
কোবে থেকে বঙ্গোপসাগর
এ বছর ৭-১০ অক্টোবর আমি জাপানের কোবে শহরে আন্তর্জাতিক বন্দর ও হারবার সমিতি (আইএপিএইচ) আয়োজিত বিশ^ বন্দর সম্মেলনে যোগদান করি। এতে অংশগ্রহণের পেছনে প্রথম থেকেই সুস্পষ্ট দুটি লক্ষ্য ছিল আমার- এক. সংলাপকে অংশীদারিত্বে রূপান্তর করা এবং দুই. বাংলাদেশের সমুদ্রখাতকে তার পরবর্তী অভিযাত্রার লক্ষ্যে উপযুক্ত সক্ষমতায় প্রস্তুত করা। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রতিটি বন্দর কর্তৃপক্ষ কোবে সম্মেলনে হাজিরা দেন। এরাই বস্তুত বৈশি^ক নৌপরিবহন নীতিমালা নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিয়ামক শক্তি হিসেবে পরিগণিত। চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য একটি শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সমুদ্রখাতের এ বিশ^সভায় অংশ নেয়াটা বস্তুত আমাদের জন্যও ছিল এক অনন্য সুযোগ।
বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে এ সম্মেলনে অংশ নিতে পারাটা ব্যক্তিগতভাবে আমার নিজের জন্যও ছিল বিশেষভাবে সম্মানজনক; আর সেটিও কিনা এমন এক সময়ে- যখন দেশের সমুদ্রখাতের উন্নয়নে অভ‚তপূর্ব গুরুত্ব প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন অন্তবর্তী সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর প্রশাসন এ সত্য যথার্থই উপলব্ধি করেছে যে বঙ্গোপসাগর আজ শুধু আমাদের কৌশলগত সীমান্তই নয়, বরং সেটি বাংলাদেশের আগামী প্রবৃদ্ধিরও মূলভিত্তি বটে। চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং এর লজিস্টিক্স আধুনিকীকরণের প্রতি সরকারের নিবিড় অঙ্গীকার মূলত বৃহত্তর জাতীয় আকাক্সক্ষারই প্রতিফলন, যে আকাক্সক্ষার সারমর্ম: সমুদ্রখাতের দক্ষতাকে দেশের অর্থনৈতিক নবায়নের ভরকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
বৈশ্বিক বাণিজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযোগ প্রতিষ্ঠা
সম্মেলনের এক অবকাশে হামবুর্গ বন্দর কর্তৃপক্ষের শীর্ষ নির্বাহী ইয়েন্স মেয়ার এবং জাপানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠককালে আমি ইউরোপ ও জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি নৌ-রুট চালুর প্রস্তাব তুলে ধরি। রুটগুলি চালু করা গেলে জাহাজের ট্রানজিট টাইম কমবে, ব্যয়ভার হ্রাস পাবে; ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তামুখী এক বাজারে রপ্তানিকারকদের জন্য একটি ন্যূনতম নির্ভরযোগ্য শিডিউল নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। ইয়েন্স মেয়ার এ ব্যাপারে আন্তরিক সহযোগিতার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বলেন, প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি জার্মান ট্রেড প্রোমোশন কাউন্সিলের সহায়তা নিয়ে উভয় বন্দরের মধ্যে একটি টেকসই ‘এন্ড-টু-এন্ড’ লজিস্টিক্স ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন। এছাড়া, জাপানের সাথে সরাসরি নৌ-যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শুরু থেকেই এর বাণিজ্যিক সম্ভাব্যতা নিশ্চিতের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন জাপানি কর্তৃপক্ষ।
সম্মেলনে আইএপিএইচ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. প্যাট্রিক ভারহোভেনের সঙ্গেও আমার একদফা সাক্ষাত ঘটে। এ সময় আমরা চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন অগ্রাধিকার ও তার ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক প্রভাব সম্পর্কে মত-বিনিময় করি। আমাদের আলোচনার মধ্য দিয়েই আমার কাছে এটি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বৈশি^ক সমুদ্রখাত পরিচালনার ক্ষেত্রে বর্তমানে কেবল একজন অনুসারী হিসেবে নয়, বরং বাংলাদেশকে একটি গঠনমূলক কণ্ঠস্বর হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
কেন জরুরি ছিল কোবে ২০২৫
এমন এক সময়ে এসে এই কোবে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো যখন বৈশি^ক বাণিজ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ অতিক্রম করছে। সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনে আলোচ্যসূচির মধ্যেও তার প্রতিফলন দেখা গেছে- ভ‚রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, জ্বালানি রূপান্তর ও ডিজিটাল বিপর্যয়ের বর্তমান সময়ে বন্দরগুলো কোন প্রক্রিয়ায় নিজেদের অভিযোজিত করে নেবে। চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য শিক্ষাগুলি ছিল অত্যন্ত সময়ানুগ এবং অতীব প্রাসঙ্গিক।
প্রথমত, বাণিজ্যিক অস্থিরতা এ সময়ে বিশ^জুড়েই এক কাঠামোগত বাস্তবতা। সুতরাং পরিকল্পনার শুরু থেকেই তার মধ্যে নমনীয়তার প্রশ্নটিকে জায়গা করে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, নৌপরিবহন খাতে গোটা বিশ^ই বর্তমানে অত্যন্ত দ্রæতগতিতে ডিকার্বনাইজেশনের পথে হাঁটতে শুরু করেছে এবং আগামী দিনের বিনিয়োগ প্রসঙ্গটিও বহুলাংশে নির্ভর করবে এটার ওপর। তৃতীয়ত, দ্রæততম সময়ে সাইবার সহনশীলতা (রেজিলেন্স) নিশ্চিত করাটা আমাদের জাতীয় অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্যই অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। সম্মেলনে আলোচিত এসব প্রতিটি প্রসঙ্গ চট্টগ্রাম বন্দরের সংস্কার কার্যক্রমের মধ্যে সরাসরি প্রতিফলিত রয়েছে এবং এর আলোকেই নৌবিশে^ পরবর্তী অভিযাত্রার লক্ষ্যে নিজেদের প্রস্তুত করে নিচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর।
দক্ষতার মাধ্যমে উত্থান
দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে চলমান অগ্রগতির ছাপ ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান। চট্টগ্রাম বন্দরে রেকর্ডসংখ্যক কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সাফল্য প্রমাণ করছে বাংলাদেশের শিল্পখাতের বুনিয়াদ সম্প্রসারিত হবার সুবাদে বর্তমানে রপ্তানি ও আমদানি উভয় খাতেই আমাদের প্রবৃদ্ধি ঘটছে। প্রত্যেক মাসে আমরা পূর্বেকার থ্রুপুট রেকর্ড ভেঙে এগিয়ে চলেছি। এতে আরো প্রমাণ হচ্ছে যে বাংলাদেশের লজিস্টিক্স নেটওয়ার্কের ওপর দিনদিন বৈশি^ক আস্থা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এ প্রবৃদ্ধিই এখন অবকাঠামো সক্ষমতার পাশাপাশি প্রযুক্তি ও প্রক্রিয়াগত দক্ষতা বৃদ্ধির এক নতুন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে আমাদের সামনে।
বন্দরের গতিশীলতা ধরে রাখতে আমরা ধারাবাহিকভাবে টার্মিনালগুলি উন্নত করছি, জাহাজের টার্ন-অ্যারাউন্ড টাইম কমিয়ে আনছি এবং রিয়েল-টাইম কার্গো ট্র্যাকিংয়ের লক্ষ্যে উন্নত ডেটা সিস্টেম চালু করছি। বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতা-সক্ষম, প্রাসঙ্গিক ও টেকসই থাকার লক্ষ্যে সমুদ্র বাণিজ্য এবং লজিস্টিক করিডরে আন্তর্জাতিক শুদ্ধাচার প্রতিপালনে চট্টগ্রাম বন্দর শতভাগ অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমাদের আপাত কর্তব্য বন্দরের অপারেশনাল অর্জনকে একটি কৌশলগত সক্ষমতায় রূপান্তর করা, যাতে বৈশ্বিক বন্দর ক‚টনৈতিক মহলে চট্টগ্রাম বন্দর নিজের জন্য সুদৃঢ় একটি অবস্থান নিশ্চিত করতে পারে।
বিশ^সভায় বাংলাদেশের জোরালো কণ্ঠ
আইএপিএইচ বিশ্বব্যাপী বন্দরগুলোর অনুসরণীয় আন্তর্জাতিক মান নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। সমিতির বার্ষিক সাধারণ সভায় নির্বাচিত পরিচালনা পর্ষদ সমুদ্রখাতের গবেষণা, নীতি প্রণয়ন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে যাবতীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করে। এ প্রক্রিয়ার মধ্যে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ নিজেকে বৈশ্বিক এজেন্ডার একজন অনুসারী মাত্র নয়, বরং এজেন্ডার গতি নির্ধারক হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে পারবে।
প্রার্থী মনোনয়ন, প্রযুক্তিগত ওয়ার্কিং গ্রæপ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ এবং ডিজিটাল ইয়ার্ড ম্যানেজমেন্ট বা ঘূর্ণিঝড় সহনশীল অবকাঠামোর মতো নিজেদের একান্ত উদ্ভাবনগুলি যদি আমরা এ সভায় তুলে ধরতে পারি, তাহলে বৈশি^ক নৌ-বাণিজ্যের নীতিনির্ধারণী আলোচ্যসূচিতে বিশে^র উন্নয়নশীল নৌ-জাতিগুলির বিদ্যমান বাস্তবতার যথার্থ প্রতিফলনও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
নেট-জিরো রূপান্তরে পথনির্দেশ
কোবে সম্মেলনে নেট-জিরো নির্গমন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ওপর জোর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বিনিয়োগকারী এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলিরও প্রত্যাশা, বন্দরগুলির পরিবেশগত অগ্রগতির বিষয়টি এক্ষেত্রে বরাবর পরিমাপযোগ্যভাবে প্রদর্শিত থাকবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের ক্ষেত্রে আমরা নেট-জিরো রূপান্তর প্রক্রিয়াটি ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করছি। প্রথম ধাপে বন্দরে ‘এনার্জি-রেডি’ বার্থ স্থাপন, দক্ষ বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা, এবং নিরাপত্তা অবকাঠামোর আধুনিকীকরণ নিশ্চিত করা হবে। পরবর্তী ধাপগুলোতে ক্রমান্বয়ে সবুজ মিথানল, সবুজ অ্যামোনিয়া ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) মতো পরিচ্ছন্ন জ্বালানি হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা তৈরি করা হবে। আমাদের লক্ষ্য এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা প্রকৃতপক্ষে কতটুকু উপকৃত হচ্ছি, সেটিকে একটি হিসাবের আওতায় নিয়ে আসা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ চলাকালীন ‘ডাউনটাইম’ বা কাজ স্থগিত রাখার সময়সীমা কমিয়ে আনা, তীরভ‚মির বিদ্যুৎ সংযোগের গতিবৃদ্ধি করা, এবং ঘূর্ণিঝড়ের পর দ্রæততম সময়ের মধ্যে কার্যক্রম শুরুর সক্ষমতা তৈরি করা। এ সবকিছুরই মূল উদ্দেশ্য পরিবেশ রক্ষার অঙ্গীকারটি যাতে শুধু মুখের কথার মধ্যে আটকে না থেকে সেটা একটি বাস্তব এবং আর্থিক বিশ্বাসযোগ্যতায় রূপ নিতে পারে; বিনিয়োগকারীরা যাতে পরিষ্কার দেখতে পারে যে গৃহীত পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপগুলো আসলেও অর্থনৈতিকভাবে ফলপ্রসূ।
ডিজিটালাইজেশন ও সাইবার নিরাপত্তা
আধুনিক বন্দরগুলি আজকাল কংক্রিটের অবকাঠামোর চেয়ে সফটওয়্যার অবকাঠামোর ওপর অনেক বেশি পরিমাণে নির্ভরশীল। ফলত আমাদের মনে রাখা উচিত, অটোমেশন উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে সত্য, কিন্তু একই সঙ্গে সেটি সাইবার হুমকির ঝুঁকিটিও বাড়িয়ে তোলে।
এক্ষেত্রে আমাদের কৌশল হবে সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি ইয়ার্ড টেলিমেট্রি থেকে শুরু করে কাস্টমস ডাটা বিনিময় সংক্রান্ত প্রতিটি নতুন সিস্টেমের মধ্যে শুরু থেকেই অঙ্গীভ‚ত করা। সাইবার প্রস্তুতি ও প্রতিরোধ সক্ষমতা আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে আইএপিএইচ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আমরা অংশীদার বন্দরগুলোর সঙ্গে যৌথ সিমুলেশন এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য অনুশীলন পরিচালনা করব। উচ্চ-নিরাপত্তা মানদÐ পূরণকারী টার্মিনাল অপারেটরদের জন্য এক্ষেত্রে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থাও থাকবে। এর ফলে ঝুঁকি কমবে, কাজের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত হবে এবং ন্যূনতম মাত্রায় নেমে আসবে অংশীদারদের বীমা ব্যয়।
ডেটা-নির্ভর দক্ষতা
কোবে সম্মেলনে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের নবায়িত পোর্ট রিফর্ম টুলকিট এবং ২০২৫ কনটেইনার পোর্ট পারফরমেন্স ইনডেক্স অনুযায়ী বর্তমান যুগে তথ্যই হচ্ছে যে কোনো বন্দরের প্রতিযোগিতা-সক্ষমতার মূল ভিত্তি।
অযথা টার্মিনাল বিস্তারের বদলে এক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্য, লজিস্টিক্সের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং আইডল-টাইম (অকেজো-সময়) বিলোপনের মাধ্যমে ‘কংক্রিটবিহীন সক্ষমতা’ বাড়িয়ে তোলা। বন্দরে শিগগিরই এআই-ভিত্তিক ডিজিটাল ট্র্যাকিং ও মনিটরিং সিস্টেম চালু হবে। এ সিস্টেমে কার্গো, ট্রাক ও ট্রেনের চলাচল একস্থান থেকেই তদারকি করা সম্ভব হবে। ড্যাশবোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলো- যেমন, ক্রেন কতবার মাল তুলছে-নামাচ্ছে কিংবা জাহাজ সময়মতো আসছে কি না- এগুলিও দৃশ্যমান হবে। এ তথ্যগুলি চুক্তি-প্রণোদনায় যুক্ত করা হলে সরকারি-বেসরকারি উভয় পক্ষের স্বার্থ আরো সুসমন্বিত হবে এবং নিশ্চিত হবে গতিশীল উন্নতি।
বৈশ্বিক শুদ্ধাচার শিক্ষণ ও তার চর্চা
অগ্রণী অবস্থানে থাকতে হলে বাংলাদেশকে বৈশি^ক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি তাতে নিজের সক্রিয় অবদানও রাখতে হবে। এক্ষেত্রে আইএপিএইচ পরিচালিত ডিজিটালাইজেশন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও জলবায়ু অভিযোজন সংক্রান্ত ওয়ার্কিং গ্রæপে বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।
পরবর্তী আইএপিএইচ সাসটেইনেবিলিটি অ্যাওয়ার্ডস আয়োজনে আমরা আমাদের ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা ব্যবস্থাপনা ও ইয়ার্ডের পানি নিষ্কাশন সংক্রান্ত উদ্ভাবনগুলো তুলে ধরব। পাশাপাশি, বিশে^র বিভিন্ন বন্দরের মধ্যে কর্মী বিনিময় ও পারস্পরিক অভিজ্ঞতা ভাগাভাগির লক্ষ্যে আমরা সিস্টার-পোর্ট অংশীদারিত্ব আরো বাড়িয়ে তুলব। এসব প্রতিটি উদ্যোগই বৈশি^ক সামুদ্রিক মানদÐ নির্ধারণী শীর্ষফোরামে বাংলাদেশের অবস্থান আরো দৃঢ় এবং মজবুত করবে।
হামবুর্গ ও জাপানের সঙ্গে সরাসরি নৌ-রুট
প্রত্যক্ষ সেবা প্রদান করাই আমাদের কর্মকৌশলের মূল লক্ষ্য। জার্মানির বাণিজ্য-উন্নয়ন সংস্থার সহায়তায় পরিকল্পিত চট্টগ্রাম-হামবুর্গ রুট চালু করা সম্ভব হলে ট্রানশিপমেন্ট হাবের ওপর বাংলাদেশের বর্তমান নির্ভরতা ব্যাপকভাবে কমে আসবে এবং পরিবহন সময়সূচিতেও কাক্সিক্ষত স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব হবে। অনুরূপ, চট্টগ্রাম-জাপান নৌ-সংযোগ চালু হলে দেশের পোশাক, চামড়া ও ক্ষুদ্র-প্রকৌশল খাতজাত পণ্যসমূহের জন্য উচ্চমূল্যের বাজারে প্রবেশের অনন্য সুযোগ তৈরি হবে। এ সুবাদে পরিবহনকাল এবং কার্বন নিঃসরণ, দুটোই হ্রাস পাবে আশাতীতভাবে।
পরিকল্পিত এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নে একটি জয়েন্ট টাস্কফোর্স গঠন করা হবে। এ টাস্ক ফোর্স কাস্টমস, লজিস্টিক্স ও রিফার (শীতল পণ্যবাহী কনটেইনার) সময়সূচির মধ্যে একটি সুষ্ঠু সমন্বয় নিশ্চিত করবে। পাইলট ভয়েজে রপ্তানিকারক ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলির অংশগ্রহণের সুযোগ রাখার ফলে ব্যবস্থাটি আরো বিশ্বস্ত এবং কার্যকর হবে। ক্যারিয়ার এবং বিনিয়োগকারীরাও এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রতি আরো বেশি আগ্রহী হতে শুরু করবে। এ সকল উদ্যোগের সার্থক সমন্বয়ের ফলশ্রæতিতে একটি ‘ডুয়াল-হাব’ বাণিজ্য মডেলও তৈরি করা সম্ভব হবে। ফলত এতে বাংলাদেশের বাণিজ্য-কার্যক্রম ক্রমশ আরও বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠবে; পাশাপাশি, বৈশি^ক পর্যায়ের যে কোনো অর্থনৈতিক ধাক্কা সামাল দেয়ার ক্ষেত্রেও তাকে সুদৃঢ় এবং স্থিতিশীল থাকার শক্তি জোগাবে।
অর্থায়ন ও গ্রাহকমুখীনতা
কোবে সম্মেলনে জোর দিয়ে বলা হয়েছে- যে কোনো টেকসই পরিকল্পনার মেরুদÐ হলো একটি বিশ্বাসযোগ্য অর্থায়ন। চট্টগ্রাম বন্দর এক্ষেত্রে একটি ‘এনার্জি-হাব’ মডেল অনুসরণ করছে যেখানে শিল্প জ্বালানির চাহিদা ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানি সরবরাহের সহাবস্থান- প্রথম দিন থেকেই অর্থনৈতিকভাবে টেকসই থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করবে। বেøন্ডেড ফাইন্যান্স, সুস্পষ্ট বিধি-বিধান, এবং অ্যাঙ্কর-টেন্যান্ট চুক্তি হবে এসব অর্জনের চাবিকাঠি।
অভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ একজন বন্দর-গ্রাহকের দৃষ্টি দিয়ে বন্দর-কার্যক্রমের বিচার করার বিষয়টি। পণ্য মালিক ও নৌপরিবহন সংস্থাগুলোর মূল চাওয়া- নির্ভরযোগ্যতা, স্বচ্ছতা, এবং পরিবেশের প্রতি আন্তরিক দায়িত্বশীলতা। চট্টগ্রাম বন্দরের ডিজিটাল সংস্কার ও টেকসই বিনিয়োগ কার্যক্রমগুলিও বস্তুত তাদের এ প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যেই গৃহীত। আশা করা যায়, এসব পদক্ষেপের মধ্য দিয়েই পারস্পরিক সেই আস্থা নির্মিত হবে, যার সুবাদে আমরা সকল পক্ষের মধ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদী বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হব।
আগামীর পথ
কোবে সম্মেলনে চট্টগ্রাম বন্দরের অংশগ্রহণ আমাদের যে বার্তা দেয়, তা হচ্ছে, বর্তমান নৌবিশে^ বাংলাদেশ বিশ^-নেতৃত্বের একজন অনুসারী মাত্র নয়, বরং বৈশি^ক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব প্রদানের জন্যেও সে পূর্ণ প্রস্তুত। পাশাপাশি, ড. ইউনূসের আধুনিক ও বিশ^মুখীন অর্থনীতির রূপকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও নির্ধারিত জাতীয় কর্মকৌশলের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে সামুদ্রিক উন্নয়নের প্রশ্নটি। এক্ষেত্রে আমাদের এখনকার দায়িত্ব ডেটা-নির্ভর দক্ষতা, নেট-জিরো প্রস্তুতি, ও সাইবার রেজিলেন্স অর্জন এবং এর পাশাপাশি, ইউরোপ ও জাপানের সঙ্গে সরাসরি নতুন নৌপথ গড়ে তোলার মাধ্যমে তাঁর এ রূপকল্পের একটি বাস্তবসম্মত রূপদান করা।
জাঢ্যতা নয়, উদ্যমী পরিকল্পনার মধ্য দিয়েই আগামীর পথে অগ্রসর হতে পারে একটি বন্দর। জাতীয় পর্যায়ের অঙ্গীকার এবং নজিরবিহীন কর্মদক্ষতার প্রবৃদ্ধি প্রদর্শনের মাধ্যমে কোবে সম্মেলনে আমরা নিজেদের জন্য আগামী দিনের যে পথরেখাটি তৈরি করেছি, তা থেকেই সুস্পষ্ট যে বাংলাদেশের নৌ-ভবিষ্যৎ ইতোমধ্যেই তার নির্মাণপ্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। দেশের প্রতিটি মহল যথার্থই উপলব্ধি করতে পারছেন যে বঙ্গোপসাগর আজ আমাদের জন্য শুধুই একটি সীমান্ত মাত্র নয়, বরং এটাই আমাদের বৈশ্বিক অংশীদারত্ব ও টেকসই ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির মহীসোপান।


