Home Blog Page 221

গালফ অব গিনি ডিক্লারেশনে যুক্ত ৯৯ স্টেকহোল্ডার

সাম্প্রতিক সময়ে গিনি উপসাগরে জলদস্যুতা বেড়ে যাওয়ায় মেরিটাইম খাতসংশ্লিষ্টদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এ কারণে তারা জোটবদ্ধভাবে এই সমস্যা মোকাবিলার উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের সমন্বিত প্রচেষ্টারই ফসল গালফ অব গিনি ডিক্লারেশন অন সাপ্রেশন অব পাইরেসি। এখন পর্যন্ত ৯৯টি মেরিটাইম কোম্পানি, সংস্থা ও ফ্ল্যাগ স্টেট এই ডিক্লারেশনে স্বাক্ষর করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক শিপিং সংগঠন বাল্টিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম কাউন্সিলও (বিমকো) এতে যুক্ত হয়েছে।

২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে মোট ১৩৫ জন ক্রু জাহাজ থেকে অপহৃত হয়েছেন। এই অপহরণের ৯৫ শতাংশই ঘটেছে গিনি উপসাগরে। তাও আবার নির্দিষ্ট একটি অংশেই বারবার এসব ঘটনা ঘটছে। আন্তর্জাতিক জলসীমায় মোট সাগরের ২০ শতাংশেরও কম আয়তনের এলাকাজুড়ে অপতৎপরতা চালাচ্ছে জলদস্যুরা। কয়েক বছর আগেও এই অঞ্চলে সোমালি জলদস্যুদের আধিপত্য ছিল।

শুধু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেই হবে না, বন্দরে জীবনের ঝুঁকি কমাতে প্রয়োজন সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য টিকা নিশ্চিত করা

গত বছরের করোনার প্রথম ঢেউ সামলে আমরা যখন আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছি, আমাদের অর্থনীতি যখন পুরোদমে গতিশীল হওয়ার পথে তখনই চোখ রাঙাচ্ছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। প্রথম ঢেউয়ের সময় লকডাউনে যখন সারা দেশ স্থবির হয়ে পড়েছিল, তখনও সচল ছিল চট্টগ্রাম বন্দর। এবারও তার ব্যতিক্রম হওয়ার উপায় নেই। কারণ চট্টগ্রাম বন্দর হয়েই দেশের আমদানি-রপ্তানির প্রায় পুরোটা পরিচালিত হয়। কিন্তু যে হারে চট্টগ্রামে করোনার তীব্র সংক্রামক ডেলটা ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে, এখন থেকেই সর্তক না হলে দ্রুতই তা বন্দর পরিচালনায় সংকট তৈরি করবে বলে ধারণা করা যায়। আমরা যেমন এক মুহূর্তের জন্যও বন্দর বন্ধ থাকুক তা চাই না, তেমনি বন্দরে কর্মরত কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়ে জীবনের ঝুঁকিতে পড়–ক সেটাও কাম্য নয়। ইতিমধ্যেই আমরা বেশ কয়েকজন সহকর্মীকে হারিয়েছি। এটা শুধু তাদের পরিবারই নয়, আমাদের জন্যও ছিল অপূরণীয় ক্ষতি। আমরা চাই না আর কোনো অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু। তাই শুধু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেই হবে না, জীবনের ঝুঁকি কমাতে শিগগিরই বন্দরের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য টিকা নিশ্চিত করতে হবে।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকা-ের সাথে সাথে বাড়ছে দেশের সমুদ্রনির্ভর বাণিজ্যের কলেবর। তাই ব্যস্ততা বেড়েছে আমাদের দুই প্রধান সমুদ্র বন্দরেরও। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে বছরে প্রায় ৪ হাজার জাহাজ ভিড়ে এবং মোংলা বন্দরে ২০২০-২০২১ অর্থবছরের একমাস বাকি থাকতেই বন্দরটির ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৯১৩টি বাণিজ্যিক জাহাজ ভিড়েছে। দেশের সমুদ্র অঞ্চল ঘিরে এই যে বিপুল কর্মযজ্ঞ তা সম্পন্ন করতে কাজ করছে অনেকগুলো পক্ষ। একদিকে যেমন রয়েছে বন্দর এবং তার অংশীজনরা, অন্যদিকে রয়েছে জাহাজ মালিক, চার্টারার, নাবিক, আমদানি-রপ্তানিকারক, ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, শিপিং এজেন্ট ইত্যাদি। স্বাভাবিকভাবেই নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় এসব পক্ষের মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে বিরোধ বা দাবি উঠতে পারে। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে সমুদ্র অঞ্চলের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত ও নির্বিঘন্নে করার বিকল্প নেই। তাই এসব বিরোধ দ্রুত নিষ্পন্ন করার জন্য রয়েছে বিশেষায়িত বিচারব্যবস্থা এবং তা পরিচালনায় প্রণীত হয়েছে ‘অ্যাডমিরালটি কোর্ট অ্যাক্ট, ২০০০’। বাংলাদেশের অ্যাডমিরালটি আদালত নিয়ে আমাদের এবারের মূল আয়োজন।

এই সময়ে পৃথিবীজুড়েই একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় পরিবেশ দূষণ। বায়ুম-লে ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ বছর বছর লাফিয়ে বাড়ছে, দিন দিন খারাপ হচ্ছে জলবায়ু পরিস্থিতি। এর পিছনে অন্যতম প্রধান কারণ শিল্প-কারখানা ও যানবাহন থেকে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ। তাই কার্বন নিঃরসরণ কমিয়ে আনতে সচেষ্ট হয়েছেন বিশ্ব নেতারা। এক্ষেত্রে সমাধান রয়েছে তিনটিÑ বিদ্যুৎচালিত যন্ত্র ও যানবাহন ব্যবহার, জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে জৈবজ্বালানির ব্যবহার এবং কার্বন ক্যাপচার অ্যান্ড স্টোরেজ (সিসিএস) পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটানো। সম্ভাবনাময় হিসেবে বিশ^জুড়ে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সিসিএস প্রযুক্তি। খুব প্রচলিত না হলেও যুগান্তকারী এ প্রযুক্তির প্রসারে বিশ্ব ব্যাপী বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায় আগামী দিনে এটি হয়ে উঠতে পারে অন্যতম হাতিয়ার। সিসিএস নিয়ে রয়েছে বিশেষ রচনা।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে আর্কটিকেও। গত বছরের জুনে এর তামপাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে। এটি ছিল ইতিহাসের সর্বোচ্চ। এর জন্য প্রধানত দায়ী করা হয় ব্ল্যাক কার্বনকে। গত ২২-২৬ মার্চ অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের (আইএমও) সাব-কমিটি অন পলিউশন প্রিভেনশন অ্যান্ড রেসপন্স (পিপিআর)-এর অষ্টম সেশনে ব্ল্যাক কার্বন নিঃসরণ কীভাবে বন্ধ করা যায়, সে বিষয়ে বিশেষ আলোকপাত করা হয়েছে। বিশেষ রচনায় এ বিষয়ে থাকছে বিস্তারিত।

প্রিয় পাঠক, আমরা চাই এদেশের মেরিটাইম চর্চাকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড় করাতে। বৈচিত্র্যময় আঙ্গিকে, সমৃদ্ধ কলেবরে বন্দরবার্তার পথচলা বাংলাদেশের মেরিটাইম খাতের বিকাশে আরও সহায়ক হবে- সেই প্রত্যাশা।

ছবিতে সংবাদ – জুন

২৪ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় পূর্বপ্রস্তুতিমূলক সভায় সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান। এসময় পর্ষদ সদস্যবৃন্দ, পরিচালকগণ ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

৯ মে চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সের প্রশিক্ষণার্থীদের মাঝে প্রধান অতিথি হিসেবে সনদ বিতরণ করেন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান। সনদ বিতরণ শেষে অতিথিদের সাথে প্রশিক্ষণার্থীদের ফটোসেশন।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ৩১ মে বন্দরের ডক অফিস পরিদর্শন করেন। এ সময় নৌ, নৌপ্রকৌশল ও প্রকৌশল বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ২৪ মে বন্দরের মেরিন ওয়ার্কশপ পরিদর্শন করেন। এ সময় প্রকৌশল বিভাগ ও নৌ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

কক্সবাজার-২ আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক ২৫ মে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।

আহমাদ ইবনে মজিদ

মধ্যযুগে ওমান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত, বর্তমান আরব আমিরাতের রাস আল খাইমাহ এলাকায় ১৪৩২ সালে জন্ম নেওয়া বিখ্যাত এই আরব নেভিগেটর ও কার্টোগ্রাফারকে অসীম সাহসের জন্য ‘দ্য লায়ন অব দ্য সি’ নামেও ডাকা হয়। নাবিক পরিবারে জন্ম নেওয়ার ফলে ১৭ বছর বয়সেই জাহাজ পরিচালনায় বেশ দক্ষ হয়ে ওঠেন তিনি।

মধ্যযুগে নৌ-অভিযান বিদ্যার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল তাঁর লেখা ‘কিতাব আল ফাওয়াইদ ফি উসুল ইলম আল-বাহর ওয়া আল কাওয়াইদ’ (দ্য বুক অব দ্য বেনেফিটস অব দ্য প্রিন্সিপালস অ্যান্ড ফাউন্ডেশনস অব সিম্যানশিপ)। গাইডবুক হিসেবে এ বই হাতে দীর্ঘ অভিযানে বেরিয়ে পড়ে পর্তুগিজ, স্প্যানিশ, তুর্কি, ফরাসি, ইংরেজ বেনিয়ারা। দখল করতে থাকে নব আবিষ্কৃত ভূখ-, গড়ে ওঠে উপনিবেশ। মূলত এনসাইক্লোপিডিয়া আকারে লিখিত এ বইয়ে নেভিগেশনের ইতিহাস, প্রাথমিক ধারণা, সেলেস্টিয়াল নেভিগেশনভিত্তিক ল্যাটিচিউড-লঙ্গিচিউড নির্ণয়ের আধুনিক পদ্ধতি, লুনার ম্যানসন, লোক্সোড্রোম, কোস্টাল এবং ওপেন সি ফেয়ারিংয়ের পার্থক্য, পূর্ব আফ্রিকা থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত প্রতিটি বন্দরের অবস্থানসহ ম্যাপ, মৌসুমি এবং ঋতুভিত্তিক বায়ু, ঘূর্ণিঝড়ের মৌসুম ও ঝড়ের পূর্বাভাস প্রাপ্তিসহ একজন পেশাদার মেরিনারের জন্য, বিশেষ করে ভারত মহাসাগরে নৌপরিচালনার অতি প্রয়োজনীয় সকল বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

নৌ-অভিযানের মৌলিক বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন বলে তাকে মুয়াল্লিম বা শিক্ষক (টিচার অব নেভিগেশন) হিসেবেও অভিহিত করেন আধুনিক নৌ-ইতিহাসবিদরা। সেকালে প্রচলিত পদ্ধতি, সূর্যের সাহায্যে দিক খোঁজার বদলে তাঁর সকল নেভিগেশনাল ক্যালকুলেশনের ভিত্তি ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান। তাঁর নিজ হাতে লেখা বইয়ের পা-ুলিপি সংরক্ষিত আছে ফ্রান্সের জাতীয় জাদুঘরে। আনুমানিক ১৫০০ সালে বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

শিয়ামেন বন্দর

দক্ষিণ ফুজিয়ান প্রদেশের জিউলংজিয়াং নদীমোহনায় ডংডু হারবারে রয়েছে চীনের মূল ভূখ-ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গভীর সমুদ্রবন্দর শিয়ামেন। অতিদ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ চীনের অষ্টম বৃহত্তম এই বন্দর চীন, হংকং, তাইওয়ান এবং এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ট্রাংক লাইন পোর্ট হিসেবে কাজ করে। চীনের চতুর্থ বন্দর হিসেবে এটি ষষ্ঠ প্রজন্মের কনটেইনার জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ে সক্ষম। ২০১৯ সালে মোট ১১ দশমিক ১২ মিলিয়ন টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডল করেছে এ বন্দর। বিশ্বের শীর্ষ ২০ শিপিং কোম্পানির সব কয়টি তাঁদের কার্যক্রম এবং অফিস রেখেছে এখানে। ৬৮টি শিপিং রুটের মাধ্যমে ৫০টির বেশি দেশের সাথে সরাসরি সংযুক্ত শিয়ামেনে মাসিক গড়ে ৪৭০টি জাহাজ ডকিং হয়।

শিয়ামেন মিউনিসিপ্যাল গভর্নমেন্টের অধীনে পরিচালিত হয় শিয়ামেন বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দরসংলগ্ন হারবার এলাকার দৈর্ঘ্য ৩০ কিলোমিটার, জেটি এলাকায় পানির গভীরতা গড়ে ১৭ মিটার। বিশাল উপকূলজুড়ে রয়েছে ১২২টি বার্থ, যার ৩৭টিই ডিপ-ওয়াটার। একটি রাখা হয়েছে কেবল লাখ টনের বেশি ধারণক্ষমতার জাহাজের জন্য, ১০ হাজার টনের উপরের জাহাজের জন্য ২৩টি এবং ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টনবিশিষ্ট জাহাজের জন্য আছে আলাদা বার্থ। কনটেইনার টার্মিনাল আছে নয়টি। খোলা সাগর এবং জেটি এলাকার মধ্যে লম্বাটে আকৃতির কিনম্যান আইল্যান্ডের মতো প্রাকৃতিক আড়াল থাকায় জলোচ্ছ্বাস, তীব্র বাতাস থেকে অনেকটাই সুরক্ষিত থাকে বন্দর। অ্যাপ্রোচ চ্যানেলের দৈর্ঘ্য ৪২ কিলোমিটার, গভীরতা ১৪ মিটার।

জিন সাম্রাজ্যের শাসনামলে আনুমানিক ২৮২ খ্রিস্টাব্দের দিকে যাত্রা শুরু করে এখনো কার্যকর থাকায় পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন বন্দর শিয়ামেন। আশির দশক থেকে বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য বিপুল সুযোগ-সুবিধা দেওয়া শুরু করে এ বন্দর। রপ্তানিমুখী বন্দর হিসেবে প্রচুর কর্মসংস্থান ও শিল্প-কারখানার মূল ঘাঁটি শিয়ামেন বন্দরকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয় ২০০৬ সালে। হাইচান, সংইউ, লিউ এবং ঝ্যাংঝু এলাকায় ছড়িয়ে থাকা বেশকিছু স্থাপনাকে একত্র করে গঠিত হয় নতুন শিয়ামেন বন্দর। এর মধ্যে ডংডু পোর্ট ডিস্ট্রিক্টে রয়েছে বন্দরের মূল স্থাপনা। কনটেইনার, জেনারেল কার্গো মূলত এখানেই হ্যান্ডল করা হয়। কনটেইনার ও কার্গোর লার্জ-স্কেল ট্রান্সশিপমেন্ট হয় দায়ু ডিস্ট্রিক্টে, পোর্ট লজিস্টিকস সাপ্লাই এবং ভারী শিল্পের জন্য নির্ধারিত অঞ্চল হলো লিউদিয়ান। কনটেইনার এবং বাল্ক কার্গো হ্যান্ডলিং, ট্রানজিট এবং ওয়্যারহাউস সুবিধা দিচ্ছে হাইচাং ডিস্ট্রিক্ট। হেপিং ডিস্ট্রিক্ট মূলত প্যাসেঞ্জার ট্রাফিক জোন। ক্রুজ শিপের জন্য ইন্টারন্যাশনাল ট্যুরিস্ট ফেরি টার্মিনাল, জিনমেন আইল্যান্ড অভিমুখী ফেরি টার্মিনাল এবং উটং সি অ্যান্ড এয়ার ট্রান্সপোর্ট টার্মিনাল রয়েছে এখানে। ঝাওইন ডিস্ট্রিক্টে কনটেইনার, ড্রাই বাল্কের পাশাপাশি সকল রোল-অন/রোল-অব কার্গো লোড-আনলোড করা হয়। রেল-ওয়াটার ট্রান্সপোর্টের জন্য গাওগি ডিস্ট্রিক্ট, শিল্প-কারখানার জন্য জিংলিন, রাসায়নিকের জন্য হাউশি, অফশোরের জন্য হাইচাং, পেট্রোলিয়ামের জন্য সংইউ, নির্মাণসামগ্রীর জন্য পাইতৌ ডিস্ট্রিক্ট নির্ধারিত রয়েছে। এভাবে বিশেষায়িত অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন সেবা দেওয়ার ফলে লয়েডস লিস্ট প্রকাশিত সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী বিশে^র ১৪তম ব্যস্ত এ বন্দরে জাহাজজট একেবারে শূন্য।

বর্তমান যুগের সবচেয়ে বড় আকারের জাহাজগুলোকে দ্রুততম সময়ে সেবা দেওয়ার জন্য এখানে রয়েছে ৬০ এবং ৯০ টন বার্জ ক্রেন, ৫০ টন কার ক্রেন, ৪০ টন কনটেইনার ব্রিজ ক্রেন, ৪০ টন কনটেইনার ফর্ক ট্রাক, ৩৫ টন কনটেইনার স্ট্রাডেল ক্যারিয়ার, ৩০.৫ টন ক্রেন শিপ। বাল্ক শস্য এবং সার ওঠানামা করানোর সুবিধার্থে আছে স্বয়ংক্রিয় ব্যাগিং ইকুইপমেন্ট। কয়লার চালানের জন্য আছে অ্যাডভান্সড স্টিভেডোরিং সিস্টেম। ১০৬ একরের ওপেন ইয়ার্ড এবং ১০ একরের বেশি ওয়্যারহাউস সুবিধাসংবলিত শিয়ামেন বাল্ক অ্যান্ড ব্রেকবাল্ক টার্মিনালে মূল আমদানি পণ্য হলো গম, সিমেন্ট, সার, কয়লা, রোলড স্টিল, চিনি, আকরিক লোহা ও গ্রানাইট। রপ্তানি পণ্য হিসেবে বাইরে যায় মূলত চা, লবণ ও গ্রাফাইট পাউডার।

কার্বন ক্যাপচার অ্যান্ড স্টোরেজ ডিকার্বনাইজেশনের ভবিষ্যৎ

কার্বন নিঃসরণ কমানোর দাবি দিন দিন জোরালো হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিকল্প রয়েছে তিনটি- বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্র ও যানবাহন ব্যবহার, জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে জৈবজ্বালানির ব্যবহার, অথবা কার্বন ক্যাপচার অ্যান্ড স্টোরেজ (সিসিএস) পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটানো। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সিসিএস নিয়ে গবেষণায় গতি এসেছে।

অস্তিত্বের সংকটে আছে পৃথিবী, এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। বছর বছর লাফিয়ে বাড়ছে বায়ুম-লে ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ, দিন দিন খারাপ হচ্ছে জলবায়ু পরিস্থিতি। টিকে থাকার তাড়নায় আসছে নতুন সমাধান, নয়া প্রযুক্তি। সকল উদ্ভাবনের মধ্যে আজ পর্যন্ত সবচেয়ে সম্ভাবনাময় হিসেবে বিশ্বজুড়ে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কার্বন ক্যাপচার অ্যান্ড স্টোরেজ বা সিসিএস প্রযুক্তি। খুব প্রচলিত না হলেও যুগান্তকারী এ প্রযুক্তির প্রসারে বিশ্বব্যাপী বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। ব্যাপক ব্যবহার শুরু করা গেলে ধরিত্রী রক্ষায় আগামী দিনে এটি হয়ে উঠতে পারে সর্বোত্তম হাতিয়ার।

কী এই কার্বন ক্যাপচার অ্যান্ড স্টোরেজ

বেশ জটিল কৌশলবিশিষ্ট সিসিএসের পেছনের যুক্তিটা কিন্তু সহজ। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বন্ধে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, যা বাস্তবায়িত হতে গিয়ে অপচয় হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান সময়। অথচ ততদিনে বিপৎসীমার অনেক ওপরে চলে যাচ্ছি আমরা। পরিবেশে নতুন কার্বন যোগ হওয়া বন্ধের পাশাপাশি তাই পুরোনো কার্বন সরিয়ে যথাযথ উপায়ে সংরক্ষণ করাও সমান জরুরি।

কার্বন ক্যাপচার মূলত এমন একটি প্রযুক্তি, যেখানে জ্বালানি পোড়ানোর পর নিঃসৃত গ্যাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড ছেঁকে আলাদা করে নিয়ে কয়লা সিম, অ্যাকুইফার, ক্ষয়ে যাওয়া কিংবা খালি তেল বা গ্যাস রিজারভয়ার অথবা বৃহৎ কোনো সংরক্ষণ পাত্রে নিয়ে সমুদ্রতলদেশে বা ভূপৃষ্ঠের গভীরে পুঁতে ফেলা হয়। সংরক্ষণের জন্য কার্বন ডাই-অক্সাইড যেমন কোনো শিল্পকারখানার নিঃসরণ থেকে সংগ্রহ করা যেতে পারে, তেমনই মুক্ত বায়ুম-ল থেকেও ধরা যাচ্ছে কার্বন। জীবাশ্ম জ্বালানি দহনের ফলে উৎপন্ন এবং ইতিমধ্যেই বায়ু-লে বিরাজমান ৯০ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড এ প্রযুক্তির মাধ্যমে কমিয়ে ফেলা সম্ভব।

সিসিএসের তিনটি পর্যায় রয়েছে-

১. কার্বন ডাই-অক্সাইড সংগ্রহ

২. সংগৃহীত কার্বন ডাই-অক্সাইড উপযুক্ত স্থানে পরিবহন

৩. পরিত্যক্ত তেল বা গ্যাস খনি অথবা গভীর সমুদ্রে ডিপ স্যালাইন অ্যাকুইফার নির্মাণ করে আহরিত কার্বন ডাই-অক্সাইডকে নিরাপদে সংরক্ষণ

কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বা শিল্পকারখানা থেকে নির্গত গ্যাস থেকে প্রথমে কার্বন ডাই-অক্সাইডকে আলাদা করে নেওয়া হয়। কারখানার পরিত্যক্ত গ্যাস নিঃসরণকারী টানেলে ক্যাপচারিং যন্ত্র বসানো হলে প্রায় ৮০ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইডকে বায়ু-লে অবমুক্ত করা থেকে আটকানো যায়। সংগৃহীত কার্বন ডাই-অক্সাইড পাইপলাইনের মাধ্যমে জাহাজ বা ট্রাকে করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। ফাঁদ পেতে কার্বন ধরা ছাড়াও শিল্প খাতে ব্যবহারের জন্য বছরে মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড রোড ট্যাংকার, জাহাজ এবং পাইপলাইনের সাহায্যে পরিবহন করা হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো চার দশক ধরেই নিরাপদে কার্বন ডাই-অক্সাইড পরিবহন করে আসছে। শিল্পকারখানায় ব্যবহারযোগ্য কার্বন ডাই-অক্সাইডের সাথে কার্বন ক্যাপচারিং অ্যান্ড স্টোরেজ প্রযুক্তিতে কার্বন পরিবহনের পার্থক্যটা হলো, সাপ্লাই চেইনের শেষ প্রান্তে কোনো কারখানা থাকে না। ভূপৃষ্ঠের কয়েক কিলোমিটার গভীরে শিলাস্তরের পানিপূর্ণ ফাঁকা জায়গা অর্থাৎ কোনো অ্যাকুইফারে জমা রাখা হয় জীবের মৌলিক একক বা ‘বিল্ডিং ব্লক’ হিসেবে পরিচিত পর্যায় সারণির ষষ্ঠ মৌলটিকে।  

কানাডার ক্যালগারি বিশ^বিদ্যালয়ের একদল গবেষক গ্রিনহাউস গ্যাসবন্দী ও মজুত করার আরও কার্যকর পদ্ধতি উদ্ভাবনের চেষ্টা করছেন। এ লক্ষ্যে তাঁদের ছয় বছরের একটি প্রকল্পে দেশটির প্রকৃতিবিজ্ঞান ও প্রকৌশল পরিষদ সম্প্রতি ১৬ লাখ ডলারের তহবিল দিয়েছে। কার্বন ক্যাপচার, ইউটিলাইজেশন অ্যান্ড স্টোরেজ অর্থাৎ সিসিইউএস নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশে^র ২৪টি দেশ একসঙ্গে কাজ করছে। যার মূল উদ্দেশ্য, পরিবেশ থেকে কার্বন কমিয়ে ক্লিন এনার্জি উদ্ভাবন। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতও এ উদ্যোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। 

শিপিংয়ে সিসিএসের ভূমিকা

গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের অন্যতম কারিগর হিসেবে বহুকাল ধরেই শিপিং খাতকে দায়ী করা হয়েছে। অতি প্রয়োজনীয় এই ইন্ডাস্ট্রি থেকে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে তাই কয়েক বছর ধরে জোরেশোরে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন শুরু করেছে শিপিংয়ের অভিভাবক সংস্থা আইএমও। ২০০৮ সালের তুলনায় কার্বন নিঃসরণ অন্তত ৫০ শতাংশ কমাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে এর সদস্য দেশগুলো। প্রচলিত পেট্রোকেমিক্যালের পরিবর্তে বিকল্প জ্বালানি, তুলনামূলক ধীরে জাহাজ চালনা করছে বেশির ভাগ জাহাজ মালিক সংস্থা। কিন্তু শিপিংকে ডিকার্বনাইজ করতে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে কার্বন স্টোরেজের পক্ষেই মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। সম্প্রতি জাপান শিপ টেকনোলজি রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন এবং নিপ্পন ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, জাহাজ থেকে কার্বন নিঃসরণ ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারে অনবোর্ড ক্যাপচার সিস্টেম। অবশ্য ফাঁদ পেতে ধরা সেই কার্বনের ওজন মোট ফুয়েলের চেয়ে প্রায় চার গুণ ভারী হবে বলে গন্তব্যে পৌঁছাতে হলে জাহাজে আরও বেশি প্রপালশন তথা জ্বালানি প্রয়োজন হবে।

অবশ্য এভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইডের হাত থেকে অনেকখানি মুক্ত হওয়া গেলেও অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিয়ে ঝুঁকি থেকে যায়। লোডিং এবং ব্যবহারের আগে রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফুয়েল থেকে সালফার এবং নাইট্রেট আলাদা করা হলে আইএমও নির্ধারিত ৫০ শতাংশ কম গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ অনেকখানি সহজ হয়ে যাবে। 

পরিবেশ এবং বায়ুম-মলে ইতিমধ্যেই জমে থাকা ক্ষতিকর এবং উষ্ণায়ন ঘটানো গ্যাস সংগ্রহ করে পৃথিবীকে ডিকার্বনাইজ করার যুগান্তকারী প্রযুক্তি নিয়ে বৈশ্বিক নৌপরিবহন শিল্পে বেশকিছু প্রকল্প চলমান আছে। এনওয়াইকে, সভকমফ্লোট, নুটসেন ওএএস, আর্ডমোর এবং ডেইউ শিপবিল্ডিং অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো বৃহৎ শিপিং কোম্পানি একত্রে গড়ে তুলেছে মেরিটাইম ডেভেলপমেন্ট সেন্টার। ‘ডিকার্বনআইস’ নামক

প্রকল্পের অধীনে অনবোর্ড কার্বন ক্যাপচার অ্যান্ড স্টোরেজ প্রযুক্তির উন্নয়নে কাজ করছে সংস্থাটি। ২০১৯ সালের অক্টোবরে যাত্রা করা প্রকল্পটির লক্ষ্য এর সম্ভাব্যতা যাচাই এবং আইএমওর অনুমোদনপ্রাপ্তির লক্ষ্যে পেপারওয়ার্ক প্রক্রিয়া শুরু করা। মূলত নবনির্মিত জাহাজে এ প্রযুক্তি বসানো নিয়ে কাজ করবে ডিকার্বনআইস। তবে বর্তমানে চলমান জাহাজসমূহে রেট্রোফিটিং পদ্ধতি অনুসরণ করে ক্যাপচার সিস্টেম ইনস্টল করা যায় কিনা, সেটিও যাচাই করবে এ প্রকল্প। 

মিৎসুবিশির নেতৃত্বে জাহাজে কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি নিয়ে কাজ শুরুর ঘোষণা দিয়েছে কে লাইন এবং ক্লাসএনকে। মেরিটাইম খাত থেকে ডিকার্বনাইজেশনে লক্ষণীয় পরিবর্তন আনতে শীঘ্রই এ প্রযুক্তির পরীক্ষামূলক ব্যবহার শুরু করতে যাচ্ছে জাপানি টেকনোলজি টাইকুন প্রতিষ্ঠানটি। কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ অন্তত ৯০ শতাংশ কমাতে সক্ষম মিৎসুবিশির এই প্রযুক্তি জাহাজের এগজস্ট পাইপ থেকে ধরে ফেলা কার্বন দিয়ে নতুন ফুয়েল উৎপাদনের কাঁচামালও তৈরি করতে সক্ষম হবে। মূলত অনশোর পাওয়ার প্ল্যান্টে কর্মক্ষম কার্বন ডাই-অক্সাইড ক্যাপচার সিস্টেমকে মেরিন পরিবেশে তথা অনবোর্ড জাহাজে ব্যবহার উপযোগী করে তুলছে মিৎসুবিশি। দুই বছরের গবেষণা, উন্নয়ন এবং পরীক্ষামূলক পরিচালন শেষে ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে কে লাইনের মালিকানাধীন জাহাজে টেস্ট ইউনিট স্থাপনের মাধ্যমে পুরো প্রযুক্তিটি সাধারণের মধ্যে ব্যবহারের উপযোগী হয়ে উঠবে, আশাবাদ মিৎসুবিশি কর্তৃপক্ষের।   

শিপিং ইন্ডাস্ট্রিতে কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কোম্পানিগুলোর জোট দ্য অয়েল অ্যান্ড গ্যাস ইনিশিয়েটিভের (ওজিসিআই) সাথে যুক্ত হয়েছে ট্যাংকার প্রতিষ্ঠান স্টেনা বাল্ক। স্টেনা বাল্কের ইনফ্রাস্ট্রাকচার, শিপিং রিসোর্স, নেভাল ইঞ্জিনিয়ারিং জ্ঞান ব্যবহার করে কার্বন ডাই-অক্সাইড মজুত ও হ্যান্ডল প্রকল্পে অর্থায়ন করবে ওজিসিআই। এর আগে স্টেনা বাল্কের সাথে একত্রে হেভি-ডিউটি ট্রাক ব্যবহার করে পৃথকভাবে অনবোর্ড কার্বন ক্যাপচারের সফল পরীক্ষা চালিয়েছিল সংস্থার প্রভাবশালী সদস্য প্রতিষ্ঠান আরামকো। 

সবচেয়ে কার্যকর ও যোগ্যতম কার্বন ক্যাপচার ইউনিট উদ্ভাবন ও ইনস্টলেশন প্রকল্পে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন স্পেসএক্স ও টেসলার মতো বিখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তিত্ব এলন মাস্ক। 

অন-বোর্ড কার্বন সংগ্রহের কার্যপ্রণালি

আছে মুদ্রার অপর পিঠও

কার্বন স্টোরেজ প্রযুক্তির সুবিধা অনেক। এমনকি অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, আকরিক জ্বালানি থেকে সৌর বা বায়ুবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে পরিবর্তনের চাইতে ব্যয়সাশ্রয়ী হবে এ প্রযুক্তি। কিন্তু যেমনটা মিৎসুবিশি হিসাব করেছে, প্রতিটি ভেরি লার্জ কনটেইনার ক্যারিয়ারে (ভিএলসিসি) কার্বন ক্যাপচার সিস্টেম বসাতে আপাতত খরচ পড়বে গড়ে ৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। জাহাজ নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যাওয়াটাই একমাত্র সমস্যা না। সংগৃহীত বিপুল পরিমাণ কার্বন এবং এর ওজন সামলানোটাও একটা চ্যালেঞ্জ। ভূমিতে যে পদ্ধতিতে কার্বন ট্রিটমেন্ট করা হচ্ছে, মোটামুটি সে সিস্টেমই অনবোর্ড জাহাজের জন্য ধরে রাখছে মিৎসুবিশির কার্বন ক্যাপচার প্রকল্প। যন্ত্রসহ সংগৃহীত কার্বনের ওজন হবে ৪ হাজার ৫০০ টনের বেশি বা ভেসেলের মোট ডেড ওয়েট টনের প্রায় ২ শতাংশ। একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, কার্বন ক্যাপচার সিস্টেম কিন্তু এখনো শতভাগ কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না। সবচেয়ে উন্নত সিস্টেমের ক্যাপচার রেট এখনো ৮৬ থেকে ৯০ শতাংশ। নিশ্চিতভাবেই আগামীতে এর কর্মক্ষমতা আরও বাড়বে। তবে শূন্য কার্বন নিঃসরণ আশা করে জাহাজে এটি ইনস্টল করলে এই মুহূর্তে আশাহত হতে হবে।

তলদেশে মজুত করা কার্বন ডাই-অক্সাইড কোনোভাবে লিক করে সমুদ্রে অবমুক্ত হয়ে গেলে ঠিক কী ঘটে, তা জানতে বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালাচ্ছেন ইতালির কাছে এয়োলিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্ট এই দ্বীপমালার নিচে বিশাল পরিমাণ প্রাকৃতিক কার্বন ডাই-অক্সাইড জমা রয়েছে। ফলে গবেষণার জন্য এই জায়গাটিকে আদর্শ বলা চলে। সমুদ্রবিজ্ঞানী সিনসিয়া দে ভিটর বলেন, ‘এখানকার জীবজগৎ দীর্ঘকাল ধরে এই পরিবেশের সঙ্গে

নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। এখানে কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রায়ই প্রাকৃতিক কারণে বেরিয়ে পড়ে। ফলে অন্যান্য এলাকার তুলনায় এখানে পিএইচ-এর মাত্রা কম।’

অফশোরে তেল ও জ্বালানির ভরপুর মজুত আছে উত্তর সাগরে। এখানকার তলদেশ থেকে তেল উত্তোলনের পর সেখানে বহু বছর ধরে কার্বন ডাই-অক্সাইড মজুত করেছে নরওয়ে। বর্তমানে উদ্ভাবিত নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে লিকের ঝুঁকি ও তার সম্ভাব্য প্রভাব আগেভাগেই নির্ণয় করা সম্ভব।

ভারমুক্ত হবে পৃথিবী

আইএমওর নির্দেশনা অনুযায়ী বাণিজ্যিক জাহাজে ভেরি লো সালফার ফুয়েল বাধ্যতামূলক ব্যবহার শুরু হয়েছে। জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এলএনজি। বায়োফুয়েল, ইলেকট্রো ফুয়েলের মতো অপ্রচলিত জ্বালানিচালিত জাহাজ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সাগরে। এসব ফুয়েলের প্রাপ্যতা ও ব্যবহার বাড়ছে প্রতিদিন। ফলে আগামী দিনে এসব প্রযুক্তির কল্যাণে শিপিংয়ে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হবে আগের চেয়ে অনেক কম। স্থলে বহু আগে থেকে প্রচলিত কার্বন ক্যাপচার অ্যান্ড স্টোরেজ প্রযুক্তিকে যথাযথভাবে পরিবর্তন করে জাহাজে ব্যবহার শুরু করা গেলে আর কুড়ি বছর নাগাদ কার্বন নিউট্রাল তো বটেই, কার্বন নেগেটিভ হয়ে উঠতে যাচ্ছে শিপিং ইন্ডাস্ট্রি, এ আশাবাদ এখন আর দূর কল্পনা নয়।

আইএমওর পিপিআর সাব-কমিটির অষ্টম সেশন আর্কটিকে ব্ল্যাক কার্বন নিঃসরণ প্রশমনে অগ্রাধিকার

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অস্বাভাবিকভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে উত্তর মেরু। গত বছরের জুনে তো আর্কটিক সার্কেলের উত্তরাঞ্চলের তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উন্নীত হয়, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ। এর জন্য প্রধানত দায়ী করা হয় ব্ল্যাক কার্বনকে। গত ২২-২৬ মার্চ অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের (আইএমও) সাব-কমিটি অন পলিউশন প্রিভেনশন অ্যান্ড রেসপন্স (পিপিআর)-এর অষ্টম সেশনে ব্ল্যাক কার্বন নিঃসরণ কীভাবে বন্ধ করা যায়, সে বিষয়ে বিশেষ আলোকপাত করা হয়েছে।

উত্তর মেরুর তাপমাত্রার অস্বাভাবিক পরিবর্তনের নেপথ্যে রয়েছে এইচএফও (হেভি ফুয়েল অয়েল)-চালিত জাহাজগুলো থেকে নির্গত ব্ল্যাক কার্বন। বরফ অথবা হিমের সংস্পর্শে মারাত্মক দূষণকারী এই ব্ল্যাক কার্বনের উষ্ণায়ন ক্ষমতা ৭ থেকে ১০ গুণ বেড়ে যায়। ফলে বরফ গলার হারও বেড়ে যায়। বরফ গলে গিয়ে নিচের পানি বা ভূপৃষ্ঠ বেরিয়ে পড়ে। ভূপৃষ্ঠ এবং পানি বরফের থেকে গাঢ় রংয়ের হওয়ায়, তুলনামূলকভাবে কম তাপ প্রতিফলন করে। সূর্যের তাপ শোষিত হওয়ায় তাপমাত্রাও বেড়ে যায়।

ব্ল্যাক কার্বনের আরও কিছু উৎস থাকলেও আর্কটিক অঞ্চলের উষ্ণায়নের জন্য এইচএফও-চালিত জাহাজগুলোই প্রধানত দায়ী। মোট ব্ল্যাক কার্বনের ২ শতাংশের উৎস এসব জাহাজ। বাকি উৎসগুলোর অবস্থান বায়ুম-লের অনেক ওপরের স্তরে এবং সেগুলোর বরফের সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা খুব কম।

উত্তর মেরুর জলপথে চলাচলকারী জাহাজগুলোয় জ্বালানি হিসেবে এইচএফও ব্যবহার ও ব্যবহারের জন্য তা পরিবহনের কারণে পরিবেশগত যে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, তা প্রশমনের লক্ষ্যে একটি দিকনির্দেশনা প্রস্তুত করেছে একটি করেসপন্ডেন্স গ্রুপ। অষ্টম সেশনে সাব-কমিটি সেই খসড়া নিয়েই পর্যালোচনা করেছে।

এই খসড়া দিকনির্দেশনার মূল লক্ষ্য হলো জাহাজ থেকে দূষণ নিয়ন্ত্রণে মারপোল কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী সব দেশের প্রশাসনকে সহায়তা করা। বিশেষ করে, যাদের উপকূল রেখার সঙ্গে উত্তর মেরুর জলসীমার সংযোগ রয়েছে। এসব দেশ যেন এইচএফও-সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি মোকাবিলায় জাতীয় পর্যায়ের উদ্যোগ নিতে পারে, সেই বিষয়ে সহায়ক দিকনির্দেশনা উপস্থাপনই এই খসড়ার মূল উদ্দেশ্য। দূষণ কমাতে শিপিং অপারেটরদেরও বড় একটা ভূমিকা রয়েছে। এইচএফও ব্যবহারকারী ও পরিবহনকারী যেসব জাহাজ আর্কটিক সি-রুট ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে, সেগুলো থেকে নিঃসরণ ঝুঁকি কীভাবে কমানো যায়, তার কিছু সুপারিশও রয়েছে এই গাইডলাইনে।

সাব-কমিটি জানিয়েছে, জুনে আইএমওর মেরিন এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন কমিটির (এমইপিসি) যে সেশন হওয়ার কথা রয়েছে (এমইপিসি ৭৬), সেখানে মারপোল অ্যানেক্স ১-এর অনুমোদিত খসড়া সংশোধনী গৃহীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি কার্যকর হলে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে আর্কটিক অঞ্চলের জলপথে জাহাজগুলোর এইচএফও ব্যবহার ও পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা সম্ভব হবে।

পর্যালোচনা শেষে পিপিআর খসড়া গাইডলাইনের প্রাসঙ্গিক অন্যান্য অংশ সংশ্লিষ্ট সাব-কমিটিগুলোর কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে নেভিগেশনাল ও যোগাযোগ-সংক্রান্ত বিষয় পর্যালোচনার জন্য সাব-কমিটি অন নেভিগেশন, কমিউনিকেশনস অ্যান্ড সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ (এনসিএসআর), জ্বালানি ট্যাংকের অবস্থান-সংক্রান্ত উদ্বেগের বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য সাব-কমিটি অন শিপ ডিজাইন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন (এসডিসি) এবং ট্রেনিং ও অন-বোর্ড ফ্যামিলিয়ারাইজেশন-সংশ্লিষ্ট সেকশন পর্যালোচনার জন্য সাব-কমিটি অন হিউম্যান এলিমেন্ট, ট্রেনিং অ্যান্ড ওয়াচকিপিং (এইচটিডব্লিউ)-এর কাছে খসড়াটি পাঠানো হয়েছে।

আগামী বছর পিপিআর সাব-কমিটির পরবর্তী সেশন অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে একটি ড্রাফটিং গ্রুপকে দায়িত্ব দেয়া হবে খসড়া গাইডলাইনটি চূড়ান্ত করার জন্য। পরে সেই চূড়ান্ত গাইডলাইন এমইপিসি বরাবর অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে।

ব্ল্যাক কার্বন নিঃসরণ সীমিত রাখার লক্ষ্যে আইএমও অনেক দিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে আসছে। এই নিঃসরণের পরিমাণ হিসাবে রাখা ও তা রিপোর্ট করার প্রমিত প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছে তারা। এ বিষয়ে ভলান্টারি মেজারমেন্ট স্টাডির জন্য এরই মধ্যে একটি রিপোর্টিং প্রোটোকল প্রাথমিকভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে। এখন একটি প্রমিত প্রোটোকল তৈরির লক্ষ্যে সাব-কমিটি ব্ল্যাক কার্বন পরিমাপ নিয়ে আরও গবেষণা চালানোর জন্য আইএমওর সদস্য দেশগুলোর সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। এই প্রমিত প্রোটোকল প্রণয়ন করা গেলে ব্ল্যাক কার্বন নিঃসরণের তথ্য আরও নিখুঁতভাবে সংরক্ষণ করা যাবে এবং তা সাব-কমিটির পরবর্তী সেশনে উপস্থাপন করা সম্ভব হবে।

কানাডার উদ্যোগে সম্প্রতি মেরিন ইঞ্জিন থেকে নিঃসৃত ব্ল্যাক কার্বনের জন্য একটি স্ট্যান্ডারাইজড স্যাম্পলিং, কনডিশনিং ও মেজারমেন্ট প্রোটোকল প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক টেকনিক্যাল ওয়ার্কিং গ্রুপ (টিডব্লিউজি) গঠন করা হয়েছে। সাব-কমিটি এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে।

এদিকে ব্ল্যাক কার্বন নিঃসরণের মাত্রা নিয়ে সম্প্রতি একটি যৌথ গবেষণা চালিয়েছে ফিনল্যান্ড ও জার্মানি। এই গবেষণার চূড়ান্ত ফলাফল আইএমওর কাছে জমা দিয়েছিল তারা। সাব-কমিটির বৈঠকে এই ফলাফল পর্যালোচনা করা হয়েছে। এই গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব জ্বালানিতে অধিক হারে অ্যারোমেটিক কম্পাউন্ড থাকে, সেসব জ্বালানি ব্ল্যাক কার্বন নিঃসরণে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এক্ষেত্রে চূড়ান্ত উপসংহারে পৌঁছাতে হলে সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি ফ্যাক্টর বিবেচনায় নিতে হবে।

বৈঠক শেষে সাব-কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ব্ল্যাক কার্বন নিঃসরণ কমাতে শিপিং লাইনগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে তারা বাধ্যতামূলক নিয়মাবলির বাইরেও ঐচ্ছিকভাবে কিছু দিকনির্দেশনা অনুসরণ করতে পারে।

এক নজরে সাব-কমিটি গৃহীত কর্মপরিকল্পনা-

জাহাজ থেকে নির্গত ব্ল্যাক কার্বন নিঃসরণের প্রভাব থেকে আর্কটিক অঞ্চলকে যথাসম্ভব মুক্ত রাখতে নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপের বিষয়ে চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা প্রস্তুত করা। এক্ষেত্রে পিপিআর ৬-এর সুপারিশকৃত পদক্ষেপগুলো বিবেচনায় নেওয়া হবে।

 ব্ল্যাক কার্বনের মাত্রা পরিমাপের জন্য সুপারিশকৃত যেসব পদ্ধতি রয়েছে (যেমন এফএসএন, পিএএস ও এলআইআই), সেগুলোর বিষয়ে আরও পর্যালোচনা করা।

স্যাম্পলিং, কন্ডিশনিং ও মেজারমেন্টের জন্য একটি প্রমিত প্রোটোকল প্রস্তুত করা।

 আগামী বছরে অনুষ্ঠেয় এমইপিসির ৭৯তম সেশনে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা।

 ব্যালাস্ট ওয়াটার কম্পায়েন্স মনিটরিং ডিভাইসের ভেরিফিকেশনের জন্য মানদ- প্রণয়ন করা।

 আইএমওর বায়োফাউলিং গাইডলাইন পর্যালোচনা করা।

 মাছ ধরার বিভিন্ন সরঞ্জাম সাগরে পড়ে যাওয়া অথবা সেগুলো নিক্ষেপ ও তা তদারকি করা।

বাংলাদেশের অ্যাডমিরালটি আদালত এখতিয়ার, ক্ষেত্র এবং অনুশীলন

বাংলাদেশের বিস্তৃত সমুদ্রসীমায় আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমসহ বিপুল কর্মযজ্ঞ চলে। আর এই কর্মযজ্ঞ সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে কাজ করে অনেকগুলো পক্ষ। একদিকে যেমন রয়েছে বন্দর এবং তার অংশীজনেরা, অন্যদিকে জাহাজ মালিক, চার্টারার, নাবিক, আমদানি-রপ্তানিকারক, বীমা কোম্পানি, শিপিং এজেন্ট ইত্যাদি। স্বাভাবিকভাবেই নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় এসব পক্ষের মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে বিরোধ বা দাবি উঠতে পারে। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে সমুদ্র অঞ্চলের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত ও নির্বিঘন্নে করার বিকল্প নেই। তাই এসব বিরোধ দ্রুত নিষ্পন্ন করার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে অ্যাডমিরালটি কোর্ট অ্যাক্ট। অ্যাডমিরালটি আদালত মূলত সমুদ্রসীমার অন্তর্গত বিভিন্ন আইন, বিধি, আইনি ধারণা এবং প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করে। এর কার্যপরিধির মধ্যে রয়েছে সমুদ্র বাণিজ্য, নেভিগেশন, সামুদ্রিক দূষণ, নাবিকের মজুরিপ্রাপ্তি, জাহাজের সংঘর্ষ, জাহাজ গ্রেপ্তার, টোয়েজ, লিয়েন, বীমা, সমুদ্রপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন এবং সমুদ্রের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন দাবি বা বিরোধ।

বাংলাদেশের অ্যাডমিরালটি আদালতের প্রেক্ষিত

ভূরাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে এর সমুদ্রসীমা বিস্তৃত, যা ভারত মহাসাগরের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই সমুদ্র অঞ্চল ঘিরে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কাজকর্ম পরিচালিত হয়। দেশের ৯৫ শতাংশ বাণিজ্য সম্পাদন এবং প্রায় ত্রিশ মিলিয়ন মানুষের জীবিকানির্বাহের ব্যবস্থা করে আমাদের সমুদ্র অঞ্চল। বিশ্ব ব্যাংকের এক হিসাবে দেখা যায়, ২০১৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুনীল অর্থনীতি বা ব্লু-ইকোনমির অবদান ছিল প্রায় ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

সমুদ্র অর্থনীতির খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে জাহাজ চলাচল ও জাহাজ ব্যবস্থাপনা, বন্দর এবং এর সহায়ক পরিষেবাগুলো। যেমন জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত, জাহাজের স্বত্বাধিকার এবং পরিচালনা, জাহাজের প্রতিনিধিত্ব ও ব্রোকারি, জাহাজ ব্যবস্থাপনা, মাছ ধরার নৌকা এবং বন্দর প্রতিনিধিত্ব, বন্দর বাণিজ্য, জাহাজ সরবরাহ, কনটেইনার শিপিং পরিষেবা, খালাসি, রোল অন-রোল অফ অপারেটর, শুল্ক গ্রহণ, মালবাহী জাহাজ ফরোয়ার্ড, নিরাপত্তা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি।

সমুদ্র বাণিজ্য সম্পাদনে দেশের বন্দরে প্রতিনিয়ত ভিড়ছে দেশি-বিদেশি জাহাজ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে জাহাজের আগমনও বেড়ে চলেছে দ্রুতগতিতে। চট্টগ্রাম বন্দরে বছরে ভেড়ে প্রায় ৪ হাজার জাহাজ। এক্ষেত্রে মোংলা বন্দরও রেকর্ড ছুঁয়েছে। ২০২০-২০২১ অর্থবছরের একমাস বাকি থাকতেই বন্দরটিতে তার ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৯১৩টি বাণিজ্যিক জাহাজ ভিড়েছে। অর্থাৎ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে আমাদের বন্দর আর সমুদ্র অঞ্চল ঘিরে।

নির্বিঘন্নে ভাবে সমুদ্রপথে বাণিজ্য পরিচালনা, সমুদ্রসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট আইন। এ ছাড়া সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ, পরিবেশ রক্ষায় সঠিক দিকনির্দেশনারও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই প্রেক্ষিতেই প্রণীত হয়েছে বাংলাদেশের অ্যাডমিরালটি কোর্ট অ্যাক্ট।

পাশাপাশি সমুদ্র উপকূলবর্তী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আনক্লস, মারপল, এমএলসিসহ সমুদ্রবিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রণীত বিধি-বিধান ও সনদের সদস্য হয়েছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চল নিয়ে প্রথম আইনটির আত্মপ্রকাশ ঘটে বঙ্গবন্ধুর হাতেই। আমাদের সমুদ্রসীমার সুরক্ষায় এবং সেখানে বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠায় ১৯৭৪ সালে তিনি প্রণয়ন করেন ‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোন অ্যাক্ট, ১৯৭৪’। এরও আট বছর পর ১৯৮২ সালে আলোর মুখ দেখে সমুদ্র আইন সম্পর্কিত জাতিসংঘের কনভেনশন আনক্লস।

ইতিহাসের পথ ধরে অ্যাডমিরালটি আদালত

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রচলিত আইনগুলো সাধারণত ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখনো ভারতে প্রয়োগ করা অধিকাংশ আইন ১৬৮৩ সালের ব্রিটিশ পার্লামেন্টের রয়েল চার্টারস, লেটারস পেটেন্ট বা সংবিধানের মাধ্যমে ইংলিশ ল থেকে উদ্ভূত। বাংলাদেশের অ্যাডমিরালটি আদালত আইনের আঁতুড় ঘরও সেই ব্রিটিশ ল। ১৮৪০ সালে প্রণীত ‘অ্যাডমিরালটি কোর্ট অ্যাক্ট, ১৮৪০’ ছিল ইংল্যান্ডের প্রথম অ্যাডমিরালটি আদালত আইন। এরপর ‘অ্যাডমিরালটি কোর্ট অ্যাক্ট, ১৮৬১’ প্রণয়ন করে অ্যাডমিরালটি আদালতের এখতিয়ার আরও প্রসারিত করা হয়। ইল্যান্ডের ঔপনিবেশিক দেশগুলোর আদালতের জন্য ১৮৯০ সালে প্রণয়ন করা হয় ‘দ্য কলোনিয়াল কোর্ট অব অ্যাডমিরালটি অ্যাক্ট, ১৮৯০’ এবং পরের বছরই ভারতবর্ষের জন্য তা হালনাগাদ করা হয় ‘দ্য কলোনিয়াল কোর্ট অব অ্যাডমিরালটি (ইন্ডিয়া) অ্যাক্ট, ১৮৯১’ নামে।

এই আইনের আলোকেই বাংলাদেশের অ্যাডমিরালটি  মামলাগুলো পরিচালিত হয়ে আসছিল। ২০০০ সালে এই আইন হালনাগাদ করে প্রণীত হয় বাংলাদেশের নিজস্ব আইন ‘অ্যাডমিরালটি কোর্ট অ্যাক্ট, ২০০০’।

বাংলাদেশের অ্যাডমিরালটি আদালত

বাংলাদেশের ‘অ্যাডমিরালটি কোর্ট অ্যাক্ট, ২০০০’ ব্রিটিশ অ্যাডমিরালটি কোর্ট অ্যাক্ট ১৮৪০ ও ১৮৬১, দ্য কলোনিয়াল কোর্ট অব অ্যাডমিরালটি (ইন্ডিয়া) অ্যাক্ট ১৮৯১ এবং ১৯১২ সালের অ্যাডমিরালটি রুলস অনুযায়ী সাজানো হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এই আইনকে ঔপনিবেশিক ভারতের বিভিন্ন আদালতের সিদ্ধান্ত দ্বারা প্রভাবিত হতে দেখা যায়। তাছাড়া ইংলিশ সাধারণ আইনের নীতিসমূহ, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ভারত এবং আমেরিকার সুপিরিয়র এবং অ্যাডমিরালটি আদালতের সিদ্ধান্তের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মেরিটাইম সম্মেলনগুলোর সিদ্ধান্ত ও বিবৃতি নিয়মিত অ্যাডমিরালটি কোর্টে উদ্ধৃত করা হয় এবং এগুলো গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।

‘অ্যাডমিরালটি কোর্ট অ্যাক্ট, ২০০০’-এ অ্যাডমিরালটি মামলা মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগকে মূল এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। এই এখতিয়ার বাংলাদেশের যেকোনো নৌবন্দরে অবস্থিত জাহাজ এবং জাহাজের নেভিগেশন সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত। বাংলাদেশের অ্যাডমিরালটি আদালত বিশ্বের সকল নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত। যেকোনো ব্যক্তি মালিকসহ জাহাজ কিংবা এর সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবেন।

অ্যাডমিরালটি মামলার শুনানি ও নিষ্পত্তি হাইকোর্ট বিভাগের একক বেঞ্চ করে থাকেন। অ্যাডমিরালটি কোর্ট অ্যাক্ট, ২০০০ এর ৩(২) ধারা অনুযায়ী নিম্নক্ত যেকোনো প্রশ্ন বা দাবি শোনার এবং রায় দেওয়ার এখতিয়ার থাকবে এই বেঞ্চের-

(ক) জাহাজের দখল বা মালিকানা বা তার শেয়ারের মালিকানা বা নিবন্ধন সার্টিফিকেট, লগবুক বা জাহাজের চলাচল ও নৌপরিবহনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সকল সার্টিফিকেটসহ জাহাজের স্বত্ব-মালিকানার দলিল পুনরুদ্ধার-সংক্রান্ত সকল দাবি;

(খ) জাহাজের দখল, কর্মনিয়োগ বা আয় সম্পর্কিত কোনো জাহাজের সহমালিকগণের মধ্যে উত্থাপিত যেকোনো প্রশ্ন;

(গ) কোনো জাহাজ বা তার শেয়ারের বন্ধক বা চার্জ-সংক্রান্ত দাবি;

(ঘ) কোনো জাহাজ কর্তৃক সংঘটিত ক্ষতির দাবি;

(ঙ) ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজের ক্ষতিপূরণের দাবি;

(চ) জাহাজের কোনো ত্রুটি বা ত্রুটিযুক্ত যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামের ফলে, জাহাজের সাথে সম্পৃক্ত কারো বেআইনি কর্ম বা অবহেলা, ত্রুটিপূর্ণ পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনার কারণে সংঘটিত প্রাণহানি বা ব্যক্তিগত ক্ষতির দাবি;

(ছ) জাহাজের পরিবহনকৃত কোনো পণ্য হারিয়ে যাওয়া বা ক্ষতির দাবি;

(জ) কোনো জাহাজের পণ্য পরিবহন, ব্যবহার বা ভাড়া-সংক্রান্ত চুক্তি থেকে উদ্ভূত কোনো দাবি;

(ঝ) সিভিল এভিয়েশন অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০ এর ১২ ধারার দ্বারা বা অধীনে আনীত দাবিসহ সমুদ্র, রাষ্ট্রীয় জলসীমা বা অভ্যন্তরীণ জলসীমা বা বন্দরে অবস্থিত জাহাজের লোকদের জীবন রক্ষা, জাহাজ বা জাহাজের সরঞ্জামাদি উদ্ধার বা জাহাজে রক্ষিত মালপত্র বা সম্পদ উদ্ধারকাজের জন্য যেকোনো দাবি;

(ঞ) জাহাজ বা বিমান টেনে আনা (টোয়েজ)-সংক্রান্ত দাবি;

(ট) জাহাজ বা বিমান চালনা (পাইলটেজ)-সংক্রান্ত দাবি;

(ঠ) জাহাজ পরিচালনা বা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য বা সামগ্রী সরবরাহ-সংক্রান্ত দাবি;

(ড) জাহাজের নির্মাণ, মেরামত, সজ্জিতকরণ বা বন্দরের খরচাদি বা দায়-সংক্রান্ত দাবি;

(ঢ) জাহাজে মাস্টার বা নাবিকদের প্রাপ্য মজুরির দাবি;

(ণ) জাহাজের মাস্টার, পণ্য প্রেরক, ভাড়াকারী বা এজেন্ট কর্তৃক জাহাজের জন্য ব্যয়কৃত অর্থ-সংক্রান্ত দাবি;

(ত) সাধারণ গড়পড়তা কাজ (জেনারেল এভারেজ অ্যাক্ট) বা এরকম বলে দাবিকৃত কাজ থেকে উত্থাপিত দাবি;

(থ) জাহাজ বা জাহাজের মাল বন্ধক থেকে উদ্ভূত দাবি;

(দ) কোনো জাহাজ বা কোনো জাহাজের মাধ্যমে পরিবহনাধীন বা পরিবহনকৃত বা পরিবহন প্রচেষ্টারত পণ্য বাজেয়াপ্তকরণ বা ব্যবহারের অযোগ্য ঘোষণা করা-সংক্রান্ত দাবি বা জব্দকৃত জাহাজ বা জাহাজের পণ্য ফেরত প্রদান বা ড্রইটস অব অ্যাডমিরালটি (সমুদ্রবিষয়ক অধিকার)-সংক্রান্ত দাবিসহ এই অধ্যাদেশের বিধানানুযায়ী প্রতিকার প্রদানের এখতিয়ার বা এই আইন প্রণয়নের অব্যবহিতপূর্বে অ্যাডমিরালটি আদালত হিসেবে প্রথাগতভাবে সমুদ্রগামী জাহাজ বা বিমানের বিষয়ে হাইকোর্ট বিভাগের যে সকল বিষয়ে এখতিয়ার ছিল, সেসব বিষয়।

অ্যাডমিরালটি আদালতে মামলা দায়েরের পদ্ধতি

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি নিজে বাদী হয়ে অ্যাডমিরালটি আদালতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ অভিযোগ দায়ের করে মামলা করতে পারেন। আদালত একজন আইনজীবীকে তার পক্ষে উপস্থিত হয়ে কাজ করার জন্য অনুমতি দেন। বাদী ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থাকতে না পারলে বা বিদেশে অবস্থান করলে তিনি একজন পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়োগ দেবেন। পাওয়ার অব অ্যাটর্নি আইনজীবীর মাধ্যমে মামলা করতে পারবেন।

পাওয়ার অব অ্যাটর্নি যথাযথভাবে নোটারাইজড এবং আইনীকরণ করা বাধ্যতামূলক। সেখানে প্রয়োজনীয় নথিগুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এসব নথির মধ্যে রয়েছে জাহাজের মালিকানার প্রমাণ, বন্দর কর্তৃক শিপকলের বিশদ বিবরণ এবং রেম দাবিতে বাদীর প্রদর্শিত নথি।

সাধারণত দুটি পদ্ধতিতে অ্যাডমিরালটি আদালতে মামলা দায়ের করা হয়।

১) অ্যাকশন ইন পারসনাম: ধারা ৫ এর বিধান সাপেক্ষে, হাইকোর্ট বিভাগের অ্যাডমিরালটি এখতিয়ার সকল ক্ষেত্রে অ্যাকশন ইন পারসনাম এর মাধ্যমে প্রয়োগ করা যাবে। অ্যাকশন ইন পারসনাম বলতে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ বোঝায়। এক্ষেত্রে তা জাহাজের মালিক বা জাহাজে সুবিধাভোগী অন্য যেকোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের বোঝাবে, যিনি মামলাটির কারণ হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে দায়বদ্ধ থাকবেন।

২) অ্যাকশন ইন রেম: ধারা ৩(২) এর কিছু বিধান সাপেক্ষে, হাইকোর্ট বিভাগের অ্যাডমিরালটি এখতিয়ার সকল ক্ষেত্রে অ্যাকশন ইন রেম-এর মাধ্যমে প্রয়োগ করা যাবে। অ্যাকশন ইন রেম বলতে কোনো সম্পদের বিপক্ষে অভিযোগ বোঝায়। এক্ষেত্রে মালিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ না করে জাহাজ, কার্গো এবং ফ্রেইটের মতো মেরিটাইম প্রোপার্টির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হবে। পরবর্তীতে মামলাটিতে বাদীর স্বার্থ রক্ষার জন্য এবং ডিক্রি কার্যকর করার সময়ে বিক্রির প্রয়োজনে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযুক্ত প্রোপার্টি দায়বদ্ধ থাকবে।

কোর্ট ফি

অ্যাডমিরালটি মামলার জন্য আদালত ফি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অ্যাডমিরালটির মামলা দায়েরের জন্য অ্যাডমিরালটি কোর্ট অ্যাক্ট, ২০০০ এ ‘কোর্ট ফি অ্যাক্ট, ১৮৭০’ এর বিধান অনুসরণ করা হয়েছে। তবে সেখানে শর্ত দেওয়া আছে যে, এই কোর্ট ফি অ্যাক্টে ভিন্নরকম বিধান থাকা সত্ত্বেও  অ্যাডমিরালটি কোর্ট অ্যাক্টের ধারা ৩(২) এর দফা ‘ঢ’ এ উল্লেখিত দাবি বাদে অন্য সকল দাবির ক্ষেত্রে কোর্ট ফি অনধিক এক লাখ টাকা হবে এবং দফা ‘ঢ’ এ উল্লেখিত দাবি অর্থাৎ জাহাজের মাস্টার বা নাবিকদের প্রাপ্য মজুরি দাবির ক্ষেত্রে কোর্ট ফি একশ টাকা প্রদেয় হবে। এছাড়া Í আদালতের সব ধরনের ফিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

এই আইনের অধীন আরজির ওপর আরোপযোগ্য সকল ফি স্ট্যাম্পের মাধ্যমে বা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের রেজিস্ট্রার বা তার দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি বরাবর নগদ প্রদানের মাধ্যমে আদায় করা যাবে।

সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা

সংঘর্ষের সাথে সম্পর্কিত কোনো ঘটনায় একটি জাহাজ কর্তৃপক্ষ অপর একটি জাহাজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের দাবিতে মামলা করতে পারে। এজন্য মামলায় নি¤œলিখিত নথিগুলো দাখিল করতে হবেÑ

১। জরিপের প্রতিবেদনে মেরামতের মূল হিসাব;

২। ইতিমধ্যে যদি কোনো মেরামত করা হয়ে থাকে, তবে তার বিল;

৩। মাস্টার দ্বারা দায়ের করা মূল প্রতিবাদের নোট (যথাযথভাবে নোটারাইজড হতে হবে);

৪। ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজের প্রাসঙ্গিক লগ বইয়ের কপি;

৫। মাস্টার এবং চিফ অফিসারের বক্তব্য বা প্রতিবেদন;

৬। ক্ষতির মোট দাবির পরিমাণ।

ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য মামলা

পণ্য পরিবহনের সময় হারিয়ে গেলে বা পণ্যের ক্ষতি হলে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি পণ্য ক্ষতিপূরণের জন্য মামলা করতে পারেন। তখন তাকে অভিযোগপত্র এবং জাহাজ গ্রেপ্তারের আবেদনসহ নি¤œলিখিত নথিগুলো আদালতে পেশ করতে হবে-

১। জরিপের মূল প্রতিবেদন;

২। ব্যাংক গ্যারান্টি (বিজি) বা লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) এর কপি, চালান, বিল অব এন্ট্রি;

৩। মামলা সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক দলিলপত্রের কপি।

মামলা স্থগিত করা

‘দেওয়ানি কার্যবিধি, ১৯০৮’ এর ধারা ১০ অনুযায়ী, যদি একই জাহাজের বিরুদ্ধে আগেই কোনো মামলা হয়ে থাকে এবং সেই মামলার পক্ষসমূহ ও বিচার্য বিষয় এবং পরবর্তীতে দায়েরকৃত মামলার পক্ষসমূহ ও বিচার্য বিষয় একই হয়, তখন পরবর্তীতে দায়েরকৃত মামলাটির বিচারকার্য আদালত স্থগিত বা মুলতবি করে দেবেন। তবে পূর্ববতী মামলা যদি কোনো বিদেশি আদালতে দায়ের করা হয়ে থাকে, তখন মামলার কারণ একই হওয়া সত্ত্বেও তা বাংলাদেশের আদালতে পরবর্তী মামলার বিচারে কোনো বাধা সৃষ্টি করবে না।

জাহাজ গ্রেপ্তার

অ্যাডমিরালটি আদালত আইনে জাহাজ গ্রেপ্তার একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। প্রাথমিক অবস্থায় প্রতিকার পাওয়ার জন্য পাওনাদারের কাছে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অ্যাডমিরালটি কোর্ট অ্যাক্ট, ২০০০ এবং মার্চেন্ট শিপিং অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ থেকে প্রাপ্ত আইনের ভিত্তিতে একটি জাহাজকে গ্রেপ্তারের আদেশ দেওয়া হয়। গ্রেপ্তার বলতে নির্দিষ্ট দাবি আদায়ের জন্য বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি জাহাজকে আটক করা বোঝায়। অ্যাডমিরালটি আইনের অধীনে এই দাবি সাধারণত জাহাজ এবং পণ্যবাহী পরিবহন-সংক্রান্ত কার্যকলাপের সমস্ত কারণ এবং শিপিংয়ের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করে। অ্যাডমিরালটি আদালতের একটি বিশেষ পর্যায়ে গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। গ্রেপ্তার আদেশের ফলে অভিযুক্ত জাহাজটি আইনিভাবে চলাচলে ও সব ধরনের বাণিজ্যিক কাজ থেকে বিরত থাকে, যতক্ষণ না আদালত থেকে এই আদেশ প্রত্যাহার করা হয়।

কমন ল-ভুক্ত দেশগুলোতে, একটি জাহাজ কেবলমাত্র সীমিত সংখ্যক মামলায় গ্রেপ্তার হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে দাবিদাররা তাদের দাবি বাস্তবায়নের জন্য প্রসেডিং ইন রেম-এর মাধ্যমে অভিযোগ দায়ের করেন। মূলত অ্যাকশন ইন রেম জাহাজ গ্রেপ্তার অধিকারের ভিত্তি তৈরি করে। এটি কেবল অ্যাডমিরালটি আদালতেই অনুশীলন করা হয়।

বাংলাদেশে অ্যাডমিরালটি কোর্ট অ্যাক্ট, ২০০০ এর ধারা ৮ অনুযায়ী অ্যাডমিরালটি আদালতের এখতিয়ার উচ্চ আদালত বিভাগের একক বিচারক বেঞ্চ দ্বারা প্রয়োগ করা হয়। এই আইনের অধীনে বাংলাদেশে একটি জাহাজের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে হলে বাদীকে অবশ্যই দুটি শর্ত পূরণ করতে হবে। যথা-

১) আদালতকে সন্তুষ্ট করতে হবে যে, বাদীর দাবিটি এই আইনের ধারা ৩(২) এ বর্ণিত এক বা একাধিক বিভাগের মধ্যে পড়ে। এবং

২) আদালতকে আরও সন্তুষ্ট করতে হবে যে, এই জাতীয় দাবি আদায়ের জন্য অ্যাকশন ইন রেম পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

তবে, এই আইনের ৪ ধারামতে, এই দাবির প্রেক্ষিতে অ্যাকশন ইন রেম-এর আওতায় শুধু জাহাজই সীমাবদ্ধ নয়, এর সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য সম্পত্তিতেও এই আইন বলবৎ হতে পারে।

কোনো জাহাজ গ্রেপ্তারের জন্য আবেদনকারীকে অবশ্যই আদালতে এক লাখ টাকা কোর্ট ফি প্রদান করে মামলার জন্য আবেদন করতে হবে। আবেদনকারী প্রয়োজনীয় সকল তথ্যাদিসহ আবেদনপত্র আদালতের সেকশন অফিসে জমা দেবে এবং জাহাজ গ্রেপ্তারের জন্য আবেদনটি উপস্থাপন করবে। এ সময় গ্রেপ্তারের দাবি সমর্থিত সমস্ত দলিলপত্র উপস্থাপন করতে হবে। সাধারণত আবেদনটি পরবর্তী কর্মদিবসে দৈনিক শুনানির তালিকাভুক্ত হয়। তবে আদালত যদি বিষয়টিকে জরুরি মনে করেন, তবে বিষয়টি আমলে নিয়ে সাপ্লিমেন্টারি কারণের তালিকাভুক্ত করে একই দিনে শুনানি গ্রহণ করবেন। প্রাথমিক বিবেচনায় মামলাটি দাবির সমর্থনে পেশ হলে আদালত সমন জারির নির্দেশ দেন। আদালত কর্তৃক মামলা শুনানির জন্য সুনির্দিষ্ট তালিকা প্রকাশ করা হয় এবং আসামিদের কোনো বক্তব্য থাকলে লিখিত আকারে জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। তারপর গ্রেপ্তারের জন্য আবেদনের শুনানি হয়। আদালত আবেদনের কারণ সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে সন্তুষ্ট হলে দাবি আদায়ের জন্য সিকিউরিটি হিসেবে জাহাজটিকে গ্রেপ্তারের আদেশ দেন। যদি বিবাদীর পক্ষ থেকে কোনো না-রাজি দায়ের করা না হয়, তবে বাদী কর্তৃক প্রদত্ত ফি এবং চার্জের প্রাপ্তি সাপেক্ষে আদালত অভিযুক্ত জাহাজটি গ্রেপ্তারের কার্যক্রম শুরু করেন। একইভাবে জাহাজে অবস্থিত কার্গো বা যেকোনো পক্ষের মালিকানাধীন কোনো সম্পত্তিও অ্যাডমিরালটি কোর্টের আদেশে গ্রেপ্তার করা যেতে পারে।

১৪ জুন ২০১৯ চট্টগ্রাম বন্দরের চ্যানেলে তেলবাহী ট্যাংকারের সাথে একটি কনটেইনারবাহী জাহাজের সংঘর্ষ হয়। এ ধরনের সংঘর্ষের ঘটনায়
একটি জাহাজ কর্তৃপক্ষ অপর একটি জাহাজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের দাবিতে অ্যাডমিরালটি আদালতে মামলা করতে পারে

সিস্টার শিপ গ্রেপ্তারের অধিকার

উচ্চ আদালতের অ্যাডমিরালটি এখতিয়ার অনুযায়ী কেবল অভিযুক্ত জাহাজের বিরুদ্ধে নয়, পরিবর্তে ‘সিস্টার শিপ’ অর্থাৎ অভিযুক্ত জাহাজ মালিকের মালিকানাধীন অপর একটি জাহাজের বিরুদ্ধে একই দাবি অনুসারে গ্রেপ্তারের পদক্ষেপ নেওয়া যায়।

অ্যাডমিরালটি অ্যাক্ট, ২০০০ এর ৪(৪) ধারামতে-

(ক) সিস্টার শিপ হচ্ছে সেই জাহাজ, যেটি বিক্রি করলে তার উল্লেখযোগ্য লভ্যাংশের অধিকারী হবেন অভিযুক্ত জাহাজের মালিকানাধীন একই ব্যক্তি; অথবা,

(খ) অন্য যেকোনো জাহাজ, যা আগে থেকেই অভিযুক্ত জাহাজ মালিকের মালিকানাধীন ছিল।

মেরিটাইম লিয়েনের ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার আদেশ

যদি বাদীর দাবিটি মেরিটাইম লিয়েন হয়, তবে জাহাজের মালিকানা পরিবর্তনের পরেও অধিকারটি সুরক্ষিত থাকে এবং জাহাজটিকে গ্রেপ্তার করা যায়। মেরিটাইম লিয়েন হলো একটি ইন রেম ক্লেইম, যা কোনো জাহাজ, এর আনুষাঙ্গিক যন্ত্রাদি, এতে যুক্ত সেবা অথবা এসব সম্পদ দ্বারা কোনো ক্ষতিসাধন সম্পর্কিত দাবি বুঝায়। যদি দাবিটি মেরিটাইম লিয়েন ব্যতীত ক্লেইম হয় এবং মামলা দায়েরের আগে জাহাজের মালিকানা বদলে যায়, সেক্ষেত্রে জাহাজটিকে গ্রেপ্তার করা যাবে না।

একটি জাহাজকে গ্রেপ্তারের অন্যান্য উপায়

আবেদনকারীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ডিভিশন কর্তৃক গৃহীত কোনো আদেশ বা জাহাজের মালিকের বিরুদ্ধে কোনো বিদেশি আদালতের রায় প্রদানের ঘটনায় জাহাজ গ্রেপ্তার করা যেতে পারে। রায় দেওয়ার আগেও একটি জাহাজ ব্যক্তিগতভাবে মামলাতে যুক্ত হতে পারে।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট শিপিং অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ এর অধীনে মার্কেন্টাইল মেরিন বিভাগের প্রিন্সিপাল অফিসার একটি নোঙর করা জাহাজ আটক করতে পারেন। একই আইনের অধীনে, হাইকোর্ট ডিভিশন বাংলাদেশ সরকারের যেকোনো আইনের বত্যয় ঘটলে একটি বিদেশি জাহাজকে গ্রেপ্তার করতে পারেন অথবা যেকোনো বাংলাদেশী নাগরিক বা সংস্থা এবং প্রিন্সিপাল অফিসার বা শুল্কের কালেক্টর হাইকোর্ট বিভাগে আবেদন করার আগেই একটি জাহাজ আটক করতে পারেন।

চট্টগ্রাম বন্দর কার্যক্রম (কার্গো এবং কনটেইনার), ২০০১ প্রবিধানের অধীনে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষও কোনো জাহাজ আটক করতে পারে। নেভিগেশন চ্যানেল ব্যবহারের জন্য ব্যয় এবং যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার সমপরিমাণ সিকিউরিটি মানি না দেওয়া পর্যন্ত অথবা মোট অর্থ পরিশোধ না করা পর্যন্ত একটি জাহাজকে আটকে রাখার এখতিয়ার রয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষের। এছাড়া ঋণখেলাপির দাবিতেও জাহাজ গ্রেপ্তার করা যাবে।

তবে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, যেমন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ পুলিশ এবং কোস্ট গার্ডের জাহাজসমূহ অ্যাডমিরালটি আদালতের আওতার বাইরে থাকবে।

একটি জাহাজ যদি বেয়ারবোট চার্টারে থাকে তবে এটি গ্রেপ্তার হতে পারে, কিন্তু যদি সেটি টাইম চার্টারের অন্তর্ভুক্ত হয় তবে তা গ্রেপ্তার করা যায় না।

বাংলাদেশি জাহাজ মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান কজ মেরিনের কাছে মেরামত বাবদ বিপুল পরিমাণ টাকা বকেয়া থাকার অভিযোগের প্রেক্ষিতে
২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসের সময় সিঙ্গাপুরের পতাকাবাহী জাহাজ ‘কোটা আঙ্গেরিক’কে আটক করে নৌ-বাণিজ্য দপ্তর

জাহাজ ফ্রিজিং এর আদেশ

অ্যাডমিরালটি কার্যক্রম বা ডিক্রি কার্যকর করার জন্য একটি জাহাজের গ্রেপ্তার ব্যতীত আলাদা কোনো ফ্রিজিং এর আদেশ বাংলাদেশের অ্যাডমিরালটি আদালত দিতে পারে না। তবে আবেদনের মাধ্যমে কোনো পক্ষকে স্ক্র্যাপিং থেকে বিরত রাখতে বা একটি জাহাজ অপসারণের আদেশ আদালত দিতে পারেন।

গ্রেপ্তার আদেশ জারির পরবর্তী করণীয়

আদালত গ্রেপ্তারের আদেশ জারি করার পরে, মার্শালকে এটি অনুলিপিসহ নি¤œলিখিত কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করার আদেশ দেনÑ

ক) হারবার মাস্টার,

খ) শুল্ক সংগ্রাহক,

গ) মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের প্রিন্সিপাল অফিসার,

ঘ) বন্দর পুলিশ সুপার,

ঙ) জেলা জজ,

চ) বন্দর কর্তৃপক্ষের ডিরেক্টর ট্র্যাফিক।

রায় কার্যকর করা

বিবাদী পক্ষ যদি জাহাজটি মুক্ত করতে না পারে, তবে বাদী জাহাজের পেটেন্ট বিক্রির জন্য আদালতের কাছে আবেদন করতে পারেন। আদালত নিলামের মাধ্যমে জাহাজটি বিক্রির অনুমতি দেবেন। আদালতের আদেশে মার্শাল জাহাজটির প্রকাশ্য নিলাম করেন এবং মামলার বাদীকে তাঁর ক্ষতিপূরণ প্রদান করেন। যদি একাধিক দাবিদার থাকে এবং উদ্ধারকৃত অর্থ যদি দাবি পূরণ করতে না পারে, তবে আদালত ইংলিশ অগ্রাধিকার আইন প্রয়োগ করেন। এই আইন বিদেশি বিরোধ নিষ্পত্তি এবং সালিশি রায়ের ক্ষেত্রেও প্রয়োগযোগ্য।

জাহাজ যখন কাস্টডিতে

গ্রেপ্তারের সময় থেকে জাহাজটি অ্যাডমিরালটি কোর্ট মার্শালের হেফাজতে থাকবে এবং এর ওপর যেকোনো হস্তক্ষেপকে রহিত করা হবে। কোর্ট মার্শাল বন্দর কর্তৃপক্ষকে জাহাজের ওপরে নজর রাখার জন্য অনুরোধ করেন।

মার্শাল অ্যাডমিরালটি বিধি, ১৯১২ অনুসারে মার্শাল এমন একটি কর্তৃপক্ষ, যিনি অ্যাডমিরালটি আদালতের আদেশ কার্যকর করেন, বিশেষত কিছু সময় রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার সহায়তায় বৈধ শক্তি প্রয়োগ করে জাহাজ গ্রেপ্তার বা মুক্তির আদেশ পালন করেন। মার্শাল সোনালী ব্যাংকের সুপ্রিম কোর্ট শাখায় একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রাখেন, যেখানে জাহাজের বিক্রয়কৃত অর্থ রাখা হয় এবং পরবর্তীতে দাবিদারকে প্রদান করা হয়। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের রেজিস্ট্রার জেনারেল মার্শাল হিসেবে কাজ করেন।

আপিল প্রক্রিয়া

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদে বিধান করা হয়েছে যে আপিল বিভাগ উচ্চ আদালতের রায়, ডিক্রি, আদেশ বা দ-াদেশের বিপক্ষে আপিল শুনানি এবং নির্ধারণ করার অধিকার রাখে। সেই অনুসারে, অ্যাডমিরালটি আদালতের সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট যে কেউ সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে আবেদন করতে পারবেন। অ্যাডমিরালটি রুলস, ১৯১২ এর বিধি ৫৯ এ বলা হয়েছে, ‘আইন সম্পর্কিত প্রশ্ন ব্যতীত বিচারকের অনুপস্থিতিতে তাঁর অন্য কোনো রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না।’

গ্রেপ্তার আদেশ প্রত্যাহার

বিবাদীর পক্ষ হতে একই আদালতে আবেদন করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করা যেতে পারে এই মর্মে যে, জাহাজটিকে ভুলভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া বিবাদী সিকিউরিটি মানির পরিমাণ হ্রাস করার জন্যও আবেদন করতে পারেন। তবে এই পদ্ধতিতে শুনানি হতে ১/২ সপ্তাহ সময় লেগে যায়। তাই দ্রুত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করাতে হলে আদালতের ধার্যকৃত টাকা অথবা স্থানীয় ব্যাংক গ্যারান্টি জমা দিতে হয়।

রিলিজ অর্ডার

আদালতের কাছ থেকে মুক্তির আদেশ পাওয়ার জন্য জাহাজ মালিকের একজন সলিসিটারের সাহায্য নিতে হবে এবং পরবর্তীকালে আদালতে মামলার সম্পূর্ণ মূল্যমানের একটি ব্যাংক গ্যারান্টি দাখিল করতে হবে। মুক্তির আদেশ অর্থাৎ আদালত কর্তৃক রায় হওয়ার পরে, আদেশের একটি প্রত্যয়ন কপি আদালতের মাধ্যমে প্রস্তুত করতে হবে।

এই প্রত্যয়ন কপিটি পাওয়া গেলে, যেখানে জাহাজটি বন্দি অবস্থায় আছে, সেখানে নিয়ে যেতে হবে এবং মুক্তির আদেশটি বন্দর এবং শুল্ক কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করতে হবে। আদালতের কাছ থেকে এই ধরনের মুক্তির আদেশ প্রাপ্তির পরে, বন্দর এবং শুল্ক কর্তৃপক্ষ জাহাজের বন্দর থেকে বহির্গমনের ছাড়পত্র প্রক্রিয়াকরণ করে থাকে, এবং এই ছাড়পত্র পেয়ে জাহাজটি অন্যত্র যাত্রা করতে সক্ষম হয়।

গ্রেপ্তারকৃত জাহাজটি কত তাড়াতাড়ি মুক্তি পেতে পারে তা নির্ভর করে জাহাজের মালিক নির্ধারিত ব্যাংক গ্যারান্টির ব্যবস্থা কত দ্রুততার সাথে করতে পারেন তার ওপর। ব্যাংক গ্যারান্টির ব্যবস্থা করতে সাধারণত ২-৩ দিন সময় লাগে এবং এটি আদালতে জমা দিতে আরও ১-২ দিন সময় লাগে। তারপর শুনানি হয় এবং একটি রিলিজ অর্ডার পেতে হয় এবং সর্বশেষে রিলিজ আদেশটি এই কাজের সাথে সম্পৃক্ত বিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষের (বন্দর, শুল্ক, মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্ট, পোর্ট পুলিশ এবং জেলা জজ ইত্যাদি) কাছে প্রেরণ করা হয়। সুতরাং, এই পদ্ধতিতে রিলিজ পেতে মোট ৪-৬ দিন প্রয়োজন হয়।

উল্লেখ্য, এখানকার আদালত কোনো জাহাজের বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারের আদেশ প্রত্যাহার করার জন্য কোনো নগদ আমানত কখনই গ্রহণ করেন না। সিকিউরিটি হিসেবে আদালত কোনো ক্লাবের গ্যারান্টি চিঠিও গ্রহণ করেন না। মুক্তির আদেশ জারির জন্য আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য একমাত্র বিষয় হলো একটি তফসিলি ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত নির্ধারিত মূল্যের ব্যাংক গ্যারান্টি।

আদালতে পাল্টা সিকিউরিটি প্রদান

কোনো জাহাজ গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়ার সময় আদালতের কোনো পাল্টা সিকিউরিটি বা সুরক্ষা দেয়ার দরকার হয় না। দেওয়ানি কার্যবিধি অনুযায়ী, যেখানে মামলার একমাত্র বাদী বা একাধিক বাদী আছে এবং সকলেই দেশের বাইরে অবস্থান করেন অথবা এক বা একাধিক বাদী কারো কাছেই মামলার হিসাব অনুযায়ী পর্যাপ্ত অস্থাবর সম্পত্তি নেই, সেই সকল ক্ষেত্রে আদালত তার নিজস্ব গতিতে বা কোনো বিবাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মামলায় ব্যয়কৃত এবং কোনো বিবাদী দ্বারা ব্যয় হওয়ার সম্ভাব্য সমস্ত ব্যয়ের জন্য আদালতে পাল্টা সিকিউরিটি বা সুরক্ষা প্রদান করতে বাদী বা বাদীদের আদেশ দিতে পারেন।

অ্যাডমিরালটি মামলা নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনীয় সময়

যদি বাদী মামলার বিভিন্ন পর্যায়ে স্থগিতাদেশ না নেন, তবে মামলাটি ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করা যেতে পারে। অ্যাডমিরালটির বিচারক মামলা স্থগিত করার ক্ষেত্রে বিবাদীর কোনো রকম বিভ্রান্তিমূলক প্রচেষ্টার অনুমতি দেন না। দুর্ভাগ্যক্রমে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাদী পক্ষই স্থগিতাদেশ নেন বা শুনানিতে বিলম্ব করেন এবং সেক্ষেত্রে মামলাটি নিষ্পত্তি করতে কয়েক বছর সময় লেগে যায়।

বিচারাধীন মামলা সমঝোতা

বাংলাদেশে যেকোনো সময়ে বিচারাধীন অ্যাডমিরালটি মামলা নিয়ে সমঝোতা করার সুযোগ রয়েছে। অ্যাডমিরালটির বিচারক আদালতের বাইরে মামলা-মোকদ্দমা মিটমাট করার যেকোনো প্রয়াসকে প্রশংসা করেন। যদি আলোচনা করার সুযোগ দেওয়ার জন্য শুনানি স্থগিত করার দরকার হয়, তবে আদালত সেই অনুমতিও দিয়ে থাকেন। আদালতের বাইরে বন্ধুত্বপূর্ণ নিষ্পত্তি হয়ে গেলে আদালতে মামলা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য আবেদন করা যায়।

আছে কিছু প্রতিকূলতাও

মামলা পরিচালনায় অ্যাডমিরালটি আদালতকে বেশ কিছু প্রতিকূলতার মুখেও পড়তে হয়। এর ফলে মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হয় এবং একটি মামলা কয়েক বছর বিচারাধীন অবস্থায় পড়ে থাকে। এতে বিচারপ্রার্থীদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং বাদীগণ বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন। বিচার প্রক্রিয়া বিলম্ব হওয়ার পেছনে নিচের বিষয়গুলো উল্লেখ করা যায়-

●     দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত সমুদ্রবন্দরগুলো ঢাকার অ্যাডমিরালটি আদালত থেকে অনেক দূরে অবস্থিত এবং এসব স্থান থেকে যাতায়াতে একটি বড় অন্তরায় যানজট। এর ফলে মামলার পক্ষদ্বয়ের আদালত পর্যন্ত পৌঁছতে যথেষ্ট সময় অতিবাহিত হয়।

●     এছাড়া জাহাজ গ্রেপ্তারের আদেশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা ও নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, আর এই সুযোগে অভিযুক্ত জাহাজটি বন্দর ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। তখন বাদীপক্ষের ন্যায়বিচার অনিশ্চিত হয়ে যায়।

●     নাবিকদের মজুরি-সংক্রান্ত মামলাগুলো আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় আটকে থাকার দরুন তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়; যা তাদের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন করে।

●     হাইকোর্ট ডিভিশনে অ্যাডমিরালটি মামলা ছাড়াও সকল প্রকার দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার বিচারকার্য সম্পন্ন হয়ে থাকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই আদালতে প্রচুর মামলা বিচারাধীন অবস্থায় থাকে এবং বিচারকাজে অনেক বেশি চাপের সৃষ্টি হয়। একই কারণে মাননীয় বিচাকগণ অ্যাডমিরালটি মামলায় পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না।  এছাড়া স্থান সংকুলানের জন্য একই আদালত প্রাঙ্গণে সকল ধরনের মক্কেলদের ভিড় হয়ে থাকে। যা মক্কেলদের মাঝে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই আদালতে কেবল বাংলাদেশী নাগরিকরাই নন, বরং বাংলাদেশের এখতিয়ারের ভেতরে যেকোনো বিদেশি নাগরিক তাঁর অধিকার আদায়ের জন্য আবেদন করতে পারেন। তাই আদালতের পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

●     অ্যাডমিরালটি আদালতে ১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধি অনুযায়ী ট্রায়াল অনুষ্ঠিত হয়। যা অনেকটাই জটিল এবং দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে।

●     এছাড়া বাংলাদেশে অ্যাডমিরালটি মামলা পরিচালনা করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ফলে বিচারপ্রার্থীগণ, বিশেষ করে বিদেশি মক্কেলরা এই আদালতে মামলা দায়েরে নিরুৎসাহিত বোধ করেন।  

●     অ্যাডমিরালটি আদালতে বিভিন্ন দেশের নাগরিকগণ তাদের দাবি নিয়ে উপস্থিত হয় এবং আইনজীবীদের বিভিন্ন ভাষা-ভাষীর মক্কেলদের সাথে কাজ করতে হয়। অনেক সময়ই আইনজীবীগণ ভিনদেশি মক্কেলের সমস্যা বা দাবিগুলো সঠিকভাবে বুঝতে পারেন না; এর ফলে ন্যায়বিচার ব্যাহত হয়। এছাড়া আমাদের দেশে এখনো অ্যাডমিরালটি আইন সম্পর্কে অভিজ্ঞ আইনজীবীর সংখ্যা অপ্রতুল! এই আদালতের জন্য দক্ষ লোকবলের অভাব একটি বড় সমস্যা। 

এসব সমস্যা সমাধান করার লক্ষ্যে যথাযথ কর্তৃপক্ষ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। যেমন-

●     অ্যাডমিরালটি আদালত যেহেতু সমুদ্র বাণিজ্য এবং সমুদ্র বন্দরনির্ভর বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কাজ করে, তাই এই আদালতকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও পৃথক আদালত হিসেবে গঠন করে এর অবস্থান সমুদ্রবন্দরের কাছাকাছি করা উচিত। এতে মামালা দ্রুত নিষ্পত্তি করার পাশাপাশি অপরাপর প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে দ্রুত জাহাজের গ্রেপ্তারসহ অন্যান্য আদেশ কার্যকর করা সম্ভব হবে। 

●     একটি বিশেষ আদালত হিসেবে অ্যাডমিরালটি আদালতের বিচারকার্য পরিচালনার জন্য মাননীয় বিচারকগণের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। অ্যাডমিরালটি আইন সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন বিচারক নিয়োগ দিতে হবে, যারা শুধু অ্যাডমিরালটি মামলাগুলোর রায় প্রদান করবেন। তাদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে হবে।

●     অ্যাডমিরালটি আদালতে দক্ষ জনবল বৃদ্ধি করার পাশাপাশি অ্যাডমিরালটি আইন ও আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক আইন সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন আইনজীবীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া আইনজীবীদের ভাষাগত দক্ষতা এবং বিশেষ আদালতে ট্রায়াল পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।

●     মামলার ট্রায়ালের জন্য দেওয়ানি কার্যবিধি ১৯০৮ এর ওপর নির্ভর না করে সময়োপযোগী পদ্ধতি ব্যবহার করা, যাতে দ্রুত শুনানি শেষ করে রায় প্রদান করা যায়।

●     মামলা পরিচালনার ব্যয় সংকোচন করা, যাতে দাবিপ্রত্যাশীগণ সহজেই তাদের মামলার ব্যয়ভার বহন করতে পারেন।

এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করার পাশাপাশি উপযুক্ত পরিবেশে যোগ্য বিচারক দিয়ে সহজ ও নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি অনুসরণ করে স্বল্প সময়ে, স্বল্প ব্যয়ে দ্রুত বিচারকাজ নিষ্পত্তি করা সম্ভব। এতে করে সবার কাছে বাংলাদেশের অ্যাডমিরালটি আদালতের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে।

ইনফোগ্রাফিক্স- জুন, ২০২১

মে, ২০২১

খতিয়ান – মে, ২০২১