Home Blog Page 208

সংবাদ সংক্ষেপ – সেপ্টেম্বর

পুরনো এফপিএসও ভেসেলের ঝুঁকি নিরসনে উদ্যোগী এবিএস

ফ্লোটিং প্রডাকশন স্টোরেজ অ্যান্ড অফলোডিং (এফপিএসও) সেক্টরে সুরক্ষার বিষয়টি এখন বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ খাতের বৈশ্বিক বহরে বর্তমানে যেসব শিপ টাইপ ভেসেল রয়েছে, তার অর্ধেকের বেশি ৩০ বছরের পুরনো। এক-চতুর্থাংশের বয়স ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। এসব পুরনো ভেসেল দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা প্রকৃত অর্থেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঝুঁকি নিরসনে শেভরন, শেল, পেট্রোব্রাসের মতো এফপিএসও খাতের শীর্ষ কোম্পানিগুলোকে সঙ্গে নিয়ে যৌথ প্রকল্প হাতে নিয়েছে এবিএস। বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষও এ উদ্যোগে শামিল হয়েছে।

বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিচ্ছে ব্রাজিল

বিনিয়োগকে গতিশীল করার লক্ষ্যে নিজেদের শীর্ষ বন্দর ও টার্মিনালগুলো পরিচালনার দায়িত্ব বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে ব্রাজিল সরকার। এ লক্ষ্যে কয়েক দফার নিলামও আয়োজন করেছে তারা। এর মধ্যে সর্বশেষ দফার নিলামে দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় তিনটি বন্দর পরিচালনার দায়িত্বের জন্য প্রায় ৭৫ লাখ ডলারের দরপ্রস্তাব পেয়েছে সরকার। এর আগে গত এপ্রিলের নিলাম অনুযায়ী দক্ষিণাঞ্চলের পাঁচটি পোর্ট টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তরের বিষয়ে চুক্তি করেছে সরকার।

কানাডায় বন্দরে বিনিয়োগ করছে সরকার

করোনা প্রভাবে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা থেকে উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে নিজেদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল পোর্টগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে কানাডা। আর এ লক্ষ্যে দুটি নতুন প্রকল্পের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। দেশটির পরিবহনমন্ত্রী সম্প্রতি এ ঘোষণা দিয়ে বলেন, কানাডার বাণিজ্য ও পরিবহন করিডোরগুলোর উন্নতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক উত্তরণ প্রক্রিয়ায় গতি আনার চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে দুটি প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হচ্ছে।

প্রথমার্ধে হ্যাপাগ-লয়েডের মুনাফা ১০% বেড়েছে

চলতি বছরের প্রথমার্ধে শিপিং জায়ান্ট হ্যাপাগ-লয়েডের মুনাফা প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। আলোচ্য সময়ে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম এই শিপিং কোম্পানির নিট মুনাফা হয়েছে ২৭০ কোটি ইউরো (৩২৮ কোটি ডলার)। আগের বছরের একই সময়ে এই মুনাফা ছিল মাত্র ২৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ছয় মাসে জার্মান কোম্পানিটির মোট আয় হয়েছে ৮৮০ কোটি ইউরো, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫১ শতাংশ বেশি। এ সময়ে জাহাজের গড় ভাড়া বেড়েছে ৪৬ শতাংশ।

বিদেশি মেরিটাইম ক্রুদের টিকা দেবে সিঙ্গাপুর

করোনাভাইরাসের প্রকোপ থেকে সুরক্ষার লক্ষ্যে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সিঙ্গাপুর। সি ক্রু ভ্যাকসিনেশন ইনিশিয়েটিভ বা সিভ্যাক্স কর্মসূচির অধীনে অনিবাসী বিদেশি ক্রু সদস্যদের টিকা দেবে দেশটি। এর ফলে যেসব অনশোর ওয়ার্কার ও পর্যটকের ওইসব বিদেশি ক্রুর সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা রয়েছে, তাদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি অনেকটাই কমে যাবে। করোনা থেকে স্থানীয় মেরিটাইম ওয়ার্কার ও নাবিকদের সুরক্ষা দিতে যেসব দেশ সবার আগে টিকাদান কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল, সিঙ্গাপুর তাদের অন্যতম। এ ধরনের ৯০ শতাংশের বেশি কর্মীকে টিকাদান সম্পন্ন করেছে দেশটি।

স্বয়ংক্রিয় কনটেইনার র‌্যাকের ট্রায়ালে সাফল্য পেয়েছে ডিপি ওয়ার্র্ল্ড

বিশ্বজুড়ে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে কনটেইনারের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। এর ফলে বন্দরগুলোর জন্য অন্যতম মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কনটেইনার রাখার স্থান সংকুলান করা। এমন পরিস্থিতিতে কনটেইনার ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করতে সম্পূর্ণ নতুন রোবোটিক র‌্যাক সিস্টেম চালু করেছিল ডিপি ওয়ার্ল্ড। এ নিয়ে ছয় মাসের ট্রায়ালও সম্পন্ন করেছে তারা। আর এই পরীক্ষায় প্রত্যাশার চেয়েও ভালো ফল পেয়েছে কোম্পানিটি। ইউএইর জেবেল আলি টার্মিনালে ৮০০ কনটেইনার রাখার উপযোগী ‘বক্সবে’ নামের এই স্বয়ংক্রিয় র‌্যাক বসিয়েছে ডিপি ওয়ার্ল্ড।

ভূমধ্যসাগরের বন্দরগুলোয় এলএনজি সাপ্লাই চেইন সম্প্রসারণে উদ্যোগী ইএমএসএ

ভূমধ্যসাগর, কৃষ্ণ সাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের বিভিন্ন আঞ্চলিক বন্দরে এলএনজি সরবরাহ বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে ইউরোপিয়ান মেরিটাইম সেফটি এজেন্সি (ইএমএসএ)। এলএনজি বাংকারিং ও স্টোরেজ সুবিধা বাড়াতে ক্লাসিফিকেশন সোসাইটি আরআইএনএর সঙ্গে একটি ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি করেছে তারা। ইএমএসএ ও আরআইএনএ জানিয়েছে, এই অঞ্চলের বন্দরগুলোয় এলএনজি অবকাঠামো, নিয়ন্ত্রণমূলক কমপ্লায়েন্স ও নিরাপত্তার বিষয়ে কিছু ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি দূর করতেই নতুন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে তারা।

বৈরুত বিস্ফোরণের বর্ষপূর্তিতে দোষীদের বিচার দাবি

গত বছর বৈরুত বন্দরে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন দেশটির নাগরিকরা। ওই ঘটনার বর্ষপূর্তিতে আয়োজিত বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে এই দাবি উত্থাপন করা হয়। অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটভর্তি একটি গুদামে অগ্নিকা- থেকে ওই ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনায় দুই শতাধিক মানুষ প্রাণ হারান। আহত হন ৭ হাজারের বেশি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্দর, কাস্টমস ও সেনা কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণেই এতগুলো মানুষের হতাহতের ঘটনা ঘটে।

হাইড্রোজেনের ব্যবহার বাড়াতে কৌশলগত ধারণাপত্রে রুশ সরকারের অনুমোদন

হাইড্রোজেন এনার্জি ডেভেলপমেন্টের বিষয়ে প্রণীত একটি ধারণাপত্রে অনুমোদন দিয়েছে রুশ সরকার। মূলত জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেন ব্যবহারে মার্কেট লিডার হয়ে উঠতে চাইছে রাশিয়া। এ অবস্থায় হাইড্রোজেন উৎপাদন, ব্যবহার ও রপ্তানিতে রাশিয়ার সম্ভাবনার পূর্ণ সদ্ব্যবহারের লক্ষ্যেই এই ধারণাপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে হাইড্রোজেন উৎপাদনের পাইলট প্রকল্প গ্রহণ, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম তৈরির জন্য কনসোর্টিয়াম গঠন এবং হাইড্রোজেন সংরক্ষণ ও পরিবহনের উপযোগী অবকাঠামো তৈরির কথা বলা হয়েছে।

জাহাজের কনটেইনার থেকে রাসায়নিক নির্গমন বন্ধ করেছে এসএলপিএ

কলম্বো বন্দরে এমভি সিস্প্যান লাহোর নামের একটি জাহাজে থাকা একটি কনটেইনারের ছিদ্র দিয়ে রাসায়নিক বেরিয়ে যাওয়া সফলভাবে প্রতিরোধ করেছে শ্রীলংকা পোর্টস অথরিটি (এসএলপিএ)। ভারতের মুন্দ্রা পোর্ট থেকে কনটেইনার নিয়ে কলম্বো বন্দরে পৌঁছানো ওই জাহাজে একটি কনটেইনারের ভেতরে ড্রামে করে নাইট্রিক এসিড পরিবহন করা হচ্ছিল। কনটেইনারটি কলম্বো হয়ে আফ্রিকায় নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। মুন্দ্রা ছাড়ার ছয় ঘণ্টার মাথায় কনটেইনারের ছিদ্র দিয়ে নাইট্রিক এসিড নির্গমন শনাক্ত করা হয়।

অভিবাসী সামুদ্রিক প্রাণীদের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিতে উদ্যোগী পানামা খাল কর্তৃপক্ষ

প্রতি বছর ১ আগস্ট থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে পানামা খাল দিয়ে তিমি, ডলফিন ও অন্যান্য বড় সামুদ্রিক প্রাণী এক জায়গা থেকে অন্যত্র পাড়ি জমায়। তাদের এই অভিবাসন প্রক্রিয়াকে নির্বিঘন্ন করতে এরই মধ্যে জাহাজের গতি ও দিক-সংক্রান্ত কিছু নির্দেশনা জারি করেছে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও)। এই চার মাসে পানামা খাল অতিক্রমের সময় জাহাজগুলো যেন সেই নির্দেশনা যথাযথ মেনে চলে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবে ক্যানেল কর্তৃপক্ষ।

ভিয়েতনামে আন্তর্জাতিক টার্মিনালের কার্যক্রম আংশিক বন্ধ

এক মাস ধরে ভিয়েতনামে কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। এ অবস্থায় হো চি মিনের বৃহত্তম আন্তর্জাতিক টার্মিনালের কিছু কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সায়গন নিউপোর্ট করপোরেশন। করপোরেশন জানিয়েছে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার ফলে বন্দরে কর্মী সংখ্যা অর্ধেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে পণ্য খালাসে বিলম্ব হচ্ছে। বর্তমানে কনটেইনার ইয়ার্ডের ধারণক্ষমতার শতভাগ পূর্ণ হয়ে আছে। এই কনটেইনার দ্রুত খালাস করতে না পারলে বন্দরে কার্গো শিপ প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে বলেও জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

জ্বালানি রূপান্তরের বিষয়ে বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এখনই: ডিএনভি

বিশ্ব জুড়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের পরিসর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের চাহিদাও বাড়ছে। এ কারণে নতুন নতুন জাহাজ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তাও দেখা দিয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এই বাড়তি চাহিদা মেটাতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ১ হাজারের বেশি জাহাজ নির্মাণের কার্যাদেশ আসতে পারে। জাহাজের চাহিদা বৃদ্ধির বিষয়টি মালিকপক্ষের জন্য অবশ্যই সুখবর। তবে তা একই সঙ্গে ঝুঁকিরও বটে। কৌশলগত হিসাব-নিকাশে ভুল হলে মুনাফার বদলে বড় অংকের লোকসান গুনতে হতে পারে তাদের।

বিষয়টি খোলাসা করা যাক। কার্বন নিঃসরণ কমানো বিষয়টি এখন শিপিং খাতে অন্যতম চর্চিত বিষয়। বিভিন্ন মহল থেকে নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে অব্যাহত চাপ আসছে। এ অবস্থায় নতুন জাহাজের কার্যাদেশ দেওয়ার সময় জাহাজমালিকদের অবশ্যই জ্বালানি বাছাই ও নকশা প্রণয়নের বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। কারণ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে ভবিষ্যতে তাদের পস্তাতে হতে পারে। সম্প্রতি মেরিটাইম পরামর্শক ও ক্ল্যাসিফিকেশন সোসাইটি ডিএনভি প্রকাশিত ‘মেরিটাইম ফোরকাস্ট টু ২০৫০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে।

ডিএনভি বলেছে, কার্বন নিঃসরণ কমানো এখন আর কেবল ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের (আইএমও) অগ্রাধিকারমূলক বিষয় নয়। বরং বিভিন্ন আঞ্চলিক ও জাতীয় আইনপ্রণেতারাও বিষয়টির ওপর জোর দিচ্ছেন। ব্যাংকার ও বিনিয়োগকারীরাও নিঃসরণ কমানোকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছেন। তারা সবাই শিপিং খাতে দ্রুত জ্বালানি রূপান্তরের দাবি জানাচ্ছেন। এর সঙ্গে পরিবেশবাদীদের তৎপরতা তো রয়েছেই। এসব চাপের কারণে আগামী বছরগুলোয় পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইনগত দিকনির্দেশনা আসতে পারে। এখনই সেই সময়কার জন্য প্রস্তুতি না নিলে জাহাজমালিকদের বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে।

ড্রাইবাল্ক সুপার সাইকেলের সম্ভাবনা ক্ষীণ

চলতি বছরের প্রথমার্ধে বিশ্বজুড়ে শিপিং খাতে অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল ড্রাইবাল্ক পরিবহনে নতুন ভরা মৌসুম বা সুপার সাইকেল। সবার নজর এখন সেদিকেই। আলোচ্য সময়ে ভোগ্যপণ্যের দাম কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। একই সঙ্গে ফ্রেইট রেট বা জাহাজের ভাড়াও বেড়েছে সমানতালে এবং তা গত দশকের সর্বোচ্চ মানকে ছাড়িয়ে গেছে। তাহলে কি একে সুপার সাইকেল বলা যাবে? বাস্তবতা হলো সেই পর্যায়ে আসতে এখনো ঢের বাকি।

বাল্টিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম কাউন্সিলের (বিমকো) চিফ শিপিং অ্যানালিস্ট পিটার স্যান্ডের মতে, ‘ভোগ্যপণ্যের দাম আবার বাড়তে শুরু করেছে এবং তা ২০০৭ ও ২০০৮ সালের সময়কার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এ কারণে সবাই কমোডিটি সুপার সাইকেলের কথা বলছে। তবে বাস্তবতা হলো, ড্রাইবাল্ক পরিবহনে জাহাজভাড়া কিংবা শিপ ভ্যালু যতই গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকুক না কেন, ২০০৭-০৮ সালের দিকে কোম্পানিগুলোর যে আয় ছিল, তার চেয়ে ঢের পিছিয়ে রয়েছে। আর তা সেই পর্যায়ে যাবে, সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ।’

চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে সব ধরনের ড্রাইবাল্ক ক্যারিয়ার দিনপ্রতি গড়ে ২০ হাজার ডলারের বেশি আয় করেছে। এর মধ্যে কেপসাইজ ক্যারিয়ারগুলোর প্রতিদিনের গড় ভাড়া ছিল ২৪ হাজার ৯৭০ ডলার। ২০০৮ সালের একই সময়ে তা ছিল ১ লাখ ৪৭ হাজার ৪৭৫ ডলার। অন্যান্য সাইজের ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রেও গড় আয় ২০০৮ সালের তুলনায় বেশ কম রয়েছে এখন। সুতরাং বলা যায় অনেকের ধারণা থাকলেও সুপার সাইকেলের মতো পর্যায়ে যাওয়ার সম্ভাবনা এখন নেই।

গভীর সমুদ্র বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প দেড় হাজার কোটি ডলারের সম্ভাবনাময় এক বাজার

নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হিসেবে বিশ্বজুড়ে অফশোর উইন্ড বা গভীর সমুদ্র বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের প্রকল্পের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে কলেবর। টার্বাইনের আকার বড় হচ্ছে। সাগরের আরও গভীরে যাচ্ছে সাইটগুলো। ফাউন্ডেশনের আকারও দিন দিন বড় হচ্ছে। মোট কথা, এতদিন যেসব অফশোর উইন্ড প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হয়েছে, নতুন প্রকল্পগুলো তার চেয়ে অনেক বড় পরিসরের হতে যাচ্ছে।

উইন্ড ফার্মগুলোর কলেবর বাড়ার অর্থ এগুলো স্থাপনের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তাও বেড়ে যাওয়া। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে উইন্ড টার্বাইন ইনস্টলেশন ভেসেলের (ডব্লিউটিআইভি) যে আন্তর্জাতিক বহর রয়েছে, তার প্রায় পুরোটাই ২০২৫ সাল নাগাদ প্রযুক্তিগতভাবে অকার্যকর হয়ে পড়বে। তাহলে নতুন যেসব প্রকল্পের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন হবে কীভাবে? তার জন্য নতুন ভেসেল তৈরি করতে হবে এবং বিদ্যমান জাহাজগুলোর সংস্কারের মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্ধিত চাহিদা পূরণে এ ধরনের ৬০টির বেশি ভেসেলের প্রয়োজন হবে, যা প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান, জাহাজ নির্মাতা, কনভারশন ইয়ার্ড, যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী, সেবাপ্রদানকারী ও সমুদ্রসম্পদ খাতে বিনিয়োগকারীদের জন্য ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের সম্ভাবনাময় বাজার তৈরি করেছে।

ওয়ার্ল্ড এনার্জি রিপোর্টস কর্তৃক প্রকাশিত সর্বশেষ ‘ইন্টারন্যাশনাল উইন্ড টার্বাইন অ্যান্ড ফাউন্ডেশন ইনস্টলেশন ভেসেল মার্কেট’ প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

গভীর সমুদ্র বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্ষেত্রে চীন তুলনামূলক ব্যস্ত বাজার। দেশটির অভ্যন্তরীণ চাহিদা অনেক বেশি। চীনা ডব্লিউটিআইভিগুলো এ চাহিদার সবটা হয়তো পূরণ করতে পারবে না। তবে সেক্ষেত্রে সহায়ক হিসেবে অন্যান্য দেশের ছোট ইনস্টলেশন ভেসেলগুলোকে চীনে কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেখা যেতেও পারে। আর স্বাভাবিকভাবেই চীনা ডব্লিউটিআইভিগুলোর দেশটির বাইরে কার্যক্রম পরিচালনার সম্ভাবনা খুব কম।

এতদিন উইন্ড ফার্মগুলোর ইনস্টলেশন চাহিদার বেশির ভাগ পূরণ করে এসেছে জ্বালানি তেল ও গ্যাস ফিল্ডগুলোর জন্য নকশাকৃত ডব্লিউটিআইভি ও হেভি লিফটগুলো। তবে এখন সময় এসেছে এই খাতের জন্য উপযোগী উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ভেসেল ও হেভি লিফট নির্মাণের।

১৯৯১ সালে ডেনমার্কে প্রথম গভীর সমুদ্র বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প হিসেবে ৫ মেগাওয়াট ভিন্ডবি উইন্ডফার্মের যাত্রা হয়। এতে প্রতিটি ৪৫০ কিলোওয়াট সক্ষমতার ১১টি টার্বাইন স্থাপন করা হয়েছিল। বর্তমানে বিশ্বের ১৮ দেশে স্থাপিত অফশোর উইন্ড ফার্মগুলোর সম্মিলিত সক্ষমতা ৩২ গিগাওয়াটের বেশি।

কোবে বন্দর

জাপানের চতুর্থ ব্যস্ততম বন্দর কোবে। জাপানের মধ্যাঞ্চলীয় হিয়োগো প্রিফেকচারে ওসাকা উপসাগরের কোল ঘেঁষে অবস্থিত বন্দরটি আন্তর্জাতিক সমুদ্র পরিবহন নেটওয়ার্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ১৩০ দেশের পাঁচ শতাধিক বন্দরের সঙ্গে এর সংযোগ রয়েছে। কেবল কমোডিটি ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টারই নয়, বরং বিনোদনের জন্যও জনপ্রিয়তা রয়েছে এর। 

কোবে বন্দরের রয়েছে মনোমুগ্ধকর ল্যান্ডস্কেপ। বন্দরটি রোকো পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত। এই রোকো পর্বতমালা মৌসুমি ঝোড়ো হাওয়া থেকে বন্দরকে সুরক্ষা দেয়। কোবে বন্দর ঘেঁষে রয়েছে হানশিন ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া। কৌশলগত অবস্থানের সুবিধার কারণে বড় বড় সব ইস্পাত ও জাহাজ নির্মাণকারী কোম্পানি কোবেতে তাদের শিল্প-কারখানা স্থাপন করেছে। এছাড়া খাদ্যপণ্য, ছোট অ্যাপ্লায়েন্স এবং যোগাযোগ ও পরিবহন যন্ত্রপাতির কারখানাও গড়ে উঠেছে সেখানে।

শুধু ব্যবসায়ীই নয়, পর্যটকদের কাছেও কোবে বন্দরের কদর রয়েছে বেশ। ক্রুজ পোর্ট হিসেবে বন্দরটি জনপ্রিয়। রোকো পর্বতমালার পাদদেশে হওয়ায় বন্দরটি প্রতিষ্ঠায় বেশ মুন্সিয়ানা দেখাতে হয়েছে কর্তৃপক্ষকে। কারণ সেখানে সমতল জমি রয়েছে খুব কম। এ কারণে বন্দরের বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বেশ কয়েকটি কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করা হয়েছে।

কোবে বন্দর প্রথম উন্মুক্ত করা হয় ১৮৬৮ সালে। সে সময় এর নাম ছিল হিয়োগো বন্দর। জাপানের পশ্চিমে এটি ছিল অন্যতম প্রথম বাণিজ্যিক বন্দর। শুরুর দিকে বন্দরটি পরিচালিত হতো তৎকালীন সামন্ততান্ত্রিক সামরিক সরকার তাকুগাওয়া শোগুনাতের অধীনে। ১৮৭১ সালে জাপানের ঐতিহ্যবাহী সামন্ত্রতন্ত্র বিলুপ্ত হলে বন্দরটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়। বর্তমানে বন্দরের প্রশাসক হিসেবে কাজ করছে কোবে সিটি গভর্নমেন্ট। আর কনটেইনার, লাইনার ও ফেরি টার্মিনালসহ অন্যান্য টার্মিনাল নির্মাণ, ইজারা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে কোবে পোর্ট টার্মিনাল করপোরেশন (কেপিটিসি)।

কোবে বন্দরের দীর্ঘ পথচলায় আরও কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা রয়েছে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রপক্ষ বি-২৯ বোমারু বিমান থেকে এ বন্দরে বোমা ফেলা হয়। এতে প্রায় ৯ হাজার মানুষের মৃত্যু ও শহর এলাকার এক-পঞ্চমাংশ ধ্বংস হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালে সিটি কাউন্সিল কোবে বন্দরে পারমাণবিক অস্ত্রবোঝাই জাহাজ প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর ফলশ্রুতিতে মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলোর বন্দরে প্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৫ সালে গ্রেট হানশিন ভূমিকম্প বন্দরে আঘাত হানে। রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৩ মাত্রার এই ভূমিকম্পের কারণে দুই লাখের বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। প্রাণহানি ঘটে প্রায় ৪ হাজার ৬০০ মানুষের। বন্দরের বেশির ভাগ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্দরসেবায় নেমে আসে স্থবিরতা। ১৯৯৭ সালে বন্দরের পুনর্গঠন সম্পন্ন হয়। ভূমিকম্পে প্রায় ১০ লাখ কোটি ইয়েনের ক্ষয়ক্ষতি হয়, সেই সময় যা ছিল জাপানের জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশের সমান।

১৯৭০-এর দশক ছিল কোবে বন্দরের জন্য স্বর্ণযুগ। সে সময়ে বন্দরটি থেকে বিশ^ব্যাপী সর্বাধিক পণ্য সরবরাহ করা হয়। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত এটি বিশ্বের ব্যস্ততম কনটেইনার পোর্ট ছিল। হানশিনের সেই ভূমিকম্প বন্দরের এতটাই ক্ষতি করেছে যে, পুনর্গঠনের পরও এটি আর তার আগের অবস্থানে ফিরে আসতে পারেনি।

কোবে বন্দরের রয়েছে মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট সুবিধা। সমুদ্র, আকাশ ও স্থলপথে এ বন্দরে পণ্য আনা-নেওয়া করা যায়। বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য রয়েছে রোকো আইল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনাল। এসব টার্মিনালে রয়েছে মোট চারটি বার্থ, যেখানে পানির গড় গভীরতা ১৪ মিটার। এছাড়া বন্দরের পোর্ট আইল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনালে রয়েছে ছয়টি বার্থ। এই টার্মিনালের মোট আয়তন ৭ লাখ ৮৬ হাজার ৮৮০ বর্গমিটার।

বন্দরে ক্রুজ টার্মিনাল হিসেবে রয়েছে কোবে পোর্ট টার্মিনাল ও নাকা পিয়ার ক্রুজ টার্মিনাল। এর মধ্যে কোবে পোর্ট টার্মিনালে রয়েছে ছয়টি বার্থ। আরও রয়েছে কেপিটিসি কনভেনশনাল লাইনার টার্মিনাল ও রোকো আইল্যান্ড ফেরি টার্মিনাল।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের একটি মেগাপ্রকল্পের সঙ্গে কোবে বন্দরের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। দেশের প্রথম মেট্রোরেলের কোচগুলো নির্মাণ হচ্ছে জাপানে। আর সেগুলো কোবে বন্দর থেকে মোংলা বন্দর হয়ে নদীপথে ঢাকায় আনা হচ্ছে।

ইনফোগ্রাফিক্স- সেপ্টেম্বর, ২০২১

পায়রাতেও ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল

বিসিআইএম: সম্ভাবনাময় এক অর্থনৈতিক করিডোর

বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক খাতে অগ্রসরমান একটি দেশ। একসময়ের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর দেশটি আজ সারা বিশে^র জন্য উন্নয়নের রোলমডেল। মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জনের পথে অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে বাংলাদেশকে। দেশের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অর্জিত অবস্থান সংহত করা এবং নতুন লক্ষ্যে পৌঁছানো। এজন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো ভৌগোলিক অবস্থানগত সুযোগ কাজে লাগানো। বর্তমান যুগ যোগাযোগ বা কানেক্টিভিটির। যোগাযোগ খাতে অগ্রসর হতে পারলে ব্যবসার ব্যয় বা কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস কমবে। বাড়বে উৎপাদন সক্ষমতা। এছাড়া বিশ্ববাজার ও একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতাও বাড়বে। মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে অভ্যন্তরীণ বাজারে নিজ দেশের উৎপাদকের পাশাপাশি অন্য দেশের উৎপাদকের সঙ্গেও প্রতিযোগিতা করতে হয়। কানেক্টিভিটি এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত এখন বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। আর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীনও আমাদের কাছের দেশ। এ দুটি দেশ থেকে আমাদের প্রয়োজনীয় পণ্যের বেশির ভাগ আমদানি হয়। চীন থেকে বছরে প্রায় এক হাজার কোটি ডলার ও ভারত থেকে ৬০০ কোটি ডলারের পণ্য আসে বাংলাদেশে। বিপরীতে জনবহুল এ দেশ দুটিতে আমাদের জন্যও রয়েছে সম্ভাবনাময় বিশাল বাজার। বাংলাদেশ সেখানে প্রচুর পণ্য রপ্তানি করতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত দেশ দুটি থেকে আমদানির তুলনায় রপ্তানি অনেক কম। এক্ষেত্রে অবশ্যই কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তবে শুল্ক বাধার চাইতে অশুল্ক বাধাই অনেক বড়। সেটা দূর করা বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ উতরাতে হলে আঞ্চলিক সংযোগ বা কানেক্টিভিটি উন্নত করতে হবে। বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার (বিসিআইএম) অর্থনৈতিক করিডোর সেই সুযোগটাই করে দেবে।

বিসিআইএম হলো একটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক করিডোর, যার উদ্যোক্তা চীন। বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার নিয়ে এই করিডোর গঠনের প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। এটি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দ্বার খুলে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বিআরআই: সিল্ক রোডের পুনরুত্থান

বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বা ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (ওবিওআর) যে নামেই ডাকা হোক না কেন, প্রকৃত অর্থে এটি হলো প্রাচীন সিল্ক রোডেরই নতুন সংস্করণ। এক কথায় বলা যায়, পুরনো কাঠামোর ওপর ভিত্তি করেই কোনো কিছুর নতুন রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা এটি।

অর্থনৈতিক শক্তি বজায় রাখতে যতগুলো বাণিজ্যিক যোগাযোগ সুবিধা থাকা দরকার, তার সবটা কাজে লাগাতে চায় বেইজিং। এজন্য চীনের বিআরআই প্রস্তাবনাটি কৌশলগত কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ উদ্যোগ নতুন কোনো বিষয় নয়। প্রাচীনকালে চীনের বণিকরা এশিয়া ও ইউরোপের সঙ্গে সিল্ক রোড দিয়ে ব্যবসা করতেন। মূলত তারই পুনরুত্থান হচ্ছে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রস্তাবিত বিআরআই।

চীনে খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ অব্দের দিকে হান সা¤্রাজ্যের সময়ে সিল্ক রোড বা সিল্ক রুট নামের এই বাণিজ্য পথটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ পথ দিয়ে শুধু চীনা ব্যবসায়ীরাই নন, বরং আরব, তুরস্ক, ভারত, ইরান, সিরিয়া, আর্মেনিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীরা মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, আরব, ইউরোপ ও আফ্রিকায় বাণিজ্য করতেন। এই পথের নাম সিল্ক রোড হওয়ার কারণ হলো এ পথে চীনের উৎকৃষ্ট মানের রেশম বিশে^র বিভিন্ন দেশে পাঠানো হতো।

বিআরআই ও বিসিআইএম

১৯৩০ সালে ব্রিটিশ সরকার দুই হাজার বছরের পুরনো সিল্ক রোড চালুর উদ্যোগ নিয়েছিল। চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য কক্সবাজার, টেকনাফ, মিয়ানমারের আকিয়াব, মান্দালয় হয়ে চীনের কুনমিং পর্যন্ত পৌঁছানোই ছিল এ পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের কারণে এ উদ্যোগের বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এর প্রায় সাত দশক পর ১৯৯৯ সালে বাণিজ্যিক শহর কুনমিংয়ে সিল্ক রোড পুনরুজ্জীবিত করার ঘোষণা দেয় চীন। ১৪ বছর ধরে প্রস্তাবটি নিয়ে কাজ করে চীন। কিন্তু অন্য দেশগুলো তখন তেমন সাড়া দেয়নি। তবে অর্থনৈতিক লাভের বিষয়টি ভেবে বর্তমানে সব দেশই ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে।

বিসিআইএম মূলত চীনের বিআরআই উদ্যোগেরই একটি অংশ। প্রাচীন সিল্ক রোড একসময় এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটিয়েছিল। ওবিওআর বা বিআরআইয়ের মাধ্যমে সেই সমৃদ্ধিই আবার ফিরিয়ে আনতে চাইছে চীন। পার্থক্য কেবল একটাই-বর্তমান ভূ-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই করিডোর নতুনভাবে সম্প্রসারণের ছক এঁকেছে তারা। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে চীন একটি ইকোনমিক ল্যান্ড বেল্ট গঠনের বিষয়ে কাজ করছে, যার ফলে প্রাচীন সিল্ক রোডের আওতাধীন দেশগুলোর সঙ্গে মধ্য এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ যুক্ত হবে। এছাড়া চীন একটি মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্কও গড়ে তুলতে চাইছে, যার মাধ্যমে দেশটির বন্দরগুলোর সঙ্গে আফ্রিকান ঊপকূলের সংযোগ স্থাপন হবে।

ওবিওআর ধারণা প্রথমে সামনে আসে ২০১৩ সালে। সংগত কারণেই অনেক দেশ এ উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। তারা উপলব্ধি করে, যদি এশিয়া ও বিশে^র অন্যান্য স্থানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি বাড়াতে হয়, তাহলে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও মানুষে মানুষে যোগাযোগ গভীরতর করতে হবে। এশিয়া ও ইউরোপের সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ও সহযোগিতা বাড়াতে পারলে অর্থনীতিতে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ভোক্তা ও উৎপাদক, আমদানি ও রপ্তানিকারক-সবাই এর সুফলভোগী হবে।

বিসিআইএম নিয়েও আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয় ২০১৩ সালে। সে বছরের ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয় চার দেশের প্রতিনিধি দলের প্রথম বৈঠক। পরের বছরের ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বর কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী সম্মেলনে অংশ নেয় বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মিয়ানমার। সেই সম্মেলনে বিসিআইএম বিষয়ে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে চার দেশ। এতে জ্বালানি সহযোগিতা, জলবায়ু পরিবর্তন, বাণিজ্য সহজীকরণ, শুল্ক কমানো, অ-শুল্ক বাধা দূর, সংস্কৃতি বিনিময় ও জনসাধারণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়, দারিদ্র্য বিমোচন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিষয় উঠে আসে।

গতিশীল হবে বিনিয়োগ

বিসিআইএম করিডোর নিয়ে চার দেশ অনেক দিন ধরেই কাজ করছে। বিসিআইএম দেশগুলোয় ২৮০ কোটি মানুষের বসবাস, যার অর্থনীতির আকার ১১ লাখ কোটি ডলার। বিসিআইএমের বিষয়টি সমন্বয় করছে চীনের ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট রিফর্মস কমিটি (এনডিআরসি)। সড়ক, রেল ও সমুদ্রপথকে ব্যবহার করে এই এলাকার মানুষের মধ্যে একটি বড় বাজার সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। এর আগে চীনের উদ্যোগে এ অঞ্চলের ২১টি দেশ মিলে ৫ হাজার কোটি ডলারের তহবিল নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সিল্ক রোড চালুর জন্য ৪ হাজার কোটি ডলারের আর্থিক সহায়তাও ঘোষণা করেছেন। সিল্ক রোড নির্মাণ ও এই অঞ্চলের অবকাঠামোগত উন্নয়নে খরচ করা হবে এই অর্থ। বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে অর্থনৈতিক করিডোর চালুর জন্য যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠায় প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার লাগবে বলে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে কক্সবাজার সম্মেলনে প্রাথমিকভাবে জানানো হয়েছিল। বিসিআইএম চালু হলে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়াসহ ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান, আফগানিস্তানও যুক্ত হতে পারবে।

২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরকালে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু হয় এবং প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের উন্নয়নের বিষয়ে সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বিআরআই উদ্যোগের আওতায় এসব উন্নয়ন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত।

চীনের কুনমিং থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোরের আওতায় কী কী প্রকল্প গ্রহণ করা যাবে, সেটা নিয়ে যৌথ স্টাডি গ্রুপের সমীক্ষা চলছে। এ ধরনের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে চাই অবকাঠামো খাতে প্রচুর বিনিয়োগ। এআইআইবি গঠনের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে এসব খাতের অর্থের জোগান দেওয়া। এ ব্যাংক স্থাপনে চীনের উদ্যোগ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বাংলাদেশসহ অর্ধশতাধিক দেশ এরই মধ্যে এর সদস্য হয়েছে।

কুনমিং থেকে কলকাতা পর্যন্ত অর্থনৈতিক করিডোর কেবল যোগাযোগের করিডোর হবে না। এর অর্থনৈতিক করিডোরে রূপান্তরের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। এর আওতায় বিনিয়োগ বাড়বে। অর্থনৈতিক কর্মকা- জোরদার হবে। পরিবহন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যয় কমিয়ে আনার জন্য নেওয়া হবে বিভিন্ন পদক্ষেপ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চীন হচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান আমদানি উৎস। বাংলাদেশ বিশ^বাজার থেকে যত পণ্য আমদানি করে, তার বড় একটি অংশ আসে চীন থেকে। সাম্প্রতিক সময়ে চীন ভারতেরও অন্যতম প্রধান বাণিজ্য অংশীদার হয়ে উঠেছে। দুই দেশের মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ৬ হাজার কোটি ডলার। কুনমিং থেকে কলকাতার যোগাযোগ সহজ হলে পরিবহন ব্যয় কমবে এবং দেশ দুটি তা থেকে বিপুলভাবে উপকৃত হবে। এজন্য যে বিনিয়োগ হবে, তাতে বহু মানুষের নতুন কর্মসংস্থান হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে বাণিজ্য আশানুরূপ নয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর এই আঞ্চলিক বাণিজ্যে প্রয়োজনীয় গতি আনতে সক্ষম হবে। ভারতের রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম ফর ডেভেলপিং কান্ট্রিজের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, এই করিডোর ১ হাজার ৩২০ কোটি ডলারের বাণিজ্যের দুয়ার খুলে দিতে পারে।

২০১৯ সালের জুনে চীনে অনুষ্ঠিত বিসিআইএম আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরামে ১২-দফা যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা।

রয়েছে চ্যালেঞ্জ

বিসিআইএম বাস্তবায়নে কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথমেই বলতে হবে অপ্রতুল বাজার প্রবেশাধিকারের কথা। এছাড়া অ-শুল্ক বিভিন্ন বাধা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে অনুকূল ব্যাংকিং ও ফিন্যান্সিয়াল মেকানিজমের অনুপস্থিতি সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিসিআইএম থেকে সুবিধা নিশ্চিত করতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। এ বিষয়টিও খুব একটা সহজ হবে না।

চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি) ও বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর দুটোই বিআরআইয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই দুই উদ্যোগের অংশীদার দেশগুলোর মধ্যকার ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক যে খুব উষ্ণ, তা বলা যাবে না। ফলে সবদিক সামাল দিয়ে দুটি প্রকল্প নিয়ে এগোনো একটু কঠিন হবে বৈকি।

বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোরকে কেন্দ্র করে এর আগেও এ ধরনের চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছিল। এই করিডোরটিকে চীন তাদের উচ্চাভিলাষী বিআরআই প্রকল্পের অংশ হিসেবেই দেখাতে চায়। কিন্তু এই বিআরআইয়েরই আরেকটি অংশ পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে-এই যুক্তিতে ভারত এই উদ্যোগকে না বলে দেয়। কারণ ভারত সমগ্র কাশ্মীরকে নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি করে থাকে এবং সেই ভূখ-ের ওপর অন্য দেশের কোনো আন্তর্জাতিক প্রকল্প মেনে নেওয়াকে নিজেদের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে আপস হিসেবেই দেখে তারা।

ভারতের এই বিরোধিতার কারণেই ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত বিআরআই-সংশ্লিষ্ট ৩৫টি করিডোর ও প্রকল্পের তালিকায় নাম ছিল না বিসিআইএমের। তবে সে বছরই ১৩তম বিসিআইএম ফোরামে নিজেদের প্রতিনিধি পাঠানোর মাধ্যমে ভারত এই উদ্যোগে আবার প্রাণ ফিরিয়ে দেয়।

বাংলাদেশ অবশ্য বরাবরই আশপাশের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তোলার পক্ষে মত দিয়ে আসছে। গত এক দশকে ভারত ও বাংলাদেশ মিলে একশর কাছাকাছি কানেক্টিভিটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। বিসিআইএম কার্যকর হলে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কও আরও জোরদার হবে।

চীন মনে করে, বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর বাস্তবায়িত হলে চলমান রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের পথ সুগম হবে। ছবিটি বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের উখিয়া ক্যাম্পের

লাভবান হবে বাংলাদেশ

কৌশলগত অবস্থান ও শ্রমশক্তির কারণে সিল্ক রোডের মাধ্যমে এ অঞ্চলের বিশাল বাজারের সুবিধা নিতে পারবে বাংলাদেশ। তৈরি পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ যেমন বিশ্ববজারে প্রতিযোগিতা করছে, তেমনি সিল্ক রোড কাজে লাগিয়ে চামড়া, তথ্যপ্রযুক্তি ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে আরও বিকশিত করার সুযোগ পাবে। বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে পরিবহন নেটওয়ার্ক শক্তিশালী হলে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, বিদ্যুৎ ও পর্যটন যোগাযোগে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে। প্রস্তাবিত বিসিআইএম করিডোরটির আওতায় আসবে চীনের ইউনান প্রদেশ, বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারতের সাড়ে ১৬ লাখ বর্গকিলোমিটারের বিশাল অঞ্চলের ৪৪ কোটি মানুষ; পাশাপাশি থাকবে সড়ক, জল ও আকাশপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা। রুটটি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল দিয়ে হলে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক ব্যবসার সুযোগ বাড়িয়ে দেবে। চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য কক্সবাজার, টেকনাফ হয়ে মিয়ানমারের আকিয়াব, মান্দালয় হয়ে কুনমিং পর্যন্ত পৌঁছাবে।

বর্তমানে চীন থেকে বাংলাদেশে পণ্য আনতে খরচ বেশি পড়ছে। এছাড়া রপ্তানিতেও খরচ বেশি পড়ায় চীনের বাজারে সুবিধা করতে পারছে না বাংলাদেশী পণ্য। ভারত যেভাবে তার এক অংশ থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্যে পণ্য নিতে বাংলাদেশের কাছে ট্রানজিট চাইছে, তারও অনেকখানি পূরণ করবে এই অর্থনৈতিক করিডোর।

বিসিআইএম নিয়ে করা এশিয়া প্যাসিফিক রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং নেটওয়ার্ক অন ট্রেডের গবেষণায় দেখা গেছে, চারটি দেশের মধ্যকার বাণিজ্যনীতি যদি আংশিক উদারীকরণ করা হয়, তাহলে ন্যূনতম ৩ হাজার ১২০ কোটি টাকার শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা ভোগ করতে পারবে বাংলাদেশ। সর্বোচ্চ সুবিধা পাবে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার। এছাড়া সব মিলিয়ে এই চার দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে সাড়ে ৪৪ হাজার কোটি টাকা।

পাশাপাশি ভৌগোলিক কারণে রপ্তানি সেবায় বড় ধরনের আয় হবে বাংলাদেশের। এই অঞ্চল বিনিয়োগের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হবে, ব্যাপক পরিবর্তন হবে অর্থনীতির।

বিসিআইএম করিডোর বিষয়ে বাংলাদেশেও গবেষণা চালানো হচ্ছে যথেষ্ট। এসব গবেষণায় দেখা গেছে, ঐতিহাসিক সিল্ক রোডের পুনরুত্থানে লিড টাইম কমে যাবে অনেকটা, যা দ্রুত পরিবর্তনশীল এই বিশে^ প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ক্ষেত্রে একটা বড় নিয়ামক।

চীনের বাজারে ৫ হাজার ৭০০ পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পায় বাংলাদেশ। বিসিআইএম করিডোর কার্যকর হলে এই সুবিধার পরিসর আরও বাড়বে বলে আশা করা যায়। এছাড়া বাংলাদেশের মেশিনারি, হালকা প্রকৌশল ও ইন্টারমিডিয়েট গুডসের মতো শিল্প খাতগুলোয় চীনের বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিসিআইএম উদ্যোগ এই বিনিয়োগ আসার পথ আরও সুগম করবে। এছাড়া সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনাময় খাতগুলো অনুসন্ধানেও চীনকে পাশে পেতে পারে বাংলাদেশ।

বিসিআইএম উদ্যোগ বাস্তব রূপ নিলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, পরিবহন অবকাঠামো, শিপিং, পর্যটন, ব্যবসা ও বিনিয়োগ খাত নিশ্চিতভাবেই গতিশীল হবে। তবে এই উদ্যোগ থেকে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ কতটা সুবিধা আদায় করে নিতে পারবে, সে বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের প্রত্যাশা

বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর বাস্তবায়নের মধ্যে চলমান রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান অন্তর্নিহিত বলে বিশ্বাস করে চীন। ২০১৯ সালের মে মাসে এক সম্মেলনে এমন কথা জানিয়েছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং জু। সে সময় তিনি বলেছিলেন, চীন রোহিঙ্গা ইস্যু গভীরভাবে লক্ষ করছে। বেইজিং আশা করে, বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর বাস্তবায়নে সমস্যাটির উপযুক্ত সমাধান আসবে। বাংলাদেশ বিআরআই উদ্যোগের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারের মর্যাদা পাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন ঝ্যাং জু।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মিয়ানমারের রাজনৈতিক পটভূমিতে পরিবর্তন এসেছে। বিসিএমআই অর্থনৈতিক করিডোরও এখনো প্রস্তাবনার পর্যায়েই রয়েছে। তাই পরিবর্তিন প্রেক্ষাপটে এই উদ্যোগ রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়, তা দেখতে হলে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।

উপসংহার

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের সুযোগ রয়েছে আঞ্চলিক অর্থনীতির কেন্দ্রে পরিণত হওয়া। এ উদ্দেশ্য সামনে রেখেই মূলত চীনের বিআরআই ও বিসিআইএম উদ্যোগে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ। আসলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বরাবরই আঞ্চলিক সুসম্পর্ক ও অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততার প্রতি জোর দিয়ে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী মনে করেন, গোটা বিশ্ব আজ গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। এ কারণে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কানেক্টিভিটি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। চীনের বিআরআই কিংবা বিসিআইএম উদ্যোগের ফলে এই যোগাযোগ ব্যবস্থা বা কানেক্টিভিটির উন্নতি হবে, যার অর্থনৈতিক সুফল পাবে সংশ্লিষ্ট সব দেশ। বাংলাদেশ যেন কোনোভাবেই এই সুফল থেকে বঞ্চিত না হয়, সেই লক্ষ্য সামনে রেখেই কূটনৈতিক অবস্থান নিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে কোনো দেশের সঙ্গে দ্বন্দ্বে না জড়ানোর বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।

যেকোনো আঞ্চলিক উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে গেলে বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি আসবে। কৌশলগত অবস্থান, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন প্রভাবক, নীতিগত মতপার্থক্যের কারণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। কূটনৈতিক আলোচনা ও তৎপরতার মাধ্যমে এসব বাধা দূর করা সম্ভব। অতীতেও এমনটি দেখা গেছে। বিসিআইএমের ক্ষেত্রেও এ কথা সমানভাবে প্রযোজ্য। উদ্যোগটি বাস্তবায়নের পথে যদি নতুন করে কোনো চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়, তবে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে তা মোকাবেলা করা সম্ভব হবে বলে বাংলাদেশ বিশ্বাস করে।

বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোরটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্তরণের গতি আরও ত্বরান্বিত হবে। দেশের মানুষও এতে লাভবান হবে। কারণ এই যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরির ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে, যার ফলে বিপুল কর্মসংস্থান তৈরি হবে। অর্থাৎ দেশের জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বিসিআইএম। এ কারণে সম্ভাব্য সব চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে উদ্যোগটির সফল বাস্তবায়ন হবে, এটাই এখন প্রত্যাশা।

মহামারিকালে বৈশ্বিক কনটেইনার সংকট বাণিজ্য সুরক্ষায় উদ্যোগী চট্টগ্রাম বন্দর

বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রধান প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দর। দেশের মোট সমুদ্র বাণিজ্যের ৯০ শতাংশের বেশি সম্পন্ন হয় এ বন্দর দিয়ে। সুতরাং দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দরের গতিশীলতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। বন্দর কর্তৃপক্ষ সেই কাজটি বেশ দক্ষতার সঙ্গেই করে চলেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় লয়েড’স লিস্টে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থানের ক্রমশ উন্নতি সেটাই প্রমাণ করে। কিন্তু সেই অগ্রযাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনাজনিত নানা সংকট। বিশেষ করে বৈশ্বিক কনটেইনার সংকটের আঁচ লেগেছে চট্টগ্রাম বন্দরেও, যা প্রধানত দুভাবে বন্দরের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করছে।

যখন কোনো বন্দরে কনটেইনারের সংখ্যা ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি হয়ে যায়, তখন তা জটের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এই কনটেইনারজট বন্দরের কাজের গতিশীলতা কমায়। অন্যদিকে যখন কোনো বন্দর দিয়ে পণ্য রপ্তানির সময় পর্যাপ্ত সংখ্যক কনটেইনার পাওয়া যায় না, তখন সেই ঘাটতি রপ্তানি বাণিজ্যকে বাধাগ্রস্ত করে। কনটেইনারজট ও কনটেইনারস্বল্পতা-এ দুটোই এখন বৈশ্বিক সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সেই প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর।

ভোক্তা চাহিদায় হঠাৎ উত্থানের কারণে দেশে দেশে আমদানি বেড়ে যাওয়া, শীর্ষ শিল্পোৎপাদক দেশগুলো পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়িয়ে দেওয়া, ই-কমার্সের জোয়ার, জাহাজের ব্ল্যাংক সেইলিং, নতুন কনটেইনার উৎপাদন কমে যাওয়াসহ আরও কিছু কারণে এই কনটেইনার সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকট বৈশি^ক হওয়ার কারণে বাংলাদেশের একার পক্ষে তা দূর করা সম্ভব নয়। তবে এর প্রভাব যেন দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ওপর কম পড়ে, তা নিশ্চিত করতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে।

বন্দর, কনটেইনার এবং বিশ্ব বাণিজ্য

বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো সমুদ্রবন্দর। উৎপাদনকারীর কাছ থেকে পণ্য ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে ইন্টারমিডিয়েট পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে বন্দর। বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও বন্দরের গুরুত্ব অনেক। কোনো অঞ্চলের বন্দরের পণ্য হ্যান্ডলিং ১০ শতাংশ বাড়লে তা ওই অঞ্চলের জিডিপিতে ৬-২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এনে দিতে পারে।

আঙ্কটাডের একটি উপাত্ত বলছে, পরিমাণের দিক থেকে বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ ও মূল্যমানের দিক থেকে ৭০ শতাংশ সম্পন্ন হয় সমুদ্রপথে। ২০১৭ সালের দিকে বিশ্ব অর্থনীতির পালে জোর হাওয়া লাগতে শুরু করলে এই সমুদ্র পরিবহনের গতিও ঊর্ধ্বমুখী হয়। আর এই উত্থানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে সমুদ্রবন্দরগুলো।

বিশ্ব বাণিজ্য কতটা গতিশীল থাকবে, তা অনেকটাই নির্ভর করে সমুদ্রবন্দরগুলোর কর্মদক্ষতার ওপর। এর পাশাপাশি চাহিদা, শিল্পোৎপাদন, ভোক্তাদের ব্যয় সক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়গুলো তো রয়েছেই। বন্দরগুলো কতটা দ্রুত পণ্য বোঝাই-খালাস করতে পারছে, তার ওপর নির্ভর করে সমুদ্র পরিবহন ও বিশ^বাণিজ্য কতটা মসৃণ গতিতে এগিয়ে যাবে। এ কারণে দেশে দেশে এখন বন্দর সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর নজর দেওয়া হচ্ছে।
এই যে বৈশি^ক বাণিজ্যে মোট পণ্যের বড় একটা অংশ পরিবহন হয় সমুদ্রপথে, তার সিংহভাগ আবার পরিবহন হয় কনটেইনারে। বিশেষ করে নন-বাল্ক কার্গোর প্রায় ৯০ শতাংশ পরিবহন হয় কনটেইনারবাহী জাহাজে। নিরাপদ ও সুবিধাজনক মাধ্যম হওয়ায় বিশে^র বড় বড় শিপিং কোম্পানিগুলো এখন ভোগ্যপণ্য পরিবহনে কনটেইনারকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।

কনটেইনার জাহাজের ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। গত শতকের পঞ্চাশের দশকের শুরুতে প্রথম মডেলের কনটেইনার জাহাজের যাত্রা হয়। এরপর গত ছয়-সাত দশকে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে কনটেইনারের চাহিদা ও জাহাজগুলোর বহন সক্ষমতা দুটোই বেড়েছে। এই যেমন ১৯৬৮ সালের তুলনায় বর্তমানের জাহাজগুলো ১ হাজার ২০০ শতাংশ বেশি কনটেইনার পরিবহন করতে পারে। অন্যদিকে সমুদ্র পরিবহন খাতে কনটেইনারের চাহিদা এখন আকাশচুম্বী। চলতি বছর এরই মধ্যে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।

বিশ্ব জুড়ে শিপিং কোম্পানি ও বন্দর কর্তৃপক্ষগুলো এই বাড়তি চাহিদা সামাল দিতে ধীরে ধীরে নিজেদের সক্ষম করে গড়ে তুলছিল। এমনই একসময়ে হানা দিল বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯। রাতারাতি পাল্টে গেল চিত্রপট। স্থবির হয়ে পড়ল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কর্মকা-। ধস নামল ভোক্তা চাহিদা ও শিল্পোৎপাদনে। ভেঙে পড়ল সাপ্লাই চেইন। এরপর দেখা গেল চীনের উৎপাদন তৎপরতা ও মহামারির প্রথম ঢেউ শেষে ভোক্তাচাহিদায় হঠাৎ ঊর্ধ্বগতি। বৈশ্বিক বাণিজ্যের এই দ্রুত পটপরিবর্তনের সঙ্গে ঠিক খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি সমুদ্র পরিবহন খাত। এর সঙ্গে বিভিন্ন প্রভাবক যোগ হওয়ায় দেশে দেশে বন্দরগুলোয় দেখা দেয় কনটেইনার ও জাহাজজট। আবার চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় খালি কনটেইনারের যে স্বল্পতা দেখা দিয়েছে, তা-ও বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ দুই সংকট বৈশি^ক সাপ্লাই চেইনের জন্য বিশেষ মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সাধারণত একটি দেশে আমদানি করা পণ্যবাহী কনটেইনার বন্দরে খালাস করে সেটি খালি ফেরত পাঠানো হয় না। সেই দেশ থেকে রপ্তানিমুখী পণ্য বোঝাই করে তবেই সেই কনটেইনার আবার জাহাজে তোলা হয়। এখন যদি কোনো দেশে আমদানির পরিমাণ হঠাৎ বেড়ে যায়, তবে সেখানে কনটেইনারের প্রবাহ বেড়ে যায়। কিন্তু সেই অনুযায়ী রপ্তানি না বাড়লে কনটেইনারগুলো সেখানে আটকে পড়ে। এতে করে একদিকে সেই দেশের বন্দরে যেমন কনটেইনারজট তৈরি হয়, অন্যদিকে অন্যান্য দেশের রপ্তানিকারকদের কনটেইনার সংকটে পড়তে হয়।

করোনাকালীন পরিস্থিতিতে সেটাই হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, কনটেইনার জট ও স্বল্পতার কারণে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের মোট বৈশি^ক সক্ষমতার ১০ শতাংশ অব্যবহৃত থাকছে।

করোনায় বন্দর কার্যক্রমে সংকট: চীন ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ভোগ্যপণ্যের বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের পাওয়ার হাউস হয়ে উঠেছে চীন। বিশ্ব অর্থনীতির দ্বিতীয় বৃহত্তম এই পরাশক্তির রয়েছে বৈশ্বিক জিডিপিতে ১৬ শতাংশে হিস্যা। আর বৈশ্বিক অর্থনীতির ধসের জন্য কারণ যে নভেল করোনাভাইরাস, তার উৎপত্তি সেই চীনেই। করোনার কারণে চলতি বছর বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ১৩-৩৩ শতাংশ সংকোচন দেখা যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হওয়ার কারণে চীনের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে যেকোনো সংকট তৈরি হলে তার রেশ টানতে হয় পুরো বিশ্বকে সমুদ্র পরিবহনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। চীনা সমুদ্রবন্দরগুলোর কার্যক্রমে যেকোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলে বৈশ্বিক আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে চীনের গুরুত্বপূর্ণ দুটি বন্দরে করোনাজনিত স্থবিরতা সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। গত মে মাসে শেনঝেনের ইয়ানতিয়ান পোর্টের কার্যক্রম বন্ধের কারণে সাংহাই ও হংকং বন্দরে জট লেগে যায়। এছাড়া জুনের বেশির ভাগ সময়েই চীনের গুরুত্বপূর্ণ এই এক্সপোর্ট হাবের মোট সক্ষমতার মাত্র ৩০ শতাংশ কার্যক্রম চালু ছিল। পরবর্তী সময়ে সেই জট ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই নতুন করে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের তৃতীয় ব্যস্ততম কনটেইনার পোর্ট নিংবোর সংকট। একজন ডকওয়ার্কার করোনা পজিটিভ শনাক্ত হওয়ার পর ১১ আগস্ট থেকে এক সপ্তাহের জন্য বন্দরটির আংশিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এতে বন্দরটি ঘিরে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, যা চীনের অন্য বড় বন্দরগুলোর ওপরও চাপ তৈরি করেছে। সাংহাই ও হংকংয়েও নতুন করে জট তৈরি হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সমুদ্রবাণিজ্যের প্রধান দুটি গেটওয়ে হলো পোর্ট অব লস অ্যাঞ্জেলেস ও পোর্ট অব লং বিচ। কোভিড-১৯ মহামারির শুরুর দিকে এই দুই বন্দরে বার্থিং স্পেসের জন্য স্যান পেড্রো বে-তে অপেক্ষারত জাহাজের সংখ্যা রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছায়। এখন পরিস্থিতি আবার সেদিকেই এগোচ্ছে। গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে এ দুই বন্দরে বার্থিংয়ের জন্য অপেক্ষারত কনটেইনার জাহাজের সংখ্যা ২০ ছাড়িয়ে যায়। জুনে এ সংখ্যা ছিল ১০।
মূলত ২০২০ সালের শেষ ও চলতি বছরের শুরুর দিকে তীব্র জট দেখতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলীয় বন্দরগুলো। এর প্রধান তিনটি কারণ হলো:
 ই-কমার্সের উত্থান ও ভোগ্যপণ্যের আমদানি বৃদ্ধি
 চীনের উৎপাদন কার্যক্রমে ঊর্ধ্বগতি ও চান্দ্র নববর্ষের ছুটির মধ্যেও কারখানায় উৎপাদন চালু রাখা
 করোনার কারণে বন্দরে কর্মীর স্বল্পতা তৈরি হওয়া। এর ফলে মেরিন টার্মিনাল প্রডাক্টিভিটির গতি শ্লথ হয়ে পড়ে।

মহামারির প্রভাব কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ভোক্তা ব্যয় আবার চাঙ্গা হতে শুরু করেছে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনরায় খুলতে শুরু করায় সামনে এ ব্যয় আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সরবরাহ বৃদ্ধিরও প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এর ফলে দেশটিতে চীনা পণ্য আমদানিতে হঠাৎ করেই জোয়ার তৈরি হয়েছে। আর এই চাপ গিয়ে পড়েছে কনটেইনার পোর্টগুলোর ওপর।

করোনার কারণে কেবল চীন বা যুক্তরাষ্ট্রই নয়, বরং বন্দর কার্যক্রমে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তেই। গত মার্চে সিঙ্গাপুর বন্দরে ১৮ হাজার টিইইউ অথবা এর চেয়ে বেশি ধারণক্ষমতার আল্ট্রা-লার্জ কনটেইনার জাহাজের অপেক্ষমাণ থাকার সময় দাঁড়ায় পাঁচ থেকে সাত দিন, যেখানে বন্দরটিতে জাহাজের স্বাভাবিক টার্ন-অ্যারাউন্ড সময় দুদিন। মেরিন ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস ইইসির তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ে হংকং বন্দরে জাহাজের ওয়েটিং রেশিও ছিল ৬৭ শতাংশ। ওকল্যান্ড, স্যাভানাহ, সিয়াটল ও ভ্যাঙ্কুভার বন্দরেও ওয়েটিং রেশিও ছিল ৬৫ শতাংশের ওপরে।

এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সব দেশই আকাশ ও সমুদ্রপথে পরিবহনের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে সঙ্গে সংযুক্ত। মহামারির শুরুর দিকে এসব দেশ করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরওপ করে। এতে আকাশ ও সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের বেশির ভাগ কার্যক্রমই স্থবির হয়ে পড়ে।
করোনার কারণে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সতর্কতামূলক পদক্ষেপও ছিল কঠোর। অনেক দেশেই বহিরাগতদের জন্য ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করা হয়। এই নিয়মের কারণে এসব দেশে পণ্যবাহী জাহাজের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এই প্রতিবন্ধকতার কারণে কিছু শিপিং কোম্পানি তাদের শিডিউল ও রুট পরিবর্তন করে। আবার যারা শিডিউল অপরিবর্তিত রেখেছে, তাদের কেউ কেউ গ্রাহকদের কাছ থেকে কোয়ারেন্টিন সারচার্জ নিয়েছে। কেউ আবার কোয়ারেন্টিনজনিত বিলম্বের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা দাবি করেছে।

মহামারির কারণে এশিয়া-প্যাসিফিক দেশগুলোর ভোক্তাবাজারে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। অতিমারির শুরুর দিকে ভোক্তা চাহিদায় ধস নামলেও প্রথম প্রবাহ শেষে তা হঠাৎ বেড়ে যায়।

কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সারা বিশ্বেই অর্থনৈতিক মন্দা নেমে এসেছে। এই মন্দার কারণে বৈশ্বিক শিল্পোৎপাদন ও ম্যানুফ্যাকচারিং কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে আসে। পরিবর্তন এসেছে ভোক্তা ব্যয় ও চাহিদার প্যাটার্নে। আসলে এই মহামারি ব্যবসায়িক পরিবেশেই পরিবর্তন এনেছে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে শিপিং ও লজিস্টিকস মার্কেটেও। বৈশ্বিক অর্থনীতির নিম্নগামিতায় মেরিটাইম ট্রেড ও পোর্ট ট্রাফিকও পতনমুখী হয়েছে।

করোনার প্রাথমিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চান্দ্র নববর্ষের ছুটির মধ্যেও শিল্পোৎপাদন চালু রেখেছিল চীন। এই বাড়তি উৎপাদিত পণ্য পরিবহনের জন্য কনটেইনারের চাহিদা বেড়ে যায়

জাহাজের অপেক্ষার সময় ২০১৯ সালের তুলনায় দ্বিগুণ

নভেল করোনাভাইরাসের প্রথম প্রবাহের স্থবিরতা কাটিয়ে ভোক্তা চাহিদা ফের চাঙ্গা হতে শুরু করায় পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় তৈরি হয়েছে বাড়তি চাপ। সেই চাপ সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খাওয়ার জোগাড় বৈশ্বিক শিপিং খাতের। বাণিজ্য বেড়ে যাওয়ায় বন্দরগুলোয় পণ্য ও জাহাজজটের ঘটনা বেড়েছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ব্যস্ততম বন্দরগুলোর নিয়মিত চিত্র এটি। আইএইচএস মার্কিটের বিশ্লেষণ বলছে, বর্তমানে কনটেইনার জাহাজগুলোকে বার্থিংয়ের জন্য গড়ে যতটা সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে, ২০১৯ সালের তুলনায় তা দ্বিগুণের বেশি।

আইএইচএস মার্কিট বলছে, ভোক্তা চাহিদা বেড়ে যাওয়া, যন্ত্রপাতির সংকট ও মহামারির অন্যান্য প্রভাবের কারণেই মূলত বন্দরে জাহাজগুলোর বার্থিংয়ে বিলম্ব হচ্ছে। বিশ্ববাণিজ্যের পুনরুদ্ধারের গতি আরও ত্বরান্বিত হওয়া এবং এর ব্যাপকতা বেড়ে যাওয়ায় বন্দরের এই জটিলতা আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছে প্রতিষ্ঠানটি।

আইএইচএস মার্কিটের পোর্ট পারফরম্যান্স ডাটা বলছে, চলতি বছরের মে মাসে উত্তর আমেরিকার বন্দরগুলোয় জাহাজগুলোকে গড়ে সবচেয়ে বেশি ৩৩ ঘণ্টা সময় অ্যাংকরিংয়ে কাটাতে হয়েছে, ২০১৯ সালের একই সময়ে যা ছিল মাত্র আট ঘণ্টা। পোর্ট অব লং বিচ ও লস অ্যাঞ্জেলেসের বন্দরগুলোয় বিলম্ব সবচেয়ে বেশি হয়েছে। আইএইচএস মার্কিট বলছে, উত্তর আমেরিকার এই বন্দরগুলোর মতো অবস্থা বিশ্বের প্রায় সব শীর্ষ বন্দরেরই।

সংকটের নেপথ্যে…

বৈশ্বিক রপ্তানি বাণিজ্যে চীনের একক অংশীদারত্ব ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ, যা সর্বোচ্চ। ৮ দশমিক ১ শতাংশ অংশীদারত্ব নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৯ সালে চীনের রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ২৩ হাজার কোটি ইউয়ান। ২০২০ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৯৩ হাজার কোটি ইউয়ানে।
২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে চীনের রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৯৫ হাজার কোটি ইউয়ান। ২০২০ সালের প্রথমার্ধে তা কমে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৭১ হাজার কোটি ইউয়ানে। তবে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে চীনা রপ্তানি আগের দুই বছরের তুলনায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৮৫ হাজার কোটি ইউয়ান। অর্থাৎ করোনার উৎপত্তিস্থল হলেও প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ফের চাঙ্গা হতে শুরু করেছে চীনের রপ্তানি বাণিজ্য।

করোনা প্রতিরোধে টানা ৭৬ দিন লকডাউনের বিধিনিষেধ কার্যকর রাখার পর ২০২০ সালের এপ্রিলে সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসায় কিছু শর্ত জুড়ে দিয়ে জনসাধারণকে বাইরে চলাচলের অনুমতি দেয় চীন। জুলাইয়ে শর্ত তুলে নিলে শিল্পকারখানা পুরোদমে উৎপাদন শুরু করে। তখনো বিশ্বর অধিকাংশ দেশ করোনাভাইরাস সংক্রমণের কঠিন সময় পার করছিল। এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও অন্যান্য দেশে সুরক্ষা ও চিকিৎসাসামগ্রীর চাহিদা বেড়ে যায়। ফলে চীন থেকে প্রচলিত রপ্তানি পণ্যের বাইরে চিকিৎসাসামগ্রী রপ্তানির সুযোগ তৈরি হয়। এছাড়া অক্টোবরে প্রজাতন্ত্র দিবসের ছুটির আগে বড়দিনকে কেন্দ্র করে উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর বাড়তি চাহিদা পূরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে চীন। শ্লথ হয়ে আসা রপ্তানি বাণিজ্য পুনরুদ্ধারের এই সুযোগ ব্যবহারে দেশটি পুরোদমে কাজে নেমে পড়ে। চীনের রপ্তানি বাণিজ্যের অন্যতম অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউভুক্ত দেশগুলোয় আগস্ট থেকে ক্রমান্বয়ে রপ্তানি অস্বাভাবিক হারে বাড়তে শুরু করে। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ পরিবহন সক্ষমতা কমিয়ে আনা, স্বল্প জনবলে বন্দর ও আইসিডি পরিচালনা, সংক্রমণ রোধে জাহাজের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ দেশগুলোর বন্দরে জাহাজ ভিড়তে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। এতে জাহাজজট দেখা দেয়। এছাড়া করোনার আগে যেখানে রপ্তানি করা কনটেইনারের পণ্য খালাস করে বন্দরে ফেরত আনতে এক থেকে দুদিন সময় লাগত, সেখানে এক সপ্তাহের বেশি সময় লেগেছে পণ্য আনস্টাফিংয়ে জনবল ও পরিবহন সংকটের কারণে। বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ফোর্বস বলছে, জাহাজজটে কনটেইনার টার্ন-অ্যারাউন্ড টাইম (আমদানিকারকের দেশে পণ্য খালাস করে আবার রপ্তানিকারক দেশে ফেরত আসার গড় সময়) ৬০ দিন থেকে বেড়ে ১০০ দিনে গিয়ে দাঁড়ায়। ফলে বিপুল পরিমাণ পণ্যবাহী কনটেইনার জাহাজে আটকে থাকায় সংকট দেখা দেয়, বেড়ে যায় কনটেইনার ভাড়া।

রপ্তানি বাণিজ্যে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে এ সময় আরেকটি পন্থা অবলম্বন করে চীন। দেশটি কনটেইনার দ্রুত ফিরিয়ে আনার জন্য শিপিং লাইনগুলোকে বাড়তি ভাড়া দেওয়া শুরু করে। অর্থাৎ রপ্তানিকৃত পণ্য খালাসের পর কিছুদিন অপেক্ষা করে পণ্যভর্তি কনটেইনার চীনে ফেরত পাঠানোর চেয়ে দ্রুত খালি কনটেইনার পাঠানো অধিক লাভজনক হয়ে ওঠে। এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময়ের জন্য কনটেইনার বুকিং নেয় চীন। ফলে শিপিং লাইনগুলো অধিক লাভ নিশ্চিত করতে অন্য রুটে কনটেইনার বুকিং উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে দেয়। কারণ শিপিং কোম্পানিগুলো স্বাভাবিকভাবেই কনটেইনার বুকিংয়ে মুনাফা ও কৌশলগত গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছে। এই সময় চীনের আমদানি-রপ্তানি কনটেইনারের অনুপাত গিয়ে দাঁড়ায় ১:৩। অর্থাৎ তিন কনটেইনার পণ্য রপ্তানির বিপরীতে আমদানি হতো এক কনটেইনার পণ্য। ফলে অন্যান্য রপ্তানিকারক দেশ চাহিদা অনুযায়ী কনটেইনার বুকিং পায়নি। একদিকে লকডাউনের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন বন্দর থেকে কনটেইনার পরিবহন বন্ধ থাকা; অন্যদিকে চীনের রপ্তানি বাণিজ্যে অংশীদারিত্ব ধরে রাখার অদমনীয় প্রবণতার কারণেই মূলত কনটেইনার সংকটের সূত্রপাত।

তবে কনটেইনারজটের জন্য চীনকে এককভাবে দায়ী করা মোটেই সমীচীন হবে না। কারণ কনটেইনার পরিবহন ব্যবস্থার দুর্বলতা আগে থেকেই ছিল। চীন সেটিকে সামনে এনেছে মাত্র। কনটেইনারজটের ক্ষেত্রে আরও বেশ কয়েকটি প্রভাবক কাজ করেছে। যেমন-

ব্ল্যাংক সেইলিং: একটি শিপিং লাইন যখন তার নিয়মিত রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেয়, চলাচল কমিয়ে আনে বা যাত্রাপথে রুটের কোনো একটি বা একাধিক বন্দরে নোঙর না করে ফিরে আসে, তখন সেটিকে ব্ল্যাংক সেইলিং বলে। করোনা সংক্রমণ চীন থেকে বিশে^র অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়া শুরু করলে প্রত্যাশিত পণ্য পরিবহন না হওয়ায় শিপিং কোম্পানিগুলো ব্ল্যাংক সেইলিং শুরু করে। এতে বিপাকে পড়ে পণ্য রপ্তানিকারকরা। জাহাজের ধারণক্ষমতার অত্যধিক খালি থেকে গেলে বা স্ট্রিংস (একটি শিপিং কোম্পানি নিয়মিত রুটে সপ্তাহে বা মাসে কয়বার জাহাজ পরিচালনা করবে, তার শিডিউল) কমিয়ে আনলে ব্ল্যাংক সেইলিং হয়। করোনার কারণে এই দুটিই হয়েছে। বাণিজ্যবিষয়ক পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা স্ট্যাটিস্টার তথ্যমতে, করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে ২০২০ সালের মার্চে ইউরোপ-এশিয়া রুটে ব্ল্যাংক সেইলিং হয়েছে ২৯টি। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে হয়েছে ৪৮টি, যা করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকে এক মাসে সর্বোচ্চ। গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৯১৯টি ব্ল্যাংক সেইলিং হয়েছে। মহামারির প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে বিশ্বের রপ্তানিমুখী দেশগুলো যখন বাণিজ্য পুনরুদ্ধারে তৎপর হয়ে উঠেছে, তখনো শিপিং কোম্পানিগুলো নিয়মিত রুটগুলোয় জাহাজ পরিচালনা বাড়ায়নি। ফলে জাহাজে পণ্য পরিবহনে কাক্সিক্ষত হারে স্পেস বরাদ্দ পায়নি রপ্তানিকারকরা। এ কারণে তাদের পণ্য রপ্তানিতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে।

নতুন কনটেইনার উৎপাদন কমে যাওয়া: কনটেইনার সংকটের আরেকটি কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, গত কয়েক বছরের তুলনায় ২০২০ সালে নতুন কনটেইনার উৎপাদন কমেছে। এক বছরে ব্যবহার অনুপযোগী কনটেইনারের (স্ক্র্যাপ ঘোষিত) সংখ্যার চেয়ে উৎপাদনের পরিমাণ কম হওয়াকে সংকটের একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আলফা লাইনার, ক্লার্কসন ও আইএমএফের সূত্র উল্লেখ করে একটি পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে গণমাধ্যমগুলোয়। এতে দেখা যায়, ২০১৮ সালে ২৫ লাখ কনটেইনার স্ক্র্যাপ ঘোষণা করা হয়, বিপরীতে উৎপাদন হয় ৪৪ লাখ। ২০১৯ সালে ১৪ লাখ কনটেইনার স্ক্র্যাপের বিপরীতে ২৫ লাখ নতুন কনটেইনার উৎপাদন হয়েছে। এই দুই বছরে স্ক্র্যাপ ঘোষণার তুলনায় উৎপাদনের পরিমাণ বেশি ছিল। তবে গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে ৩৪ লাখ কনটেইনার স্ক্র্যাপ ঘোষণার বিপরীতে উৎপাদিত হয়েছে ২০ লাখ কনটেইনার। ফলে কনটেইনারের বৈশ্বিক বহরের আকার হ্রাস পেয়েছে। গত বছরের শেষের দিকে নতুন কনটেইনারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দামও বেড়ে যায়।

সুয়েজ খালে আটকা পড়া দানবীয় কনটেইনার জাহাজ এভার গিভেন। গত মার্চের সেই ঘটনায় ব্যস্ততম রুটটিতে টানা ছয়দিন জাহাজ চলাচল বন্ধ ছিল। ফলে তা বৈশ্বিক পণ্য পরিবহনে সংকট তৈরী করে

সুয়েজ খালে প্রতিবন্ধকতা: বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ততম বাণিজ্যপথ সুয়েজ খালে চলতি বছরের মার্চে বড় ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হয়। দানবাকার কনটেইনার জাহাজ এভার গিভেন আটকে যায় সেখানে। এর ফলে টানা ছয়দিন ব্যস্ততম এই রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ ছিল। এই অচলাবস্থা করোনাসৃষ্ট সংকটকে আরও প্রকট করেছে। ছয়দিন সুয়েজ খালে জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় খালের দুই পাশে ৪৫০টি জাহাজ পারাপারের অপেক্ষায় ছিল। ফলে পণ্য পৌঁছাতে জাহাজগুলোর ১১ দিন পর্যন্ত বেশি সময় লেগেছে। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে এশিয়ার বন্দরগুলোয় খালি কনটেইনার আসা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে কনটেইনার সংকটের তীব্রতা বেড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি ১০ কনটেইনার রপ্তানির বিপরীতে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে মাত্র চারটি কনটেইনার ফেরত এসেছে এই সময়ে। জটের কারণে কিছু শিপিং কোম্পানি তাদের ভাড়া ৪৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। সুয়েজ খালের দুর্ঘটনা কনটেইনার প্রাপ্তির সময়কে প্রলম্বিত করেছে।

সংকটের বাইরে নয় বাংলাদেশও

তৈরি পোশাকনির্ভর রপ্তানি বাণিজ্যে বাংলাদেশের বড় ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইইউ দেশগুলো। রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় শতভাগ পণ্য পরিবহন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। কনটেইনার সংকট কিংবা কনটেইনারজট যেটিই হোক না কেন, প্রথমেই আলোচনায় আসে চট্টগ্রাম বন্দর। পণ্য আমদানি-রপ্তানির অন্যতম নিয়ন্তা হিসেবে যেকোনো সংকট সামনে থেকে সামাল দিতে হয় চট্টগ্রাম বন্দরকে।

কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতার ঘাটতি আর কনটেইনারজটের বিষয় দুটিকে এক করে দেখলে চলবে না। আমদানিকারকরা যখন বন্দর থেকে নির্দিষ্ট সময় পণ্যভর্তি কনটেইনার খালাস নেন না, তখন বন্দরের ইয়ার্ডে কনটেইনারের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। এ সংখ্যা যখন ধারণক্ষমতার কাছাকাছি চলে যায়, তখন জাহাজ থেকে কনটেইনার খালাস করে রাখার জায়গাস্বল্পতায় জটের সৃষ্টি হয়। কারণ কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের যন্ত্রপাতি চলাচলের জন্য ইয়ার্ডের ৩০ শতাংশ জায়গা খালি রাখতে হয়। করোনা মহামারি শুরুর পর সাধারণ ছুটিতে গত বছরের এপ্রিলে ও চলতি বছরের জুলাইয়ে কনটেইনারজটের সৃষ্টি হয়। জট নিরসনে প্রথমে কনটেইনারের ভাড়া মওকুফ ও পরে নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য খালাস না করলে জরিমানা আরোপের মতো পদক্ষেপ নেওয়া হলেও প্রথম দফা সাধারণ ছুটিতে কনটেইনারের জট কমানো যায়নি। পরে জট কমাতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বন্দর থেকে সব ধরনের পণ্য বেসরকারি আইসিডিতে সরিয়ে নেওয়া ও খালাসের অনুমোদন দেয় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। এতে পরিস্থিতির উন্নতি হয়। চলতি বছরের জুলাইয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ ঈদের ছুটির আগে আমদানি-সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নির্দিষ্ট সময়ে কনটেইনার খালাস নেওয়ার অনুরোধ করে চিঠি দেয়। আগাম সতকর্তা হিসেবে কর্তৃপক্ষের এমন পদক্ষেপে আমদানিকারকরা সায় দেয়নি। ফলে ২৩ জুলাই থেকে শুরু হওয়া লকডাউনে পণ্য খালাস একেবারে কমে যায়। গড়ে তিন হাজারের অধিক কনটেইনার থেকে দুই অংকের ঘরে নেমে আসে কনটেইনার খালাসের সংখ্যা। বাধ্য হয়ে পুরনো পথে হাঁটতে হয়েছে কর্তৃপক্ষকে। এনবিআরের অনুমোদনে আবারও আমদানি করা পণ্যবাহী কনটেইনার বেসরকারি আইসিডিতে নিয়ে খালাসের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এছাড়া বন্দর কর্তৃপক্ষের ফোর্স লোডিংয়ের কারণেও বন্দরের ইয়ার্ডে কনটেইনারের সংখ্যা কমেছে।

চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে কনটেইনার সংকট প্রকট হয়েছে পণ্য রপ্তানির জন্য পর্যাপ্ত কনটেইনার বুকিং না পাওয়ার কারণে। এক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া কনটেইনার বুকিং, ব্ল্যাংক সেইলিং ও নতুন কনটেইনারের সংখ্যা হ্রাস পাওয়াকে কারণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। এছাড়া অধিক মুনাফার আশায় শিপিং কোম্পানিগুলো চীন-ইউরোপ ও চীন-যুক্তরাষ্ট্র রুটে অধিক সংখ্যক জাহাজ পরিচালনা করার ফলে আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডসহ বেশকিছু দেশে বিপুল সংখ্যক কনটেইনার অলস পড়ে আছে দীর্ঘদিন, যা সংকটকে দীর্ঘায়িত করেছে।

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মূলত ফিডার ভেসেল (মাঝারি আকারের জাহাজ) পণ্যবাহী কনটেইনার নিয়ে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে যায়। সেখান থেকে কনটেইনার পুনরায় বড় জাহাজে বোঝাই করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোয় নিয়ে যাওয়া হয়। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া ৪৪ শতাংশ পণ্য সিঙ্গাপুর বন্দর, ৩৭ শতাংশ শ্রীলংকার কলম্বো বন্দর, ১২ শতাংশ তানজুং বন্দর ও অবশিষ্ট ৭ শতাংশ পণ্য পোর্ট ক্ল্যাং হয়ে রপ্তানি হয়। চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ দেশগুলোয় পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধি, এককভাবে চীন কর্তৃক বিপুল সংখ্যক কনটেইনার বুকিং করে রাখা ও ব্ল্যাংক সেইলিংয়ের কারণে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোয় বড় জাহাজে বুকিং পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। এছাড়া ক্রেতা দেশের বন্দরগুলোয় জটের কারণে খালি কনটেইনার ফেরত আসতেও আগের চেয়ে বেশি সময় লাগছে।
গত বছরের নভেম্বর থেকে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি ও বাংলাদেশমুখী আমদানি পণ্য পরিবহনে ফিডার ভেসেল অপারেটররা সাময়িক সারচার্জ (বাড়তি ভাড়া) আরওপ করে। এর কারণ হিসেবে তারা বলেছে, কলম্বো বন্দরে বার্থিং পেতে দুদিন ও সিঙ্গাপুর বন্দরে বার্থিং পেতে পাঁচদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে, যা বড় জাহাজে কনটেইনার বোঝাইয়ের বুকিং পেতে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে। সিঙ্গাপুরভিত্তিক শিপিং লাইন ফার শিপিং ১৫ নভেম্বর থেকে চট্টগ্রাম-কলম্বো রুটে পণ্যবাহী কনটেইনারের ওপর অতিরিক্ত ৭৫ ডলার ও খালি কনটেইনার পরিবহনে ৩৭ দশমিক ৫ ডলার সারচার্জ আরওপ করে। ট্রান্সওয়ার্ল্ড ফিডার সার্ভিসও চট্টগ্রাম-কলম্বো ও চট্টগ্রাম-পোর্ট ক্ল্যাং-সিঙ্গাপুর রুটে সারচার্জ কার্যকর করে ২০ নভেম্বর থেকে।

আগে থেকেই এশিয়ার দেশগুলো কনটেইনার সংকটে থাকলেও চলতি বছরের জুন থেকে বাংলাদেশের কনটেইনার স্বল্পতার সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। করোনা সংকটের মধ্যে দেশের পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করে গত বছরের জুলাই থেকে। চলতি বছরের শুরু থেকেই ক্রয়াদেশ বৃদ্ধি পাওয়ায় রপ্তানিও বেড়েছে। পণ্য পরিবহনের এই বাড়তি চাপ মোকাবেলায় চট্টগ্রাম বন্দর পুরোদমে প্রস্তুত থাকলেও কনটেইনার সংকট ও জাহাজে বুকিং না পাওয়ায় কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হয়নি। স্বাভাবিক সময়ে যে পরিমাণ পণ্যবাহী কনটেইনার জাহাজীকরণ হতো, এ সময় তা উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসে। এতে রপ্তানিমুখী পণ্য হ্যান্ডলিং করা ১৯টি বেসরকারি আইসিডিতে পণ্যের স্তূপ জমে যায়। ফলে পণ্য ক্রেতার হাতে পৌঁছাতে ২০ থেকে ২৫ দিন বাড়তি সময় লেগেছে। অতিমারির সংকট কাটিয়ে ব্যবসায়ীরা যখন কিছুটা স্বস্তি বোধ করছিলেন, তখনই কনটেইনারজটের এ সংকট দুশ্চিন্তার উদ্রেক করে। ৫ জুলাই পর্যন্ত ১৪ হাজারের বেশি কনটেইনারের পণ্য আইসিডিগুলোয় জমেছিল।

৪০ ফুট দৈর্ঘ্যরে কনটেইনার সংকট

বাংলাদেশে আমদানি করা পণ্যের অধিকাংশ আসে চীন থেকে। পোশাক তৈরির কাঁচামাল, ইলেকট্রনিকস পণ্য, প্রসাধনী, ফল, মসলা, ছোট যন্ত্রপাতিসহ বেশকিছু পণ্য আমদানি হয় কনটেইনারে। শিপিং কোম্পানিগুলোর তথ্যমতে, ২০ ফুট ও ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যরে প্রায় সমান সংখ্যক কনটেইনার ব্যবহার হয় পণ্য আমদানিতে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ ও আমেরিকায় পোশাক রপ্তানিতে ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যরে কনটেইনারকে প্রাধান্য দেন ক্রেতারা। জাহাজ ভাড়া, কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ ও অভ্যন্তরীণ পরিবহন খরচ সাশ্রয়ে ক্রেতারা এমন নির্দেশনা দিয়ে আসছেন অনেক আগে থেকেই। ফলে যে পরিমাণ ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যরে কনটেইনার দেশে আসে, তার চেয়ে বেশি কনটেইনারের চাহিদা থাকে সবসময়। এছাড়া বিশ্বর নামিদামি পোশাকের ব্র্যান্ডগুলো পণ্য দ্রুততম সময়ে পাওয়ার জন্য যেসব জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম থেকে বেশি সংখ্যক জাহাজ পরিচালনা করে, তাদের মাধ্যমে পণ্য পরিবহনের ওপর জোর দেয়। এতে নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি হয়েছে।

সংকট কাটাতে সচেষ্ট চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ

ওপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনারজটের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়। বন্দরের হ্যান্ডলিং সক্ষমতা পর্যাপ্ত না থাকায় যে এমনটি হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। বরং বৈশ্বিক বিভিন্ন প্রভাবকের কারণেই এই সংকট তৈরি হয়েছে। নিজেদের দায় না থাকলেও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে নিজেদের অবস্থান থেকে সম্ভাব্য সব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

আমদানি-রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডলিং ও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সংরক্ষণ করা চট্টগ্রাম বন্দরের মূল কাজ। পণ্যের শুল্কায়ন ও ছাড়পত্র নিতে হয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে। এছাড়া পণ্য খালাস ও জাহাজীকরণে ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও শিপিং এজেন্টদের কাজের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হয়। রপ্তানি পণ্যের প্রায় শতভাগ কনটেইনারে বোঝাই করা হয় বেসরকারি আইসিডিগুলোয়। আইসিডি থেকে বন্দরের ইয়ার্ডে আনার পর কনটেইনার নির্দিষ্ট সময়ে জাহাজীকরণের কাজটি করে কর্তৃপক্ষ। কনটেইনার সংকট প্রকট আকার ধারণ করলে রপ্তানিকারকদের সংগঠনগুলো উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারের সহযোগিতা চায়। চট্টগ্রাম বন্দর স্বপ্রণোদিত হয়ে সংকট মোকাবেলায় সাতটি সুপারিশ বাস্তবায়নের ওপর জোর দেয়। এগুলোর মধ্যে শ্রীলংকা ও সিঙ্গাপুরের হাইকমিশনারদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা, মেইন লাইন অপারেটর ও ফিডার ভেসেল অপারেটরদের মধ্যে কমন ক্যারিয়ার এগ্রিমেন্ট (সিসিএ) ও ডিরেক্ট ইন্টারচেঞ্জ (ডিআই) প্রথা চালু করা, বায়ার কর্তৃক নির্দিষ্ট শিপিং লাইন নির্ধারণ না করার অনুরোধ ও সরাসরি আমদানিকারকের দেশে জাহাজ পরিচালনার অনুরোধ করা ছিল অন্যতম। এছাড়া গত জুলাইয়ে এক জরুরি সভায় আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এগুলোর মধ্যে কলম্বোগামী ফিডার ভেসেলকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বার্থিং দেওয়া, মায়েরস্ক শিপিং লাইনকে চট্টগ্রাম-কলম্বো রুটে ন্যূনতম তিনটি ফিডার ভেসেল চালুর জন্য প্রিন্সিপালের সঙ্গে সমন্বয় করা ও আগ্রহী নতুন ফিডার ভেসেল অপারেটরদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অনুমোদন দেওয়া অন্যতম। নির্দিষ্ট শিপিং লাইন ও আইসিডি নির্ধারণ করে না দেওয়ার জন্য পুনরায় বায়ারদের সঙ্গে আলোচনার জন্য বিজিএমইএকে অনুরোধ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, সংকট কাটাতে সিসিএ বাস্তবায়নে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রস্তাব প্রশংসনীয়। এতে জাহাজে পর্যাপ্ত জায়গা থাকা সাপেক্ষে একটি শিপিং লাইনে অন্য শিপিং লাইনের কনটেইনার পরিবহনের সুযোগ তৈরি হয়। তবে ডিআই বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে বলছে শিপিং কোম্পানিগুলো। তাদের মতে, এ প্রথা অনুযায়ী একটি প্রতিষ্ঠানের কনটেইনার অপর একটি প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিলে তা কীভাবে ও কত সময়ের মধ্যে ফেরত দেওয়া হবে, সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা থেকে যায়। ফলে নিজেদের পণ্য পরিবহন ব্যাঘাত ঘটার আশঙ্কায় ডিআইপ্রথা অনুসরণ করতে চায় না প্রতিষ্ঠানগুলো।

সহসাই সমাধান হচ্ছে না বৈশ্বিক সংকটের

জাহাজ পরিচালনাকারী ও কনটেইনার লিজিং প্রতিষ্ঠানগুলোর বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বলছে, কনটেইনারের এই সংকট সহসাই কাটছে না। কারণ এখনো অনেক দেশ করোনার কারণে সীমিত জনবল দিয়ে বন্দর, আইসিডি ও পণ্য পরিবহন চেইন চালু রেখেছে। এতে কনটেইনার খালাসের গতি কমেছে, পণ্য পরিবহনে সময় লাগছে এবং অসম বাণিজ্যের কারণে কনটেইনার পরিবহন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাড়া বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকে জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভাড়া বাড়িয়েছে। এছাড়া নতুন কনটেইনারের উৎপাদন আগের ছন্দে ফিরে আসতে সময় লাগবে। ফলে আগামী বছর পর্যন্ত কনটেইনারের সংকট থাকবে বলে আভাস দিচ্ছেন মেরিটাইম-সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলো।

সর্বোচ্চ সেবা দিতে প্রস্তুত চট্টগ্রাম বন্দর

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বন্দরের কনটেইনার ও জাহাজজট পরিস্থিতিতে অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। রটারডাম, অ্যান্টওয়ার্প, সিঙ্গাপুর ও পোর্ট ক্ল্যাংয়ের মতো বন্দরগুলো যেখানে জাহাজজটের কারণে বার্থিংয়ে ১০ দিন পর্যন্ত সময় নিচ্ছে; সেখানে আগস্টের প্রথম ১৫ দিনের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরে এখন কনটেইনারবাহী জাহাজ একদিনেই বার্থিংয়ের সুযোগ পেয়েছে। এছাড়া তিনটি শিফটে পুরোদমে হ্যান্ডলিং চালু থাকায় জাহাজের টার্নঅ্যারাউন্ড সময়ও কমে এসেছে, যা করোনাকালীন পরিস্থিতিতেও সন্তোষজনক বলছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।

বৈশ্বিক কনটেইনার সংকটের প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরেও। এ সংকট প্রকট হয়েছে পণ্য পরিবহনের জন্য পর্যাপ্ত কনটেইনারের বুকিং না পাওয়ার কারণে

ট্রেভার্স বোর্ড

বর্তমানে মেরিটাইম নেভিগেশনে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। প্রযুক্তির আশীর্বাদে এখন জাহাজ চলাচলের তথ্য-উপাত্ত রেকর্ড করা হচ্ছে সহজেই। কিন্তু আদিকালে এতসব ডিজিটাল সুযোগ-সুবিধা ছিল না। কিন্তু তাই বলে সেই সময়ে নেভিগেশনের তথ্য সংরক্ষণ থেমে থাকেনি। ডিজিটাল না হোক, নাবিকরা অ্যানালগ পদ্ধতিতে ঠিকই তাদের জাহাজের গতিপথ, দূরত্ব, গতিবেগ ইত্যাদি তথ্য টুকে রাখতেন।

অ্যানালগ যুগে জাহাজ চলাচলের দিক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে যেমন সেক্সট্যান্ট যন্ত্রের ব্যবহার ছিল, ঠিক তেমনই ষোলো থেকে আঠারো শতক পর্যন্ত জাহাজের গতিপথ ও গতিবেগ নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত হতো ট্রেভার্স বোর্ড। এটি আসলে এক ধরনের মেমোরি এইড যন্ত্র, যেটি ডেড রেকোনিং নেভিগেশনের কাজে ব্যবহৃত হতো।

মেরিটাইম নেভিগেশনে ডেড রেকোনিং হলো একটি প্রক্রিয়া, যেখানে চলন্ত জাহাজের পূর্ব নির্ণীত অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে বর্তমান অবস্থান নির্ধারণ করা হয়। এরপর কিছু হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে জাহাজের গতিবেগ, ভবিষ্যৎ গতিপথ ও অতিবাহিত সময়ের গতিপথ নির্ধারণ করা হয়। নাবিকদের জন্য এই ডেড রেকোনিংয়ের কাজটাই সহজ করে দিয়েছিল ট্রেভার্স বোর্ড। বিশেষ করে এমন একসময়ে, যখন নিরাপদ জাহাজ চলাচল পুরোপুরি নির্ভর করত ক্রুদের দক্ষতার ওপর। আধুনিক নেভিগেশন ব্যবস্থার কিছুই ছিল না সে সময়ে।

ষোলো শতকের স্বনামধন্য গণিতবিদ উইলিয়াম বর্নের ‘ওল্ড সল্ট’-এ ট্রেভার্স বোর্ডের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে ট্রেভার্স বোর্ড হলো কাঠের তৈরি একটি বোর্ড, যেটি ঊর্ধ্ব ও নি¤œ-এই দুই অংশে বিভক্ত। ওপরের দিকে একটি কম্পাস আঁকা থাকে, যা পেগ ও কর্ডের মাধ্যমে নিচে থাকা কয়েকটি পেগ হোলের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে।

যে সময়কালে ট্রেভার্স বোর্ড ব্যবহার করা হতো, সে সময় জাহাজীদের বেশির ভাগই লেখাপড়া জানতেন না। তবে এই বোর্ডের কার্যপ্রণালি এতটাই সহজ ছিল যে, লেখাপড়া না জানা ক্রু সদস্যরাও এটি ব্যবহার করতে পারতেন।

মেরিটাইম নেটওয়ার্কস: স্পেইশাল স্ট্রাকচারস অ্যান্ড টাইম ডায়নামিকস সিজার দ্যুক্রে

মানবসভ্যতার সঙ্গে নৌবাণিজ্যের সম্পর্ক বেশ পুরনো। বিভিন্ন কমিউনিটির মধ্যে আন্তঃসংযোগ স্থাপনের অন্যতম প্রাচীন একটি উপায় হলো নৌপরিবহন। অতীতে পণ্য পরিবহনের প্রধান মাধ্যম ছিল মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট। আধুনিক যুগেও তা-ই। বর্তমানে বিশ^বাণিজ্যের নব্বই শতাংশের বেশি পণ্য পরিবহন হয় সমুদ্রপথে। সমুদ্রবাণিজ্যের মাধ্যমে বন্দর, টার্মিনাল, উপকূলীয় শহর, অঞ্চল ও দেশগুলো একে অন্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত। স্বাভাবিকভাবেই বন্দর, পরিবহন ব্যবস্থা ও জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়ন ও পরিকল্পনার জন্য সদা পরিবর্তনশীল মেরিটাইম নেটওয়ার্ককে সঠিকভাবে অনুধাবন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তবে বাস্তবতা হলো, মেরিটাইম কানেক্টিভিটি সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে সম্যক ধারণা অনেকেরই নেই; এমনকি খাতসংশ্লিষ্ট অংশীজনদেরও। এ কারণে প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন তত্ত্ব, ধারণা, পদ্ধতি ইত্যাদি সম্পর্কে পর্যালোচনা করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। মেরিটাইম নেটওয়ার্কস বইয়ে বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে সেই পর্যালোচনাই করা হয়েছে। বিশে^র বিভিন্ন দেশের খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা পুরাতত্ত্ব, ইতিহাস, ভৌগোলিক, আঞ্চলিক বিদ্যা, অর্থনীতি, গণিত, পদার্থবিদ্যা, কম্পিউটার প্রযুক্তিসহ মেরিটাইম নেটওয়ার্কের বিভিন্ন অনুষঙ্গের ওপর আলোকপাত করেছেন এ বইয়ে। জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেমস (জিআইএস), স্পেইশাল বা দূরত্ব-সংক্রান্ত বিষয়, নেটওয়ার্ক, মডেলিং ও সিমুলেশনসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়াগত বিষয়ের ভিত্তিতে তারা বন্দর কার্যপ্রণালির ক্রমবিন্যাস, রুট ডেনসিটি, বিভিন্ন ট্রান্সপোর্ট মোডের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, নেটওয়ার্কের দৃঢ়তা ও দুর্বলতা, ট্্রাফিক কনসেন্ট্রেশন, প্রযুক্তিগত রূপান্তর, আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন।

আর্থ-সামাজিক প্রতিবেশ মেরিটাইম নেটওয়ার্কের ওপর কীরূপ প্রভাব ফেলে এবং এ-সম্পর্কিত জ্ঞান বন্দর, সাপ্লাই চেইন ও ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্কের উন্নয়নে কতটা সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে, সেই বিষয়টি তুলে ধরার প্রয়াস রয়েছে এই বইতে। কেউ যদি বিশ^বাণিজ্যের পরিবহন নেটওয়ার্ক ভালোভাবে অনুধাবন এবং বন্দর ব্যবস্থার মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জটিল প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজে বের করতে চান, তবে তার জন্য এই বইটি আদর্শ একটি রেফারেন্স হতে পারে।

৪০৮ পৃষ্ঠার মেরিটাইম নেটওয়ার্কস হার্ডকভার বইটির মূল্য ১৭০ মার্কিন ডলার হলেও সুলভ পেপারব্যাক সংস্করণের দাম ধরা হয়েছে ৪৬ ডলার। বইটির প্রকাশক ব্রিটিশ বহুজাতিক পাবলিশার রাউটলেজ।

আইএসবিএন ১০: ১১৩৮৯১১২৫৯

আইএসবিএন ১৩: ৯৭৮-১১৩৮৯১১২৫৩