Home Blog Page 225

নিখোঁজ ইন্দোনেশীয় সাবমেরিনের সন্ধান মিলেছে

ইন্দোনেশিয়ায় নিখোঁজ সাবমেরিনের ধ্বংসাবশেষের সন্ধান মিলেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৫০ মিটার গভীরে এর অবস্থান শনাক্ত করা হয়েছে। তবে সাবমেরিনটির ৫৩ আরোহীর কেউই বেঁচে নেই বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট এরই মধ্যে তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছে।

বালি সাগরে হারিয়ে যাওয়া কেআরআই নাংগালা-৪০২ সাবমেরিনটির ছয় টুকরো ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেছে। উদ্ধারকাজে অংশ নেয়া ইন্দোনেশীয় যুদ্ধজাহাজ সেই অঞ্চলটি স্ক্যান করে ধ্বংসাবশেষগুলো শনাক্ত করে।

ইন্দোনেশিয়ার সামরিক কমান্ডার জানান, সিঙ্গাপুর থেকে রেসকিউ জাহাজ এমভি সুইফট পানির নিচে ছবি তুলতে রিমোটচালিত গাড়ি (আরওভি) পাঠিয়েছিল। সাবমেরিনের বিভিন্ন অংশের যেসব ছবি পাওয়া গেছে, সেগুলো কেআরআই নাংগালা-৪০২ এর অংশ বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

প্রথম প্রান্তিকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভাঙার জন্য বিক্রি হয়েছে ১৫৫টি জাহাজ

চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) দক্ষিণ এশিয়ার জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ডগুলোর কাছে মোট ১৫৫টি জাহাজ বিক্রি করা হয়েছে। আর আলোচ্য সময়ে এ খাতে মোট নয়জন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান শিপব্রেকিং প্লাটফর্মের সর্বশেষ প্রান্তিকীয় প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথম প্রান্তিকে বিশ্বজুড়ে মোট ২০৪টি জাহাজ ভাঙা হয়েছে। এর মধ্যে ৭৬ শতাংশ বা ১৫৫টি জাহাজ বিক্রি করা হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার ইয়ার্ডগুলোর কাছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জাহাজ বিক্রি করেছে গ্রিসের জাহাজমালিকরা। এরপর যথাক্রমে রয়েছে জাপান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও দক্ষিণ কোরিয়া।

ভারতীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের বরাতে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২৪ সাল নাগাদ গুজরাটের আলাং শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের সক্ষমতা বৈশ্বিক জাহাজ ভাঙা ব্যবসার প্রায় ৫০ শতাংশে উন্নীত হবে।

কার্বন কর আরোপের পক্ষে বৈশ্বিক শিপিং সংগঠনগুলো

ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের (আইএমও) নেতৃত্বে বৈশ্বিক শিপিং খাতে চলছে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জোরালো প্রচেষ্টা। এরই অংশ হিসেবে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে ৫০০ কোটি ডলার তহবিল বরাদ্দ চায় বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শিপিং সংগঠনগুলো। জলবায়ু বিষয় সম্মেলনের আগে আরও একবার এ দাবি জানিয়েছে তারা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এ সম্মেলনে যোগ দেয়ার কথা।

এসব শিপিং সংগঠনের মধ্যে রয়েছে বাল্টিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম কাউন্সিল (বিমকো), ক্রুজ লাইনস ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন, ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব শিপিং ও ওয়ার্ল্ড শিপিং কাউন্সিল। সম্মিলিতভাবে তারা বৈশ্বিক সমুদ্র বাণিজ্যের ৯০ শতাংশের বেশি প্রতিনিধিত্ব করে। এসব সংগঠন সরকারগুলোকে কার্বন কর আরোপের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করার আহ্বান জানিয়েছে, যা তাদের দাবিকৃত তহবিল বরাদ্দের সুযোগ করে দেবে বলে মনে করছে তারা।

সংবাদ সংক্ষেপ – মে

ভারতে অক্সিজেনবাহী জাহাজের চার্জ মওকুফের নির্দেশ সরকারের

করোনা মহামারি দ্বিতীয় ঢেউয়ে নাকাল ভারতে মেডিকেল গ্রেড অক্সিজেনের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় অক্সিজেনবাহী জাহাজগুলোকে বিভিন্ন চার্জ থেকে ছাড় দেয়ার জন্য বন্দরগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে দেশটির সরকার।

মেডিকেল গ্রেড অক্সিজেন, অক্সিজেন ট্যাংক, অক্সিজেন বোটল, পোর্টেবল অক্সিজেন জেনারেটর ও অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটরবাহী জাহাজগুলো ভেসেল-রিলেটেড চার্জ, স্টোরেজ চার্জ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর থেকে অব্যাহতি পাবে। এছাড়া এসব জাহাজ বার্থিংয়ের ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে।

মায়েরস্ককে ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে এমএসসি

আগামী বছরের কোনো একসময়ে সক্ষমতার ভিত্তিতে মায়েরস্ককে ছাড়িয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কনটেইনার লাইনারে পরিণত হতে পারে মেডিটারেনিয়ান শিপিং কোম্পানি (এমএসসি)। ইতালীয়-সুইস শিপিং লাইনটির নতুন কার্যাদেশ, সেকেন্ডহ্যান্ড টনেজ মার্কেটে সক্রিয় সংশ্লিষ্টতা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে এমন সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে আলফালাইনার।

বর্তমানে মায়েরস্ক ও এমএসসির মধ্যে সক্ষমতার ব্যবধান ২ লাখ ২৫ হাজার টিইইউ। মায়েরস্কের বহরে রয়েছে ৭০৯টি জাহাজ। অন্যদিকে এমএসসির বহরে থাকা জাহাজের সংখ্যা ৫৮৮টি।

ব্যালাস্ট ওয়াটার রেকর্ড পদ্ধতির আধুনিকায়ন চায় বিমকো

সামুদ্রিক পরিবেশের ওপর ক্রুজ শিপ, বড় ট্যাংকার ও বাল্ক ক্যারিয়ারগুলো থেকে ফেলে দেয়া ব্যালাস্ট ওয়াটারের প্রভাব অপরিসীম। এ কারণে ব্যালাস্ট ওয়াটারের রেকর্ড রাখা প্রতিটি জাহাজের জন্য বাধ্যতামূলক।

ব্যালাস্ট ওয়াটার রেকর্ড বুকে (বিডব্লিউআরবি) সংরক্ষিত কোডের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রশাসন, বন্দর নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ, তৃতীয় পক্ষের নিরীক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট এক্সটার্নাল পার্টিগুলো প্রায়ই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। এই দ্বন্দ্ব নিরসনের লক্ষ্যেই বিডব্লিউআরবি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের (আইএমও) বিদ্যমান নির্দেশনা হালনাগাদ করার আর্জি জানিয়েছে বাল্টিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম কাউন্সিল (বিমকো)।

কার্বনমুক্ত হতে তিন বছরে ১৮০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে মিৎসুই

প্রথম জাপানি শীর্ষ শিপিং কোম্পানি হিসেবে ২০৫০ সাল নাগাদ নিজেদের বহর সম্পূর্ণরূপে কার্বন নিঃসরণমুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে মিৎসুই ওএসকে লাইনস। এ লক্ষ্যে আগামী তিন বছরে ১৮০ কোটি ডলারের বড়সড় বিনিয়োগ পরিকল্পনা করেছে তারা। 

কার্বন নিঃসরণ কমাতে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তিন বছরে কী কী পদক্ষেপ নেয়া হবে, সে বিষয়ে ২০২০ সালে একটি কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করে মিৎসুই। এতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার উদ্যোগের কথা বলা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

বৈরুত বন্দরের জন্য ৬০ কোটি ডলারের উন্নয়ন পরিকল্পনা সিএমএ সিজিএমের

গত আগস্টে রাসায়নিক বিস্ফোরণে ল-ভ- লেবাননের পোর্ট অব বৈরুতে আবার জমজমাট ভাব ফিরিয়ে আনতে প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সিএমএ সিজিএম।

বিশে^র চতুর্থ বৃহত্তম কনটেইনার পরিবহন ও শিপিং কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা ফরাসি-লেবানিজ বিলিয়নেয়ার জ্যাক সাদে। তার জন্মস্থান লেবাননের বৈরুত। তাই বৈরুত বন্দরের প্রতি সাদে পরিবারের দুর্বলতা রয়েছে। ওই দুর্ঘটনার পর থেকেই বন্দরের পুনর্গঠনে সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত রয়েছে সিএমএ সিজিএম। এবার তারা পুনর্গঠনের পাশাপাশি সম্প্রসারণের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা লেবানিজ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছে। এ কাজে মোট ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪০-৬০ কোটি ডলার।

১০০ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ চায় মিশর

সুয়েজ খালে আটকে যাওয়া জাহাজ এভার গিভেনকে সরানো গেছে ঠিকই, তবে জাহাজটি পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি এখনো। প্রায় ১০০ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ না দিলে জাহাজটিকে মিশর ছেড়ে বেরোতে দেয়া হবে না বলে জানিয়েছে সুয়েজ কর্তৃপক্ষ।

জাহাজটিকে নড়াতে কাজ করা ৮০০ শ্রমিকের পারিশ্রমিক, ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির খরচ ও ড্রেজিংয়ের কারণে খালের যে ক্ষতি হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে এই অর্থ দাবি করা হবে। তাছাড়া এভার গিভেনের কারণে সুয়েজের দু’পাশে যে ৪০০ জাহাজ আটকা পড়েছিল, তাদের অর্থও ফিরিয়ে দেয়া হবে।

করোনায় ভারতের জাহাজ ভাঙা শিল্পে স্থবিরতা

করোনা মহামারির কারণে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের জাহাজ ভাঙা শিল্প প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে দেশটিতে অক্সিজেনের মারাত্মক সংকট তৈরি হয়েছে। এ কারণে গ্যাস টর্চে ব্যবহৃত ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেনকে এখন করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে কাজে লাগানো হচ্ছে।

ভারতের সবচেয়ে বড় শিপব্রেকিং ইয়ার্ড আলাংয়ে জাহাজ কাটার কাজে অক্সিজেন ফুয়েল টর্চ ব্যবহার করা হয়। তবে সব অক্সিজেন এখন চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করায় আলাংয়ের ৯০ শতাংশ জাহাজ ভাঙা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

জলে ভাসতে যাচ্ছে বিশে^প্রথম হাইড্রোজেনচালিত কার্গো জাহাজ

শিগগিরই জলে ভাসতে যাচ্ছে বিশ্বের প্রথম হাইড্রোজেনচালিত কার্গো জাহাজ। প্যারিসের সিন নদীর জলে ভাসানো হবে একটি ইউরোপীয় ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্পের অধীনে নির্মিত জাহাজটি।

১৬৪ ফুট দীর্ঘ প্যালেট শাটল বার্জটি ইলেকট্রোলাইট থেকে উৎপাদিত সংকুচিত হাইড্রোজেন দ্বারা চালিত হবে। ইউরোপের শিপিং খাত-সংশ্লিষ্ট ১২টি অংশীদার প্রতিষ্ঠানের কনসোর্টিয়াম গৃহীত প্রকল্পটির অধীনে ফ্রান্স ও নরওয়ের জন্য হাইড্রোজেনচালিত জাহাজ নির্মাণ করা হবে। ২০১৮ সালে এই প্রকল্প ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি তহবিল থেকে ৫০ লাখ ইউরো সহায়তা পেয়েছে।

একযোগে কাজ করবে কোরিয়া রেজিস্টার হুন্দাই

দক্ষিণ কোরিয়ার জাহাজ নির্মাণশিল্পের প্রতিযোগিতাসক্ষমতা আরও জোরালো করতে একযোগে কাজ করবে কোরিয়া রেজিস্টার অব শিপিং ও হুন্দাই হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ গ্রুপ। এ বিষয়ে সম্প্রতি তারা একটি সমন্বিত কৌশলগত কর্মপরিকল্পনার ঘোষণা দিয়েছে। তাদের এ কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য পরিবেশগত নীতিকাঠামোর সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা।

কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে কোরিয়ার বৃহত্তম জাহাজনির্মাতা ও ক্লাস সোসাইটি তাদের প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ বিনিময় করবে এবং যৌথ গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

রেডিওঅ্যাক্টিভ পণ্যবাহী জাহাজকে বহিষ্কার করেছে শ্রীলংকা

সম্প্রতি একটি জাহাজ শ্রীলংকার হাম্বানটোটা বন্দরে নোঙর করে, যেটি চীনে রেডিওঅ্যাক্টিভ কার্গো নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু পণ্যের বিবরণের ঘোষণা না দেয়ায় শ্রীলংকান কর্তৃপক্ষ জাহাজটিকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

হাম্বানটোটা বন্দরটি শ্রীলংকায় অবস্থিত হলেও এটি পরিচালনা করছে চীন। সেখানেই নোঙর করে বিবিসি নেপলস, যেটি চীনে ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লুরাইড বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল। বিষয়টি জানতে পেরে শ্রীলংকার পারমাণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল জাহাজটিকে বন্দর ত্যাগের তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেয়।

সিঙ্গাপুরের প্রথম মেরিটাইম ড্রোন এস্টেট উদ্বোধন

সিঙ্গাপুরের প্রথম মেরিটাইম ড্রোন এস্টেট (এমডিই) গত ২০ এপ্রিল উদ্বোধন করা হয়েছে। মেরিটাইম অ্যান্ড পোর্ট অথরিটি অব সিঙ্গাপুর আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করে।

মেরিনা সাউথ পিয়ারের নিকটবর্তী এমডিই বিভিন্ন ড্রোন প্রযুক্তির উন্নয়ন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ করে দেবে। এসব ড্রোন প্রযুক্তি শোর-টু-শিপ ডেলিভারি ও রিমোট শিপ ইনস্পেকশনের মতো মেরিটাইম অ্যাপলিকেশনে কাজে লাগানো সম্ভব হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে খাত-সংশ্লিষ্ট ১১টি প্রতিষ্ঠান তাদের ড্রোন প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং সিস্টেম, ম্যানুফ্যাকচারিং ও কমিউনিকেশন সার্ভিস প্রদর্শন করেছে।

ডিএনভির সাইলেন্ট-নোটেশন পেয়েছে ওনেক্স পিস

পানির নিচে শব্দদূষণ কমানো অথবা পরিহারের সক্ষমতা থাকার নোটেশন পেয়েছে ওনেক্স পিস নামের একটি আফরাম্যাক্স ক্লাস অয়েল ট্যাংকার। পানামায় নিবন্ধিত জাহাজটির ক্লাস রেজিস্ট্রেশনে এই নোটেশন দিয়েছে ক্লাসিফিকেশন সোসাইটি ডিএনভি।

জাহাজটির নির্মাতা হুন্দাই সামহো হেভি ইন্ডাস্ট্রি। সম্প্রতি এটি মালিকপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বিশে^র প্রথম বাণিজ্যিক জাহাজ হিসেবে ডিএনভির সাইলেন্ট-ই নোটেশন পেয়েছে জাহাজটি। ওনেক্স পিসের এই অর্জন অন্যান্য জাহাজের মালিক ও জাহাজনির্মাতাদের পরিবেশবান্ধব জাহাজ তৈরিতে আরও বেশি উৎসাহ জোগাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সংবাদ সংকেত – মে

মালয়েশিয়ায় একটি ট্যাংকার ১২ এপ্রিল সশস্ত্র ডাকাতির শিকার হয়েছে। সান্দাকানের এমওটি টার্মিনালে বার্থিংয়ে থাকা হেনরি মায়েরস্কে এ ঘটনা ঘটেছে। এশিয়ায় এ নিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে তিনটি জাহাজ ডাকাতের কবলে পড়ল।

জাহাজের ভেতরের ভয়াবহ পরিবেশের কারণে কাতারি মালিকানাধীন একটি বাল্কারের ওপর ১৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে অস্ট্রেলিয়ান মেরিটাইম সেফটি অথরিটি। এর আগে জাহাজটিকে দুই মাস আটকে রাখা হয়।

বাল্টিক এক্সচেঞ্জের প্রধান সি ফ্রেইট সূচক ২১ এপ্রিল দশ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। ব্রাজিল থেকে আকরিক লোহা সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে কেপসাইজ ভেসেল সেগমেন্টে উল্লম্ফন এই অবস্থান অর্জনে ভূমিকা রেখেছে।

মিশরের ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে ওয়েস্ট নাইল ডেল্টা (ডব্লিউএনডি) প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের র‌্যাভেন ফিল্ড থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু করেছে বিপি। উত্তর আলেক্সান্দ্রিয়া ও পশ্চিম ভূমধ্যসাগরে ডিপওয়াটার অফশোর কনসেশন ব্লকে মোট পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে বিপির।

ব্রেক্সিটের কারণে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন বন্দরে কার্গো পরিবহনে বড় ধরনের ধস নেমেছে। অবশ্য কর্মকর্তারা বলছেন, ব্রেক্সিটের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব জানতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

চীনের কাছ থেকে তিনটি হাইব্রিড রোরো জাহাজ কিনছে ফিনল্যান্ডের শিপিং কোম্পানি ফিনলাইনস। এর মধ্যে প্রথম জাহাজের লঞ্চিং সম্প্রতি নানজিং জিনলিং শিপইয়ার্ডে সম্পন্ন হয়েছে।

ডাচ হেভি লিফট ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি জাম্বো শিপিং ও জার্মানির এসএএল হেভি লিফট সম্প্রতি তাদের পূর্বঘোষিত একীভূতকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। এখন থেকে জাম্বো-এসএএল-অ্যালায়েন্স নামে একক প্লাটফর্মের অধীনে তাদের কার্যক্রম পরিচালিত হবে।

ইতালির ভেনিসে বর্তমানে বড় আকারের ক্রুজ শিপ ডকিংয়ে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা চলছে। এতে সুফল মিলেছে তাৎক্ষণিক। এ কারণে দেশটির সরকার এ নিষেধাজ্ঞাকে স্থায়ী করার উদ্যোগ নিয়েছে।

২০২১ অর্থবছরে ভারতের গুজরাটে মুন্দ্রা পোর্টে প্রায় ৫৭ লাখ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে, যা বছরওয়ারি ১৮ শতাংশ বেশি। মুম্বাই বন্দরকে সরিয়ে ভারতের ব্যস্ততম কনটেইনার পোর্টে পরিণত হয়েছে মুন্দ্রা।

২০২০ অর্থবছরে প্রায় ৩৫০ কোটি ডলার মুনাফা অর্জন করেছে জাপানের ওশান নেটওয়ার্ক এক্সপ্রেস (ওয়ান), যা বছরওয়ারি ৩ হাজার ২২৯ শতাংশ বেশি। করোনা পরিস্থিতিতে ২০১৯ হিসাব বছরে মাত্র সাড়ে ১০ কোটি ডলার মুনাফা করেছিল কোম্পানিটি।

২০৩০ সাল নাগাদ কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জনের লক্ষ্য রয়েছে পানামা খাল কর্তৃপক্ষের। এ লক্ষ্যে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনায় বৈদ্যুতিক গাড়ি ও অন্যান্য বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার করবে তারা। সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত একটি কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করেছে কর্তৃপক্ষ।

“আমাদের রূপকল্প হচ্ছে বিশ্বমানের বন্দর ও নৌপরিবহন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা”

মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৯১ সালে বরিশাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার হিসেবে। এরপর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার পর্যন্ত মাঠ প্রশাসনের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে দায়িত্ব পালন ছাড়াও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগে অতিরিক্ত সচিব হিসেবেও কাজ করেন। ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তিনি যোগদান করেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসেবে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে গত কয়েক মাসে তাঁর কাজের অভিজ্ঞতা এবং নৌপরিবহন খাতের চ্যালেঞ্জ, সম্ভাবনা ও অর্জন নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন বন্দরবার্তার সাথে।

এক দশক ধরেই উচ্চপ্রবৃদ্ধিতে রয়েছে বাংলাদেশ। এটা সম্ভব হচ্ছে অর্থনৈতিক নানা কর্মকা- বিশেষ করে আমদানি-রপ্তানির ওপর ভর করে। আর পণ্য বাণিজ্য তথা আমদানি-রপ্তানিতে বন্দরের রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। দেশের নৌ এবং স্থল উভয় বন্দরই নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। আপনার মন্ত্রণালয়ের গুরুত্ব এবং কর্মপরিধি নিশ্চয়ই প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে?

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ধারণ করে দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন রেল, নৌ ও সড়ক পরিবহন খাতের সমন্বয়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সৃষ্টি হয়। পরবর্তী সময়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কার্যপরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় জাতীয় স্বার্থে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে পুনর্বিন্যাসপূর্বক বন্দর, জাহাজ চলাচল ও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৮৮ সালের জানুয়ারি মাসে বন্দর, জাহাজ চলাচল ও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে ‘নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়’ হিসেবে নামকরণ করা হয়। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ১২টি দপ্তর ও সংস্থার মাধ্যমে নৌপথের যোগাযোগ, নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারকরণ, নাব্যতা বৃদ্ধি, নৌবন্দরসমূহের ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, সমন্বিত ড্রেজিং কার্যক্রম, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের উন্নয়ন, স্থলবন্দর উন্নয়ন, সমুদ্রপথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্র্র্র্রসারণ এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে দক্ষ নাবিক তৈরির দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দপ্তর ও সংস্থাসমূহ হচ্ছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, নৌপরিবহন অধিদপ্তর, মেরিন একাডেমি, ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, গভীর সমুদ্রবন্দর সেল ও পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে এবং নৌপরিবহনমন্ত্রীর নির্দেশনায় সমুদ্রসম্পদ আহরণ এবং এ সংক্রান্ত স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা নিয়ে ‘ব্লু-ইকোনমি’ কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে অনেকগুলো দপ্তর এবং সংস্থা কাজ করছে। এতগুলো দপ্তর/সংস্থার মধ্যে সমন্বয় রক্ষা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। মন্ত্রণালয় কীভাবে এটা সম্ভব করছে?

আগেই বলেছি ১২টির মতো দপ্তর এবং সংস্থা নিয়ে এই মন্ত্রণালয়ের কাজ। এই মন্ত্রণালয়ের কাজগুলোর মধ্যে আছে নদীবন্দর, সমুদ্রবন্দর ও স্থলবন্দরসমূহের ব্যবস্থাপনা, বাতিঘর ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন ও সংরক্ষণ; নাব্যতা রক্ষাকল্পে নৌপথ ড্রেজিং, নিরাপদ নৌ-চলাচলের জন্য বয়া লাইটেড নির্দেশিকা ও পিসি পোল স্থাপন; নৌ-বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও সহযোগিতা; অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন ও জাহাজ চলাচল, মেরিন সার্ভিসেস এবং নিরাপদ নৌ-চলাচল নিশ্চিতকরণ; অভ্যন্তরীণ নৌপথের নাব্যতা উন্নয়ন ও সংরক্ষণ; যান্ত্রিক নৌযান ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ, নৌযান জরিপ ও রেজিস্ট্রেশন; সামুদ্রিক জাহাজ চলাচল ও নেভিগেশন; নৌবাণিজ্য জাহাজ সম্পর্কিত

প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ; মূল ভূখ- ও দ্বীপসমূহের মধ্যে এবং অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ; মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত বিষয়াদি সমন্বয় ও গবেষণা; জাহাজ চলাচল ও নেভিগেশন সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন; আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সাথে যোগাযোগ এবং বিভিন্ন দেশ ও বিশ্ব সংস্থার সাথে চুক্তি ও স্মারক সম্পর্কিত বিষয়াদি; আদালতে গৃহীত ফি ব্যতীত মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন চার্জ সম্পর্কিত বিষয়াদি ছাড়াও রয়েছে অনেক কর্মযজ্ঞ। তবে আমাদের রূপকল্প হচ্ছে বিশ্বমানের বন্দর, মেরিটাইম ও নৌপরিবহন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা; আর এ মন্ত্রণালয়ের অভিলক্ষ্য হচ্ছে সমুদ্র, নৌ ও স্থলবন্দরসমূহের আধুনিকায়ন, নৌপথের নাব্যতা সংরক্ষণ, মেরিটাইম সেক্টরে দক্ষ জনবল সৃষ্টি, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ যাত্রী ও পণ্য পরিবহন এবং বৈদেশিক বাণিজ্য সম্প্রসারণে সহায়তাকরণ, সুতরাং রূপকল্প এবং অভিলক্ষ্যের প্রতি দৃঢ়তা থাকলে সমন্বয় সহজ হয়, সাফল্য আসে।

উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে বিশ্বজুড়েই গুরুত্ব বাড়ছে মেরিটাইম তথা বন্দর খাতের। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বন্দরের সামর্থ্য বৃদ্ধি এবং দক্ষতা নিশ্চিত করার বিষয়টি সামনে রেখে বহুমাত্রিক উন্নয়নের কী ধরনের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে? নৌপরিবহনে আঞ্চলিক হাব হিসেবে বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে কীভাবে দেখছেন?

উন্নয়নশীল দেশে অভিগমনের পর ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে প্রবেশের লক্ষ্য নিয়ে আমরা এগোচ্ছি। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও জ্বালানি সেক্টরে বেশকিছু মেগা প্রকল্প চলমান রয়েছে। এ ছাড়া সরকার শতাধিক ইজেড, এসইজেড এবং ইপিজেড স্থাপন করছে, যাতে করে বড় আকারের আমদানি করা মালামাল সহজে এবং কম সময়ে তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। আমদানি পণ্যগুলো আমাদের জলসীমানায় পৌঁছানোর পর থেকে চট্টগ্রাম বন্দর মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। আমদানি বা রপ্তানি পণ্যের ডেলিভারি এবং গ্রহণের জন্য বন্দরটি সার্বক্ষণিক নিয়োজিত। এবং মনে রাখা দরকার, যদি আমরা দেশে টেকসই উন্নয়নের গতি বজায় রাখতে চাই, তাহলে পণ্যের ডেলিভারি দ্রুত এবং কার্যকরী হওয়া উচিত। এই সক্ষমতা অর্জনের জন্য আমরা মাল্টিমোডাল হাবসহ হিন্টারল্যান্ড সংযোগ স্থাপনের পাশাপাশি বন্দরের বিদ্যমান অবকাঠামো পুনর্নির্মাণের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করেছি। একই সাথে এটিও মনে রাখতে হবে যে, বিশ্বব্যাপী মেরিটাইম সংস্থাগুলো পরিবেশগত সমস্যা এবং কার্যকর জালানি ব্যবহারের ওপর বেশি সংবেদনশীল হয়ে উঠছে। আমাদের সমগ্র নির্মাণযজ্ঞে আমরা মূলত পরিবেশের যাতে কোনো রকম ক্ষতি না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখছি। আবার এতে করে অর্থনীতির চাকা যাতে গতিশীল থাকে তাতেও আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকছে।

কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ২০২০ ছিল নজিরবিহীন একটা বছর। মহামারির শুরুর দিকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অনেক বন্দরের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের বন্দর বিশেষ করে চট্টগ্রামের কথা বললে ব্যতিক্রমী চিত্র চোখে পড়ে। মহামারির মধ্যেও একদিনের জন্যও বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ হয়নি। মহামারির ধাক্কা সামলে দ্রুতই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এমনকি অর্থবছর শেষে প্রবৃদ্ধিও ধরে রেখেছে। কীভাবে এটা সম্ভব হলো?

মহামারির মধ্যেও আমরা আমদানি-রপ্তানি সচল রাখতে পেরেছি। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সময়োপযোগী ও উদ্ভাবনী কৌশল এবং তার বাস্তবায়নের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থাও এক্ষেত্রে সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছে। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষের কথাই সবার আগে

বলতে হবে। সমুদ্রগামী জাহাজের মাধ্যমে ভাইরাসটি যাতে দেশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেজন্য সংক্রমণের শুরুর দিকেই বিশেষ সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

আবার কনটেইনারজটের কারণে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে যাতে বিঘœ না ঘটে সেজন্য এপ্রিলের শেষ দিকে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। কনটেইনারজট সামলাতে প্রয়োজনীয় যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয় টাস্কফোর্সকে। এর সুফলও পাওয়া যায়। আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমের স্বাভাবিক গতি ধরে রাখা সম্ভব হয়। এছাড়া আমদানিকারকরা যাতে বন্দর চত্বর থেকে কনটেইনার খালাস করেন, সেজন্য স্টোর রেন্টে ছাড় দেওয়া হয়। বন্দর সচল রাখতে কর্মীরাও সাধারণ ছুটির মধ্যে পালা করে কাজ চালিয়ে গেছেন। এসবের ফলে মহামারি সত্ত্বেও ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে চট্টগ্রাম বন্দরে কার্গো, কনটেইনার ও জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে।

মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর সম্পর্কে কিছু বলুন। ২০২৬ সালের মধ্যে বন্দরের কার্যক্রম শুরু করার ব্যাপারে আপনি কতটা আশাবাদী?

সাড়ে ১৮ মিটার চ্যানেল তৈরির কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। ব্রেক ওয়াটারও প্রস্তুত। চ্যানেলটি দিয়ে মাতাবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটিতে প্রথমবারের মতো জাহাজ ভিড়েছে। প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে সেপ্টেম্বরেই জাপানের নিপ্পন কোয়ের সাথে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে এবং তারা কাজও শুরু করেছে। তাই বলা যায়, সবকিছু ঠিকমতোই এগোচ্ছে এবং ২০২৬ সালের মধ্যেই দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে মাতারবাড়ীর কার্যক্রম আমরা শুরু করতে পারব বলে আশা করছি।

মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর হলে ব্যবসায়ীরা বিশেষ কী সুবিধা পাবেন?

বাংলাদেশের রপ্তানির ক্ষেত্রে বর্তমানে প্রথমে ফিডার ভেসেলে করে পণ্য প্রথমে সিঙ্গাপুর বা কলম্বো বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে মাদার ভেসেলে করে রপ্তানি গন্তব্যে সেগুলো পৌঁছে দেওয়া হয়। একইভাবে আমদানি পণ্যও প্রথমে সিঙ্গাপুরে আসে এবং সেখান থেকে ফিডার ভেসেলে করে চট্টগ্রাম বন্দরে আনা হয়। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে মাদার ভেসেল বন্দরটিতে ভিড়তে পারবে। সেখান থেকে লাইটারেজ জাহাজে করে পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর বা অন্যান্য এলাকায় নিয়ে যাওয়া যাবে। এতে আমদানি-রপ্তানিতে সময় অনেক সাশ্রয় হবে। এতে ব্যবসায়ী বিশেষ করে রপ্তানিকারকরা সুবিধা পাবেন। এ কারণে রপ্তানির ক্ষেত্রেও লিড টাইম কমিয়ে আনা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

অভ্যন্তরীণ ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে স্থলবন্দরগুলোর ভূমিকাও কম নয়। দেশের স্থলবন্দর এবং সমুদ্রবন্দরের জন্য কী ধরনের নীতিমালার কথা বিবেচনায় রয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়?

অনেকেই অবগত আছেন যে, আঞ্চলিক বাণিজ্য পরিচালনার জন্য বাংলাদেশে ২৩টি স্থলবন্দর রয়েছে এবং দেশটির সাথে ভারতের প্রায় ৪ হাজার কিমি সীমানা রয়েছে। গত বছর সরকার সিলেট, সাতক্ষীরায় এবং খাগড়াছড়ি জেলায় নতুন তিনটি স্থলবন্দরের অবকাঠামো নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাতে ভারতের সাথে আঞ্চলিক যোগাযোগের মাধ্যমে বাণিজ্য বৃদ্ধি করতে পারে। একই পরিকল্পনার অধীনে বেনাপোল স্থলবন্দরকেও আধুনিকীকরণ করা হচ্ছে। আমরা এই বন্দরগুলোর মধ্যে খোলা ইয়ার্ড, গুদাম এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করছি যাতে যোগাযোগ ও ট্র্যাফিক সহজ হয়। প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সংযোগ স্থাপনের বিষয়টি সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। অন্যদিকে ভুটান ও নেপাল দেশের চট্টগ্রাম বন্দর এবং অন্যান্য সমুদ্রবন্দরের সুবিধা নিতে গভীর আগ্রহ দেখিয়েছে। জাতীয় নীতি ও আঞ্চলিক বাণিজ্যের সুবিধার্থে স্থলবন্দর এবং সমুদ্রবন্দরগুলোর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

পরিবহন খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ এর লজিস্টিকস এবং হিন্টারল্যান্ড সুবিধা। বর্তমান হিন্টারল্যান্ড ব্যবস্থা পরিবহন খাতে কীভাবে ভূমিকা রাখছে? বন্দরগুলোর হিন্টারল্যান্ড সংযোগ বৃদ্ধিতে কী কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে?

মেরিটাইম বন্দর উন্নয়নের সমান্তরালে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান প্রবণতার সাথে গতিশীল রাখতে, সড়ক, রেল এবং অভ্যন্তরীণ নৌপথ পরিবহনের (বিআইডব্লিউটিএ) ওপর জোর দিতে হয়। হিন্টারল্যান্ড যোগাযোগ মূলত যাতায়াত ব্যবস্থা ও বিভিন্ন ধরনের পরিবহনের উপর নির্ভরশীল; তবে খরচ, সময় এবং নিরাপত্তা বিবেচনায় প্রাধান্য পায়। বাংলাদেশ পণ্য পরিবহনের বড় অংশ অর্থাৎ ৮০ শতাংশ ঘটে সড়কপথে, ১৬ শতাংশ নৌপথে এবং ৪ শতাংশ রেলপথে। নদীমাতৃক দেশ হিসেবে আমাদের নৌপথের ব্যবহার বাড়াতে হবে, সড়কপথের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হবে এবং রেলপথে পণ্য ব্যবহার সহজলভ্য করতে হবে। এ লক্ষ্যে আমাদের বিভিন্ন মেগা প্রজেক্টসহ অসংখ্য কার্যক্রম রয়েছে। অচিরেই বাংলাদেশের হিন্টারল্যান্ড যোগাযোগ বিস্তৃত ও সহজ হবে।

প্রতিবেশী দেশের সাথে সমুদ্রসীমা মীমাংসা হওয়ায় বাংলাদেশ এখন একটি বিশাল সমুদ্র এলাকার অধিকারী। এই সমুদ্র এলাকায় ‘ব্লু-ইকোনমি’ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা সাজিয়েছে। এ পরিকল্পনায় কী থাকছে?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দূরদর্শী কূটনৈতিক সাফল্যের কারণে মূলত বাংলাদেশের পক্ষে এই রায় এসেছে। এই রায়ের ফলে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি টেরিটোরিয়াল সমুদ্র এলাকা, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চাহিদা মেটাতে তাকিয়ে আছে সমুদ্রসম্পদের দিকে।

২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে প্রায় ৯০০ কোটি। গবেষকরা বলছেন, বিপুল এই জনগোষ্ঠীর খাবার জোগান দিতে তখন সমুদ্রের মুখাপেক্ষী হতে হবে। আর এ কারণেই ব্লু-ইকোনমি বা সমুদ্রসম্পদনির্ভর অর্থনীতিকে গুরুত্বারোপ করার তাগিদ দিচ্ছেন গবেষক ও বিশ্লেষকরা। বিশে^র ৪৩০ কোটি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ¦ালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে। সমুদ্রের বুকে প্রাপ্ত অনবায়নযোগ্য সম্পদের মধ্যে রয়েছে তেল-গ্যাসসহ নানাবিধ খনিজ পদার্থ, যেমন ফসফরাইট ডিপোজিট, পলিমেটালিক ডিপোজিট, সালফাইড, ম্যাঙ্গানিজ নডিউলস ও ক্রাস্ট, গ্যাস হাইড্রেট, এভাপোরাইট ইত্যাদি। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের ন্যূনতম প্রায় ১ দশমিক ৭৪ মিলিয়ন টন খনিজ বালুর সমাহার রয়েছে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে। এখানে মোট ১৭ প্রকারের খনিজ বালুর সন্ধান পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে ৮টির অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে; যেমন ইলমেনাইট, জিরকন, রুটাইল, ম্যাগনেটাইট, লিউকোক্সিন, কিয়ানাইট, মোনাজাইট। বিশ্ব ব্যবহৃত শতকরা ৫০ ভাগের বেশি ম্যাগনেশিয়াম সামুদ্রিক পানি থেকে সংগ্রহ করা হয়। এই প্রাকৃতিক উৎস থেকে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরি সম্ভব। এ পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার যৌগ সমুদ্র থেকে পাওয়া গেছে। পরবর্তী প্রজন্মের ওষুধ এই সমুদ্র থেকেই পাওয়া যাবে বলে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন। এসব লক্ষ্য সামনে রেখে আমরা সমুদ্রবন্দর ও গভীর সমুদ্রবন্দরসমূহের উন্নয়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করে চলেছি, কোস্টাল শিপিংকে কার্যকরী করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখাসহ ব্লু-ইকোনমিকে সামনে রেখে দ্বিপক্ষীয় এবং আঞ্চলিক সমঝোতা স্মারক, চুক্তি ও প্রোটকলের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নৌবাণিজ্য সম্প্রসারণের কাজ করছি, ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি করছি।

এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) জ্বালানি, সার, খাদ্যশস্যসহ বিভিন্ন পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু সংস্থাটির বহরে জাহাজের সংখ্যা সেই অর্থে খুব বেশি নয়। বিএসসির জাহাজবহর শক্তিশালী করতে কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?

১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। দেশের দুই পুঁজিবাজারেই তালিকাভুক্ত বিএসসিকে সরকার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নেতৃস্থানীয় শিপিং কোম্পানিতে উন্নীত করতে যায়। সে লক্ষ্য সামনে রেখে বহরে জাহাজের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। চীন সরকারের অর্থায়নে ছয়টি জাহাজ ইতোমধ্যেই বিএসসির বহরে যুক্ত হয়েছে এবং এগুলো সমুদ্রপথে পরিচালিতও হচ্ছে। সংগৃহীত জাহাজগুলোর মধ্যে তিনটি প্রডাক্ট ট্যাংকার ও তিনটি বাল্ক ক্যারিয়ার।

বহর শক্তিশালী করতে আগামীতে জাহাজ ক্রয়ের আরও বেশকিছু প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। ৮০ হাজার টনের দুটি মাদার বাল্ক ক্যারিয়ার ও ১০ থেকে ১৫ হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন ১০টি বাল্ক ক্যারিয়ার ক্রয় প্রকল্প এর মধ্যে অন্যতম। এর বাইরে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ক্রুড অয়েল পরিবহনের জন্য প্রতিটি ১ লাখ টন থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি মাদার ট্যাংকার ক্রয়ের প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের আমদানি করা ডিজেল ও জেট ফুয়েল যাতে পরিবহন করা যায়, সেজন্য কেনা হচ্ছে ৮০ হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি মাদার প্রডাক্ট অয়েল ট্যাংকার।

দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটাতে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। আমদানি করা এই এলএনজি যাতে নিজস্ব জাহাজে পরিবহন করা যায়, সেজন্য প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটারের দুটি, প্রায় ১ লাখ ৭৪ হাজার ঘনমিটারের দুটি এবং প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার ঘনমিটারের আরও দুটি এলএনজি ভেসেল বিএসসির বহরে যুক্ত করার প্রাথমিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

শ্রীলঙ্কাসহ বিমসটেকের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ফিডার সার্ভিস চালুর বিষয়ে আলোচনা চলছে। এটি বিবেচনায় নিয়ে প্রতিটি ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টিইইউ ধারণক্ষমতার চারটি নতুন সেলুলার কনটেইনার জাহাজ ক্রয়ের আরও একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সেলুলার কনটেইনার জাহাজগুলো ডেনমার্ক সরকারের সহায়তায় নির্মিত হবে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানিতে উন্নীত হবে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম নৌপরিবহন অধিদপ্তর। নাবিকদের সার্টিফিকেট অব কম্পিট্যান্সি (সিওসি),সার্টিফিকেট অব প্রোফিসিয়েন্সি (সিওপি), কন্টিনিউয়াস ডিসচার্জ সার্টিফিকেট (সিডিসি) ও অভ্যন্তরীণ যোগ্যতার সনদসহ বিভিন্ন সেবা দিয়ে থাকে অধিদপ্তর। প্রথাগত পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসব সেবা ডিজিটাল করা এখন সময়ের দাবি। এ ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগ কী?

বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সেবাসমূহ ডিজিটাল হওয়াটা খুবই জরুরি, যাতে তা সহজ ও কার্যকরী হয়। সে লক্ষ্যে আমরা অনেক দূর এগিয়েছিও। সমুদ্রগামী ও অভ্যন্তরীণ জাহাজের নাবিকদের সিওসি এবং সিওপির মতো সনদের আবেদন এখন অনলাইনেই গ্রহণ করা হচ্ছে। সেই সাথে সনদ প্রণয়ন ও সনদ প্রস্তুতের তথ্য মোবাইল মেসেজের মাধ্যমে আবেদনকারীর কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি নাবিকদের পরীক্ষাসহ বিভিন্ন ধরনের আবেদন, সেইফ ম্যানিং সনদ, শিপ সার্ভেয়ার সনদ ও অন্যান্য বিষয়ে এনওসির জন্য অনলাইনে আবেদন দাখিলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নাবিকদের সাইন অন, সাইন অফ কার্যক্রমও অনলাইনে সম্পাদনের পদ্ধতি চালু করা হয়েছে।

সিডিসি জালিয়াতি যাতে বন্ধ হয়, সে পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। জালিয়াত  রোধকল্পে বিশেষ নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য যেমন আল্ট্রা ভায়োলেট, মাইক্রো সিকিউরিটি লাইন, অ্যান্টি-ফটোকপি ও কুইক রেসপন্স কোডযুক্ত কাগজে হাতে লেখার পরিবর্তে মেশিন প্রিন্টেড সিডিসি প্রবর্তন করা হয়েছে।

যে খাতই হোক না কেন, সেখান থেকে সাফল্য অর্জন করতে দক্ষ জনশক্তির বিকল্প নেই। দেশে নৌপরিবহন খাতে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে আপনারা কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন?

দক্ষ জনশক্তি তৈরি করার জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে মেরিন একাডেমি এবং ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি ৪ দশক ধরে নাবিক ও নৌকর্মী প্রস্তুত করে আসছে। এছাড়া দেশের বেশকিছু মেরিটাইম ইনস্টিটউট এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ে মেরিটাইম সম্পর্কিত বিষয় পড়ানো হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এবং সমুদ্রবিজয়ের পর ২০১৩ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে প্রথম মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সুতরাং, দক্ষ জনশক্তির সংকট ভবিষ্যতে আর থাকবে না।

আমাদের বর্তমান জাতীয় নৌপরিবহন নীতিমালাটি প্রণীত হয়েছে আজ থেকে প্রায় দুই দশক আগে। অন্যদিকে শিপিং খাতের অবকাঠামো ও বৈশিষ্ট্যগত ক্ষেত্রে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ঘটেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন নতুন একটি নৌপরিবহন নীতিমালা প্রণয়নের সময় হয়েছে আমাদের। আপনার কী মত এ বিষয়ে?

আমাদের বিদ্যমান নৌপরিবহন নীতিমালা আপডেট করা খুব বেশি প্রয়োজন, সেই সাথে আমাদের অর্থনীতির গতিশীলতার প্রয়োজনে নৌপরিবহন শিল্পটিকে উৎসাহ দিয়ে এটি উদারীকরণের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ নদীসমৃদ্ধ একটি উপকূলীয় দেশ; সুতরাং স্থানীয় পণ্য, যাত্রী পরিবহন বা আন্তর্জাতিক ফিডার শিপিংয়ের জন্য একটি দৃঢ় এবং বাংলাদেশের উপযোগী নৌপরিবহন নীতিমালার প্রয়োজন বেড়েই চলেছে। নীতিমালাটি দেশের বাণিজ্য উন্নয়ন এবং রপ্তানি আয় বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন। গত দশকে নৌপরিবহন ব্যবস্থা বাংলাদেশের কর্মসংস্থান সৃষ্টির একটি উৎস হিসেবে কাজ করেছে। এছাড়া জাতীয় রাজস্বের প্রধান অবদান রাখার জন্য এবং আমাদের অর্থনীতির আন্তর্জাতিকীকরণের জন্য চালক হিসেবে কাজ করার জন্য নৌপরিবহন ব্যবস্থার অবদান অনস্বীকার্য। আমি বিশ্বাস করি, সরকারের চিন্তাভাবনা আছে এবং অবশ্যই এই নীতিমালা-সংক্রান্ত সংকটের খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সমাধান হবে।

বন্দরবার্তাকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

আপনাকেও ধন্যবাদ। বাংলা ভাষায় মেরিটাইম চর্চাকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড় করাতে গত বছর ধরে বন্দরবার্তা যে নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়।

করোনাকালীন মহাসংকটে আমাদের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দরকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সচল রেখেছেন বন্দর শ্রমিকেরা

মে মাস এলেই ফিরে আসে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের ইতিহাস। কালে কালে শ্রমজীবী মানুষেরাই গড়ে দিয়েছেন পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। চট্টগ্রাম বন্দর আজ যে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আঞ্চলিক শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার, সেই অর্জনেও বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীদের অবদান অনস্বীকার্য। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি সেই সব শ্রমজীবী মানুষদের, যাঁদের অবদানে হাজার বছরের পরিক্রমায় চট্টগ্রাম বন্দর পেয়েছে আজকের অবস্থান। এই করোনাকালীন মহাসংকটে আমাদের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দরকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সচল রেখেছেন বন্দর শ্রমিকেরা। অভিবাদন জানাই বন্দরে কর্মরত সকল শ্রমিক-কর্মচারীদের। তাঁদের অক্লান্ত শ্রম আমাদের একদিন এনে দেবে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট, এই বিশ্বাস।

দেশের অর্থনীতির আকার বৃদ্ধির সাথে সাথে চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক জাহাজ চলাচলও বেড়েছে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। বর্তমানে বছরে প্রায় চার হাজার জাহাজ হ্যান্ডল করছে চট্টগ্রাম বন্দর। এটি কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিসংখ্যানে পৃথিবীর অনেক স্বনামধন্য বন্দরকে পেছনে ফেলে লয়েডস লিস্টে ৫৮তম স্থানে অবস্থান করছে। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিসংখ্যান ও প্রবৃদ্ধি সবসময় আলোচিত হলেও চট্টগ্রাম বন্দর কনটেইনারের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ খোলা (বাল্ক ও জেনারেল) পণ্যও হ্যান্ডল করে, যা সামগ্রিক পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের প্রায় অর্ধেক। আর এই খোলা পণ্য বা কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের সিংহভাগ হয় বঙ্গোপসাগরের বিস্তৃত জলরাশিতে, জনমানুষের চোখের আড়ালে। কারণ, কর্ণফুলী নদীর মোহনায় হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরকে কিছু প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা অতিক্রম করেই এগিয়ে যেতে হচ্ছে। খর¯্রােতা এবং জোয়ার-ভাটানির্ভর কর্ণফুলী চ্যানেলের গভীরতা তারতম্যের কারণে বেশি ড্রাফটের জাহাজগুলোকে অপেক্ষা করতে হয় বহির্নোঙরে।

কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে বহির্নোঙরের অংশীদারিত্ব প্রায় ৮০ ভাগ। চট্টগ্রাম বন্দরের বিশাল কর্মযজ্ঞের সাথে জড়িয়ে আছে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান। যাদের নিরলস পরিশ্রম অর্থনীতিকে প্রতিনিয়ত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বন্দরের জেটিতে বার্থ ও টার্মিনাল অপারেটরেরা কনটেইনারজাত পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের কাজ করছে, তেমনি বহির্নোঙরে পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের পুরোটাই করছে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরেরা। বহির্নোঙরে পণ্য খালাসের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের নিয়োজিত ৩০টি শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর কাজ করছেন। এরা পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য বন্দর কর্তৃক নিয়োজিত হয়ে থাকেন। বহির্নোঙরের শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরদের নিয়ে থাকছে এবারের বন্দরবার্তার মূল আয়োজন।

বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার চালিকাশক্তি হলো নৌপরিবহন খাত। কিন্তু বর্তমানে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণজনিত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও চলাচলে সীমাবদ্ধতা আরোপের বিষয়টি এখন নৌপথে পণ্য পরিবহনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে অনেক স্থানেই নাবিকেরা জাহাজ থেকে নামতে পারছেন না, নিজ দেশে ফিরতেও পারছেন না। আবার যাঁরা ঘরে আটকা, তাঁরাও জাহাজে আরোহণের জন্য নিকটবর্তী বন্দরে যেতে পারছেন না। প্রয়োজনীয় এন্ট্রি বা এক্সিট ভিসা সংগ্রহ করতে পারছেন না অনেক নাবিক। উপরন্তু উড়োজাহাজের বাণিজ্যিক ফ্লাইট বন্ধ থাকায় এ সমস্যা হয়ে উঠছে জটিলতর। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক সমুদ্রযান প্রায় ৯৬ হাজার। এসব জাহাজের নাবিক সংখ্যা প্রায় ১৮ লাখ, যাঁদের এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি এখন আটকা পড়ে আছে জাহাজ বা বাড়িতে। অনেক দেশই নাবিক পরিবর্তন নিষিদ্ধ করেছে, পুরো প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত কঠোর করে তুলেছে বাদবাকি রাষ্ট্রগুলো। নিয়ম অনুযায়ী, একজন নাবিক সাগরে টানা অবস্থান করতে পারবেন সর্বোচ্চ ১১ মাস। কিন্তু অনেকেই সাগরে অবস্থান করছেন ১৬ মাসেরও বেশি সময় ধরে। তাঁদের অনেকেই এখন বিপজ্জনকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। মাসের পর মাস সমুদ্রযাত্রার ধকল এবং বাড়ি ফিরতে না পারার মানসিক চাপ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে তাঁদের মধ্যে। শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর মতে, আধুনিক যুগে এসেও মধ্যযুগীয় দাসপ্রথার মতো অমানবিক আচরণের শিকার হচ্ছেন নাবিকেরা। কোভিড-১৯ সংকটে জাহাজে আটকে পড়া বিশ্ব বাণিজ্য পরিচালনের নেপথ্য নায়ক নাবিকদের নিয়ে রয়েছে বিশেষ রচনা।

প্রিয় পাঠক, আমরা চাই এ দেশের মেরিটাইমচর্চাকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড় করাতে। বৈচিত্র্যময় আঙ্গিকে, সমৃদ্ধ কলেবরে বন্দরবার্তার পথচলা বাংলাদেশের মেরিটাইম খাতের বিকাশে আরও সহায়ক হবে-সেই প্রত্যাশা। সবাইকে শুভেচ্ছা।

কোভিড-১৯ বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় সমুদ্রমানবরা

জীবনসঙ্গিনীর হাতে হাত রেখে যে তারিখে বিয়ের ম-পে পা রাখার কথা ছিল, সেদিন ব্রাজিলের সান্তোস বন্দরে জাহাজ ডকিং করাচ্ছিলেন আসল নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফিলিপাইনের অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার আলোনা (ছদ্মনাম)। টানা ১৬ মাস প্রায় কোনো ছুটির দিন ছাড়া একই জাহাজে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন তিনি, মাটিতে পা রাখার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে তিনবার। সঙ্গী আরও ৯ নাবিকের অবস্থাও তথৈবচ। মানসিক অবসাদে ভারাক্রান্ত দেহ চলতে চায় না, নিজেদের মধ্যে রাগারাগি-বিশৃঙ্খলা বাড়ছে, মনোবল-কর্মস্পৃহা শূন্যের কোটায়। সমুদ্রমানবরা বাড়ি ফিরতে চায়।

কিন্তু কেন এ পরিণতি?

বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার চালিকাশক্তি হলো নৌপরিবহন খাত। আমদানি-রপ্তানিতে জাহাজে মালামাল পাঠানোর চেয়ে সহজ ও সাশ্রয়ী অপর কোনো বিকল্প নেই। আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহনের ৮০ শতাংশই হয় সমুদ্রপথে, এ তথ্য দিয়েছে জাতিসংঘের বৈশ্বিক উন্নয়ন ও বাণিজ্যবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাড। কিন্তু বর্তমানে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণজনিত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও চলাচলে সীমাবদ্ধতা আরোপের বিষয়টি এখন নৌপথে পণ্য পরিবহনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কারণে নাবিকরা জাহাজ থেকে নামতেও পারছেন না, নিজ দেশে ফিরতেও পারছেন না। আবার যারা ঘরে আটকা, তারাও জাহাজে আরোহণের জন্য নিকটবর্তী বন্দরে যেতে পারছেন না। প্রয়োজনীয় এন্ট্রি বা এক্সিট ভিসা সংগ্রহ করতে পারছেন না অনেক নাবিক। উপরন্তু উড়োজাহাজের বাণিজ্যিক ফ্লাইট বন্ধ থাকায় এ সমস্যা হয়ে উঠছে জটিলতর।

বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক সমুদ্রযান প্রায় ৯৬ হাজার। এসব জাহাজের নাবিক সংখ্যা প্রায় ১৮ লাখ, যাদের এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি এখন আটকা পড়ে আছে জাহাজ বা বাড়িতে। তীরে এসেও তরী থেকে নামতে পারছে না অন্তত ৪ লাখ নাবিক। কোভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় বিমাতাসুলভ আচরণ করছে বন্দরগুলো। অনেক দেশই নাবিক পরিবর্তন নিষিদ্ধ করেছে, পুরো প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত কঠোর করে তুলেছে বাদবাকি রাষ্ট্রগুলো।

নিয়ম অনুযায়ী, একজন নাবিক সাগরে টানা অবস্থান করতে পারবেন সর্বোচ্চ ১১ মাস। কিন্তু অনেকেই সাগরে অবস্থান করছেন ১৬ মাসেরও বেশি সময় ধরে। এদের অনেকেই এখন বিপজ্জনকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। এছাড়া অবসন্ন নাবিকদের নিয়ে জাহাজ চালানো হলে ক্যাপ্টেনদেরই ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হতে পারে। মাসের পর মাস সমুদ্রযাত্রার ধকল এবং বাড়ি ফিরতে না পারার মানসিক চাপ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে তাদের মধ্যে। শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর মতে, আধুনিক যুগে এসেও মধ্যযুগীয় দাসপ্রথার মতো অমানবিক আচরণের শিকার হচ্ছেন নাবিকেরা। পরিস্থিতি দিন দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে নাবিক বিদ্রোহের আশঙ্কা করছে শিপিং কোম্পানিগুলো।

সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে ক্ষয়ক্ষতি

অতিসম্প্রতি ৯২৬ জন নাবিকের ওপর বিবিসি’র সহায়তায় একটি জরিপ চালিয়েছে নাবিকদের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশন (আইটিএফ)। দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারী ৫৯ শতাংশ নাবিকের চুক্তি বর্ধিত করা হয়েছে ক্রু চেঞ্জের ব্যবস্থা করতে না পেরে। ২৬ শতাংশ নাবিক আইনে বেঁধে দেওয়া সময়সীমার চেয়ে বেশি সময় ধরে টানা কাজ করে চলেছে, যার মধ্যে অনেকেই ১৮ মাস পার করে ফেলেছে। চুক্তির সময়সীমা পেরিয়ে গেলে আইনত যদিও কাজ বন্ধ করে দেওয়ার স্বাধীনতা রয়েছে একজন নাবিকের, সৌভাগ্যবশত কোনো জাহাজে একজন সমুদ্রমানবও এ কাজ করেনি, অন্তত ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। ফিলিপিনো আলোনার মতে, ‘স্থলভাগ থেকে বহুদূরে সমুদ্রের মধ্যিখানে যদি জাহাজ ডুবে যায় বা অপর কোনো দুর্ঘটনায় পতিত হয়, তা মানবজীবনকে ভয়ংকরভাবে প্রভাবিত করবে। নিজ দায়িত্বে অবহেলার ফলে যদি তা ঘটে, সেটি একজন নাবিকের জন্য চরম গ্লানিকর। তাই আমি নিজের কাজটা পছন্দ করি আর নাই করি, জাহাজকে সচল রাখতেই হবে।’        

আইটিএফের জরিপে নাবিকদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রাজনিত অবসাদের ফলে মানুষের জীবন, সম্পত্তি বা সামুদ্রিক পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ আকস্মিক দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা দশের মধ্যে কত বলে মনে করে তারা। পাঁচ বা তার বেশির পক্ষে মত দিয়েছে ৭১ শতাংশ নাবিক, ১৫ শতাংশ বলেছে এ সম্ভাবনা দশে দশ। ঠিকমতো বেতন পাচ্ছে না ৮ শতাংশ এবং যথাযথ চিকিৎসাসেবা পায়নি ৩০ শতাংশ। দাঁত ব্যথায় ডাক্তার দেখাতে পারেনি বলে প্লায়ার্স দিয়ে টেনে দাঁত তুলে ফেলেছে নাবিকেরা, গত কয়েক মাসে এমন বেশকিছু ঘটনার রেকর্ড রয়েছে হংকং শিপওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কাছে।

রাশিয়ান নাবিক অ্যালেক্সেভ কুলিবাবার ঘটনা ফলাও করে প্রচার করেছিল আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোক করার পরও কোভিড-১৯ জনিত নিষেধাজ্ঞার অজুহাতে তাকে জরুরি চিকিৎসাসেবা, ইমার্জেন্সি ইভ্যাকুয়েশন কিছুই দিতে অস্বীকৃতি জানায় ইন্দোনেশিয়া। বর্তমানে তার শরীর ঠিকমতো কাজ করে না, দৈনন্দিন কাজের জন্য অপরের ওপর নির্ভর করতে হয়। অথচ সময়মতো চিকিৎসাসহায়তা পেলে এ পরিণতি এড়ানো যেত।

লজিস্টিকের গোলকধাঁধায়

যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক উপকূলের কেপ হেনরি বহির্নোঙরে অপেক্ষমাণ থাকার সময় আলোনাদের ১৯০ মিটার দীর্ঘ রক সল্ট বোঝাই বাল্ক ক্যারিয়ারে নাবিকদের মধ্যে খুশির গুঞ্জন চলছিল। তাঁদের ম্যানিং এজেন্সি শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফেরার সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। কিন্তু চীন, কোরিয়া এবং চিলিতে একই প্রক্রিয়া ব্যর্থ হতে দেখে খুব একটা আশাবাদী হতে পারেনি আলোনা। অ্যাংকরেজ থেকে বন্দরে প্রবেশের পরই খারাপ সংবাদ। সময়মতো পেপারওয়ার্ক শেষ না করায় আর ফ্লাইট বাতিলের কারণে ম্যানিলা থেকে রিপ্লেসমেন্ট ক্রু না আসায় বাড়ি ফেরা হচ্ছে না এবারও।

ক্রু চেঞ্জ প্রক্রিয়াতে এমনিতেই অনেক বেশি পেপারওয়ার্ক থাকায় পুরো ব্যাপারটি বেশ সময়সাপেক্ষ। মহামারির কারণে সাথে যোগ হয়েছে ভ্রমণজনিত নিষেধাজ্ঞা। কম ফ্লাইট চলাচল, হরহামেশা বিনা নোটিশে উড়ান বাতিলের কারণে দেশ ছাড়তে পারছে না ডাঙায় আটকে থাকা নাবিকেরা। আবার কোভিড-১৯ এর সাথে লড়াইয়ে নিত্যনতুন বিধান আরোপ করছে বন্দরগুলো। বিভিন্ন বন্দরের ব্যবস্থা আবার ভিন্ন ভিন্ন। অল্প সময়ের জন্য বন্দরে আসা জাহাজগুলোর পক্ষে সেসব নিয়মকানুন সঠিকভাবে মেনে চলাটা মুশকিলের কাজ। ম্যানিং এজেন্সিগুলো অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে পেপারওয়ার্কে দেরি করে এই আশায় যে, পরের বন্দর হয়তো সাশ্রয়ী হবে বা সেখানকার ফ্লাইট হয়তো কম মূল্যে পাওয়া যাবে। আর এসব কিছুর মাশুল দিতে হচ্ছে আলোনার মতো সিফেয়ারারদের।

সরকারি সমুদ্র পরিবহন অফিসের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় চার হাজার নাবিক ও স্টাফ বিভিন্ন দেশের জাহাজে আটকা পড়ে আছেন

নরক দর্শন

স্থলের বেশির ভাগ শ্রমিকের তুলনায় নাবিকদের মজুরি ভালো। কিন্তু বেশি পারিশ্রমিকের মূল্য চুকাতে হয় দীর্ঘ সময় ঘর-পরিবার-প্রিয়জনদের কাছ থেকে দূরে থেকে। নাবিকের চাকরি করে তরুণ থাকতে থাকতে অনেক অর্থ উপার্জন করতে চান আলোনা। এরপর কোনো ব্যবসা শুরু করবেন এই ইঞ্জিনিয়ার, যাতে আর সমুদ্রে ফিরতে না হয়। ১৬ মাস ধরে টানা সমুদ্রে থেকে মনে হয় অনন্তকাল বুঝি প্রিয়তমা হবু বধূর মুখখানি দেখা হয়নি তার, পা ফেলা হয়নি মাটির পৃথিবীতে। দীর্ঘ সময় টিনের প্রক্রিয়াজাত খাবার খেতে বাধ্য হওয়ায় শারীরিকভাবেও ভেঙে পড়ছেন তারা।

অবশ্য ব্রাজিলে পৌঁছেই সুসংবাদ। ফিলিপাইন থেকে অবশেষে রওনা হতে পেরেছে রিপ্লেসমেন্ট ক্রু। ব্রাজিলে আসার পর কোভিড টেস্টও যদি নেগেটিভ হয়, আলোনা এবং তার সঙ্গীরা শেষ পর্যন্ত বাড়ির পথ ধরতে পারবে।

সবাই বাধা সবার সাথে

মহামারির মধ্যেও বৈশ্বিক অর্থনীতিকে চালু রাখতে নিরন্তর অমানুষিক পরিশ্রম করে চলেছে নাবিকেরা। কিন্তু এটি কখনই একপক্ষীয় কোনো কাজ নয়। ১৯০টি দেশে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভারের কথাই ধরা যাক। ৭০টি দেশে ছড়িয়ে আছে তাদের কারখানা। তাই কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের প্রথমদিকে যখন চীন লকডাউনে ছিল, অন্য দেশে উৎপাদন চালিয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানটি। পরে যখন ইউরোপ আর ভারত কঠোর লকডাউনে, চীনে আবার বাণিজ্য শুরু করে তারা। পরিকল্পনা বদলালেও ব্যবসা থামেনি আর শিপিং ছাড়া এর কিছুই সম্ভব হতো না। কারণ সাবান বা আইসক্রিম-যা-ই তৈরি করুন না কেন, কাঁচামাল হিসেবে যে কোকোবীজ, সয়াবিন তেল, ভ্যানিলা এবং পামতেল প্রয়োজন, তা আসে বিশে^র বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। এই অবস্থায় যেসব নাবিক ইতোমধ্যেই বাণিজ্যিক জাহাজে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে, তাদের সিংহভাগ ধর্মঘট করে বসতে পারে। নাবিকেরা যেন নির্বিঘেœ বাড়ি ফিরতে পারে, তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় সকল আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে আইটিএফ। দক্ষ নাবিকেরা আইনি উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে ইতিমধ্যেই মন্দায় আচ্ছন্ন বিশ্ব অর্থনীতির জন্য এ পদক্ষেপ ঘোর সংকটের সূচনা করতে পারে।

গত জুনে সমুদ্রযাত্রায় অস্বীকৃতি জানায় জার্মান মালিকানাধীন একটি ট্যাংকার। এ বিষয়ে ট্যাংকার কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হলো, পর্যাপ্ত সংখ্যক ক্রু ও নাবিক প্রতিস্থাপনের আগ পর্যন্ত কোনোভাবেই সাগরে যাত্রা করবে না জাহাজটি। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত নাবিক ও ক্রু নিয়ে অনিরাপদ চলাচলের শঙ্কা দূর করতে কঠোর অবস্থান বেছে নিয়েছে ট্যাংকারটি। মেরিটাইম খাতসংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, সমুদ্র বাণিজ্যের সাথে যুক্ত অন্যান্য জাহাজও ট্যাংকারটিকে অনুসরণ করতে পারে।

চাই জোরালো পদক্ষেপ

ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের (আইএমও) পক্ষ থেকে গত মাসে নিরাপদে জাহাজের নাবিক পরিবর্তন-সংক্রান্ত ১২ দফাসংবলিত একটি প্রটোকল প্রকাশ করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন দেশের সরকার এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নে দেরি করায় বর্তমানে প্রতি সপ্তাহেই সাগরে আটকা পড়া নাবিকের সংখ্যা বাড়ছে। গত মার্চে বৈশ্বিক পণ্য সরবরাহ অক্ষুন্নে  রাখার স্বার্থে শিপিং কোম্পানি এবং ইউনিয়নগুলো এক সমঝোতার মাধ্যমে ১৬ জুন পর্যন্ত নাবিক পরিবর্তনের কার্যক্রম বন্ধ রেখেছিল। কিন্তু সেটি ছিল একটি বড়, বৈশ্বিক  সমস্যার স্বল্পমেয়াদি সমাধান। ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের মহাসচিব স্টিভ কটন এ প্রসঙ্গে বলেন, নাবিকদের সাগরে আটকে রাখতে ১৬ জুনের পর এ বন্দোবস্তের মেয়াদ কোনোভাবেই বাড়ানো সম্ভব নয়। তারা এরই মধ্যে চুক্তির বাইরে দীর্ঘ সময় ধরে সাগরে অবস্থান করেছেন। আমরা নাবিকদের বলব না, তাদের জাহাজে থাকতে হবে। বরং তারা যদি বের হয়ে আসতে চায়, আমরা তাদের সহায়তা করব।

ভেসে চলেছেন বাংলাদেশীরাও  

সরকারি সমুদ্র পরিবহন অফিসের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় চার হাজার নাবিক ও স্টাফ বিভিন্ন দেশের জাহাজে আটকা পড়ে আছে। আকাশপথের পরিবহন সচল না হলে অনিশ্চয়তা আরও বাড়বে তাঁদের পরিবারে। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) ৬টি জাহাজের ১৫৬ জন নাবিক, অফিসার ও স্টাফ বিভিন্ন দেশে আটকা পড়ে আছে। আকাশপথ সচল না হওয়া পর্যন্ত তাদের জাহাজে থাকার নির্দেশ দিয়েছে বিএসসি কর্তৃপক্ষ। আন্তর্জাতিকভাবে যখন দক্ষ নাবিকের সংকট দেখা দিয়েছে, তখন চুক্তি নবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশি অনেক নাবিক এখন সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে। কিন্তু তাদেরকেও পরিবার রেখে দূরে থেকে দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার ধকল সইতে হবে। যাদের অনেকেই গত ৬ মাসের বেশি সময় ধরে সমুদ্রে আছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা দাবি তুলেছেন, বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর নাবিকদের জন্য ‘নিরাপদ করিডোর’ স্থাপন করা হোক। একই সঙ্গে সমুদ্রগামী নাবিকদের অর্থনীতির ‘অপরিহার্য কর্মী’ স্বীকৃতি দিয়ে সমুদ্রযানে কাজে যোগদান বা সেখান থেকে ফেরার ক্ষেত্রে মুক্তভাবে চলাচলের সুযোগ দেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন তারা। পাশাপাশি দাপ্তরিক নথিপত্রকে পরিচয়ের প্রামাণিক দলিল বিবেচনায় নিয়ে বিমানবন্দরগুলোয় নাবিকদের নিরাপদ ট্রানজিট নেওয়ার সুযোগ তৈরিরও দাবি তুলেছেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক নৌপরিবহন বিশেষজ্ঞরা।

এক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরকে মডেল হিসেবে দেখা যেতে পারে। ২০২০ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪০ হাজারের বেশি ক্রু চেঞ্জ হয়েছে এখানে। সকল নাবিক ২ সপ্তাহের আবশ্যিক আইসোলেশন পার করে অনুমোদিত স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে কোভিড টেস্ট করিয়ে নেগেটিভ আসার পর সিঙ্গাপুরে প্রবেশ করছে। অন বোর্ড হওয়ার আগে অন্তত ৭২ ঘণ্টা বন্দরে স্থাপিত ভাসমান আইসোলেশন সেন্টারে অবস্থান করে তারা জাহাজে উঠছে। শীর্ষস্থানীয় অন্য বন্দরগুলোও এ পদ্ধতি অনুসরণ করতে চলেছে।

আশা করা যায় অচিরেই এ অমানবিক পরিস্থিতির অবসান ঘটবে, আলোনার মতো সমুদ্রমানবেরা ফিরে যাবে প্রিয়জনের কাছে।

বহির্নোঙরে পণ্য খালাসের নেপথ্যে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর

ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমা আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে নির্ধারিত হওয়ায় বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চল, ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার অধিকার পেয়েছে। দেশের বিস্তৃত সমুদ্র অঞ্চলে সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকা-ের বড় একটি অংশ বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় পুরোটাই হয়ে থাকে এই সমুদ্রাঞ্চলের মাধ্যমে। একেবারে নগণ্য পরিমাণে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে বৈদেশিক বাণিজ্য হয়ে থাকে স্থলবন্দরগুলোর মাধ্যমে। সমুদ্র উপকূল থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এ এলাকায় চলাচলকৃত আন্তর্জাতিক রুটের জাহাজগুলোর ওপর নজরদারির সুযোগ তৈরি হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-ের পরিধি বৃদ্ধির সাথে সাথে ক্রমবর্ধমান আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে জাহাজ আগমনের সংখ্যা। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দর ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে মাথায় রেখে বহির্নোঙরের কলেবরও বৃদ্ধি করেছে। এক দশকে বহির্নোঙরের বিস্তৃতি সাড়ে ৬ গুণ বৃদ্ধি করে ৫০ নটিক্যাল মাইল করা হয়েছে। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরসহ দেশের নির্মাণাধীন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর ভবিষ্যৎ চাহিদা মাথায় রেখে বাড়ানো হয়েছে বহির্নোঙর এলাকা।

চট্টগ্রাম বন্দর জোয়ার-ভাটানির্ভর কর্ণফুলী নদীর পাড়ে গড়ে ওঠায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পণ্যবাহী বড় আকারের জাহাজ কর্ণফুলী চ্যানেলে প্রবেশ করতে পারে না। সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফট ও ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যরে আন্তর্জাতিক রুটের অপেক্ষাকৃত ছোট জাহাজগুলোকে চলাচল করতে হয় এই চ্যানেলে। ফলে বড় জাহাজগুলোকে বন্দরের বহির্নোঙরে লাইটার জাহাজে পণ্য খালাস করতে হয়। বহির্নোঙরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং না হলেও খোলা পণ্যের সিংহভাগ খালাস হয়। চট্টগ্রাম কাস্টমসের নির্দেশনা, নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারিতে এসব পণ্য খালাস করে বন্দর নিয়োজিত শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর।

কেন শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর

শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর কেন জানতে হলে প্রথমেই জানতে হবে লাইটারিং বা নৌযান থেকে নৌযানে পণ্য স্থানান্তর কী। লাইটারিং হলো বিভিন্ন আকারের নৌযানের মধ্যকার পণ্য স্থানান্তর প্রক্রিয়া। এটি হতে পারে বড় নৌযান থেকে ছোট নৌযানে কিংবা ছোট নৌযান থেকে বড় নৌযানে পণ্য স্থানান্তর। লাইটারিংয়ের ধারণাটি প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো। বাষ্পীয় ইঞ্জিনেচালিত বড় আকারের নৌযান যখন এক দেশ থেকে অন্য দেশে পণ্য আনা-নেওয়া করত, তখন অপেক্ষাকৃত ছোট বন্দরে প্রবেশ করতে পারত না। ফলে ছোট ছোট নৌযানে করে পণ্য খালাস করে বন্দরে নেওয়া হতো। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, জীবজন্তু এ পদ্ধতিতে খালাস করা হতো। এছাড়া বন্দর থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পণ্য পরিবহন করতেও লাইটারিংয়ের প্রয়োজন হয়। লাইটারিংয়ের কাজটি করার জন্যই শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর। নিজস্ব শ্রমিক ও যন্ত্রপাতি দ্বারা পণ্য লাইটারিংয়ের কাজ করে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে নিবন্ধিত শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরা কাজ করছে।

বহির্নোঙরে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর

চট্টগ্রাম বন্দরের বিশাল কর্মযজ্ঞের সাথে জড়িয়ে আছে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান। যাদের নিরলস পরিশ্রম  অর্থনীতিকে প্রতিনিয়ত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বন্দরের জেটিতে বার্থ ও টার্মিনাল অপারেটরেরা কনটেইনারজাত পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের কাজ করছে, তেমনি বহির্নোঙরে পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের পুরোটাই করছে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরা। বহির্নোঙরে পণ্য খালাসের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের নিয়োজিত ৩০টি শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর কাজ করছে। এরা পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য বন্দর কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে থাকে।

 মাদার ভেসেল থেকে পণ্য লাইটারিংয়ের সর্বশেষ তথ্য বার্থিং মিটিংয়ে উপস্থাপন করতে হয় সংশ্লিষ্ট শিপিং এজেন্ট ও শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরকে। কাস্টমস ও বন্দরের ডিটিএম (অপারেশন) এবং মেরিন বিভাগ পুরো প্রক্রিয়াটি সমন্বয় করে। ডিটিএম (অপারেশন) এর দপ্তর থেকে লাইটারিংয়ে প্রাপ্য রাজস্ব প্রাপ্তির বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয়।

কীভাবে পণ্য হ্যান্ডলিং করা হয়

বন্দরের জেটির মতো শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষায় ২৪ ঘণ্টা হ্যান্ডলিং কার্যক্রম চলে বহির্নোঙরে। বর্ষাকালের বৈরী আবহাওয়ায় সাগর যখন উত্তাল থাকে, তখন সাময়িক বন্ধ থাকে পণ্য খালাসের কাজ। বন্দরের জেটিতে জাহাজ ভিড়িয়ে পণ্য খালাস করতে যেমন নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, তেমনি বহির্নোঙরে পণ্য খালাস করতেও অনুসরণ করতে হয় নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া। শুল্ক দিয়ে কাস্টমস ও বন্দরের নিয়মনীতি অনুযায়ী পণ্য খালাস করতে হয়। বহির্নোঙরে মূলত আমদানীকৃত খোলা পণ্য খালাস হয়ে থাকে। রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ একেবারে নগণ্য। শিপিং এজেন্ট আমদানিকারকের পক্ষে জাহাজে করে পণ্য আমদানির ঘোষণা দেন। এরপর শিপিং এজেন্টের মনোনীত শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর পণ্য খালাসের প্রক্রিয়া শুরু করে। আমদানিকারক শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরকে লাইটার জাহাজ সরবরাহ করে। এজন্য আমদানিকারককে লাইটার জাহাজ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের মাধ্যমে লাইটার বরাদ্দ নিতে হয়। বহির্নোঙরে অবস্থান করা মাদার ভেসেলে পৌঁছে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরের সুপারভাইজার পণ্যবাহী জাহাজের সুপারভাইজার ও ক্যাপ্টেনের সাথে যোগাযোগ করে খালাস প্রক্রিয়া শুরু করেন। আমদানিকারক ও জাহাজের সার্ভেয়ার পণ্যের জরিপকাজ শেষ করার পর শুরু হয় খালাসের কাজ। সাধারণত দুটি পদ্ধতিতে পণ্য খালাস হয়। এর মধ্যে একটি হলো কাস্টমস আউটপাস বিল অব এন্ট্রির বিপরীতে বন্দরের রিভার ডিউস পরিশোধ করে সরাসরি লাইটার জাহাজে খালাস করা। আর অন্যটি হলো কাস্টমস গ্যারান্টির বিপরীতে ‘গ্রিনবোট নোট’-এর মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট লাইটারে পিও অনবোর্ডের তত্ত্বাবধানে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস এবং পরবর্তীতে কাস্টমস আউটপাসের বিপরীতে ‘ব্লু বোট নোট’-এর মাধ্যমে পণ্য খালাস।

বহির্নোঙরে পণ্য খালাসের জন্য আমদানিকারক শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরকে লাইটার জাহাজ সরবরাহ করে। এজন্য আমদানিকারককে
লাইটার জাহাজ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের মাধ্যমে লাইটার বরাদ্দ নিতে হয়

যেভাবে কাজ করেন শ্রমিকেরা

কাস্টমসের শুল্কায়নের আনুষ্ঠানিকতা, আমদানিকারক ও জাহাজের সার্ভেয়ারের পণ্য জরিপের পর শুরু হয় খালাস। পণ্য খালাসের শুরুতেই শ্রমিকদের গ্যাং নির্ধারণ করা হয়। গ্যাং বলতে পণ্যবাহী জাহাজের কোন ক্রেনে কত জন শ্রমিক কাজ করবে তা নির্ধারণকে বোঝায়। পণ্য ও জাহাজের আকার অনুযায়ী ৫, ৯, ১১ ১৮ জনের গ্যাং হয়ে থাকে। কাজের সুবিধার্থে গ্যাং নির্ধারণ করা হয়ে আসছে শুরু থেকেই। শ্রমিকদের কাজ তদারকিতে জাহাজের প্রতিটি হ্যাজে একজন করে ফোরম্যান থাকেন। আর পুরো খালাস কার্যক্রমটি তদারকি করেন একজন সুপারভাইজার, কাজের প্রতিবেদন তৈরিতে কাজ করেন একজন রিপোর্টারও। কার্গো পণ্যের ক্ষেত্রে শ্রমিক, ফোরম্যান ও সুপারভাইজারের পাশাপাশি কাজ করেন ট্যালি ক্লার্ক। বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে কী পরিমাণ পণ্য খালাস হচ্ছে, সেটির হিসাব রাখাই ট্যালি ক্লার্কের কাজ।

পণ্য খালাসে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরদের জাহাজের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের পাশাপাশি নিজস্ব যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে গ্রেভ, এক্সক্যাভেটর, পে-লোডারসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি। শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরদের অপারেটররাই এসব যন্ত্রপাতি পরিচালনা করেন। আর জাহাজের ক্রেন পরিচালনায় কাজ করেন উইন্সম্যান।

শ্রমিক সুরক্ষা

বহির্নোঙরে জাহাজ থেকে জাহাজে পণ্য হ্যান্ডলিং সাধারণ জেটিতে পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের মতো সহজ বিষয় নয়। পাশাপাশি দুটি জাহাজের পণ্য হস্তান্তরে প্রতিনিয়ত সতর্ক থাকতে হয় নিয়োজিত সুপারভাইজার, রিপোর্টার, ফোরম্যান ও শ্রমিকদের। এতে প্রথমেই যে বিষয়টি সামনে আসে, সেটি হলো শ্রমিকদের সুরক্ষা। শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে নির্দেশনা রয়েছে সুরক্ষা উপকরণ ব্যবহারের। এর মধ্যে রয়েছে মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, হেলমেটসহ অন্যান্য নিরাপত্তা উপকরণ।

যেসব পণ্য হ্যান্ডলিং হয়

অর্থনীতি ও দেশের চলমান উন্নয়ন কর্মকা-ের সাথে তাল মিলিয়ে গত কয়েক বছরে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিনিয়ত বাড়ছে আমদানির পরিমাণ। এ বিশাল পরিমাণ পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরকে। বিশেষ করে অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য আমদানীকৃত নির্মাণসামগ্রী যেমন পাথর, রড তৈরিতে ব্যবহৃত স্ক্র্যাপ ও অন্যান্য ভারী যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ও শিল্পের কাঁচামালের পাশাপাশি উন্নয়ন প্রকল্পের এ বাড়তি হ্যান্ডলিংয়ের কাজটি করছে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরেরা। শুধু উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য আনা সামগ্রীই নয়; নিয়মিতভাবে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরেরা চাল, ডাল, গম, রেফশিট, চিনি, সিমেন্ট ক্লিংকার, স্ক্র্যাপ স্টিল, কয়লা ও ভারী যন্ত্রপাতি হ্যান্ডলিং করে আসছে। পদ্মা সেতু, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য আনা ভারী যন্ত্রপাতি হ্যান্ডলিং করে নির্দিষ্ট সময় ও গন্তব্যে পৌঁছে দিতে ভূমিকা রাখছে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরেরা।

কর্ণফুলী নদীর উজানে পণ্য খালাসে অপেক্ষমান লাইটার জাহাজ । এসব লাইটার জাহাজই চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে বন্দরের জেটি
কিংবা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নৌপথে আমদানীকৃত পণ্য সহজে ও কম খরচে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছে

অংশগ্রহণ আছে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলেরও

শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর পণ্য বা কার্গো জাহাজ থেকে জাহাজে স্থানান্তরের কাজ করে। বড় আকারের জাহাজ থেকে পণ্য ছোট আকারের জাহাজে নেওয়াই শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরের কাজ। ছোট আকারের জাহাজকে বলা হয় লাইটার জাহাজ। আমদানিকারক, শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর আর ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের সমন্বয়ে বহির্নোঙরে পণ্য লাইটারিং হয়ে থাকে। ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) লাইটার জাহাজের বেসরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ডব্লিউটিসি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে মাদার ভেসেল থেকে বন্দরের জেটি কিংবা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নৌপথে আমদানীকৃত পণ্য সহজে ও কম খরচে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছে। সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে কমিটির মাধ্যমে ডব্লিউটিসি লাইটার সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত করে থাকে। লাইটার জাহাজগুলোর ধারণক্ষমতা ৮০০ থেকে ৩ হাজার মেট্রিক টন। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে লাইটার জাহাজে খালাসকৃত পণ্য সদরঘাট লাইটার জেটি ছাড়াও দেশের প্রত্যন্ত এলাকা যেমন নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুর (সিঅ্যান্ডবি), বরিশাল, নওয়াপাড়া, বাঘাবাড়ী, নগরবাড়ী, ঘোড়াশাল, আশুগঞ্জ, মিরপুর, ভৈরবসহ বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যায়।

চট্টগ্রামের আনু মাঝির ঘাটে লাইটার জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করে ট্রাকে তুলছেন শ্রমিকরা

চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন ও অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে এবং সারা দেশে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে পণ্য পরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে ২০০৫ সালে বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (ভিসিভোয়া) ও কোস্টাল শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব) একসাথে মিলিত হয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল বা ডব্লিউটিসি। এ সেল গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে মাদার ভেসেল থেকে বন্দরের জেটি কিংবা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নৌপথে আমদানীকৃত পণ্য সহজে ও কম খরচে পৌঁছে দেওয়া এবং চট্টগ্রাম বন্দর তথা দেশের টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে অভ্যন্তরীণ জাহাজ দ্বারা পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা। ডব্লিউটিসি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে মাদার ভেসেলের অবস্থানকাল কমানোর পাশাপাশি বন্দরের সুনাম বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল গঠনের আগে আমদানিকারক ও লাইটার মালিকদের মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না। ফলে ভাড়া ও পণ্য পরিবহনে বিশৃঙ্খলা ছিল। ডব্লিউটিসি আমদানিকারক, কার্গো এজেন্ট এবং লাইটার জাহাজ মালিকসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের মধ্যে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আমদানিকারকের দুয়ারে পণ্য পৌঁছানোর যুক্তি সংগত ভাড়া নির্ধারণ করে দেয় ডব্লিউটিসি, ফলে অতিরিক্ত ভাড়া গ্রহণের সুযোগ নেই।

বর্তমানে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের অধীনে ৭৫০টির অধিক লাইটার জাহাজ চলাচল করে। যেগুলোর পরিবহন সক্ষমতা প্রায় ৯ লাখ মেট্রিক টন। ডব্লিউটিসি প্রতিষ্ঠার পর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা মাদার ভেসেল থেকে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন গন্তব্যে পণ্য পরিবহনে কাজ করছে। সঠিক সময়ে মাদার ভেসেল থেকে পণ্য খালাসে লাইটার সরবরাহ করে ডব্লিউটিসি।

আমদানিকারকের পণ্য পরিবহনে নৌপথে চলাচলকারী জাহাজগুলোকে নির্দিষ্ট নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। বহির্নোঙর থেকে পণ্য পরিবহনে ইচ্ছুক এমন নৌযানকে পণ্য পরিবহনের আগে অবশ্যই ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলে নিবন্ধিত হতে হয়। এক্ষেত্রে সরকারি রাজস্ব পরিশোধ ও সার্ভে সার্টিফিকেট ছাড়া কোনো নৌযানকে পণ্য পরিবহনের অনুমতি দেয় না ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল। এ ছাড়া সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে ও রাজস্ব পরিশোধ করা হয়নি এমন পণ্য পরিবহনে লাইটার বরাদ্দ দেয় না ডব্লিউটিসি।

চট্টগ্রাম বন্দরে যেমন বহির্নোঙর থেকে জেটিতে জাহাজ ভিড়তে বার্থিং মিটিং পরিচালিত হয়, ঠিক তেমনি পণ্য পরিবহনে লাইটার জাহাজ বরাদ্দ দিতে প্রতিদিন ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের অফিসে বার্থিং মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। আমদানিকারকের দেওয়া লাইটার জাহাজের চাহিদার ভিত্তিতে লাইটার বরাদ্দ দেওয়া হয়। আমদানিকারকের পক্ষে কার্গো বা পণ্যের এজেন্ট ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলে চাহিদা উত্থাপন করে। শুধু লাইটার বরাদ্দ দেয় এমন নয়, লাইটার কোন গন্তব্যে যাচ্ছে তা নিয়মিত মনিটরিংও করে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল। এছাড়া লাইটার বরাদ্দ পাওয়ার পর, আমদানিকারকের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পণ্য খালাস পর্যন্ত যেকোনো সমস্যা বা সৃষ্ট জটিলতা মীমাংসায় কাজ করে ডব্লিউটিসি। ফলে আমদানিকারকে পণ্যের কোনো ধরনের ঝামেলা বা সমস্যায় পড়তে হয় না সঠিক সময়ে পণ্যের প্রাপ্তি নিয়ে। এছাড়া খাদ্যদ্রব্য ও কৃষিকাজে ব্যবহৃত সার পরিবহনের তথ্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে সরবরাহ করে ডব্লিউটিসি। ফলে একদিকে যেমন খাদ্যদ্রব্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করছে, ঠিক তেমনি দেশের কৃষি উৎপাদন প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে ডব্লিউটিসি।

২০১৯-২০ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস হওয়া মোট ৬ কোটি ৮৪ লাখ ৭৩ হাজার ৪১৪ মেট্রিক টন পণ্যের মধ্যে ৫ কোটি ৪২ লাখ ৫৪ হাজার
৮২৭ মেট্রিক টন হ্যান্ডলিং হয়েছে বহির্নোঙরে। শতাংশের হিসাবে এর পরিমাণ প্রায় ৮০ শতাংশ

কোথায় হয় লাইটারিং

একসময় চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর এলাকা ছিল উপকূল থেকে পাঁচ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত। বন্দরে জাহাজ আগমনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০১১ সালে তা বৃদ্ধি করে ৭ দশমিক ৫ নটিক্যাল মাইল করা হয়। গত কয়েক বছরের ব্যবধানে জাহাজ আসার পরিমাণ সাড়ে ৩ হাজার অতিক্রম করেছে। এছাড়া মাতারবাড়ী ঘিরে এলএনজি টার্মিনাল, জাইকার উদ্যোগে নির্মাণাধীন মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর পণ্যবাহী জাহাজ ভেড়ানোর সুবিধার্থে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর এলাকা ৭ নটিক্যাল মাইল থেকে বৃদ্ধি করে ৫০ নটিক্যাল মাইল করেছে কর্তৃপক্ষ। বহির্নোঙরের আওতা বাড়ানোর প্রস্তাবটি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে ২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারি বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ হয়। ফলে কর্ণফুলীর মোহনা থেকে কুতুবদিয়া পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর বিস্তৃত হয়েছে। পুরো বহির্নোঙরে সারা বছর চলে পণ্য লাইটারিংয়ের কাজ। ফলে আগের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদে পণ্য লাইটারিং ও জাহাজ অবস্থান করতে পারে। আবহাওয়া খারাপ থাকলে পায়রা বন্দরের জাহাজও কখনো কখনো চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে লাইটারিং করে।

ঘণ্টায় ৬-৭ নটিক্যাল মাইলের শক্তিশালী জোয়ারের প্রভাবে বহির্নোঙর এলাকায় চলাচল এবং নোঙর করতে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় জাহাজের পাইলট ও নাবিকদের। বিশেষ করে জোয়ারের সময় বহির্নোঙরের অন্য কোনো জাহাজ অতিক্রম না করা, ইঞ্জিন চালু রাখা, জরুরি প্রয়োজনে ৬ নটিক্যাল মাইল বেগে চলাচল, চ্যানেলের প্রবেশপথে অবস্থান না করা, ২ থেকে ৩ বার জোয়ারের পর নোঙরের অবস্থান যাচাই করা এবং ড্রাফট অনুযায়ী নোঙর করার নির্দেশনা রয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষের। দুর্ঘটনা এড়াতে পোর্ট রেডিও কন্ট্রোল থেকে জাহাজ চলাচল এবং অবস্থানে নির্দেশনা দেওয়া হয় পাইলটদের। এছাড়া মৌসুমি বায়ুর প্রভাব এবং মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দ্রুত আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রবণতা যেমন ঝড়, বৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড়ের কথা মাথায় রেখে চলাচল করতে হয় পাইলটদের।

পণ্য লাইটারিংয়ে বড় জাহাজ এবং লাইটার ভেসেলকে পাশাপাশি অবস্থান করতে হয়। দুই জাহাজের সার্বক্ষণিক যোগাযোগের পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন লাইটারিং নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা রাখতে হয় প্রয়োজনীয় ফেন্ডারিংয়ের (মুরিং দড়ি, পুরোনো টায়ার), যাতে জোয়ার এবং ঢেউয়ের প্রভাবে সৃষ্ট দুলুনিতে মাদার ভেসেল এবং লাইটার জাহাজের মধ্যে যেকোনো ধরনের সংঘর্ষ না ঘটে।

চট্টগ্রাম বন্দরের ভিটিএমআইএস নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক বন্দর চ্যানেল ও বহির্নোঙরে অবস্থানরত জাহাজের চলাচল
মনিটরিং করা হয়। কনটেইনার বা কার্গোবাহী জাহাজ যখন চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে প্রবেশ করে, ঠিক তখন থেকেই
এরা ভিটিএমআইএসের নজরদারিতে চলে আসে

খোলা পণ্যের ৮০ শতাংশ হ্যান্ডলিং বহির্নোঙরে

চট্টগ্রাম বন্দর কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিসংখ্যানে পৃথিবীর অনেক বন্দরকে পেছনে ফেলে লয়েডস লিস্টে ৫৮তম স্থানে অবস্থান করছে। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিসংখ্যান ও প্রবৃদ্ধি সবসময় আলোচিত হলেও চট্টগ্রাম বন্দর কনটেইনারের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ খোলা (বাল্ক ও জেনারেল) পণ্যও হ্যান্ডলিং করে, যা সামগ্রিক পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের প্রায় অর্ধেক। আর এই খোলা পণ্য বা কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের সিংহভাগ হয় বঙ্গোপসাগরের বিস্তৃত জলরাশিতে, জনমানুষের চোখের আড়ালে। বন্দরের জেটির মতো ক্রেনের সাহায্যে পণ্য বা কনটেইনার ওঠানামা ও ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান কিংবা লরির চলাচল দৃশ্যত নজরে না এলেও জাহাজ থেকে জাহাজে (শিপ টু শিপ অর্থাৎ এসটিএস) খালাস হয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টন পণ্য।

আমরা কিছু তুলনামূলক পরিসংখ্যান দেখলেই এটি বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারব। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে বাল্ক ও জেনারেল পণ্য খালাস হয়েছে ৫ কোটি ৯০ লাখ ৭৭ হাজার ৭২৫ মেট্রিক টন। এর মধ্যে শুধু বহির্নোঙরে খালাস হয়েছে ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৮৯ হাজার ৩২২ মেট্রিক টন পণ্য। একইভাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে খালাস হওয়া ৬ কোটি ৪২ লাখ ৬৮ হাজার ৮৬ মেট্রিক টন পণ্যের মধ্যে ৪ কোটি ৯৯ লাখ ৫৮ হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬ কোটি ৮৪ লাখ ৭৩ হাজার ৪১৪ মেট্রিক টন পণ্যের মধ্যে ৫ কোটি ৪২ লাখ ৫৪ হাজার ৮২৭ মেট্রিক টন হ্যান্ডলিং হয়েছে বহির্নোঙরে। শতাংশের হিসাবে এর পরিমাণ প্রায় ৮০ শতাংশ।

বহির্নোঙরে লাইটার জাহাজে পণ্য পরিবহন সড়কপথে চাপ কমাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সকল আমদানিপণ্য চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে খালাস হলে প্রতিদিন কমপক্ষে ২০-২৫ হাজার ট্রাক মহাসড়কে যোগ হতো। এ সংখ্যাই বলে দিচ্ছে বহির্নোঙরে পণ্য পরিবহন শুধু পরিবেশবান্ধবই নয়, বরং মহাসড়কে যানবাহন চলাচলকে আরও সহজ ও নিরাপদ করছে।

জাহাজ হ্যান্ডলিংয়েও এগিয়ে বহির্নোঙর

পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের পরিসংখ্যানের মতো জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের পরিসংখ্যানেও বহির্নোঙরের অংশীদারিত্ব বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায় এ বছর চট্টগ্রাম বন্দরে খোলাপণ্যের জাহাজ এসেছে ২ হাজার ২০৪টি। এর মধ্যে শুধু বহির্নোঙরে খালাস হয়েছে ১ হাজার ৩২১টি জাহাজের পণ্য। বন্দরের নিজস্ব জেটি, বিশেষায়িত জেটি ও মুরিংয়ে খালাস হয়েছে যথাক্রমে ৪৭৯ ও ৪০৪টি জাহাজ। এরপরের অর্থবছরে (২০১৯-২০) খোলাপণ্যের জাহাজ এসেছে ২ হাজার ৩০৯টি। এর মধ্যে শুধু বহির্নোঙরে খালাস হয়েছে ১ হাজার ৪৬৪টি জাহাজের পণ্য। এছাড়া জেটিতে ৪৯১টি ও বিশেষায়িত জেটি এবং মুরিংয়ে ৩৪৭টি জাহাজের পণ্য খালাস হয়েছে। সর্বশেষ অর্থবছরের (২০১৯-২০) পরিসংখ্যান অনুযায়ী বহির্নোঙরে খোলাপণ্যের জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের অংশীদারিত্ব প্রায় ৬৩ শতাংশ।

নিরাপদ বহির্নোঙর

চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেল ও বহির্নোঙর দেশি-বিদেশি জাহাজ চলাচলের নিরাপদ গন্তব্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি, নিয়মিত টহল ও বন্দর কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণকক্ষের সাথে জাহাজের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ অপরাধমূলক কার্যক্রমের সংখ্যা কমানোর পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দরকে নিরাপদ বন্দরের পরিচিতি এনে দিয়েছে এবং একই সাথে উজ্জ্বল হয়েছে বন্দরের ভাবমূর্তি।

দেশের বহির্নোঙরে অপরাধকর্ম বাড়লে বিদেশি জাহাজের চলাচলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ নেতিবাচক প্রভাবের কারণে পণ্য পরিবহনে বাড়তি জাহাজভাড়া আরোপ হয় আর বিপাকে পড়তে হয় দেশীয় আমদানি-রপ্তানিকারকদের। সাগরে দস্যুতা প্রতিরোধে প্রতিনিয়ত কাজ করছে কোস্ট গার্ড, বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম বন্দর আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিধিমালা আইএসপিএসের লেভেল-১ বাস্তবায়ন করছে। বহির্নোঙরে যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা, চুরি কিংবা দস্যুতার ঘটনা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমকে (ভিটিএমআইএস) আপগ্রেড করা হয়েছে। আর নিজস্ব উদ্যোগে নজরদারির জন্য হাইস্পিড জাহাজ এবং হেলিকপ্টার কেনার বিষয়টিও পরিকল্পনায় রয়েছে। বহির্নোঙর ছাড়াও পোর্ট লিমিটের মধ্যে থাকা সব স্থাপনা, রিভার মুরিং, জেটি, টার্মিনালকে আরও বেশি নজরদারির মধ্যে আনার প্রক্রিয়া চলছে। আর নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড চুরি কিংবা দস্যুতার কোনো অভিযোগ পেলে ১০ মিনিটের মধ্যে যাতে সরাসরি সাগরের ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারে, সেজন্য বন্দর চ্যানেলের ১৫ নম্বর ঘাটের কাছে একটি র‌্যাপিড রেসপন্স বার্থ স্থাপন করা হয়েছে।

ভিটিএমআইএস: সার্বক্ষণিক নজরদারি

চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর নিয়ে কথা বলতে গেলে এর সার্বিক পরিচালনায় যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, সেই প্রসঙ্গে আলোকপাত করতেই হয়। নৌবাণিজ্য নিরাপদ, নির্বিঘন্নে এবং আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (ভিটিএমআইএস) চালু করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর আধুনিকায়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই সিস্টেম। ভিটিএমআইএস বন্দরের সক্ষমতা এবং দক্ষতা বাড়িয়েছে বহুগুণে। বেলজিয়াম, আমেরিকা ও সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশের বন্দরে ব্যবহৃত হচ্ছে এই সিস্টেম। ভিটিএমআইএস পরিচালিত হয় আন্তর্জাতিক নৌ-সংস্থা আইএমও এবং সোলাস কনভেনশন অনুসরণ করে। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর এই সিস্টেমের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেল ও বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থান করা সব জাহাজের নজরদারি করতে পারছে কর্তৃপক্ষ। কনটেইনার বা কার্গোবাহী জাহাজ যখন চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে প্রবেশ করে, ঠিক তখন থেকেই এরা ভিটিএমআইএসের নজরদারিতে চলে আসে। নিয়মানুযায়ী জাহাজ বহির্নোঙরে প্রবেশ করে ভিএইচএফ কমিউনিকেশনের মাধ্যমে পোর্ট রেডিও কন্ট্রোলে তাদের আগমন নিশ্চিত করে। পোর্ট রেডিও কন্ট্রোল জাহাজের প্রয়োজনীয় তথ্য যেমন ড্রাফট, আয়তন, কার্গো পরিমাণ বা কনটেইনারের পরিমাণ ইত্যাদি সংরক্ষণ করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও বহির্নোঙর এলাকায় কোন অ্যাংকরেজে অবস্থান করবে তা জাহাজের ক্যাপ্টেনকে জানিয়ে দেয়।

ভিটিএমআইএসের সুবাদে একদিকে যেমন জাহাজ চলাচল বন্দরের নিয়ন্ত্রণে এসেছে, তেমনি কমেছে সংঘর্ষ, চুরি কিংবা ডাকাতির ঘটনা। বহির্নোঙরে পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে নিষেধাজ্ঞার সময় বিশেষ করে অতিবৃষ্টি ও ঘনকুয়াশার সময়ও জাহাজের কর্মকা- কর্তৃপক্ষের নজরদারিতে এসেছে।

ভিটিএমআইএস পরিচালনায় চট্টগ্রাম বন্দরে রয়েছে দুটি কন্ট্রোল স্টেশন ও চারটি রাডার স্টেশন। একটি বন্দর ভবন কন্ট্রোল স্টেশন; অন্যটি পতেঙ্গা পয়েন্ট কন্ট্রোল স্টেশন। চারটি রাডার স্টেশনগুলো হলো পতেঙ্গা পয়েন্ট রাডার স্টেশন, গুপ্তা পয়েন্ট রাডার স্টেশন, রুবি সিমেন্ট রাডার স্টেশন ও সদরঘাট রাডার স্টেশন। সিসিটিভি ক্যামেরা, ডে-নাইট ক্যামেরা সিস্টেম, ভিএইচএফ রেডিও সিস্টেম এবং অটোমেটিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম (এআইএস) সমৃদ্ধ এই সিস্টেমের মাধ্যমে প্রতিটি জাহাজের চলাচল চিহ্নিত করা যায় কন্ট্রোল স্টেশন থেকেই। ভিটিএমআইএসের মাধ্যমে স্টেশনে বসেই বিশ্বের যেকোনো দেশ থেকে আসা জাহাজের বহির্নোঙরে প্রবেশ, জাহাজের বিস্তারিত তথ্য, গতিবিধি এবং পাশর্^বর্তী জাহাজ থেকে দূরত্ব অবলোকন করা যায়। বহির্নোঙরে জাহাজ চলাচলের উপযুক্ত সময়, দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকলে আগাম সতর্কতা জারি, বন্দর চ্যানেলে জাহাজ প্রবেশ ও বহির্গমন, বহির্নোঙরে পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের সঠিক সময় সম্পর্কে তথ্য প্রদান এবং যোগাযোগের মাধ্যমে সমন্বয়ের কাজ করে ভিটিএমআইএস। একই সাথে জাহাজগুলোকেও পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের তথ্য ও জাহাজ সঠিকভাবে নোঙর করা আছে কিনা তা নিশ্চিত করে তথ্য প্রেরণ করতে হয় নিয়ন্ত্রণকক্ষে। যেকোনো দুর্ঘটনায় ত্বরিত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি দুর্ঘটনার তদন্তে ভিটিএমআইএসএ’র অডিও ও ভিডিও রেকর্ডিং এনে দিয়েছে যুগান্তকারী সাফল্য। অনুমতি ছাড়া যেকোনো জাহাজের বন্দর চ্যানেলে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণেও কার্যকর ভিটিএমআইএস। দুর্ঘটনা প্রশমনে গঠন করা হয়েছে বহির্নোঙর সেল (আউটার অ্যাংকরেজ সেল)। এই সেলের কাজ হচ্ছে বহির্নোঙরে যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা প্রশমন করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও নজরদারি জোরদার করা।

ব্যাপ্তি বেড়েছে অনেক, বাড়বে আরও

দেশের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সমুন্নত রাখতে হলে চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। বাণিজ্য বৃদ্ধির সুবাদে ক্রমাগত বাড়ছে পণ্য আমদানি-রপ্তানি। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে প্রতিবেশী দেশগুলোর ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্ট চালু হওয়ায় পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের সম্ভাবনা আরও বাড়ছে। পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে প্রতিনিয়ত নিজের সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি টার্মিনাল অপারেটর, বার্থ অপারেটর ও শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছে চট্টগ্রাম বন্দর। কাক্সিক্ষত উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে চট্টগ্রাম বন্দর তার সম্ভাবনার সবটুকু কাজে লাগাতে বদ্ধপরিকর। ক্রমোন্নয়নের নিরলস প্রচেষ্টায় পাল্টে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের চিরচেনা চিত্র। পাল্টে যাচ্ছে দৃষ্টির আড়ালে থাকা বহির্নোঙরে পণ্য খালাসের চিত্রও। বিশে^র ব্যস্ততম বন্দরের তালিকায় অচিরেই শীর্ষসারিতে উঠে আসবে চট্টগ্রাম বন্দর, তা এখন আর স্বপ্ন নয়।

ওমর ফারুক ইমন

প্রতিবেদক, বন্দরবার্তা

ইনফোগ্রাফিক্স- মে, ২০২১