্তঃদেশীয় ট্রানজিট, কনটেইনার হ্যান্ডলিং ও সংরক্ষণ, মালামাল স্টাফিং ও আনস্টাফিং সেবাটি সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে এক্স ওয়াই শেড এলাকায় পরিপূর্ণ অফডক নির্মাণের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এফ শেড এবং পাশর্^বর্তী এলাকা সম্পূর্ণ রেনোভেট করে কর্ণফুলী এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনকে তাদের তৈরিকৃত পণ্য রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণের জন্য হস্তান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অফডকসমূহের বিভিন কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতকরণের জন্য বন্দরের মনিটরিং কমিটি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং নতুন অফডক নির্মাণের জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে।
বন্দরের অটোমেশন কার্যক্রম দ্রুততার সাথে করার লক্ষ্যে দ্রুতগতির ইন্টারনেটের প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে বন্দরে ফাইভ জি কার্যক্রম চালুর সার্ভে করা হচ্ছে। শিগগিরই ফাইভ জি চালু হবে।
পণ্যবাহী গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে রাস্তায় যাতে যানজট সৃষ্টি না হয় সেজন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ লালদিয়াতে একটি ও বে টার্মিনালে ৪টি টার্মিনাল নির্মাণ করছে। এই টার্মিনাল চালু হলে প্রায় পাঁচ হাজার যানবাহন পার্কিং করা সম্ভব হবে। এতে রাস্তার যানজট উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে।
বন্দরের আইন ও বিধিবিধানসমূহ যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ যথাযথ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এই আইনের আলোকে বন্দরের কর্মচারী প্রবিধানমালা হালনাগাদ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামে একটি ফ্রি ট্রেড জোন প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। যা বাস্তবায়ন হলে দেশে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে, যার সুফল জনগণ পাবে।
বাংলাদেশের প্রকৃত আমদানি রপ্তানি সম্ভাব্যতা যাচাই বাছাই করে বন্দরের টার্মিনালের প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণের লক্ষ্যে সরকার ‘ন্যাশনাল মেরিটাইম পোর্ট স্ট্র্যাটেজি’ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। দ্রুততম সময়ে ডকুমেন্টেশন সম্পন্ন করার লক্ষ্যে আগামী জুনে চালু হবে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার।

বিগত সময়ে বৈষম্যের শিকার হয়ে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীই দীর্ঘদিন পদোন্নতি বঞ্চিত ছিলেন। এই বৈষম্য দূরীকরণে কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?

এস. এম. মনিরুজ্জামান: দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই এই বৈষম্য দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ করি। তারই অংশ হিসেবে ১১ আগস্ট পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত ৭৮ ক্যাটাগরিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষে মোট ৬৪৬টি শূন্য পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১২ ক্যাটাগরির ১৯টি শূন্য পদে কর্মকর্তা এবং ৬৬ ক্যাটাগরির মোট ৬২৭টি শূন্য পদে কর্মচারীদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এক সাথে এত বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পদোন্নতি দেওয়ার ঘটনা বন্দরের দীর্ঘ ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি।

বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কল্যাণে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?

এস. এম. মনিরুজ্জামান: চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে বন্দর হাসপাতালের আধুনিকায়ন ও সেবা প্রদানের কলেবর বৃদ্ধির লক্ষ্যে উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গৃহ নির্মাণের জন্য হাউজিং স্কিম ঋণ নীতিমালা করা হচ্ছে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বড় পদক্ষেপ হিসেবে কর্মকর্তাদের গাড়ি ক্রয়ে সুদমুক্ত ঋণসুবিধা দেওয়ার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পোষ্যরা যাতে প্রচলিত সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়তে পারে, সে উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। এছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পোষ্যগণ যাতে বিভিন্ন খেলাধুলায় অংশগ্রহণের জন্য স্টেডিয়াম, স্পোর্টস কমপ্লেক্স, সুইমিং কমপ্লেক্সসহ সকল সুবিধাদি ব্যবহার করে নিয়মিত প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে, সে বিষয়ে কার্যক্রম ও নীতিমালা অনুমোদন করা হয়েছে। এ ছাড়া খেলাধুলা ও বিনোদনের সুবিধার্থে মাঠ তৈরি ও সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে এবং আধুনিক টার্ফ তৈরি করা হচ্ছে।
শ্রমিকদের কল্যাণেও নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক শ্রমিককে ৯ হাজার টাকা করে বিশেষ উৎসাহ বোনাস দেওয়া হয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের ওয়ারিশদের মধ্যে থেকে যাচাই-বাছাই করে ৪৪৩ জনকে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মরত শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরিপ্রাপ্তি, চিকিৎসাসেবা, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সামগ্রী প্রদানসহ শ্রমিকদের অন্যান্য সকল মৌলিক সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিয়মিতভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। নিয়মিত মনিটরিংয়ের ফলে জেটিতে শ্রমদুর্ঘটনা হ্রাস পেয়ে প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে। শ্রমিকদের কল্যাণমূলক কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে এবং শ্রমিকদের যাবতীয় সুযোগে-সুবিধা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ডিজিটাল ডেটাবেইজ প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

বন্দরের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চালাতে অনেকগুলো অংশীজনের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন হয়। বন্দর এবং অংশীজনদের মধ্যে সমন্বয়ের কাজটি কীভাবে করছেন?

বন্দর তখনই সর্বোচ্চ সেবাটি দিতে পারে যখন তার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি অংশীজন তাদের দায়িত্বটুকু সময়মতো ও সঠিকভাবে পালন করে। আমদানিকারকরা সময়মতো কনটেইনার ডেলিভারি না নিলে বন্দরে জট তৈরি হয়। সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে বন্দর কর্তৃপক্ষ, কাস্টম অফিস, বিএসটিআই, কোয়ারেন্টাইন অধিদপ্তর, ব্যাংক, বার্থ অপারেটর, টার্মিনাল অপারেটর ও শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এবং পরিবহনসহ অন্যান্য অংশীজনের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো জরুরি। পাশাপাশি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বন্দর জনশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধি ও কার্যক্রমে গতিশীলতা আনাও দরকার। সে লক্ষ্যে কাজ করছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে আপনার ভিশন কী?

এস. এম. মনিরুজ্জামান: মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার দিকনির্দেশনায়, নৌপরিবহন উপদেষ্টার নেতৃত্বে এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সার্বিক সহযোগিতায় চট্টগ্রাম বন্দরকে গতিশীল, আধুনিক, জবাবদিহি ও কল্যাণমূলক এবং অধিক ব্যবহারবান্ধব করে তোলাই আমার লক্ষ্য। সে লক্ষ্যেই সব কার্যক্রম পরিচালনা করছি। এজন্য যেসব ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন, সেগুলো করা হচ্ছে।
জুলাই পরবর্তী চট্টগ্রাম বন্দরে ইতিবাচক যেসব পরিবর্তন দেখছেন তার সবই অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে, অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে হয়েছে। বন্দর দেশের সম্পদ। এই বন্দরকে জনবান্ধব করতে চাই, যাতে সকলে বন্দরকে সমানভাবে ব্যবহার করতে পারে; এর সুফল পায়। এজন্য কাজ করতে হবে স্বচ্ছতা, ন্যায় ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে। এটা শতভাগ বাস্তবায়ন করতে পারলেই জনগণ ভালো থাকবে।

বন্দরবার্তাকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ

এস. এম. মনিরুজ্জামান: বন্দরবার্তাকেও ধন্যবাদ। শুরু থেকেই আপনারা বন্দরবার্তাকে একটি সময়োপযোগী ও মানসম্মত কনটেন্টসমৃদ্ধ প্রকাশনা হিসেবে এগিয়ে নিয়েছেন। প্রকাশের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বন্দরবার্তা বাংলাদেশের মেরিটাইম খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলেই আমার বিশ^াস।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here