Home Blog Page 230

অ্যান্টার্কটিক পেনিনসুলা রক্ষা করতে হবে নিজেদের স্বার্থে

অ্যান্টার্কটিকা। বিশ্বের শেষ বুনো এলাকা। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের যুক্ত আয়তনের সমান। রহস্য উন্মোচন করা মানুষের সবচেয়ে প্রাচীন নেশা। পৃথিবীব্যাপী বহুকালের লক্ষ অভিযানের পর সেই নেশা চরিতার্থ করতে অবশিষ্ট আছে কেবল এই একটি জায়গা। কিন্তু আমাদের খেয়াল-খুশিমতো অ্যাডভেঞ্চার আর বাণিজ্যের নেশায় আজ অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে অ্যান্টার্কটিকা।

১২টা দেশের সরকার একত্রিত হয়ে সেই ৬০ বছর আগে একটা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, যার পোশাকি নাম অ্যান্টার্কটিকা ট্রিটি। যে চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল এই এলাকায় নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছাড়া আর সব ধরনের বাণিজ্যিক অ্যাক্টিভিটি নিষিদ্ধ করা। কিন্তু তারপর সাগর-মহাসাগরে বয়ে গিয়েছে বহু পানি। যুগ বদলেছে, বাণিজ্যের বিশ্বায়ন হয়েছে। প্রবৃদ্ধি মানেই কেবল আর্থিক উন্নয়ন, অনৈতিক এবং অযৌক্তিক এ ধারণা বেশ শক্তপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। যদিও টেকসই প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে একথা একেবারেই খাটে না। দুঃজনক হলেও বিশ্বায়নের হাত থেকে বাদ যায় নি অ্যান্টার্কটিকাও। বর্তমানে সাউদার্ন ওশেনের কেবল ৫ শতাংশ এলাকা মেরিন প্রোটেক্টেড এরিয়া হিসেবে বিবেচিত। জীববৈচিত্র্যে অত্যন্ত সমৃদ্ধ অ্যান্টার্কটিকা তাই অনেকটাই অরক্ষিত। বিশেষ করে রুক্ষ মহাদেশের সর্ব উত্তরে অবস্থিত পশ্চিম অ্যান্টার্কটিক পেনিনসুলার বায়োডাইভার্সিটি অত্যন্ত হুমকির মুখে আছে। বাণিজ্যিক ক্রিল ফিশিং, পর্যটন, গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বিলুপ্ত হতে বসেছে মেরিন ইকোলজির সূতিকাগার।    

অরক্ষিত উপদ্বীপ

শুধু মেরিন ইকোসিস্টেম নয়, বৈশ্বিক খাদ্যশৃঙ্খল নিরবচ্ছিন্ন রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে অ্যান্টার্কটিকা। শুধু কি জীববৈচিত্র্য? অকল্পনীয় শক্তিশালী, অত্যন্ত ডায়নামিক ওয়েদার অ্যান্ড অ্যাটমোসফরিক মেশিনের হৃৎপি- বলা হয় অ্যান্টার্কটিকাকে, যেগুলো গর্জনশীল চল্লিশ দ্রাঘিমায় ওঠা ঝড়গুলোয় এনার্জি তৈরি করে। যে মেশিন কোনো আণবিক বিস্ফোরণের চেয়ে অনেক বেশি শক্তির জন্ম দেয়। সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহটির জলবায়ু এবং মহাসাগরীয় স্রোতধারা নিয়ন্ত্রণ করে সাউদার্ন ওশেন। বিশ্বের পানযোগ্য ৭০ শতাংশ পানিই বরফ হয়ে জমা আছে এ মহাদেশে।

অথচ গ্রিনহাউস অ্যাফেক্টের ফলে যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে, এ পরিবর্তন সবার আগে ধাক্কা দিয়েছে অ্যান্টার্কটিকাকে। গলে যাচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে জমা থাকা মূল্যবান বরফ, অনন্য প্রাণিলের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে দিন দিন। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে রেকর্ড ২০ দশমিক ৭৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছে এখানকার তাপমাত্রা, রেকর্ডবুক চালুর পর থেকে অ্যান্টার্কটিকায় এটিই ছিল উষ্ণতম গ্রীষ্ম। সহজে গমনযোগ্য হওয়ায় চোখ ধাঁধানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বন্য প্রাণীদের অবাধ বিচরণ এবং সমৃদ্ধ ইকোসিস্টেম দেখতে প্রতি বছরই হাজার হাজার পর্যটক আসেন এখানে। ওদিকে ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় ট্যুরিস্টদের স্কুবা গিয়ার, ফেলে আসা বর্জ্যরে কারণে মেরিন ইকোসিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ২০১৯ সালে ৭৪ হাজার এর কিছু বেশি ক্রুজ শিপ ভ্রমণ প্যাকেজ পরিচালনা করেছে এ পেনিনসুলায়, দশ বছর আগেও যার সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৩ হাজার।

অ্যান্টার্কটিক উপদ্বীপে এখন পর্যন্ত ১৮টি দেশ রিসার্চ স্টেশন নির্মাণ করেছে। ১৯টি স্থায়ী এবং ৩০টি মৌসুমি রিসার্চ স্টেশন রয়েছে এখানে। বিজ্ঞানী-গবেষকদের জন্য আধুনিক ল্যাবরেটরি, উপযুক্ত বাসস্থান, সড়ক, ফুয়েল স্টোরেজ এবং উড়োজাহাজ-হেলিকপ্টার অবতরণের জন্য রানওয়ে নির্মাণ করার ফলে এ পেনিনসুলা হয়ে উঠেছে মহাদেশের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এতে বাস্তুচ্যুত হয়েছে হাজারের বেশি প্রজাতির লাখ লাখ প্রাণী। আর ক্রিল। অ্যান্টার্কটিক ফুড চেইনের ভিত্তি ক্রিল নিল তিমি থেকে শুরু করে সকল প্রজাতির শিশু মাছ, স্কুইড, সিল, পেঙ্গুইনের প্রধান খাদ্য। সংখ্যায় লাখ লাখ, কোটি কোটি ক্রিল ঝাঁক বেঁধে চলে। ছোট চিংড়ির মতো দেখতে শেল-ফিশ ক্রিলকে বলা হয় কর্নারস্টোন ফুড ফর এভরি লিভিং থিং ইন সাউদার্ন ওশেন। মৎস্য খামারের জন্য ফিশমিল এবং ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট হিসেবে মানবদেহের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ওমেগা-৩ এর সবচেয়ে সস্তা এবং প্রাকৃতিক উৎস। ২০০০ সালে যেখানে বার্ষিক মোট ৮৮ হাজার ৮০০ টন ক্রিল শিকার হয়েছিল, ২০১৯ সাল শেষে মাত্র ৯ বছরে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ টনে। অথচ ক্রিলের বৃহত্তম চারণভূমি অ্যান্টার্কটিক পেনিনসুলা এখন দক্ষিণ সাগরের সবচেয়ে কোলাহলপূর্ণ স্থান। সমুদ্রে ভাসমান বরফের স্তর যত পাতলা হচ্ছে, সমানুপাতে ফিশিং ভেসেলের সংখ্যাও বাড়ছে। বাড়াচ্ছে মেরুর উত্তাপ, মনুষ্যসৃষ্ট বর্জ্য, শব্দ। ক্রিলের আধিক্যের কারণে নিল তিমির ব্রিডিং গ্রাউন্ড হিসেবে বহুকাল ধরে বিখ্যাত অ্যান্টার্কটিকার পানি। পৃথিবীর বৃহত্তম প্রাণীর তকমার পাশাপাশি সমুদ্রের সবচেয়ে লাভজনক শিকার হলো নিল তিমি। অথচ মানুষের জন্য লোভনীয় খাদ্য হিসেবে অবাধে চলছে অপরিণত ক্রিল শিকার। ফলে ইতিমধ্যেই বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় নাম লেখানো নিল তিমি এখন রয়েছে গণবিলুপ্তির পথে। গত ৩০ বছরে অ্যান্টার্কটিকায় আডেলি এবং চিনস্ট্র্যাপ জাতের পেঙ্গুইনের সংখ্যা অর্ধেকের বেশি কমেছে। যার মূল কারণ অতিরিক্ত ক্রিল শিকার এবং সমুদ্রে ভাসমান বরফ কমে যাওয়া।    

বাঁচাতেই হবে দক্ষিণকে

অ্যান্টার্কটিক পেনিনসুলাকে বাঁচানোর প্রধান উপায় কেবল দুটি। যেকোনো মূল্যে এখানকার বরফশীতল পানিকে সংরক্ষণ এবং ক্রিলের সুরক্ষা। বাণিজ্যিকভাবে মৎস্য আহরণ বন্ধ করে গোটা উপদ্বীপকে মেরিন প্রোটেকটেড এরিয়া (এমপিএ) ঘোষণা ও কঠোরভাবে কার্যকর করা ছাড়া অ্যান্টার্কটিকাকে রক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শীতলতম মহাদেশের ৬ লাখ ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এমপিএ ঘোষণা করতে ২০১৮ সালে প্রথম প্রস্তাব উঠলেও সাউদার্ন ওশেন নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান দ্য কনজারভেশন অব অ্যান্টার্কটিক মেরিন লিভিং রিসোর্সেস এখনো এ-সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা অনুমোদন দেয়নি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহ এবং আরও ২৫ দেশের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এ কমিশন। প্রস্তাবনা অনুযায়ী দুই অংশে বিভক্ত এমপিএ’র ৬০ শতাংশ জুড়ে থাকবে জেনারেল প্রোটেকশন জোন। যেখানে সামুদ্রিক প্রাণীর অভয়াঞ্চল এবং বিশেষায়িত ইকোসিস্টেম সংরক্ষণে সকল প্রকার ফিশিং নিষিদ্ধ থাকবে। অপর ৪০ শতাংশ থাকবে ক্রিল ফিশারি জোন হিসেবে, যেখানে সীমিত আকারে ক্রিল ও অন্যান্য সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের সুযোগ থাকবে। অনুমোদনের পর পরবর্তী ৭০ বছরের জন্য বলবৎ থাকবে অ্যান্টার্কটিকার এমপিএ। এ ছাড়া পূর্ব আটলান্টিক এবং ওয়েডেল সি রক্ষায় আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ এমপিএ গঠনের প্রস্তাবনা কমিশনের পরবর্তী সভার আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

অতিমারির দিনগুলোতে চট্টগ্রাম বন্দর সর্বোচ্চ সতর্কতার এক বছর

মহামারির রূপ যে এতটা ভয়ংকর আর শক্তিশালী হয়ে উঠবে, দূরতম কল্পনায়ও আসেনি কারো। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে বিশ্ববাণিজ্য, জীবনধারা, ভূ-রাজনীতির চেহারা বদলে দিয়েছে এ মহামারি। দেশে দেশে লকডাউন, জরুরি অবস্থা জারি করেও রোধ করা যাচ্ছে না মৃত্যুর মিছিল। অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন, মাস্ক আর সামাজিক দূরত্ব হয়ে উঠেছে আমাদের নিত্যসঙ্গী। বিদ্যালয়ের পথ ভুলে গেছে শিশুরা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রস্তুতি থাকে, সামলানোর পরিকল্পনা থাকে। কিন্তু মহামারি সামাল দেওয়ার তো কোনো আগাম নির্দেশনা ছিল না। এ অবস্থায় জনগণের জীবন আগে নাকি জীবিকা-চরম সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে সরকারকে। শ্বাসরুদ্ধকর এ অবস্থায় কেমন কাটল দেশের প্রধান বন্দরের বারোটি মাস?

নতুন নয় মহামারি

চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির এই সময়েও করোনাভাইরাস মহামারি নাড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বকে। তবে এর চেয়েও ভয়াবহ প্রাণহানির অভিঘাত সয়ে এসেছে মানুষ। কোনো কোনো মহামারির প্রভাব এতটা তীব্র হয়েছে যে, তাতে বদলে গেছে সভ্যতার গতিপথ। ৫৪১ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়ে জাস্টিনিয়ান প্লেগ মহামারি চলে প্রায় দুই শতাব্দী ধরে। মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোতে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণ নেয় এই মহামারি। ব্যাকটেরিয়াজনিত এই রোগ ইঁদুরের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। চৌদ্দ শতকে এই প্লেগই পরিণত হয় ইউরোপের অন্যতম প্রাণসংহারী মহামারি ‘ব্ল¬্যাক ডেথ’-এ। লাইভসায়েন্সের তথ্যমতে, ১৩৪৬ সালে এশিয়া থেকে ইউরোপে ছড়িয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যায় ব্ল্যাক ডেথ। অনেকের মতে, এই মহামারিতে ইউরোপের অর্ধেকের মতো মানুষ প্রাণ হারায়। বাংলা সাহিত্যের অনেক লেখকের সাহিত্যকর্মে মহামারি কলেরার কথা উঠে এসেছে। এই রোগের কারণে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। মৃতের সংখ্যার হিসাবে আধুনিক যুগের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারির একটি হচ্ছে ১৯১৮ সালে ধরা পড়া স্প্যানিশ ফ্লু। প্রথম বিশ^যুদ্ধে যেখানে পাঁচ বছরে ১ কোটি ১৬ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়, সেখানে স্প্যানিশ ফ্লুতে মাত্র দুই বছরে মারা যায় ২ কোটি মানুষ। দুর্ভাগ্যের ধারাবাহিকতায় গত বছরের শুরুতে প্রথমবারের মতো নভেল করোনা নামক ভীতিকর এক ভাইরাসের মুখোমুখি হয় বিশ্ববাসী। তীব্র সংক্রামক ও মারণক্ষমতা বিচারে একে কোভিড-১৯ বৈশি^ক মহামারির তকমা দেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

অপ্রস্তুত ছিল বিশ্ব

২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহান শহরে নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ ছড়াতে দেখে প্রথম চীনের কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করে। এটিকে নভেল করোনাভাইরাসসৃষ্ট কোভিড-১৯ রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এরপর ২০২০ সালের ১১ জানুয়ারি এই রোগে প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। কিন্তু জানুয়ারির শেষ থেকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে করোনা। মার্চ নাগাদ লাফিয়ে বাড়তে থাকে মৃতের সংখ্যা। শুরু হয় মানবিক বিপর্যয়। জাহাজে করোনা রোগী, কিন্তু সংক্রমণের ভয়ে কোনো দেশই তাঁকে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে না।

২০২০ সালের ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯-কে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা করে। এক রকম স্থবির হয়ে পড়ে গোটা দুনিয়া। তখন বিশে^র ১১৪ দেশে করোনাভাইরাসের রোগী ছিল। এক বছরের মধ্যে জিনেটিক মিউটেশনের ফলে ভাইরাসটি বেশ কয়েকবার রূপ বদলেছে। রূপ বদলে নতুন ধরনে আরো বেশি সংক্রামক ও প্রাণঘাতী হয়েছে রোগটি। আরো সক্রিয় হচ্ছে করোনা। চলছে দ্বিতীয় ঢেউ। করোনার টিকা আবিষ্কার হলেও এখনো অস্বস্তিতেই বিশ্ববাসী। মহামারি ঘোষণার মাত্র বারো মাসের ব্যবধানে বিশ্বের ২১২টি দেশের চৌদ্দ কোটি মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, হারিয়ে গেছে ত্রিশ লাখ প্রাণ। ২০২১ সালের ১৪ এপ্রিল বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনে রেকর্ড ৯৬ জনের মৃত্যু হয়েছে আমাদের দেশে, কোথায় গিয়ে থামবে কোভিড-১৯ তা জানা নেই কারো।

প্রতিরোধে সচেষ্ট বাংলাদেশ

২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। বৈশি^ক এই ভাইরাস সংক্রমণের ব্যাপকতা ঠেকানো সম্ভব না। তাই করোনাভাইরাস প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধে জোর দেওয়া হয়। আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা এবং পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা ছাড়া সুরক্ষিত থাকার আর কোনো উপায় নেই। বাংলাদেশ সরকারও দফায় দফায় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। করোনা পরীক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি, বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ, আইসিইউ শয্যা বৃদ্ধি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, বিদেশগামী সকল ফ্লাইট বন্ধ ঘোষণার পাশাপাশি করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ রোধ করতে সরকার প্রথম দফায় ২০২০ সালের ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। বন্ধ রাখা হয় সব ধরনের দোকানপাট, বাণিজ্য তথা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বন্দরের বেলায় তো আর এ পরিস্থিতি খাটে না। ওষুধ ও জরুরি পণ্য পরিবহনসহ বন্দরগুলোও এ নিষেধাজ্ঞার বাইরে ছিল।

সজাগ ছিল চট্টগ্রাম বন্দর

গত বছরের মার্চে বন্দর ভবনে অনুষ্ঠিত এক জরুরি সভায় সমুদ্রপথে করোনাভাইরাস প্রবেশ প্রতিরোধে জাহাজের ক্যাপ্টেন এবং এজেন্ট কর্তৃক জাহাজ বহির্নোঙরে আসার সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়ে যথাযথ ঘোষণা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বন্দরে আসা জাহাজের মাস্টারকে পোর্ট লিমিটে আসার সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা দিতে হবে যে, ওই জাহাজে করোনাভাইরাস আক্রান্ত নাবিক নেই। এ ছাড়া অন্য দেশ থেকে আগত জাহাজগুলো শেষ বন্দর ছেড়ে আসার ১৪ দিন পর্যন্ত কোয়ারেন্টাইনে থাকবে। চট্টগ্রাম বন্দর জলসীমায় পৌঁছানোর পর শতভাগ নাবিকের পোর্ট হেলথ অফিসার কর্তৃক স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে নিরাপদ ঘোষণা করলেই কেবল বন্দরে ঢোকার অনুমতি মিলবে। বিদেশ থেকে বন্দরে আসা জাহাজের ভিনদেশি নাবিকদের শোর পাস (নগরে প্রবেশের পাস) ইস্যু করা হচ্ছে না। একই সঙ্গে কোনো জাহাজের নাবিক বদলির সুযোগও বন্ধ রাখা হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে অনলাইন বার্থিং মিটিং আয়োজনের চেষ্টা চলছে। তবে বাংলাদেশের কনটেনারাইজড পণ্যের হাব কলম্বো, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার তানজুং পেলেপাস বন্দর থেকে আগত কনটেইনার ফিডার জাহাজগুলো এই ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন বাধ্যবাধকতার বাইরে থাকছে। সেই সাথে বন্দর ইমিগ্রেশন ডেস্কে পোর্ট হেলথ অফিসারের তত্ত্বাবধানে একটি মেডিকেল টিম সার্বক্ষণিক দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে।

বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের প্রধান দুটি টার্মিনাল এনসিটি ও সিসিটির অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) ক্যাপ্টেন তানভীর হোসেন জানান, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বন্দরে। জ¦র মেপে হাত ধোয়া নিশ্চিত করে সবাইকে বন্দরের অভ্যন্তরে ঢোকানো হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের কাজে যারা জাহাজে উঠছেন তাদের ওঠার সময় একবার পুরো শরীরে জীবাণুনাশক স্প্রে করে দেওয়া হচ্ছে, আবার নামার সময় আরেকবার স্প্রে করা হচ্ছে। কর্মীদের জন্য সাবান, পানি, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক ও জীবাণুনাশক স্প্রেরও ব্যবস্থা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে বন্দরের কর্মকর্তা এবং ডাক্তারদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম প্রস্তুত করা হয়, যার সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছেন পোর্ট হেলথ অফিসার।

জাহাজ থেকে হাসপাতালে দ্রুত রোগী স্থানান্তরের জন্য বন্দরের অ্যাম্বুলেন্স শিপ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বন্দর ইমিগ্রেশন ডেস্কে পোর্ট হেলথ অফিসারের তত্ত্বাবধানে একটি মেডিকেল টিম সার্বক্ষণিক দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে। কোনো নাবিক বাইরে যেতে চাইলে মেডিকেল স্ক্রিনিংয়ে সুস্থতা সাপেক্ষেই শুধু অনুমতি দেওয়া হবে।

বন্দরের সকল বিভাগের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের নিরাপত্তার জন্য হ্যান্ড হেল্ড থার্মোমিটার, মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, পিপিই (পার্সোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট), ব্লিচিং পাউডার, প্রটেকটিভ গগলস এবং জীবাণুনাশক তরল ও সাবান সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বন্দর ভবন, সংলগ্ন স্থাপনা, বিভিন্ন ইয়ার্ড, জেটি এবং আবাসিক এলাকায় নিয়মিত বিরতিতে জীবাণুনাশক ছিটাচ্ছে বন্দর ফায়ার সার্ভিস।

গত বছরের ২৭ মে থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্মচারী পরিষদের কার্যালয়ে সম্ভাব্য রোগীদের জন্য নমুনা সংগ্রহ বুথ স্থাপন করা হয়। একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও একজন প্যাথলজিস্ট এ নমুনা সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত আছেন। সংগৃহীত নমুনা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ল্যাবে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। সেখান থেকে প্রাপ্ত ফলাফল বন্দরের ওয়েবসাইটে অনলাইনে দিয়ে দেওয়া হয়।

ডেডিকেটেড কোভিড ইউনিট

সর্বোচ্চ সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পরও বন্দরের ট্রাফিক, যান্ত্রিক, প্রশাসনসহ সকল বিভাগের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী আক্রান্ত হন। এপ্রিল মাস পর্যন্ত ১৮ জন মৃত্যুবরণ করেছেন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। ফলে বন্দর সচল রাখতে কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সঠিক চিকিৎসাপ্রাপ্তির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। বন্দরের সকল শ্রেণির কর্মী এবং তাঁদের পরিবারের সদস্য মিলিয়ে প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষের জন্য বিশেষায়িত ৫০ শয্যার কোভিড ইউনিট চালু হয় বন্দর হাসপাতালে। গত বছরের ১ জুলাই বন্দর হাসপাতালের নতুন ভবনের সি-ব্লকে কোভিড-১৯ ইউনিটের উদ্বোধন করেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। ১৩ জন ডাক্তার, ৩৬ জন নার্সসহ মোট ১৫৯ জন চিকিৎসাকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এখানে। করোনা আক্রান্ত রোগীর মাত্রাভেদে বিভিন্ন সময় অক্সিজেন সাপোর্ট প্রয়োজন হয়। প্রতি সেকেন্ডে অক্সিজেন মাত্রা সঠিকভাবে নির্ণয় করার জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি লাগে। গুরুতর রোগীদের ভেন্টিলেশন দরকার হয়। এসব বিষয় মাথায় রেখে সংক্রমিত রোগীদের চিকিৎসায় নিরবচ্ছিন্ন হাই ফ্লো অক্সিজেন সাপ্লাই, ফ্লোমিটার, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর, ভেন্টিলেটর ও অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হয়েছে, যার সিংহভাগই বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে।  

সরেজমিনে চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শন শেষে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব
মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী করোনাভাইরাসসৃষ্ট পরিস্থিতিতে বন্দর সচল রাখার বিষয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করেন

ইতিমধ্যে সরকারি প্রতিনিধি দল চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতালে টিকা প্রদানের সুবিধাদি পরিদর্শন করেছে এবং টিকা প্রদান ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও নার্সদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। এ বছর ১১ এপ্রিল বন্দর হাসপাতালে পরীক্ষামূলকভাবে টিকা প্রদান কার্যক্রম পরিচালনার পরদিন ১২ এপ্রিল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতালে টিকা প্রদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বন্দর হাসপাতাল কেন্দ্রে টিকাগ্রহণে ইচ্ছুক নাগরিকেরা সুরক্ষা অ্যাপে বা সফটওয়্যারে তাঁদের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে পারবেন। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে বন্দর কর্তৃপক্ষ চিঠি দেওয়ার প্রেক্ষিতে নতুন টিকাদান কেন্দ্রে পরিণত হলো বন্দর হাসপাতাল। চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের জন্য বন্দর হাসপাতালে ১১১ নম্বর কক্ষে রেজিস্ট্রেশন সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

করোনার প্রভাব বন্দরে

লকডাউনের কবলে পড়ে ইতিমধ্যে বিশে^র অর্থনীতি ধসে গেছে, ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত দেশগুলোর স্বাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়েছে। অথচ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে হলে সাপ্লাই চেইন তথা বন্দরগুলোকে সচল রাখতেই হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন চট্টগ্রাম বন্দর, যার স্লোগান হলো, ‘কান্ট্রি মুভস উইথ আস’। দেশের মোট আমদানির ৮২ শতাংশ আর রপ্তানির ৯১ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে চট্টগ্রাম বন্দর। সুতরাং আমদানি-রপ্তানির এই গতিতে সামান্যতম নেতিবাচক প্রভাব পড়লে তা পুরো দেশের অর্থনীতির ওপরই বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে যদি ডাক্তার আর নার্সরা সম্মুখযোদ্ধা হন, তাহলে তাঁদের হাতিয়ার হলো চিকিৎসায় ব্যবহৃত সকল সরঞ্জাম। দেশে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে চলা যুদ্ধের যন্ত্রাংশ, কাঁচামাল, কেমিক্যাল, ওষুধসহ সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর স্বাভাবিক সরবরাহ বজায় রাখতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিরামহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছেন চট্টগ্রাম বন্দরের সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী। বিশ্ব ব্যাপী মৃত্যু ও আতঙ্কের ভয়াল থাবা মেলে দেওয়া কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ ঠেকাতে গত বছর দেশে চলমান সাধারণ ছুটির মধ্যেও কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য ওঠানামা-সরবরাহ কাজ ২৪ ঘণ্টা সচল ছিল। এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে বন্দর ব্যবহারকারী বেশ ক’টি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমও ছিল অবাধ। খোলা ছিল পণ্য শুল্কায়নে জড়িত চট্টগ্রাম কাস্টমসের কার্যক্রমও, তবে সীমিত আকারে। ২০২০ সালের ২৬ মার্চ থেকে শুধু জরুরি খাদ্যপণ্য, ওষুধসহ নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের শুল্কায়ন করে কাস্টম হাউস। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনারজট বাড়তে থাকে। অবশ্য সরকারি-পরবর্তী নির্দেশে কাস্টমসের কাজও পুরোদমে সচল হয়। দিনে তিন ঘণ্টা করে খোলা রাখা হয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যক্রম। কিন্তু বন্দর ব্যবহারকারী সরকারি-বেসরকারি সবগুলো সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে সমন্বয় না থাকায় বন্দর থেকে পণ্য সরবরাহ কমে যায়। আগে দিনে যেখানে চার থেকে সাড়ে চার হাজার টিইইউ পণ্যভর্তি কনটেইনার বন্দর থেকে সরবরাহ নিতেন ব্যবসায়ীরা, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর ডেলিভারির সংখ্যা নেমে আসে দৈনিক ৫০০-৭০০ কনটেইনারে। কমতে কমতে এমনকি একেবারে শূন্য ডেলিভারির দিনও দেখেছে বন্দর।

বন্দর সচল রাখতে কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সঠিক চিকিৎসাপ্রাপ্তির বিষয়টি সামনে রেখে
সকল শ্রেণির কর্মী এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যের জন্য বিশেষায়িত ৫০ শয্যার কোভিড ইউনিট চালু হয় বন্দর হাসপাতালে

ঘোষিত সাধারণ ছুটির দিনগুলোতে রোস্টার অনুযায়ী দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মাধ্যমে চলছে সকল বিভাগের কার্যক্রম। গত বছর ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি শুরুর সময় থেকে বন্দর দিয়ে আমদানি করা সব ধরনের কনটেইনার রাখার ভাড়ায় অর্থাৎ স্টোর রেন্ট সুবিধায় সম্পূর্ণ ছাড় দিয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। সাধারণ ছুটির কারণে বেশির ভাগ সংস্থার সেবার আওতা সীমিত করায় এই ছাড় দেওয়া হয়। কিন্তু এ সুবিধা নিয়ে বেশকিছু আমদানিকারক নির্দিষ্ট সময়ে বন্দর থেকে কনটেইনার ছাড়িয়ে না নেওয়ায় পণ্যজট আরো বেড়ে গেলে প্রায় এক মাস পর ২০ এপ্রিল, ২০২০ থেকে তা প্রত্যাহার করে নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ।

পরে বিজিএমইএর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে শুধু তৈরি পোশাক কারখানার কাঁচামালের জন্য দ্বিতীয়বার স্টোর রেন্ট মওকুফ করে চট্টগ্রাম বন্দর। তবে এই সুবিধা সবার জন্য নিশ্চিত করতে বন্দরের অনুরোধে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় বিষয়টি বিবেচনায় নিলে আবার সব ধরনের পণ্যের জন্য ছাড়ের অনুমোদন মেলে। করোনায় লকডাউনজনিত কারণে দুই দফা স্টোর রেন্ট মওকুফ করায় গত বছর শুধু এপ্রিল-মে মাসে ব্যবসায়ী ও শিল্পমালিকদের ১৩৮ কোটি টাকা প্রণোদনা হিসেবে সুবিধা প্রদান করেছে চট্টগ্রাম বন্দর। এতে বন্দর দুই ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে। প্রথমত ১৩৮ কোটি টাকার রাজস্ব আয় কম, দ্বিতীয়ত উক্ত পণ্য দীর্ঘদিন সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অপারেটিং ব্যয়জনিত ক্ষতি অন্তত ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকা। তাছাড়া এই রাজস্ব আয় কম হওয়া মানে রাষ্ট্রেরও আয় কম হওয়া। কারণ বন্দরের আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ হারে আয়কর পেয়ে থাকে সরকার।

সংকটে রিফার কনটেইনার ব্যবস্থা

রিফার কনটেইনার হচ্ছে, বড় ধরনের ডিপ ফ্রিজ। এসব কনটেইনারে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত পণ্য যেমন ফলমূল, আদা, মাছ, মাংস, শাকসবজি, ক্ষেত্রবিশেষে পেঁয়াজ, দুধ, ফুল, ফার্মাসিউটিক্যালস আইটেম পরিবহন করতে ব্যবহৃত হয়। এসব কনটেইনার জাহাজে তোলার পর জাহাজেই বৈদ্যুতিক সংযোগ দিয়ে রাখা হয়। আবার বন্দরে নামানের পর খালাস না হওয়া পর্যন্ত বন্দর কর্তৃপক্ষ এসব কনটেইনারে বৈদ্যুতিক সংযোগ দিয়ে রাখে ভেতরের পণ্য সতেজ রাখতে। চট্টগ্রাম বন্দর ইয়ার্ডে বিশেষায়িত এসব কনটেইনার রাখার জন্য ডেডিকেটেড বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রয়োজন হয়। বন্দর ইয়ার্ডে রিফার কনটেইনার সংরক্ষণের জন্য বৈদ্যুতিক প্লাগ পয়েন্ট রয়েছে ১ হাজার ৪০০-এর সামান্য বেশি। আর ইয়ার্ডে রিফার কনটেইনার সংরক্ষণ ক্যাপাসিটি রয়েছে ২ হাজার ৬০০ টিইইউ। প্লাগ পয়েন্টের চেয়ে ইয়ার্ডে রিফার কনটেইনারের স্তূপ বেড়ে গেলে প্লাগ পয়েন্ট ব্যবহারে রেশনিং করা হয়। ৩-৪ ঘণ্টা পরপর প্লাগ পয়েন্ট পরিবর্তন করে অন্য কনটেইনারে দেওয়া হয়। করোনা পরিস্থিতিতে রিফার কনটেইনারের স্তূপ বেড়ে গেলে এভাবেই রেশনিং পদ্ধতিতে কোনো রকমে চলে আসছিল। রিফার কনটেইনার স্বাভাবিক গতিতে ডেলিভারি না হওয়ায় ইয়ার্ডে রিফার কনটেইনারের বর্ধিত ধারণক্ষমতাও ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষ করোনা পরিস্থিতির প্রণোদনা হিসেবে সব ধরনের কনটেইনারের ওপর শতভাগ স্টোর রেন্ট মওকুফের ঘোষণা দিলেও রিফার কনটেইনার ডেলিভারিতে ধীরগতি থেকেই যায়। ইয়ার্ডে বিশেষায়িত এসব কনটেইনার রাখার স্থানাভাবের কারণে জাহাজ থেকে কনটেইনার খালাসেও সমস্যা হতে থাকে। কারণ এতে জাহাজের সেইলিং (বন্দর ত্যাগ) ও টার্ন অ্যারাউন্ড টাইম (গড় অবস্থানকাল) উভয়ই বৃদ্ধি পায়।

চট্টগ্রাম বন্দর এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় কোল্ড চেইন লজিস্টিকের অভাব প্রকট হয়ে ওঠে এ দুর্যোগে। রিফার বা অন্যান্য কনটেইনারের মাধ্যমে আমদানিকৃত খাদ্যজাতীয়/কৃষিজাত পণ্যের ক্ষেত্রে প্লান্ট কোয়ারেন্টাইন এবং পরমাণু শক্তি কমিশন রেডিয়েশন সনদ প্রয়োজন হয়। লকডাউনের কারণে এই কার্যালয়গুলো যথাযথ সার্ভিস না দেওয়ায় এ জাতীয় কনটেইনার ডেলিভারি সীমিত হয়ে পড়ে। বন্দরের অভ্যন্তরে প্লান্ট কোয়ারেন্টাইন, এটমিক এনার্জি কমিশন, বিএসটিআই, বিজিএমইএ এবং বেজার কার্যালয়ের প্রয়োজন তীব্রভাবে অনুভূত হয় এ সময়।

সংকট কাটাতে একযোগে প্রচেষ্টা

চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ধারণক্ষমতা ৪৯ হাজার ১৮ টিইইউ (প্রতিটি ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে কনটেইনারকে এক একক ধরে)। বন্দরের হিসাবে ২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল দিন শেষে জমা ছিল ৪৭ হাজার ৪১৩ টিইইউ কনটেইনার। বিশেষ ব্যবস্থায় কিছু খালি জায়গায় এবং নির্মাণাধীন ওভারফ্লো ইয়ার্ডে নিরাপত্তাঝুঁকি নিয়েও আমদানি কনটেইনার সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। গত বছর ১৫ এপ্রিল অন্তত ১৫ থেকে ২০ হাজার টিইইউ কনটেইনার বন্দর ইয়ার্ড থেকে সরিয়ে বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে (আইসিডি) পাঠানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অনুমোদন চেয়ে চিঠি পাঠানো হয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে। সেই সাথে পরিস্থিতি সামাল দিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে লকডাউনের মধ্যে গেল বছর বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন ১৪ এপ্রিল সার্কিট হাউসে বন্দর কর্তৃপক্ষ, বন্দর ব্যবহারকারী, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের উপস্থিতিতে জরুরি সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার, বন্দরের চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার, সিটি মেয়র, ডিজিএফআইয়ের কমান্ডার, চট্টগ্রাম বন্দরের দুই পর্ষদ সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) ও সদস্য (হারবার অ্যান্ড মেরিন) উপস্থিত ছিলেন। বন্দরের অচলাবস্থা উত্তরণে এই সভা টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে।

সাধারণত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া ৩৮ ধরনের পণ্যবাহী কনটেইনার বেসরকারি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোগুলোতে (আইসিডি) নিয়ে খালাস করা হয়। লকডাউনজনিত স্থবিরতার ফলে গত বছর ১৮ এপ্রিল এনবিআরের এক আদেশে আরো ছয় ধরনের এবং ২৩ এপ্রিল আরেক আদেশে সকল ধরনের পণ্য অফডকগুলোতে নিয়ে খালাসের অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে তিনটি শর্ত সাপেক্ষে। অফডকগুলোতে স্থানান্তরের সময় শতভাগ কনটেইনার আবশ্যিকভাবে স্ক্যানিং ও স্ক্যানিং রিপোর্ট সংরক্ষণ করতে হবে। অফডকে স্থানান্তরিত সব বাণিজ্যিক পণ্যের চালান অবশ্যই কাস্টম হাউস, চট্টগ্রাম এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও অধিদপ্তরের প্রতিনিধির সমন্বয়ে শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করে প্রাপ্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে। ৩০ জুনের পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এ আদেশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যায় যা আর বর্ধিত করা হয়নি।

নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর পরিদর্শন

নতুন করোনা পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদানের জন্য ২৩ এপ্রিল ঢাকা থেকে ছুটে আসেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী। বন্দর ভবনে অনুষ্ঠিত বন্দর কর্তৃপক্ষ ও ব্যবহারকারীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা শেষে প্রেস ব্রিফিং এ নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী ও সচিব পণ্যজট ৫০ শতাংশ হ্রাসের আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এরপর সরেজমিনে বন্দর পরিদর্শনের সময় প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মেজ্বাহ উদ্দিন চৌধুরী, বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানসহ পর্ষদ সদস্যবৃন্দ।

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে এক দিনের বেতন জমা দিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এপ্রিল মাসের বেতন থেকে বন্দরের প্রায় ৬ হাজার কর্মীর এক দিনের বেতন বাবদ ২৯ লাখ ৪২ হাজার ২০৪ টাকা তহবিলের ব্যাংক হিসাবে হস্তান্তর করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর আগে নৌপরিবহন মন্ত্রাণালয়ের মাধ্যমে বন্দরের তহবিল থেকে এককালীন ২৫ কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হয়।

করোনায় স্থিতিশীল বাজার

বন্দরে বর্তমানে প্রতিটি জাহাজকে এক দিন বাড়তি অপেক্ষার জন্য গুনতে হয় প্রায় আট লাখ টাকা, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপরই বর্তায়। মহামারি শুরু থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ওষুধসামগ্রী এবং আদা, রসুন, পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে এসব পণ্য নিয়ে আসা জাহাজকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে জেটিতে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে বাজারদর ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষ এ বিশেষ ব্যবস্থা নেয়। বন্দরের পরিবহন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, যেসব জাহাজে অন্তত ১৫০ বক্স ধরনের পণ্য অথবা এর যেকোনো একটি পণ্য ৫০ বক্স বা তার বেশি থাকলে সেটা জেটিতে ভেড়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে। তবে একসঙ্গে কেবল একটি জাহাজ এই সুবিধা পাবে। অর্থাৎ এভাবে বার্থ পাওয়া একটি জাহাজ নোঙর তোলার পর অনুরূপ আরেকটি জাহাজ প্রবেশের সুযোগ পাবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, একই সময়ে একাধিক জাহাজ থাকলে সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সংখ্যক কনটেইনারের ভিত্তিতে অগ্রাধিকারপ্রাপ্তি বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে।

দেশের সাপ্লাই চেইন স্বাভাবিক রাখতে যত দ্রুত সম্ভব পণ্য খালাস করে নেওয়ার জন্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছেও চিঠি দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। পণ্য খালাস নেওয়ার জন্য বন্দরের কাছ থেকে সরাসরি আমদানিকারকদের কাছে চিঠি দেওয়ার মতো উদ্যোগ সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রথম। বন্দর চত্বরে যাদের আমদানি করা পণ্য পড়ে রয়েছে, তাদের কাছে পৃথক পৃথক চিঠি দিয়ে তা খালাসের জন্য এই চিঠি দেওয়া হয়। আবার চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ফল ব্যবসায়ী সমিতিকেও পৃথক চিঠি দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। যেসব পণ্যের ক্ষেত্রে বন্দরে রাখার নির্দিষ্ট সময়সীমা পেরিয়ে গেছে, সেগুলো নিলামে তুলতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে আরএল (রিমুভ লেটার) পাঠায় চট্টগ্রাম বন্দর। ভোগ্যপণ্যের কনটেইনার দীর্ঘদিন পড়ে থাকলে পণ্যের গুণগত মান নষ্ট হয়ে বাণিজ্যিক মূল্য হারায়।

ধীরে ধীরে ছন্দে ফেরা

দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের কনটেইনার ও জাহাজজট কমাতে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের সুফল মিলতে থাকে। লকডাউনের মধ্যেও দ্রুততম সময়ে স্বাভাবিক হয় কনটেইনারজট। ২০২০ সালের ৩০ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সকাল আটটা পর্যন্ত আগের ৪৮ ঘণ্টায় বন্দর থেকে ৮ হাজার ৬৮২ টিইইউ কনটেইনার ডেলিভারি দেওয়া হয়। ডেলিভারি বাড়ায় বন্দর এলাকায় কনটেইনারবাহী প্রাইম মুভার, ট্রেইলার, কাভার্ড ভ্যান, ট্রাক চলাচলও বাড়তে থাকে।

বিশ্বব্যাপী করোনার প্রভাবে আমদানি সবচেয়ে বেশি কমেছে  ২০২০ সালের এপ্রিল, মে ও জুনে। তবে জুলাই থেকে ধারাবাহিকভাবে পণ্যের হ্যান্ডলিং বাড়তে থাকে। ওই মাসে আমদানি পণ্যভর্তি কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ১ লাখ ২৩ হাজার ৮০৮ টিইইউ (টোয়েন্টি ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিটস)। এরপর যথাক্রমে আগস্টে ১ লাখ ২৬ হাজার ৮০৩, সেপ্টেম্বরে ১ লাখ ২৮ হাজার ৬৮, অক্টোবরে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৬৩৫ ও নভেম্বরে ১ লাখ ২১ হাজার ১২১ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। সেপ্টেম্বর থেকে আমদানি বাণিজ্যে আগের গতি পুরোপুরি ফিরে পায় চট্টগ্রাম বন্দর। মূল ইয়ার্ডের সঙ্গে ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) ও ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনালের (আইসিটি) হ্যান্ডলিং কার্যক্রমও যুক্ত হয়েছে এ হিসাবে। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ভিত্তিতে গেল বছর লয়েডস লিস্ট যে শীর্ষ ১০০ বন্দরের তালিকা করেছে, তাতে ৫৮তম অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। কিন্তু কোভিড এসে ব্যাহত হয়েছে বন্দরের এ অগ্রযাত্রা। অথচ গত পাঁচ বছরের হিসাব বিবেচনায় নিলে এ বন্দরে পণ্যের ওঠানামায় গড়ে সাড়ে ৯ থেকে ১০ শতাংশ করে প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল।

খালাস না হওয়ায় এভাবেই বন্দরে পড়ে ছিল পচনশীল পণ্য পরিবাহী রিফার কনটেইনারগুলো। স্বাভাবিক গতিতে ডেলিভারি না হওয়ায়
ইয়ার্ডে রিফার কনটেইনারের বর্ধিত ধারণক্ষমতাও ছাড়িয়ে যায়। ফলে জাহাজ থেকে কনটেইনার খালাসেও সমস্যা হতে থাকে।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে কোভিডের প্রভাব সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয় গত এপ্রিল ও মে মাসে। ওই দুই মাসে যথাক্রমে ১৪ হাজার ৭৪৪ ও ৩৩ হাজার ৮৩৬ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। পরের দুই মাস রপ্তানিতে কিছুটা গতি এলে জুনে ৫২ হাজার ১৪৯ টিইইউ ও জুলাইয়ে ৭৪ হাজার ৮৪৯ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয় বন্দর দিয়ে।

এরই মধ্যে নতুন উচ্চতায়

করোনার ধাক্কায় গত বছরজুড়ে যেখানে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যসহ সব ধরনের ব্যবসায় ছিল মন্দাভাব। তেমন এক বছরে চট্টগ্রাম বন্দর ইতিহাসের অংশ হয়েছে প্রথমবারের মতো। চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাসের পাতায় গত জুলাই মাসের কথা লেখা থাকবে সবসময়। এই মাসে চট্টগ্রাম বন্দর ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হিসেবে বিশে^ পরিচিতি পেয়েছে। এই বন্দর দিয়ে আগেও নেপালের ট্রানজিট পণ্য পরিবহন হয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিক ট্রানজিট চুক্তির আওতায় এই বন্দর হয়ে সড়কপথে ভারতে পণ্য নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে গত জুলাইয়ে।

করোনা মহামারির মধ্যে মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে বন্দরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা আক্রান্ত হয়েছেন, মারাও গেছেন অনেকে। এমন বৈরী পরিস্থিতিতেও এ বন্দর ছোটো আকারে হলেও ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের পণ্য পরিবহন করে সক্ষমতা দেখিয়েছে। উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দর মূলত প্রান্ত বন্দর, অর্থাৎ শেষ ব্যবহারকারীর হাতে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার বন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা

চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে করোনার প্রভাব কিছুটা কাটিয়ে দেশে শিল্প-কারখানা সচল হতে থাকলে সরকারি প্রকল্পের আমদানির পাশাপাশি সক্রিয় হতে শুরু করেন বেসরকারি আমদানিকারকরা। বন্দরের আমদানি পরিচালন কার্যক্রমেও গত ছয় মাসে ইতিবাচক চিত্র দৃশ্যমান হতে থাকে ধারাবাহিকভাবে। কিন্তু রপ্তানির ধারাবাহিকতায় ফের ধাক্কা দিয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলোতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় লকডাউনের কারণে আবারো স্থবিরতা নেমে এসেছে রপ্তানি কার্যক্রমে। এতে চট্টগ্রাম বন্দরে আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায় রপ্তানি কনটেইনার হ্যান্ডলিং।

বছরের ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হয় দেশে দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউন। ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (প্রশাসন) স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে ঘোষিত সরকারি ছুটির মধ্যে বন্দরের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় এবং কার্যক্রম নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।

●             চট্টগ্রাম বন্দরের নৌ-বিভাগ বন্দরে আগত জাহাজের জন্য পাইলটিং সার্ভিস যথারীতি চালু রাখবে। তার আগে আইএমও এবং ডব্লিউএইচও ঘোষিত পদ্ধতি অনুসারে জাহাজের নাবিকদের কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে জাহাজ বার্থিং করাবে। এছাড়া ভিটিএমআইএস এবং ভিটিএসএস সার্বক্ষণিক সচল থাকবে।

●             পরিবহন বিভাগ বন্দরে আগত জাহাজসমূহতে পণ্য ওঠানামার যাবতীয় কার্যক্রম আগের মতোই ২৪/৭ সম্পাদন করবে। ন্যূনতম জনবল দিয়ে কাস্টম বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত ক্লিয়ারেন্সের পর দ্রুততার সাথে পণ্য ডেলিভারির ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

●             চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগ বন্দরের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম গ্রহণ করবে।

●             চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম সার্বক্ষণিকভাবে চালু থাকবে। চিফ মেডিকেল অফিসার প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসক ও নার্সদের রোস্টার দায়িত্ব বণ্টন করবেন। পাশাপাশি অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্যান্য সুবিধাদি সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত রাখবেন।

●             যান্ত্রিক বিভাগ বন্দরের সকল যন্ত্রপাতি সার্বক্ষণিক সচল রাখার নিশ্চয়তা বিধান করবে এবং প্রয়োজনীয় ন্যূনতম জনবল বিভিন্ন ওয়ার্কশপে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত রাখবে। এছাড়া প্রতিদিন প্রয়োজনীয় সংখ্যক ইসিএম চালককে দায়িত্ব পালনের জন্য সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখবে। ভাড়ায় চালিত গাড়িসমূহের ব্যবহার সীমিত রাখবে। লকডাউন/গণপরিবহন বন্ধ হয়ে গেলে যান্ত্রিক বিভাগ শিডিউল করে বিভিন্ন শিফটে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিবহনের ব্যবস্থা করবে।

●             বিদ্যুৎ বিভাগ ২৪/৭ চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে অপারেশনাল এরিয়াসহ সকল পয়েন্টে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করবে।

●             চট্টগ্রাম বন্দরের ফায়ার সার্ভিস টিম যথারীতি ২৪/৭ দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত থাকবে।

●             বন্দরের সিস্টেম অ্যানালিস্ট সিটিএমএস এবং আইসিটি বেইজড সুবিধাদি সচল রাখবে।

●             পুরকৌশল বিভাগ বিভিন্ন সেবা প্রদানের জন্য একটি ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম প্রস্তুত রাখবে। টিমের মোবাইল নম্বর, ইমেইল ঠিকানা ইত্যাদি পরিচালক (প্রশাসন), চবক (চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ) এর নিকট প্রেরণ করবেন।

●             বন্দরের দাপ্তরিক ও অপারেশনাল কার্যক্রম নির্বিঘœ রাখার লক্ষ্যে ও প্রশাসনিক প্রয়োজনে বন্দর পর্ষদ সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) ও সদস্য (অর্থ) পরস্পরের এবং সদস্য (প্রকৌশল) ও সদস্য (হারবার ও মেরিন) একে অপরের প্রতিভূ কর্মকর্তা হিসেবে বিবেচিত হবেন।

●             চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য ও কনটেইনার ডেলিভারি কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার জন্য পরিবহন বিভাগ, শিপিং এজেন্টস, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস, বার্থ অপারেটরস, টার্মিনাল অপারেটরস, শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরস এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারগণ কাস্টমস বিভাগকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবেন।

●             সকল বিভাগীয় প্রধানগণ জরুরি বিষয়ে ই-ফাইলিং এর মাধ্যমে দাপ্তরিক কাজ সম্পাদনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং ই-মেইল, টেলিফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করবেন।

●             পরিচালক (প্রশাসন), চবক এবং সচিব, চবক বন্দর ভবনের অফিস কার্যক্রম সমন্বয় করবেন। ছুটির দিনসমূহে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মচারী উপস্থিত রাখার ব্যবস্থা করবেন। অন্যান্য সকল কর্মচারী বর্ণিত ছুটিকালীন সময়ে কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারবেন না অর্থাৎ বাধ্যতামূলকভাবে বাসায় অবস্থান করবেন। অননুমোদিত কোনো কর্মচারীকে বন্দর ভবনে বা অন্য কোনো দপ্তরে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

●             বন্দরের অভ্যন্তরে বা বাইরে করোনা পরিস্থিতি-সংক্রান্ত বিষয়ে পরিচালক (নিরাপত্তা), চবক এবং পরিচালক (পরিবহন), চবক পোর্ট হেলথ অফিসার ডা. মো. মোতাহার হোসেন (টেলিফোন নম্বর +৮৮০৬৫৪৪৫৬৭৮৮) এর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করবেন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ২৫২০২২৪ নম্বরে যোগাযোগ করা যাবে।

●             অর্থ বিভাগ সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-আনুতোষিক ইত্যাদি নিয়মিত পরিশোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। 

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নাবিকের পরিচর্যায় বন্দর মেডিকেল বিভাগের বিশেষ টিমকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতালের উদ্যোগে ভাইরাসটির সংক্রমণ প্রতিরোধের লক্ষ্য মৌলিক সুস্থতা অনুশীলনের নানাবিধ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

তবু আশা

শুরুতে করোনা নিয়ে নানা ভয়, সিদ্ধান্তহীনতা এবং চিকিৎসার অব্যবস্থাপনায় এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। করোনা বা মহামারির অভিজ্ঞতা সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও প্রথম। যেহেতু ভাইরাসটি ছিল নতুন, তাই তার অনেক কিছুই অজানা ছিল। ফলে শুরুতে অনেক কিছুই ঠিক ছিল না। মানুষের মধ্যে সচেতনতা কম ছিল। এখন বারবার হাত ধোয়া, মাস্ক পরিধান করা, ভিড় এড়িয়ে চলার মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পক্ষে সচেতনতা বেড়েছে। ভ্যাকসিন এসে যাওয়ায় মানুষের আতঙ্ক কমেছে।

মহামারির শুরুর দিকে বিভিন্ন গ্রিনহাউস গ্যাস ও অন্যান্য বায়ুদূষণকারী পদার্থের নির্গমন উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেলেও তা পরবর্তীতে আবারো বেড়েছে। সব মিলিয়ে ২০২০ সালে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হওয়ার পরিমাণ প্রায় ছয় শতাংশ কমে যায়। পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী অনেক দেশের অনেক শহরেই এই দূষণের মাত্রা কমে এসেছে করোনার কল্যাণে। পরিবেশবাদীরা ধারণা করছেন, বিশ্বজুড়ে বিমান চলাচলের ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ ও যানবাহনের সীমিত চলাচলের কারণে জলবায়ুর ওপর করোনাভাইরাসের দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় নেওয়া ব্যবস্থা মডেল হিসেবে বৈশি^ক জলবায়ু পরিবর্তনের কাজেও ব্যবহার করার বিষয়ে চিন্তা করা উচিত। কারণ এখনো প্রতিষেধক না থাকায় করোনা থেকে সহসা রেহাই মিলবে না। স্টে হোম, কোয়ারেন্টাইন, অফিস ফ্রম হোম শব্দগুলো আরো বেশ কিছুদিন আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করবে। বৈশ্বিক এ মহামারি চলাকালীন এবং পরবর্তী সময়ে অর্থনীতি আর আগের মতো থাকবে না, এ কথা হলফ করেই বলা যায়। দেশে দেশে মৈত্রী, সহায়তা ও অর্থনীতির নতুন মেরুকরণ হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের মতো মধ্যম আয়ের দেশে নাগরিকদের জীবনমান নিশ্চিত করতে হলে চট্টগ্রাম বন্দর ও বন্দর ব্যবহারকারী পক্ষগুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে হতে হবে একে অপরের সহায়ক। সার্বিকভাবে বন্দরের কাজ ত্বরান্বিত করার দিকে নজর দিতে হবে সবাইকে। শুধু বন্দরের দক্ষতা বাড়ালে হবে না। সংশ্লিষ্ট অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতাও বাড়াতে হবে।

ইনফোগ্রাফিক্স- মার্চ, ২০২১

মার্চ, ২০২১

বিদেশি বিনিয়োগ টানতে ‘ব্র্যান্ডিং’ করাবে বিডা

বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের চিত্র (এফডিআই) স্থির প্রকৃতির। প্রতি বছর ঘুরেফিরে গড়ে ৩০০ কোটি ডলার এফডিআই আসে দেশে। কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ না আসার পেছনে অনুকূল পরিবেশ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও বাংলাদেশ সম্পর্কে দেশের বাইরে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে দায়ী করে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। তাই বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এজন্য দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়াতে কয়েকটি দেশে প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশকে বাইরের দেশে ব্র্যান্ডিং করার জন্য আমরা বেটার বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনকে (বিবিএফ) দুই বছরের জন্য নিয়োগ করছি। প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের অনুরোধ করবে বিবিএফ। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরবে তাঁরা। একই সঙ্গে বাংলাদেশে অবকাঠামোগত যে অগ্রগতি হয়েছে, তা-ও তুলে ধরবে।’

বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে ১৯০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। সবশেষ প্রতিবেদনে এই অবস্থান ১৬৮তম। এমন বাস্তবতায় বিদেশে বাংলাদেশের অবস্থান শক্ত করতে বিবিএফকে নিয়োগ দিতে যাচ্ছে সরকার।

বিবিএফের চেয়ারম্যান মাসুদ এ খান বলেন, ‘আমাদের বৈশ্বিক একটা নেটওয়ার্ক আছে। আমরা বিদেশি দূতাবাসগুলোকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করব। বিনিয়োগকারীদের জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) সেবাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা তুলে ধরা হবে।’

ভারতে ভোজ্যতেল রপ্তানির আহ্বান হাইকমিশনারের

২০ শতাংশ মূল্য সংযোজন করে ভারতে ভোজ্যতেল রপ্তানি করতে পারে বাংলাদেশ, এ বিষয়ে মত প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী। পাশাপাশি বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) সনদ ভারতে গ্রহণযোগ্য করার ব্যাপারেও ইতিবাচক বিবেচনা করা হচ্ছে বলেও জানান হাইকমিশনার। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রহমানের সাথে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আলোচনা ও সৌজন্য সাক্ষাৎকালে এ কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, দিল্লি এবং চট্টগ্রাম বন্দরের মধ্যে পরিবহন ও সময়ের ব্যয় খুব বেশি। রপ্তানি ও আমদানি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে বাংলাদেশের সকল স্থলবন্দরগুলোতে অবকাঠামোগত এবং প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধার উন্নয়ন আবশ্যক বলে মন্তব্য করেন দোরাইস্বামী।

তিনি বলেন, পণ্য পরিবহনে দীর্ঘসূত্রতার ফলে ব্যবসা পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া ব্যয়সাশ্রয়ী হওয়ায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে রেলপথের ব্যবহার বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেন তিনি। এ লক্ষ্যে সিরাজগঞ্জে রেলওয়ের একটি কনটেইনার ডিপো স্থাপনেরও প্রস্তাব করেন ভারতীয় হাইকমিশনার।

করোনার টিকা শুল্কমুক্ত

সরকারি-বেসরকারি খাতে করোনার টিকা আমদানি করতে এখন থেকে আর অগ্রিম কর দিতে হবে না। শুধু কোভিড-১৯ টিকা নয়; মানুষের জন্য আনা সব ধরনের টিকা আমদানিতেই অগ্রিম কর মওকুফ করা হয়েছে। ১৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। সাধারণত যেকোনো পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ অগ্রিম কর দিতে হয়। পরে আমদানিকারক তা বার্ষিক আয়কর বিবরণীর সঙ্গে সমন্বয় করে নেন। এছাড়া জীবন রক্ষাকারী ওষুধ হিসেবে করোনার টিকা আমদানিতে ভ্যাট ও আমদানি শুল্কও নেই। ফলে কোনো শুল্ক-কর ছাড়াই টিকা আসবে দেশে।

পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সহায়ক হিসেবে পিপিই, মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, ফেশশিল্ডসহ অন্যান্য ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী আমদানিতেও কোনো শুল্ক-কর নেই। এমনকি এসব সুরক্ষাসামগ্রী বানাতে কাঁচামাল আমদানিতেও শুল্ক নেই।

বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ এখন নতুন উচ্চতায়

বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তথা মজুদ ৪ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। করোনার মধ্যে জোর গতিতে প্রবাসী আয় আসায় এবং পণ্য রপ্তানিতে বড় আকারে ধস না নামায় রিজার্ভ বেড়েই চলেছে।

আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকে ২৪ ফেব্রুয়ারি দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ হাজার ৪০২ কোটি ৮০ লাখ ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ৩ লাখ ৭৪ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে)। এই রিজার্ভ দিয়ে দেশের কমপক্ষে আট মাসের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা সম্ভব।

রিজার্ভের বেশ কয়েকটি উৎস রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বর্তমানে বড় ভূমিকা রাখছে প্রবাসী আয়। ফেব্রুয়ারির প্রথম ২৩ দিনে ১৪৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার প্রবাসী আয় এসেছে। এই আয় গত বছরের একই সময়ের ১২৪ কোটি ৬০ লাখ ডলারের চেয়ে ১৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ বেশি। প্রবাসী আয় বাড়াতে গত ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২ শতাংশ প্রণোদনা দিতে শুরু করে সরকার। এরপর থেকেই প্রবাসী আয়ে গতি আসে। বিশেষ করে করোনার পরে তাতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।

করোনাভাইরাসের মধ্যে গত ১ সেপ্টেম্বর রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ৩ হাজার ৯০০ কোটি ডলার অতিক্রম করে। ৮ অক্টোবর তা আরও বেড়ে ৪ হাজার কোটি ডলারে ওঠে।

নওয়াপাড়া থেকে রেলপথে সার যাচ্ছে নেপালে

বাংলাদেশ থেকে রেলপথে সরাসরি ডিএপি (ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট) সার যাচ্ছে নেপালে। চীন থেকে আমদানি করা এই সার যশোরের নওয়াপাড়া রেলস্টেশন থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রোহনপুর এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার রাজ্য হয়ে পণ্যবাহী ট্রেনে নেপালে পাঠানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে ১৫ হাজার মেট্রিক টন সার নেপালে পাঠানো হয়েছে।

ট্রানজিটের আওতায় বাংলাদেশ ও ভারতের ভূখ- ব্যবহার করে নেপালে সার পাঠিয়েছে ঢাকাভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দেশ ট্রেডিং করপোরেশন। এ নিয়ে নেপাল সরকারের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির চুক্তি হয়েছে। বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে ১৯৭৬ সালে দ্বিপক্ষীয় ট্রানজিট ও প্রটোকল চুক্তি হয়। চুক্তিটির আওতায় নেপালকে ছয়টি বন্দর থেকে যানবাহনে পণ্য পরিবহনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বন্দরগুলো হচ্ছে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং বেনাপোল, বাংলাবান্ধা, বিরল ও চিলাহাটি স্থলবন্দর। এর মধ্যে বাংলাবান্ধা ছাড়া আর কোনো বন্দর দিয়ে নেপালে নিয়মিত পণ্য আনা-নেওয়া করা হতো না। ২০১৮ সালের ৩০ মে থেকে ১ জুন নেপালের কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত দুই দেশের বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের বৈঠকে নেপাল রোহনপুর থেকে পোর্ট অব কল, অর্থাৎ যানবাহনে পণ্য পরিবহনের সুযোগ চায়। এরপর ২০২০ সালের ১০ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে নতুন এই ট্রানজিট পথের খসড়া অনুমোদন করা হয়।

ট্রানজিটের আওতায় রেলপথে দুই উপায়ে বাংলাদেশ থেকে নেপালে সরাসরি পণ্য পরিবহন হয়। এর একটি হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জের রোহনপুর-ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহের সিঙ্ঘাবাদ-বিহারের জগবানি-নেপালের বিরাটনগর, আর অন্যটি হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রোহনপুর-পশ্চিমবঙ্গের বিরল-রাধিকাপুর-বিহারের রক্সল-নেপালের বীরগঞ্জ।

২০০৪ সালে ভারতের সিঙ্গাবাদ থেকে নেপালের বিরাটনগর পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ চালু হয়। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ অংশে ব্রডগেজ রেলপথ চালু হওয়ার ফলে সরাসরি নেপালের সঙ্গে পণ্য পরিবহনের সুযোগ তৈরি হয়।

যুক্তরাজ্যে ২০২৭ সাল পর্যন্ত জিএসপি পাবে বাংলাদেশ

যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসন ১৬ ফেব্রুয়ারি দুই দেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রথম বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্মেলন নিয়ে এক ব্রিফিংয়ের আয়োজন করেন। এ সময় তিনি জানান, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলেও ২০২৭ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা পাবে। দুই ধাপে তিন বছর করে বাংলাদেশের পণ্য যুক্তরাজ্যের বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা বা জিএসপি পাবে।

রবার্ট ডিকসন বলেন, ‘বিশেষ করে উচ্চমানের সেবা খাতসহ যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বাংলাদেশে ব্যবসার সুযোগ বাড়ছে। রপ্তানিভিত্তিক বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিকে বিকশিত করার ক্ষেত্রে সহযোগিতার অংশ হিসেবে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলেও দুই ধাপে তিন বছর করে যুক্তরাজ্যের বাজারে জিএসপি সুবিধা পাবে। প্রথম ধাপে ২০২৪ সাল আর দ্বিতীয় ধাপে ২০২৭ সাল পর্যন্ত জিএসপি সুবিধা পাবে।’

রবার্ট ডিকসন জানান, বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের তৃতীয় বৃহত্তম গন্তব্য যুক্তরাজ্যের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ৩৪০ কোটি পাউন্ড। এর মধ্যে বাংলাদেশ সে দেশে রপ্তানি করেছে ২৮০ কোটি পাউন্ডের পণ্য, আর যুক্তরাজ্য থেকে আমদানি করেছে ৬৩ কোটি পাউন্ডের পণ্য। মূলত যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের রপ্তানির অধিকাংশই হচ্ছে তৈরি পোশাক। আর বাংলাদেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগকারী দেশ হচ্ছে যুক্তরাজ্য।