
করোনায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বন্দর ও বন্দর ব্যবহারকারীদের মধ্যে আরও সমন্বয় বাড়াতে হবে
২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর করোনা রোধে ২৬ মার্চ দেশজুড়ে সাধারণ ছুটিসহ লকডাউন ঘোষণা করা হয়। কিন্তু দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে হলে সাপ্লাই চেইন তথা বন্দরগুলোকে সচল রাখার বিকল্প নেই। বাংলাদেশের আমদানি রপ্তানির প্রায় পুরোটাই হয়ে থাকে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। তাই একে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন, যার স্লোগান হলো, ‘কান্ট্রি মুভস উইথ আস’। সুতরাং চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমে সামান্যতম নেতিবাচক প্রভাব পড়লে তা পুরো দেশের অর্থনীতির ওপরই বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। এই কারণেই বিশ্বব্যাপী মৃত্যু ও আতঙ্কের ভয়াল থাবা মেলে দেওয়া কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে সাধারণ ছুটির মধ্যেও ২৪ ঘণ্টা সচল থেকেছে চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য ওঠানামা ও সরবরাহের কাজ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে পৃথিবীতে আরও বেশ কিছু দিন করোনা স্বরূপে বিস্তৃতি ঘটাতে থাকবে। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বন্দর চালু রাখলেই হবে না, এর পুরো সুফল পেতে হলে চট্টগ্রাম বন্দর ও বন্দর ব্যবহারকারীদের মধ্যে আরও সমন্বয় বাড়াতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে হতে হবে একে অপরের সহায়ক। তাহলেই এই করোনা সংকটেও সম্ভব বন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক রেখে দেশের অর্থনীতির উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার অব্যাহত রাখা।
করোনার লকডাউনে বন্দর চালু থাকলেও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সর্বোচ্চ সর্তক থেকেছে বন্দর। কর্মীদের জন্য সাবান, পানি, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক ও জীবাণুনাশক স্প্রের ব্যবস্থা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে বন্দরের কর্মকর্তা এবং ডাক্তারদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম প্রস্তুত করা হয়, যার সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছেন পোর্ট হেলথ অফিসার। জাহাজ থেকে হাসপাতালে দ্রুত রোগী স্থানান্তরের জন্য বন্দরের অ্যাম্বুলেন্স শিপ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বন্দর ইমিগ্রেশন ডেস্কে পোর্ট হেলথ অফিসারের তত্ত্বাবধানে একটি মেডিকেল টিম সার্বক্ষণিক দায়িত্বে নিয়োজিত থাকছে। গত বছরের ১ জুলাই বন্দর হাসপাতালে ৫০ শয্যার বিশেষায়িত কোভিড ইউনিট চালু হয়। ১৩ জন ডাক্তার, ৩৬ জন নার্সসহ মোট ১৫৯ জন চিকিৎসাকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এখানে। এ ছাড়াও বছর ধরে করোনা সংক্রমণের তীব্রতা অনুযায়ী স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নানা বিধি-নিষেধ পালন করেছে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ চট্টগ্রাম বন্দর। অতিমারির দিনগুলো কেমন করে কাটাল বন্দর তার আদ্যোপান্ত রয়েছে এবারের প্রধান রচনায়।
মানুষের অকারণ হস্তক্ষেপে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে বিশ্বের শেষ বুনো এলাকা অ্যান্টার্কটিকা। ১২টা দেশের সরকার একত্রিত হয়ে সেই ৬০ বছর আগে একটা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, যার পোশাকি নাম অ্যান্টার্কটিকা ট্রিটি। এর মাধ্যমে এই মহাদেশকে যুদ্ধ, অস্ত্র ও পরমাণু বর্জ্য থেকে মুক্ত রাখতে একমত হয়েছিলেন বিশ্বনেতারা। অ্যান্টার্কটিকা চুক্তিতে বলা হয়েছিল, এই অঞ্চল কোনো একক দেশের নেতৃত্বে থাকবে না। বরং সব দেশের বিজ্ঞানীরা মিলেমিশে সেখানে গবেষণা করবেন। কিন্তু তারপর সাগর-মহাসাগরে বয়ে গিয়েছে বহু জল। যুগ বদলেছে, বাণিজ্যের বিশ্বয়ন হয়েছে। বাদ যায়নি অ্যান্টার্কটিকাও। বর্তমানে সাউদার্ন ওশেনের কেবল ৫ শতাংশ এলাকা মেরিন প্রোটেক্টেড এরিয়া হিসেবে বিবেচিত। জীববৈচ্যিত্রে অত্যন্ত সমৃদ্ধ অ্যান্টার্কটিকা তাই অনেকটাই অরক্ষিত। বিশেষ করে রুক্ষ মহাদেশের সর্ব উত্তরে অবস্থিত পশ্চিম অ্যান্টার্কটিক পেনিনসুলার বায়োডাইভার্সিটি অত্যন্ত হুমকির মুখে আছে। বাণিজ্যিক ক্রিল ফিশিং, পর্যটন, গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বিলুপ্ত হতে বসেছে মেরিন ইকোলজির সূতিকাগার। অ্যান্টার্কটিকা নিয়ে রয়েছে আমাদের বিশেষ প্রতিবেদন।
প্রিয় পাঠক, আমরা চাই এদেশের মেরিটাইম চর্চাকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড় করাতে। বৈচিত্র্যময় আঙ্গিকে, সমৃদ্ধ কলেবরে বন্দরবার্তার পথচলা বাংলাদেশের মেরিটাইম খাতের বিকাশে আরও সহায়ক হবে-সেই প্রত্যাশা। সবাইকে শুভেচ্ছা
জিন বারেট
সাগরপথে গোটা পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো প্রথম নারী হিসেবে অমর হয়ে আছেন জিন বারেট। ফ্রান্সের হতদরিদ্র ঘরে জন্মানো মেয়েটি ‘জাঁ’ নামের পুরুষ সেজে ঘুরে বেড়িয়েছেন দক্ষিণ আমেরিকার গহিন অ্যামাজন জঙ্গল থেকে ম্যাগেলান প্রণালি হয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক সমুদ্রের স্বর্গীয় দ্বীপমালাগুলোয়। ফ্রেঞ্চ সম্রাট পঞ্চদশ লুইয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় বিখ্যাত ফরাসি এডমিরাল লুইস আন্তন দ্য বোগেনভিলা পরিচালিত ১৭৬৬ সালের সমুদ্র অভিযানে অংশ নেন জিন। জিনের ফরাসি প্রেমিক ফিলিবার্ট কমারসন ছিলেন একজন উদ্ভিদবিজ্ঞানী, এ অভিযানে অংশ নেওয়ার জন্য ফ্রান্স সরকারের কাছ থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গী হিসেবে হ্যাট, কোট-প্যান্ট পরে পুরুষের ছদ্মবেশে ১৭৬৬ সালের ডিসেম্বরে রচেফোর্ট বন্দরে অপেক্ষমাণ অভিযাত্রী জাহাজ এতোইলে পা রাখেন জিন। সমুদ্র ভ্রমণের সময় বিভিন্ন দেশ, বন্দর, তীর থেকে হাজার হাজার উদ্ভিদ নমুনা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও লেবেলিং করেন এই জুটি। জিনের সহায়তায় তৎকালীন বিশ্বের বৃহত্তম উদ্ভিদ নমুনা সংগ্রহশালা গড়ে তোলেন কমারসন। প্যারিস ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে আজো সংরক্ষিত আছে সেসব নমুনা।
জাঁ প্রকৃতপক্ষে একজন নারী, জাহাজে এরকম গুজব চালু থাকলেও ১৭৬৮ সালে অভিযাত্রিক দল তাহিতি পৌঁছানোর পর ফাঁস হয় তাঁর আসল পরিচয়। এরপর আইল দ্য ফ্রান্সে গেলে তাঁদের দেখা হয় অপর বিখ্যাত বোটানিস্ট পিয়েরে পোইভ্রের সাথে, তাঁর সঙ্গে বসবাসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জাহাজ থেকে নেমে পড়েন এই যুগল।
১৭৮৫ সালে ফ্রেঞ্চ এডমিরাল এবং অভিযাত্রী দ্য বোগেনভিল জাহাজে থাকাকালীন সাহসী এবং অনুকরণযোগ্য কর্মকা-ের পুরস্কার হিসেবে বারেটকে বার্ষিক ২০০ লিরা পেনশন মঞ্জুর করে ফরাসি সরকার। ১৮০৭ সালে ৬৭ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
ফিমেল টারস: উইমেন অ্যাব্রোড শিপ ইন দ্য এজ অব সেইল
নারী নাবিক বলতে আজকের দিনে যে আত্মপ্রত্যয়ী এবং দক্ষ মেরিনারের মুখ ভেসে ওঠে, তা কিন্তু একদিনে অর্জিত হয়নি। আঠারো ও উনিশ শতকে নৌবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার স্ত্রীরা ছাড়া আরও অনেক নারীই সমুদ্রযাত্রায় নাবিকদের সঙ্গী হতেন, যা বেশির ভাগ সময়েই সম্মানিত কোনো পদ হতো না। রাঁধুনি, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, এমনকি দেহপসারিণী হিসেবে দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় যোগ দিয়েছেন নারীরা। রক্তে অ্যাডভেঞ্চারের নেশা নিয়ে জন্মানো অনেক নারী সামাজিক বাধা উপেক্ষা করে সরাসরি নাবিক হিসেবে, এমনকি পুরুষ ছদ্মবেশে হলেও বিশ^ পরিভ্রমণ করেছেন সমুদ্রপথে, তাও সেই আঠারো শতাব্দীতে! ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে, যুদ্ধে-জলদস্যুর আক্রমণে শক্তপোক্ত, কর্কশ নাবিকদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ করেছেন তাঁরাও, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ইতিহাস তাঁদের প্রাপ্য সম্মান তো দূরের কথা, নামটাও উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করেনি। গোপন করা হয়েছে তাঁদের উপস্থিতি। সেই অভাব কিছুটা ঘুচিয়েছে সুজান জে স্টার্কের গবেষণাগ্রন্থ ফিমেল টারস: উইমেন অ্যাব্রোড শিপ ইন দ্য এজ অব সেইল।
বইটির প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে পেটের দায়ে নিশিকন্যা বনে যাওয়া হতভাগ্য মেয়েদের গল্প। ডেকের সবচেয়ে নিচের অংশে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিম্ন মানের খাবার খেয়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য হওয়া মেয়েদের কোনো ছুটির দিন, শোর লিভ ছিল না। অচেনা বন্দরে পরিত্যক্ত হওয়ার ভয়ে তাঁরা ছুটি চাইতেনও না।
লোয়ার ডেকে থাকা স্ত্রীদের কাহিনি উঠে এসেছে দ্বিতীয় অধ্যায়ে। কর্মচারী হিসেবে নাম এন্ট্রি না হওয়ায় নাবিকের স্ত্রীরা স্বামীর রেশন ভাগ করে খেতেন, কোনো আলাদা কক্ষ দূরের কথা, ঘুমানো বা পোশাক পরিবর্তনের জন্য একটু আড়ালও থাকত না। অথচ অনেকেই বিনা বেতনে রাইফেল রিলোড, পরিচ্ছন্নতা বা অন্যান্য কাজে সহকারী হিসেবে স্বামীর পাশে থাকতেন।
তৃতীয় অধ্যায় সেই সব অসম সাহসী নারী নাবিকদের, যারা পুরুষবেশে মেরিনার বনে গিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তখন মধ্যগগনে, বিপুল পরিমাণে নাবিক দরকার ছিল সরকারের। নাবিকের খাতায় নাম লেখাতে চাইলে কাউকেই ফেরানো হতো না। ন্যূনতম শারীরিক পরীক্ষা ছাড়াই ভর্তি করা হতো নৌবাহিনীতে।
উইলিয়াম শ্যান্ডলার ছদ্মনামে ১৭৬০ সালে পুরুষবেশে সমুদ্র অভিযানে অংশ নেওয়া জাহাজ মেরামতকর্মী নারী মেরি লেসির কাহিনি রয়েছে ২৪৪ পৃষ্ঠার বইয়ের চতুর্থ তথা শেষ অধ্যায়ে। ব্রিটিশ এডমিরালটি থেকে সরকারি পেনশন মঞ্জুর হওয়া প্রথম নারী নাবিক ছিলেন তিনি।
২০১৭ সালে নেভাল ইনস্টিটিউট প্রেস থেকে রিপ্রিন্ট হওয়া ফিমেল টারস: উইমেন অ্যাব্রোড শিপ ইন দ্য এজ অব সেইলের কিন্ডল ই-বুক সংস্করণ ১০ মার্কিন ডলার, পেপারব্যাক ১৮.৯৫ এবং হার্ডকভার মিলবে ৩৬ ডলারে।
আইএসবিএন-১০: ১৫৯১১৪৫৭২৪
আইএসবিএন-১৩: ৯৭৮-১৫৯১১৪৫৭২১
ইকো সাউন্ডার
ইকো সাউন্ডার হচ্ছে আধুনিক নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থায় অপরিহার্য একটি যন্ত্র। এটি দিয়ে পানির গভীরতা এবং এর তলদেশে কোনো বস্তুর উপস্থিতি নির্ণয় করা হয়। ১৯১৩ সালে জার্মান উদ্ভাবক আলেক্সান্ডার বেহম এটির প্যাটেন্ট নেন। ইকো সাউন্ডার যন্ত্র থেকে এক ধরনের শব্দতরঙ্গ নিক্ষেপ বা প্রেরণ করা হয়, যা সমুদ্রের তলদেশ কিংবা নিমজ্জিত অন্য কোনো বস্তুতে বাধা পেয়ে ফিরে আসে। সেই শব্দের প্রেরণ, নির্গমণ ও ফিরে আসার সময় রেকর্ড করে, পানিতে শব্দের দ্রুতি গণনা করে তলদেশের গভীরতা মাপা হয়। ইকো সাউন্ডারের কারণে ডুবোচরে আটকে যাওয়া বা পানির নিচে অযাচিত কোনো বস্তুর সাথে সংঘর্ষের ভয় থাকে না। পানির গভীরতা অনুযায়ী নৌযান প্রয়োজনীয় গতিতে চলতে পারে।
ইকো সাউন্ডার হাই ফ্রিকোয়েন্সির, সাধারণত ১০ থেকে ২০০ কিলোহার্টজ শব্দতরঙ্গ উল্লম্বভাবে সমুদ্রের নিচে প্রেরণ করে। বায়ুর চেয়ে পানি প্রায় তিন গুণ বেশি দ্রুত শব্দ পরিবহন করে, আর সমুদ্রপৃষ্ঠে শব্দের বেগ সেকেন্ডে ১ হাজার ৫০০ মিটার। শব্দ প্রেরণ এবং ফিরে আসার জন্য প্রয়োজনীয় সময়কে ২ দিয়ে ভাগ করে গতিবেগ দিয়ে গুণ করলে কাক্সিক্ষত গভীরতা পাওয়া যায়। ধরা যাক, সমুদ্রের মাঝখানে থাকা একটি জাহাজের ইকো সাউন্ডার থেকে শব্দ প্রেরণের ৩ সেকেন্ড এর প্রতিধ্বনি সোনারে ধরা পড়ল। সেক্ষেত্রে এই স্থানে সমুদ্রের গভীরতা ২২৫০ মিটার। যদিও একেবারে নির্ভুল পরিমাপ পেতে হলে এই ফলাফলের সাথে তাপমাত্রা, লবণাক্ততা, সমুদ্রের জলপ্রবাহের গতি এবং বায়ুচাপের মান হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হয়।
সমুদ্র তলদেশের গভীরতা পরিমাপ ছাড়াও হাইড্রোগ্রাফিক ও টপোগ্রাফিক জরিপ, মৎস্য বিচরণস্থল, জিপিএস সিস্টেমে ইকো সাউন্ডারের বহুল ব্যবহার রয়েছে।
ইনচন বন্দর
এশিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে হান নদীর তীরে গড়ে উঠেছে দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দর ইনচন। মূলত শিল্পাঞ্চল হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইনচন বন্দরকে গোটা একটি প্রদেশের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। মানচিত্রে সিউল মেট্রোপলিটন এলাকায় অবস্থিত হলেও লয়েডস লিস্টে কনটেইনার বন্দর হিসেবে ৫৭তম স্থানে থাকা ইনচন বন্দরের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ তাই কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে।
১৮৮৩ সালে ইনচন বন্দরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। ১৯১০ সালে ইনচন যুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে এ বন্দর দখল করে নেয় জাপান। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত জাপানি দখলে থাকা ইনচনে এরপর ঘাঁটি গাড়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন মিত্রশক্তি। তিন বছর পর আনুষ্ঠানিকভাবে এ বন্দরের নিয়ন্ত্রণ কোরিয়ার হাতে তুলে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে বিশ শতকে ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে ইনচন। বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে অবকাঠামোগত সংস্কারের পাশাপাশি কোরিয়ার প্রথম মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গড়ে উঠেছে এখানে। বর্তমানে কনটেইনার, গাড়ি, নির্মাণসামগ্রী, বস্ত্র, ভারী যন্ত্র আমদানি-রপ্তানির হাব হয়ে উঠেছে ইনচন।
২০২০ সালে বার্ষিক কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ ৩.২৭ মিলিয়ন টিইইউ ছাড়িয়ে যাওয়া ইনচন বন্দরকে প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। বন্দরের লক গেটের ভেতরের অংশে তুলনামূলক শান্ত পানিতে আছে মাল্টি-পারপাস পিয়ারসমৃদ্ধ ইনার পোর্ট। ৪৬ বার্থের ইনার পোর্ট ১৯৭৪ সালে কোরিয়ার প্রথম কনটেইনার পিয়ার হিসেবে কাজ শুরু করে। কনটেইনার ছাড়াও গাড়ি, শস্য, জেনারেল কার্গোও হ্যান্ডল করা হয় এখানে।
সাউথ পোর্টের তিনটি কনটেইনার বার্থে ৪ হাজার টিইইউ ধারণক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজের পাশাপাশি বাল্ক পণ্যের জন্য চারটি জেনারেল বার্থ রয়েছে। সাউথ পোর্টে ছোট ও মাঝারি আকারের, মূলত কোস্টাল কার্গো শিপগুলোকে সেবা দেওয়া হয়। শিল্পকারখানার জন্য বিশেষায়িত করা হয়েছে ইনচনের নর্থ পোর্টকে। ১৭টি বার্থে ওঠানামা করানো কাঠ, ইস্পাত, পশুখাদ্য এখানকার প্রধান আমদানি-রপ্তানি পণ্য।
উত্তর-পূর্ব এশিয়ার সাথে সংযোগের কাজ করে ইনচন নিউ পোর্ট। সর্বাধুনিক অবকাঠামোসমৃদ্ধ একটি কনটেইনার পিয়ার ও ছয়টি বার্থের মাধ্যমে ১২ হাজার টিইইউ পর্যন্ত জাহাজকে সেবা দেওয়া হয় এখানে। ক্রুড অয়েল, রিফাইনড অয়েল এবং রাসায়নিক তরল ওঠানামা করানোর জন্য নর্থ পোর্টের অয়েল ডলফিন জেটিতে আছে ছয়টি বার্থ, যেখানে ৫ থেকে ২০০ টন ধারণক্ষমতার ট্যাংকার হ্যান্ডল করা হয়। সাউথ পোর্টের দুই ডলফিন জেটিতে আকরিক তেলের পাশাপাশি এলপিজি বহনকারী জাহাজকেও সার্ভিস দেওয়া হয়। বন্দরের এ অংশের কোল পিয়ারে কয়লা ও আকরিক তেল দুইটাই হ্যান্ডলিং হয়।
প্রথম সারির বেশির ভাগ বন্দরের মতো প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল হিসেবেও দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এ বন্দর। ইনচন ইন্টারন্যাশনাল ফেরি টার্মিনালের দুটি টার্মিনাল থেকে নয়টি শিপিং কোম্পানি উত্তর চীনের অন্তত দশটি বড় শহরে যাত্রী এবং পণ্য পারাপার করে। বেশকিছু ক্রুজ লাইনারও তাদের ভ্রমণ প্যাকেজ পরিচালনা করে এখানে, ফলে বৈশি^ক মেরিটাইম ট্যুরিজম প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নৌ-পর্যটন খাতে ইনচনের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কোরিয়ার ব্যস্ততম বন্দর বুসানের ওপর চাপ কমিয়ে বন্দর হিসেবে ইনচনকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে ব্যাপক উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়েছে দেশটির সরকার। আড়াই ট্রিলিয়ন কোরিয়ান ইউয়ান ব্যয়ে ২.১ মিলিয়ন টিইইউ কার্গো অ্যান্ড কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতার ইনচন নিউ পোর্ট স্টেজ ওয়ান ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের নির্মাণকাজ প্রায় শেষ। ইনচন বন্দরের সাথে চীন এবং সিউল মেট্রোপলিটনের ট্রাফিক বৃদ্ধিতে মাইলফলক হতে যাচ্ছে এ প্রকল্প। গড়ে উঠছে ইন্টারন্যাশনাল প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল, যেখানে ৮ বার্থে ২ লাখ ২৫ হাজার টন পর্যন্ত ডেডওয়েট টনের ক্রুজ শিপ এবং কার ক্যারিয়ার পরিচালনা করা হবে। ইয়েলো সি আঞ্চলিক বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে দেশের হিন্টারল্যান্ডের সাথে সংযোগ বৃদ্ধিতেও মনোযোগ দিচ্ছে ইনচন।
সুয়েজ খুললেও শুরু ক্ষতিপূরণের যুদ্ধ
বিশালাকৃতির কনটেইনার জাহাজ এভার গিভেন আটকে বন্ধ হয়ে পড়া সুয়েজ খাল দিয়ে পুনরায় জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে। তবে গত অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ থাকার ফলে বিভিন্ন পক্ষ এখন ক্ষতিপূরণের দাবি নিয়ে মাঠে নামছে। সপ্তাহের বেশি সময় ধরে জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় আক্রান্ত হয়েছে সবাই- শিপিং লাইন, উৎপাদক কোম্পানি থেকে তেল উৎপাদকরা।
পরিবহন আইনবিষয়ক বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান অস্ট্রেলিয়ার নর্টন হোয়াইটের অংশীদার অ্যালেক্সিস কাহালান আইনি ইস্যুটিকে অত্যন্ত জটিল ও বহুবিস্তৃত বলে মনে করছেন। তিনি বলেন, ‘চ্যানেল বন্ধ হওয়ার কারণে আটকে পড়া কার্গোগুলোর কথা যদি আপনি একবার কল্পনা করেন-তেল, শস্য, ভোক্তাপণ্য থেকে পচনশীল পণ্য; তাহলে দেখবেন ক্ষতিপূরণ দাবির পূর্ণাঙ্গ চিত্রটা জানতে আমাদের বেশ সময় লেগে যাবে।’
মিশর জানিয়েছে, সুয়েজ বন্ধ থাকার কারণে তারা ১০০ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে। তবে কার কাছ থেকে এ ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে তা নির্দিষ্ট করে জানায়নি সুয়েজ ক্যানেল অথরিটি। ট্রানজিট ফি হারানো, খনন ও উদ্ধার কার্যক্রমে ক্ষতি, উদ্ধার যন্ত্রপাতি ও শ্রমিক ভাড়া ইত্যাদির ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণের এ অংক নির্ধারণ করেছে তারা।
এদিকে সুয়েজ বন্ধ থাকার সুযোগে রাশিয়া নর্দান সি রুটের প্রচারে বেশ জোর দিয়েছে। নিরাপদ ও টেকসই সমুদ্রপথ হিসেবে নর্দান রুটকে সুলভে পণ্য পরিবহনে বিশ্বের অন্যতম বিকল্প সমুদ্রপথ হিসেবে তুলে ধরছে তারা। দেশটি আশা করছে, এশিয়া থেকে ইউরোপে পণ্য পরিবহনে সুয়েজ খাল এড়িয়ে গেলে দূরত্ব কমবে ৪ হাজার নটিক্যাল মাইল।
২০২২ পর্যন্ত কাটবে না বৈশ্বিক কার্গোজট
সড়ক, সমুদ্র বা আকাশপথে কার্গোজট আগামী বছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। তাতে পণ্য পরিবহন ব্যয় বাড়বে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ফ্রেইট ব্রোকারদের একটি সিএইচ রবিনসন ওয়ার্ল্ডওয়াইড। প্রতিষ্ঠানটির ভাষ্য হচ্ছে, মার্কিন অভ্যন্তরীণ ফ্রেইট বাজার খুবই এলোমেলো বা বিচ্ছিন্ন। বৈশি^ক আকাশ ও সমুদ্রপথের বাজারও নানা মাত্রায় বাধাগ্রস্ত। ফলে শিপিং ব্যয়ে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতাই থাকবে।
সিএইচ রবিনসনের এ পূর্বাভাসে মোটা লাভের আশা দেখছেন ট্রাকার, আকাশপথে পণ্য পরিবহন কোম্পানি এবং মেরিটাইম শিপিং কোম্পানিগুলো। অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পণ্য সংগ্রহকারী রিটেইলার থেকে শুরু করে উৎপাদক-সবাইকে বাড়তি অর্থ গুনতে হবে।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে স্পট কস্টের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে উঠতে পারছে না দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি। স্পট কস্টের দরুন চলতি বছর ট্রাকে করে দীর্ঘ যাত্রায় পণ্য পরিবহনের ভাড়া দুই অংকের সামান্য নিচে বাড়বে। আকাশপথে পণ্য পরিবহন ব্যয়ও গত বছরের দ্বিগুণ হয়েছে। মেরিটাইমে ভাড়ার হার বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। হংকং থেকে ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যরে একটি কনটেইনার লস অ্যাঞ্জেলেসে পরিবহনের ব্যয় প্রায় চার গুণ হয়েছে।
কার্গোজটের পেছনে কাজ করছে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে মানুষের অন্তরীণ হয়ে পড়া। মুভি থিয়েটার, কনসার্ট বা রেস্তোরাঁয় যাওয়ার বদলে মানুষ এখন আটা বা ট্রেডমিলের পেছনে তাদের অর্থ ব্যয় করছে। যেসব দেশ তাদের নাগরিকদের অর্থসহায়তা প্রদান করছে, সেসব দেশে প্রভাব খুবই তীব্র হয়ে উঠেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কর্মহীন সুবিধাদি হিসেবে প্রাপ্ত নগদ অর্থের কারণে ট্রাক ও চালকসংকট প্রকট হয়েছে। ফলে সরবরাহ-শৃঙ্খলে জট লেগেছে। আকাশপথে যাত্রা কমার কারণে তা আরও জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে।