Home Blog Page 234

ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজ ও মাইনমুক্ত বন্দর বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক প্রজ্ঞা এবং নেপথ্যের নায়কেরা

সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ। ঘরে-বাইরে মুক্তির আনন্দ। সেই আনন্দ দ্বিগুণ হয় ’৭২ এর ১০ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে। যুদ্ধটা এখানেই শেষ নয়Ñদেশে পৌঁছেই বুঝেছিলেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানি বাহিনীর তা-বে সারা দেশ পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে, মানুষের কাজ নেই, ক্ষেতে ফসল নেই, ঘরে খাদ্য নেই। খুব দ্রুত অর্থনীতি সচল করা না গেলে, দেশে আমদানি পণ্য খাদ্য সহায়তা না পৌঁছলে মানবিক বিপর্যয় আসন্ন। সেটাও তখন সম্ভব হচ্ছিল না। বাংলাদেশের বাণিজ্যের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দর মোংলা বন্দর তখন একেবারেই ব্যবহারের অনুপযোগী। যুদ্ধে ডুবে যাওয়া জাহাজ এবং পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া ডুবোমাইনে চট্টগ্রাম বন্দর এর চ্যানেল পরিণত হয়েছিল এক আতঙ্কের নামে। এমনকি নৌচলাচলে ঝুঁকির কারণে আন্তর্জাতিক বীমা প্রতিষ্ঠান লয়েডস তাদের প্রিমিয়াম ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করেছিল।

এমন সংকটে বঙ্গবন্ধু দেখালেন তাঁর অনন্য কূটনৈতিক প্রজ্ঞা। দ্রুততম সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে রাজি করিয়ে ফেলেন বন্দরের মাইন অপসারণ ডুবে-থাকা জাহাজ উদ্ধারে। কোনো অর্থব্যয় ছাড়াই মাত্র চার মাসে প্রাথমিকভাবে এবং দুইবছর তিন মাসের মাথায় সম্পূর্ণ ব্যবহার উপযোগী হলো চট্টগ্রাম বন্দর।

মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বন্দর

যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে প্রবেশের আকাশপথ ভারতের কড়া নজরদারিতে থাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে অস্ত্র, রসদ আর গোলাবারুদ পৌঁছাতো সমুদ্রপথে, চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে। তাই চট্টগ্রামসহ গুরুত্বপূর্ণ নৌবন্দরগুলো অকার্যকর করে দিতে ১৬ আগস্ট ১৯৭১ এর প্রথম প্রহরে একযোগে গেরিলা আক্রমণ করে অসম সাহসী নৌ যোদ্ধারা। ইতিহাসে এটি অপারেশন জ্যাকপট হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। অপারেশন জ্যাকপটে চট্টগ্রাম বন্দরের ১০টি লক্ষ্যবস্তু সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়। এর মধ্যে ছিল ৯ হাজার ৯১০ টন অস্ত্র-গোলাবারুদবাহী জাহাজ এমভি হরমুজ, ১০ হাজার ৪১৮ টন সামরিক সরঞ্জামবাহী এমভি আল-আব্বাস এবং ৬ হাজার ২৭৬ টন অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে ফিশ হারবার জেটির সামনে অবস্থান করা ওরিয়েন্ট বার্জ নং ৬। এতে চট্টগ্রাম বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পাকিস্তানিদের সরবরাহ শৃঙ্খল।

পরবর্তীতে ভারত মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে ৪ ডিসেম্বর ভারতীয় নৌবাহিনীর রণতরী ‘আইএনএস বিক্রান্ত’ থেকে যুদ্ধবিমান চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার পোতাশ্রয়ে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে ওখানে থাকা বেশির ভাগ জাহাজই ডুবে যায় কিংবা অকার্যকর হয়ে পড়ে। অন্যদিকে পরাজয় নিশ্চিত হলে পাকিস্তানিরা ভারতীয় নৌবাহিনী কিংবা খাদ্য ও জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জামের সম্ভাব্য প্রবেশ রোধে বন্দর চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের প্রবেশপথে অসংখ্য মাইন ছড়িয়ে দেয়। আত্মসমর্পণের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে পাক নৌবাহিনী পূর্ব পাকিস্তান থেকে লুণ্ঠিত প্রচুর স্বর্ণ ও  রুপার অলঙ্কার, পাকিস্তান জাতীয় ব্যাংকের পূর্ব পাকিস্তান শাখায় মজুদকৃত ৬টি বৃহৎ ট্রাংকভর্তি স্বর্ণবাহী জাহাজ বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে দেয়। সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর এলাকা ও তার আশপাশে সে বছরের ডিসেম্বর মাসে ৪০টির বেশি নৌযান নিমজ্জিত অবস্থায় ছিল।

প্রয়োজন জরুরি পুনর্গঠন

ডুবে যাওয়া জাহাজ এবং যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মাইনের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর ও সংলগ্ন এলাকা পুরোপুরি নৌচলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এছাড়া তা স্থানীয় জেলে এমনকি জনসাধারণের জন্যও বড় ধরনের নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি করে। ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে এ রকম একটি মাইন ভেসে কুতুবদিয়ার তীরে চলে আসে। চিনতে না পেরে স্থানীয় লোকেরা তা লোকালয়ে নিয়ে আসলে সেটি বিস্ফোরিত হয়। এতে নিহত হয় ১৫ জন গ্রামবাসী, পুড়ে যায় অন্তত দশটি ঘর।

সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজ এবং মাইন অপসারণ করতে হতো সবচেয়ে অগ্রাধিকারভিত্তিতে। বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে অতি দ্রুত উদ্ধার ও মাইন সুইপিংয়ের কষ্টসাধ্য কাজ শুরু করে ভারতীয় নৌবাহিনী। চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে ব্যবহারোপযোগী করে তোলার জন্য একই সাথে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চাইলেন তিনি। বন্দরে এল পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ দল। সমীক্ষা শেষে তাঁরা জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেলকে সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত করতে কমপক্ষে তিন বছর সময় লাগবে। সেই সাথে প্রয়োজন বিপুল অঙ্কের অর্থ।

মাইন অপসারণ: শুরুটা ভারতের হাতেই

খুবই সীমিত আকারে ভারতীয় নৌবাহিনী চট্টগ্রাম বন্দরে মাইন অপসারণের কাজ শুরু করেছিল। মাইন অপসারণের ক্ষেত্রে ভারতীয় নৌবাহিনীর অভিজ্ঞতা ছিল নিতান্তই কম এবং তাদের মাইন সুইপিং জাহাজের সংখ্যা ছিল নগণ্য। প্রকৃতপক্ষে ট্রেনিং স্কুলের বাইরে এই প্রথম ভারতীয় নাবিকেরা লাইভ মাইন নিয়ে কাজ করছিল। তবে ভারতীয় নৌবাহিনী একটা কাজের কাজ করে। বন্দি পাকিস্তানি নৌ-কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে মাইনগুলোর অবস্থান ও গভীরতা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করে তাঁরা। কোস্টাল ক্র্যাফট ব্যবহার করে ১ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে মোট ৯৪টি মুরড কন্ট্যাক্ট টাইপ মাইন পুঁতে রাখে পাকিস্তানিরা। ২৩ ও ২৪ ডিসেম্বর বিমানবাহী রণতরী বিক্রান্ত থেকে উড়ে আসা যুদ্ধবিমান অ্যালিয থেকে মাইনফিল্ডে বোমা বর্ষণ করা হয়, যাতে যথাসম্ভব বেশি করে মাইন বিস্ফোরণ করানো যায়। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে আইএনএস ক্যানানোর, আইএনএস বুলসার ও আইএনএস ভাটকালÑএই তিন মাইন সুইপার জাহাজ পুরোদমে কাজ করছিল চট্টগ্রাম বন্দরে। এ সময় দুর্ঘটনায় পড়ে বুলসার। মাইন বিস্ফোরিত হয়ে এটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বেশ কয়েকজন ভারতীয় নাবিক হতাহত হয়। পশুর নদে ভেসে আসা মাইন বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরেক মাইন সুইপার বিশ্ব কুসুম। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছায় ভারতীয় নৌবাহিনীর আরও দুই মাইন সুইপার কাঁকিনাড়া ও কারওয়ার।

এমএস খাবারোভস্ককের ডেকে মাইন অপসারণ কাজে ব্যস্ত রাশিয়ান নৌবাহিনীর সদস্যরা

কিন্তু ডুবে থাকা বা ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ উদ্ধারের কাজ তখনো অতল তিমিরে। ওদিকে দেশি-বিদেশি চাপ এবং কূটনৈতিক কারণে বাংলাদেশ থেকে দ্রুত ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয় এবং ১৯৭২ সালের মার্চের মধ্যে ভারতীয় সৈন্যরা দেশে ফিরে যায়। এরই অংশ হিসেবে অল্প কয়েকটি মাইনসুইপার বাদে ভারতীয় নৌবাহিনীকেও বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা থেকে বিদায় নিতে হয়।

বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক তৎপরতা: মঞ্চে আরেক বন্ধুরাষ্ট্র

চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরকে ব্যবহার উপযোগী করতে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে দ্রুত সাড়া দেয় জাতিসংঘ ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। জাতিসংঘ একটি অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠান দিয়ে এই কাজটি সম্পন্ন করতে চাইছিল। এজন্য তাদের সময়ের প্রয়োজন ছিল এবং বেশ বড় অংকের অর্থও খরচ করতে হতো বাংলাদেশকে। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে রাজি হয়। সেই ধারাবাহিতায় ১৯৭২ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন। এটা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের প্রথম বিদেশ সফর। বঙ্গবন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব লিওনিদ ব্রেজনেভ, প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সি কোসিগিন ও প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পডগর্নির সঙ্গে বৈঠক করেন। দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও বন্ধুত্ব এগিয়ে নিতে ৩ মার্চ এক যৌথ ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরকে ব্যবহারোপযোগী করার কাজে দ্রুততম সময়ে ও নিঃশর্তভাবে মাইন অপসারণে সহায়তার আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেওয়া হয় ক্রেমলিন থেকে। বঙ্গবন্ধু এ প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেন।

আন্ডার-ওয়াটার রেসকিউ অপারেশনের উপযোগী যন্ত্রপাতি সজ্জিত রাশিয়ান জাহাজ উপহার হিসেবে দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশকে

২১ মার্চ ৯ সদস্যের একটি সোভিয়েত প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসে। দীর্ঘ ৩৪ ঘণ্টা আলোচনার পর বন্দরের মাইন অপসারণ ও ডুবে-থাকা জহাজ উদ্ধারে দুই দেশের মধ্যে একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যদিও আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হওয়ার আগেই সোভিয়েত ইউনিয়নে উদ্ধার অভিযানের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। ১৯ মার্চ উদ্ধার অভিযানের সার্বিক দায়িত্ব দেওয়া হয় বহু অভিযানের পোড় খাওয়া অফিসার রিয়ার এডমিরাল সের্গেই পাভলভিচ জুয়েনকোকে এবং ২২ মার্চ ১০০ নাবিকের সমন্বয়ে গঠিত একটি অগ্রবর্তী দল চট্টগ্রাম রওনা হয়। দলটিতে ছিল টাগবোট এন বি ১৭৫ এবং ডুবুরি নৌযান বি এম ৮৪। অন্যদিকে ২৭ মার্চ বিমানযোগে একদল মেরিন ইঞ্জিনিয়ারের সাথে ঢাকায় পা রাখেন রিয়ার এডমিরাল জুয়েনকো।

চট্টগ্রামে সোভিয়েত দল

জুয়েনকো ও তাঁর সহযাত্রী ইঞ্জিনিয়াররা ২৮ মার্চ সকালে চট্টগ্রামে পৌঁছেন। বন্দর ভবনে প্রাথমিক আলোচনা ও হালকা আপ্যায়নের পর সোভিয়েত অতিথিদের নিয়ে যাওয়া হলো মূল বন্দরে। সাথে ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তৎকালীন পরিচালক গোলাম কিবরিয়া। বন্দরে প্রবেশের আগেই তাঁদের চোখে পড়ে একটি ট্যাংকারের ধ্বংসাবশেষ, যার পেছনের অংশ এক পাশে হেলে আর সামনের অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে একটু দূরে পড়েছিল। বিধ্বস্ত ডকইয়ার্ডের কাছের পানিতে এদিক-সেদিক থেকে উঁকি দিচ্ছিল বেশকিছু ভাঙাচোরা নৌযান। কারো সামান্য অংশ দেখা যাচ্ছে, কেউ অর্ধডুবন্ত। প্রবেশপথে মাইন ফেলে রাখায় বন্দরে ঢুকতে না-পারা দশটির মতো জাহাজ বহির্নোঙরে নোঙর করে আছে। রীতিমতো ভয়জাগানিয়া দৃশ্য। সঠিক কর্মপরিকল্পনার জন্য বিশেষজ্ঞ দলের প্রতিবেদন দরকার। ৩০ মার্চ সোভিয়েত পর্যবেক্ষক দলের জাহাজ-উদ্ধার সম্পর্কিত প্রতিবেদন হাতে পান এডমিরাল জুয়েনকো। কিন্তু সেই প্রতিবেদনে ছিল না সুখকর কোনো খবর। প্রতিবেদনে বলা হয়:

● উদ্ধারকারী দলের বিদ্যমান সরঞ্জাম দিয়ে কেবল ন্যূনতম মাত্রায় বন্দরের স্বাভাবিক জীবন শুরু করা যাবে।

● পানির স্রোতের গড়ে ৮ নটিক্যাল মাইল হওয়ায় এবং অত্যধিক পলিযুক্ত পানির কারণে নদীর তলদেশে কিছু দেখা না যাওয়ায় জাহাজ উত্তোলনে ডুবুরিদের কাজে লাগানো নিষ্ফল ও বিপজ্জনক।

●  এ পরিস্থিতিতে জাহাজ তোলার কাজে পন্টুন ব্যবহার অবাস্তব চিন্তা।

এরকম একিট নৈরাশ্যজনক প্রতিবেদনে জাহাজ উদ্ধারে সফলতা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হলেও পিছু হটার কোনো উপায় ছিল না। তবে মাইন বিশেষজ্ঞ মাইন অপসারণে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু নির্দিষ্ট প্রস্তাবনা দিতে পেরেছিলেন।

২ এপ্রিল চট্টগ্রামে পৌঁছায় অগ্রগামী বহরের প্রথম জাহাজ ফ্লোটিং ওয়ার্কশপ পি এম ৪০। দ্রুত তাদের সরঞ্জাম স্থাপন করে কাজ শুরু করে। সোভিয়েত দলকে পূর্ণ সহযোগিতা করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দরের নেভিগেশনাল তথ্য, লে-আউটসহ সমস্ত প্রয়োজনীয় ডেটা সরবরাহ করায় জাহাজ উত্তোলনের পরিকল্পনা ও কাগজপত্র তৈরি সহজ হয়। মে মাসের ৪ তারিখের মধ্যে ব্লদিভস্তক থেকে ২২টি জাহাজ ও আরও ৭০০ নাবিক চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছে। ২২ নৌযানের মধ্যে মাইন অপসারণকারী জাহাজ, উদ্ধারকারী জাহাজ ও সহযোগী নৌযানের সব কয়টি ছিল সোভিয়েত প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের অংশ। রিয়ার এডমিরাল জুয়েনকোর নেতৃত্বে মোট ৮০০ সদস্য বিভিন্ন সময়ে এই অভিযানে অংশগ্রহণ করে।

এমভি আল-আব্বাসকে উদ্ধারের পর বন্দর থেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে

সোভিয়েতরা বঙ্গোপসাগরে থাকা অবশিষ্ট ভারতীয় জাহাজগুলোর সঙ্গে তাদের কার্যক্রম সমন্বয় করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ব্রিটিশনির্মিত ভারতীয় জাহাজগুলোর সঙ্গে সোভিয়েত জাহাজগুলোর সমন্বয় করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় এবং ১৯৭২ সালের নভেম্বরে অবশিষ্ট ভারতীয় জাহাজগুলোকেও প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।

সীমাহীন প্রতিকূলতা

সোভিয়েত নেভির স্পেশাল এক্সপিডিশন-১২ অপারেশনের নাবিকেরা যখন কাজ শুরু করে, তখন বন্দরের চারপাশ ছিল জাহাজের ধ্বংসাবশেষ ও মাইন দিয়ে ঘেরা। এমনকি বন্দরে যাওয়ার রাস্তায়ও মাইন পুঁতে রাখা হয়েছিল। চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করার ১৮টি স্থানের মধ্যে ১২টি যুদ্ধের সময়ই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। এত বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে ডুবে যাওয়া জাহাজ ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মাইন অপসারণ সোভিয়েত উদ্ধারকারী বাহিনীর জন্যও ছিল নতুন এবং অন্য রকম চ্যালেঞ্জ। ১৪ এপ্রিল ডুবুরিদের নিয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছে সোভিয়েত জাহাজ এম বি ১৭৫ আর বি এম ৮৪। এগুলো উপস্থিত হওয়া মাত্রই পি এম ৪০ এর ক্রুরা পূর্ণ উদ্যমে কাজ শুরু করে।

স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই মাইন অপসারণ, ডুবন্ত জাহাজ উদ্ধার করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। মানুষের শক্তির চরম সীমা বলতে যদি কিছু থাকে, নিশ্চিত করে বলা যায় মাইন-নিষ্ক্রিয়কারী দল সেই সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে কাজ করে। যে নৌকার পাটাতনে দাঁড়িয়ে মাইন অপসারণ করা হয়, প্রতি মুহূর্তে সেটা বিস্ফোরণের আশঙ্কা মনের ওপর কতখানি চাপ সৃষ্টি করে, সেটা একজন নাবিকই শুধু বোঝে। এ কারণে মাইন-সুইপিং জাহাজ দেখা মাত্র অন্য সব জাহাজ নিজেদের পতাকা অর্ধনমিত রাখে। এটি আন্তর্জাতিক শিষ্টাচার।

চট্টগ্রামের উদ্ধার অভিযান ছিল আরও কঠিন। কারণ কর্দমাক্ত, লবণাক্ত ও দূষিত কর্ণফুলী নদীর পানি ছিল অত্যন্ত ঘোলাটে এবং এর ফলে পানির নিচে দৃশ্যমানতা ছিল খুব কম। ডুবে থাকা জাহাজের ফাটল আর গোলায় সৃষ্ট গর্ত মেরামত, জাহাজগুলোর নিচ দিয়ে ক্রেনের টানার জন্য শিকল প্রবেশ করানো, তোলার জন্য পন্টুন প্রস্তুত করা কিংবা অবশেষে তুলে আনা-সব কাজই কঠিন হয়ে পড়ে। স্বচ্ছ পরিষ্কার সাগরের পানিতে কাজ করে অভ্যস্ত সোভিয়েত ডুবুরিরা বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপের পলিযুক্ত পানিতে ‘হাতে ধরে ধরে’ অনুমানের ভিত্তিতে সব কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

পলি ছাড়াও কর্ণফুলীতে কাজ করায় ছিল আরও প্রতিকূলতা। এখানে স্রোতের গতিপথ দিনে চারবার পরিবর্তন হয়। কাজের গতি ধরে রাখা আর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব কেবল স্রোতে পরিবর্তনের ১৫-২০ মিনিট আগে অথবা স্রোতে পরিবর্তন শেষ হওয়ার ৪০-৫০ মিনিট পরে। ফলে, ডুবুরিরা দৈনিক সাড়ে ৩ ঘণ্টার বেশি নদীতে নামতে পারছিলেন না। আবার একবারে ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটের বেশি পানির নিচে থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। ভøাদিভস্টকের মতো তীব্র শীতল পরিবেশে অবস্থান করে অভ্যস্ত সোভিয়েত নাবিকদের জন্য আমাদের দেশের উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া ছিল কঠিন। অর্থাৎ সীমাহীন চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে তাদেরকে কাজ করে যেতে হয়েছে নিরলস। তবে পেশাদার সোভিয়েত নাবিকেরা কঠিন এ কাজকে গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছিল। সব নেতিবাচক আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বসবাসের প্রতিকূল পরিবেশ আর বৈরী আবহাওয়ার বিরুদ্ধে সোভিয়েত নৌবাহিনীর পরিশ্রম ও কর্মতৎপরতা জয়ী হতে শুরু করে।

নৌযানের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারের জন্য পানির নিচে বিস্ফোরণ ঘটানোর পদ্ধতি ছিল সোভিয়েত নাবিকদের দৃষ্টিতে বেশি কার্যকরী ও দ্রুততর পদ্ধতি। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের তীরবর্তী নদী কর্ণফুলী তুলনামূলক সরু এবং বহু বাঁকবিশিষ্ট। সেখানে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করলে বন্দরে থাকা জাহাজগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এ ছাড়া মাছ ও অন্যান্য জলজ সম্পদের প্রভূত ক্ষতি হতো। এ জন্য সোভিয়েত নাবিকেরা নিমজ্জিত নৌযানগুলো উদ্ধারে সনাতন পদ্ধতি ‘ডুবন্ত পন্টুন’ কৌশল ব্যবহার করে। এই পদ্ধতিটি ছিল অত্যন্ত কঠিন, শ্রমনির্ভর ও সময়সাপেক্ষ। জাহাজের ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে পন্টুনকে যুক্ত করে তা সংকুচিত বাতাসের চাপ দিয়ে উপরে উঠানো হয়।

একাগ্রতায় আসে সাফল্য

সোভিয়েত উদ্ধারকারী দলের নিরলস চেষ্টা, শ্রম আর একাগ্রতায় সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে শিগ্গিরই সাফল্য আসতে শুরু করে। ২৩, ২৫, ২৭ এপ্রিল বন্দর থেকে সব মিলিয়ে ৫০ হাজার টনের তিনটি জাহাজ সরিয়ে ফেলা হয়, অবমুক্ত হয় প্রায় ৬০০ মিটার মিলিত দৈর্ঘ্যরে তিনটি টার্মিনাল। বন্দর আংশিকভাবে ব্যবহার উপযোগী হয়ে উঠে। মে মাসের প্রথমদিকে ১৫ হাজার টন ধারণক্ষমতার ‘সুদর্শনা হংকং’ ট্যাংকার জ্বালানি বহন করে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবেশ করে। এটাই ছিল উদ্ধার অভিযানের প্রথম সাফল্য।

নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৬ হাজার টনের বাল্ক জাহাজ আল-আব্বাস, ১৫ হাজার টনের আলী-বক্স, ১০ হাজার টনের ট্যাংকার আভালাঁশসহ ছোট-বড় বেশ কয়েকটি জাহাজ উদ্ধারের সাথে আরও একটি উল্লেখযোগ্য কাজ করে রুশীয়রা। ১৯৬০ সালের ভয়াল ঘূর্ণিঘড়ে ডুবে যাওয়া ৮ হাজার টনের মালবাহী জাহাজ ক্ল্যান আয়াইসকেও তুলে আনে কর্নফুলীর মোহনা থেকে।

সোভিয়েত উদ্ধারকারী দলের ১ নম্বর লক্ষ্যবস্তু ছিল কর্ণফুলীতে ডুবে থাকা বৃহত্তম জাহাজ ‘সোনার তরী’। কিন্তু অবস্থানগত কারণে এটি উদ্ধার ছিল সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু সেটাকে অন্যভাবে নেয় পশ্চিমা বিশ্ব। জাতিসংঘ অধিবেশনে মার্কিন প্রতিনিধি অভিযোগ করেন সোভিয়েতরা ইচ্ছাকৃতভাবে ‘সোনার তরী’ উত্তোলনে গাফিলতি করছে। সেই সাথে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রপাগান্ডা ছড়ানো হয়: জাহাজ উত্তোলনের কাজে দীর্ঘসূত্রতা, মাইন নিষ্ক্রিয়করণে অস্বচ্ছতা, বাংলাদেশকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে অপারগ সোভিয়েত ইউনিয়ন, উদ্ধার অভিযান ব্যর্থ ইত্যাদি শিরোনাম করে। কাজের মাধ্যমেই এর জবাব দেয় সোভিয়েত বাহিনী। পেশাদারিত্ব, কর্মকৌশল ও অপার সাহসের জোরে কর্ণফুলীর মোহনা পুরোপুরি জাহাজমুক্ত করে ১০ আগস্ট উঠে আসে সোনার তরী। এরফলে ৫৭৫ ফুট পর্যন্ত দৈর্ঘ্যরে যেকোনো জাহাজ তখন বন্দরে আসা-যাওয়া করতে সক্ষম হয়।

সোভিয়েত বাহিনীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধার ছিল, যুদ্ধজাহাজ ‘যশোর’। ভারতের বিমান আক্রমণে ডুবে গিয়েছিল যুদ্ধজাহাজ ‘যশোর’। পলিমাটি দিয়ে জাহাজটি সম্পূর্ণ ভর্তি হয়ে যাওয়ায় মাত্র ২৫০ টনের জাহাজটি উদ্ধার করতে ৫০টি দিন লেগে যায় উদ্ধারকারী দলের। পরবর্তীতে মেরামতের পর বিএনএস বিশখালী নামে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে এটি কমিশন করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর সজাগ দৃষ্টি চট্টগ্রামে

চট্টগ্রামে উদ্ধারকাজ চলমান থাকাকালে প্রতিনিয়তই তাঁর হালনাগাদ জেনে নিতেন বঙ্গবন্ধুÑকখনো সোভিয়েত রাষ্ট্রদূতকে ফোন করে, কখনো বা লোক মারফত। মে মাসের শুরুতে এডমিরাল জুয়েনকোকে ফোন করেন সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত বি এফ পোপভ। যত দ্রুত সম্ভব ঢাকায় আসতে বলেনÑবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং তাঁর রিপোর্ট শুনতে চান। জাতির পিতার ব্যক্তিগত কামরায় আরামকেদারায় বসে দীর্ঘক্ষণ ধরে বন্দরে উদ্ধার কাজের সমস্ত দিক বর্ণনা করেন এডমিরাল। বন্দরে কঠোর পরিশ্রম চলছে এবং বেশকিছু প্রাথমিক সাফল্যও অর্জিত হয়েছে শুনে সন্তুষ্ট হলেন তিনি। জুয়েনকোকে হাসিমুখে ধন্যবাদ জানালেন বঙ্গবন্ধু, একই সাথে পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে বললেন। ‘সাবাস নাবিকেরা! চমৎকার কাজ করেছেন। তবে প্রথম সাফল্যেই উদ্বেলিত হয়ে যাবেন না। বাকি সমস্ত ঘাট ও টার্মিনালও একই রকম কর্মস্পৃহা, মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে উদ্ধার করে চালু করে দিতে হবে। যাতে ছোট-বড় সব ধরনের নৌযান নিশ্চিন্তে বন্দরে মাল খালাস করতে পারে। বন্দর খুলতে হবে ‘‘তাড়াতাড়ি”’-এ কথা বলে তিনি হাসিমুখে এডমিরালকে জড়িয়ে ধরলেন। ‘তাড়াতাড়ি’ শব্দটি শুনে আশ্চর্য হলেন তাঁরা। স্মিত হাস্যে বঙ্গবন্ধু জবাব দিলেন: বন্দর দ্রুত, দ্রুত খুলতে হবে! এই বাংলা শব্দটি এডমিরাল জুয়েনকো মনে গেঁথে যায়। এক লেখায় তিনি জানান, শেখ মুজিবের উচ্চারিত ‘তাড়াতাড়ি’ শব্দটি বৈরী পরিস্থিতিতেও তাঁদের নিরন্তর পরিশ্রম করতে উৎসাহ জুগিয়েছে।

’৭২-এর শেষের দিকে আরও একবার রাশিয়ান দলনেতাকে বঙ্গভবনে ডেকে পাঠান বঙ্গবন্ধু, কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে সরাসরি দিকনির্দেশনা দেন।

মাইন অপসারণের পালা

পরিকল্পনা অনুযায়ী ২ মে থেকে ডুবন্ত জাহাজ তুলে আনার পাশাপাশি মাইন ধ্বংসের কাজ শুরু হয়। অনুসন্ধানী বহরে ছিল চারটি বি টি শ্রেণির নৌযান ও পাঁচটি ছোট বোট। বি টি নৌযানের ধারণক্ষমতা ৪৫০ মেট্রিক টন আর সর্বোচ্চ গতি ১০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত। প্রতিটিতে ১০০, ৪৫ ও ৩৭ মিলিমিটার কামান রয়েছে। মাইন বিধ্বংসী বোমা আছে বিশটি করে। প্রধান অস্ত্র হিসেবে আছে ট্রেলার। ট্রেলার হলো লম্বা একটি লোহার রড, যার আগায় সংকেতদানকারী যন্ত্র রয়েছে।

১৯৭২ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে সোভিয়েত নাবিকেরা চট্টগ্রাম বন্দরে চলাচলের চ্যানেল সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার করে ফেলতে সক্ষম হয়। বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্যানুযায়ী বন্দরের প্রবেশপথে কমপক্ষে ৮০টি মাইন বসনো ছিল। মাইন সার্চিংয়ের শেষে বোঝা যায়, এসব মাইন সোভিয়েত সরকারই বিক্রি করেছিল চীনের কাছে। গণচীন আবার উপহারস্বরূপ এগুলো প্রদান করেছিল পাকিস্তান নৌবাহিনীকে। ফলে এক অর্থে নিজেদের মাইনই নিষ্ক্রিয় করছিল সোভিয়েত নৌসেনারা। যদিও তখনো অনেক নিমজ্জিত নৌযান ও মাইন ছিল, কিন্তু বন্দরটি ১০ জুলাই জাহাজ চলাচলের পুরোপুরি উপযোগী হয়ে ওঠে। জাতিসংঘ ও পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা যেখানে অনুমান করেছিলেন যে, বন্দর ব্যবহারোপযোগী হয়ে উঠতে দু-তিন বছর সময় লাগবে, সেখানে সোভিয়েত নৌবাহিনীর কর্মতৎপরতার ফলে মাত্র তিন মাসেই বন্দর বিপদমুক্ত হয়। এমনকি এ সময় বন্দর দুটির সক্ষমতা যুদ্ধপূর্ব পাকিস্তান আমলের ধারণক্ষমতার চেয়েও বেড়ে গিয়েছিল। পরিসংখ্যান বলছে, আগের বছরের জুনের চেয়ে ১৯৭২ সালের জুনে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন পণ্য বেশি হ্যান্ডলিং হয়েছিল।

অবশেষে বিদায়

নেভিগেশনাল চ্যানেলে ডুবে থাকা সকল জাহাজ উদ্ধার ও মাইন পরিষ্কার করার পর মূল সোভিয়েত নৌবহরের বেশকিছু জাহাজ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। বাকি জাহাজগুলো তাদের কাজ অব্যাহত রাখে। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর সম্পূর্ণরূপে মাইনমুক্ত হয় এবং আরও কিছু নিমজ্জিত নৌযান উদ্ধার হয়। এই সময়ই সোভিয়েত নৌবহরকে বাংলাদেশ থেকে পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১৯৭৩ সালের ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং চুক্তি অনুযায়ী সোভিয়েত নৌবহর ১৯৭৪ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করে আরও কিছু নৌযান উদ্ধার ও বন্দরের পুনর্নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণ করতে সম্মত হয়। ১৯৭৪ সালের মার্চের প্রথমদিকে অবশিষ্ট দুটি সোভিয়েত জাহাজ বন্দর ত্যাগ করে এবং এর মধ্য দিয়ে নির্ধারিত সময়ের তিন মাস আগেই বাংলাদেশে সোভিয়েত নৌবহরের উপস্থিতির সমাপ্তি ঘটে। ১৯৭৪ সালের ১২ জুন সোভিয়েত নৌবহরটির অবশিষ্ট কর্মীদের অধিকাংশ সোভিয়েত জাহাজ ‘এমভি খাবারভস্কে’ চড়ে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে ভøাদিভস্টকের উদ্দেশ্য যাত্রা করে। ২৪ জুন বাকিরাও বাংলাদেশ ত্যাগ করে।

প্রায় দুই বছরব্যাপী এই অভিযানে সোভিয়েত নৌবহর চট্টগ্রাম বন্দরের আশপাশে থেকে মোট এক লাখ ডেডওয়েট টনের ২৬টি নিমজ্জিত জাহাজ উদ্ধার করে এবং সেগুলোকে বাংলাদেশের উপকূলের বিভিন্ন শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে পৌঁছে দেয়। এই জাহাজগুলোর মধ্যে ১৫ হাজার টন ওজনবিশিষ্ট ফ্রেইটার থেকে শুরু করে ছোট ছোট কোস্টাল ও ইনল্যান্ড ভেসেল, বালুবাহী নৌযান, মাছ ধরা জাহাজÑসব ধরনের জলযানই ছিল। এর পাশাপাশি তারা সমুদ্রবক্ষ থেকে যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ ১ হাজার ৯০০ টন ধাতব বর্জ্য ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নিমজ্জিত সম্পদ উদ্ধার করে। চট্টগ্রাম বন্দরের ১ হাজার ২ বর্গমাইল অঞ্চল তারা সম্পূর্ণরূপে মাইনমুক্ত করে।

১৯৭৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে মাইন নিষ্ক্রিয়করণের সময় নিহত নাবিক ইউরি রেডকিনের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন
রাশিয়ান ও বাংলাদেশি কর্মকর্তারা

যাওয়ার সময় সোভিয়েত নৌবহর বাংলাদেশকে তিনটি উদ্ধারকারী নৌযান উপহার দেয় এবং দেশ ত্যাগের আগে তাঁদের ডুবুরি সরঞ্জাম ও অন্যান্য ইকুইপমেন্ট বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে প্রদান করে। দুই বছরে তাঁরা ৪৪ জন বাংলাদেশি ডুবুরিকে প্রশিক্ষণ প্রদান করে। এই ডুবুরিরা ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রশিক্ষিত ডুবুরি দল। আশ্চর্যের ব্যাপার, সোভিয়েত ইউনিয়ন এই সবকিছুই করেছিল বিনা মূল্যে, যা সদ্যস্বাধীন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

লেখা আছে অশ্রুজলে

একেবারে নিষ্কণ্টক ছিল না দুই বছরব্যাপী এ উদ্ধার অভিযান। চট্টগ্রাম বন্দরকে সচল করতে গিয়ে একজন সোভিয়েত নাবিক প্রাণ হারিয়েছিল। ইউরি ভিক্তরোভিচ রেডকিন নামক মাত্র ২২ বছরের সেই টগবগে তরুণ নাবিক ১৯৭৩ সালের ১৩ জুলাই কর্ণফুলী নদী আর বঙ্গোপসাগরের মিলনস্থলে ডুবে থাকা জাহাজের গায়ে আংটা বাঁধার সময় প্রবল বিপরীত স্রোতের তোড়ে প্রাণ হারান। তার নামানুসারে সে স্থানের নাম রাখা হয়েছে রেডকিন পয়েন্ট। চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় অবস্থিত বাংলাদেশ নেভাল একাডেমি প্রাঙ্গণে তাকে সমাহিত করা হয়। প্রতি বছর ১৮ ডিসেম্বর রেডকিনের জন্মদিনে চট্টগ্রামে অবস্থিত রুশ কনস্যুলেট জেনারেল, বাংলাদেশ নেভাল একাডেমি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা রেডকিনের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

উদ্ধার অভিযান সম্পন্ন করে ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ভ¬াদিভস্তকের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া রাশিয়ান নৌবাহিনীর জাহাজ এমএস খাবারোভস্ককে বিদায় জানাচ্ছে বাংলাদেশিরা

ইতিহাসের দায়মোচন

সোভিয়েত নাবিকদের বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর অসম সাফল্যের স্মারক হিসেবে সোভিয়েত সরকার তাঁদের অনেককে বিভিন্ন পদক ও সম্মাননা প্রদান করে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁদেরকে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক সম্মাননা প্রদান করা হয়নি। অবশেষে দীর্ঘ ৪০ বছর পর ২০১৩ সালের মার্চে ইতিহাসের দায়মোচন করে বাংলাদেশ। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারোপযোগী করে তোলার সঙ্গে জড়িত কয়েকজন সোভিয়েত নাবিককে আনুষ্ঠানিক সম্মাননা প্রদান করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। ২০১৩ সালে আগত রাশিয়ান অতিথিদের নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন সেকেন্ড র‌্যাংক ভিক্টর কোঝুরিন। ১৯৭২ সালের স্পেশাল এক্সপেডিশন-১২ ইঞ্জিনিয়ার সার্ভিসের একজন সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় কর্মরত ছিলেন তিনি। দলে ছিলেন ব্লাদিমির কারামাইশেভ। সে সময় চট্টগ্রামে সোভিয়েত কমান্ডারের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন তিনি। ছিলেন শিপ রেইজিং পার্টির ডেপুটি কমান্ডার নিকোলাই কলোসভ। ইলেকট্রো মেকানিক কমব্যাট ইউনিট-৫ ফ্লোটিং ক্রেন ‘চার্নোমোরেটস ১৩’-এর কমান্ডার আলেকজান্ডার চুকানিনও আসেন তাঁর ৪০ বছরের পুরনো কর্মস্থলে। অভিযানের প্রধান প্রকৌশলী ব্লাদিমির মোলচানোভ ইতিমধ্যেই পরলোকগমণ করায় তাঁর হয়ে সম্মাননা গ্রহণ করতে আসেন স্ত্রী আনা মোলচানোভা।

উপসংহার

বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, সামরিক অভ্যুত্থানের পর বেশ কয়েক বছরের জন্য পথ হারায় বাংলাদেশ। অদক্ষ কূটনীতির কারণে শক্তিশালী বেশ কয়েকটি দেশের সাহচর্যও হারিয়ে যায়। অথচ চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর চ্যানেলকে মাইন ও ডুবে থাকা জাহাজ মুক্ত করার পেছনে সেকালের পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নকে সম্পৃক্ত করার জন্য প্রায় একক ভূমিকা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ধ্বংসপ্রাপ্ত, নন-অপারেশনাল দুই সমুদ্রবন্দরকে বিপদমুক্ত করে উন্নয়নের পথে নিয়ে আসেন তিনি। সেই পথ ধরে চট্টগ্রাম বন্দর আজ বিশ^খ্যাত লয়েডস লিস্টে ৫৮তম স্থানে, অভিজাত তিন মিলিয়ন টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলার পোর্ট ক্লাবের সদস্য হিসেবে বিশ^দরবারে মর্যাদার আসনে আসীন। এ সাফল্যের পেছনে সে সময়ের ত্বরিত সিদ্ধান্ত এবং সঠিক বাস্তবায়নের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক প্রজ্ঞার এক অনন্য নিদর্শন হয়ে থাকবে চট্টগ্রাম বন্দরের সেই সময়কার উদ্ধার অভিযান।

ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট

ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বৈশ্বিক প্রথা। এটা ছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বলতে গেলে অপূর্ণ। শুধু অবস্থানগত সুবিধার কারণে কোনো কোনো বন্দর হয়ে উঠেছে ‘ট্রান্সশিপমেন্ট হাব’। ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে অর্থনীতিতে শক্তি জোগাচ্ছে এসব বন্দর। বন্দর হয়ে উঠেছে এসব দেশের অর্থনীতির প্রাণবায়ু।

চট্টগ্রাম বন্দরও ১৯০৫-১৯১১ সাল নাগাদ পূর্ববাংলা ও আসাম অঞ্চলের প্রধান সমুদ্রবন্দর হয়ে ওঠে। ১৯২৮ সালে এসে ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম ব্যস্ত বন্দরের তকমা পেয়ে যায় এটি। ’৪৭-এর আগ পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্যে অবিভক্ত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যে সমৃদ্ধি, তা এই চট্টগ্রাম বন্দরের কল্যাণেই সূচিত হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আসামের চা শিল্প পুরোপুরি এ বন্দরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কিন্তু ভারত ভাগের পর ট্যারিফ ও ডিউটি জটিলতার কারণে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ট্রানজিট স্তিমিত হয়ে আসে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর বন্দরটি দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার ট্রানজিট পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর প্রায় চার দশকের অপেক্ষা। দীর্ঘ আলোচনার পর ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারতের পণ্য পরিবহনের জন্য আবার উন্মুক্ত করা হয় এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন বন্দরটি। ট্রানজিটের পাশাপাশি মিলছে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের পরিচিতিও।

ট্রান্সশিপমেন্ট কী

সাধারণত কোনো কার্গো বা কনটেইনার চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছানোর আগে যখন এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজে তোলা হয়, তখন সেটাকে ট্রান্সশিপমেন্ট বলা হয়। ট্রান্সশিপমেন্টের এ পণ্য পোর্ট পারফরম্যান্সে দুবার যুক্ত হয়। কারণ একবার সেগুলো নামানো হয় এবং আরেকবার উঠানো হয়।

ট্রান্সশিপমেন্টের ভালো একটি উদাহরণ হলো ডারবান থেকে ম্যানিলায় পণ্য পরিবহন। কারণ এ দুই বন্দরের মধ্যে সরাসরি কোনো সংযোগ নেই। তাই ম্যানিলা অভিমুখী কনটেইনার প্রথমে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে একটি জাহাজে করে সিঙ্গাপুরে আনা হয়। সেখান থেকে তা আরেকটি জাহাজে উঠিয়ে ম্যানিলায় পোঁছে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর হচ্ছে ট্রান্সশিপমেন্ট হাব। অর্থাৎ কনটেইনার বা কার্গোর উৎস ও গন্তব্যের মধ্য সংযোগ স্থাপনকারী বন্দর।

মোটা দাগে তিনটি কারণে ট্রান্সশিপমেন্ট হয়ে থাকে। প্রথমত, আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকের মধ্যে জল, স্থল ও আকাশপথে সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ না থাকলে অথবা এ পথে সরাসরি পণ্য পরিবহন খুব বেশি ব্যয়বহুল হলে। দ্বিতীয়ত, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা এড়াতেও অনেক সময় ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন করে থাকে অনেকে। তৃতীয়ত, কাক্সিক্ষত বন্দর বড় জাহাজ ভেড়ার উপযোগী না হলে অন্য বন্দরে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে বড় জাহাজ ভিড়তে না পারার কারণে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি পণ্যের অধিকাংশই সিঙ্গাপুর, কলম্বো পোর্ট কেলাংয়ে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে পরিবহন করা হয়।

ট্রানজিটের সাথে তফাত

ট্রানজিট মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে-অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক। আমদানি পণ্যের চালান কাস্টমস বিভাগের নিয়ন্ত্রণে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবহনই মূলত অভ্যন্তরীণ ট্রানজিট। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন এগ্রিমেন্টের আর্টিকেল ৯-এ অভ্যন্তরীণ ট্রানজিট সুবিধা প্রদানকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ব্যবস্থায় একটি কাস্টমস স্টেশনে আমদানীকৃত পণ্য কাস্টমস নিয়ন্ত্রণে ওই দেশের অভ্যন্তরীণ অন্য কাস্টমস অফিসে নিয়ে যাওয়া যায় এবং সেখানে কাস্টমস আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করানো হয়।

বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই রেল ও নদীপথে অভ্যন্তরীণ ট্রানজিট ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এ ব্যবস্থার ফলে কাস্টম হাউসের মাধ্যমে আমদানীকৃত পণ্য রেলপথে ঢাকাস্থ কাস্টম হাউস, আইসিডি কমলাপুরে পাঠানো হয়। এরপর সেখানে কাস্টমস আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে ওই পণ্য খালাস দেয়া হয়। একইভাবে আংটিহারা বন্দরের মাধ্যমে আমদানি পণ্যের চালান নদীপথে দেশের অন্যান্য কাস্টমস বন্দরে পরিবহন করার পর তা ওইসব কাস্টমস বন্দরের মাধ্যমে খালাস দেয়া হয়।

এবার আসা যাক আন্তর্জাতিক ট্রানজিট বিষয়ে। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য সহজ করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে এটি। জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ ১৯৯৪-এর আর্টিকেল ৫ এবং বার্সেলোনা কনভেনশনের আওতায় কোনো সদস্য দেশ তার ভূখ- ব্যবহার করে অন্য কোনো দেশ তৃতীয় আরেকটি দেশে পণ্য পরিবহন করতে চাইলে ট্রানজিটের শর্ত আরোপ করতে পারে। ডব্লিউটিওর ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন এগ্রিমেন্টের আর্টিকেল ১১-তে আন্তর্জাতিক ট্রানজিটের স্বাধীনতার কথা বলা আছে।

১৯৭৩ সালে স্বাক্ষরিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় নেপালি পণ্য বাংলাদেশের ভূখ- ব্যবহারের ক্ষেত্রে ট্রানজিট সুবিধা ভোগ করছে। চুক্তিটির আওতায় প্রটোকলের মাধ্যমে এ জাতীয় ট্রানজিটের কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এছাড়া ‘প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেড’-এর আওতায় ভারতীয় পণ্য ও অভ্যন্তরীণ নৌপথে ট্রানজিট সুবিধা পাচ্ছে।

সহজ ভাষায় বললে, ট্রানজিট হচ্ছে কোনো পণ্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় উপ-আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে আলোচনা করলে ট্রানজিটের সংজ্ঞা দাঁড়ায় এ রকম-বাংলাদেশের ভূখ- ব্যবহার করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে ভারতের পণ্য পরিবহনের সুযোগ। ভারতের নিজস্ব যানবাহনেই এসকল পণ্য পরিবহন হবে। আর ট্রান্সশিপমেন্ট হচ্ছে কার্গো বা কনটেইনার এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজে স্থানান্তরের পর গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া।

অন্য দেশ হয়ে বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট

আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হিসেবে সিঙ্গাপুর, কলম্বো, পোর্ট কেলাং ও তানজং পেলেপাসকে ব্যবহার করে আসছে। আমদানির ক্ষেত্রে পণ্যবাহী জাহাজ প্রথমে এসব বন্দরে পৌঁছায়। এরপর সেখান থেকে ফিডার ভেসেলে করে চট্টগ্রাম বন্দরে আনা হয়। দেশের বন্দরগুলোয় বড় জাহাজ ভেড়ার উপযোগী গভীরতা না থাকায় একইভাবে ট্রান্সশিপমেন্টের প্রয়োজন পড়ে রপ্তানির ক্ষেত্রেও।

বাংলাদেশের বেশির ভাগ পণ্যই আমদানি হয় চীন থেকে। জাহাজীকরণের পর মাদার ভেসেলে (বড় জাহাজ) করে প্রথমে সিঙ্গাপুর বন্দরে পৌঁছে এসব পণ্য। সেখান থেকে ফিডার ভেসেলে করে তা চট্টগ্রাম বন্দরে আনা হয়। বাংলাদেশে আমদানি কনটেইনারের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই আসে সিঙ্গাপুর বন্দর হয়ে।

রপ্তানির ক্ষেত্রেও প্রথমে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে যাওয়া হয় সিঙ্গাপুর বন্দরে। সেখান থেকে মাদার ভেসেলে তা ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমা দেশের সাথে সরাসরি রুট না থাকায় সিঙ্গাপুর থেকে গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় বেশি লাগে। এ কারণে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হিসেবে কলম্বোকেও গুরুত্ব দেওয়া হয় অনেক সময়। সরাসরি রুট থাকায় এখান থেকে পশ্চিমা গন্তব্যে পণ্য পৌঁছাতে তুলনামূলক কম সময় লাগে।

আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হিসেবে সিঙ্গাপুর, কলম্বো, পোর্ট কেলাং ও তানজং পেলেপাসকে ব্যবহার করে আসছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের আমদানি পণ্যের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই আসে সিঙ্গাপুর বন্দর হয়ে

কয়েকটি শিপিং অপারেটর চট্টগ্রাম থেকে কলম্বো বন্দরে ফিডার ভেসেল পরিচালনা করছে। চট্টগ্রাম থেকে কলম্বো বন্দরে প্রতি সপ্তাহে গড় ৮ থেকে ১০টি ভয়েজ হয়ে থাকে। তবে চট্টগ্রাম থেকে সিঙ্গাপুরে ফিডার ভেসেল চলাচল করে এর চেয়ে অনেক বেশি। রুটটিতে ৬০ থেকে ৭০টি ফিডার ভেসেল চলাচল করে।

মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে কলম্বো ও সিঙ্গাপুর বন্দরের বিকল্প হিসেবে কাজ করবে এটি। তখন আর আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর বা কলম্বো বন্দরের ট্রান্সশিপমেন্টের প্রয়োজন পড়বে না। মাদার ভেসেল সরাসরি মাতারবাড়ী বন্দরে ভিড়তে পারবে এবং সেখান থেকে রপ্তানি পণ্য বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। একইভাবে আমদানি পণ্যবাহী মাদার ভেসেলও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরে ভিড়তে পারবে। এরপর সেখান থেকে লাইটার জাহাজে করে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা বন্দর এবং ভবিষ্যতের বে টার্মিনালসহ অন্যান্য স্থানে পণ্য নিয়ে যাওয়া যাবে। এতে সময় যেমন কমবে, ব্যয়ও সাশ্রয় হবে।

চট্টগ্রাম বন্দরে ট্র্রান্সশিপমেন্ট

পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য বাংলাদেশ কাস্টমসের আইনগত বিধান রয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এক কাস্টমস বন্দর বা স্টেশন থেকে অন্য কাস্টমস স্টেশনে অথবা বাংলাদেশ থেকে বিদেশের কোনো গন্তব্যে আমদানি পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট কীভাবে সম্পন্ন হবে কাস্টমস আইন, ১৯৬৯ এর ১২০-১২৫ ধারায় সে সম্পর্কে প্রয়োজনীয় বিধান সন্নিবেশিত করা রয়েছে।

ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্য পরিবহনের কথা বলা হয়েছে বন্দরের রেগুলেশনেও। এজন্য আলাদা কোনো চুক্তির প্রয়োজন নেই। ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হিসেবে চট্টগ্রামকে ব্যবহার করে কলকাতায় পণ্য পরিবহনও এরই মধ্যে করা হয়েছে। ২০২০ সালের ২৫ জুলাই ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্যের একটি চালান চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। মোট ৪৫ কনটেইনারের ভারতীয় পণ্যের চালানটি চীনের নিংবো, ভিয়েতনামের হো চি মিন, থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ও মালয়েশিয়ায় কেলাং বন্দর হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। বন্দরে এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজে স্থানান্তর করে তা কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়।

চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ভারতের ট্রানজিট

ব্রিটিশ আমলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে বাকি অংশের ব্যবসা-বাণিজ্য তথা পণ্য পরিবহন হতো বাংলাদেশের ওপর দিয়ে। ১৯৬৫ সাল পর্যন্তও বাংলাদেশের রেল ও নৌপথ ব্যবহারের সুযোগ ছিল দেশটির। সে বছর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশের ভূখ- ব্যবহার করে ভারতের মূল অংশের সাথে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর পণ্য বাণিজ্যে ছেদ পড়ে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে নৌপথে পণ্য পরিবহন চালু করা হলেও রেল ও সড়কপথে ট্রানজিট অধরাই থেকে যায়। যদিও এর ফলে উভয় দেশের আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সকল সুযোগই রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের রয়েছে দুটি সমুদ্রবন্দর। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ভারতের পরীক্ষামূলক ট্রানজিট সম্পন্নও হয়েছে।

যে চুক্তির আওতায় ট্রানজিট

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২০১৮ সালের অক্টোবরে ‘এগ্রিমেন্ট অন দ্য ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মোংলা পোর্ট ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু অ্যান্ড ফ্রম ইন্ডিয়া’ শীর্ষক একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তিতেই বাংলাদেশের মোংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ভারতকে তার পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় পণ্য পরিবহনের সুযোগ দেওয়ার কথা বলা আছে। তবে এজন্য বন্দর ও পরিবহন ব্যবহার-সংক্রান্ত সকল ধরনের খরচ ভারতই বহন করবে। চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সাত ধরনের মাশুল ধার্য্য করেছে। ট্রানজিট পণ্যবাহী জাহাজ বার্থিংয়ের ক্ষেত্রে বাড়তি কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বার্থিংয়ের যে নিয়ম আছে, এসব জাহাজের বার্থিংও সে অনুযায়ীই। অর্থাৎ যে জাহাজটি আগে আসবে সেটিই আগে জেটিতে ভিড়বে। তাই বলে একে কম গুরুত্ব দেওয়ারও সুযোগ নেই। চুক্তির আর্টিকেল ফাইভের পোর্ট অ্যান্ড আদার ফ্যাসিটিলিজ অংশে বিষয়টি খোলাসা করে বলা হয়েছে, আমদানি-রপ্তানি পণ্য যে ধরনের সুবিধা পায় এসব পণ্যের ক্ষেত্রেও একই সুবিধা প্রযোজ্য হবে।

চুক্তির পথক্রম

ট্রানজিটের বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময়। সফর উপলক্ষে ওই বছরের ১২ জানুয়ারি যে যৌথ ঘোষণাপত্র দেওয়া হয়, সেখানে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। এরপর সরকারি পর্যায়ে একাধিক বৈঠক শেষে পণ্য পরিবহনে ভারতকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে একমত হয় উভয় দেশ। ২০১৫ সালের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে ‘এগ্রিমেন্ট অন দ্য ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মোংলা পোর্টস ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু অ্যান্ড ফ্রম ইন্ডিয়া’ শীর্ষক একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। সমঝোতা স্মারকটি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় চুক্তি ও প্রটোকল পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করতে সম্মত হয় ঢাকা ও দিল্লি। জল, স্থল, রেল বা মাল্টিমোডাল পরিবহন ব্যবস্থা ব্যবহার করে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে ভারতীয় পণ্য আনা বা সেখান থেকে পাঠানোর বিষয়টিও উল্লেখ করা হয় সমঝোতা স্মারকে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পণ্য পরিবহন হবে এখানকার আইন ও নীতিমালার আওতায়। এজন্য পরিবহন ও অন্যান্য সেবামাশুল এবং প্রযোজ্য শুল্ক-কর ভারতকে পরিশোধ করতে হবে বলেও জানানো হয় সমঝোতা স্মারকে। সবশেষে কীভাবে এটি আরো বেশি লাভজনক, কার্যকর ও নির্ভরযোগ্য করা যায় সে উপায় খুঁজে দেখার প্রতিশ্রুতি দেয় ঢাকা ও দিল্লি।

চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় যাতে পণ্য পরিবহন করতে পারে, সে-সংক্রান্ত চুক্তির খসড়াটি ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে তোলা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভা তাতে অনুমোদন দেয়। সে সময় বলা হয়, ভারতের সাথে সম্পাদনের জন্যই চুক্তির খসড়াটি প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে চাইলে নেপাল ও ভুটানও এর সাথে যুক্ত হতে পারবে। পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশকে জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্রেড (গ্যাট) এবং বাংলাদেশি বিধি-বিধান অবশ্যই পরিপালন করতে হবে।

মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ‘এগ্রিমেন্ট অন দ্য ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মোংলা পোর্টস ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু অ্যান্ড ফ্রম ইন্ডিয়া’ শীর্ষক চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। এ-সংক্রান্ত স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) স্বাক্ষরিত হয় পরের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এই এসওপি পরস্পরের মধ্যে হস্তান্তরিত হয়।

যা আছে চুক্তিতে

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষরিত ‘ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট অন কো-অপারেশন ফর ডেভেলপমেন্ট’-এ যেসব উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে, চুক্তিটি তা বাস্তবায়নেরই অংশ। চুক্তিতে মোট ১৪টি আর্টিকেল রাখা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি আর্টিকেল হলো:

আর্টিকেল ৩: বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পরিবহনের সময় অবশ্যই জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্রেড (গ্যাট) এবং এখানকার জাতীয় আইন ও বিধি-বিধান মেনে চলার কথা বলা হয়েছে এই আর্টিকেলে।

আর্টিকেল ৫: বন্দরে ভারতীয় পণ্য কী ধরনের সুবিধা পাবে, সেটি খোলাসা করা হয়েছে আর্টিকেলটিতে। এই আর্টিকেলের পোর্ট অ্যান্ড আদার ফ্যাসিটিজ অংশে বলা হয়েছে, চুক্তির অধীন পরিবহন করা পণ্যকে বাংলাদেশ থেকে আমদানি-রপ্তানি পণ্যের তুলনায় কম সুযোগ-সুবিধা দেয়া যাবে না এবং বন্দরে জায়গা থাকাসাপেক্ষে ওই পণ্য রাখার জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিতে সুযোগ দিতে হবে।

চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ভারতীয় পণ্যের প্রথম ট্রানজিট হয় গত জুলাইয়ে। পরীক্ষামূলক এই ট্রানজিটে পণ্যবাহী কনটেইনার নিয়ে এমভি সেঁজুতি নামে একটি জাহাজ ২০২০ সালের ২১ জুলাই ভোরে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছায়

বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত মাশুল চুক্তির অধীনে পরিবহন করা পণ্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। সময় সময় বন্দর কর্তৃপক্ষ যদি মাশুলের হার পরিবর্তন করে এক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হবে।

আর্টিকেল ৬: সমঝোতা স্মারকে উল্লেখিত রুটগুলোকে ট্রানজিটের পণ্য পরিবহনের রুট হিসেবে ব্যবহার করা হবে। সমঝোতা স্মারকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর হয়ে যেসব রুটে পণ্য পরিবহনের কথা বলা হয়েছে; তা হলো:

১.         চট্টগ্রাম/মোংলা বন্দর থেকে আখাউড়া হয়ে ত্রিপুরার আগরতলা

২.        চট্টগ্রাম/মোংলা বন্দর থেকে সিলেটের তামাবিল হয়ে মেঘালয়ের ডাউকি

৩.        চট্টগ্রাম/মোংলা বন্দর থেকে শেওলা হয়ে আসামের সুতারকান্দি

৪.         চট্টগ্রাম/মোংলা বন্দর থেকে বিবিরবাজার হয়ে ত্রিপুরার শ্রীমন্তপুর

৫.        ত্রিপুরার আগরতলা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া হয়ে চট্টগ্রাম/মোংলা বন্দর

৬.        ডাউকি থেকে তামাবিল হয়ে চট্টগ্রাম/মোংলা বন্দর

৭.         সুতারকান্দি থেকে শেওলা হয়ে চট্টগ্রাম/মোংলা বন্দর

৮.        শ্রীমন্তপুর থেকে বিবিরবাজার হয়ে চট্টগ্রাম/মোংলা বন্দর

তবে ট্রানজিটের জন্য গঠিত আন্তঃসরকার কমিটির অনুমোদনসাপেক্ষে অন্য যেকোনো রুটও এর সাথে যুক্ত করার সুযোগ রাখা হয়েছে চুক্তিতে।

এছাড়া বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যকার মোটরযান চলাচল চুক্তি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতীয় পণ্য পরিবহন করতে হবে কেবল এখানকার যানবাহন বা জাহাজের মাধ্যমে।

আর্টিকেল ৭: পণ্যের মালিককে সকল ধরনের মাশুল ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে জরিমানা পরিশোধে বাধ্য থাকবে মর্মে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে একটি বন্ড সই করতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম না করলে জরিমানা আদায় করা হবে।

আর্টিকেল ৯: উভয় দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে কাস্টমস অ্যান্ড পোর্ট সাব গ্রুপ নামে একটি কমিটি গঠন করার কথা বলা হয়েছে এই আর্টিকেলে। সাব গ্রুপের কাজ হবে ছয় মাসে অন্তত একটি বৈঠক করা এবং এসওপি বাস্তবায়নের পথে কোনো ইস্যুর অবতারণা হলে সেটি নিয়ে আলোচনা ও মীমাংসা করা। তবে এমন কোনো ইস্যু যদি থাকে, যা কাস্টমস অ্যান্ড পোর্ট সাব গ্রুপের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়, তাহলে সেটি আন্তঃসরকার কমিটিতে চলে যাবে।

আর্টিকেল ১০: আন্তঃসরকার কমিটি গঠিত হবে উভয় দেশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব বা সমপর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা কমিটির প্রধান হবেন এবং বছরে অন্তত একবার বৈঠকে বসবে এ কমিটি। একটি বৈঠক বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হলে পরেরটি হবে ভারতে।

আর্টিকেল ১১: এই আর্টিকেলের অধীনে যেকোনো পক্ষ চুক্তিতে সংশোধনী আনার প্রস্তাব করতে পারবে। এমন প্রস্তাব এলে সেটি নিয়ে আন্তঃসরকার কমিটিতে আলোচনা হবে। আলোচনার ভিত্তিতে আন্তঃসরকার কমিটি কোনো প্রস্তাব করলে অনুমোদনের জন্য সেটি সংশ্লিষ্ট সরকারের কাছে পাঠানো হবে।

আর্টিকেল ১৩: জাতীয় নিরাপত্তার জন্য জরুরি অবস্থার মতো কোনো পরিস্থিতি তৈরি হলে উভয় পক্ষই চুক্তি বাস্তবায়ন আংশিক বা পুরোপুরি রোহিত করতে পারবে। কোনো পক্ষ চুক্তি বাস্তবায়ন রোহিত করতে চাইলে যত দ্রুত সম্ভব অন্য পক্ষকে তা অবহিত করতে হবে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়ন আবার শুরু করবে উভয়পক্ষ।

আর্টিকেল ১৪: চুক্তির মেয়াদ হবে পাঁচ বছর এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা নবায়নের কথা বলা হয়েছে এই আর্টিকেলে। তবে তার আগেই কোনো পক্ষ যদি চুক্তিটি বাতিল করতে চায়, সেক্ষেত্রে ছয় মাস আগে অন্য পক্ষকে লিখিতভাবে তা জানাতে হবে।

সফল পরীক্ষা

নৌ-প্রটোকলের আওতায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ট্রানজিট আগেই শুরু হয়েছে। ২০১১ সালে এর আওতায় কলকাতা থেকে আগরতলায় পরীক্ষামূলক তিনটি চালান নেওয়া হয়। এর পাঁচ বছর পর ২০১৬ সালে মাশুল আরোপ করে এ ট্রানজিট শুরু হয়। নৌ-প্রটোকলের আওতায় এ ট্রানজিট হলেও পণ্য পরিবহন করা হয় মাল্টিমোডাল পদ্ধতিতে। প্রথমে কলকাতা থেকে আশুগঞ্জ পর্যন্ত নৌপথে, এরপর আশুগঞ্জ থেকে সড়কপথে আখাউড়া হয়ে আগরতলায় ট্রানজিট পণ্য নেওয়া হয়। নৌ-প্রটোকলের আওতায় নিয়মিত এ ট্রানজিটের বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বে আছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।

চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ভারতীয় পণ্যের প্রথম ট্রানজিট হয় গত জুলাইয়ে। পরীক্ষামূলক এই ট্রানজিটে পণ্যভর্তি চারটি কনটেইনার নিয়ে এমভি সেঁজুতি নামে একটি জাহাজ ২০২০ সালের ২১ জুলাই ভোরে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছায়। এর আগে ১৯ জুলাই ভারতের শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বন্দর (সাবেক কলকাতা বন্দর) থেকে পণ্য নিয়ে জাহাজটি চট্টগ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করে। কনটেইনারগুলোতে টিএমটিবার ও ডালজাতীয় পণ্য ছিল।

জেটিতে ভেড়ার পর কনটেইনারগুলো খালাস করা হয়। এরপর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে চারটি ট্রেইলারে করে ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে কনটেইনারগুলো ২৩ জুলাই বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্তের বাংলাদেশ অংশে পৌঁছায়। স্থলবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে পরদিন সকালে সীমান্ত পার হয়ে ট্রেইলারগুলো পৌঁছায় ত্রিপুরার আগরতলা স্থলবন্দরে। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে কনটেইনারগুলো বুঝে নেন। এর মধ্যে ডালভর্তি দুটি কনটেইনার যায় আসামের গুয়াহাটির ইটিসি এগ্রো প্রসেসিং ইন্ডিয়া লিমিটেড নামের একটি কোম্পানিতে। আর টিএমটি বারভর্তি কনটেইনার দুটি যায় আগরতলা শহরের এমএস কর্পোরেশন লিমিটেডে।

পরীক্ষামূলক ট্রানজিট থেকে প্রসেসিং মাশুল, নিরাপত্তা মাশুল, প্রশাসনিক মাশুল, এসকর্ট মাশুল, কনটেইনার স্ক্যানিং মাশুল ও ইলেকট্রিক সিলের মাশুল বাবদ অর্থ পেয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এছাড়া শুল্কায়ন বাবদ অর্থ পেয়েছে শুল্ক বিভাগও। সরকারি এ আয়ের বাইরে বাংলাদেশি জাহাজে পণ্য আনা এবং স্থলপথে তা পরিবহন বাবদ ভাড়াও বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান পেয়েছে।

নিয়মিত করার প্রস্তুতি

চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ভারতীয় পণ্যের পরীক্ষামূলক ট্রানজিটের পর এটি নিয়মিত করার প্রস্তুতি চলছে। এর অংশ হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) একটি অভিন্ন কার্যপ্রণালি প্রণয়নে কাজ করছে। শিপার্স ও কাস্টমস কর্মকর্তা-উভয়কেই এ কার্যপ্রণালি মেনে চলতে হবে। আন্ডারটেকিং, ট্রানজিটের সময় পণ্যের এস্কর্টিং, ই-সিল, কাস্টমস ডিক্লারেশন ও কাস্টমস-সংক্রান্ত অন্যান্য খুঁটিনাটি এবং প্রশাসনিক বিষয়াদির সবিস্তার উল্লেখ থাকবে এতে। তবে মাশুলের বিষয়টি এতে উল্লেখ না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। এটি নির্ধারিত হবে দেশগুলোর মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে।

চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে পরীক্ষামূলক ট্রানজিটের মাশুল আদায়ের ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) অনুসরণ করেছে এনবিআর। সংস্থাটির কাস্টমস শাখা থেকে জারি করা এক অফিস আদেশের মাধ্যমে পরীক্ষামূলক চালানটি ত্রিপুরায় পৌঁছায়।

তবে প্রতিবার চালান আসার আগে এ-সংক্রান্ত প্রক্রিয়াগুলো চূড়ান্ত করা সহজসাধ্য নয়। তাই এ-সংক্রান্ত একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন করছে এনবিআর। এসব প্রক্রিয়া শেষ করে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে নিয়মিত ট্রানজিট শুরু হবে। এজন্য ২০২১ সাল লেগে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

লাভ সকল পক্ষেরই

ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের আওতায় পণ্য পরিবহনের সুফল সকল পক্ষই পাবে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতের পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে দূরত্ব, সময় ও খরচ-সবই কমে আসবে। কারণ স্থলপথে কলকাতা থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কম-বেশি সব রাজ্যের দূরত্বই গড়ে দেড় হাজার কিলোমিটার। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে দূরত্ব যেখানে গড়ে ৫০০ কিলোমিটার।

এছাড়া ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের মতো ল্যান্ডলকড্ রাজ্যগুলোও সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের সুযোগ পাবে। ত্রিপুরা ফেনী নদীর ওপর দক্ষিণ ত্রিপুরার সাবরুম ও বাংলাদেশের রামগড় পর্যন্ত মৈত্রী সেতুর মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে যুক্ত হবে। সাবরুম থেকে ত্রিপুরার দূরত্ব ১৩৫ ও চট্টগ্রামের ৭৫ কিলোমিটার। এছাড়া কলকাতা/হলদিয়া থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রটোকল রুট দিয়ে দুই হাজার টনের বেশি সক্ষমতার জাহাজ চলাচলের সুযোগ নেই। এর আওতায় আরো বড় জাহাজ চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে ভিড়তে পারবে। এতে ভারতের বিভিন্ন অংশ থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহন বাড়বে। সেই সাথে কমবে পরিবহন ব্যয়। এর মধ্য দিয়ে ভারতের অন্যান্য অংশের সাথে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত যে ভারসাম্যহীনতা তা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক নৈকট্য বৃদ্ধি পাবে।

অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের সুবিধাও কম নয়। কারণ এর ফলে একদিকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে কনটেইনার পরিবহন বাড়বে। এতে বন্দর কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি কাস্টমস কর্তৃপক্ষও বাড়তি আয়ের সুযোগ পাবে। আবার এসব কার্গো/কনটেইনার যখন বাংলাদেশের যানবাহন ব্যবহার করে সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে, তখন পরিবহন ব্যবসায়ীরাও আর্থিকভাবে লাভবান হবেন। তাদের জন্যও বাড়তি আয়ের সুযোগ করে দেবে এই ব্যবস্থা। ফলে বাড়বে রেমিট্যান্সের পরিমাণ। ট্রানজিট ঘিরে বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণেরও সুযোগ রয়েছে। সর্বোপরি নেপাল ও ভুটানকে এর সাথে যুক্ত করা গেলে তার সুফল হবে আরো সুদূরপ্রসারী।

কতিপয় ভ্রান্ত ধারণা

ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট ঘিরে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা যেমন রয়েছে, একইভাবে এর বিপরীত আলোচনাও জারি আছে। নিরাপত্তার বিষয়টিকেই এক্ষেত্রে প্রধান যুক্তি হিসেবে দাঁড় করান অনেকে। এটি অর্থনৈতিক বিষয় হলেও অনেকেরই যুক্তি, এর ফলে ভারতীয় পণ্যের চোরাচালান বেড়ে যেতে পারে। যদিও এসব আশঙ্কার কোনোটিরই বাস্তবে রূপ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ, নিষিদ্ধ কোনো পণ্য থাকলে স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে সহজেই তা ধরা পড়বে। এছাড়া পণ্য যদি কনটেইনারে পরিবহন করা হয়, সেক্ষেত্রে চোরাচালানের ঝুঁকিও কমে যায়। এছাড়া এর অপব্যবহার রোধে সংশ্লিষ্ট পণ্য যেখান দিয়ে ঢুকবে এবং যে পথ দিয়ে বেরোবে, সেখানে পর্যাপ্ত নজরদারির ব্যবস্থা তো থাকছেই। সড়কপথে পরিবহনের ক্ষেত্রে পণ্যের পরিমাণ যাতে বেশি না হয় সেজন্য ওয়েব্রিজের ব্যবস্থাও আছে।

আর ট্রান্সশিপমেন্ট বা ট্রানজিটে সত্যিই কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি যে নেই, সেটা বুঝতে হলে কয়েকটি প্রশ্নের ওপর আলোকপাত করা যেতে পারে। তাহলেই নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টি পরিষ্কার হবে। প্রথম প্রশ্নটি হলো-অভ্যন্তরীণ নৌপথে ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার ফলে বাংলাদেশকে নিরাপত্তা-সংক্রান্ত কোনো সমস্যায় পড়তে হয়েছে কি? তথ্য-উপাত্ত বলছে, ‘না’। দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে, নেপাল-বাংলাদেশ ট্রানজিট রুটে ভারতকে এ ধরনের কোনো সমস্যায় পড়তে হয়েছে কি? এ প্রশ্নের উত্তরও ‘না’।

দৃষ্টি আরেকটু প্রসারিত করলেও এ ধরনের কোনো সমস্যার নজির চোখে পড়বে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা আসিয়ানের কথাই ধরা যাক। কোনো ধরনের নিরাপত্তাঝুঁকি ছাড়াই এসব জোটভুক্ত দেশের ওপর দিয়ে এক দেশের পণ্যবাহীযান অন্য দেশে বাধাহীনভাবে চলাচল করছে। তাই ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট ঘিরে বাংলাদেশেরও নিরাপত্তাজনিত কোনো ঝুঁকির আশঙ্কা পুষে রাখার সুযোগ নেই।

গুরুত্ব দিতে হবে যেসব বিষয়ে

বাংলাদেশের ভূখ- ব্যবহার করে ভারতের পণ্য পরিবহন যাতে লাভজনক ও নির্বিঘœ হয়, সেজন্য উভয় পক্ষকেই বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রধান যে বিষয়, তা হলো কোনো পক্ষকেই সদিচ্ছার সাথে কোনো ধরনের আপস করা চলবে না। কারণ, এর সাফল্য ও পারস্পরিক লাভের বিষয়টি নির্ভর করছে সদিচ্ছা ও সে অনুযায়ী কর্ম সম্পাদনের ওপর।

এর সর্বোচ্চ সুফল ঘরে তুলতে বাংলাদেশ ও ভারত-দুই অংশেই যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে (যেমন সড়ক, রেল ও নৌপথ) বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আখাউড়া থেকে আগরতলা পর্যন্ত রেল যোগাযোগের উদ্যোগ এক্ষেত্রে ইতিবাচক উদাহরণ। যে উদ্দেশ্যে এ ব্যবস্থা তা সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা, তা মূল্যায়নে একটি তদারকি ব্যবস্থা দাঁড় করানোটাও জরুরি। কার্যকর ব্যবস্থাপনার জন্য জোর দিতে হবে নির্ভরযোগ্য ডেটা সংগ্রহের ওপরও।

যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর সক্ষমতার বিষয়টি এক্ষেত্রে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সড়ক যোগাযোগ আগের চেয়ে অনেক উন্নত হলেও রেলপথ ট্রানজিট পণ্য পরিবহনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হতে পারে। কারণ, বাংলাদেশ রেলওয়ের এমনিতেই বাড়তি কিছুৃ সক্ষমতা আছে এবং আগামীতে তা আরো বাড়বে। এছাড়া দূরের পথ পাড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে রেলপথ যেমন পরিবেশবান্ধব, একইভাবে ব্যয়সাশ্রয়ী ও নিরাপদ। তাই বলা যায়, ট্রানজিট পণ্য পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে রেলকে ব্যবহার করা গেলে আর্থিকভাবেও সুবিধা পাবে সংস্থাটি। অবস্থানগত কারণেই চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের উপ-আঞ্চলিক ‘হাব পোর্ট’ হয়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে। বন্দরটি ব্যবহারে ভারতের আগ্রহ সে সম্ভাবনারই ইঙ্গিত। আন্তর্জাতিক মানের সেবা প্রদানের মাধ্যমে আরো বেশি সংখ্যক জাহাজের গন্তব্য হয়ে উঠতে পারে বন্দরটি।

শেষ কথা

আধুনিক বিশ্ব আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপের গুরুত্ব অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। এর মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে সুবিধা যেমন রয়েছে, একইভাবে আছে পরোক্ষ সুবিধাও। প্রত্যক্ষ সুবিধাটি আর্থিক, যা দেখা যায়। এর বাইরে যে পরোক্ষ সুবিধা সেটি দেখা না গেলেও তার গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী। কারণ, পারস্পরিক অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততার ছোট ছোট উদ্যোগ সমষ্টিগতভাবে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। এটা দেখা না গেলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুনামের পাশাপাশি পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি করে, যা অর্থনৈতিকভাবে একসাথে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়।

নৌপরিবহন শিল্পের জন্য মহামারির শিক্ষা

কোভিড-১৯ মহামারির জন্য কোনো শিল্পই প্রস্তুত ছিল না। এর আঘাত থেকে কেউ রেহাইও পায়নি। অদৃশ্য এই ভাইরাস একদিকে শিল্পের চাকা থামিয়ে দিয়েছে, অন্যদিকে ব্যবসার ঝাঁপও নামিয়ে দিয়েছে। সীমান্ত যোগাযোগ ও বন্দরের কার্যক্রমও বন্ধ করে দিয়েছে ভাইরাসটি। সেই সাথে রয়েছে লাখো মৃত্যু ও কোটি কোটি মানুষের দুর্ভোগ-দুর্ভাবনা।

সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ায় এর তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও নৌপরিবহন শিল্পের ওপর। ক্রুজ শিপে ব্যাপক হারে সংক্রমণ সুবিধাজনক দেশের অধীনে জাহাজ নিবন্ধনের যে রেওয়াজ তার ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলতে বাধ্য করেছে। আগে থেকেই ধুঁকতে থাকা এই শিল্পের জন্য নতুন বিপত্তি হয়ে দেখা দিয়েছে জ্বালানি তেলের দরপতন। সেই সাথে আইএমওর স্বল্পমাত্রার সালফারযুক্ত জ্বালানিনীতি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ তো আছেই!

মহামারির কারণে জাহাজ চলাচল যে পুরোপুরি থামিয়ে দিতে হয়েছে, তেমন নয়। তবে সমস্যায় পড়তে হয়েছে বন্দরগুলোর জাহাজ ভিড়তে দেওয়ায় অস্বীকৃতি ও কোরারেন্টিন-সংক্রান্ত বিধানের কারণে। ফলে চুক্তির মেয়াদ শেষেও জাহাজিরা জাহাজ ছাড়তে পারেননি। এর মধ্যেই জাহাজে করোনাভাইরাসের সংক্রমণও বেড়েছে। ক্রুজ জাহাজগুলোয় সংক্রমণ তো ছিল রীতিমতো উদ্বেগজনক! অস্ট্রেলিয়ায় রুবি প্রিন্সেস ও জাপানে ডায়মন্ড প্রিন্সেসের কয়েকশ যাত্রী ও ক্রু কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হন। এ থেকে বুঝতে বাকি থাকে না যে, মহামারি মোকাবিলায় প্রস্তুতির কতটা ঘাটতি ছিল এই শিল্পের। বিভিন্ন দেশ ক্রুজ জাহাজকে তাদের বন্দরে ভিড়তে না দেওয়ায় সংক্রমণের মাত্রা আরো বেড়ে যায়।

পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে উত্তরণ

বাণিজ্যিক ও পরিচালনগত-উভয় ক্ষেত্রেই মালিকদের পক্ষে জাহাজ চালিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন শিপ ম্যানেজাররা। তবে তাদের প্রধান কাজ জাহাজ চলাচল যাতে অব্যাহত থাকে, সেটি নিশ্চিত করা অথবা কলাম্বিয়া শিপ ম্যানেজমেন্টের সিইও মার্ক ও’নিলের ভাষায়, ‘প্রপেলারগুলো নিরাপদে ঘূর্ণায়মান রাখা’। ‘হার্টব্রেক রিজ’ মুভিতে কিèল্ট ইস্টউডের মতো শিপ ম্যানেজারকেও কৌশল আঁটতে হয়েছে, পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে হয়েছে, তারপর এ থেকে উত্তরণ মিলেছে। মহামারির মধ্যেও জাহাজ চলাচল যাতে সচল থাকে, সেজন্য অনেক বেশি নমনীয় হতে হয়েছে তাদের। প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করতে হয়েছে শক্তিশালী ও আগাম পরিকল্পনা। সবচেয়ে লক্ষণীয় যে বিষয়, তা হলো তাদেরকে শক্তিশালী ও স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির নেতৃত্বের ভূমিকায় নামতে হয়েছে।

এর সাথে একমত থম শিপ ম্যানেজমেন্টের সিইও নর্টুন ওলাভ। আরো খানিক অগ্রসর হয়ে তিনি বলেন, শিপ ম্যানেজারদের মতোই একই চ্যালেঞ্চ মোকাবিলা করতে হয়েছে জাহাজ মালিকদেরও। তবে সবচেয়ে বড় যে সমস্যা, সেটি হলো নাবিক বদল করতে না পারা। এর ভুক্তভোগী হয়েছেন শিপ ম্যানেজারদের থেকে শুরু করে জাহাজ মালিক সবাই। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন এবং আইএমও বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে সিফেরারদের ‘কি ওয়ার্কার’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আর্জি জানাতে বাধ্য হয়েছে, যাতে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তারা জাহাজ থেকে নামতে পারেন এবং দেশে ফেরার সুযোগ পান।

নাবিক বদল

মহামারির কারণে জাহাজে থাকা নাবিকরা একাধিকভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছেন। উল্লেখযোগ্য সময় পর্যন্ত তাদের বেতন বাকি পড়েছে। জাহাজ থেকে নেমে যে ঘরে ফিরবেন, সে সুযোগও তারা পাননি। কারণ খুব কম সংখ্যক দেশই নাবিকদের গ্রহণ করেছে।

নাবিক প্রত্যাবর্তনের জন্য জাহাজ মালিক ও শিপ ম্যানেজারদের অনেকগুলো বিষয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কার্নিভাল ক্রুজ লাইনের আটকাপড়া ২৬ হাজার নাবিকের কথাই ধরুন। তাদের বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করার সাথে উত্তর ইউরোপ, ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন্সে জাহাজ পাঠানোর বিষয়টি জড়িত।

ডোমিনিকা মেরিটাইম সার্ভিসেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেনরিক জেনসেন যেমনটা বলছিলেন, নাবিক বদলের সাথে জটিল যেসব বিষয় জড়িত, সবসময়ই যে সেগুলো এক রকম থাকে তা নয়। এজন্য জাহাজ মালিক ও শিপ ম্যানেজার উভয়কেই নমনীয় হতে হয়। নাবিক বদলের ব্যাপারে আমরা সবসময়ই তৎপর ছিলাম এবং এখনো আছি। এজন্য সব ধরনের বিকল্পই আমরা খতিয়ে দেখছি। জাহাজের রুট বরাবর কোনো বন্দর আছে কিনা, সেটা দেখা হচ্ছে। নাবিক বদলের জন্য উপযোগী কোনো বন্দর যদি পেয়ে যাই, সেক্ষেত্রে জাহাজটির অভিমুখ সেদিকে ঘুরিয়ে নেওয়া যায় কিনা, নিলে সেটা লাভজনক হবে কিনা সেসব নিয়ে জাহাজ মালিকদের সাথে আমরা আলোচনাও করছি।

বিএসএম ক্রুজ সার্ভিসেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মার্টিন স্প্রিঙ্গার বলেন, বিশে^র সব বন্দর যখন একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় আমাদের গ্রাহক জার্মান ট্যুর অপারেটর ফিনিক্স রেইজেন তৎক্ষণাৎ সব যাত্রীকে বিমান ধরে নিজ নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানায়। তা সম্ভব না হলে যাত্রীসহ জাহাজটিকেই ফিরে আসতে বলা হয়। যদিও বিশ্বব্যাপী বন্দর বন্ধ ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা-সম্পর্কিত নতুন ঘোষণা আসার পর পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে যায়।

ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের (আইটিএফ) হিসাবমতে, নাবিক বদলে জটিলতার কারণে বিপুল সংখ্যক সিফেরারকে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও কাজ চালিয়ে যেতে হয়। ২০২০ সালের মধ্য জুন পর্যন্ত এ ধরনের সিফেরারের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ লাখ। কাজের বাইরে থাকা সমসংখ্যক সিফেরার নতুন করে জাহাজে যোগদানের অপেক্ষায় ছিলেন। সুতরাং বলা যায়, নাবিক বদলে বাধা সৃষ্টিকারী কোভিড-১৯-সংক্রান্ত ভ্রমণ বিধিনিষেধ ও সরকারের অন্যান্য নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় ছয় লাখ নাবিক।

আইটিএফের মহাপরিচালক স্টিফেন কটনের ভাষায়, তিন লাখ সিফেরার জাহাজে আটকা পড়েন, যারা ঘরে ফিরতে মরিয়া। আরো তিন লাখ সিফেরারকে আর্থিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয় জাহাজে যোগ দিতে না পারার কারণে। আইটিএফ সিফেরার শাখার প্রধান ডেভ হেইন্ডেল এর সাথে যোগ করে বলেন, মেরিটাইম শিল্পে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখতে না চাইলে সরকারগুলোকে অবশ্যই এ বিষয়ে ভূমিকা পালন করতে হবে। জরুরি পদক্ষেপ এ মুহূর্তে খুব বেশি দরকার।

মানসিক চাপ নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ

নাবিক বদল না করতে পারার প্রভাব মেরিটাইম শিল্পে কতটা বিপদ ডেকে আনতে পারে সে-সম্পর্কে কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন ভি. গ্রুপের গ্রুপ পরিচালক ম্যাট ডানলপ। তিনি বলেন, নাবিকদের ওপর চাপ দীর্ঘায়িত হলে সাগরে থাকা জাহাজ মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়তে পারে। কারণ আইএমওর উপাত্তই বলছে, সাগরে দুর্ঘটনার ৮০ শতাংশ ঘটে মানুষের ভুলে। দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্য, অবসাদ ও চাপ সিফেরারদের দৈনন্দিন কাজে বিঘ্ন ঘটানোর জন্য যথেষ্ট। জাহাজ নিরাপদে চলবে নাকি দুর্ঘটনার মুখে পড়বে, এসবের ওপরই তা নির্ভর করে।

চাপ থেকে মুক্তি পেতে একজন সিফেরার নিজেকে তার কেবিনে বন্দি করে রাখতে পারেন। কিন্তু এতে চাপ কমবে না। বরং তিনি আরো বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বেন এবং তার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে; বিশেষ করে বাড়ি থেকে কোনো খারাপ খবর শুনলে এবং তাতে সাহায্য করতে না পারার যন্ত্রণা থেকে। তাই জাহাজ মালিক ও ম্যানেজার সবারই উচিত সিফেরাররা যাতে ভালো থাকেন, সেদিকে মনোযোগ দেওয়া। কারণ সিফেরারের দুর্বল শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য জাহাজকে বড় কোনো দুর্ঘটনায় ফেলে দিতে পারে।

মহামারির কারণে জাহাজে থাকা নাবিকরা একাধিকভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছেন। তাদের অনেক দিনের বেতন বাকি পড়েছে। জাহাজ থেকে নেমে যে ঘরে ফিরবেন, সে সুযোগও তারা পাননি

এর সাথে আরো কিছু তথ্য যোগ করেন গ্রেস্টোক শিপ ম্যানেজমেন্টের রবার্ট হেডলি। তিনি বলেন, এই মহামারি আমাদেরকে যেসব শিখিয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সিফেরারদের কল্যাণকে উপেক্ষা না করা। সবসময় মনে রাখতে হবে, সিফেরাররাই আপনার সম্পদ। অতীতে বহু জাহাজ মালিক ও ম্যানেজারকে আমরা দেখেছি সিফেরারদের দায়মুক্তি দিতে। কারণ নাবিক শুধু একটা উপাধি নয়, তারাই মূল শক্তি।

সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন

সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ও লকডাউন জাহাজ পরিচালনাকে ব্যাহত করেছে। বৈশ্বিক বাণিজ্যের ৯০ শতাংশই পরিবাহিত হয় জাহাজে। নাবিক বদলে অসমর্থ হলে বন্দরে পণ্যজট তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক। কোভিড-১৯ মহামারিতে তার প্রমাণও পাওয়া গেছে।

নর্টুন বিষয়টার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, জাহাজের যন্ত্রাংশ সরবরাহ ও মেশিনারির সার্ভিসিংয়ের নিরিখে দেখলে ড্রাইডক ও মেরামত কারখানার সংকট দেখা দিয়েছে। নিরীক্ষা, জরিপ ও পরিদর্শনের জন্য সার্ভেয়াররা জাহাজে উঠতে পারেননি। এই সমস্যার সমাধানে বিকল্প ব্যবস্থার দিকে হাঁটতে হয়েছে।

তবে সরবরাহ ব্যবস্থার এই যে বিঘ্ন, তা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অবদান রেখেছে দূর যোগাযোগ পদ্ধতি। সিফেরারদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার ক্ষেত্রেও কাজে দিয়েছে এটি। এর মধ্যে আছে দূর থেকে নিরীক্ষা, জরিপ, পরিদর্শন এবং আউটব্রেক ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান ও সব নাবিকের পিপিই পরিধানের বিষয়ে মাস্টার, প্রধান প্রকৌশলী, অন্যান্য নাবিকের দূর থেকে জানানো।

বিভিন্ন দেশের পদক্ষেপ

যুক্তরাজ্যের উদ্যোগে নাবিক বদল নিয়ে ভার্চুয়াল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় চলতি বছরের গোড়ার দিকে এবং সেখানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্তও হয়। সম্মেলনে পরিষ্কারভাবে বলা হয়, সিফেরারদের চুক্তি অব্যাহতভাবে বর্ধিত করা যাবে না। মেরিটাইম লেবার কনভেনশন (এমএলসি) ২০০৬ নির্ধারিত ১২ মাসের নিচেই রাখতে হবে চুক্তির মেয়াদ। এক্ষেত্রে মানবাধিকার ও নাবিক কল্যাণ এবং নীতিমালা-সংক্রান্ত ইস্যু তো আছেই। একই সাথে আছে নাবিকদের অবসাদগ্রস্ততা ও দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্যের কারণে জাহাজের বড় ধরনের দুর্ঘটনায় পড়ার ঝুঁকিও।

এর আাগে ১৩টি দেশ সিফেরারদের ‘কি ওয়ার্কার’ অত্যাবশ্যকীয় কর্মী হিসেবে স্বীকৃতিদানেও সম্মত হয়। দেশগুলো হলো ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, ইন্দোনেশিয়া, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, ফিলিপাইন্স, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।

মহামারির শিক্ষা

অন্যান্য শিল্পের মতো মেরিটাইম শিল্পকেও অনেক কিছু শিখিয়েছে এই মহামারি। মহামারি ও এর প্রভাব মোকাবিলা করতে গিয়ে একটা বিষয় খুব ভালোমতোই খোলাসা হয়ে গেছে; তা হলো কার্যক্রম চালিয়ে রাখতে গেলে অনলাইন পদ্ধতির শরণাপন্ন হওয়ার বিকল্প নেই। এটা এখন অভ্যাসে পরিণত করা উচিত। কারণ নাবিক ও জাহাজকে উল্লেখযোগ্য সময় পর্যন্ত সাগরেই থাকতে হয়। নাবিক কল্যাণ, আপৎকালীন পরিকল্পনা সেই সাথে কর্মতৎপর ও নমনীয় হওয়াটা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নর্টুন মহামারির শিক্ষাকে সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন এভাবে: কোভিড-পরবর্তী শিপ ম্যানেজমেন্টের টেকসই ভবিষ্যৎই দেখতে পাচ্ছি। বিশ্বব্যাপী মহামারির মধ্যে তার নিদর্শন আমরা রেখেছিও। একটা সময় তো বিশ্বের এক-পঞ্চমাংশ মানুষই অন্তরীণ হয়ে পড়েছিল। তবে দেশগুলো তাদের পণ্য সময়মতো যাতে হাতে পায়, সেজন্য শিপ ম্যানেজাররা এখনো দক্ষভাবে জাহাজ ব্যবস্থাপনা করে যাচ্ছেন।

মহামারির মধ্যে দেশগুলো যাতে ওষুধ, জ্বালানি ও খাদ্যের মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ঘাটতিতে না পড়ে, সেজন্য শিপ ম্যানেজাররা এখন পর্যন্ত বন্দরে জাহাজ ভেড়া নিশ্চিত করে চলেছেন। এটা করতে হচ্ছে বেশকিছু অনিশ্চয়তাকে সাথে নিয়েই। বিশ্বব্যাপী সরকারগুলোর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে চুক্তির মেয়াদ শেষেও জাহাজ সচল রাখার মাধ্যমে জাহাজিরাও এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে চলেছেন।

জিওয়া তরো বন্দর

কনটেইনার থ্রুপুটের দিক থেকে ভূমধ্যসাগরে ষষ্ঠ, ইউরোপে নবম এবং ইতালির বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর জিওয়া তরো দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় পর্যটন তীর্থ রেজিও কালাব্রিয়ার উত্তরে জিওয়া উপসাগরের তীরে অবস্থিত। জিব্রালটার প্রণালি হয়ে সুয়েজ খাল ব্যবহারকারী ট্রেড রুটের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে এ বন্দর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। মূলত কনটেইনার বন্দর হলেও এখানে ড্রাই বাল্ক এবং রো-রো কার্গোও হ্যান্ডল করা হয়। প্রাকৃতিকভাবেই পানির গড় গভীরতা ১৮ মিটারের বেশি হওয়ায় ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী দীর্ঘতম লিনিয়ার কি জেটি রয়েছে ৪৪ লাখ বর্গমিটার আয়তনের এই বন্দরে। সেই সাথে জাহাজ থেকে ২৩ সারি কনটেইনার লোড-আনলোডে সক্ষম ২২টি অত্যাধুনিক শিপ-টু-শোর ক্রেন থাকায় এক সাথে চারটি পর্যন্ত আলট্রা লার্জ কনটেইনার ভেসেলকে মুরিং সুবিধা দিতে পারে জিওয়া তরো।

অথচ সমৃদ্ধশালী বন্দরটির জন্ম হয়েছিল রাজনৈতিক, সামাজিক আন্দোলনের ডামাডোলের মধ্য দিয়ে। ১৯৭০ সালে রেজিও কালাব্রিয়া বিদ্রোহ প্রশমনের উদ্দেশে রেলরোড স্টাম্প এবং জিওয়া বন্দরসহ দেশের পঞ্চম স্টিলওয়ার্ক সেন্টার গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ইতালীয় প্রধানমন্ত্রী এমিলিও কোলোম্বো। ৩ বিলিয়ন লিরা বিনিয়োগের এ মেগা প্রকল্পে ১০ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা তৈরি হয়। সময়মতো সেটি না হওয়ায় কয়লাভিত্তিক একটি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে নানাবিধ সমস্যার কারণে দুটি বৃহৎ প্রকল্পের একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ ততদিনে বন্দরের মূল হারবার, ডক, জেটি, পিয়ার সবকিছু তৈরি। পরে বন্দরের মূল নকশায় কিছু অদলবদল করে কনটেইনার আমদানি-রপ্তানিকারী বাণিজ্যিক বন্দরের চেহারা দেওয়া হয়। এর মধ্যে কনটেইনারবাহী জাহাজের আকৃতি দিন দিন বাড়তে থাকায় ১৯৯৫ সালে জিওয়া তরোকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। স্থাপিত হয় হারবার মাস্টারের কার্যালয়, শুল্ক অফিস, ইতালীয় ফিন্যান্স পুলিশের দপ্তর, ফায়ার এবং পুলিশ স্টেশন।

নিরাপত্তায় আইএসপিএস কমপ্লায়েন্ট এবং কনটেইনার স্ক্যানিং সুবিধায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন মেগাপোর্ট ইনিশিয়েটিভের অংশ বন্দরটিতে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা খুবই উন্নত। ১৯৯৮ সালে এটি তখনকার বৃহত্তম কনটেইনার জাহাজ ৩১৮ মিটার দীর্ঘ এবং ৬ হাজার ৪০০ টিইইউ ধারণক্ষমতার এমভি রেজাইনা মায়ের্স্ককে সেবা দেয়। সে সময় বিশ্বজুড়ে হাতে গোনা কয়েকটি বন্দরে এত বড় জাহাজ মুরিং এবং আনলোড সুবিধা ছিল। এভাবে ২০০৮ সালের বৃহত্তম জাহাজ এমএসসি ড্যানিয়েলাকে ডকিং করে জিওয়া তরো। প্রথমবারের মতো ১৪ হাজার টিইইউ বহনের মাইলফলক অতিক্রমকারী ড্যানিয়েলা মেগা-শিপের ইতিহাসে নতুন যুগ সূচনা করে। ইতালির প্রথম বন্দর হিসেবে এত বড় জাহাজ থেকে কনটেইনার হ্যান্ডলের পর নিজের তৈরি রেকর্ড আরো কয়েকবার ভেঙেছে এ বন্দর। ইতালিতে এখন পর্যন্ত বার্থিং করা বৃহত্তম জাহাজ ১৬ হাজার ৬৫০ টিইইউ বহনকারী এমএসসি লন্ডনকেও মুরিং করানো হয়েছিল এখানেই।

এমন সম্ভাবনাময় একটি বন্দরের যতটা প্রবৃদ্ধি হওয়া স্বাভাবিক ছিল, সেটি এখনো অর্জিত হয়নি কালাব্রিয়ার কুখ্যাত সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র ‘এনদ্রানঘেতা’র কারণে। ধারণা করা হয়, ইতালিয়ান মাফিয়ার মতো অর্গানাইজড ড্রাগ ক্রাইম সিন্ডিকেটটির গুপ্তচর লুকিয়ে আছে এখানে অপারেশন পরিচালনাকারী টার্মিনাল অপারেটর কোম্পানিতে, এমনকি খোদ বন্দর কর্তৃপক্ষের ভেতরেও। ২০০৬ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী গোটা ইউরোপে কলম্বিয়া থেকে যত কোকেন আসে, তার ৮০ শতাংশই আসে জিওয়া তরো বন্দর দিয়ে। অত্যন্ত প্রভাবশালী এ সংগঠনের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা ও নজরদারি বৃদ্ধির সুফল মিলতে শুরু করেছে। মেগাপোর্ট ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে কনটেইনার নিরাপত্তা ও স্ক্যানিং প্রক্রিয়া সরাসরি যুক্ত করা হয়েছে মার্কিন কর্মকর্তাদের। মাদকের বেশ কয়েকটি বড় চালান ধরা পড়ার পর কমতে শুরু করেছে অবৈধ কার্গোর সংখ্যা।

জিওয়া তরো বন্দর

কনটেইনার থ্রুপুটের দিক থেকে ভূমধ্যসাগরে ষষ্ঠ, ইউরোপে নবম এবং ইতালির বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর জিওয়া তরো দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় পর্যটন তীর্থ রেজিও কালাব্রিয়ার উত্তরে জিওয়া উপসাগরের তীরে অবস্থিত। জিব্রালটার প্রণালি হয়ে সুয়েজ খাল ব্যবহারকারী ট্রেড রুটের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে এ বন্দর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। মূলত কনটেইনার বন্দর হলেও এখানে ড্রাই বাল্ক এবং রো-রো কার্গোও হ্যান্ডল করা হয়। প্রাকৃতিকভাবেই পানির গড় গভীরতা ১৮ মিটারের বেশি হওয়ায় ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী দীর্ঘতম লিনিয়ার কি জেটি রয়েছে ৪৪ লাখ বর্গমিটার আয়তনের এই বন্দরে। সেই সাথে জাহাজ থেকে ২৩ সারি কনটেইনার লোড-আনলোডে সক্ষম ২২টি অত্যাধুনিক শিপ-টু-শোর ক্রেন থাকায় এক সাথে চারটি পর্যন্ত আলট্রা লার্জ কনটেইনার ভেসেলকে মুরিং সুবিধা দিতে পারে জিওয়া তরো।

অথচ সমৃদ্ধশালী বন্দরটির জন্ম হয়েছিল রাজনৈতিক, সামাজিক আন্দোলনের ডামাডোলের মধ্য দিয়ে। ১৯৭০ সালে রেজিও কালাব্রিয়া বিদ্রোহ প্রশমনের উদ্দেশে রেলরোড স্টাম্প এবং জিওয়া বন্দরসহ দেশের পঞ্চম স্টিলওয়ার্ক সেন্টার গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ইতালীয় প্রধানমন্ত্রী এমিলিও কোলোম্বো। ৩ বিলিয়ন লিরা বিনিয়োগের এ মেগা প্রকল্পে ১০ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা তৈরি হয়। সময়মতো সেটি না হওয়ায় কয়লাভিত্তিক একটি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে নানাবিধ সমস্যার কারণে দুটি বৃহৎ প্রকল্পের একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ ততদিনে বন্দরের মূল হারবার, ডক, জেটি, পিয়ার সবকিছু তৈরি। পরে বন্দরের মূল নকশায় কিছু অদলবদল করে কনটেইনার আমদানি-রপ্তানিকারী বাণিজ্যিক বন্দরের চেহারা দেওয়া হয়। এর মধ্যে কনটেইনারবাহী জাহাজের আকৃতি দিন দিন বাড়তে থাকায় ১৯৯৫ সালে জিওয়া তরোকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। স্থাপিত হয় হারবার মাস্টারের কার্যালয়, শুল্ক অফিস, ইতালীয় ফিন্যান্স পুলিশের দপ্তর, ফায়ার এবং পুলিশ স্টেশন।

নিরাপত্তায় আইএসপিএস কমপ্লায়েন্ট এবং কনটেইনার স্ক্যানিং সুবিধায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন মেগাপোর্ট ইনিশিয়েটিভের অংশ বন্দরটিতে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা খুবই উন্নত। ১৯৯৮ সালে এটি তখনকার বৃহত্তম কনটেইনার জাহাজ ৩১৮ মিটার দীর্ঘ এবং ৬ হাজার ৪০০ টিইইউ ধারণক্ষমতার এমভি রেজাইনা মায়ের্¯‹কে সেবা দেয়। সে সময় বিশ্বজুড়ে হাতে গোনা কয়েকটি বন্দরে এত বড় জাহাজ মুরিং এবং আনলোড সুবিধা ছিল। এভাবে ২০০৮ সালের বৃহত্তম জাহাজ এমএসসি ড্যানিয়েলাকে ডকিং করে জিওয়া তরো। প্রথমবারের মতো ১৪ হাজার টিইইউ বহনের মাইলফলক অতিক্রমকারী ড্যানিয়েলা মেগা-শিপের ইতিহাসে নতুন যুগ সূচনা করে। ইতালির প্রথম বন্দর হিসেবে এত বড় জাহাজ থেকে কনটেইনার হ্যান্ডলের পর নিজের তৈরি রেকর্ড আরো কয়েকবার ভেঙেছে এ বন্দর। ইতালিতে এখন পর্যন্ত বার্থিং করা বৃহত্তম জাহাজ ১৬ হাজার ৬৫০ টিইইউ বহনকারী এমএসসি লন্ডনকেও মুরিং করানো হয়েছিল এখানেই।

এমন সম্ভাবনাময় একটি বন্দরের যতটা প্রবৃদ্ধি হওয়া স্বাভাবিক ছিল, সেটি এখনো অর্জিত হয়নি কালাব্রিয়ার কুখ্যাত সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র ‘এনদ্রানঘেতা’র কারণে। ধারণা করা হয়, ইতালিয়ান মাফিয়ার মতো অর্গানাইজড ড্রাগ ক্রাইম সিন্ডিকেটটির গুপ্তচর লুকিয়ে আছে এখানে অপারেশন পরিচালনাকারী টার্মিনাল অপারেটর কোম্পানিতে, এমনকি খোদ বন্দর কর্তৃপক্ষের ভেতরেও। ২০০৬ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী গোটা ইউরোপে কলম্বিয়া থেকে যত কোকেন আসে, তার ৮০ শতাংশই আসে জিওয়া তরো বন্দর দিয়ে। অত্যন্ত প্রভাবশালী এ সংগঠনের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা ও নজরদারি বৃদ্ধির সুফল মিলতে শুরু করেছে। মেগাপোর্ট ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে কনটেইনার নিরাপত্তা ও স্ক্যানিং প্রক্রিয়া সরাসরি যুক্ত করা হয়েছে মার্কিন কর্মকর্তাদের। মাদকের বেশ কয়েকটি বড় চালান ধরা পড়ার পর কমতে শুরু করেছে অবৈধ কার্গোর সংখ্যা।

নকটার্নাল

প্রকৃতপক্ষে এক ধরনের অ্যাস্ট্রোল্যাব, যা মূলত রাতে নেভিগেশনের জন্য ব্যবহার করা হতো। একটি ঘূর্ণনক্ষম বাহু বা আজিমুথাল পরিমাপ ডিভাইসের সাথে কয়েকটি রিং ডিস্ক লাগানো থাকত নকটার্নালে, আর থাকত একটি হ্যান্ডল যা পুরো যন্ত্রটিকে উল্লম্বভাবে দাঁড় করিয়ে রাখত। সূর্য্যরে সাহায্য ছাড়া রাতে ল্যাটিচিউড মাপতে হলে নকটার্নাল রিংয়ের শূন্য ডিগ্রি চিহ্নকে দিগন্তের সাথে সমান্তরালে রেখে আজিমুথ রিডিং ডিভাইসকে পোল স্টার বা শুকতারার দিকে তাক করা হতো। এতে উৎপন্ন কোণকে নতি বা অ্যাঙ্গেল অব এলিভেশন হিসেবে পাওয়া যায়। রাতে সময় নির্ধারণেও নাবিকদের কাছে এর কদর ছিল। নকটার্নালের দুই ডিস্কে দিন ও মাসের গ্রেডিয়ান এবং অপরটিতে ঘণ্টার পরিমাপ থাকত। দিনের হিসাব আঁকা ডিস্কের কেন্দ্র থেকে মধ্যরাতে শুকতারার দিকে তাকিয়ে আজিমুথ রিডিং ডিভাইসকে উরসা মেজরের দিকে ধরলে একটি ঘড়ির ডায়ালের লম্বা কাঁটার মতো গঠন তৈরি হয়। উত্তর গোলার্ধে শুকতারার কাছে উদিত হওয়া উরসা মেজর প্রায় ২৪ ঘণ্টায় (২৩ ঘণ্টা ৫৬ মিনিটে) একটি পূর্ণ আবর্তন সম্পন্ন করায় সময়ের এ পরিমাপ প্রায় নিখুঁত হতো। বন্দরে জোয়ার-ভাটার ঠিকঠাক সময় নির্ধারণেও নাবিক, ক্যাপ্টেনরা নকটার্নাল ব্যবহার করতেন। পৃথিবীর উত্তর মেরু-দক্ষিণ মেরু সংযোগকারী কল্পিত রেখা মেরিডিয়ানের ওপর চাঁদের গতিপথ এবং চাঁদের বয়সের (নতুন চাঁদ, নাকি ক্ষয়া বা পূর্ণ) ওপর ভিত্তি করে এ হিসাব করা হতো।

কিন্তু নকটার্নালের হিসাব অনেক সময় ভুলও হতো। ২৪ ঘণ্টার বদলে ২৩ ঘণ্টা ৫৬ মিনিটের ওপর ভিত্তি করে হিসাব করা হতো বলে সকল পরিমাপে ৪ মিনিটের ফাঁক থেকে যেত। আবার উত্তাল সাগরে নকটার্নালকে, বিশেষ করে আজিমুথ রিডিং ডিভাইসকে স্থির করে রাখা ছিল অত্যন্ত দুষ্কর। আধুনিক নেভিগেশন ইকুইপমেন্ট আসার পর অ্যাস্ট্রোল্যাবের সাথে সাথে কার্যকারিতা হারায় নকটার্নাল।

জ্যাক কস্তু

১৯১০ সালে সেইন্ট আন্দ্রেতে জন্ম নেওয়া এ ফরাসি নৌবাহিনী কর্মকর্তা ছিলেন একাধারে চৌকস একজন নেভাল অফিসার, সমুদ্র অভিযাত্রী এবং আবিষ্কারক। তবে ইতিহাস তাকে মনে রাখবে তাঁর উদ্ভাবিত স্কুবা ডাইভিং অ্যাপারেটাস অ্যাকুয়া-লাংয়ের জন্য, যা সমুদ্রে ডাইভিংয়ের জন্য এখনো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

১৯৪৩ সালে এসে যৌথভাবে প্রথম সম্পূর্ণ অটোমেটিক কমপ্রেসড এয়ার অ্যাকুয়া লাং নির্মাণে সক্ষম হন কস্তু এবং ফ্রেঞ্চ ইঞ্জিনিয়ার এমিল গ্যাগনান। এরপর ১৯৫৯ সালে সহজে দিক পরিবর্তনযোগ্য ছোট সাবমেরিন ডাইভিং সসার, কয়েক ধরনের আন্ডারওয়াটার ক্যামেরাসহ সমুদ্র তলদেশে অভিযানের উপযোগী এবং ওশেনোগ্রাফারদের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক যন্ত্রপাতি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি।

ওশেনোগ্রাফিক গবেষণা এবং স্কুবা ডাইভিংয়ের ওপর ফ্রেডেরিক দ্যুমা ও জ্যাক কস্তুর লেখা বই ‘দ্য সাইলেন্ট ওয়ার্ল্ড’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে। বেস্ট সেলার এ বইয়ের ওপর ভিত্তি করে তিন বছর পর বিশিষ্ট চলচিত্র নির্মাতা লুই মালের সাথে যৌথভাবে তিনি নির্মাণ করেন ডকুমেন্টারি ফিল্ম দ্য সাইলেন্ট ওয়ার্ল্ড। সে বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবের পাম দ’র এবং সেরা ডকুমেন্টারির অস্কার বাগিয়ে নেয় চলচ্চিত্রটি। ১৯৫৭ সালে মোনাকোর ওশেনোগ্রাফিক মিউজিয়ামের পরিচালক নিযুক্ত হন। সমুদ্রে কন্টিনেন্টাল শেলফে গবেষণার জন্য পরিচালিত কনশেলফ স্যাচুরেশন ডাইভ প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে কনশেলফ ওয়ান, টু এবং থ্রি নামে মার্শেইয়ের কাছে ভূমধ্যসাগরের ৩০ ফুট, ১০০ ফুট এবং ৩৩৬ ফুট গভীরে তিনটি আন্ডারসি ল্যাবরেটরি গড়ে তোলেন তিনি। ১৯৮৫ সালে মার্কিন সরকার তাকে ইউএস প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম সম্মাননায় ভূষিত করে। ১৯৯৭ সালে ৮৭ বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।

মেরিটাইম লজিস্টিকস: আ গাইড টু কনটেম্পোরারি শিপিং অ্যান্ড পোর্ট ম্যানেজমেন্ট

সম্পাদনা: ডং-উক সং, ফোটিস এম. পানাইডেস

বিশ্বায়নের আশীর্বাদে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গতি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ব্যক্তিগত ও কোম্পানি পর্যায়ে অনলাইন ক্রয়-বিক্রয়, সেকেন্ডের মধ্যে আর্থিক লেনদেন, আমদানি-রপ্তানি কাজে বন্দর ও অংশীজনদের সিঙ্গেল উইন্ডো ব্যবহার এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে। কিন্তু যতই আধুনিকায়ন হোক না কেন, পণ্য সেই একইভাবে সমুদ্রপথে প্রথাগত লজিস্টিক সিস্টেম ব্যবহার করেই আনা-নেওয়া করা হচ্ছে। একটি দেশ তথা জাতির উন্নয়নে মেরিটাইম লজিস্টিক সিস্টেম উন্নয়নের কোনো বিকল্প যে আসলে নেই, এ বিষয়টিই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ‘মেরিটাইম লজিস্টিকস: আ গাইড টু কনটেম্পোরারি শিপিং অ্যান্ড পোর্ট ম্যানেজমেন্ট’ বইটি। মূলত প্রবন্ধ সংকলনধর্মী বইটিতে চলতি নৌপরিবহন ব্যবস্থার কিছু মৌলিক দিক তুলে ধরেছেন এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটির ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড লজিস্টিক বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর ডং-উক সং এবং সাইপ্রাস ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির শিপিং ইকোনমিকসের সহযোগী অধ্যাপক ফোটিস পানাইডেস।

বন্দর এবং শিপিং ইন্ডাস্ট্রিতে লজিস্টিক ও সাপ্লাই চেইন সম্পর্কিত সর্বাধুনিক উন্নয়ন, জ্ঞান, প্রযুক্তি এবং ব্যবহার সম্পর্কিত ২০টি নিবন্ধ রয়েছে চার অংশে বিভক্ত বইয়ে। নিত্যনতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ইতিবাচক দিক ও সমস্যাগুলো বিশেষ করে পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলোও নির্মোহ দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন সংকলকদ্বয়।

বাড়তি পণ্যের ক্রমবর্ধমান চাপ সামাল দিতে কেবল বড় বড় জাহাজ তৈরি করা যথেষ্ট নয়। এগুলোকে সেবা দেওয়ার মতো বন্দর ব্যবস্থা গড়ে তোলাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আবার পরিবর্তিত বন্দর ব্যবস্থায় যথাযথ লজিস্টিক সাপোর্ট সিস্টেম না থাকলে দেশের অর্থনীতি, শিল্প-বাণিজ্যে, মানুষের জীবনমানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ২০১৫ সালে কোগান পেইজ থেকে প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণে একবিংশ শতাব্দীর বন্দর-কেন্দ্রিক পরিবহনের ধারণা ও প্রয়োগ, হিন্টারল্যান্ড লজিস্টিক, গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন, ড্রাই বাল্ক, ট্রেড ফ্যাসিলিটেটর হিসেবে মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট ও লজিস্টিকের অবদান এবং পরিবর্তনের ভবিষ্যৎ ধারা নিয়ে কয়েকটি প্রবন্ধ নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অভিজ্ঞ সম্পাদনার গুণে বিশে^র বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা আন্তর্জাতিক লজিস্টিক বিশেষজ্ঞদের লেখা এসব নিবন্ধ তথ্যে ভরপুর নীরস গবেষণা সন্দর্ভ না হয়ে চমৎকার প্রাঞ্জল গদ্য হয়ে উঠেছে।

৪৮০ পৃষ্ঠার বইয়ের কিন্ডল ই-বুক ৬১ মার্কিন ডলারে, পেপারব্যাক ৬৪ ডলারে এবং হার্ডকভার ২৫৪ ডলারে পাওয়া যাবে অ্যামাজনে।

আইএসবিএন-১০: ০৭৪৯৪৭২৬৮৫

আইএসবিএন-১৩: ৯৭৮-০৭৪৯৪৭২৬৮৯।

আইএমও ২০২০: নিষ্কণ্টক নয় ভিএলএসএফও-এ অভিগমন

আইএমও ২০২০ অনুযায়ী স্বল্পমাত্রার সালফারযুক্ত জ্বালানি তেলের (ভিএলএসএফও) পথে অভিগমনের পথটা নিষ্কণ্টক হবে কোন পন্থায়? একাধিক ইস্যু বিবেচনায় নিয়ে ২০১৯ সালেই এ ব্যাপারে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। তাহলে সঠিক পথ কোনটি? এই প্রশ্নের উত্তর মেলাতে ২০২০ সালের জুলাইয়ে বিমাকারী প্রতিষ্ঠান গার্ড মেরিন অ্যান্ড এনার্জি ইন্স্যুরেন্স তাদের সদস্য ও গ্রাহকদের জন্য ধারাবাহিক ওয়েবিনারের আয়োজন করে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশের কম সালফারযুক্ত জ্বালানি ব্যবহার করতে গিয়ে জাহাজ মালিক, ক্রু ও চার্টারারদের কারিগরি, আইনি ও কমপ্লায়েন্স-সংক্রান্ত যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে ওয়েবিনারগুলোতে তার ওপর আলোকপাত করেছেন আলোচকরা।

ওয়েবিনার চলাকালে, এমনকি এর শেষেও আলোচকরা কারিগরি, বিমা এবং বাস্তবায়ন-সংশ্লিষ্ট একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের অবতারণা করেন। সেগুলোর উত্তর ও ভিএলএসএফওর পথে অভিগমে গার্ডের অভিজ্ঞতার মিশেলে এই আলোচনা।

গার্ডের অভিজ্ঞতা

প্রাথমিক অভিজ্ঞতা বলছে, উপাদানগত দিক দিয়ে কম ঘনত্বের ভিএলএসএফওগুলোর মধ্যে লক্ষণীয় মাত্রায় ভিন্নতা রয়েছে। আইএসও ৮২১৭ মানদন্তের  ব্যত্যয় পাওয়া গেছে এসব জ্বালানিতে। ভিএলএসএফও সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি যে সমস্যার কথা গার্ডকে শুনতে হয়েছে তা হলো উচ্চ মাত্রায় টোটাল সেডিমেন্ট পোটেনশিয়াল বা টিএসপি (জ্বালানি তেলের বিশুদ্ধতা ও স্থায়িত্বের পরিমাপ) ও সামান্য হলেও বেশি মাত্রায় সালফারের উপস্থিতি। একই ফলাফল পাওয়া গেছে বাল্টিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম কাউন্সিল (বিমকো), ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব শিপিং (আইসিএস), ইন্টারকার্গো ও ইন্টারট্যাংকোর যৌথ সমীক্ষায়ও।

পরিচালনগত দিক বিবেচনায় নিলে জ্বালানি হিসেবে ভিএলএসএফও ব্যবহারের কারণে সবচেয়ে বেশি যে সমস্যা জাহাজিদের সামলাতে হচ্ছে, তা হলো পিউরিফায়ার ও ফিল্টারে অতিরিক্ত স্লাজ জমা হওয়া। যদিও এর ফলে ইঞ্জিন ঘন ঘন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কোনো খবর এখনো তেমন একটা পাওয়া যায়নি। বেশি হারে ইঞ্জিন বিকল না হওয়ার দুটি ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে-হয় ক্রু সদস্যরা জ্বালানিটির ব্যবস্থাপনা ভালোমতোই রপ্ত করেছেন অথবা সমস্যা দেখা দিলে তা জাহাজ থেকে অপসারণ করছেন। গার্ডের নিজস্ব জরিপও একই কথা বলছে।

জ্বালানির কারণে জাহাজের যন্ত্রপাতি নষ্ট-সংক্রান্ত যে উপাত্ত গার্ডের হাতে রয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ২০১৮ ও ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় ২০২০ সালের একই সময়ে ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দাবি ঢের কম এসেছে। তবে চুক্তিভিত্তিক জ্বালানি তেল সরবরাহ-সংক্রান্ত বিরোধের কারণে দায়ের করা মামলার সংখ্যা গত বছরের মতোই আছে। এই যখন অবস্থা, তখন গার্ডের অনুমান বলছে, খুব বেশি ইঞ্জিনের ক্ষতি বা মালিক ও চার্টারারদের মধ্যে ব্যাপক মাত্রায় মামলার ঘটনা অন্তত সামনের ছয় মাসে দেখা যাবে না। তবে স্বল্পমাত্রার সালফারযুক্ত জ্বালানির পথে অভিগমনে চ্যালেঞ্জ আছে বিস্তর। কী সেই সব চ্যালেঞ্জ?

ভিএলএসএফও ব্যবহার-পূর্ব পরীক্ষা

ব্যবহারের আগে জাহাজ মালিকদের ভিএলএসএফও পরীক্ষা করতেই হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে সরবরাহকারীরা জ্বালানির মান ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করছেন কিনা, সে ব্যাপারে জাহাজ মালিকরা অন্ধকারে থাকায় বিশেষায়িত পরীক্ষাগারে তা পরীক্ষা করাটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিমার বাইরে রয়েছেন, এমন বিজ্ঞ মালিকদের ভূমিকা এই পরিস্থিতিতে কী হবে, একজন বিমাকারীর পক্ষ থেকে সে প্রশ্ন তোলাই যায়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উত্তম চর্চাটি হতে পারে ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় সন্তোষজনক ফলাফল না আসা পর্যন্ত নতুন ব্যাচের জ্বালানি তেল ব্যবহার থেকে বিরত থাকা। আবার এমন পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে, যেখানে ব্যবহারের আগে জ্বালানির পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ লাভজনক নয়।

জ্বালানি তেলের পরীক্ষা যদি করতেই হয় তাহলে এর নমুনা সংগ্রহ করতে হবে কোত্থেকে? এ নিয়ে একটা বিতর্ক আছেই। চার্টারার ও বাংকার সাপ্লায়াররা জোর দিয়ে থাকেন সরবরাহকারকদের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহের ওপর। অন্যদিকে জাহাজ মালিকদের আগ্রহ জাহাজ থেকেই নমুনা সংগ্রহের বিষয়ে। তাদের দাবি, সরবরাহকারকের নমুনা জ্বালানির সঠিক প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। বিশেষ করে গ্রহীতা জাহাজের ক্রু সদস্যরা যদি বাংকার বার্জের নমুনার ওপর দক্ষভাবে নজরদারি করতে অসমর্থ হয়ে থাকেন। কিছু ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন নমুনা পরীক্ষায় ভিন্ন ভিন্ন ফলাফলের প্রমাণও মিলেছে। সরবরাহকারীর নমুনা গুণগত মানের হলেও গ্রহীতা জাহাজের নমুনায় এর ব্যত্যয় দেখা গেছে।

এই যখন অবস্থা, তখন আইএসও ১৩৭৩৯-এর ২০২০ সংস্করণে জাহাজ থেকে নমুনা সংগ্রহের কথা বলা হয়েছে। আগের সংস্করণে সরবরাহকারী ও গ্রহীতা-উভয় প্রান্ত থেকেই নমুনা সংগ্রহের সুযোগ ছিল। এক্ষেত্রেও নিয়মনীতির ব্যত্যয় যে হয় না, তা নয়। এমন কিছু বাংকার ডেলিভারি নোট (বিডিএন) দেখা গেছে, যেখানে সব নমুনাই গ্রহীতা জাহাজ থেকে সংগ্রহের কথা বলা আছে। তথ্য যাচাই না করে জাহাজের ক্রু সদস্যরা তাতে স্বাক্ষরও করেছেন। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জ্বালানি তেল সম্পর্কিত তথ্য যাচাই না করে জাহাজের মাস্টার ও প্রধান প্রকৌশলীকে বিডিএনে স্বাক্ষর না করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

যন্ত্রপাতি ক্ষতির দায় কার

জাহাজের ইঞ্জিন যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তদন্তের পর যদি প্রমাণ হয় যে, জ্বালানি তেলের দূষিত উপাদানের কারণেই এমনটা হয়েছে, তাহলে এর দায়ভার কার ওপর বর্তাবে? জাহাজ মালিক নাকি চার্টারারকে এই ক্ষতির দায় নিতে হবে? এই জাতীয় প্রশ্নের মুখে গার্ডকে প্রায়ই পড়তে হয়। তবে ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সুনির্দিষ্ট কারণ প্রতিষ্ঠা করাটা বেশ শক্ত। কারণ জ্বালানি তেলে এমন কিছু উপাদান পাওয়া যায়, যেগুলো মানসম্মত জ্বালানির অংশ নয়। এবং এজন্য জিএস-এমএস জাতীয় তদন্তের প্রয়োজন পড়ে। আবার এই সব উপাদানের কারণেই যে ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটা প্রতিষ্ঠা করাও অতটা সহজ নয়।

ধরুন, সরবরাহকৃত জ্বালানিতে বিদ্যমান দূষিত উপাদানের কারণেই ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মত দিলেন রসায়নবিদ ও প্রকৌশলীরা। তখন প্রশ্ন আসে জাহাজ মালিকের সাথে সম্পাদিত চুক্তির বাধ্যবাধকতা কি লঙ্ঘন করেছেন চার্টারার? সেটা হলে ক্ষতির দায়ভার চার্টারারকেই নিতে হবে।

চার্টার-সংক্রান্ত একেক ধরনের চুক্তি একেক রকম। টাইম চার্টারাররা (নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জাহাজ ইজারা নেওয়া) জাহাজে চুক্তিতে উল্লেখিত মানদ-ের জ্বালানি তেল সরবরাহে বাধ্য থাকেন। আইএসও ৮২১৭ অনুযায়ী ব্যবহৃত জ্বালানি তেলে এমন কিছু থাকা যাবে না, যা কর্মী ও জাহাজের জন্য ক্ষতিকর এবং ইঞ্জিনের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়।

এই আলোকে বলা যায়, জ্বালানি তেলের চিহ্নিত কোনো উপাদানের কারণে যদি ইঞ্জিনের ক্ষতি হয়, তাহলে তত্ত্বগতভাবে চার্টারারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারেন জাহাজ মালিক। তবে এ ধরনের দাবি তদন্ত ও তারসাপেক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ করাটা বেশ ব্যয়বহুল।

জ্বালানি হিসেবে ভিএলএসএফও ব্যবহারের কারণে জাহাজ পরিচালনায় সবচেয়ে বেশি যে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে, তা হলো পিউরিফায়ার ও ফিল্টারে অতিরিক্ত স্লাজ জমা হওয়া

জ্বালানির মান নিয়ে জাহাজ মালিক ও চার্টারারের মধ্যে ভিন্ন ধর্মী বিবাদও তৈরি হতে পারে। গুণগত মানের না হওয়ায় গৃহীত জ্বালানি অনেক সময় ব্যবহারে রাজি হন না জাহাজ মালিক। আবার চার্টারারও তা বাদ দিতে চান না। এমন পরিস্থিতিতে জাহাজ চলাচলই বন্ধ হয়ে যায়। বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির বিষয় জড়িত এক্ষেত্রে। কারণ মালিকের দাবি যদি সঠিক প্রমাণিত হয়, তাহলে জাহাজ না চললেও চার্টারারকে ভাড়া গুনতে হয় ঠিকই। আবার চার্টারারের দাবি অনুযায়ী, জ্বালানির মান সঠিক প্রমাণিত হলে ভাড়া না পাওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে হয় জাহাজ মালিককে। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে উভয় পক্ষকেই যা করতে হবে, তা হলো জ্বালানিটি মানহীন কিনা ত্বরিত তা পরীক্ষা করে দেখা। এজন্য বিশেষজ্ঞের সাহায্যের প্রয়োজন পড়বে। একই সাথে জ্বালানি যদি জাহাজ থেকে অপসারণ করতেই হয়, তাহলে দ্রুত সময়ের মধ্যে বাংকার সাপ্লায়ারকে এর সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। বিক্রয় চুক্তির শর্ত মেনে স্বনামধন্য বাংকার সাপ্লায়াররা হয়তো অপসারণে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতেও পারে।

বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা

মানহীন জ্বালানির কারণেই যন্ত্রপাতির ক্ষতি হয়েছে কিনা, তা প্রতিষ্ঠা করা অনেক সময় কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাহলে প্রশ্ন হলো এ সমস্যার সমাধানে কি বিশেষজ্ঞ নিয়োগের প্রয়োজন আছে? চলতি বছর এ-সংক্রান্ত বেশকিছু ঘটনা অবশ্য এর সপক্ষেই কথা বলছে। ওই সব ঘটনায় প্রকৌশলী বা রসায়নবিদ নিয়োগ দিতে হয়েছিল। যেসব ঘটনায় নিয়োগ দেওয়া হয়নি, সেগুলোর ক্ষেত্রে অন্তত এসব বিশেষজ্ঞের পরামর্শের প্রয়োজন পড়েছিল। বিশেষ করে আইএসও ৮২১৭ মানদন্তের জ্বালানির ক্ষেত্রে, যেগুলোর ব্যবস্থাপনা এখনো ভালোমতো রপ্ত করে উঠতে পারেননি ক্রু সদস্যরা। তাছাড়া জ্বালানির কারণেই যে যন্ত্রপাতির ক্ষতি হয়েছে, সেটি প্রতিষ্ঠা করা বেশ জটিল ব্যাপার। একই সাথে সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। চলতি বছর উদ্ভূত এ ধরনের একটি সমস্যার শুধু তদন্ত করতেই খরচ হয়ে গেছে ২০ হাজার ডলার।

পোর্ট স্টেট কন্ট্রোলের করণীয়

কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে পোর্ট স্টেট কন্ট্রোলের (পিএসসি) পরিদর্শন ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। তা সত্ত্বেও টোকিও এমওইউ রিজিয়নে মারপলের ষষ্ঠ সংযোজনের আওতায় সালফার ডাই-অক্সাইড সংক্রান্ত ঘটনায় আটককৃত জাহাজের সংখ্যা দুই অংকে পৌঁছে গেছে। আটককৃত বেশির ভাগ জাহাজের জ¦ালানিতেই উচ্চ মাত্রায় সালফারের উপস্থিতি ছিল।

গার্ডের পর্যবেক্ষণ বলছে, পিএসসি কর্মকর্তারা মোটামুটিভাবে মারপলের ষষ্ঠ সংযোজন ও আইএমওর এমইপিসি.৩২০(৭৪) রেজল্যুশনের আওতায় পোর্ট স্টেট কন্ট্রোলের জন্য ২০১৯ সালে প্রণীত আইএমওর নীতিমালা সম্পর্কে অবগত এবং এগুলো মেনেও চলছেন। তবে পিএসসি পরিদর্শন নীতিমালা সম্পর্কে যাতে সুস্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়, সেজন্য ক্রু সদস্য এমনকি স্থলের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষেরও অধিকতর প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।

সাধারণ সুপারিশসমূহ

জাহাজের জ্বালানি-সংক্রান্ত সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে তো ঢের হলো আলোচনা। এখন প্রশ্ন হলো এর সমাধান কী? উত্তর খুঁজতে চোখ রাখতে হবে নিচের সুপারিশসমূহে। সুপারিশগুলো কী, এবার তাহলে দেখে নেওয়া যাক।

  নিম্নমানের জ্বালানি কোনোভাবেই যাতে ব্যবহার না হয়, জাহাজ মালিক ও চার্টারার সবাইকেই এ বিষয়টিতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। সরবরাহকারী নির্বাচনের আগে জ্বালানি সরবরাহ শৃঙ্খলের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ আছে কিনা, বাজারে সুনাম কেমন, বিমা কাভারেজ আছে কিনা সেগুলো নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে।

  সরবরাহকৃত জ্বালানি মারপলের ষষ্ঠ সংযোজনের ১৪ ও ১৮ ধারার শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে জাহাজ মালিককে তাৎক্ষণিক তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে। এরপর আইএমওর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এ-সংক্রান্ত তথ্য আইএমও জিআইএসআইএস প্লাটফর্মে আপলোড করবে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বিভিন্ন ফ্ল্যাগ স্টেট এ-সম্পর্কিত ১৫২টি প্রতিবেদন আপলোডও করেছে। জাহাজ মালিক, ব্যবস্থাপক ও চার্টারারের জন্য এটা তথ্যের খুব ভালো একটা উৎস।

  বর্তমানে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে বিবাদের ক্ষেত্রগুলোর ওপর। জাহাজ মালিক ও চার্টারার উভয়েই উদ্ভূত চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে সামাল দেবে, সে দিকটায় মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে কমই। কিন্তু এমন অনেক ক্ষেত্রে আছে, পারস্পরিক লাভের জন্য যেগুলোতে তারা একে অপরকে সহযোগিতা করতে পারে। পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো হতে পারে বাংকার সাপ্লায়ারকে ভেটিং, জ্বালানির উপাদান সম্পর্কে আরো বেশি তথ্য সংগ্রহ, পরীক্ষার খরচ ভাগাভাগি এবং ব্যবহৃত জ্বালানির কার্যকারিতার তথ্য বিনিময়ের মধ্য দিয়ে। এমনটা হলে সব পক্ষের জন্যই তা আর্থিক ফল বয়ে আনবে।

ইনফোগ্রাফিক্স- ফেব্রুয়ারী, ২০২১

ফেব্রুয়ারী, ২০২১