প্রথমবারের মতো সমুদ্রপথে চারাগাছ রপ্তানির সূচনা করল বাংলাদেশ। ৯ জুন ৮ প্রজাতির ৩ হাজার ৭৪৭টি চারাগাছের একটি চালান কাতারে রপ্তানির উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে আনা হয়। ১৪ জুন মায়েরস্ক শিপিং লাইনের জাহাজ মায়েরস্ক জিয়ামেন চারাগাছের চালানটি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে যায়। রপ্তানির উদ্দেশ্যে কনটেইনারে বোঝাই হওয়া চারাগাছের চালানের মধ্যে রয়েছে মাল্টার চারা ৭৯৫টি, জামরুলের ১৫২টি, লেবুর ৯৫০টি, নিমগাছের ১ হাজার ২৮০টি, বটগাছের ৪০টি, সফেদার ৩২০টি, কাঠবাদামের ১৭০টি এবং বাবলাগাছের চারা ৪০টি। কাতারের দোহায় অবস্থিত বাংলাদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আল নাইমি ল্যান্ডস্ক্যাপিং এই চারাগাছগুলো বাংলাদেশ থেকে কাতারে আমদানি করেছে।
কুমিল্লার লাকসামের বিজরা বাজারের প্রতিষ্ঠান মেসার্স বিজরা এন্টারপ্রাইজ চারাগুলো রপ্তানি করেছে। রপ্তানির আগে চট্টগ্রামের চারাগুলো পতেঙ্গায় ইস্টার্ন লজিস্টিক ডিপোতে একটি ৪০ ফুটের হিমায়িত কনটেইনারে বোঝাই করা হয়।
বিজরা এন্টারপ্রাইজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শামসুল ইসলাম বলেন, ‘২০১৬ সালের ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে দেশের প্রথম ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের উদ্বোধনকালে ব্যবসায়ীদের নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করতে বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কৃষিপণ্যের ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন ‘‘এই মার্কেট কিন্তু কোনো দিন সংকুচিত হবে না।’’ ওই কথা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০১৮ সাল থেকে চারাগাছ রপ্তানির চেষ্টা করে যাচ্ছি। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে বিমানে কয়েকবার চারাগাছ রপ্তানি করলেও এবারই প্রথম সমুদ্রপথে বাংলাদেশ থেকে চারাগাছ রপ্তানি করছি। বিমানে চারাগাছ রপ্তানি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাই জাহাজে করে রপ্তানি শুরু করছি। এর মাধ্যমে বছরে প্রায় ১ কোটি ডলারের গাছ রপ্তানি করতে পারব আশা রাখি।’
কাতারের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান আল নাইমি ল্যান্ডস্ক্যাপিং এবং কুমিল্লার মেসার্স বিজরা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আবু সুফিয়ান মারুফ বলেন, ‘কাতারে আমরা ২০ বছর ধরে চারাগাছের ব্যবসা করছি। ২০টিরও বেশি দেশ থেকে চারাগাছ কাতারে আমদানি করে বিক্রি করি। কিন্তু এবার নিজ দেশ থেকে জাহাজে করে প্রথমবারের মতো চারাগাছ নিয়ে যাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘পাশের দেশ ভারতসহ ভিয়েতনাম ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশই গাছ রপ্তানি করে। প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এই খাতে পিছিয়ে আছে।’
মেরিটাইম ইন্ডাস্ট্রিতে নারী পেশাজীবীদের সংখ্যা এখন আর নগণ্য নয়। ইঞ্জিনরুম সহকারী, অসম সাহসী নাবিকের মতো তৃণমূল থেকে শুরু করে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শিপিং লাইন আর ব্যস্ততম বন্দরের প্রধান নির্বাহী পদে আজকের নারীরা উঠে এসেছেন নিজেদের পরিশ্রম আর যোগ্যতার গুণে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজতক তাঁদের সংখ্যা, ভূমিকা, নারী-পুরুষ অনুপাতবিষয়ক সার্বিক কোনো জরিপ হয়নি। সে অভাব মোচনে নৌপরিবহন এবং সমুদ্রচারী নারীদের অবস্থান সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও) এবং উইমেন ইন্টারন্যাশনাল শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউআইএসটিএ বা উইসটা)।
দেরিতে হলেও এই প্রথম শিপিংয়ের অভিভাবক সংস্থা আইএমও মেরিটাইম সেক্টরে কর্মরত নারীদের নিয়ে কেন্দ্রীয় কোনো জরিপ করছে। ‘উইমেন ইন মেরিটাইম-আইএমও অ্যান্ড উইসটা ইন্টারন্যাশনাল সার্ভে-২০২১’ শীর্ষক এ জরিপে ইন্ডাস্ট্রিতে নারীদের সংখ্যা, নারী-পুরুষ অনুপাত, কোন পদে তাঁদের অংশগ্রহণ কত, কোন ধরনের পদে তাঁরা তুলনামূলক পিছিয়ে আছেন, প্রতিষ্ঠান-দেশ-মহাদেশভিত্তিক সুযোগ-সুবিধা-অগ্রগতি-বৈষম্যের একটা সার্বিক চিত্র পাওয়া যাবে।
টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মেরিটাইম ইন্ডাস্ট্রিতে কীভাবে আরও বৈচিত্র্যময় জনশক্তি গড়ে তোলা যায়, সে জন্য বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এ সকল কার্যাবলির অংশ হিসেবে আয়োজিত এ জরিপে বৈচিত্র্য এবং লৈঙ্গিক সাম্য অর্জনে কতখানি এগোনো গেল, সেটাও পরিষ্কার বোঝা যাবে। উইসটা ইন্টারন্যাশনাল একটি অলাভজনক সংস্থা, যেটি মেরিটাইম ইন্ডাস্ট্রির তৃণমূলের পাশাপাশি নীতিনির্ধারণী এবং ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে। ১৯৭৮ সালে উইসটা ইন্টারন্যাশনালের জন্মের পর শুধু শিপিং নয়, সকল শিল্প খাতের নারীদের এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিশ^ব্যাপী নারী নির্বাহী এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সংস্থা হিসেবে বেশকিছু জোরালো পদক্ষেপ নিয়ে দ্রুতই কর্মজীবী নারীদের জন্য সর্বোচ্চ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ স্থানে উঠে আসে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে সকল ধরনের শিল্প ও বাণিজ্য খাত মিলিয়ে ৫৪ দেশের ৩ হাজার ৯০০-এরও বেশি নারী পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্ব করে এ সংগঠন।
মেরিটাইম খাতে বৈচিত্র্য আনয়ন এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে ২০২০ সালে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল আইএমও এবং উইসটা ইন্টারন্যাশনাল। নৌপরিবহন শিল্পের অপারেশন, বাণিজ্যিক এবং লজিস্টিক সেক্টরে নারীদের সমর্থন ও এ পেশাকে পুরুষের তুলনায় অধিকতর পরিবারকেন্দ্রিক নারীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলাই ছিল এ চুক্তির মূল উদ্দেশ্য। সে জন্য একটি পদ্ধতিগত কাঠামো দাঁড় করাতে হবে সবার আগে, আর তারই অংশ হিসেবে জরিপ শুরু হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে আইএমও মহাসচিব কিতাক লিম বলেন, যেকোনো ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো বৈচিত্র্য। সমাজের অর্ধেক অংশকে ক্ষমতায়িত করা গেলে যেমন অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হয়, তেমনি সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের পথে উঠে আসে রাষ্ট্র। মেরিটাইম সেক্টরের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীরা উঠে এলে আগের চেয়ে অনেক বেশি টেকসই উন্নয়ন দেখবে এ খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল শ্রেণির পেশাজীবী।
উইসটা ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট ডেসপিনা পানাইতোউ থিওডোসিউর মতে, যেকোনো উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ বা নীতি প্রণয়নের আগে এ ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য তথ্য থাকতে হবে। চরমভাবে পুরুষ শাসিত এ ইন্ডাস্ট্রির কোন কোন দিকে বেশি নজর দেওয়া প্রয়োজন তার একটি পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যাবে জরিপ করা হলে। গৃহীত পদক্ষেপ ও উন্নয়ন উদ্যোগকে সার্বিকভাবে ফলপ্রসূ করতে হলে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ শুরু করতে হবে এই জরিপ থেকেই। দুটি প্রভাবশালী বৈশি^ক সংস্থা এখানে যুক্ত থাকায় জরিপে অংশগ্রহণের হার, মেরিটাইম বিশ্ব গ্রহণযোগ্যতা বেশি পাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
২০১৯ সালে আইএমও সাধারণ সভায় গৃহীত রেজল্যুশন এ. ১১৪৭(৩১) অনুযায়ী মেরিটাইম সেক্টরে নারীর উপযুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় সদস্য দেশগুলো। এরই পথ ধরে পরের বছরের মেরিটাইম বর্ষের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয় ‘মেরিটাইম বিশে^ নারীর ক্ষমতায়ন’। জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) লক্ষ্য অর্জনের অন্যতম সহায়ক যে লিঙ্গসাম্য, অন্তত মেরিটাইম ইন্ডাস্ট্রিতে সেটি নিশ্চিত করার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে হবে এ জরিপ। এ ছাড়া জাতিসংঘ ঘোষিত জেন্ডার ইকুয়ালিটিবিষয়ক এসডিজি ফাইভ, সুষম শ্রমবণ্টনের এসডিজি এইট এবং অংশগ্রহণভিত্তিক এসডিজি সতেরো অর্জনেও সহায়ক হবে এ জরিপ।
আন্তর্জাতিক মেরিটাইম সংস্থার সকল সদস্য রাষ্ট্র ও সরকারি-স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, মেরিটাইম সেক্টরে কর্মরত পাবলিক এবং প্রাইভেট কোম্পানি, মেরিটাইম প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে আইএমও-উইসটা ইন্টারন্যাশনাল সার্ভে। তবে সদস্য দেশ এবং মেরিটাইম শিল্পের সাথে যুক্ত প্রতিষ্ঠান দুটি ভিন্ন ক্যাটাগরিতে জরিপে অংশ নিতে পারবে।
সুষ্ঠুভাবে জরিপ সম্পন্ন ও বিশ্লেষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ডাটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান আইএইচএস মারকিটকে। বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতি তিন বছরে একবার সার্ভের তথ্য হালনাগাদ করা হবে। এবারের জন্য প্রাথমিকভাবে জরিপে অংশগ্রহণ করার শেষ সময় ৩০ জুন ২০২১ পর্যন্ত থাকলেও তা ৩০ জুলাই পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
বহুল কাক্সিক্ষত চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার সমাধান হয়েছে। এ প্রকল্পের প্রস্তাবিত ৮০৩ একর খাসজমি অধিগ্রহণের অনুমোদন দিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। ২২ জুন ভূমি মন্ত্রণালয় অধিগ্রহণ-২ এর উপসচিব মো. আসাদুজ্জামান স্বাক্ষরিত চিঠিতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে ভূসম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইনে ওই ৮০৩ একর জায়গা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সচিবকে হস্তান্তর করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে বে-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের জটিলতার অবসান ঘটল।
চট্টগ্রাম বন্দর নিজস্ব তহবিল থেকে বে-টার্মিনালের জন্য ৬৮ একর জমি কিনেছিল। কেন্দ্রীয় ভূমি বরাদ্দ কমিটি বে-টার্মিনালের জন্য প্রস্তাবিত ৮০৩ একর খাসজমি অধিগ্রহণের জন্য আটকে ছিল। ব্যক্তিমালিকানাধীন দশমিক ৭৯ একরসহ মোট ৮০৩ দশমিক ১৭ একর ভূমির অনুমোদনের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে আরও একধাপ এগোল বন্দর কর্তৃপক্ষ।
অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় ধাপে জেলা প্রশাসন ভূমি অধিগ্রহণের ৭ ধারায় অবকাঠামোর থাকা সাপেক্ষে ভূমির মূল্যমান নির্ধারণ করবে। গণপূর্তসহ বিভিন্ন সংস্থার সরেজমিন সার্ভে শেষ নির্ধারণ করা মূল্য পরিশোধের জন্য বন্দরের কাছে ৮ ধারা নোটিশ জারি করবে। এর ১২০ দিনের মধ্যে নামমাত্র মূল্যে পাওয়া অর্থ বন্দর পরিশোধ করবে। এছাড়া টাকা পাওয়ার ৭ দিনের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকেরা তাঁদের পাওনা বুঝে নিয়ে জায়গা ছাড়বেন। বন্দরকে সেই জায়গা হস্তান্তর করবে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। এরপরেই শুরু হবে বে-টার্মিনাল নির্মাণের কাজ।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ৩টি টার্মিনালের একটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এককভাবে এবং অপর দুটি বিল্ড-অপারেট অ্যান্ড ট্রান্সফার (বিওটি) ভিত্তিতে নির্মিত হবে। যা চালু হবে ২০২৬ সালের মধ্যে।
চট্টগ্রাম বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘বে-টার্মিনাল প্রকল্পের কাজ বন্দর কর্তৃপক্ষ অনেক আগেই হাতে নিয়েছে। বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে ৬৮ একর জায়গা কিনে নিয়েছিল। এখন ভূমি মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বে-টার্মিনাল প্রকল্পে নতুন আশার আলো দেখা যাচ্ছে।’
ডিজিটালাইজেশনের অংশ হিসেবে কনটেইনার হ্যান্ডলিং বিল অনলাইনে সংশ্লিষ্ট শিপিং এজেন্টদের কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। ১ আগস্ট থেকে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কনটেইনার হ্যান্ডলিং বিল পাঠাতে আংশিক অনলাইন ও প্রথাগত পদ্ধতি অনুসরণ করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
১ আগস্ট থেকে বন্দরের এমএলও ও শিপিং এজেন্টদের ইউজার আইডিতে নিয়মিত কনটেইনার হ্যান্ডলিং বিল পাঠানো হবে। তখন থেকে কোনো হার্ডকপি বা প্রিন্টকপি পাঠাবে না বন্দর।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, ‘অনলাইনে বিল প্রেরণের পদ্ধতি, আপত্তি দাখিল, বিল সমন্বয় করার বিষয়ে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং অনলাইনে বিল পাওয়া ও যাবতীয় বিষয়গুলো কীভাবে যাচাই-বাছাই করা হবে তা যথাযথভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
দেশের সবচেয়ে বড় রেলসেতু বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর নির্মাণসামগ্রী নিয়ে মোংলা বন্দরে পৌঁছেছে পানামার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি ফ্রানবো লোহাস। ১৪ জুন সেতুর নির্মাণসামগ্রী নিয়ে বন্দরের ৭ নম্বর জেটিতে ভিড়েছে জাহাজটি। জাহাজটির এদেশীয় এজেন্ট হক অ্যান্ড সন্সের ব্যবস্থাপক মো. শওকত আলী জানান, ‘বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুর ৩ হাজার ২৮৮ মেট্রিক টন স্টিল পাইপ ও পাইল নিয়ে এসেছে জাহাজটি। স্থানীয় শ্রমিক দিয়ে এগুলো খালাস করা হয়েছে।’
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ মুসা বলেন, ‘ভিয়েতনাম থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর মালামাল এসেছে। দ্রুততম সময়ে এগুলো খালাস করা হয়েছে।’
বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর নির্মাণসামগ্রী নিয়ে ১৪ জুন মোংলা বন্দরের ৭ নম্বর জেটিতে ভেড়ে পানামার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি ফ্রানবো লোহাস
২০২০ সালের নভেম্বরে যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতুর তিনশ মিটার উত্তরে এ রেলওয়ে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ৪ দশমিক ৮ মিটার দৈর্ঘ্যরে সবচেয়ে দীর্ঘ এই সেতুর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ সরকারের অভীষ্ট লক্ষ্য রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি উন্নত, সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তোলা। সেই লক্ষ্য পূরণে সহযোগী হিসেবে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে বিভিন্ন সরকারি দপ্তর বা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সর্বোচ্চ সেবা পেতে সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকাণ্ডে গতি, দক্ষতা, দায়বদ্ধতা এবং সুশাসন ও শুদ্ধাচার বাড়াতে বদ্ধপরিকর। আর এর জন্য প্রয়োজন একটি সুনির্দিষ্ট ও সুবিন্যস্ত কর্মপরিকল্পনা। এই প্রেক্ষিতেই সরকারি কর্মসম্পাদন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির (জিপিএমএস) আওতায় গৃহীত হয়েছে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) কার্যক্রম। নিঃসন্দেহে এটি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি জনকল্যাণমুখী প্রশাসনিক সংস্কার। এই চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা পূরণের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর আধুনিক ও যুগোপযোগী হওয়ার চলমান প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। পাশাপাশি ডিজিটাল ব্যবস্থা প্রচলন করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং দক্ষতা বাড়ানোও সম্ভব হচ্ছে।
সরকারি কর্মসম্পাদন ব্যবস্থাপনা
১৯৮০ দশকের শুরুতে ‘নিউ পাবলিক ম্যানেজমেন্ট’ ধারণা থেকে বিশ্বে সরকারি খাতে কর্মসম্পাদন ব্যবস্থাপনার শুরু হয়। এ ব্যবস্থাপনার মূলে ছিল সরকারি দপ্তরসমূহের দক্ষতা, কার্যকারিতা ও দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি এবং সরকারি সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার। বিশ^জুড়ে সরকারসমূহের প্রতিশ্রুতি আর জনমুখী বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে সরকারের কাছে নাগরিকদের প্রত্যাশা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গত দুই দশক ধরে বিশে^র বিভিন্ন দেশ কর্মসম্পাদন ব্যবস্থাপনা চালু করেছে। কর্মসম্পাদন ব্যবস্থা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে কর্মচারীদের সক্ষম করে তোলে, বাস্তবায়নের অগ্রগতি পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করে এবং পরবর্তীতে মূল্যায়নের ভিত্তিতে কর্মচারীদের প্রণোদনা প্রদান করে। কর্মসম্পাদন ব্যবস্থাপনার আওতায় একটি প্রতিষ্ঠান তার সম্পদ. কর্মচারী এবং কার্যপদ্ধতিকে কৌশলগত উদ্দেশ্য এবং বিভিন্ন অগ্রাধিকারের সাথে কার্যকরভাবে যুক্ত করে। এটি সরকারের কার্যক্রমের ধারাবাহিক সংস্কার, উন্নয়ন এবং তা পরিমাপের একটি গতিশীল পদ্ধতি। সরকারি দপ্তরকে আরও বেশি দক্ষ ও কার্যকরভাবে গড়ে তুলতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন নামে কার্যসম্পাদন ব্যবস্থাপনা চালু করেছে।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন বা এসিআর পদ্ধতিতে সরকারি কর্মচারীদের কার্যসম্পাদন ব্যবস্থাপনা শুরু হয়। এতে কর্মচারীদের নির্দিষ্ট কিছু সূচকের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসম্পাদন ব্যবস্থাপনা শুরু হয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দকৃত বাজেট এবং এডিপিতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে। এরপর কিছু মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক (কেপিআই) নির্ধারণ করা হয়। এটি সকল পর্যায়ের সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োগযোগ্য না হওয়ায় সমন্বিত কার্যসম্পাদন ব্যবস্থা প্রচলনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। দক্ষ ও সেবামুখী জনপ্রশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক কর্মসম্পাদন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালুর সুপারিশ করা হয় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিটির প্রতিবেদনে। ২০১২ সালে শুদ্ধাচার কৌশলেও কর্মসম্পাদনভিত্তিক নিরীক্ষা চালুর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এটি বাস্তবায়নে ২০১৪ সালের জুন ও নভেম্বরে সকল মন্ত্রণালয়ের সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে তিনটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এ কর্মশালায় অংশগ্রহণ করা সকলেই কর্মসম্পাদন ব্যবস্থা প্রচলনের সুপারিশ করেন। এর আগে একই বছরের জুনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাথে এর আওতাধীন সংস্থাসমূহ পারফরম্যান্স কনট্রাক্টিং এর আওতায় কেপিআই ভিত্তিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে, যা সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানে কার্যসম্পাদন চুক্তি প্রবর্তনের পথকে সুগম করে। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে কার্যসম্পাদন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির আওতায় বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি বা অ্যানুয়াল পারফরম্যান্স এগ্রিমেন্ট (এপিএ) চালু করে সরকার। প্রথম পর্যায়ে ২০১৫ সালের মার্চে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ৪৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এপিএ স্বাক্ষর করে।
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি
একটি দপ্তর বা প্রতিষ্ঠান কোনো একটি নির্দিষ্ট অর্থবছরে একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে যেসব গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জন করতে চায়, সে বিষয়ে সরকারের সাথে প্রতিষ্ঠানের চুক্তিই হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি বা এপিএ। প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট করা এসব লক্ষ্য এবং তার নির্দেশকসমূহ একটি ছকের মাধ্যমে এপিএতে লিখিত আকারে বর্ণনা করা হয়। সুশাসন এবং সংস্কারমূলক কার্যক্রমসমূহ যেমন; জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল, অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা, সেবাপ্রদানের প্রতিশ্রুতি, ই-গভর্ন্যান্স, উদ্ভাবন ও তথ্য অধিকার সমন্বিতভাবে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির অংশ।
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি দুটি অংশে বিভক্ত। একটি প্রাতিষ্ঠানিক কৌশলগত উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন, অপরটি সুশাসন ও সংস্কারমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন। সুশাসন ও সংস্কারমূলক কার্যক্রম মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্তৃক নির্ধারিত।
মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর পক্ষে সচিব প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সাথে এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন। আর বিভাগ বা সংস্থার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়ের সচিবের সাথে বিভাগ বা সংস্থার প্রধান এ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিবের মধ্যে বার্ষিক কর্ম সম্পাদন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অর্থবছর শেষে চুক্তি অনুযায়ী কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছে কিনা তা পর্যালোচনা করে মন্ত্রণালয়। এজন্য সরকার নির্ধারিত মানদ- রয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের অভিলক্ষ্য ও বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি
ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির চাহিদা পূরণে চট্টগ্রাম বন্দরকে নিজের দক্ষতার পরিচয় দিতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বাড়াতে হচ্ছে সক্ষমতা। জনবলের সর্বোত্তম ব্যবহার আর প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হচ্ছে। নিত্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার এই পথকে সুগম করতে সরকারের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, দক্ষতা আর প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জনের একাগ্রতা চট্টগ্রাম বন্দরকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
সরকারের রূপকল্প-২০৪১ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে দক্ষ, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব বন্দর বাস্তবায়নের রূপকল্প নির্ধারণ করেছে কর্তৃপক্ষ। রূপকল্পের লক্ষ্য অর্জনে নির্ধারণ করেছে অভিলক্ষ্য। এগুলো হলো; উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বন্দরের আধুনিকায়ন, কর্ণফুলী চ্যানেলের নাব্যতা সংরক্ষণ, দক্ষতার সাথে কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে জাহাজের গড় অবস্থানকাল হ্রাস এবং জেটি ও ইয়ার্ড সুবিধাদি সম্প্রসারণসহ নিরাপদ ও দক্ষ বন্দর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ এবং জাতীয় আমদানি-রপ্তানিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন। এসব অভিলক্ষ্য অর্জনে যেসব ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ কাজ করবে, সেগুলোও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়েছে। জোর দেওয়া হয়েছে টেকসই উন্নয়ন, পরিবেশবান্ধব বন্দর ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর। পৃথকভাবে পাঁচটি পরস্পর সম্পর্কিত ক্ষেত্র হলো; টেকসই উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন, চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ ও নিরাপত্তা প্রদান, কর্মসম্পাদনে গতিশীলতা আনয়ন ও সেবার মান বৃদ্ধি এবং আর্থিক ও সম্পদ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন। এছাড়া সুশাসন ও সংস্কারমূলক কার্যক্রম গ্রহণে জোর দেওয়া হয়েছে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে।
প্রতিষ্ঠানের রূপকল্প ও অভিলক্ষ্যের সাথে মিল রেখে প্রাতিষ্ঠানিক কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হয়। চট্টগ্রাম বন্দর তার কৌশলগত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছে। যেসব বিষয়কে কর্তৃপক্ষ আমলে নিয়ে অগ্রাধিকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো; রূপকল্প ২০৪১, ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ ও এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন। এসব বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েই বন্দরের এপিএ নির্ধারিত হয়।
মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ মনিটরিং ও কর্তৃপক্ষের নিরলস প্রচেষ্টায় সর্বশেষ অর্থবছরে (২০২০-২০২১) এপিএ-এর ৭টি পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার শতভাগ অর্জন করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এগুলো হলো; সংরক্ষণ ড্রেজিং, কার্গো হ্যান্ডলিং, কনটেইনার হ্যান্ডলিং, ৩০ হাজার বর্গমিটার নতুন কনটেইনার ইয়ার্ড নির্মাণ, সার্ভিস জেটি নির্মাণ, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প।
কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে মাইলফলক
করোনা অতিমারির কারণে বিশ^ব্যাপী বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে গত বছরের এপ্রিল থেকে। এর প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতিতেও। গত বছরের মার্চে শুরু হওয়া প্রথম ধাপের লকডাউনের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ নি¤œমুখী হয়। জুন-জুলাই থেকে শিল্প-কারখানা আবার পুরোদমে চালু হলে বাড়তে থাকে আমদানি-রপ্তানি। দেশের সরবরাহ ব্যবস্থা নির্বিঘœ রাখতে বন্দর কর্তৃপক্ষ করোনা পরিস্থিতিতেও ২৪/৭ অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ফলে সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে (২০২০-২০২১) চট্টগ্রাম বন্দর কনটেইনার, কার্গো ও জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের তিনটি সূচকেই প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা ২৮ লাখ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের বিপরীতে কর্তৃপক্ষ হ্যান্ডলিং করেছে ৩০ লাখ ৯৭ হাজার কনটেইনার। অন্যদিকে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের ৯ কোটি মেট্রিক টন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে হ্যান্ডলিং করেছে ১১ কোটি ৩৭ লাখ মেট্রিক টন কার্গো। জাহাজ হ্যান্ডলিং লক্ষ্যমাত্রা বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে না থাকলেও এক্ষেত্রেও গত অর্থবছরের পরিসংখ্যানকে টপকে ৪ হাজার ৬২টি জাহাজ হ্যান্ডলিং করেছে চট্টগ্রাম বন্দর। গত অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৭৬৪টি।
মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প
বতর্মান সরকারের ২০১৮ সালের নির্বাচনের নির্বাচনী ইশতেহারের ৩ দশমিক ২০ অনুচ্ছেদে মাতারবাড়ীতে সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সরকার ১০টি অগ্রাধিকার প্রকল্পের একটি (ফাস্ট ট্র্যাক) মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে গত অর্থবছরের ১০ জুনের মধ্যে পরামর্শক নিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও একই অর্থবছরের ২৩ সেপ্টেম্বর পরামর্শক নিয়োগের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ের ৮ মাস আগেই চুক্তি স্বাক্ষর সম্পাদন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল
চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান সক্ষমতা বাড়াতে পতেঙ্গায় নির্মাণ করা হচ্ছে কনটেইনার টার্মিনাল। বন্দরের নিজস্ব তহবিলের প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তিনটি কনটেইনার ও একটি তেল খালাসের জেটি তৈরি হচ্ছে প্রকল্প এলাকায়। করোনা অতিমারির কারণে নির্মাণ কাজে ব্যাঘাত ঘটলেও বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা শতভাগ অর্জন করেছে কর্তৃপক্ষ। এই সময়ে প্রকল্পের ৩০ শতাংশ কাজ বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল। এর আগের দুই অর্থবছরে ১৫ ও ২৮ শতাংশসহ সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে প্রকল্পের মোট ৭৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়েছে সার্ভিস জেটির নির্মাণকাজ
চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব জাহাজসমূহ বার্থিংয়ের জন্য বন্দরের ১ নং জেটির উজানে ২২০ মিটার দীর্ঘ সার্ভিস জেটির নির্মাণকাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করেছে কর্তৃপক্ষ। গত অর্থবছরে এই প্রকল্পের অবশিষ্ট ৩৭ শতাংশ কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। নির্ধারিত কাজের পুরোটাই বাস্তবায়ন হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে বন্দরের নিজস্ব নৌযান যেমন টাগবোট, স্পিড বোট, বার্জ, ড্রেজার, পাইলট বোট ও অ্যাম্বুলেন্স বোট বার্থিংয়ের জন্য কোনো নির্ধারিত জেটি ছিল না। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে বন্দরের নিজস্ব নৌযান বার্থিংয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ জেটিতে বার্থিংকৃত জাহাজসমূহের মেরামত ও পানি সরবরাহের সুবিধা রয়েছে। প্রকল্পের সুফল হিসেবে বন্দরের নিজস্ব জাহাজগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ খরচও অনেকাংশে কমে আসবে। প্রকল্পের আওতায় ২২০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ২০ মিটার প্রস্থের জেটি, ১৯ মিটার দৈর্ঘ্যরে কানেক্টিং ব্রিজ, তিন তলা অফিস ভবন, ১ হাজার বর্গমিটার শেড, ২ হাজার ঘনমিটার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ভূগর্ভস্থ পানির ট্যাংকসহ প্রয়োজনীয় সুবিধাদি নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রমে গতি আসবে। কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সার্ভিস জেটিটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৮২ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
সংরক্ষণ ড্রেজিংয়ে লক্ষ্যমাত্রা পেরিয়ে…
চট্টগ্রাম বন্দর কর্ণফুলী নদীর পাড়ে গড়ে ওঠায় জেটিতে জাহাজ আসা-যাওয়ার সুবিধার্থে নাব্যতা রক্ষায় প্রতিনিয়ত সংরক্ষণ ড্রেজিং করতে হয় কর্তৃপক্ষকে। উজান থেকে আসা পলিতে যাতে কর্ণফুলী চ্যানেলের নাব্যসংকট দেখা না দেয়, সেটি নিশ্চিত করতে বন্দর কর্তৃপক্ষ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংরক্ষণ ড্রেজিং পরিচালনা করে। এতে সারা বছর নির্বিঘেন্নে জেটিতে জাহাজ চলাচল করতে পারে। গত অর্থবছরের কর্মসম্পাদন চুক্তিতে কর্ণফুলী চ্যানেল ও বহির্নোঙরের ২০ কিলোমিটার এলাকা ড্রেজিংয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। অর্থবছর শেষে কর্তৃপক্ষ ২২ কিলোমিটার ড্রেজিং করতে সক্ষম হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ কিলোমিটার বেশি। আর যদি ঘনমিটার হিসাব করা হয় তাহলে ১১ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ড্রেজিং করা হয়েছে ১২ লাখ ঘনমিটার।
নতুন ইয়ার্ড নির্মাণ
ক্রমবর্ধমান হারে আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধির সাথে পণ্য ও কনটেইনার সংরক্ষণে চট্টগ্রাম বন্দরকে সম্প্রসারণ করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। চাহিদার সাথে তাল রেখে কর্তৃপক্ষ ইয়ার্ড সম্প্রসারণ করছে পরিকল্পনা অনুযায়ী। সদ্যবিদায়ী অর্থবছরে ৩০ হাজার বর্গমিটার নতুন ইয়ার্ড যোগ হয়েছে বন্দর। যা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছে।
বন্দরের সুশাসন ও সংস্কারমূলক কর্মসম্পাদন
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি অনুযায়ী বন্দর তার সুশাসন ও সংস্কারমূলক কর্মসম্পাদনে বদ্ধপরিকর। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী ৫টি ক্ষেত্রে এসব কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়। এগুলো হলো শুদ্ধাচার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, ই-গভর্ন্যান্স ও উদ্ভাবন, আইন অনুযায়ী তথ্য অধিকার বাস্তবায়ন, অভিযোগ প্রতিকার কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও প্রতিশ্রুত সেবাপ্রদানের কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন।
শুদ্ধাচার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন
শুদ্ধাচার বলতে সততা ও নৈতিকতা দ্বারা প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষতাকে বোঝায়। একটি সমাজের কালোতীর্ণ মানদ-, নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্যকেও শুদ্ধাচার বলা যায়। ব্যক্তিপর্যায়ে এর অর্থ হলো কর্তব্যনিষ্ঠা, সততা ও ন্যায়নিষ্ঠা। ব্যক্তির সমষ্টিতে প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়। তাদের সম্মিলিত লক্ষ্যই প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্যে প্রতিফলিত হয়। কোনো প্রতিষ্ঠানের তিনটি ক্ষেত্রে শুদ্ধাচার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়। এগুলো হলো প্রাতিষ্ঠানিক, আর্থিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট এবং শুদ্ধাচার-সংক্রান্ত অন্যান্য কার্যক্রম। চট্টগ্রাম বন্দরও একইভাবে শুদ্ধাচার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে।
প্রাতিষ্ঠানিক শুদ্ধাচার
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা ও শৃঙ্খলা বৃদ্ধি এবং অনৈতিক মনোভাব দূর করতে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য কর্মশালার আয়োজন করে নিয়মিত। দুর্নীতিবিষয়ক পাঠ, শুদ্ধাচার, সুশাসন ও সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা বিষয়ে অবহিত করা হয় এসব প্রশিক্ষণ ও কর্মশালায়। গত অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ৮৫টি কোর্সের মাধ্যমে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এসব কোর্সের মধ্যে ছিল বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও প্রাথমিক চিকিৎসা, দক্ষতা বৃদ্ধি ও কার্যকর উপস্থাপনা, পরিচালনা ও শৃঙ্খলা, নিরাপত্তাবিষয়ক প্রশিক্ষণ, ই-নথি বাস্তবায়ন পদ্ধতি প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ কোর্স। নিয়মিত অফিসে আগমন তদারকির জন্য প্রশাসন ও হিসাব বিভাগসহ বেশ কয়েকটি বিভাগে চালু করা হয়েছে বায়োমেট্রিক অ্যাটেনডেন্স সিস্টেম। এর আগে থেকেই ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে উপস্থিতির রেজিস্টার সংরক্ষণ করা হয় চট্টগ্রাম বন্দরে।
অতিমারির এই সংকটকালেও সর্বশেষ বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং লক্ষ্যমাত্রা পেরিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। এ সময়ে রেকর্ড ৪ হাজার ৬২টি জাহাজ হ্যান্ডলিং করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ
এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের ১৭টি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানদের তত্ত্বাবধানে ইলেকট্রনিক ডিভাইস, কাগজ ও অন্যান্য স্টেশনারি সামগ্রীর ব্যবহার মনিটরিং করা হয়। সুরক্ষা নিশ্চিতে প্রতিদিন অফিস শুরুর আগে ও পরে সকল অফিস কক্ষ পরিষ্কার করা হয়। অতিমারির কারণে এর সাথে যোগ হয়েছে জীবাণুনাশক স্প্রে করা। বন্দরের স্থাপনাসমূহে বন্দরের নিজস্ব ফায়ার সার্ভিস ফায়ার ট্রাকের মাধ্যমে জীবাণুনাশক স্প্রে করছে নিয়মিত। এছাড়া বন্দরের সকল দপ্তরে মাস্ক পরিধান ও স্বাস্থ্যবিধি কার্যকরে পরিচালনা করা হচ্ছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
আর্থিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে শুদ্ধাচার
চট্টগ্রাম বন্দর দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর হওয়ায় আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিতের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। পরিচালন ব্যয়, উন্নয়ন ব্যয় ও সামাজিক উন্নয়ন খাতে (সিএসআর) ব্যয়ের সঠিক হিসাব ও প্রতিবেদন দাখিল করতে হয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে। প্রতি অর্থবছরের শুরুতে বাজেট প্রণয়ন করা হয়। প্রতিটি বিভাগের চাহিদা, উন্নয়ন প্রকল্প ও ক্রমবর্ধমান পরিচালন ব্যয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট প্রণয়ন করা হয়। এতে খাতওয়ারি ব্যয় নির্ধারণ করা হয় চাহিদামাফিক। এছাড়া সম্ভাব্য আয়ের খাত বিবেচনায় আয়েরও প্রক্ষেপণ করা হয়। চলতি অর্থবছরের বাজেট বইয়ে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর আগের অর্থবছরের ক্রমপুঞ্জিত ব্যয়, অনুমোদিত ব্যয়, সংশোধিত ব্যয় ও চলতি অর্থবছরের প্রাক্কলিত ব্যয় উল্লেখ করা হয়েছে। এতে উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় সম্পর্কে সহজেই ধারণা পাওয়া যায়। এছাড়া বিগত পাঁচ অর্থবছরের আয়, ব্যয় ও উদ্বৃত্ত অর্থের পরিমাণও উল্লেখ করা হয়েছে বাজেট বইয়ে।
শুদ্ধাচার-সংক্রান্ত অন্যান্য কার্যক্রম
ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনকারী সব ধরনের যানবাহন ও চালকদের ডাটাবেজের আওতায় আনা হয়েছে। ফলে অনিবন্ধিত কোনো যানবাহন বা ব্যক্তি বন্দরে প্রবেশ করতে পারে না।
অনলাইন বার্থিং সিস্টেম চালুর ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বার্থিং শিডিউল নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে। এতে একদিকে যেমন স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়েছে, তেমনি সেবাপ্রদানের আনুষ্ঠানিকতাও কমছে পর্যায়ক্রমে।
ই-গভর্ন্যান্স ও উদ্ভাবন
দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিতে ই-গভর্ন্যান্স ও উদ্ভাবন চর্চার বিকল্প নেই। ই-গভর্ন্যান্স ও উদ্ভাবন অনুশীলনে উদ্ভাবন, সেবা সহজীকরণ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রয়োগ করতে হয়। সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা প্রতিষ্ঠানের সেবাপ্রদান প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও অভ্যন্তরীণ কাজের গুণগত পরিবর্তনে ই-গভর্ন্যান্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ই-গভর্ন্যান্স পরিকল্পনার উদ্দেশ্য উদ্ভাবন, সেবা সহজীকরণ, ব্যয় কমানো এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহারকে সুশৃঙ্খল, নিয়মতান্ত্রিক, প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং দায়বদ্ধতা সৃষ্টি।
করোনা অতিমারির এই সংকটকালেও চট্টগ্রাম বন্দর তার সর্বোচ্চ সেবা দিয়েছে স্টেকহোল্ডারদের। করোনায় আক্রান্ত হয়ে বন্দরের ওয়ান স্টপ সার্ভিসে কর্মরত একজন কর্মী মারা যান সংক্রমণের শুরুতেই। সেবাদাতা ও সেবাগ্রহীতাকে শারীরিক উপস্থিতির মাধ্যমে এখানে সেবা দিতে ও নিতে হয় বলে সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। এ ঝুঁকি হ্রাসে চট্টগ্রাম বন্দরের পর্ষদ সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মো. জাফর আলমের নেতৃত্বে পরিচালক (পরিবহন) এনামুল করিম, টার্মিনাল ম্যানেজার মো. কুদরত-ই খুদা মিল্লাত ও উপপ্রধান প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) মো. মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরীসহ একটি দল উদ্ভাবন করেন সেবাপ্রদানের আধুনিক এক পদ্ধতি। ‘রি-ইঞ্জিনিয়ারিং অব সিপিএ ওয়ান স্টপ সার্ভিস; আ সাসটেইনেবল সলিউশনস টু কমব্যাট প্যানডেমিক (কোভিড-১৯) সিচুয়েশন’ শীর্ষক এ পদ্ধতিতে পণ্য বা কনটেইনারের রিলিজ অর্ডার, এজেন্ট ডেলিভারি অর্ডারসহ ওয়ান স্টপ সার্ভিসের বেশ কিছু সেবা অনলাইন গেটওয়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা শুরু হয়। ফলে বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সহজেই সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের দাখিল করা দলিলাদি ভেরিফাই করতে পারছেন। এটি কার্যকরের ফলে শারীরিক উপস্থিতি কমার সাথে সাথে সেবাপ্রদানের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েক গুণ। নতুন উদ্ভাবিত এ পদ্ধতিটি পুরোপুরি চালু হলে আরও কম সময়ে ও অধিক স্বচ্ছতার সাথে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারের সেবা অনলাইনেই পাবেন সেবাগ্রহীতারা। উদ্ভাবিত এ সেবার স্বীকৃতিও দিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের ‘উদ্ভাবক পুরস্কার-২০২১’ পেয়েছেন উদ্ভাবনী দলের দলনেতা সরকারের যুগ্ম সচিব ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মো. জাফর আলম।
বন্দরে হ্যান্ডলিংকৃত জাহাজের বিল প্রথাগতভাবে সংশ্লিষ্ট শিপিং এজেন্টকে পাঠানো হতো কাগুজে দলিল হিসেবে। অনলাইনসেবা সহজীকরণের অংশ হিসেবে এখন অনলাইনে বিল পাঠানো হয় শিপিং এজেন্টদের। দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়টি সামনে রেখে বন্দরের অভ্যন্তরীণ নথির বেশির ভাগ ই-নথির মাধ্যমে সম্পাদন করা হচ্ছে। বন্দরের সেবা কার্যক্রম অটোমেশন (আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর) করার জন্য ৫০টি মডিউল তৈরির প্রকল্প চলমান রয়েছে। এছাড়া স্টেকহোল্ডারদের সেবা সম্পর্কিত তথ্য জানাতে চালু করা হয়েছে কল সেন্টার।
সেবাপ্রদানে প্রতিশ্রুতি: সিটিজের চার্টার
চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব জনবল প্রায় ৬ হাজার ৫০০ জন। এ বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিচালনা, শৃঙ্খলা ও স্টেকহোল্ডারদের সেবা নিশ্চিতে চট্টগ্রাম বন্দরের রয়েছে সিটিজেন চার্টার। এতে নাগরিক সেবা, প্রাতিষ্ঠানিক সেবা ও অভ্যন্তরীণ সেবা শ্রেণিতে সব ধরনের সেবার উল্লেখ রয়েছে। সর্বশেষ হালনাগাদ অনুযায়ী সিটিজেন চার্টারে নাগরিক সেবা রয়েছে ৫১টি, প্রাতিষ্ঠানিক সেবা ৩২ এবং অভ্যন্তরীণ সেবা রয়েছে ৫৬টি। এসব সেবা গ্রহণের সুবিধার্থে সিটিজেন চার্টারে সেবার নাম, সেবাপ্রদান পদ্ধতি, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও প্রাপ্তিস্থান, সেবার মূল্য ও পরিশোধ পদ্ধতি, সেবাপ্রদানের সময়সীমা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নাম, পদবি, মোবাইল নম্বর ও ই-মেইল অ্যাড্রেস দেওয়া আছে।
সেবাপ্রদান বিষয়ে স্টেকহোল্ডারদের অবহিতকরণ
চট্টগ্রাম বন্দর তার স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে প্রতি বছর উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক করে থাকে। এতে প্রতিটি স্টেকহোল্ডার সংগঠনের প্রতিনিধি উপস্থিত থেকে বন্দরসেবা ও উন্নয়ন সম্পর্কিত তাদের মতামত, পরামর্শ ও প্রস্তাবনা দিয়ে থাকেন। মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এতে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে উত্থাপিত সব মতামত, পরামর্শ ও প্রস্তাবনা আমলে নিয়ে কর্তৃপক্ষ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। এছাড়া আগের বৈঠকের আলোচিত বিষয়ের অগ্রগতি উপস্থাপন করে স্টেকহোল্ডারদের অবহিত করে কর্তৃপক্ষ। করোনা অতিমারি বিবেচনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে গত বছরের ২০ ডিসেম্বর সর্বশেষ উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থাপনা
কোনো বন্দর ব্যবহারকারী সেবাপ্রাপ্তিতে অসন্তুষ্ট হলে বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সে বিষয়ে সমাধান দিতে ব্যর্থ হলে অভিযোগ নিষ্পত্তি কর্মকর্তা (অনিক) তা সমাধান করবেন। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বর্তমান অভিযোগ নিষ্পত্তি কর্মকর্তা হলেন পরিচালক (প্রশাসন) মো. মমিনুর রশিদ। তিনি সমাধান দিতে না পারলে আপিল নিষ্পত্তি কর্মকর্তা (আনিক) হিসেবে বন্দরের পর্ষদ সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মো. জাফর আলম এর সমাধান দেবেন। বন্দরের ওয়েবসাইটে এ সম্পর্কিত সকল তথ্য হালনাগাদ করা আছে।
তথ্য অধিকার বাস্তবায়ন
তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ অনুসারে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাগরিকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে তথ্য প্রদান করে থাকেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে তথ্য প্রদানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের তথ্য হলে ২০ দিনের মধ্যে এবং এর সাথে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকলে ৩০ দিনের মধ্যে তথ্য প্রদান করতে হয়। আর তথ্য প্রদানে অপারগ হলে আবেদনের ১০ দিনের মধ্যে আবেদনকারীকে তা জানিয়ে দিতে হয়। চট্টগ্রাম বন্দর তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়ন করছে। তথ্যপ্রাপ্তির জন্য তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা চিফ পারসোনেল অফিসার মো. নাছির উদ্দিন, বিকল্প কর্মকর্তা সিনিয়র পারসোনেল অফিসার (আইআর) মোহাম্মদ আজিজুল মওলা ও আপিলের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান বরাবর আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। অবাধ তথ্য সরবরাহের অংশ হিসেবে বন্দরের কার্গো, কনটেইনার ও জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের তথ্য প্রতিনিয়ত হালনাগাদ করা হয় বন্দরের ওয়েবসাইটে। বন্দরসেবা সম্পর্কিত যেকোনো অফিস আদেশ, বিজ্ঞপ্তি ও অনুরোধপত্রও নিয়মিত হালনাগাদ করা হয়। বন্দরের বার্ষিক প্রতিবেদন (অ্যানুয়াল রিপোর্ট) প্রকাশ করা হয় ওয়েবসাইটে। এতে বন্দরের সার্বিক চিত্র উঠে আসে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের নিয়মিত কার্যক্রম, সমস্যা, সম্ভাবনা, পরিকল্পনা ও সংশ্লিষ্ট খাতগুলোর হালনাগাদ তথ্য নিয়ে প্রকাশ করা হয় মেরিটাইম ম্যাগাজিন ‘বন্দরবার্তা’ ও ‘সিপিএ নিউজ’।
কর্মসম্পাদন চুক্তিতে চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা
এপিএর কার্যক্রমসমূহ বাস্তবায়নে করোনা অতিমারি এখন একটি বড় সমস্যা। এই সমস্যা থেকে উত্তরণে বন্দরে কর্মরত শতভাগ শ্রমিক-কর্মচারীদের টিকা দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। করোনার বৈশ্বিক সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের নেতিবাচক প্রভাব বন্দরের কার্যক্রমের ওপর পড়বে। এর সাথে অন্যান্য প্রতিকূলতা বিবেচনা করে নির্ধারণ করা হয়েছে চলতি অর্থবছরের (২০২১-২০২২) বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা।
অপারেশনাল কার্যক্রমের লক্ষ্যমাত্রা
দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বন্দরের কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এবারের কর্মসম্পাদন চুক্তিতে। প্রতি ঘণ্টায় ৪০ দশমিক ৫০ মেট্রিক টন কার্গো ও ১৬টি কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। হ্যান্ডলিংয়ের এ হারে অর্থবছরের মোট হ্যান্ডলিং লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ কোটি মেট্রিক টন কার্গো ও ২৮ দশমিক ৫০ লাখ টিইইউ কনটেইনার। করোনার প্রভাব বিবেচনায় গত অর্থবছরের ৯ মাসের প্রকৃত হ্যান্ডলিংয়ের ভিত্তিতে এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা
টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও আধুনিকায়নে এবারের (২০২১-২০২২) কর্মসম্পাদন চুক্তিতে ১৯টি প্রকল্পের বাস্তবায়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেসব প্রকল্পের প্রতিটি বন্দরের সক্ষমতা ও আধুনিকায়নের সাথে জড়িত। এসব প্রকল্পের মধ্যে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের অবশিষ্ট ১২ শতাংশ কাজ শেষ করার মাধ্যমে কনটেইনার হ্যান্ডলিং শুরু করা, মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের ৩টি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান ও মূল্যায়ন মার্চের মধ্যে শেষ করা, ১০ জুনের মধ্যে ২টি টাগবোট ক্রয়ের কাজ শেষ করা, বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে বে-টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার নেভিগেশনাল অ্যাকসেস চ্যানেলের ডিটেইল ডিজাইন প্রণয়নে ১০ জুনের মধ্যে পরামর্শক নিয়োগ করা, একই তারিখের মধ্যে বে-টার্মিনালের জন্য পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ কর্তৃপক্ষের মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন, বে-টার্মিনালের ২ ও ৩ নম্বর টার্মিনালের বিজনেস কেস মডেল প্রণয়নের জন্য পরামর্শক নিয়োগ এবং ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের মাধ্যমে ২৮ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং অন্যতম। এসব লক্ষ্যমাত্রার সবগুলোই সর্বোচ্চ মান। এছাড়া কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য ১০৪টি যন্ত্রপাতি সংগ্রহ, ১২ লাখ ঘনমিটার সংরক্ষণ ড্রেজিং, ১৮টি হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ চার্ট তৈরি, ৬টি জরিপ যন্ত্রপাতি সংগ্রহ, ১০ হাজার বর্গমিটার ইয়ার্ড নির্মাণ, বহুতল কার পার্কিং শেড নির্মাণ, সিসিটি ও এনসিটি এলাকায় ৪৪৮টি এলইডি লাইট স্থাপন, ডাটা সেন্টারের জন্য প্রয়োজনীয় মালামাল সংগ্রহ ও প্রতিস্থাপন, নিরাপত্তা বিভাগের অভিযান পরিচালনার জন্য যন্ত্রপাতি ও উদ্ধারযান সংগ্রহ এবং বন্দর আবাসিক এলাকার রাস্তা মেরামত রয়েছে এবারের কার্মসম্পাদন চুক্তিতে।
শুদ্ধাচার ও সংস্কারমূলক কার্যক্রমের কর্মপরিকল্পনা
সেবার গতিশীলতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতে কর্তৃপক্ষ শুদ্ধাচারের শতভাগ বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। অনুমোদিত জনবলের কম লোকবল নিয়ে সর্বোচ্চ সেবাপ্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। ৬২টি কোর্সের মাধ্যমে প্রায় ২ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এছাড়া তিন মাস পর পর নৈতিকতা কমিটির সভা, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, কর্মপরিবেশ উন্নয়ন, অভিযোগ প্রতিকারে দ্রুত ব্যবস্থা, ওয়েবসাইটে তথ্য হালনাগাদ করা, প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভা, আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ, বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ ও সব ধরনের সেবা ডিজিটালাইজড করার কাজকে এগিয়ে নিতে কর্মপরিকল্পনা ও সময় নির্ধারণ করা হয়েছে এবারের কর্মসম্পাদন চুক্তিতে।
এক নজরে চট্টগ্রাম বন্দরের তিন বছরের সাফল্য
বিগত তিন বছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির প্রায় সবগুলো সূচকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরই ফলে প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতির নির্দেশক কি-পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটরের সূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের।
গত তিন অর্থবছরে প্রায় ৮৭ দশমিক ২৩ লাখ টিইইউ কনটেইনার ও ২৮ দশমিক ৯৭ কোটি মেট্রিক টন কার্গো হ্যান্ডলিং করা হয়েছে। একই সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরে কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং গড়ে যথাক্রমে ৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ ও ৫ দশমিক ২১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্ণফুলীর নাব্যতা রক্ষায় গড়ে প্রতি বছর ১৯ কিলোমিটার সংরক্ষণ ড্রেজিং করা হয়েছে। বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ১ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার ইয়ার্ড নির্মাণ করা হয়েছে। লন্ডনভিত্তিক শিপিং বিষয়ক সাময়িকী লয়েড’স লিস্টে বিশ্বের সেরা ১০০টি কনটেইনার বন্দরের তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দর তিন বছরে ৭১তম অবস্থান থেকে এগিয়ে ২০২০ সালে ৫৮তম অবস্থান অর্জন করেছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং এলাকায় ওভার ফ্লো কনটেইনার ইয়ার্ড, ১ নং জেটির উজানে সার্ভিস জেটি এবং সদরঘাট এলাকায় একটি ৭৫ মিটার লাইটারেজ জেটি নির্মাণ করা হয়েছে। বন্দর ভবনের নিরাপত্তা রক্ষায় অ্যাকসেস কন্ট্রোল সিস্টেমের প্রবর্তন করা হয়েছে। বহির্নোঙরের সীমা ৭ নটিক্যাল মাইল থেকে ৫০ নটিক্যাল মাইলে উন্নীত করা হয়েছে। ফলে বন্দরের জলসীমা ৬ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, গেট এন্ট্রি সিস্টেম পূর্বের তুলনায় আরও আধুনিক করা হয়েছে। এছাড়া কা-ারি-১২, ২টি মুরিং লঞ্চ, ২টি সাইট স্ক্যান সোনার, ২টি ইকো সাউন্ডার ও ১টি সি গোয়িং লো ফিবোর্ড হারবার টাগবোট (২০০০ বিএইচপি) সংগ্রহ করা হয়েছে। বন্দরের কার্যক্রম গতিশীল করার লক্ষ্যে গত তিন অর্থবছরে ৯১টি কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হয়েছে।
সর্বশেষ অর্থবছরে অতিমারি করোনার ধাক্কা সামলিয়ে বন্দরকে পুরোদমে সচল রাখতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বন্দর হাসপাতালে ‘কোভিড-১৯’ এর নমুনা সংগ্রহ করা, আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য ৫০ শয্যাবিশিষ্ট পৃথক করোনা ইউনিট স্থাপন ও টিকাপ্রদান কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। ২টি মোবাইল হারবার ক্রেন যুক্ত করার ফলে বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যন্ত্রপাতি সংযোজন ও বন্দর ব্যবস্থাপনায় সংস্কারের ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে কোনো প্রকার জাহাজজট নেই। ‘কোভিড-১৯’ এর মধ্যেও বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম সার্বক্ষণিক অর্থাৎ ২৪/৭ চালু রাখা হয়েছে।
এপিএর মাধ্যমে বন্দর পৌঁছবে অভীষ্ট লক্ষ্যে
রূপকল্প-২০৪১, এসডিজি, ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়ন বা এলডিসি থেকে উত্তরণ যেটাই বলি না কেন, প্রত্যেকটিতে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ। এসব লক্ষ্য অর্জনে এপিএ কার্যকর ভূমিকা রাখছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এতে কাজের প্রতি মনোযোগ বাড়ছে, তেমনি লক্ষ্য অর্জনে পুরস্কৃত হচ্ছে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, বিভাগ ও মন্ত্রণালয়। সরকারের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে বন্দরের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আরও বেশি দায়বদ্ধ ও বাস্তবমুখী করছে এপিএ। আরও বেশি সম্পৃক্তি ও নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করছে বন্দরের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায়। এতে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা বাড়ছে, উন্নত হচ্ছে কর্মসম্পাদনের মান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘সমৃদ্ধি আসার সহজ কোনো পথ নেই। প্রাণপণ লড়াই করে আমাদের সমৃদ্ধি আনতে হবে।’ তাই আমাদের এই পথেই হাঁটতে হবে। আর এ সমৃদ্ধি অর্জনে বন্দরের পথপ্রদর্শক বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি বা এপিএ।
২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে রূপান্তর করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে সরকার। এজন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার জন্য বঙ্গোসাগর ও ভারত মহাসাগরে স্থিতিশীলতা চায় বাংলাদেশ। এই অঞ্চলের কোনো বিবদমান পক্ষে জড়াতে চায় না বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘আমাদের এই অঞ্চলে যদি অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়, তাহলে লক্ষ্যে পৌঁছাতে সমস্যা হবে। সুতরাং আমরা চাই ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর যেন স্থিতিশীল থাকে। এর মাধ্যমে চলাচল থেকে শুরু করে সমুদ্রসম্পদ আহরণ সবকিছু আমরা সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পারব। আমাদের চেষ্টা থাকবে কীভাবে স্থিতিশীলতার দিকে যেতে পারি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছের দেশগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যমূলক নীতি অবলম্বন করতে হবে। দূরের দেশগুলোর জন্য সেটি আমরা না-ও করতে পারি। বঙ্গবন্ধুর ‘‘সবার সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে বৈরিতা নয়’’ এই নীতিকে মূলমন্ত্র হিসেবে ধরে নিলে ভারসাম্যমূলক নীতি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব।’
সমুদ্রগামী জাহাজের উদ্যোক্তাদের এবারের বাজেট স্বস্তি দিয়েছে। এ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোক্তারা যেসব দাবি জানিয়ে আসছিলেন, সেগুলোর কয়েকটি পূরণ করেছে সরকার। এত দিন এ খাতের উদ্যোক্তারা বিদেশ থেকে সর্বোচ্চ ২২ বছরের পুরোনো জাহাজ আমদানি করতে পারতেন। আবার কেনার পর পাঁচ বছরের আগে ওই জাহাজ বিক্রির কোনো সুযোগ ছিল না। দিতে হতো আগাম করও। তাই করভার তুলে দেওয়াসহ এ খাতের ব্যবসার ওপর আরোপিত বিভিন্ন বিধিনিষেধ তুলে দেওয়ার দাবি ছিল উদ্যোক্তাদের।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তাঁর বাজেট বক্তব্যে সমুদ্রগামী জাহাজ আমদানির ক্ষেত্রে ভ্যাট-সংক্রান্ত আদেশে পুরোনো জাহাজের আয়ুষ্কাল ২২ বছরের পরিবর্তে ২৫ বছর এবং আমদানির পর বিক্রয়ের সময়সীমা ৫ বছরের পরিবর্তে ৩ বছর নির্ধারণের সুপারিশ করেন। আবার আগাম কর প্রত্যাহারের প্রজ্ঞাপনে আছে সমুদ্রগামী জাহাজের নামও। প্রজ্ঞাপনে পাঁচ হাজার টনের বেশি পণ্য পরিবহনক্ষমতার সমুদ্রগামী জাহাজ আমদানিতে আগাম কর প্রত্যাহারেরও ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
নৌবাণিজ্য কার্যালয়ের গত এপ্রিল মাসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা এখন ৬৬। কেএসআরএম (এসআর শিপিং), মেঘনা গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, কর্ণফুলী লিমিটেড, এমজেএল বাংলাদেশ, ওরিয়ন গ্রুপসহ ১১টি শিল্প গ্রুপের হাতে সমুদ্রগামী জাহাজ রয়েছে। আগের তুলনায় কয়েক বছর ধরে এ খাতের উদ্যোক্তাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোয় জাহাজের সংখ্যা বেড়েছে। এ বছর মেঘনা গ্রুপ, কর্ণফুলী লিমিটেডের মতো শিল্পগোষ্ঠী খাতটিতে নতুন করে বিনিয়োগ করেছে।
তিনটি সমুদ্রবন্দরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে সাড়ে ১০ কোটি টনের বেশি আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন হয় সমুদ্রপথে। এ পণ্যের খুব সামান্য অংশই দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজে পরিবহন হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সমুদ্রপথে পণ্য আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছে ২ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার বা ২৪ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা। তবে জাহাজ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ওশান গোয়িং শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে সব মিলিয়ে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন বাবদ ব্যয় আট বিলিয়ন ডলারের কম হবে না। এর মাত্র ৩০০ মিলিয়ন ডলার বা পৌনে ৪ শতাংশ দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের।
মেরিটাইম ট্রান্সপোর্টের বিভিন্ন অংশীজনের মধ্যে রয়েছে বন্দর, শিপিং লাইন ও বন্দর ব্যবহারকারী মার্চেন্টরা। তাদের প্রত্যেকেরই সম্পদ ও অবকাঠামো সীমিত। তা সত্ত্বেও সবারই লক্ষ্য থাকে নিজেদের অবস্থানে থেকে গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সেবা প্রদান করা। আর তাদের এই লক্ষ্য পূরণে যে উদ্যোগ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, তা হলো পোর্ট কল অপটিমাইজেশন।
বৈশ্বিক বাণিজ্যে তথা পণ্য পরিবহনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে রয়েছে সমুদ্রপথ। মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট একটি সুবিস্তৃত প্রক্রিয়া, যা পরিচালিত হয় সুনিয়ন্ত্রিত ও স্ব-সংগঠিত ইকোসিস্টেমের মধ্যে। আর এই ইকোসিস্টেমের উপাদান হিসেবে রয়েছে বিভিন্ন অংশীজন, যাদের নিজ নিজ কার্যক্রম সমন্বিতভাবে শিপিং খাতে প্রাণ সঞ্চার করেছে। সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের শৃঙ্খলে প্রত্যেক অংশীজনের ভূমিকাই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ খাতের টেকসই উন্নয়নে সবার মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার সম্পর্ক থাকা অত্যাবশ্যকীয়। আর এই সম্পর্ক কার্যকরভাবে গড়ে তুলতে পারে পোর্ট কল অপটিমাইজেশন।
কেবল একটি পক্ষের উদ্যোগে পোর্ট কলের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যেই একটি যোগসূত্র গড়ে উঠতে হবে। যার যার কাছে যে তথ্য রয়েছে, তা অন্যদের সঙ্গে বিনিময় করতে পারলে তবেই সুফল মিলবে। একটি জাহাজ কখন বন্দরে নোঙর করলে যতটা দ্রুত সম্ভব সেবা নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে, সেই সম্ভাব্যতা সম্পর্কে আগেভাগেই সঠিক অনুমান করতে পারলে এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা সাজাতে পারলে শিপিং কোম্পানি, বন্দর কর্তৃপক্ষ ও গ্রাহক-সবারই লাভ। ডিজিটাল ডাটা শেয়ারিংয়ের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আমাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে। আর এই সুযোগ কাজে লাগাতে প্রয়োজন পোর্ট কল অপটিমাইজেশনের উদ্যোগ গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন।
মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট খাতকে সর্বোতভাবে টেকসই করে গড়ে তুলতে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পোর্ট কল অপটিমাইজেশনের ওপর বেশ জোর দেওয়া হয়েছে। ঠিক কোন পদ্ধতি অনুসরণ করলে এর সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করা যাবে কিংবা সেবাদানকারী বন্দরের সঙ্গে যাত্রারত জাহাজ এবং পূর্ব ও পরবর্তী বন্দরগুলোর যোগাযোগের মানদ- কীরূপ হবে, তা নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এরই মধ্যে। আর এই অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে পোর্ট ও টার্মিনালগুলো তাদের গ্রাহকসেবার মান আরও উন্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
পোর্ট কল অপটিমাইজেশনের বেশকিছু সুবিধা এরই মধ্যে মিলতে শুরু করেছে। তার মধ্যে বড় একটি সুবিধা হলো প্রেডিক্টেবিলিটি বা অনুমেয়তা বৃদ্ধি, যা শিপিং কোম্পানিগুলোর শিডিউলিং ও প্ল্যানিংয়ে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। তবে শুধু যে জাহাজগুলোই এর উপকারভোগী হচ্ছে, তা নয়। বরং বন্দর কর্তৃপক্ষগুলোও এর সুবিধা পাচ্ছে।
প্রথাগতভাবে এতদিন বন্দরগুলোয় ‘আগে আসলে আগে সেবা’ মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে সেবা দেওয়া হলেও এখন বিভিন্ন বন্দর কর্তৃপক্ষ পূর্বপ্রতিশ্রুত সময়ে সেবাপ্রদানের নীতিতে হাঁটতে চাইছে। আর এই যুগান্তকারী পরিবর্তনের পরিকল্পনা সাজাতে বন্দর কর্তৃপক্ষগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ লাইফ লাইন হিসেবে কাজ করছে আগে থেকে অনুমান করার সক্ষমতা।
আসলে ব্যবসায়িক লক্ষ্য যা-ই হোক না কেন, পোর্ট কল অপটিমাইজেশনের সুবিধাভোগী হয় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই। বন্দরকেন্দ্রিক পেক্ষাপটে দেখা যায়, বিদ্যমান সম্পদ ও অবকাঠামোর সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের চাপ থাকে বন্দর পরিচালনাকারীদের ওপর। আর জাহাজকেন্দ্রিক প্রেক্ষাপটে সর্বোত্তম কার্যকরভাবে একাধিক বন্দরে কাজ সম্পাদনের চাপ থাকে জাহাজগুলোর ওপর। কনটেইনার শিপিং কোম্পানিগুলো সাধারণত পোর্ট রোটেশন স্কিমের অধীনে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। আর এক্ষেত্রে একাধিক বন্দরে যেতে হয় জাহাজগুলোকে। একটি জাহাজ কেবল একটি বন্দরেই যাবে, শিপিং কোম্পানিগুলোর ব্যবসা এমন ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠেনি। বন্দরকেন্দ্রিক বা জাহাজকেন্দ্রিক যে প্রেক্ষাপটেই হোক না কেন, পোর্ট কল অপটিমাইজেশনের গুরুত্ব অস্বীকার করার সুযোগ নেই কোনোভাবেই।
পোর্ট কল কী?
কোনো নির্দিষ্ট যাত্রাপথে একটি জাহাজকে পণ্য খালাস-বোঝাই বা জ্বালানি গ্রহণের মতো কাজের জন্য বিভিন্ন বন্দরে যাত্রাবিরতি দিতে হয়। একেই বলা হয় পোর্ট কল। শিপিং মনিটরিং, রিপোর্টিং অ্যান্ড ভেরিফিকেশন (এমআরভি) রেগুলেশনে পোর্ট কলকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে- কোনো একটি বন্দরে কার্গো জাহাজগুলোর পণ্য লোডিং অথবা আনলোডিং এবং প্যাসেঞ্জার ক্রুজশিপের যাত্রী তোলা অথবা নামানোর জন্য যাত্রাবিরতি দেওয়াটাই হলো পোর্ট কল। এটি একটি টেকনিক্যাল টার্ম যা সব অফিশিয়াল শিপিং ডকুমেন্টে ব্যবহার করা হয়।
পোর্ট কল অপটিমাইজেশন
আধুনিক মেরিটাইম ট্রান্সপোর্টে পোর্ট কল অবিচ্ছেদ্য একটি অংশে পরিণত হয়েছে। জাহাজগুলোকে যাত্রাপথে প্রয়োজনের খাতিরেই বিভিন্ন বন্দরে যাত্রাবিরতি দিতে হয়, কখনো শিডিউলের মধ্যে থেকে, আবার কখনো পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে। আবার বন্দরগুলোকেও একই সময়ে একাধিক জাহাজকে সেবা দিতে হয়। ফলে অনেক সময় দেখা যায়, ব্যস্ত বন্দরগুলোয় জাহাজের অপেক্ষমাণ থাকার সময়টা দীর্ঘতর হচ্ছে। এই সমস্যা নিরসনে দারুণ এক সমাধান হলো পোর্ট কল অপটিমাইজেশন। এটি শিপিং কোম্পানি, টার্মিনাল ও অন্য সেবাদানকারীদের পরিবেশগত বিরূপ প্রভাব কমানো এবং সুরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা উন্নতকরণের সুযোগ করে দেয়।
পোর্ট কল অপটিমাইজেশন নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে শিপিং কোম্পানি, তাদের এজেন্ট ও বন্দর কর্তৃপক্ষগুলো আসলে এমন একটি সমাধান খুঁজে পেতে চাইছে, যা থেকে সব ধরনের বাণিজ্য, প্রতিটি বন্দর ও অংশীজন সুফল পাবে।
প্রতিটি বন্দরেরই নিজস্ব কিছু কর্মপদ্ধতি ও নিয়মাচার রয়েছে। শিপিং কোম্পানিগুলোকে এসব মেনেই কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। একটি শিপিং কোম্পানির প্রতিটি যাত্রার পরিকল্পনা হতে হয় স্বতন্ত্র। কারণ একটি বন্দরের সঙ্গে আরেকটির প্রতিযোগিতা থাকতে পারে। তাই প্রতিটি বন্দরকেন্দ্রিক প্রকল্পগুলো হয় স্বকীয়।
পোর্ট কল অপটিমাইজেশনের উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটি কয়েকটি পর্যায়ে বিভক্ত। এগুলো হলো-
১. জাহাজমালিকদের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সংগঠন বাল্টিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম কাউন্সিল (বিমকো) চুক্তি ও ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের (আইএমও) রেজল্যুশনের ভিত্তিতে পোর্ট কলের চলমান বৈশ্বিক চর্চার সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করা;
২. এই চর্চার জন্য ন্যূনতম তথ্য সরবরাহের সুযোগের বিষয়ে একমত হওয়া;
৩. তথ্য বিনিময়-সংক্রান্ত বিদ্যমান বৈশ্বিক কার্যকর সংজ্ঞার বিষয়ে সহমত পোষণ করা;
৪. তথ্যের মালিককে পোর্ট কল ইনফরমেশন বিনিময়ের সুযোগ দেওয়া;
৫. বিদ্যমান বৈশ্বিক তথ্যের সংজ্ঞা, ফরম্যাট ও প্ল্যাটফর্মের বিষয়ে একমত হওয়া;
৬. তথ্যের মালিকের কাছে থাকা তথ্য গ্লোবাল সার্ভিসের সঙ্গে বিনিময় করা;
৭. তথ্যের গুণগত মানের নিশ্চয়তার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো;
৮. তথ্য বিনিময়ের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করা;
৯. আইএমও ও আইএইচওর কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত হওয়া।
ইন্টারন্যাশনাল টাস্কফোর্স পোর্ট কল অপটিমাইজেশন
পোর্ট কল অপটিমাইজেশন প্রক্রিয়াকে বেগবান করতে শিপিং খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অংশীজনকে নিয়ে যাত্রা হয় ইন্টারন্যাশনাল টাস্কফোর্স পোর্ট কল অপটিমাইজেশনের। মূলত পোর্ট কল ডাটা কোয়ালিটি উন্নত করা এবং ইন্টারন্যাশনাল হারবার মাস্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা (আইএইচএমএ) যেন এই তথ্য খুব সহজেই পেতে পারে, সেই তাগাদা থেকেই মূলত এই টাস্কফোর্সের যাত্রা।
মনে রাখতে হবে, ইন্টারন্যাশনাল টাস্কফোর্স পোর্ট কল অপটিমাইজেশন হলো একটি নিরপেক্ষ সংস্থা। এর কাজ পরামর্শ দেওয়া। বিভিন্ন সলিউশন প্রোভাইডারকে প্রমোট করা এর কাজ নয়।
পোর্ট ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস (পিএমআইএস)
সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন শিল্পের সুরক্ষা ও কার্যকারিতা অনেকখানি নির্ভর করে তথ্য বিনিময়ের ওপর। স্যাটেলাইট ও ইলেকট্রনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্রুত অগ্রগতির সুবাদে পোর্ট কমিউনিটি সিস্টেম আজ অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। সমুদ্রবন্দর কমিউনিটির অংশীজন বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে উন্নত ইলেকট্রনিক সংযোগ গড়ে উঠেছে। এসব অংশীজনের মধ্যে রয়েছে কাস্টমস, বন্দর কর্তৃপক্ষ, কোস্ট গার্ড ও অন্যান্য সংস্থা।
এই সিস্টেমে হারবার মাস্টার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শিপ ও শোর বেজড কার্যক্রমে একজন হারবার মাস্টার ক্রমেই তথ্য ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে অবতীর্ণ হচ্ছেন। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে এখন জাহাজের কর্মকর্তারা সহজেই পোর্ট ও টার্মিনালের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে পারেন এবং ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে রিপোর্টিং করতে পারেন। এমনকি সমুদ্রে থাকা অবস্থাতেই বন্দরে প্রবেশের বিষয়ে পরিকল্পনা সাজানোর সুযোগ পাচ্ছেন তারা।
পোর্ট কল অপটিমাইজেশনের জাহাজ ও বন্দরকেন্দ্রিক প্রেক্ষাপট
নটিক্যাল পোর্ট ইনফরমেশন
একটি বন্দরের কর্মদক্ষতা অনেকখানি নির্ভর করে নির্ভরযোগ্য তথ্যের ওপর। ২০০৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল হারবার মাস্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (আইএইচএমএ) পঞ্চম কংগ্রেসের একটি কর্মশালা শেষে হারবার মাস্টারদের নির্ভরযোগ্য পোর্ট এন্ট্রি ইনফরমেশন সংগ্রহে সহায়তা করা ও একটি মানসম্পন্ন কাঠামো সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সামনে হাজির করার লক্ষ্যে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০০৮ সালের জুলাই থেকে এই কাঠামো আইএইচএমএ’র ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হচ্ছে। মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট খাত-সংশ্লিষ্টরা এই উদ্যোগকে স্বাগতও জানিয়েছে উৎসাহের সঙ্গে। তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিপিং কোম্পানি ও বন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মিলে একটি টাস্কফোর্স গ্রহণ করেছে এবং পোর্ট কল অপটিমাইজেশনের মাধ্যমে মাস্টার ও ইভেন্ট ডাটার সহজলভ্যতা ও গুণগত মান উন্নত করার বিষয়ে কাজ করছে। এই উদ্যোগের ফলে বন্দর, শিপিং লাইন, সেবাদাতা ও টার্মিনালগুলো যেসব সুবিধা পাচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- খরচ কমে যাওয়া, আরও বেশি পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধি ও অধিক সুরক্ষা।
সমুদ্রের গভীরতা, অ্যাডমিশন পলিসি ইত্যাদি তথ্যের প্রবাহ মাস্টার ডাটার সহজলভ্যতা ও গুণগত মান বৃদ্ধি করে। এসব তথ্য ভেসেল/বার্থ কম্প্যাটিবিলিটি নিশ্চিত করে এবং কখন বন্দরে প্রবেশ ও ত্যাগ করা নিরাপদ, সেই বিষয়ে সম্যক ধারণা অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
এদিকে বার্থে পৌঁছানোর পরিকল্পিত সময়, কার্গো অপারেশন সম্পন্নের আনুমানিক সময় ইত্যাদি ইভেন্ট ডাটার সহজলভ্যতা ও গুণগত মান বৃদ্ধি করে। প্রকৃত সময়োপযোগী তথ্য পাইলটদের বোর্ডিংয়ের বিষয়ে পরিকল্পনা, সব ধরনের পোর্ট সার্ভিসের প্রি-প্ল্যানিং ও পরবর্তী বন্দরের বিষয়ে পরিকল্পনা সাজাতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। মাস্টার ও ইভেন্ট ডাটা দুটোই বিদ্যমান নটিক্যাল এবং সাপ্লাই চেইন স্ট্যান্ডার্ড ও ফরম্যাট অনুযায়ী প্রস্তুত করা হয়।
টেকসই খাতের জন্য পোর্ট কল অপটিমাইজেশন
বর্তমানে বিশ্বের অনেক বন্দরেই জাহাজগুলোকে আগে আসলে আগে সেবা ভিত্তিতে সেবা দেওয়া হয়। কিন্তু এই পদ্ধতিতে বন্দরের সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণ কমানোর উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই সমস্যা দূর করার জন্য পোর্ট কল অপটিমাইজেশনের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
আসলে জাস্ট-ইন-টাইম শিপিংয়ের পথে যেসব সমস্যা তৈরি হয়েছে, সেগুলো দূর করার জন্য একটি জাহাজের বন্দরে প্রবেশের পরিকল্পনা ও সেই বন্দরের সেবাপ্রদানের সক্ষমতার মধ্যে সামঞ্জস্য আনা এখন সময়ের দাবি। আইএমওর এজেন্ডাতেও বিষয়টিকে অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা হয়েছে। এছাড়া বিশ্বজুড়ে বন্দরগুলো ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রেও অন্যতম একটি জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি।
বিশে^র সব বন্দরে জাস্ট-ইন-টাইম শিপিং চালু করাকে অন্যতম কঠিন একটি উদ্যোগ মনে করা হয়। তবে শিপিং খাতকে টেকসই করতে ও এই খাতের জনপ্রিয়তা বাড়াতে এর বিকল্প কিছু নেই। পণ্য পরিবহনে ক্যাপিটাল প্রডাক্টিভিটির সঙ্গে এনার্জি এফিশিয়েন্সির প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে। আর এই এনার্জি এফিশিয়েন্সির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো পোর্ট কল অপটিমাইজেশন। ডিজিটাল কনটেইনার শিপিং অ্যাসোসিয়েনের (ডিসিএসএ) মতো সংস্থাগুলো তাই পোর্ট ভিজিটের প্রমিত চর্চা হিসেবে এবং জাহাজের টার্ন-অ্যারাউন্ড সময় সর্বনিম্নে রাখার জন্য পোর্ট কল অপটিমাইজেশনকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
একটি বন্দরের কার্যক্রম সম্পন্ন করতে কোনো জাহাজের বিলম্ব হওয়ার অর্থ হলো পরবর্তী বন্দরগুলোয় দেরি হওয়া। আগের বন্দরে বিলম্বের কারণে একটি জাহাজকে পরবর্তীতে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হতে পারে। যেমন-
পরবর্তী বন্দরে প্রকৃত টাইম স্লট অনুযায়ী পৌঁছানোর জন্য জাহাজটিকে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত চালাতে হবে এবং আরও বেশি জ্বালানি পোড়াতে হবে। এর ফলে রিটার্ন অন ক্যাপিটাল প্রডাক্টিভিটি ও এনার্জি এফিশিয়েন্সি কমে যাবে।
রোটেশন শিডিউলে থাকা যেকোনো একটি বন্দরে অবস্থানের সময় কমাতে হবে অথবা এড়িয়ে যেতে হবে। এর ফলে ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসে গ্রাহকদের ভরসা হারাতে হতে পারে।
পরবর্তী বন্দরে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষমাণ থাকতে হতে পারে। এই অলস সময়ে জাহাজের সম্পদের অপটিমাইজেশন কমে যেতে পারে।
ডাটা শেয়ারিংয়ে দরকার আন্তর্জাতিক মানদ-
একেকটি শিপিং লাইনের জাহাজগুলো একাধিক বন্দরের একেকটি নেটওয়ার্কের অধীনে কার্যক্রম পরিচালনা করে। এসব বন্দরের প্রতিটির আবার রয়েছে কার্গো ও শিপ সার্ভিস প্রদানকারী পৃথক নেটওয়ার্ক। প্রায় প্রতিটি বন্দরই বিভিন্ন ধরনের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জাহাজকে সেবা দিয়ে থাকে। এসব জাহাজে যেসব কার্গো পরিবহন হয়, সেগুলোর মালিক হয় একাধিক। বিশেষ করে কনটেইনারবাহী জাহাজগুলোয় বিভিন্ন আমদানি-রপ্তানিকারকের পণ্য পরিবহন করা হয়। এসব কারণে পোর্ট কলের কার্যকর তথ্য ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক মানদ-। আর এই মানদ- তৈরির জন্য আবার দরকার বড়সড় বিনিয়োগ।
এই বিনিয়োগ হতে পারে দুই ধরনের- প্রযুক্তিগত ও মানবসম্পদ উন্নয়ন। বিভিন্ন ফরম্যাট ও স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার জন্য যে তথ্য ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন, তার জন্য চাই প্রযুক্তিগত উন্নয়ন। আর এর জন্য বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। অন্যদিকে বিভিন্ন বন্দরের চর্চাগত বিভিন্ন বিষয়ে পার্থক্য থাকতে পারে। ফলে পোর্ট কল অপটিমাইজেশনের আওতায় এসব বন্দরকে এক সুতোয় বাঁধতে গেলে সেখানে সাংস্কৃতিক কিছু পরিবর্তন আনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। তবে কেবল বিনিয়োগ করলেই তো আর চলবে না। সেখান থেকে কোনো রিটার্ন আসবে কিনা, সেই সম্ভাব্যতাও যাচাই করতে হবে। আর এক্ষেত্রে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও), বাল্টিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম কাউন্সিল (বিমকো) চুক্তি বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের বিধিবিধান যেন লঙ্ঘন না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
ইতিহাস বলে, শিপিং খাতে যেকোনো নতুন নীতি ও পদ্ধতি কার্যকর করাটা বেশ ধীরগতির একটি প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়। সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের সহমত পাওয়ার বিষয়ও রয়েছে।
আইএইচএমএ নয়টি পর্যায়ে পোর্ট কল অপটিমাইজেশন ডেভেলপমেন্ট পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছে। এর মাত্র প্রথম তিনটি এখন পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে। সুতরাং, একটি স্ট্যান্ডার্ড পোর্ট কল অপটিমাইজেশন প্রক্রিয়া অনুসরণের চর্চার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে তা বলেই দেওয়া যায়। তবে আইএমওর নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য পোর্ট কল অপটিমাইজেশনের কোনো বিকল্প নেই। ২০৫০ সাল নাগাদ শিপিং খাতে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ ২০০৮ সালের মাত্রার অর্ধেকে নামিয়ে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে আইএমও। পোর্ট কল অপটিমাইজেশনের কয়েকটি প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে অন্যতম হলো এই নিঃসরণ কমানো। সুতরাং আইএমওর লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য হলেও ব্যাপক পরিসরে পোর্ট কল অপটিমাইজেশনের চর্চা শুরু করা দরকার।
আশার কথা, আইএমও এই উদ্যোগের বিষয়ে একেবারে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে নেই। বরং সংস্থাটির গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রি অ্যালায়েন্স এরই মধ্যে পোর্ট কল অপটিমাইজেশনের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। এই চর্চা শুরু করলে কী ধরনের সুবিধা মিলবে, তার ডেমোনস্ট্রেশনও করেছে তারা। তবে এর সবকিছুই হয়েছে কাগজে-কলমে, ঐচ্ছিক সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতার ভিত্তিতে। এখন যত দ্রুত এর বাস্তবিক প্রয়োগ ঘটানো যাবে, শিপিং খাতের উন্নয়ন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রতিরোধ উদ্যোগে তা তত বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
পোর্ট কল অপটিমাইজেশন ও বন্দরকেন্দ্রিক প্রেক্ষাপট
একটি বন্দরে যে এক সময়ে একটিই জাহাজ সেবা নিতে আসবে, তা নয়। একই সময়ে একাধিক জাহাজকে সেবা দিতে হয় একটি বন্দরকে। এমনকি একই শিপিং কোম্পানির একাধিক জাহাজও একই সময়ে কোনো একটি নির্দিষ্ট বন্দরে আসতে পারে। এ অবস্থায় বন্দর কর্তৃপক্ষকে তাদের সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিয়ে চিন্তায় পড়তে হয়। গড়পড়তায় বন্দরগুলোকে বিভিন্ন ধরনের জাহাজকে সেবা দিতে হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কনটেইনার জাহাজ, ওয়েট ও ড্রাই বাল্ক, রেগুলার ও ক্রুজ-বেজড প্যাসেঞ্জার ট্রান্সপোর্ট ইত্যাদি। এসব জাহাজের ব্যবসার উদ্দেশ্যও ভিন্ন ভিন্ন। কনটেইনার জাহাজগুলোকে একই বন্দরে একাধিকবার ভ্রমণ করতে হয়। ক্রুজ জাহাজগুলো হয়তো আগে থেকেই ভ্রমণ পরিকল্পনা সাজানোর সময় পায়। রেগুলার প্যাসেঞ্জার ট্রাফিকের রুট নির্দিষ্ট থাকে বিধায় পরিকল্পনাও সেই অনুযায়ী সাজানো থাকে। আর বাল্ক শিপগুলোর চলাচল অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হয় বাজারদরের কারণে পণ্যের সরবরাহ ও চাহিদায় যে পরিবর্তন ঘটে, তার ওপর। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, একেক ধরনের জাহাজের সেবা গ্রহণের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা একেক রকমের। বন্দরগুলোর জন্য এই ভিন্নতা কিছুটা চ্যালেঞ্জের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বন্দরগুলোকে দুটি পরিপূরক পদক্ষেপ নিতে হয়। এগুলো হলো শেষ মুহূর্তে পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনার মতো নমনীয় অবস্থান গ্রহণ এবং পরিকল্পনার পরিসর যতটা সম্ভব বিস্তৃত করা। আর এ দুটি পদক্ষেপের সঙ্গে পোর্ট কল অপটিমাইজেশন অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত।
মেরিটাইম ট্রান্সপোর্টের ইকোসিস্টেম-জুড়ে রয়েছে তথ্য প্রবাহে প্রবেশাধিকার ও বর্ধিত পরিসরে ডিজিটাল কানেক্টিভিটি। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি যে বিশ্বের অনেক বন্দরই ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। এর ফলে তারা স্মার্ট কনটেইনারের তথ্য সংগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়। অথচ এই স্মার্ট কনটেইনার বন্দর ব্যবস্থাপনায় সময় সাশ্রয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে।
পোর্ট কল প্রক্রিয়ায় সমন্বয় মেকানিজমের প্রমিত সংজ্ঞাকে আরও বেশি মানসম্মত করতে এরই মধ্যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া সম্পৃক্ত পক্ষগুলোর মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার আধুনিকায়নেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে, বিশ্বের সব বন্দর কি অভিন্ন নীতি মেনে চলবে? সন্দেহ নেই যে, বন্দরের কার্যক্রমে একটি নির্দিষ্ট ধাঁচের বিষয়ে সর্বসম্মতি অর্জনের জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। বিশেষ করে বিষয়টি আরও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে সেসব বন্দরের জন্য, যেগুলোয় যথাযথ কোনো প্রতিক্রিয়াশীল পরিচালনা কাঠামো এখনো নেই। যেহেতু সব বন্দর একই নিয়মে পরিচালিত হয় না, সেহেতু কোনো একটি সমাধান সব বন্দরের জন্য কার্যকর না-ও হতে পারে। তবে পোর্ট কল অপটিমাইজেশনের কিছু সুবিধা সব বন্দরই ভোগ করতে পারে। কখন একটি জাহাজ বন্দরে পৌঁছাবে এবং কখন সেটি বন্দর ছেড়ে যেতে পারবে, সে বিষয়ে একটি আগাম ধারণা দিতে পারে এটি। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকার ও সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে একটি সমন্বয় গড়ে উঠতে হবে।
বন্দরের কর্মদক্ষতা বাড়ানোর জন্য একটি পরিপূরক অবস্থান গ্রহণ করতে হবে, যেখানে কোনো সুনির্দিষ্ট বন্দর পরিচালনা মডেল বিবেচনায় নেওয়া হবে না। বরং অংশীজনরা পরিস্থিতি অনুযায়ী ক্রমাগত তাদের পরিকল্পনা হালনাগাদ করবে।
জাহাজকেন্দ্রিক প্রেক্ষাপট
একটি বন্দরের বিশাল কর্মযজ্ঞের সঙ্গে বিভিন্ন অংশীজনের সংশ্লিষ্টতা থাকে। আর এসব অংশীজনের সবার সমন্বিত কার্যক্রমের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে বন্দর। এ কারণে বন্দর কর্তৃপক্ষের মূল লক্ষ্য থাকে নিজেদের সম্পদ ও অবকাঠামোর সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করে ভ্যালু যোগ করা। আর শিপিং লাইনগুলোর লক্ষ্য থাকে তাদের বহরে থাকা জাহাজগুলোর সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রাহকদের সেবা দেওয়া। সাধারণত শিপিং লাইনগুলো সম্ভাব্য সর্বোচ্চ গতিতে এক বন্দর থেকে অন্য বন্দরে ছুটে চলার চেষ্টা করে। এছাড়া যতটা দ্রুত সম্ভব বন্দর ত্যাগ করা যায় এবং অপেক্ষমাণ থাকার সময় যতটা কম রাখা যায়, সেই লক্ষ্যও থাকে তাদের। আর এ জন্য পোর্ট কলে সর্বোচ্চ অনুমেয়তা কাম্য থাকে তাদের। আর তাদের এই চাওয়া পূরণ করতে হলে ডিজিটালাইজেশন ও সমন্বিত তথ্য বিনিময় নিশ্চিত করতে হবে।
পরিকল্পনা হতে হবে সর্বাঙ্গিক
পোর্ট কল অপটিমাইজেশনের সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে হলে এর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন হতে হবে সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত। বর্তমানে যে বন্দরকেন্দ্রিক অ্যাপ্রোচ অনুসরণ করা হচ্ছে, তাতে পূর্ণ সুফল না-ও মিলতে পারে। এর সঙ্গে জাহাজকেন্দ্রিক পেক্ষাপটও বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ একেক ধরনের জাহাজের পোর্ট কলের চাহিদা একেক ধরনের হতে পারে। কনটেইনার শিপিং বৈশ্বিক মেরিটাইম ট্রান্সপোর্টের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ প্রতিনিধিত্ব করে। সুতরাং কেবল কনটেইনারবাহী জাহাজকে কেন্দ্র করে পরিকল্পনা সাজালে চলবে না। বরং বাণিজ্য ও সেবার অন্য খাতগুলোকেও বিবেচনায় নিতে হবে। এক কথায়, পোর্ট কল অপটিমাইজেশনে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে সব আঙ্গিকে চিন্তাভাবনা করে। এতে করে মেরিটাইম ট্রান্সপোর্টের অগ্রযাত্রা হবে টেকসই। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে তথ্যপ্রবাহের যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এক নাবিকের মৃত্যুর পর বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের জাহাজ এমভি বাংলার জয়যাত্রাকে হংকং বন্দরে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এক নাবিকের মৃত্যুর পর ২৬ জন নাবিকসহ হংকং বন্দরে বাংলাদেশের পতাকাবাহী একটি জাহাজকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের মালিকানাধীন এমভি বাংলার জয়যাত্রা জাহাজের নাবিক মোকাররম হোসেন ২১ জুন ঘুমন্ত অবস্থায় মারা যান। তাঁর নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করলে তা পজিটিভ আসে। এরপর জাহাজের অন্য সকল নাবিককে আইসোলেশনে পাঠানো হয়। এমভি জয়যাত্রা জাহাজটি চার্টার্ড জাহাজ হিসেবে বিভিন্ন দেশে পণ্য পরিবহন করে থাকে। জাহাজটি ১০ জুন চট্টগ্রাম ছেড়ে যায়। জাহাজটি ২০১৮ সালে বিএসসির বহরে যুক্ত হয়।