Home Blog Page 10

কনটেইনার জাহাজের আদ্যোপান্ত

Aerial View Of Container Cargo Ship In Sea.

ব্যবসা-বাণিজ্যের খাতিরে মানুষ ঠিক কবে থেকে সাগরকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে তা বলা মুশকিল। তবে মানবসভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই পণ্য পরিবহন ও যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে সমুদ্রপথের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। ইতিহাস ঘেঁটে খ্রিস্টের জন্মেরও সাত হাজার বছর আগে অর্থাৎ নব্যপ্রস্তর যুগে ইউরোপীয় নাবিকদের এজিয়ান সাগরে নৌবাণিজ্য পরিচালনার হদিস মিলেছে। স্থলপথের চেয়ে জলপথে পণ্য পরিবহন নিরাপদ, দ্রæত ও সাশ্রয়ী হওয়ায় খ্রিস্টপূর্ব তিন শতাব্দীতে বণিকেরা সমুদ্রবাণিজ্যে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রাচীনকালে গাছের গুঁড়ির সাথে পণ্য বেঁধে উপকূলের ধার ঘেঁষে সেগুলোকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বহন করা হতো। কালের পরিক্রমায় পণ্য পরিবহন পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। প্রযুক্তির অগ্রগতি ও অভিনব উপকরণের ব্যবহার বাণিজ্যপথের দূরত্ব ও পণ্যের পরিমাণ বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। উপকূল ছেড়ে সাগর মহাসাগরের গণ্ডি অতিক্রম করেছে নৌবাণিজ্য। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৮০ শতাংশের বেশি সমুদ্রপথে পরিবাহিত হয়। স্বল্প সময়ে নিরাপদে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পণ্য পরিবহনের মূল কারিগর কনটেইনার জাহাজ। কনটেইনার শিপিংয়ের বিবর্তন পণ্য পরিবহন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে আরও দক্ষ, সাশ্রয়ী ও সহজ করে তুলেছে।

কনটেইনার শিপিংয়ের গোড়ার কথা

বর্তমানে ৬ হাজার কনটেইনার জাহাজের বিশাল বাণিজ্যিক নৌবহর প্রতি বছর বিশ^জুড়ে আনুমানিক ২২ কোটি ৬০ লাখ কনটেইনার পরিবহন করে। মাত্র তিন শতাব্দী আগেও পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা এতটা সংগঠিত ছিল না। কনটেইনারাইজেশন প্রক্রিয়ার আগে কাঠের বাক্স, পিপে ও বস্তায় করে ব্রেক বাল্ক কার্গো হিসেবে পণ্য পরিবহন করা হতো। এর ফলে জাহাজের ডেক বা খোলের সংকীর্ণ জায়গায় পণ্য লোডিং, অফ-লোডিংয়ে শিপিং কোম্পানিগুলোকে অতিরিক্ত শ্রম, সময় ও অর্থ ব্যয় করতে হতো। যান্ত্রিক সহায়তা ছাড়া পণ্য ওঠা-নামা করা হতো বলে পণ্যবাহী জাহাজগুলো সে সময় সাগরের চেয়ে বেশি সময় বন্দরেই অতিবাহিত করত। অনিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থার দরুন তখন দুর্ঘটনা ও চুরির ঝুঁকিও ছিল বেশি। অক্ষত অবস্থায় খাদ্যদ্রব্য পরিবহন করতে শিপারদের সবচেয়ে বেশি বেগ পোহাতে হতো। নানাবিধ প্রতিকূলতা এড়িয়ে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে ব্যয় করতে হতো পণ্যমূল্যের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ।

১৮ শতকের শেষদিকে ইংল্যান্ডের কয়লা খনিগুলোকে ঘিরে সর্বপ্রথম কনটেইনারাইজেশনের উৎপত্তি ঘটে। ওরসলে ডেলফ থেকে ম্যানচেস্টারে কয়লা বহনের জন্য ১৭৬৬ সালে বক্স জাহাজ স্টারভেশনারের নকশা করেন জেমস ব্রিন্ডলে। স্টারভেশনার দশটি কাঠের কনটেইনার বহন করতে পারত। পরবর্তীতে ওয়াগনকে কনটেইনার হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ১৭৯৫ সালে লিটল ইটন গ্যাংওয়ে চালু করেন বেঞ্জামিন ওট্রাম। ঘোড়ায় টানা সেসব ওয়াগনকে সহজেই ডারবি ক্যানেলের বার্জে স্থানান্তর করা যেত, যা কনটেইনারের কাজ করত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত কনটেইনারবাহী জাহাজ সাধারণত বিলাসবহুল যাত্রীবাহী ট্রেনের মালপত্র বহনের কাজে ব্যবহার হতো। ১৯৩১ সালে বিশে^র প্রথম কনটেইনারবাহী জাহাজ অটোক্যারিয়ার চালু করে যুক্তরাজ্যের সাউদার্ন রেলওয়ে। কনটেইনার বহনের জন্য অটোক্যারিয়ারে ২১টি স্লট দেওয়া ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তেলবাহী ট্যাংকারগুলোকে কনটেইনার জাহাজে রূপান্তর করা হয়। পরবর্তীতে কনটেইনার বহনের উদ্দেশ্যে নির্মিত প্রথম জাহাজগুলো যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডস এবং ১৯৫১ সাল থেকে ডেনমার্কে কার্যক্রম শুরু করে। একই বছর যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল, ওয়াশিংটন ও আলাস্কায় এ ধরনের জাহাজগুলো কনটেইনার বহনের কাজ শুরু করে।

অধিকাংশ কনটেইনারের ধারণক্ষমতা অত্যন্ত কম থাকায় এই ধরনের জাহাজগুলো তখন তেমন সাফল্যের মুখ দেখেনি। সে সময় ৫২ শতাংশ কনটেইনারের আয়তন ছিল ৩ ঘনমিটারের চেয়েও কম। এছাড়া ইউরোপের কাঠের তৈরি কনটেইনারগুলোতে ত্রিপলের ঢাকনা ব্যবহার করায় রেল বা ট্রাকে লোডিংয়ের সময় অতিরিক্ত সরঞ্জামের প্রয়োজন পড়ত। এতে করে পণ্য পরিবহন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতো। ফ্যাক্টরি থেকে গন্তব্যে পৌঁছার উপযোগী ইন্টারমোডাল কনটেইনার নির্মাণের মাধ্যমে এ সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠে শিপিং খাত।

বাংলাদেশে কনটেইনার শিপিংয়ের ইতিবৃত্ত

বদ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত বাংলার নৌবাণিজ্য প্রাচীনকাল থেকেই বেশ সমৃদ্ধ। কর্ণফুলীর তীরবর্তী চট্টগ্রামে এই অঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক বন্দর অবস্থিত। আরব-পর্তুগিজ-ওলন্দাজ বণিকদের পর ব্রিটিশ আমলে ইউরোপীদের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন পরিচালনা করে চট্টগ্রাম। বন্দরটি সে সময় পোর্তে গ্রান্দে বা গ্র্যান্ড পোর্ট নামে সুপরিচিত ছিল। কালের পরিক্রমায় বন্দরের কাজের পরিধি বিস্তৃত হয়। দেশ স্বাধীনের পর চট্টগ্রাম বন্দরকে আন্তর্জাতিক বন্দরে পরিণত করার লক্ষ্যে মনোনিবেশ করে বাংলাদেশ সরকার।

স্বাধীন বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির প্রধান প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দরে শুরুর দিকে কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা ছিল না বললেই চলে। ১৯৭৭ সালের ২২ মার্চ চট্টগাম বন্দর দিয়ে প্রথম কনটেইনারবাহী জাহাজ এসএস টেনাসিটি এদেশে প্রবেশ করে। মাত্র ছয়টি কনটেইনার বহনকারী এ জাহাজের আগমণের পাঁচ দশকের ভেতর চট্টগ্রাম বন্দরের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পরিচালিত হয়। যার প্রায় পুরোটাই কনটেইনারাইজড পণ্য। 

১৯৭০-এর দশকে বিশ^জুড়ে কনটেইনার জাহাজের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) সে সময় তিন টন ওজনবাহী পাঁচ-ছয়টি ক্রেন ব্যবহার করে পণ্য ওঠা-নামা করত। পরবর্তীতে রপ্তানি পণ্যের তালিকায় তৈরি পোশাকের অন্তর্ভুক্তিতে কনটেইনারের ব্যবহার ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। ১৯৮০-এর দশক থেকে বন্দরের অবকাঠামোগত পরিবর্তনে সচেষ্ট হয়ে ওঠে চবক। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৬ সালে চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনাল তৈরি করা হয়। দেশের প্রথম কনটেইনার টার্মিনালটিতে দুটি ডেডিকেটেড কনটেইনার জেটি রয়েছে।

সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কনটেইনারের সংখ্যা বাড়তে থাকায় ২০০৭ সালে নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনালের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৩০ লাখ ৫০ হাজার টিইইউ কনটেইনার পরিবহন করা হয়। গত বছর ৪ হাজার ১০৩টি পণ্যবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়েছে এবং কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ প্রথমবারের মতো ১২ কোটি মেট্রিক টন ছাড়িয়ে গেছে। চলতি বছরের এপ্রিলে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু করলে চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মচাঞ্চল্য আরও বাড়বে। সৌদি আরবভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ২২ বছরের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের তৃতীয় এই টার্মিনালটির পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে। পিসিটি চালু হলে বছরে প্রায় সাড়ে চার লাখ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।

চট্টগ্রামের পাশাপাশি মোংলা বন্দরের মাধ্যমেও কনটেইনার আনা-নেওয়া করছে বাংলাদেশ। পদ্মা সেতুর কল্যাণে বর্তমানে ঢাকার সবচেয়ে নিকটবর্তী বন্দরে পরিণত হয়েছে মোংলা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বন্দরটিতে ৮২৭টি বিদেশি জাহাজ আসে এবং ২৬ হাজার ৫৯০ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়। মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বর্তমানে ৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। অন্যদিকে আগামী জুনে আনুষ্ঠানিকভাবে পায়রা বন্দরের প্রথম টার্মিনাল চালু হলে বন্দরে একসঙ্গে তিনটি জাহাজ ভিড়তে পারবে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনাল এবং কক্সবাজারের মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে বিশাল আকারের কনটেইনার জাহাজ দেশে প্রবেশ করবে, যা কনটেইনারজাত পণ্যের আমদানি-রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করবে।

সময়ের সাথে সাথে দেশীয় বন্দরগুলো কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে দক্ষ হয়ে উঠলেও পণ্য পরিবহনে বিদেশি কনটেইনার জাহাজই একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করছে। একসময় বেসরকারি খাতে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজে কনটেইনার পরিবহন করত দেশীয় প্রতিষ্ঠান এইচআরসি শিপিং কোম্পানি ও কিউসি কনটেইনার লাইন। প্রতিষ্ঠান দুটি ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সালের ভেতর শিপিং ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়। পণ্য পরিবহনে এইচআরসি শিপিং কোম্পানি মালিকানাধীন ১০টি জাহাজ এবং কিউসি কনটেইনার লাইন মালিকানাধীন ৭টি জাহাজ ব্যবহার করত। তবে ২০০৭ সালে কিউসি কনটেইনার লাইন এবং ২০১০ সালে এইচআরসি শিপিং কোম্পানি ব্যবসা গুটিয়ে নিলে দেশের কনটেইনার শিপিং আবারও বিদেশি জাহাজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

দীর্ঘ দশ বছরের খরা কাটিয়ে ২০২০ সালে আবারও সাগরে ভাসে বাংলাদেশি মালিকানাধীন কনটেইনার জাহাজ। দুটি নিবন্ধিত জাহাজ নিয়ে সেই বছর কনটেইনার শিপিং শুরু করে কর্ণফুলী লিমিটেডের মালিকানাধীন এইচআর লাইনস। ব্যবসা শুরুর আড়াই বছরের মাথায় ছয়টি জাহাজ নিয়ে এইচআর লাইনস দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ কনটেইনার জাহাজ কোম্পানিতে পরিণত হয়। তথ্য বিশ্লেষক ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আলফালাইনারের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের শুরুতে বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি কনটেইনার জাহাজ অপারেটরের ভেতর এইচআর লাইনসের অবস্থান ছিল ৭৪তম। প্রতিষ্ঠানটির বহরে আরও দুটি জাহাজ সংযুক্তির প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। জাহাজ দুটি কার্যক্রম শুরু করলে এইচআর লাইনসের সক্ষমতা বেড়ে ১১ হাজার ৮৪০ টিইইউয়ে উন্নীত হবে।

ইন্টারমোডাল শিপিং কনটেইনার

ম্যাকলিন ট্রাকিং কোম্পানির মালিক মার্কিন ব্যবসায়ী ম্যালকম ম্যাকলিন বহু বছর ধরে দ্রæত ও দক্ষতার সাথে সম্পূর্ণ কার্গো ট্রাক থেকে জাহাজে লোড করার উপায় খুঁজছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৬ সালে ইন্টারমোডাল শিপিং কনটেইনার বা ফ্রেইট কনটেইনার আবিষ্কার করেন তিনি। তার এই যুগান্তকারী আবিষ্কার বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহনে অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধন করে। ইন্টারমোডাল শিপিং কনটেইনারের সাহায্যে আনলোড বা পুনরায় লোড করার ঝামেলা ছাড়াই ট্রাক, রেল, জাহাজসহ যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে একবারে পণ্য পরিবহন করা যায়। এতে করে শিপিং কোম্পানিগুলোর শ্রম, অর্থ ও খরচ যেমন সাশ্রয় হয় তেমনি পণ্যগুলো নিরাপদে, অক্ষত অবস্থায় গন্তব্যে পৌঁছে যায়।

কনটেইনার পরিমাপের একক

বিশ্বব্যাপী পণ্য পরিবহনকে সহজ ও গতিশীল করে তুলতে কনটেইনারের আকারকে দুটি সাধারণ এককে পরিমাপ হয়। প্রমাণ আকারের কনটেইনারের ব্যবহার ইন্টারমোডাল ট্রান্সপোর্টেশনে সহায়ক ভূমিকা রাখে। প্রথমত, নির্দিষ্ট আকারের কনটেইনার হওয়ার কারণে তা জাহাজে সারিবদ্ধ অবস্থায় রাখা সহজ হয়। তাছাড়া প্রমাণ একক ব্যবহারের ফলে জাহাজে কতগুলো কনটেইনার লোড করা হলো সেই হিসাব রাখতে সুবিধা হয়। অন্যদিকে নির্দিষ্ট আকারের কনটেইনার হওয়ায় সেগুলো সড়ক বা রেলপথে পরিবহনের উপযোগী ক্যারিয়ার তৈরি করাও সহজ হয়। ভিন্ন ভিন্ন আকারের কনটেইনার ব্যবহার করলে সড়ক বা রেলপথের ক্যারিয়ারগুলোর আকারও ভিন্ন হতো। এতে পণ্য লোডিং, আন-লোডিংয়ে অতিরিক্ত অর্থ, শ্রম ও সময় ব্যয় হতো।

টোয়েন্টি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট (টিইইউ)

টোয়েন্টি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট বা টিইইউ হলো কনটেইনার পরিবহনের একটি প্রমাণ ইউনিট। ২০ ফুট দীর্ঘ ধাতব ইন্টারমোডাল কনটেইনারগুলোই টিইইউ নামে পরিচিত। তবে এ ধরনের কনটেইনারগুলোর উচ্চতার কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। কনটেইনারগুলোর উচ্চতা সাধারণত ৪ ফুট ৩ ইঞ্চি থেকে ৯ ফুট ৬ ইঞ্চির মধ্যে হয়। তবে ৮ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার কনটেইনার সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। উচ্চতায় ভিন্নতা দেখা গেলে এ ধরনের কনটেইনার প্রস্থে ৮ ফুট হয়ে থাকে।

ফরটি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট (এফইইউ)

কনটেইনারের আরেকটি স্ট্যান্ডার্ড সাইজ হলো ৪০ ফুট দৈর্ঘ্য। দৈর্ঘ্যে দ্বিগুণ হলেও এগুলোর প্রস্থ টিইইউর সমান হয়। এই আকারের কনটেইনারগুলোকে ফরটি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট বা এফইইউ একক দিয়ে প্রকাশ করা হয়। সাধারণত একটি এফইইউ কনটেইনারকে দুটি টিইইউ কনটেইনারের সমান ধরা হয়।

জাহাজের রকমফের

গত আড়াইশ বছরে কনটেইনারের সাইজের সাথে পাল্লা দিয়ে কনটেইনারবাহী জাহাজের আকার-আয়তনেও নানাবিধ পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বায়নের এই যুগে কনটেইনার জাহাজগুলো ক্রমেই দানবাকৃতি ধারণ করছে। সাইজের ভিত্তিতে কনটেইনার জাহাজকে সাতটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে।

স্মল ফিডার

সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির কনটেইনার জাহাজগুলো স্মল ফিডার ক্যাটাগরির আওতাভুক্ত। এ ধরনের জাহাজের ধারণক্ষমতা সর্বোচ্চ ১ হাজার টিইইউ। এসব জাহাজ সাধারণত ছোট বন্দর থেকে স্বল্প পরিমাণ কার্গো ট্রান্সশিপমেন্ট হাবে মাদার শিপে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে।

ফিডার

১ হাজার থেকে ২ হাজার টিইইউ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন মাঝারি-আকৃতির ফ্রেইট শিপগুলো ফিডার নামে পরিচিত। স্মল ফিডারের মতো এ ধরনের জাহাজও অগভীর বা অভ্যন্তরীণ বন্দরের সঙ্গে বৃহদাকৃতির জাহাজের সংযোগ স্থাপন করে। বড় জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা নেই এমন বন্দর থেকে কার্গো সংগ্রহ করে মাদার শিপে পৌঁছে দেওয়াই ফিডারের কাজ। এ ধরনের জাহাজ দক্ষতার সাথে কনটেইনার লোডিং আনলোডিং করতে সক্ষম। যা একই সাথে বন্দরের কাজের গতি বাড়ায় এবং কনটেইনার পরিবহন দ্রুততর করে। স্বল্প দূরত্বে কার্যক্রম পরিচালনায় পারদর্শী কোম্পানিগুলোই সাধারণত ফিডার পরিচালনা করে।

ফিডারম্যাক্স

গড়ে ১৭০ থেকে ২০০ মিটার দীর্ঘ এবং ২ থেকে ৩ হাজার টিইইউ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন কনটেইনার জাহাজগুলো ফিডারম্যাক্স নামে পরিচিত। সংকীর্ণ প্রণালী এবং অগভীর জলপথে অধিক পরিমাণ কার্গো বহনের কাজে এ ধরনের জাহাজ ব্যবহার হয়। ফিডার ক্যাটাগরির সব জাহাজই সাধারণত কার্গো ক্রেন বহন করে থাকে।

পানাম্যাক্স

পানামা খাল বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বাণিজ্যপথ। মানবসৃষ্ট এই পথটি লক সিস্টেম ব্যবহার করে দুটি ভিন্ন উচ্চতায় থাকা আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে সংযোগ সৃষ্টি করেছে। ৮২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খাল অতিক্রম করতে পণ্যবাহী জাহাজগুলোকে একাধিক জল-কপাট পার হতে হয়। পানামা খাল কর্তৃপক্ষ (পিসিএ) অতিক্রমযোগ্য জাহাজের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তাবলি ও জাহাজের ড্রাফটের সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। যেসব জাহাজ পানামা খাল অতিক্রম করতে সক্ষম সেগুলোই পানাম্যাক্স ও নিওপানামাক্স ক্যাটাগরিভুক্ত। সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৩ মিটার ড্রাফটের পানাম্যাক্স জাহাজের দৈর্ঘ্য ৯৬৫ ফুট এবং প্রস্থ ১০৬ ফুট হয়ে থাকে। এ ধরনের জাহাজ ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার ১০০ টিইইউ কনটেইনার বহন করতে সক্ষম।  

পোস্ট-পানাম্যাক্স

বর্তমান সময়ে নৌপথে পণ্য পরিবহনে বিশাল আকারের জাহাজের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। অত্যাধুনিক যেসব সুপারট্যাংকার বা কনটেইনার জাহাজ মূল পানামা খালের লকগুলো অতিক্রম করতে পারে না, সেগুলোকেই পোস্ট-পানাম্যাক্স বা ওভার-পানাম্যাক্স ক্যাটাগরিভুক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের জাহাজ ৫ হাজার ১০০ থেকে ১০ হাজার টিইইউ কনটেইনার বহন করতে পারে।

নিওপানাম্যাক্স

সময়ের সাথে সাথে পানামা খালের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। অতিরিক্ত জাহাজের চাপ সামাল দিতে পানামা খাল সম্প্রসারণ করেছে কর্তৃপক্ষ। বৃহদাকার জাহাজ চলাচলের সুবিধার জন্য ২০১৬ সালে নতুন লকগুলো খুলে দেয় পিসিএ। পানামা খালের বর্ধিত অংশ দিয়ে চলাচলের উপযোগী জাহাজগুলো নিওপানাম্যাক্স নামে পরিচিত। ১৫ দশমিক ২ মিটার ড্রাফটের নিওপানাম্যাক্স জাহাজগুলো ১২০০ ফুট দীর্ঘ এবং ১৬০ দশমিক ৭ ফুট প্রশস্ত হয়ে থাকে। দানবাকৃতির এসব জাহাজ ১০ হাজার থেকে সাড়ে ১৪ হাজার টিইইউ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন।

আল্ট্রা-লার্জ

বিগত তিন দশকে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যিক নৌবহরে বিশাল আকারের জাহাজ যুক্ত করার প্রবণতা বেড়েছে। অতিকায় আকৃতির এসব জাহাজ আল্ট্রা লার্জ কনটেইনার ভেসেল (ইউএলসিভি) ক্যাটাগরিভুক্ত। ১৫ দশমিক ২ মিটার বা তার চেয়েও গভীর ড্রাফটের এসব জাহাজ ১২০০ ফুট দীর্ঘ ও ১৬০ ফুটের বেশি প্রশস্ত হয়ে থাকে। ইউএলসিভির ধারণক্ষমতা সাড়ে ১৪ হাজার টিইইউরও অধিক। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বহরে ২৪ হাজার টিইইউর অতিকায় জাহাজ যুক্ত করছে মায়েরস্ক, ওয়ান, ওওসিএলের মতো শীর্ষস্থানীয় শিপিং কোম্পানিগুলো।

পণ্য পরিবহনের নিয়ম-নীতি

নিরাপদে পণ্য পরিবহন করাই কনটেইনারবাহী জাহাজের প্রধান কাজ। পণ্যকে অক্ষত অবস্থায় গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পণ্য পরিবহনকারীকে বেশকিছু নিয়ম-নীতি মেনে চলতে হয়।

কনটেইনার প্যাকিং

শিপিং কোম্পানিগুলো দুভাবে কনটেইনারে পণ্য লোড করে থাকে।

ফুল কনটেইনার লোড (এফএলসি)

এই ধরনের শিপমেন্টে একটি কনটেইনারের সমস্ত জায়গা জুড়ে একটি কার্গোই বহন করা হয়। এক্ষেত্রে কনটেইনারে থাকা কার্গো শিপারের মালিকানাধীন থাকে অর্থাৎ শিপার অন্য কারো সাথে কনটেইনারের জায়গা ভাগাভাগি করে নেয় না। এফএলসির ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার কোম্পানিগুলো কনটেইনার ইজারা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় শিপারের কাছে খালি কনটেইনার পাঠানো হয়। শিপার নিজ দায়িত্বে পণ্য লোড করে ক্যারিয়ার কোম্পানির দেওয়া সিল লাগিয়ে কনটেইনার বন্দরে পৌঁছে দেয়। ক্যারিয়ার কোম্পানি পরবর্তীতে জাহাজে কনটেইনার লোড করে গন্তব্যে নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে গন্তব্যে পৌঁছানোর পরও পণ্য অক্ষত থাকার নিশ্চয়তা প্রদান করার দায়িত্ব শিপারের।

লেস দ্যান ফুল কনটেইনার লোড (এলসিএল)

পরিবহনকৃত পণ্যের পরিমাণ যখন কনটেইনারের চেয়ে কম হয় তখন শিপার এলসিএল পন্থা অবলম্বন করে। এই পদ্ধতিতে শিপার অন্যান্য ছোট কার্গোর সঙ্গে মিলিতভাবে একটি কনটেইনার শেয়ার করে। একসাথে একাধিক শিপারের কার্গো বহন করা হয় বলে একে সম্মিলিত কনটেইনারও বলা হয়। এলসিএলের ক্ষেত্রে রপ্তানিকারক পণ্য কনটেইনার ফ্রেইট স্টেশনে (সিএফএস) পাঠিয়ে দেয় এবং অন্যান্য ব্যবসায়ীদের পণ্যের সাথে একত্রে সেটা কনটেইনারে লোড করা হয়। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর কনটেইনারে থাকা পণ্যগুলোকে ডিগ্রপিং প্রক্রিয়ায় পৃথক করে নিজ নিজ প্রাপকের কাছে পাঠানো হয়।

কনটেইনারের সুরক্ষা নিশ্চিতে করণীয়

জাহাজের কার্গো হোল্ড ও ডেকে করে কনটেইনার বহন করা হয়। ডেকে থাকা কনটেইনারগুলোকে উত্তাল সাগর, উচ্চ তাপমাত্রা, বৈরী আবহাওয়াসহ নানাবিধ প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়। এসব কনটেইনার সাগরে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি যেমন বেশি তেমনি এতে থাকা পণ্য অক্ষত অবস্থায় গন্তব্যে পৌঁছানোও বেশ কষ্টকর। এর ফলে এসব কনটেইনার নির্মাণে তাপ নিরোধক উপাদান ব্যবহারের পাশাপাশি সুরক্ষা নিশ্চিতে ক্যারিয়ার কোম্পানিকে বেশকিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়।

  • ওজনের নির্ধারিত সীমারেখা মেনে সমস্ত কনটেইনারে পণ্য লোড করা।
  • কনটেইনারের ভেতর পণ্যের ওজন সমানভাবে বণ্টন করা। 
  • ডেকের প্রতি বর্গফুটে যতটুকু ওজন বহনের অনুমোদন রয়েছে তা মেনে চলা।
  • কনটেইনারের যেকোনো এক পাশে ভারী পণ্য লোড না করা।
  • স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কনটেইনারের নিচের দিকে ভারী পণ্য লোড করা।
  • ভারী পণ্য বাক্স বা ক্যারেটে করে কনটেইনারে লোড করা।

উপসংহার

দশটি কনটেইনারবাহী বক্স জাহাজ স্টারভেশনার থেকে ২৪ হাজার ৩৪৬ টিইইউ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন সর্ববৃহৎ জাহাজ এমএসসি এরিনার এই দীর্ঘ যাত্রায় পণ্য পরিবহনের গতি-প্রকৃতি যেমন বদলেছে তেমনি বদলে গেছে প্রতিকূলতার ধরন। বর্তমান সময়ে এক সাথে বিপুল পরিমাণ পণ্য বহনের সুবিধা প্রদান করলেও কনটেইনার শিপিং খাতকে লড়তে হচ্ছে ভ‚রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও বৈরী প্রকৃতির বিরুদ্ধে। ক্রমবর্ধমান প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে পণ্যের সাপ্লাই চেইন সমুন্নত রাখতে হলে ক্যারিয়ার কোম্পানি ও শিপারদের যথাযথ প্রস্তুতি ও প্যাকেজিং নিশ্চিত করার পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রির নিয়ম-কানুন যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে।

যুগের চেয়ে এগিয়ে থাকা আইনের সুবর্ণজয়ন্তী

Screenshot

সমুদ্রের রোমাঞ্চ অনুভব করেন না, এমন মানুষ বোধ হয় খুব বেশি পাওয়া যাবে না। তবে রাষ্ট্রের কাছে কেবলই সৌন্দর্যের ধারক বিশাল জলরাশি নয়, বরং এর গুরুত্ব আরও ব্যাপক ও বহুমাত্রিক। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনাময় এক অবলম্বন হতে পারে বিশাল এই জলরাশি। সমুদ্রভিত্তিক সুনীল অর্থনীতি উপকূলীয় দেশগুলোর জন্য অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দক্ষিণ সীমানায় থাকা বঙ্গোপসাগর সম্পদের জোগান নিয়ে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে।

বাংলাদেশ নামের বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই বদ্বীপ গড়ে উঠেছে যার কোল ঘেঁষে, সেই বঙ্গোপসাগর ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিবেচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের নদ-নদী ও সমুদ্র যে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হয়ে উঠতে পারে, তা অনেক আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে জলরাশি বাংলাদেশের অস্তিত্বের অংশ, সঠিক পরিকল্পনা না থাকলে অদূর ভবিষ্যতে তার সুরক্ষা বিনষ্ট হতে পারে এমন আশঙ্কা ছিল তার। সে কারণেই স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনসহ বিভিন্ন ঝুঁকি মোকাবিলায় শত ব্যস্ততা ও প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি সমুদ্রের উন্নয়নে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। নদী ও সমুদ্রসম্পদের উন্নয়নে সাহসিকতা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে অসাধ্য কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় মেরিটাইম ভিশনের স্থপতি।

সমুদ্র অর্থনীতির গুরুত্ব অনুধাবন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাশিয়া সরকারের সহায়তায় যুদ্ধবিধ্বস্ত চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেলের বিভিন্ন স্থানে নিমজ্জিত-অর্ধনিমজ্জিত জাহাজও অবিস্ফোরিত মাইন অপসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক সম্পদের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সমুদ্রসম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের জন্য বঙ্গবন্ধু সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদের ২ নম্বর ধারা অনুযায়ী সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত ‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪’ প্রণয়ন করেন।

সারা বিশ্বে নীতিনির্ধারকরা সমুদ্রসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য এ-সংক্রান্ত আইন প্রণয়নে আগ্রহী হয়েছিলেন মূলত নব্বইয়ের দশক ও এর পরবর্তী সময়ে। সেখানে বঙ্গবন্ধু এই উদ্যোগ নিয়েছে তারও আগে। যার ফলে আন্তর্জাতিক আইন ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অন দ্য ল’ অব দ্য সির (আনক্লস-থ্রি) আট বছর আগেই বাংলাদেশে টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট প্রণীত হয়েছিল।

১৯৭৪ সালে প্রণীত আইনটি বাংলাদেশের উপকূলীয় সামুদ্রিক সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা, জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, উপকূলীয় অঞ্চল ব্যবস্থাপনা, সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা, সমুদ্র পরিবহন, মৎস্যসম্পদ ও সামুদ্রিক সুশাসনের মতো বিষয়গুলো নির্ধারণ করা সহজতর করেছে। সবচেয়ে বড় কথা, আইনটি বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণাধীন সমুদ্রাঞ্চলকে কয়েকটি জোনে ভাগ করে এ-সংক্রান্ত সীমা নির্ধারণ, অধিকারের ব্যপ্তি, সুরক্ষা ও নিরাপত্তার রোডম্যাপ নির্ধারণ করে দিয়েছিল।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সমুদ্রভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিসর বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্টের প্রাসঙ্গিকতা। ফলস্বরূপ আইনটিকে সময়োপযোগী করতে ২০২১ সালে প্রণয়ন করা হয় টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট। এই সংশোধনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্রবিষয়ক জাতীয় আইনকে আইএমও প্রণীত আন্তর্জাতিক আইন আনক্লস-থ্রির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের সামুদ্রিক রূপরেখার ভিত

চুয়াত্তরের টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট নবীন বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণের রূপরেখা দিয়েছিল। বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের কতখানি অংশে সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, সেই অংশে দেশের স্বার্থ কীরূপ হবে এবং এই স্বার্থের সুরক্ষা হবে কীভাবে এসব বিষয় নির্ধারণে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল এই রূপরেখা। এতে করে বাংলাদেশের জন্য বহির্বিশ্বের চাপমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে নিজেদের সমুদ্রসীমার ব্যবস্থাপনার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। এক কথায় বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চলে সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা, বহির্বিশ্বের সাথে নিরবচ্ছিন্ন বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপন তথা দেশের সামুদ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির ভিত রচনা করেছিল এই আইন।

অ্যাক্টটিতে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমাকে কয়েকটি জোন বা অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো উপকূলীয় তটরেখা, টেরিটোরিয়াল জলসীমা, কন্টিগিউয়াস জোন, একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইজেড) ও মহীসোপান (কন্টিনেন্টাল শেলফ)।

সমুদ্রসম্পদের উন্নয়নে সাহসিকতা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছিলেন মেরিটাইম ভিশনের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

টেরিটোরিয়াল ওয়াটার : উপকূলীয় তটরেখা থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল দূরত্ব পর্যন্ত এলাকা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জলসীমা (টেরিটোরিয়াল ওয়াটার)। এই সীমার মধ্যে বাংলাদেশ পূর্ণমাত্রায় সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে এবং সেখানে জাহাজ চলাচল, মৎস্য শিকার ও সম্পদ আহরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।

কন্টিগিউয়াস জোন : টেরিটোরিয়াল সমুদ্রাঞ্চলের পর তটরেখা থেকে ২৪ নটিক্যাল মাইল দূরত্ব পর্যন্ত বিস্তৃত জলসীমাকে কন্টিগিউয়াস জোন ধরা হয়। অর্থাৎ এই জোনের বিস্তার ১২ নটিক্যাল মাইল। বাংলাদেশ সেখানে শুল্কায়ন, অভিবাসন ও পরিবেশগত সুরক্ষাবিষয়ক যেকোনো আইন প্রয়োগ করতে পারবে।

ইইজেড : তটরেখা থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল দূরত্ব পর্যন্ত সমুদ্রাঞ্চল বাংলাদেশের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইজেড) হিসেবে চিহ্নিত। অনেক সময় টেরিটোরিয়াল জোনের পর থেকেই ইইজেড শুরু বলে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ কন্টিগিউয়াস জোনকেও ইইজেডের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ হিসাবে ইইজেডের বিস্তার ১৮৮ নটিক্যাল মাইল। এখানকার সামুদ্রিক সব সম্পদের ওপর কেবল বাংলাদেশেরই সার্বভৌম অধিকার রয়েছে। টেকসই উপায়ে মৎস্যসম্পদ, জীবাশ্ম জ্বালানি ও অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ আহরণের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকা গতিশীল করার ক্ষেত্রে এই অঞ্চলটি কৌশলগত দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

মহীসোপান : ইইজেডের পর তটরেখা থেকে ৩৫০ নটিক্যাল মাইল দূরত্ব পর্যন্ত সমুদ্রাঞ্চল হলো মহীসোপান। অর্থাৎ মহীসোপানের বিস্তার ১৫০ নটিক্যাল মাইল। মেরিটাইম জোনস অ্যাক্টের মাধ্যমে এই অঞ্চলে সাগরতলের যেকোনো প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের অধিকার পেয়েছে বাংলাদেশ।

টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট কেবল যে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমাই নির্ধারণ করেছিল, তা নয়। বরং এতে সম্পদ ব্যবস্থাপনা, সমুদ্র নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এটি কেবলই একটি অভ্যন্তরীণ আইন ব্যবস্থা ছিল না, একই সঙ্গে এটি ছিল দেশের সমুদ্রবিষয়ক কৌশলগত কূটনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। সমুদ্রে একটি দেশের সার্বভৌমত্বের সীমা নির্ধারণ করা থাকলে প্রতিবেশী দেশগুলো ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কূটনৈতিক ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক জোরদারের আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়, যা আঞ্চলিক শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট সেই সুযোগটিই করে দিয়েছিল।

এই যে সম্পদে পরিপূর্ণ একটি জলসীমা, তার সুরক্ষা, বিদেশি জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও টেকসই পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ সময়োপযোগী সব সমুদ্রনীতি গ্রহণ করে যাচ্ছে। আর এসব নীতির মূল ভিত্তিই হলো টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, যার প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রাগুলোর অন্যতম ছিল সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা। এই ভিতের সুবাদেই বাংলাদেশ বদ্বীপ মহাপরিকল্পনা-২১০০ এর মতো বিশদ রূপরেখা প্রণয়নের সুযোগ পাচ্ছি আমরা।

সাগর, তুমি কার?

সমুদ্রবিষয়ক আইনের প্রাথমিক ও প্রধান লক্ষ্য হলো সাগরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা। এই আইনের মাধ্যমে একটি উপকূলীয় রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সমুদ্রসীমা এবং সেই সমুদ্রসীমায় দেশটির অধিকার ও দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট হয়। আধুনিক যুগের গোড়ার দিকে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের রাজারা স্থলের পাশাপাশি জলেও আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় লিপ্ত থাকতেন। এতে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন সাম্রাজ্যের মধ্যে সংঘর্ষ লেগে যেত। এই দ্ব›দ্ব নিরসনে সাম্রাজ্যগুলোর সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সমুদ্র কারো নিয়ন্ত্রণে থাকা যুক্তিসংগত কি না, কিংবা যুক্তিসংগত হলে কোন অংশের নিয়ন্ত্রণ কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, সেই প্রশ্ন তৈরি হয়।

এই বিষয়ে ডাচ আইনজ্ঞ হুগো গ্রোশিয়াস ১৬০৯ সালে একটি বই প্রকাশ করেন, যার নাম মেয়ার লিবেরাম। এই শব্দযুগলের অর্থ মুক্ত সাগর বা সাগরের স্বাধীনতা। বইটিতে হুগো বলেন, সাগর কারও একক নিয়ন্ত্রণে থাকা উচিত নয়। বরং সাগরে সম্পদ সন্ধান, আহরণ ও বাণিজ্যের সুযোগ সবার জন্য সমান থাকা উচিত। মেয়ার লিবেরামে দুটি মূলনীতির কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো গভীর সাগর ব্যবহারের অধিকার সব দেশেরই থাকা উচিত এবং কোনো দেশ এর মালিকানা দাবি করতে পারবে না। মেয়ার লিবেরামের এই মুক্ত সাগরনীতি পরবর্তী চারশ বছর সমুদ্রবিষয়ক আইনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।

অবশ্য মেয়ার লিবেরামের কয়েক দশকের মধ্যে এর বিপরীত আরেকটি নীতি আত্মপ্রকাশ করে। ১৬৩৫ সালে ব্রিটিশ পণ্ডিত জন সেলডেন প্রকাশ করেন বই মেয়ার ক্লসাম, যার অর্থ সীমাবদ্ধ সাগর। রোমান যুগের মেয়ার নস্ট্রাম (আমাদের সাগর) নীতির সাথে জন সেলডেনের নীতির অনেকটা মিল ছিল। সেলডেন বলেন, ভূপৃষ্ঠের বেশিরভাগ অংশই যেমন কোনো-না কোনো রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তেমনি সাগরও নিয়ন্ত্রণাধীন থাকা উচিত। এর পেছনে তিনি যুক্তি দেখান, যেহেতু উপকূলীয় দেশগুলোকে জলদস্যুতার মতো সামুদ্রিক ঝুঁকির মোকাবিলা করতে হয়, সেহেতু এসব দেশের উপকূল-সংলগ্ন সমুদ্রে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অধিকার রয়েছে।

যা-ই হোক, মেয়ার লিবেরাম ও মেয়ার ক্লসাম এই দুই বিপরীত তত্তে¡র কারণে সমুদ্রে উপকূলীয় রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌম অধিকার নিয়ে চলে আসা দীর্ঘদিনের বিসংবাদ থেকেই গেল। পরবর্তী শতকগুলোয় এই সংকট নিরসনে বেশ কয়েক দফায় উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৮৫৬ সালের প্যারিস ডিক্লেয়ারেশনে প্রাইভেটিয়ারিং, নিরপেক্ষ পতাকা, নিরপেক্ষ পণ্য নির্ধারণসহ আরও কয়েকটি ইস্যুতে দ্বন্দ্ব নিরসনে কিছু সিদ্ধান্ত আসে। তবে সেই সিদ্ধান্তগুলো কোনো আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা নয়। কেবল ক্রাইমিয়া যুদ্ধে (১৮৫৩-১৮৫৬) বিবদমান দেশগুলোই এই চুক্তির প্রতি সমর্থন জানায়।

বিশ শতকের শুরুর দিকে বিভিন্ন দেশ তাদের সামুদ্রিক খনিজ ও মৎস্যসম্পদের মজুদ ও সর্বোচ্চ আহরণ নিশ্চিতকরণ এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণে তৎপরতা শুরু করে। এ লক্ষ্যে দেশগুলো নিজেদের সমুদ্রসীমারে পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা চালাতে থাকে। ১৯২০-এর দেশগুলো তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে তৎকালীন লিগ অব নেশনসে ধরনা দিতে থাকে। এই তৎপরতার ফল হিসেবে আসে বিখ্যাত ক্যানন শট রুল, যে আইনের মাধ্যমে উপকূলীয় দেশগুলোকে তটরেখা থেকে তিন নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সমুদ্রাঞ্চলে সার্বভৌম অধিকার দেওয়া হয়। আইনে বলা হয়, উপকূলীয় তটরেখা থেকে নিক্ষেপ করা কামানের গোলা সাগরে যত দূর যায়, সেই দূরত্ব পর্যন্ত অঞ্চল টেরিটোরিয়াল ওয়াটার হিসেবে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে একটি প্রমাণ দূরত্ব হিসেবে তিন নটিক্যাল মাইল গ্রহণ করা হয়। এই কামানের গোলার অতিক্রান্ত দূরত্বের কারণেই আইনটিকে ক্যানন শট রুল বলা হয়।

বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বিভিন্ন পেক্ষাপটে সাগরে দেশগুলোর সার্বভৌম অধিকার বৃদ্ধির দাবি জোরালো হতে থাকে। এ সময় সমুদ্রে মৎস্য আহরণকারী জাহাজগুলোর কাছ থেকে টোল আদায়, সামুদ্রিক খনিজ সম্পদ আহরণ ইত্যাদিকে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক বিবেচনা করা শুরু হয়। ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাদের টেরিটোরিয়াল জোনের বাইরে মহীসোপান অঞ্চলের সমুদ্র ও এর তলদেশের সব প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর অধিকার দাবি করে ঘোষণা দেয়। সেই প্রথম কোনো দেশ মহীসোপান অঞ্চলে নিজেদের অধিকারের দাবি জানায়। এর মাধ্যমে গভীর সাগরের সর্বজনীন ব্যবহার নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়। এই বিতর্ক আরও জোরালো হয়, যখন লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের দেখানো পথে হাঁটতে শুরু করে। তারা ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সমুদ্র অঞ্চলকে কয়েকটি জোনে ভাগ করে সেখানে নিজেদের অধিকারের দাবি জানায়। জোনগুলোর মধ্যে রয়েছে, টেরিটোরিয়াল সি, এপিকন্টিনেন্টাল সি, প্যাট্রিমোনিয়াল সি ইত্যাদি। ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে দাবি জানানোর এই ধারা চলছিল।

১৯৭১ সালে কেনিয়া প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে উপকূল থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সমুদ্র এলাকাকে একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইজেড) হিসেবে নির্ধারণের সর্বজনীন আইন প্রস্তাব করে। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সমুদ্র বিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি কনভেনশন গ্রহণে সম্মতি জানায়। শেষ পর্যন্ত ১৯৮২ সালে ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য সি (আনক্লস-থ্রি) গৃহীত হয় এবং ১৯৯৪ সালে তা বাস্তবায়িত হয়।

সমুদ্র অধিকার ও নৌ-আধিপত্যের পূর্বাপর

হিমালয়, কারাকোরাম ও হিন্দুকুশ এই তিন পর্বতশ্রেণি অতন্দ্র প্রহরীর মতো আগলে রেখেছে ভারতবর্ষকে। আর এই বিশাল ভূখণ্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অনাদিকাল থেকে প্রবহমান তিন বৃহৎ নদী পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার অববাহিকায় গড়ে ওঠা এক সমৃদ্ধ জনপদ এই বাংলা। হাজারো নদী আর বঙ্গোপসাগরের আশীর্বাদপুষ্ট এ অঞ্চলের শান্তি ও সমৃদ্ধিতে চিরকাল অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে নৌ-আধিপত্য।

‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪’ এর সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

ইতিহাস বলে, প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে সিন্ধু অববাহিকায় গড়ে ওঠা হরপ্পা সভ্যতার কালেই সমুদ্রপথে বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ ও বাণিজ্য বিস্তার ঘটে ভারতবর্ষের। প্রায় সমসাময়িক সময়ে এ অঞ্চলে নৌশক্তি চর্চারও বর্ণনা মেলে ইতিহাসের পাতায়। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের ভারতবর্ষ আক্রমণ ও বাংলার সীমান্ত থেকে নৌবহরসমেত ফিরে যাওয়ার কথা যেমন জানা যায়, তেমনি প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে বাংলার বুকে মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন বংশের রাজত্বকালেও নৌশক্তি সুসংহতকরণ প্রতিযোগিতার প্রমাণ পাওয়া যায়।

মধ্যযুগের প্রারম্ভে যখন বাংলায় প্রথম মুসলিম শাসকদের আবির্ভাব ঘটে, তখন বাংলাকে স্বাধীন সালতানাত ঘোষণার পাশাপাশি উন্নত নৌশক্তির জোরে বাংলা অভিমুখী দিল্লির আগ্রাসন বারবার প্রতিহত করেছেন এই অঞ্চলের প্রতাপশালী জমিদাররা। আবার বাংলায় মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নেপথ্যেও রয়েছে বাংলা সালতানাত ও বারো ভুঁইয়ার নৌ-প্রতিপত্তির অবসান।

সমুদ্রপথে একের পর এক ইউরোপীয় বণিকগোষ্ঠীর আগমনে বাংলার ইতিহাস মোড় নেয় ভিন্ন দিকে। আঠারো শতকে নৌশক্তিধর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলা তথা ভারতবর্ষে শুরু হয় ইংরেজ ঔপনিবেশিক যুগ। ব্রিটিশরাজের হাত ধরে ইতিহাসের বহু পথ পাড়ি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় রয়েল ইন্ডিয়ান নেভি। ইংরেজ নিয়ন্ত্রিত এই নৌবাহিনীতে কাজ করেছে হাজার হাজার বাঙালি।

কালক্রমে অবসান ঘটে ব্রিটিশ শাসনের। ভারতবর্ষ বিভক্ত হয় ভারত ও পাকিস্তান এই দুই দেশে। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ছেড়ে যাওয়ার সময় রয়েল ইন্ডিয়ান নেভি বিলুপ্ত হয়ে জন্ম নেয় ভারতীয় ও পাকিস্তান নৌবাহিনী। বৈষম্যের বেড়াজাল ভাঙতে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। একই সঙ্গে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।

বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনাময় সম্পদের আধার সার্বভৌম একটি দেশ। এই সম্পদের বড় একটি অংশ মজুদ বাংলাদেশের দক্ষিণের সীমানা নির্ধারণকারী বঙ্গোপসাগরে। বিশাল এই জলরাশির প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ন্যায্যতাভিত্তিক আহরণ নিশ্চিতকরণে প্রয়োজন সঠিক সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, যে কাজে স্বাধীনতা-পরবর্তী নবীন বাংলাদেশকে বেশ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। এ বিষয়ে পরিষ্কার কোনো আইনি পরিকাঠামো ছিল না সে সময়। এ কারণে নিজেদের সমুদ্রাঞ্চলের ওপর সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় একটি বিশদ আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট সেই প্রয়োজনীয়তারই প্রতিফলন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার দেশের সমুদ্রসম্পদের টেকসই ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছে। এর সঙ্গে দেশের সমুদ্র বাণিজ্যের প্রসার তো বরাবরই সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকারের বিষয়। এ দুটি বিষয়ই নিশ্চিত করতে হলে সমুদ্র নিরাপত্তার কোনো বিকল্প নেই। অন্য কোনো দেশ যেন আমাদের সমুদ্রসীমায় প্রবেশ করে সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যেতে না পারে, সেটি নজরদারিতে রাখতে হবে। সে সাথে দেশের জলসীমায় আসা বিদেশি জাহাজগুলোর নিরাপত্তার বিষয়টিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এসব নিরাপত্তামূলক কার্যক্রমের জন্য বাংলাদেশ নৌবাহিনীসহ আইন প্রয়োগকারী অন্যান্য সংস্থা সদাতৎপর। কিন্তু নিরাপত্তা নজরদারির কার্যক্ষেত্র নির্ধারণের জন্য তো নিজেদের সমুদ্রসীমা সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে জানতে হবে। টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট সেই সমুদ্রসীমাই সংজ্ঞায়িত করেছে।

বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের জন্য কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

বিশ্বের সবচেয়ে বড় উপসাগর বঙ্গোপসাগর ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের একটি প্রধান অংশ। পাশাপাশি এটি ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের সংযোগকারী হওয়ায় আঞ্চলিক ও কৌশলগতভাবে এর গুরুত্ব অনেক। মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া এমনকি স্থলবেষ্টিত ভুটান ও নেপালও বাণিজ্যিকভাবে এই জলরাশির সুবিধাভোগী। বঙ্গোপসাগর শুধু একটি সাগর নয়, বরং এটি বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও করপোরেট স্বার্থের প্রাণভোমরা।

সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্র অর্থনীতির জোয়ার ও ভূরাজনৈতিক পটপরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থনৈতিক গুরুত্বের কথা চিন্তা করলে দেখা যায়, বঙ্গোপসাগর শুধু ঐশ্বমণ্ডিত এক বিশাল লবণাক্ত জলরাশিই শুধু নয়, এটি ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ায় সম্ভাবনাময় একটি অবলম্বনও। এটি জীববৈচিত্র্যেপূর্ণ একটি বিশাল জলাধার। প্রবাল, মৎস্য প্রজনন অঞ্চল ও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল এই বৈচিত্র্য আরও বাড়িয়েছে।

সামুদ্রিক জলসীমা একটি দেশের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তা ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিলের একটি বক্তব্যেই স্পষ্ট। তিনি বলেছিলেন, যদি উন্মুক্ত সাগর ও ইউরোপ এই দুয়ের মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে ব্রিটেন অবশ্যই উন্মুক্ত সাগরকেই বেছে নেবে।

আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও ভূরাজনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। এটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত, যেখানে রয়েছে দুটি বিশাল অর্থনৈতিক জোট সার্ক ও আসিয়ান। স্বাভাবিকভাবেই এই দুই জোটের কৌশলগত পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ জুড়ে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। এই জলরাশির উপকূলবর্তী দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি প্রায় সাড়ে ৭ লাখ কোটি ডলার। আর সুবিধাভোগী দেশগুলো জিডিপিতে যোগ করেছে ৮১ হাজার কোটি ডলারের বেশি। এই অঞ্চলের সার্কভুক্ত দেশগুলোর আন্তঃবাণিজ্য তাদের মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের তুলনায় ৫ শতাংশ, আর আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর ক্ষেত্রে এ হার ২৫ শতাংশ।

‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪’ এর সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য প্রদান করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনার কারণে বাংলাদেশের কাছে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বঙ্গোপসাগর। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ধনী দেশগুলোর তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি হবে অনেক ধীর। ফলে মহামারি-পরবর্তী বিশ্বের ধনী ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বৈষম্য অনেক বেড়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্যে সমুদ্রসম্পদ আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধি করাটা মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে ওঠায় সহায়ক ভূমিকা রাখবে। দেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা হলো তৈরি পোশাক রপ্তানি। এর মাধ্যমে বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো আয় হয় বাংলাদেশের। এদিকে সামুদ্রিক সম্পদের মধ্যে কেবল মাছ রপ্তানি থেকেই বছরে ১০-১২ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। অন্যান্য সম্পদ এর সঙ্গে যোগ হলে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা আরও বেড়ে যাবে।

অধিকার আদায়ে বাংলাদেশের বন্ধুর পথচলা

মেরিটাইম বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী নেতৃত্বের নিদর্শন হলো টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪। এর মাধ্যমে সমুদ্রবিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়নের আগেই নিজস্ব আইনপ্রণেতা গুটিকয়েক দেশের অন্যতম হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। এই অ্যাক্টে বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় তটরেখা থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় সমুদ্রসীমা, ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইজেড) ও ৩৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপান অঞ্চল হিসেবে দাবি করা হয়েছে। এই দাবিকৃত অঞ্চলের অধিকার বুঝে নিতে ২০০৯ সালের জুলাই এবং ২০১০ সালের জানুয়ারি ও মার্চে মিয়ানমারের সাথে তিন দফায় বৈঠক করেও কোনো সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এছাড়া ২০০৯ সালের মার্চ ও ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ভারতের সাথেও সমুদ্রসীমা নিয়ে দুই দফা বৈঠক হয়। এতে কোনো স্থায়ী সমাধান ছাড়াই বাংলাদেশের দাবিগুলো উপেক্ষিত থেকে যায়। বৈঠকগুলোয় বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন ভৌগোলিক ও ভূতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্যগুলোকে আমলে নিয়ে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের দাবি জানায়। অন্যদিকে মিয়ানমার ও ভারত সমদূরত্বের ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পক্ষে মত দেয়। সমুদ্রসীমা আইন এড়িয়ে দেশ দুটি বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যার বড় অংশকে নিজেদের বলে দাবি করে।

২০০১ সালের জুলাইয়ে আনক্লসের প্রতি অনুসমর্থন জানায় তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। ওই সময় থেকে পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০১১ সালের জুলাই নাগাদ মহীসোপানের দাবি জাতিসংঘের কাছে জমা দেওয়ার নিয়ম। সে লক্ষ্যে ২০১০ সালের মার্চে প্রথমবারের মতো বঙ্গোপসাগরে প্রয়োজনীয় সিসমিক ও ব্যাথিমেট্রিক জরিপের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়।

ভারত ও মিয়ানমার জাতিসংঘের কাছে তাদের মহীসোপানের দাবি পেশ করার পর বাংলাদেশের স্বার্থ হুমকির মুখে পড়ে। উভয় দেশের দাবি অনুযায়ী বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকা ১৩০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ত এবং বাংলাদেশের দাবি করা ইইজেডের বড় অংশ দেশ দুটির নিয়ন্ত্রণে চলে যেত। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার দ্রুতগতিতে এই বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর আনক্লসের অধীনে ভারত ও মিয়ানমারকে সালিশি নিষ্পত্তির নোটিস দেয়। এই উদ্যোগ গ্রহণের পর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার মামলাটি আনক্লসের আওতায় প্রতিষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ল অব দ্য সি (ইটলস) তে এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার মামলাটি স্থায়ী সালিশি আদালতে (পিসিআই) প্রেরণ করা হয়।

আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিয়ে ২০১২ সালের ১৪ মার্চ ইটলসের এবং বাংলাদেশ-ভারত বিরোধ নিয়ে ২০১৪ সালের ৭ জুলাই পিসিআইয়ের রায় বাংলাদেশের অনুকূলে যায়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চলের সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণ বুঝে পায়। তিন দশকের বেশি সময়ে বিরোধ নিষ্পত্তিতে ইটলসের বিচারিক এখতিয়ার মেনে নিতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে বিশেষ মতৈক্য হয়। এই ঐতিহাসিক রায় কেবল বাংলাদেশের অধিকারই প্রতিষ্ঠা করেনি, বরং বিশ্বসভায় বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে নতুন মর্যাদার আসনে অভিষিক্ত করেছে।

সুবর্ণজয়ন্তী : চিরভাস্বর উদ্যোগকে স্মরণের উপলক্ষ

টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট ১৯৭৪ প্রণয়নের ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। এ উপলক্ষে ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা, দেশি-বিদেশি কূটনীতিক, সমুদ্র খাতের বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধনী সেশনের পর সমুদ্রবিষয়ক সংস্থা, গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে ফিফটি ইয়ারস সেলিব্রেশন অব টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪ : সিগনিফিকেন্স অ্যান্ড ওয়ে ফরোয়ার্ড শীর্ষক একটি সেমিনার সেশনের আয়োজন করা হয়।

উদ্বোধনী সেশনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। সেমিনারে মূল প্রতিপাদ্যের ওপর বক্তব্য উপস্থাপন করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমুদ্রবিষয়ক ইউনিটের সচিব রিয়ার এডমিরাল (অব.) মো. খুরশীদ আলম। প্যানেল আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. লাইলুফার ইয়াসমিন ও অধ্যাপক রাশেদ উজ জামান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রিয়ার এডমিরাল এম মুসা।

প্রধান অতিথির বক্তৃতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনাদর্শের একটি বিশেষ দিক ছিল সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সমুদ্রভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এই রাজনৈতিক দর্শনের প্রকাশ বঙ্গবন্ধুর জীবৎকালে বহুবার হয়েছে। আর ৫০ বছর পরও যখন তার প্রণীত টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট সমানভাবে প্রাসঙ্গিক থাকে, তখন বোঝা যায় এটি কতটা বাস্তবভিত্তিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিল।

‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪’ এর সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন অনুষ্ঠানে স্টল পরিদর্শন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

প্রধানমন্ত্রী বলেন, টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্টের ৫০ বছর পূর্তির এই মাহেন্দ্রক্ষণ আমাদের আইনটির তাৎপর্যের কথা বিশেষভাবে উপলব্ধি করায়। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এটি নিছক একটি আইন বা দলিল নয়, বরং একটি ভিত্তিপ্রস্তর, যা আমাদের সার্বভৌমত্বকে আরও দৃঢ় করেছে, আমাদের সামুদ্রিক সীমাকে আরও সুস্পষ্ট করেছে এবং এই অঞ্চলে আমাদের অধিকারকে সুসংহত করেছে। এই আইনের মাধ্যমে আমরা আমাদের সামুদ্রিক সম্পদ রক্ষা, সামুদ্রিক সীমানাভুক্ত এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ বৈশ্বিক মঞ্চে আমাদের অধিকার নিশ্চিত করার সক্ষমতা অর্জন করেছি।

বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং তার মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সমুদ্র অগ্রযাত্রার বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের বিষয়ে আলোকপাত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট প্রণয়নের দীর্ঘ আট বছর পর ১৯৮২ সালে আনক্লস-থ্রি প্রণয়নের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সকল দেশের জন্য একটি সমন্বিত দিকনির্দেশনামূলক বিধি প্রণয়ন করে। তবে আনক্লস-থ্রি প্রণয়নের পর বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য তৎকালীন সরকারসমূহ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে সমুদ্রসীমা ভাগাভাগি বিষয়ে অস্পষ্টতা ছিল। পরবর্তীতে বর্তমান সরকার বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির আলোকে বন্ধুত্বপূর্ণ উপায়ে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা সম্পর্কিত অস্পষ্টতা দূরীভূত করে। আমরা অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি এবং সফলভাবে মোকাবিলাও করেছি। এর ফলস্বরূপ ২০১২ ও ২০১৪ সালে বাংলাদেশ যথাক্রমে মিয়ানমার ও ভারতের সাথে সামুদ্রিক সীমানা নিষ্পত্তি করে।

প্যানেল সেশনে আলোচকরা বলেন, বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের তৃতীয় প্রতিবেশী। সমুদ্রপথে দক্ষিণ এশিয়ার গেটওয়ে হয়ে ওঠার সব সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। সমুদ্র বিজয়ের পর আমাদের জন্য সুযোগ এসেছে সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানোর। সমুদ্র বাণিজ্য, বন্দর ব্যবস্থাপনা, মৎস্য ও খনিজ সম্পদ আহরণ, ট্রান্সশিপমেন্ট-ট্রানজিট সেবা, অফশোর প্রকল্প ইত্যাদি বাংলাদেশের সুনীল অর্থনৈতিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠতে পারে।

আলোচকরা সুনীল অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে টেকসই করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সমুদ্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেন। তারা আরও বলেন, এই যে আমরা বঙ্গোপসাগরে আমাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে পরিকল্পনা সাজাতে পারছি, তার নেপথ্যে সবচেয়ে বড় অবদান রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী উদ্যোগ টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্টের। আইনটির সুবর্ণজয়ন্তীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমাদের সমুদ্র সার্বভৌমত্বের সুরক্ষা ও সুনীল অর্থনীতির সুরক্ষায় আরও বেশি প্রত্যয়ী হওয়ার শপথ গ্রহণ করতে হবে।

উপসংহার

টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট বাংলাদেশের নিজস্ব জলসীমায় সুশাসন প্রতিষ্ঠার আইনি কাঠামো তৈরি করে দিয়েছে। সামুদ্রিক কর্মকাণ্ড নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ও কার্যপরিধির একটি রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে এই অ্যাক্টে। দেশের সমুদ্র খাতে প্রযুক্তি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে দীর্ঘমেয়াদি সমুদ্রনীতি প্রণয়ণের জন্য যে মৌলিক ভিত্তি অনিবার্য ছিল, অ্যাক্টটি সেই ভিত্তি দিয়েছে। এছাড়া মেরিটাইম খাতে যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও সম্ভাবনা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আইনগত ভিত্তিও প্রতিষ্ঠিত করেছে এই অ্যাক্ট। দেশের সমুদ্র স্বার্থের সুরক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রভাব জোরদারের সুযোগ করে দিয়েছে টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট। ইইজেড ও মহীসোপান অঞ্চলে মৎস্য আহরণ ও সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সুবিধাদি আদায়ে দিয়েছে পথনির্দেশনা। জাতির পিতার দূরদর্শী নেতৃত্বে পাঁচ দশক আগে প্রণীত এই অ্যাক্টের প্রাসঙ্গিকতা এখনো বিদ্যমান। এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও বৈশ্বিকভাবে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান তৈরিতে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছে। আন্তর্জাতিক আদালতে রায়ের মাধ্যমে ২০১২ সালে মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্র বিজয়ের নেপথ্য শক্তি ছিল বঙ্গবন্ধুর টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্ব। এই বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্থলভাগের বাইরে জলসীমাতেও আরেক বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে।

সম্পাদকীয়

সময়ের চেয়েও এগিয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; ব্যতিক্রম ছিলেন না নদী ও সমুদ্রকেন্দ্রিক উন্নয়ন নিয়ে তাঁর ভাবনা ও প্রজ্ঞায়। নদী ও সমুদ্র সম্পদের উন্নয়নে সাহসিকতা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় বাংলাদেশের মেরিটাইম ভিশনের স্থপতি। পাঁচ দশক আগে তিনি টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪ প্রণয়ন করেন, যা পরবর্তীতে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের আঞ্চলিক জলসীমা ও সামুদ্রিক অঞ্চল নির্ধারণে প্রধান রূপকল্প হিসেবে ভূমিকা পালন করে। এই আইন সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য আইনি কাঠামোর পাশাপাশি সমুদ্র ও সামুদ্রিক সম্পদের ওপর অধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তৈরি করে। সামুদ্রিক দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও সমুদ্র বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্রেও এটি একটি রূপরেখা সৃষ্টি করে। এই আইনটি প্রতিবেশী দেশসমূহের সাথে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমুদ্রসম্পদের শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের পথপ্রদর্শক ছিল।

বঙ্গবন্ধু এ অঞ্চলের সমুদ্র আইনের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনসহ বিভিন্ন ঝুঁকি মোকাবিলায় শত ব্যস্ততা ও প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি সমুদ্রের উন্নয়নে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক সম্পদের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সমুদ্রসম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের জন্য বঙ্গবন্ধু সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদের ২ নম্বর ধারা অনুযায়ী সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪ প্রণয়ন করেন। এই সমুদ্র আইনের সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি আমাদের অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪ প্রণয়নের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী সেশনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনাদর্শের একটি বিশেষ দিক ছিল সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সমুদ্রভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এই রাজনৈতিক দর্শনের প্রকাশ বঙ্গবন্ধুর জীবৎকালে বহুবার হয়েছে। আর ৫০ বছর পরও যখন তার প্রণীত টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট সমানভাবে প্রাসঙ্গিক থাকে, তখন বোঝা যায় এটি কতটা বাস্তবভিত্তিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিল। একই সাথে আয়োজিত সেমিনারে আলোচকরা বলেন, বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের তৃতীয় প্রতিবেশী। সমুদ্রপথে দক্ষিণ এশিয়ার গেটওয়ে হয়ে ওঠার সব সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। সমুদ্র বিজয়ের পর আমাদের জন্য সুযোগ এসেছে সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানোর। সমুদ্র বাণিজ্য, বন্দর ব্যবস্থাপনা, মৎস্য ও খনিজ সম্পদ আহরণ, ট্রান্সশিপমেন্ট-ট্রানজিট সেবা, অফশোর প্রকল্প ইত্যাদি বাংলাদেশের সুনীল অর্থনৈতিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠতে পারে।

১৯৭৪ সালে প্রণীত আইনটি বাংলাদেশের উপকূলীয় সামুদ্রিক সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা, জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, উপক‚লীয় অঞ্চল ব্যবস্থাপনা, সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা, সমুদ্র পরিবহন, মৎস্যসম্পদ ও সামুদ্রিক সুশাসনের মতো বিষয়গুলো নির্ধারণ করা সহজতর করেছে। সবচেয়ে বড় কথা, আইনটি বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণাধীন সমুদ্রাঞ্চলের বিভিন্ন জোনের সীমা নির্ধারণ, অধিকারের ব্যপ্তি, সুরক্ষা ও নিরাপত্তার রোডম্যাপ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। এটি বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের কতখানি অংশে সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, সেই অংশে দেশের স্বার্থ কীরূপ হবে এবং এই স্বার্থের সুরক্ষা হবে কীভাবেÑএসব বিষয় নির্ধারণে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল। এতে করে বাংলাদেশের জন্য স্বাধীনভাবে নিজেদের সমুদ্রসীমার ব্যবস্থাপনার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। এক কথায় বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চলে সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা, বহির্বিশে^র সাথে নিরবচ্ছিন্ন বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপন তথা দেশের সামুদ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির ভিত রচনা করেছিল এই আইন। সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্র অর্থনীতির জোয়ার ও ভূরাজনৈতিক পটপরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থনৈতিক গুরুত্বের কথা চিন্তা করলে দেখা যায়, বঙ্গোপসাগর শুধু ঐশ^র্যমণ্ডিত এক বিশাল লবণাক্ত জলরাশিই শুধু নয়, এটি ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ায় সম্ভাবনাময় একটি অবলম্বনও। সুবর্ণজয়ন্তীতে এই সমুদ্র আইন নিয়ে বিস্তারিত রয়েছে প্রধান রচনায়।

প্রিয় পাঠক, আমরা চাই এ দেশের মেরিটাইম চর্চাকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড় করাতে। বৈচিত্র্যময় আঙ্গিকে, সমৃদ্ধ কলেবরে বন্দরবার্তার পথচলা বাংলাদেশের মেরিটাইম খাতের বিকাশে আরও সহায়ক হবে সেই প্রত্যাশা। সবাইকে শুভেচ্ছা।

২০২৪ সালে মেরিটাইম বিশ্বসংকট কাটানোর পাশাপাশি পরিবেশ ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়াই লক্ষ্য

নানা ঘটন-অঘটনের মধ্য দিয়ে কেটে গেল আরও একটি বছর। ২০২৩ সালজুড়ে চলমান ভূরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জেরে গোটা বিশ্ব টালমাটাল সময় পার করেছে। বিগত বছরের সংকট সঙ্গে নিয়েই নতুন বছরে পদার্পণ করেছে বিশ্ববাসী। মন্দার শঙ্কায় থাকা যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনীতি তাই ভাবিয়ে তুলছে গোটা বিশ্বকে। এমন অবস্থায় চলতি বছর কেমন যাবে তা নিয়ে বিস্তর জল্পনা-কল্পনা চলছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির অন্যান্য খাতের মতো মেরিটাইম খাত নিয়েও সংশ্লিষ্টদের আগ্রহের কমতি নেই।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ পণ্য সমুদ্র পথে পরিবহন হয়। এর ফলে বৈশ্বিক বাজার থেকে শুরু করে সাধারণ ক্রেতার নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম; সকল কিছুর ওপর মেরিটাইম খাতের প্রভাব অনিবার্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, চলতি বছর ভূ‚রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী ৬০টির বেশি দেশে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন, পরিবেশবান্ধব নিয়ম-নীতির প্রয়োগ, ব্যাপক যান্ত্রিকীকরণ, ডিজিটালাইজেশন, কনটেইনার জাহাজের চাহিদা-জোগানের ভারসাম্যহীনতা, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এবং পানামা খালের দীর্ঘমেয়াদি খরা মেরিটাইম খাতে প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করবে। ২০২৪ সালে মেরিটাইম খাতে সুদিন ফিরিয়ে আনতে অংশীজনদের তাই অর্থনৈতিক মন্দা, মূল্যস্ফীতি এবং অতি সক্ষমতার প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে হবে।

কেমন যাবে নতুন বছর

প্রকৃতির নির্ধারিত নিয়মে পুরনোকে পেছনে ফেলে পৃথিবীতে নতুন বছরের আগমন ঘটেছে। যুদ্ধের দামামার তালে উত্তাল ২০২৪ সাল কীভাবে কাটবে তা শতভাগ নিশ্চয়তার সাথে বলা অসম্ভব। তবে বরাবরের মতোই নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান চলতি বছরের বৈশ্বিক অর্থনীতি সম্পর্কে পূর্বানুমান ব্যক্ত করেছে। দেশে দেশে চলমান যুদ্ধের কারণে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি, মার্কিন ও চীনা অর্থনীতির মন্থর গতি, বিভিন্ন দেশে ক্রমবর্ধমান সুদহার, চীনে নতুন করে করোনাভাইরাস বিস্তারসহ নানা কারণে ২০২৪ সালে বিশ্ব অর্থনীতি বিগত বছরের তুলনায় খারাপ সময় কাটাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গত বছর অক্টোবরে প্রকাশিত ইকোনমিক আউটলুকে ২০২৪ সালের প্রবৃদ্ধি কমিয়েছে আইএমএফ। চলতি বছর ২ দশমিক ৯ শতাংশ ধীরগতির বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ব্যক্ত করেন সংস্থাটির প্রধান অর্থনীতিবিদ পিয়ের অলিভিয়েঁ গোরিনকাস। আইএমএফের তথ্যমতে, টানা তৃতীয় বছরের মতো বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হওয়ায় ২০২৪ সালে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ দেশ আর্থিক মন্দার কবলে পড়বে। সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা জানান, যেসব দেশ সরাসরি মন্দার কবলে পড়বে না, তাদের পক্ষেও এর প্রভাব এড়ানো অসম্ভব।

এদিকে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, করোনা অতিমারির পর চলতি বছর সবচেয়ে কম বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে। ২০২৪ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৪ শতাংশ হওয়ার পূর্বাভাস ব্যক্ত করেছে বিশ্বব্যাংক। ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দা এবং ২০২০ সালের অতিমারির পর এ বছরের সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধিই সবচেয়ে কম। অর্ধদশকের হিসাবে ২০২০ থেকে ২০২৪ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি বিগত ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কমবে। দেশে দেশে সরকার যদি বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে পারে তবে চলমান নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব প্রশমিত করা সম্ভব বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক।

চলতি বছর বিশ্বের প্রধান দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের অর্থনীতিতে মন্থরতা বিরাজ করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। মূল্যস্ফীতির প্রভাব, রপ্তানি হ্রাস, বেকারত্ব বৃদ্ধি, আবাসন ব্যবসায় ধস সর্বোপরি করোনা অতিমারির কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীনের অর্থনীতি গতিহীন হয়ে পড়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে চীনে ৫ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়, যা বৈশ্বিক জিডিপিতে ১৯ শতাংশ অবদান রেখেছে। গোল্ডম্যান স্যাকস ও মর্গান স্ট্যানলির মতে, ২০২৪ সালে চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। চীনা অর্থনীতির এই মন্থরতা নতুন বছরে গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকেই প্রভাবিত করবে।

অন্যদিকে ২০২৩ সালে প্রত্যাশার চেয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি (২ দশমিক ৬ শতাংশ) অর্জন করলেও চলতি বছর সেই ধারা অব্যাহত রাখতে ব্যর্থ হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্র ১ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। অন্যদিকে ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশ এবং বেকারত্ব ৪ শতাংশ থাকবে বলে পূর্বাভাস ব্যক্ত করেছে জেপি মর্গান। এদিকে নতুন বছরে ইউরোজোনের মূল্যস্ফীতি গত বছরের মতো দ্রæত কমবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অর্থনীতিবীদদের মতে, আগামী কয়েক মাস এই অঞ্চলে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকবে এবং বছরের শেষ প্রান্তিকে অর্থনৈতিক সংকোচনের শঙ্কা রয়েছে। তবে ২০২৪ সালে মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বেশ কিছু অর্থনীতিবীদ। মূল্যস্ফীতির চাপ কমায় এবং মজুরি বৃদ্ধি পাওয়ায় চলতি বছর ইউরোজোনের অর্থনীতি কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার করতে আশাবাদী অর্থনীতিবিদরা।

২০২৪ সালকে সুপার ইলেকশন ইয়ার হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ২৭টিসহ বিশ্বের ৬০টির বেশি দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনকে সামনে রেখে এসব দেশের অর্থব্যবস্থা ও নিয়ম-নীতিতে নানা রকম পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বিজয়ী প্রার্থীরা দায়িত্ব গ্রহণের পর ঋণে ছাড় প্রদান, বাণিজ্য, বিদেশি বিনিয়োগ, শুল্ক মওকুফ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশসহ গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ জনগণ অর্থাৎ প্রায় ২০০ কোটি ভোটার এসব নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবে। উল্লেখ্য, বৈশ্বিক উৎপাদনের ৬০ শতাংশ আসে এসব দেশ থেকে। এতে বিশ্বজুড়ে বয়ে যাওয়া নির্বাচনের ঢেউ নতুন বছরে বৈশ্বিক অর্থনীতিকে গভীরভাবে আন্দোলিত করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডানপন্থী রাজনীতিবীদরা নির্বাচনে জয়লাভূ করলে  বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি আরও হ্রাস পাবার আশঙ্কা রয়েছে।

মেরিটাইম খাতের পূর্বাভাস

সমুদ্র পরিবহন সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ তথা মেরিটাইম খাত বৈশ্বিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূ‚মিকা পালন করে। গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতে মেরিটাইম খাতের প্রভাব অনেকটা ডমিনো ইফেক্টের মতো। সমুদ্র পরিবহন কোনো পর্যায়ে বাধাগ্রস্ত হলে সাপ্লাই চেইন, জ্বালানি মূল্য, পণ্যের জোগান ও দাম সবকিছুর ওপরই সেটার প্রভাব পড়ে। এর ফলে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান, বীমা সংস্থা থেকে শুরু করে সাধারণ ব্যবসায়ী এমনকি ভোক্তারাও সমুদ্র পরিবহন খাতের ভূবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী।

প্রভাব ফেলবে অস্থিতিশীল ভূরাজনীতি

বর্তমানে চলতি শতকের ভূয়াবহতম যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া ভূ‚রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পালে জোর হাওয়া দিচ্ছে হামাস-ইসরায়েল সংঘর্ষ। বিশ্ববাসী যখন ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব অনেকটাই প্রশমিত করে এনেছে তখই নতুন করে আবার যুদ্ধের ডঙ্কা বেজে উঠল। ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে গোটা মধ্যপ্রাচ্যই ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

ইউক্রেন যুদ্ধের পর ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ কৃষ্ণসাগরে নৌ-চলাচল বিপদসঙ্কুল হয়ে পড়ে। গত বছর জুলাইয়ে ব্ল্যাক সি গ্রেইন ইনিশিয়েটিভূ ভেস্তে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে কৃষ্ণসাগরে অস্থায়ী মানবিক করিডোর চালু করে ইউক্রেন। বর্তমানে এই করিডোর দিয়ে ইউক্রেনে আটকে পড়া জাহাজ ও পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করছে। ইউক্রেনের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে প্রায় ১৫১টি জাহাজ এই মানবিক করিডোরটি ব্যবহার করেছে। ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো কৃষ্ণসাগরে নৌ-চলাচল স্বাভাবিক করতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। অন্যদিকে রাশিয়ায় গমের বাম্পার ফলনের জেরে ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবরে কৃষ্ণসাগরের ড্রাই বাল্ক রপ্তানি বছরওয়ারি হিসাবে ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, চলতি বছর এই পথে জাহাজ পরিচালনার ঝুঁকি বিগত দুই বছরের তুলনায় কমবে।

কৃষ্ণসাগরে নৌ-চলাচল স্বাভাবিক হবার আগেই বিশ্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ লোহিত সাগর নিয়ে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাস-ইসরায়েল সংঘর্ষের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার সূত্রপাত। পরবর্তীতে গাজায় নির্বিচার হামলার প্রতিবাদে লোহিত সাগরে ইসরায়েলি জাহাজের ওপর হামলা চালায় ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা। অন্যদিকে লোহিত সাগরে নিরাপদে পণ্যবাহী জাহাজের চলাচল নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য হুতিদের বিরুদ্ধে হামলা চালালে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করে। এমন অবস্থায় মায়েরস্ক ও হ্যাপাগ-লয়েডের মতো শীর্ষ শিপিং কোম্পানি সুয়েজ খালের পরিবর্তে উত্তমাশা অন্তরীপ বেছে নিয়েছে এবং অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে পণ্য পরিবহন করছে।

মেরিটাইম ডেটা অ্যানালাইসিস কোম্পানি সি-ইন্টেলিজেন্সের তথ্য অনুযায়ী, হুতি আক্রমণের কারণে লোহিত সাগরে পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় সাপ্লাই চেইন কোভিড-১৯ অতিমারির প্রথমদিকের চেয়েও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিস্থিতি এরই মধ্যে এতটা বিগড়ে গেছে যে বর্তমানে বাব এল-মান্দেবকে চলাচলের জন্য নিরাপদ ঘোষণা করলেও জাহাজের রুটিন বিন্যাস স্বাভাবিক হতে অন্তত দুই মাস সময় লেগে যাবে। নতুন বছরে লোহিত সাগরে সৃষ্ট এই জটিলতা তাই সমুদ্র পরিবহন খাতে মারাত্মক উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।

কঠোর হবে নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল

বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ ভূরাজনৈতিক দ্ব›েদ্ব আধিপত্য বিস্তারের অন্যতম হাতিয়ার। সমুদ্র পরিবহন খাতে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়া, ইরান, চীনের ভূ‚রাজনৈতিক মতবিরোধ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তীব্রতর হয়েছে। ইউক্রেনে সামরিক হামলা চালানোয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো রাশিয়ার ওপর কয়েক দফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। রাশিয়ার জ্বালানি তেলের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার জেরে ডার্ক ফ্লিট বা অজ্ঞাতসারে কার্যক্রম পরিচালনাকারী জাহাজের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে, যা গোটা বৈশ্বিক সমুদ্র পরিবহন খাতের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের জেরে শিপিং কোম্পানিগুলো লোহিত সাগরের পরিবর্তে উত্তমাশা অন্তরীপ দিয়ে পণ্য পরিবহন করছে

মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা ও বৈদেশিক নীতির স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করায় ২০২৩ সালের নভেম্বরে রাশিয়া ও উজবেকিস্তানের ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ তালিকায় যুক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগ। এছাড়া গত ১১ ডিসেম্বর শিপিং কোম্পানি, বীমাকারী প্রতিষ্ঠান এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কঠোরভাবে ‘নো ইওর কার্গো’-নীতি অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছে মার্কিন সরকার। নিষেধাজ্ঞা বা রপ্তানি বিধিনিষেধ অমান্য করে কেউ যেন বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের সুবিধা নিতে না পারে তাই এই নীতি গ্রহণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সমুদ্র পরিবহন ও বাণিজ্যের সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো এই নীতি পালনে ব্যর্থ হলে ফৌজাদারি ও দেওয়ানি আইনে তাদের বিরুদ্ধে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা এবং আর্থিক জরিমানাসহ শাস্তিমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে যুক্তরাষ্ট্র। কঠোর বিধিনিষেধ ও নিষেধাজ্ঞা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এর প্রতিক্রিয়া নতুন বছরে চাহিদা ও জোগানকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে মেরিটাইম খাতে।

প্রাধান্য পাবে সবুজ রূপান্তর

বর্তমানে বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের ৩ শতাংশ আসে মেরিটাইম খাত থেকে। চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে সমুদ্রপথে বাণিজ্যের পরিমাণ ২০৫০ সাল নাগাদ প্রায় তিনগুণ হবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। সময়মতো যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে এই খাতের দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর হয়ে যাবে। কয়েক বছর ধরে মেরিটাইম খাতের অংশীজনরা কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ, পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ব্যবহার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও জ্বালানি সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ গ্রহণ করায় সমুদ্র পরিবহনের সবুজ রূপান্তর প্রক্রিয়া বেগবান হয়েছে। চলতি বছর সবুজ রূপান্তরের এই ধারা আরও প্রাধান্য পাবে। পরিবেশ রক্ষায় ২০২৩ সালে গৃহীত নিয়মনীতিগুলো কতটা কার্যকর ভূ‚মিকা পালন করছে এ বছর সেটা পরিলক্ষিত হবে।

২০২৩ সালের জুলাইয়ে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের (আইএমও) মেরিন এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন কমিটির (এমইপিসি) ৮০তম অধিবেশনে সংস্থাটির ১ হাজার ৮০০ সদস্য কার্বন নিঃসরণ রোধে কঠোর লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করে। এর পাশাপাশি গত বছর আইএমওর কার্বন ইন্টেনসিটি ইন্ডিকেটর (সিআইআই) কার্যকর হয়। এসব উদ্যোগ চলতি বছর মেরিটাইম খাতে কার্যকর প্রভাব বিস্তার করবে। সেসঙ্গে ইইউর এমিশন ট্রেডিং সিস্টেম (ইটিএস) ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে বলবৎ হয়েছে। ইটিএসের আওতায় চলতি বছর ইউরোপের বন্দরে আসা-যাওয়া করা জাহাজগুলোকে কার্বন নির্গমনের কারণে প্রায় ৩৬০ কোটি ডলার কার্বন শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। ক্লাসিফিকেশন সোসাইটি ডিএনভির তথ্যমতে, ইউরোপ ও এশিয়ায় কার্যক্রম পরিচালনাকারী একটি কনটেইনার জাহাজকে ৮ লাখ ৮৭ হাজার ডলার কার্বন শুল্ক পরিশোধ করতে হবে, যা তার বার্ষিক জ্বালানি ব্যয়ের ১০ শতাংশ। পরিচালন ব্যয় কমাতে শিপিং কোম্পানিগুলো এরই মধ্যে বিকল্প পন্থা হিসেবে শিপ টু শিপ ট্রান্সফার এবং ইউরোপের পরিবর্তে নিকটবর্তী অন্যান্য বন্দরে কার্যক্রম পরিচালনার কথা ভাবছে, যা নতুন বছরে বৈশ্বিক সমুদ্র পরিবহনের গতানুগতিক ধারাকে বদলে দিতে পারে।

মেরিটাইম খাতের স্টেকহোল্ডাররা বর্তমানে গ্রিনহাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি গ্রিন শিপিং করিডোর তৈরিতে গুরুত্বারোপ করছে। গøবাল মেরিটাইম ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী গ্রিন করিডোর ইনিশিয়েটিভের সংখ্যা গত এক বছরে ২১টি থেকে ৪৪টিতে উন্নীত হয়েছে। আরও অনেক প্রকল্প বর্তমানে পরিকল্পনাধীন এবং প্রাক-বিনিয়োগ পর্যায়ে আছে। গ্রিন শিপিং করিডোরগুলো ২০২৪ সালে মেরিটাইম খাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে।

গত এক বছরে বিশ্বজুড়ে গ্রিন করিডোর ইনিশিয়েটিভের সংখ্যা ৪৪টিতে উন্নীত হয়েছে

বাধ সাধবে বৈরী পরিবেশ

চলতি বছর বৈরী প্রকৃতির সঙ্গে লড়তে হবে মেরিটাইম খাতকে। এল নিনোর প্রভাবে ২০২৪ সালজুড়ে প্রতিক‚ল আবহাওয়া বিরাজ করবে। আবহাওয়াবিদদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছর বৈশ্বিক তাপমাত্রা স্মরণকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছবে। আবহাওয়া ও জলবায়ুর এই পরিবর্তন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা নতুন বছরে আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

অন্যদিকে চলতি বছরও পানামায় অনাবৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এর ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জেরে পানামা খালে সৃষ্ট খরা চলতি বছরও দীর্ঘায়িত হবে এবং পানির সংকট অব্যাহত থাকবে। এমন অবস্থায় ২০২৪ সালেও এই বাণিজ্যপথে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম জাহাজ চলাচল করবে। দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদী, জার্মানির রাইন নদী ও যুক্তরাষ্ট্রের হ্রদগুলোতেও একই চিত্র দেখা যাবে। খরার কারণে এসব জলপথে পানির স্তর কমে যাওয়ায় পণ্য পরিবহন, বিশেষত বার্জ চলাচল ব্যাহত হবে। যা সার্বিকভাবে সমুদ্র পরিবহন খাতকে প্রভাবিত করবে।

সর্বত্র প্রযুক্তির প্রয়োগ

প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই মেরিটাইম খাতকে আমূল বদলে দিচ্ছে। এআই ব্যবহার করে সমুদ্র পরিবহন খাতে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি, রুট অপ্টিমাইজেশন বৃদ্ধি করা সম্ভব। এআই-চালিত রোবোটিকসও অটোমেশন সিস্টেম কার্গোর পরিবহন ঝুঁকি কমিয়ে এবং কার্গো লোডিংয়ের সময় জায়গার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে বন্দরগুলোয় কার্গো হ্যান্ডলিং সহজ করে তুলছে। এছাড়া এআই-চালিত অ্যানালিটিক্স জাহাজের কার্যক্ষমতা, জ্বালানি ব্যবহার, আবহাওয়া ও জলবায়ু সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে শিপিং কোম্পানিগুলোকে কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে সাহায্য করে। এর ফলে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে শিপিং খাতের দক্ষতা ও নিরাপত্তা বর্তমানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সেসঙ্গে মেরিটাইম খাতের খরচও কমেছে। প্রযুক্তি বিষয়ক মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান গার্টনারের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৪ সাল নাগাদ সাপ্লাই চেইন সংশ্লিষ্ট ৫০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান এআই এবং ডেটা অ্যানালিটিক্সে বিনিয়োগ করবে। এর পাশাপাশি জাহাজকে স্বয়ংচালিত করতে, শিপিং খাতে বøকচেইন প্রযুক্তি একীভূ‚ত করতে, মেরিটাইম খাতকে পরিবেশবান্ধব করে তুলতে সর্বোপরি সমুদ্র পরিবহনের সার্বিক উন্নয়নে চলতি বছর ইন্টারনেট অব থিংকস (আইওটি), ক্লাউড-বেজড সিস্টেম, ডিজিটাল টুইনসহ আরও অনেক প্রযুক্তি মেরিটাইম খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূ‚মিকা রাখবে।

ত্বরান্বিত হবে ডিজিটালাইজেশন ও যান্ত্রিকীকরণ

জাহাজ ও বন্দরের কর্মদক্ষতা বাড়াতে, খরচ বাঁচাতে এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে সমুদ্র পরিবহন সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ মেরিটাইম খাতে যান্ত্রিকীকরণে আগ্রহী হয়ে উঠছে। অংশীজনরা বর্তমানে স্বয়ংচালিত নৌযান তৈরি এবং অত্যাধুনিক যান্ত্রিক সুবিধা সম্পন্ন স্মার্ট বন্দর তৈরিতে বিনিয়োগ করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২৪ সালে ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া আরও গতিশীল হয়ে উঠবে। এ বছর কোনো ক্রু ছাড়া সম্পূর্ণ স্বয়ংচালিত কার্গো জাহাজ কার্যক্রম শুরু করবে। অ্যালায়েড মার্কেট রিসার্চের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বার্ষিক ২৩ দশমিক ১ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পেয়ে ২০৩২ সাল নাগাদ স্মার্ট পোর্টস মার্কেটের মূল্য ১ হাজার ৫৫০ কোটি ডলারে পৌঁছবে।

শক্তিশালী হবে সাইবার নিরাপত্তা

বিগত কয়েক বছরে লজিস্টিক ইন্ডাস্ট্রিতে সাইবার হুমকি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। গবেষণা অনুযায়ী, এই খাতে সাইবার আক্রমণের প্রচেষ্টা ৪০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাইবার হামলার মাধ্যমে হ্যাকাররা কার্গোর গোপনীয় তথ্য হাতিয়ে নেওয়া থেকে শুরু করে অবৈধভাবে জাহাজের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করছে। এর ফলে নৌ-চলাচল ব্যাহত হবার পাশাপাশি সংঘর্ষ ও মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটছে। সাইবারআউলের গেøাবাল ইন্ডাস্ট্রি রিপোর্ট অনুযায়ী, কর্মীদের অনিচ্ছাকৃত ভুলের কারণে মেরিটাইম খাতের ৯৫ শতাংশ সাইবার হামলার ঘটনা ঘটে। মেরিটাইম খাতের অটোমেশন কাজের নির্ভুলতা ও ধারাবাহিকতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সাইবার হামলার ঝুঁকি চিহ্নিত করে এবং সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। ২০২৪ সালে এআই ও অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে শক্তিশালী সাইবার নিরাপত্তা কাঠামো বাস্তবায়নের মাধ্যমে সংবেদনশীল তথ্য ও সিস্টেমগুলোকে সুরক্ষিত করতে এবং সমুদ্র পরিবহনকে নিরাপদ রাখতে কাজ করবে মেরিটাইম খাত।

চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যহীনতা আরেক ধাপ বাড়বে

কোভিড-পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী কনটেইনার চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় জাহাজ নির্মাণে উল্লম্ফন পরিলক্ষিত হয়। নবনির্মিত সেসব জাহাজ গত বছর থেকে বাণিজ্যিক নৌবহরে যুক্ত হতে শুরু করেছে। ২০২৩ সালের তুলনায় চলতি বছর সরবরাহকৃত নতুন জাহাজের সংখ্যা ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। বিমকোর প্রধান শিপিং বিশ্লেষক নিলস রাসমুসান জানান, ২০২৪ সালে ৩১ লাখ টিইইউর ৪৭৮টি নতুন কনটেইনার জাহাজ এমএসসি, মায়েরস্ক, সিএমএ সিজিএমসহ অন্যান্য শিপিং কোম্পানির বহরে যুক্ত হবে। এর ফলে কনটেইনার বহরের ধারণক্ষমতা চলতি বছর ১০ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে। তবে দেশে দেশে বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি, কঠোর সুদহার নীতি এবং ভূ‚রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জেরে ২০২৪ সালে কনটেইনার চাহিদার পরিমাণ হ্রাস পাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কনটেইনার এক্সচেঞ্জের জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৫৭ শতাংশের মতে, কোভিড-পরবর্তী সময়ে এই বছর চাহিদার পরিমাণ বাড়াতে সবচেয়ে বেশি হিমশিম খাবে মেরিটাইম খাত। জোগানের সাথে পাল্লা দিয়ে চাহিদার পরিমাণ না বাড়ায় ২০২৪ সাল থেকে কনটেইনার শিপিংয়ের অতিসক্ষমতা মারাত্মক আকার ধারণ করবে। ড্রিউরির বৈশ্বিক জোগান-চাহিদা সূচক অনুযায়ী, ২০২৪ সালে জোগানের পরিমাণ ৬ দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও চাহিদা মাত্র ২ শতাংশ বাড়বে, যা সর্বকালের সর্বনিম্ন। বিশেষজ্ঞদের মতে, চাহিদা-জোগানের এই ভারসাম্যহীনতা আগামী কয়েক বছর ধরে কনটেইনার শিপিং খাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।

কনটেইনার শিপিংয়ে নিরাশার সুর

পানামা খালে সীমিত আকারে জাহাজ চলাচল এবং কনটেইনার জাহাজের অতি সক্ষমতার দরুন সাম্প্রতিক সময়ে শিপিং কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়েই চলেছে। যার ফলে কনটেইনার জাহাজের ফ্রেইট রেট মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গত অক্টোবরে ড্রিউরি জানায়, ২০২৪ সালে বৈশ্বিক ফ্রেইট রেটে ৩৩ শতাংশ পতন হবার আশঙ্কা রয়েছে। ২০২৩ সালে ক্যারিয়ার কোম্পানিগুলো আনুমানিক ২ হাজার কোটি ডলার মুনাফা (কর-পূর্ববর্তী) অর্জন করলেও চলতি বছর ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার লোকসানের পূর্বাভাস দেয় সংস্থাটি। ২০০৯ ও ২০২০ সালে মন্দার কারণে কমতে থাকা থ্রুপুটের পরিমাণ বন্দরগুলো দ্রæত পুনরুদ্ধার করতে পারলেও বর্তমানে চলমান সংকট সহসা কাটবে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করছে ড্রিউরি। 

২০২৩ সালের নভেম্বরে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে পশ্চিমাদের সংঘর্ষ শুরু হলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করে। চলমান সংঘর্ষে লোহিত সাগর ও সুয়েজ খাল ক্রমেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। দুর্ঘটনা এড়াতে শিপিং কোম্পানিগুলো তাই বিকল্প পথ ব্যবহার করছে, যার ফলে পরিবহন ব্যয় হু-হু করে বাড়ছে। বাড়তি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে বাধ্য হয়ে ফ্রেইট রেট বাড়াচ্ছে শিপিং কোম্পানিগুলো। তবে ফ্রেইট রেটের এই ঊর্ধ্বগতি অনিশ্চয়তায় ভূরা নতুন বছরে শিপিং খাতের লোকসান আদৌ কমাতে পারবে কিনা তা এখনো সুস্পষ্ট নয়।

২০২৪ সালে অপরিশোধিত ট্যাংকার মার্কেটে কার্গো ভলিউম ৪ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে

আশা জোগাচ্ছে ট্যাংকার মার্কেট

এতসব হতাশার মাঝে আশার আলো দেখাচ্ছে ট্যাংকার মার্কেট। মূলত এশিয়ার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক তেলের চাহিদা বাড়ছে। শিপব্রোকার এক্সক্লুসিভের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে চীনে তেলের চাহিদা ২ দশমিক ৯ শতাংশ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ৩ দশমিক ২ শতাংশ বাড়বে। অন্যদিকে আমেরিকার থেকে অপরিশোধিত তেল রপ্তানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ট্যাংকার জাহাজ চলাচলের গড় দূরত্ব বাড়ছে তথা টন-মাইল অনুপাত উন্নত হচ্ছে; যা বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপথে তেল পরিবহনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) জানায় চলতি বছর দৈনিক তেলের চাহিদা ১ দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। গায়ানা ও যুক্তরাষ্ট্রে তেল উত্তোলন বৃদ্ধি এবং ওপেকভুক্ত দেশগুলো থেকে তেলের সরবরাহ অব্যাহত থাকায় ২০২৪ সালে তেলের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব বলে মনে করছে আইইএ। নতুন বছরে তেলের চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়বে ট্যাংকার জাহাজের চাহিদা। বাল্টিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম কাউন্সিলের (বিমকো) পূর্বাভাস অনুযায়ী, এ বছর অপরিশোধিত ট্যাংকার মার্কেটে কার্গো ভূলিউম ৩ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

নবযুগে দেশের বন্দর খাতপিসিটি পরিচালনায় বিদেশি অপারেটর

শিপিং খাতে নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে সংশোধিত কর্মকৌশল ও গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের নিট-জিরো স্ট্যাটাস অর্জনের পথে এগিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নতুন লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও)। গত ৩-৭ জুলাই লন্ডনে অনুষ্ঠিত আইএমওর মেরিন এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন কমিটির (এমইপিসি) ৮০তম অধিবেশনে এই ঐকমত্য তৈরি হয়।

চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন আর দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা একই সুতোয় গাঁথা। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি। এদিকে সমুদ্র পরিবহন খাতে দেশের আঞ্চলিক সম্পৃক্ততা বাড়াতে এরই মধ্যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোও ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করছে।

এমনিতেই চট্টগ্রাম বন্দর তার বর্তমান অবকাঠামো সক্ষমতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে কাজ করছে। এর ওপর চাহিদা বৃদ্ধির কারণে বন্দরটির ওপর তৈরি হচ্ছে বাড়তি চাপ। এ কারণে বিদ্যমান অবকাঠামোর সংস্কার ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) নির্মাণ করা হয়েছে সেই প্রয়োজনীয়তার তাগিদেই।

করোনা মহামারিসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে টার্মিনালটি এখন নির্মাণকাজ শেষে অপারেশনাল কার্যক্রম শুরুর অপেক্ষায়। গত ১৪ নভেম্বর টার্মিনালটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আরেকটি  অভ‚তপূর্ব অগ্রগতি হলো, পিসিটি পরিচালনায় আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয়েছে সৌদি আরবভিত্তিক আন্তর্জাতিক টার্মিনাল অপারেটর রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল (আরএসজিটিআই)। ৬ ডিসেম্বর এ বিষয়ে একটি কনসেশন চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে তাদের সাথে। দেশে বন্দর টার্মিনাল পরিচালনা খাতে এটি প্রথম কোনো বিদেশি বিনিয়োগ। এর মাধ্যমে এক নবদিগন্তের সূচনা হলো দেশের বন্দর খাতে।

পেছনের কথা

চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে এতদিন টার্মিনাল ছিল দুটি চিটাগং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) ও নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)। এছাড়া জেনারেল কার্গো বার্থে (জিসিবি) বিশেষ প্রয়োজনে গিয়ারড ভেসেলগুলোকে (যেসব জাহাজের নিজস্ব ক্রেন থাকে) কনটেইনার হ্যান্ডলিং সেবা দেওয়া হয়।

বন্দরের জিসিবি এলাকার জেটিগুলোর অবকাঠামোগত অবস্থা নাজুক হওয়ায় বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞরা সরেজমিন পরিদর্শন করে পুরনো জেটি ভেঙে নতুন করে জেটি নির্মাণের তাগিদ দেন। সে লক্ষ্যে জিসিবি এলাকার পুরনো জেটিসহ ব্যাকইয়ার্ড ভেঙে এর পরিবর্তে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত কর্ণফুলী কনটেইনার টার্মিনাল (কেসিটি) নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু নতুন কনটেইনার ইয়ার্ড ও জেটি নির্মাণ ছাড়া কেসিটির নির্মাণকাজ হাতে নেওয়া হলে আমদানি-রপ্তানি কাজের গতিশীলতা বাধাগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়। ফলে আমদানি-রপ্তানির গতি নির্বিঘ্ন রাখতে কেসিটির আগেই পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

২০১৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পিসিটি প্রকল্পের নির্মাণকাজ উদ্বোধন হয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর নাগাদ এই নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্প এলাকায় অবস্থিত সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা সরিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের জটিলতা, প্রকল্পের প্রয়োজনে নকশা পরিবর্তন, ভ‚মি অদল-বদল, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ থেকে অনাপত্তিপত্র প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতাসহ বিভিন্ন প্রভাবক টার্মিনাল নির্মাণের কাজ পিছিয়ে দিয়েছে। সার্বিক বিচারে এসব প্রতিকূলতা পেরিয়ে এরকম বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া না গেলেও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যদের দক্ষতা ও সহযোগিতায় দ্রুতগতিতে এগিয়েছে পিসিটি নির্মাণের কাজ।

নতুন প্রজন্মের টার্মিনাল

চট্টগ্রাম বন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল হিসেবে শিগগির অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি)। টার্মিনালটির অবস্থান পতেঙ্গা বোট ক্লাব ও চিটাগং ড্রাইডকের মধ্যবর্তী জায়গায়। ২৬ একর এলাকাজুড়ে নির্মিত পিসিটিতে জেটি রয়েছে চারটি। এর মধ্যে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হবে তিনটি জেটিতে। এগুলোর প্রতিটির দৈর্ঘ্য ২০০ মিটার করে। এছাড়া তেল খালাসের জন্য রয়েছে বিশেষায়িত ডলফিন জেটি, যেটি ২২০ মিটার দীর্ঘ।

পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল বছরে প্রায় পাঁচ লাখ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা যাবে। এটি নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। এই অর্থায়ন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। পিসিটি নির্মাণ প্রকল্পের কার্যাদেশ দেওয়া হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরকে।

এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা বন্দরের যতগুলো টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে, তার সবগুলোই বিদেশি প্রতিষ্ঠানের তৈরি করা নকশায় নির্মিত। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল। সম্ভাব্যতা যাচাই থেকে শুরু করে বিশদ নকশা সবকিছুই করেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। সুতরাং গর্ব করেই বলা যায়, পিসিটি নির্মিত হয়েছে সম্পূর্ণ দেশীয় মেধায়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৪ নভেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল উদ্বোধন করেন। এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক যাত্রা করে চট্টগ্রাম বন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল

বন্দর খাতে বিদেশি বিনিয়োগের সূচনা

আগামী ২২ বছরের জন্য পিসিটি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে আরএসজিটিআইয়ের বাংলাদেশি সাবসিডিয়ারি আরএসজিটি বাংলাদেশ লিমিটেড। গত ৬ ডিসেম্বর এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) ও আরএসজিটি বাংলাদেশের মধ্যে ইকুইপ-অপারেট-ট্রান্সফার বেসিসে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল, ওএসপি, এনইউপি, পিপিএম, পিএসসি ও আরএসজিটিআইয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জেন্স ও. ফ্লো প্রতিষ্ঠান দুটির পক্ষে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।

রাজধানী ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সৌদি আরবের বিনিয়োগ মন্ত্রী খালিদ আল ফালিহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই কনসেশন চুক্তি আমাদের দুই দেশের যৌথ স্বপ্ন এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও সমৃদ্ধির প্রতি অবিচল অঙ্গীকারের প্রমাণ। আমরা এমন একটি ভবিষ্যতের অপেক্ষায় আছি, যেখানে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে। আরএসজিটি আগামী ২২ বছর এই টার্মিনাল পরিচালনা করবে। এটি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করবে।

পিসিটির সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের পর সৌদি বিনিয়োগমন্ত্রী খালিদ এ আল-ফালিহ, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তফা কামাল, বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল ও সৌদি বিনিয়োগ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা টার্মিনাল পরিদর্শন করেন

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্প বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য একটি আশার আলো। স্বনির্ভর এই আধুনিক টার্মিনাল বন্দরের সক্ষমতা বাড়াবে, নিরবচ্ছিন্ন বাণিজ্য সহজ করবে এবং কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা সৃষ্টি করবে। এটি বিশ্ববাণিজ্যের একটি প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করবে। আমাদের ব্যবসার জন্য বিশে^র সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে। টার্মিনালটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতেও সাহায্য করবে। কারণ ভারত, ভুটান ও নেপাল এই টার্মিনাল ব্যবহার করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী পিসিটি পরিচালনার জন্য সৌদি আরবের টার্মিনাল অপারেটর নিয়োগের সুযোগ দেওয়ায় দেশটির সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন, জেদ্দা বন্দর ও অন্যান্য টার্মিনাল পরিচালনায় খ্যাতি অর্জনকারী আরএসজিটিআই পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালও দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সাথে পরিচালনা করবে।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান, সৌদি বিনিয়োগমন্ত্রী খালিদ আল ফালিহ ও আরএসজিটি চেয়ারম্যান আমের এ. আলিরেজা। উদ্বোধনী বক্তব্য দেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী। এ সময় ঢাকায় নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত এসা বিন ইউসুফ আল দুহাইলান ছাড়াও উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।

আরএসজিটি হলো সৌদি আরবভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক টার্মিনাল অপারেটর। বিশ্বের বৃহত্তম ১০টি টার্মিনাল অপারেটরের অন্যতম এটি, যার সম্মিলিত বার্ষিক কনটেইনার হ্যান্ডলিং ক্ষমতা ২ কোটি টিইইউ। আরএসজিটিআইয়ের একটি ফ্ল্যাগশিপ টার্মিনাল হলো আরএসজিটি জেদ্দা। সৌদি আরব ও লোহিত সাগর উপক‚লের বৃহত্তম টার্মিনাল এটি। জেদ্দা বন্দরের এই টার্মিনালটিতে ২০২৩ সালে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সংখ্যা ৩৩ লাখ টিইইউ ছাড়িয়ে যাবে। আরএসজিটিআইয়ে সৌদি আরবের পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের ৪০ শতাংশ মালিকানা রয়েছে।

পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে যন্ত্রপাতি সংযোজনে ১৭ কোটি ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে আরএসজিটিআই। ২০২৬ সালের মধ্যে এখানে চারটি শিপ-টু-শোর ক্রেন সংযোজন করবে তারা।

পিসিটি দিয়ে দেশের সমুদ্র পরিবহন খাত নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এই প্রথম কোনো বিদেশি অপারেটর বাংলাদেশে টার্মিনাল পরিচালনায় যুক্ত হলো। এর মাধ্যমে দেশের বন্দর ব্যবস্থাপনা খাতে বিদেশি বিনিয়োগের দ্বার উন্মোচিত হলো।

কী সুবিধা এনে দেবে পিসিটি?

পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল চট্টগ্রাম বন্দরের একটি যুগোপযোগী সংযোজন। কারণ এখানে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে। এছাড়া এটি মোহনার কাছাকাছি হওয়ায় জাহাজগুলোকে বার্থিংয়ের জন্য মূল বন্দরের তুলনায় কিছুটা কম পথ পাড়ি দিতে হবে, যার ফলে কনটেইনার পরিবহন কার্যক্রমে গতি আসবে।

টার্মিনালে রয়েছে ৮৯ হাজার বর্গমিটার অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ইয়ার্ড ও রাস্তা। এই ইয়ার্ডে রাখা যাবে সাড়ে চার হাজার কনটেইনার। কনটেইনার লোডিং ও আনলোডিংয়ের জন্য রয়েছে পৃথক ইয়ার্ড। যেসব ট্রাক বা লরি কনটেইনার নিতে টার্মিনালের বাইরে থেকে আসবে, সেগুলো লোডিং ইয়ার্ডে যাবে এবং কনটেইনার নিয়ে আসা ট্রাক বা লরি আনলোডিং ইয়ার্ডে গিয়ে কনটেইনার নামিয়ে চলে যাবে। নির্দিষ্ট পরিমাণ কাভার্ড ভ্যান পার্কিংয়ের জন্য পৃথক পার্কিং স্পেস রাখা হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের প্রায় ৯৮ শতাংশ রপ্তানি পণ্য এবং ৩৭ ধরনের আমদানি পণ্য হ্যান্ডলিং হয়ে থাকে বেসরকারি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোয় (আইসিডি)। বন্দরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আইসিডিগুলোর মধ্যে সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেডের তিনটি আইসিডি, ভারটেক্স অফডক লজিস্টিকস সার্ভিসেস লিমিটেড, ইনকনট্রেড লিমিটেড ও ইস্টার্ন লজিস্টিকস লিমিটেডের অবস্থান পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেই। ফলে পিসিটি থেকে আমদানীকৃত পণ্য আইসিডিতে নিয়ে যাওয়া এবং রপ্তানিমুখী পণ্য পিসিটিতে অবস্থান করা জাহাজে লোড করতে কনটেইনারবাহী প্রাইম মুভার বা পরিবহনকে বন্দরের মূল জেটি এলাকায় যেতে হবে না। ফলে বন্দরের মূল জেটি ও ইয়ার্ডের পাশাপাশি চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (সিইপিজেড) মতো ব্যস্ততম এলাকাতেও পরিবহনের চাপ কমবে।

পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালকে বন্দরের সাউথ কনটেইনার ইয়ার্ডের সাথে যুক্ত করতে পৃথক রেললাইন, লোকোমোটিভ ও বগি চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। এই সংযোগ স্থাপন করা হলে পিসিটির ব্যাকআপ ইয়ার্ড হিসেবে সাউথ কনটেইনার ইয়ার্ড ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে।

অর্থনৈতিক গুরুত্ব

২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত ও স্মার্ট অর্থনীতির দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে সরকার ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ও উন্নয়নের সাথে সাথে বাড়ছে দেশের সমুদ্র বাণিজ্যের প্রধান গেটওয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং। ভবিষ্যৎ চাহিদা বিবেচনা করলে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের ফলে যেমন অধিক সংখ্যক জাহাজ বার্থিংয়ের সুযোগ পাবে, তেমনি বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতাও বাড়বে। সরকারের অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল। এছাড়া টার্মিনাল পরিচালনায় আরএসজিটি যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে বিদেশি অপারেটরদের আরও বিনিয়োগ আকর্ষণের যে সম্ভাবনা তৈরি হলো, তা দেশের সমৃদ্ধির অভিযাত্রাতেও সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশে মেরিটাইম বিষয়ক চর্চাকে এগিয়ে নিতে চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্যোগে আট বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে বন্দরবার্তা। বাংলা ভাষায় মেরিটাইম বিষয়ক সাময়িকীর জন্য একটি মাইলফলক বৈকি! এই পথপরিক্রমায় প্রথমেই ধন্যবাদ দিতে হয় বন্দরবার্তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানসহ বোর্ড সদস্যবৃন্দ, সচিব ও সংশ্লিষ্ট বিভাগসূহকে যাদের সদিচ্ছায় সম্ভব হয়েছে এই পথচলা।

সমুদ্র অর্থনীতির প্রসারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে প্রয়াস তারই ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের মেরিটাইম শিল্প গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ থেকে হিন্টারল্যান্ড সংযোগ, অবকাঠামো উন্নয়ন ও সমুদ্র অর্থনীতির নানাবিধ গবেষণাসহ একটি বড় পরিবর্তনের সামনে দাঁড়িয়ে। বাংলাদেশের বন্দর পরিচালনা খাতে নবযুগের সূচনা করেছে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি)। চট্টগ্রাম বন্দরের তৃতীয় এই টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে সৌদি আরবভিত্তিক আন্তর্জাতিক টার্মিনাল অপারেটর রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালের (আরএসজিটিআই) বাংলাদেশি সাবসিডিয়ারি আরএসজিটি বাংলাদেশ। এ বিষয়ে ৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে দেশের বন্দর পরিচালনা খাতে বিদেশি বিনিয়োগের সূচনা হলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ১৪ নভেম্বর নবনির্মিত পিসিটি উদ্বোধন করেন। আরএসজিটিআইয়ের এই বিনিয়োগসহ চট্টগ্রাম বন্দরের নির্মাণ ও উন্নয়ন খাতে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি ডলারের (১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা) বিশাল বিনিয়োগ আসছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির এই সংকটকালীন সময়েও এই বিনিয়োগ বাংলাদেশের বন্দর খাত তথা অর্থনীতির সুদিনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

আরেকটি সমস্যাসঙ্কুল বছর কাটিয়ে নতুন বছরে পা দিল বৈশ্বিক সমুদ্র পরিবহন খাত। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের সাথে যুক্ত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য সংকট। এসব ভ‚রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জেরে গোটা বিশ্ব টালমাটাল সময় পার করেছে। বেশ জোরেশোরেই তার প্রভাব পড়েছে বৈশ্বিক মেরিটাইম খাতে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভ‚রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী ৬০টির বেশি দেশে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন, পরিবেশবান্ধব নিয়ম-নীতির প্রয়োগ, ব্যাপক যান্ত্রিকীকরণ, ডিজিটালাইজেশন, কনটেইনার জাহাজের চাহিদা-জোগানের ভারসাম্যহীনতা, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এবং পানামা খালের দীর্ঘমেয়াদি খরা প্রভৃতি চলতি বছর মেরিটাইম খাতে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করবে।

তবে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে শিপিং খাতের দক্ষতা ও নিরাপত্তা বর্তমানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২৪ সালে ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া আরও গতিশীল হয়ে উঠবে। এ বছর কোনো ক্রু ছাড়া সম্পূর্ণ স্বয়ংচালিত কার্গো জাহাজ কার্যক্রম শুরু করবে। এলাইড মার্কেট রিসার্চের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বার্ষিক ২৩ দশমিক ১ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পেয়ে ২০৩২ সাল নাগাদ স্মার্ট পোর্টস মার্কেটের মূল্য ১ হাজার ৫৫০ কোটি ডলারে পৌঁছবে। প্রযুক্তি বিষয়ক মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান গার্টনারের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৪ সাল নাগাদ সাপ্লাই চেইন সংশ্লিষ্ট ৫০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান এআই এবং ডেটা অ্যানালিটিক্সে বিনিয়োগ করবে। এর পাশাপাশি জাহাজকে স্বয়ংচালিত করতে, শিপিং খাতে বøকচেইন প্রযুক্তি একীভ‚ত করতে, মেরিটাইম খাতকে পরিবেশবান্ধব করে তুলতে সর্বোপরি সমুদ্র পরিবহনের সার্বিক উন্নয়নে চলতি বছর ইন্টারনেট অব থিংকস (আইওটি), ক্লাউড-বেসড সিস্টেম, ডিজিটাল টুইনসহ আরও অনেক প্রযুক্তি মেরিটাইম খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখবে। সব মিলিয়ে চলতি বছর চলমান সংকট কাটিয়ে পরিবেশ ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়াই লক্ষ্য মেরিটাইম বিশ্বের। বিস্তারিত রয়েছে প্রধান রচনায়।

প্রিয় পাঠক, বন্দরবার্তার এই নিরবচ্ছিন্ন পথচলার সাফল্যের ভাগীদার আপনিও। আমরা চাই এ দেশের মেরিটাইম-চর্চাকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড় করাতে। বৈচিত্র্যময় আঙ্গিকে, সমৃদ্ধ কলেবরে বন্দরবার্তার পথচলা বাংলাদেশের মেরিটাইম খাতের বিকাশে আরও সহায়ক হবে সেই প্রত্যাশা। সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।

ইয়ানতাই বন্দর

ইয়ানতাই বন্দর চীনের অন্যতম ব্যস্ত একটি সমুদ্রবন্দর। এর অবস্থান দেশটির শ্যানডং প্রদেশের উত্তরাঞ্চলীয় ইয়ানতাই শহরের উপকণ্ঠে। পীত সাগরের তীরে গড়ে ওঠা এই বন্দরটি বিশ্বের শীর্ষ ৫০ কনটেইনার পোর্টের একটি। বিখ্যাত লয়েড’স লিস্টের শীর্ষ ১০০ কনটেইনার পোর্টের তালিকায় এর অবস্থান ৪৯তম।

২০২২ সালে ইয়ানতাই বন্দরে মোট ৪১ লাখ ১৭ হাজার ৮০০ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ১২ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। ২০২১ সালে বন্দরটিতে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ ছিল ৩৬ লাখ ৫১ হাজার টিইইউ। সে বছর লয়েড’স লিস্টে বন্দরটির অবস্থান ছিল ৫২তম।

ইয়ানতাই শহরের পাশেই রয়েছে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট দারুণ একটি গভীর পানির পোতাশ্রয়। অনেক আগেই এই পোতাশ্রয়ে বন্দর ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। ইয়ানতাই শব্দের অর্থ হলো বাতিঘর। পনেরো শতকে এই এলাকায় জাপানি জলদস্যুদের বেশ উপদ্রব ছিল। সে সময় বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য উপকূলীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। এরই অংশ হিসেবে ইয়ানতাইয়ের একটি পাহাড়ে বাতিঘর ও পর্যবেক্ষণ টাওয়ার স্থাপন করা হয়।

১৮৬০ সাল পর্যন্ত ইয়ানতাইয়ের বন্দর অ্যাংলো-ফরাসি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। পরের বছর একটি চুক্তির মাধ্যমে বন্দরটিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ১৮৭৬ সালে ইয়ানতাই বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ব্রিটেন ও চীনের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়, যেটি জিফু কনভেনশন নামে পরিচিত। এই কনভেনশনের মাধ্যমে একটি ‘ট্রিটি পোর্ট’ হিসেবে নতুন করে যাত্রা করে ইয়ানতাই বন্দর।

ট্রিটি পোর্ট হলেও ইয়ানতাই বন্দরে কখনো কোনো উপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি, অথবা কনসেশন চুক্তির অধীনে বিদেশি কোনো পক্ষ সেখানে গিয়ে বন্দর পরিচালনা করেনি। অবশ্য সীমিত সংখ্যক বিদেশি বণিকরা ইয়ানতাইয়ে বসবাস করে বাণিজ্য পরিচালনা করতেন। উনিশ শতকের শেষের দিকে ইয়ানতাই বন্দর দিয়ে বাণিজ্যের পরিসর বাড়তে থাকে। সে সময় প্রচুর পরিমাণে রেশম, মটরশুঁটি ও অন্যান্য স্থানীয় উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি হতো বন্দর দিয়ে। বিপরীতে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আমদানি হতো উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পণ্য। এছাড়া শ্যানডংয়ের উত্তরাঞ্চল ও হেবেই প্রদেশের পূর্বাঞ্চলীয় কিছু বন্দরে পণ্য পরিবহনে ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট হিসেবেও ব্যবহার হতো ইয়ানতাই বন্দর।

১৮৯৮ সালে শ্যানডংয়ের দক্ষিণাঞ্চলে চিংদাও বন্দর প্রতিষ্ঠার পর ইয়ানতাইয়ে কার্গো হ্যান্ডলিং কিছুটা কমতে থাকে। বিশেষ করে ১৯০৪ সালে চিংদাওকে শ্যানডংয়ের রাজধানী জিনানের সঙ্গে সংযোগকারী রেল নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার পর প্রদেশটির সিংহভাগ রপ্তানি চিংদাও দিয়েই সম্পন্ন হতো। এর ফলে ইয়ানতাইসহ শ্যানডংয়ের উত্তরাঞ্চলীয় অন্যান্য বন্দরের কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে আসে। ১৯৫৬ সালে চিংদাওয়ের উত্তরের হুনান প্রদেশের লানচুনের সাথে রেল সংযোগ প্রতিষ্ঠার পর নতুন করে প্রাণ ফিরে পায় ইয়ানতাই বন্দর।

বর্তমানে বেইজিং ও তিয়ানজিনের মতো চীনের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর সাথে সহজ যোগাযোগ এবং কোরীয় উপদ্বীপ ও জাপানের সঙ্গে সমুদ্র যোগাযোগে সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে ইয়ানতাই বন্দরের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। দ্রুত আন্তর্জাতিক সমুদ্র পরিবহন খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট হয়ে উঠছে বন্দরটি। চীনের বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ এই বন্দর।

ইয়ানতাই বন্দরে প্রধানত কনটেইনারাইজড কার্গো হ্যান্ডলিং হয়। এর পাশাপাশি বাল্ক, ব্রেক বাল্ক, রো-রো ও জ্বালানি পণ্যও পরিবহন হয় এই বন্দর দিয়ে। বন্দরটিতে সর্বোচ্চ ১৭ মিটার গভীরতার কনটেইনার ও ব্রেক বাল্ক জাহাজ, ২০ মিটার ড্রাফটের বাল্ক ক্যারিয়ার এবং ১১ দশমিক ৩ মিটার ড্রাফটের ট্যাংকার ভিড়তে পারে। পুরো বন্দর এলাকা গড়ে উঠেছে পাঁচটি অংশ নিয়ে জিফু বে, ওয়েস্টার্ন পোর্ট, পেংলাই পোর্ট, লোংকোউ পোর্ট ও শৌগ্যাং পোর্ট। ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো ২০ কোটি টন কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের মাইলফলক অর্জন করে ইয়ানতাই বন্দর। চীনের দশম বন্দর হিসেবে এই সাফল্য দেখায় বন্দরটি।

শেখ রাসেল দিবস উদযাপন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেলের জন্মদিনে ‘শেখ রাসেল দিবস’ উদযাপন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। কর্মসূচির শুরুতে বুধবার সকালে শেখ রাসেলের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল ও পর্ষদ সদস্যবৃন্দ।

পুষ্পস্তবক অর্পণের পরে বন্দর চেয়ারম্যান শিশুদের সাথে নিয়ে জন্মদিনের কেক কাটেন। এ সময় বন্দরের পর্ষদ সদস্যবৃন্দ, বিভাগীয় প্রধানগণ, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ ও সিবিএ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীলতার প্রভাবে বিশ্বজুড়ে পণ্য পরিবহন ভাড়া বেড়েছে

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ও ইসরায়েলের চলমান সংঘর্ষে উত্তাল হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্য। মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীলতার জেরে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথগুলোয় তেল পরিবহন খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

লন্ডন-ভিত্তিক বাল্টিক এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের ১৬টি বাণিজ্যপথে পণ্য পরিবহন ব্যয় ৯ অক্টোবরের তুলনায় গড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এসব বাণিজ্যপথের ভেতর ভূমধ্যসাগরে পণ্য পরিবহন ভাড়া সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।

ট্যাংকার ইন্ডাস্ট্রিতে ওয়ার্ল্ডস্কেল পয়েন্টের ভিত্তিতে পণ্য পরিবহন ভাড়ার হিসাব নিকাশ করা হয়। ওয়ার্ল্ডস্কেল পয়েন্ট অনুসরণ করায় বিশ্বের বিভিন্ন বাণিজ্য পথে ডলার প্রতি পণ্য পরিবহন খরচ নিয়ে পণ্যের মালিক এবং শিপিং কোম্পানিগুলো সহজেই দরদাম করতে পারে।

এক সপ্তাহ আগে ভূমধ্যসাগরে পণ্য পরিবহনের ওয়ার্ল্ডস্কেল পয়েন্ট ১০৭ দশমিক ৭৮ থাকলেও ইসরায়েল-হামাসের সংঘর্ষের জেরে গতকাল (সোমবার) তা ২১৯ দশমিক ৪৪ পয়েন্টে পৌঁছেছে।

দীর্ঘদিন ধরে মেক্সিকো উপসাগরে অতিমাত্রায় পণ্য রপ্তানী এবং ইসরায়েল-হামাসের চলমান সংঘর্ষে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোর জড়িয়ে পড়ার শঙ্কায় বিশ্বজুড়ে পণ্য পরিবহন ভাড়া বেড়েছে বলে মনে করেন ফার্নলে’জ শিপব্রোকারসের পরিচালক হালভর এল্ফসন।

ব্রেকওয়েভ অ্যাডভাইজারের ব্যবস্থাপনা অংশীদার জন কার্টসোনাস বলেন, যুদ্ধ বা সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিলে মানুষ সবার আগে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে চায়। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় বিশ্বের কোথাও ভূ-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হলে শিপিং খাত বরাবরই তার দ্বারা উপকৃত হয়।

ইসরায়েলি বন্দরগুলোয় জাহাজজট বাড়ছে

ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের সশস্ত্র সংগঠন হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘর্ষ গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলছে। চলমান সংঘর্ষের জেরে ইসরায়েলের বন্দরগুলোতে দেখা দিচ্ছে জাহাজজট।

হামাসের হামলার পর গাজার নিকটবর্তী আস্কলন বন্দরের কার্যক্রম তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল। সেসঙ্গে আসদোদ বন্দর কর্তৃপক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ পণ্য পরিবহনের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করায় জাহাজ চলাচলের গতি শ্লথ হয়ে যায়। 

রোববার (১৫ অক্টোবর) শিপ ট্র্যাকিং ও মেরিটাইম তথ্য প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান মেরিন ট্রাফিক জানায়, আসদোদ বন্দরগামী পণ্য ও ড্রাই বাল্ক কার্গোবাহী অন্তত তিনটি জাহাজ যাত্রা থামিয়ে বর্তমানে নিকটবর্তী জলসীমায় অবস্থান করছে। এছাড়া তেলের ট্যাংকার ও কনটেইনারবাহী আরও তিনটি জাহাজ আসদোদ বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে।

মেরিনট্রাফিকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ১৩টি কার্গো, কনটেইনার ও ড্রাই বাল্কবাহী জাহাজ আসদোদ বন্দরের অভ্যন্তরে নোঙর করে আছে। তবে ওয়েবসাইটে দেওয়া এক বিবৃতিতে ভিন্ন কথা জানায় আসদোদ বন্দর কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের বিবৃতি অনুযায়ী, সংঘর্ষ চলাচালীন সময়েও বন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক গতিতে পরিচালিত হচ্ছে।

ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় হাইফা বন্দর ড্রাই বাল্কসহ নানা ধরনের কার্গো হ্যান্ডেলিং করে থাকে। পৃথক একটি তথ্যে জানা যায়, হাইফা বন্দরে বর্তমানে তিনটি ড্রাই বাল্কবাহী জাহাজ অপেক্ষমাণ রয়েছে। যদিও রোববার প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, জনবল ও কর্মক্ষমতার ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও সাপ্তাহিক ছুটির দিনসহ সব দিনই বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত ছিলো।   

আসদোদ বন্দরগামী কিছু কার্গো জাহাজ বর্তমানে গতিপথ বদলে হাইফা বন্দরে এসে ভিড়ছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবী, সেসব জাহাজ এবং অন্যান্য কার্গোর পণ্য খালাসের জন্য সর্বোচ্চ সক্ষমতায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে হাইফা। 

উল্লেখ্য যে, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও ইসরায়েলি বন্দরগুলোয় জাহাজ ভিড়িয়ে পণ্য ওঠানামা করতে বিশ্বের অন্যান্য বন্দরের তুলনায় অধিক সময় ব্যয় হয়। গত সপ্তাহে শিপিং কোম্পানি এমএসসি জানায়, হামাস-ইসরায়েলের সংঘর্ষের জেরে বন্দরগুলোয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদারের করার পাশাপাশি শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। এর ফলে জাহাজ চলাচলের দীর্ঘসূত্রিতা বর্তমানে আরও প্রলম্বিত হচ্ছে।

আসদোদ ও হাইফা ইসরায়েলের প্রধান ও ব্যস্ততম দুটি বন্দর। অনলাইন লজিস্টিকস প্ল্যাটফর্ম কনটেইনার এক্সচেইঞ্জ জানায়, বৈশ্বিক কনটেইনার থ্রুপুটের মাত্র শূন্য দশমিক চার শতাংশ এই বন্দর দুটি দিয়ে সংগঠিত হয়। আসদোদ ও হাইফা বন্দর বৈশ্বিক থ্রোপুটে তেমন প্রভাব না রাখলেও ইসরায়েলের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো চলমান সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে এই অঞ্চলের জাহাজ চলাচল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবার আশঙ্কা রয়েছে।

চলমান সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে এবং দীর্ঘায়িত হলে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুইটি বাণিজ্যপথ সুয়েজ খাল এবং হরমুজ প্রণালী ক্ষতিগ্রস্থ হবে বলে মনে করেন কনটেইনার এক্সচেইঞ্জের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ক্রিশিয়ান রোউল্ফ।