Home Blog Page 241

চিপ লগ

পানিতে জাহাজের গতিবেগ মাপার অন্যতম প্রাচীন যন্ত্র চিপ লগ বা লগ। যন্ত্রটিকে অনেক সময় মেরিটাইম লগ নামেও ডাকা হয়। খ্রিস্টীয় সাল গণনার শুরুর দিকে এ কাজে একটি ছোট কাঠের টুকরা ব্যবহার করা হতো, যার এক প্রান্তে দড়ি বেঁধে চলন্ত জাহাজের একেবারে সম্মুখভাগ থেকে পানিতে ফেলা হতো। কত সময়ে জাহাজ কাঠের টুকরাকে স্পর্শ করছে, সেটি নির্ণয় করে ঘণ্টাপ্রতি জাহাজের গতিবেগ মাপা যেত। অবশ্যই এর পরিমাপ একেবারে নিখুঁত হতো না, তবে কাছাকাছি মান অন্তত পাওয়া যেত।

ষোল শতকের দিকে কেবল কাঠের টুকরা থেকে চিপ লগ তার সর্বশেষ রূপ পায়। গোলপাই আকারের একটি মসৃণ কাঠের চাকতির চারদিকে সিসার পাত দিয়ে মুড়ে দেওয়া হতো। ফলে টোয়িং ছাড়াই এটি সোজাভাবে ভেসে থাকতে পারত। সমান দৈর্ঘ্য পরপর বেশ কয়েকটি গিঁটযুক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে জাহাজের পেছনের অংশ থেকে লগটিকে পানিতে ফেলার পর কত সময়ের মধ্যে পুরো দড়িটি লগের টানে পানিতে চলে যাচ্ছে, একটি স্যান্ড গ্লাসের সাহায্যে সেটি মাপা হতো। লাইন আর লগ পানি থেকে তুলে দড়ি বা লাইনের দৈর্ঘ্যকে স্যান্ড গ্লাস থেকে প্রাপ্ত সময় দিয়ে ভাগ করলেই একেবারে নির্ভুলভাবে জাহাজের গতিবেগ পাওয়া যেত।

উনিশ শতকে এসে চিপ লগের বদলে টোওড রোটর বা প্রপেলারের সাথে সংযুক্ত স্বয়ংক্রিয় স্পিড অ্যান্ড ডিসটেন্স মেজারিং ইকুইপমেন্টের লাইনের মাধ্যমে জাহাজের গতি মাপা শুরু হয়। বর্তমানে পাইটোমিটার লগ এবং ইলেকট্রনিক লগ নামে দুই ধরনের লগ ব্যবহার করে গতিবেগ নির্ণয় করা হয়। সকল ধরনের লগই জাহাজের তলদেশে স্থাপিত হয়, যারা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে জাহাজের গতি মেপে ব্রিজের মনিটরে প্রদর্শন করে।

পরিবেশ

পরিবেশের সুরক্ষায় দীর্ঘদিনের রোডম্যাপ অনুযায়ী, আইএমও সালফার ক্যাপ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু হবে বলে কয়েক বছর ধরেই ২০২০ সালের দিকে তাকিয়ে ছিল শিপিং ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনা, আশা-দুর্ভাবনা ছাপিয়ে বছরের নায়ক হয়ে থেকেছে কেবল একটি ভাইরাস। ওদিকে মানুষের বিপর্যয়ের বছরে পরিবেশ আর প্রাণিকুল ফিরে পেয়েছে সতেজতা, কার্বন নিঃসরণ কমেছে লক্ষণীয় হারে। সবচেয়ে অন্ধকার সময়ের পেছনেই থাকে নতুন দিনের আলোর রেখা, একথা যেন আরো একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে মহামারি।

গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে প্রকৃতি

এক করোনা মহামারি পুরো পৃথিবীকে থামিয়ে দিলেও বছরটি প্রকৃতির গতিকে বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ। এ বছর প্রকৃতিতে এমনসব পরিবর্তন দেখা গেছে, যা ছিল পরিবেশবিদদের জন্য অনেকটা অকল্পনীয়। বছরের প্রথম তিন মাসেই পৃথিবীর আকাশে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ বিষাক্ত উপাদানের পরিমাণ কমে যেতে দেখেন বিজ্ঞানীরা। কার্বন নির্গমন কমানোর জন্য অনেক বছর ধরে বড় বড় পদক্ষেপ দেখা গেছে সারা বিশ্বে। কাজের কাজ তেমন একটা হয়নি। তবে করোনার কারণে এ বছর কার্বন নির্গমন রেকর্ড সংখ্যক কমে গেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের অ্যাংলিয়া বিশ^বিদ্যালয়ের এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, আগের বছরের চেয়ে এ বছর কার্বন নির্গমন ৭ শতাংশ কম হয়েছে। বছরের এপ্রিলে দৈনিক কার্বন নির্গমনের হার ছিল সবচেয়ে কম, ১৭ শতাংশ। উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায় বায়ুদূষণ। আগের চেয়ে অনেক বিশুদ্ধ বাতাস পাওয়া গেছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে। দূষিত পদার্থের উপস্থিতি কমে গেছে ইতালি ও দক্ষিণ কোরিয়ার বাতাসেও। লকডাউনের কারণে ইতালির বাসিন্দা ও বিশ্বের পর্যটকরা যখন ঘরবন্দি, পর্যটন শহর ভেনিস তার রূপ বদলাতে শুরু করে। ভেনিসের খালগুলোর পানি স্বচ্ছ হতে শুরু করে। ফিরে আসতে শুরু করে প্রাণিকুল। অনেক জায়গায় লোকালয়ে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় বন্যপ্রাণীদের। বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের পানিও ঘোলাটে থেকে নীল হয়ে যায়। সৈকতের অনেক কাছে ডলফিনদের খেলতে দেখা গেছে।

আইএমও সালফার ক্যাপ ২০২০

মনে আছে আইএমও ২০২০-এর কথা? তিন বছর ধরে শিপিং দুনিয়ার আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিল ২০২০ সালের প্রথম প্রহরে কার্যকর হতে যাওয়া জাহাজের জ্বালানি হিসেবে আইএমও নির্ধারিত মাত্রায় সালফার ফুয়েল নীতিমালা। ২০৫০ সালের মধ্যে শিপিং ইন্ডাস্ট্রি থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ বৈশ্বিকভাবে অন্তত ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনতে আইএমও মারপোল অ্যানেক্স সিক্স অনুযায়ী এ আইন করেছে শিপিং দুনিয়ার অভিভাবক প্রতিষ্ঠানটি। বন্দর, তেল উৎপাদনকারী ও শোধনাগার, মজুদ প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যস্ত ছিল প্রচলিত ৩.৫০ শতাংশ সালফারসমৃদ্ধ ফুয়েলের বদলে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ লো সালফার ফুয়েল শোধন, মজুদ ও বিতরণে। এর মধ্যেই করোনার থাবায় এলোমেলো হয়ে যায় ভেরি লো সালফার ফুয়েল অয়েল উৎপাদন ও বিতরণ। ফলে গতি হারিয়েছে জাহাজের ফুয়েল হিসেবে ভিএলএসএফও’তে পরিবর্তনের প্রক্রিয়া।

বিকল্প জ্বালানিতে আগ্রহ বেড়েছে

মহামারির অনেক আগে থেকেই নবায়নযোগ্য শক্তির চাহিদা বিশ্বব্যাপী বাড়ছিল। তবে মহামারির সময়ে পৃথিবর মানুষ সত্যিকার অর্থেই নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের প্রয়োজন অনুভব করে। বছর শেষে দেখা যায় এ ধরনের শক্তির উৎপাদনও বেড়েছে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি রিনিউএবলস ২০২০ ডিসেম্বর রিপোর্ট অনুযায়ী, এ বছর বিশ্বে নবায়নযোগ্য শক্তির সক্ষমতা ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। অথচ মে মাসে আগের রিপোর্টে তারা বলেছিল, মহামারির জন্য দেরিতে নির্মাণকাজ, লকডাউনসহ নানা কারণে গত ২০ বছরের মধ্যে এ বছর নবায়নযোগ্য শক্তির সক্ষমতা সবচেয়ে কম হবে। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে নির্মাণকাজ ও উৎপাদনের ব্যাপক বৃদ্ধির কারণে নবায়নযোগ্য শক্তির সক্ষমতা বেড়েছে। পেট্রোকেমিক্যালের পরিবর্তে বায়োফুয়েল, অ্যামোনিয়া নিয়ে গবেষণা বেড়েছে। ২৩ হাজার টিইইউ কনটেইনার ধারণক্ষম দৈত্যাকার এলএনজি জাহাজ জ্যাকুয়েস সাদের বাণিজ্যিক চলাচল শুরুর পাশাপাশি হাইড্রোজেনচালিত জাহাজ এনেছে সিএমএ সিজিএম। ১০০ এলএনজি ক্যারিয়ার নির্মাণের লক্ষ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার তিন শিপইয়ার্ডের সাথে ১৮.৭৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে কাতার পেট্রোলিয়াম।

অবশেষে ইইউ ইটিএসের অংশ হলো শিপিং

মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট ছিল একমাত্র সেক্টর, যেখানে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বন্ধে ইইউর সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা ছিল না। ইউরোপিয়ান কমিশনের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর এক বছর আগে এ নিয়ে কাজ শুরু করেন উরসুলা ভন ডার লেভেন। এরপর গত সেপ্টেম্বরে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে ভোটের মাধ্যমে শিপিং ইন্ডাস্ট্রি থেকে নিঃসৃত গ্রিনহাউস গ্যাস হ্রাস-সংক্রান্ত বিধিমালা পাস হওয়ায় শিপিং খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ইইউ এমিশন ট্রেডিং সিস্টেমে (এটিএস)। ২০২২ সালের সালের জানুয়ারি থেকে ইউরোপের পানিতে চলমান জাহাজে ইটিএসের বিধিমালা অনুযায়ী জাহাজে তদারকি শুরু করবে ইইউ, যাতে ২০৩০ নাগাদ শিপিং থেকে কার্বন নিঃসরণের হার অন্তত ৪০ শতাংশ কমানো সম্ভব হয়।

ওপেন লুপ স্ক্রাবার নিষিদ্ধ করেছে আরো দেশ

আইএমও নির্ধারিত ভিএলএসএফও ব্যবহারের বিকল্প হিসেবে ওপেন লুপ স্ক্রাবারের কথা বলা হলেও বহু দেশ তাতে আস্থা হারাচ্ছে। পরিবেশ দূষণের দায়ে ২২তম দেশ হিসেবে নিজেদের মেরিটাইম সীমানায় ওপেন-লুপ স্ক্রাবার থেকে ওয়াশ-ওয়াটার নির্গমন নিষিদ্ধ করেছে সৌদি আরব।

ডিকার্বনাইজেশনের নতুন প্রকল্প উদ্বোধন

এমপিএ সিঙ্গাপুরের সাথে যৌথভাবে ‘নেক্সটজেন’ উদ্যোগ চালুর ঘোষণা দিয়েছে আইএমও। মেরিটাইম খাতে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে ইকোসিস্টেমে ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য সদস্য দেশগুলোর সাথে একযোগে কাজ করবে এ ইনিশিয়েটিভ। সাথে যুক্ত থাকবে বিভিন্ন শিপিং প্রতিষ্ঠান, গবেষণা সংস্থা।

প্রযুক্তি

মানুষে মানুষে যোগাযোগের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু করোনাকালে মানুষ অনেক বেশি করে উপলব্ধি করেছে যে, যোগাযোগ ছাড়াও অনলাইনে অনেক কাজ খুব সহজে করা যায়। চাক্ষুস না দেখে দূর থেকে ভিডিও কলে রিমোট সার্ভে-ইন্সপেকশন, অনলাইনে মেরিটাইম শিক্ষা, ট্রেনিং, সেমিনার, সম্মেলন যে সম্ভব হতে পারে, ডিজিটাল টেকনোলজির কল্যাণে বছর দেখেছে শিপিং-বিশ্ব। ব্লকচেইন ব্যবহার করে ই-বিল অব ল্যাডিং, আর্থিক লেনদেন, স্মার্ট চুক্তিপত্র, এলসির ব্যবহার বেড়েছে। প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় ব্যয় আর সময়সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহ বেড়েছে বন্দর শিপিং কোম্পানিগুলোতে। প্রযুক্তির যে পরিবর্তন ধীরে ধীরে জায়গা করে নেওয়ার কথা ছিল, কোভিড-১৯ এক ধাক্কায় ডিজিটাইজেশনের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। মহামারি-উত্তর ‘নিউ নরমাল’ শিপিং বাণিজ্যে পেপারওয়ার্ক ব্যক্তিগত মোলাকাত কমাতে মুখ্য ভূমিকা রাখতে চলেছে প্রযুক্তি।

পরিবর্তনে, একসাথে

ই-বিল ব্যবহার করে স্মার্ট কনটেইনার প্রযুক্তির প্রসারে প্রথম শ্রেণির নয় কনটেইনার শিপিং কোম্পানি-এমএসসি, মায়েরস্ক, সিএমএ সিজিএম, হ্যাপাগ-লয়েড, ওশান নেটওয়ার্ক এক্সপ্রেস (ওয়ান), এভারগ্রিন, ইয়াং মিং, এইচএমএম এবং জেডআইএম (জিম) মিলে গড়ে তুলেছে নিরপেক্ষ, অলাভজনক সংস্থা ডিজিটাল কনটেইনার শিপিং অ্যাসোসিয়েশন (ডিসিএসএ)। আরেক উদ্যোগ, ট্রেডলেন্স ব্যবহার করে ব্লকচেইন-ভিত্তিক ডেটা প্লাটফর্মের পরিসীমা বাড়াতে এক ছাদের তলায় এসেছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশ্বের এই মুহূর্তে ভাসমান ওশান কনটেইনার কার্গোর প্রায় অর্ধেকের প্রতিটি ইউনিট সম্পর্কে বিস্তারিত ডেটা থাকছে ট্রেডলেন্স ডিজিটাল প্লাটফর্মে, যেখানে প্লাটফর্ম প্রোভাইডার হিসেবে ক্লাউড সেবা দিচ্ছে আইবিএম।

ডিজিটাল টুলসের ব্যবহার বেড়েছে

২০২০ সাল বুঝিয়ে দিয়েছে সশরীরে উপস্থিত না থেকেও সফলভাবে পরিদর্শন আর জরিপের কাজ করা সম্ভব। ডিএনভি জিএল, ব্যুরো ভেরিটাসের মতো ক্ল্যাসিফিকেশন সোসাইটি তাদের ইন্সপেকশন আর সার্ভের কাজ সেরেছে দূর-নিয়ন্ত্রিত স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে। অনলাইনে ভেসেল সার্ভের কাজ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করে সাপ্লাই চেইন নিরবচ্ছিন্ন রাখতে পোর্ট স্টেট কনট্রোল গাইডেন্স প্রকাশ করেছে ইউএস কোস্ট গার্ড। শিপিং সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে প্রশংসিত হয়েছে নাবিকদের সার্টিফিকেট অর্জন বা হালনাগাদ করতে ডিজিটাল সার্টিফিকেট প্রদানের উদ্যোগ। এ সময় সি ফেয়ারার সার্টিফিকেট কীভাবে দিতে হবে, এ ব্যাপারে নির্দেশনা প্রকাশ করেছে আইসিএস। সংক্রমণ এড়াতে জরুরি স্বাস্থ্যবিধি এবং অনবোর্ড অপারেশন-সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে নাবিকদের জন্য বিনামূল্যে ই-লার্নিং কোর্স চালু করেছে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএইচও)।

স্মার্ট ম্যাপ

ভাইরাস ছড়ানোর হার কতটা দ্রুত, কোন দেশ কতখানি আক্রান্ত সেটা বিস্তারিতভাবে অনুধাবন করা কখনই সম্ভব হতো না স্মার্ট ম্যাপিং সিস্টেম না থাকলে। এই রিপোর্ট লেখার সময় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১০ কোটির কিছু কম এবং মৃতের সংখ্যা ২১ লাখের কিছু বেশি দেখাচ্ছিল জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি নির্মিত ডিজিটাল ম্যাপ। আক্রান্ত ও মৃত-দুদিক থেকেই শীর্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নির্দিষ্ট ম্যাপ থাকায় কোন কোন দেশ বা নৌপথ এড়িয়ে যাওয়া উচিত, কোথায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল ও বাণিজ্য করা নিরাপদ, কোন বন্দর বা টার্মিনাল সচল আছে, কোনটি কবে খুলবে, অঞ্চলভিত্তিক কোয়ারেন্টিন বা লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে বিশ্বকে সচল রেখেছে এসব স্মার্ট প্যান্ডেমিক ম্যাপ।

থেমে থাকেনি সভা, সেমিনার, কর্মশালা, সম্মেলন

ব্যাপক আকারে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার প্রথম দিকেই পরিবর্তিত স্বাভাবিকে শিপিং ইন্ডাস্ট্রি ভার্চুয়াল আয়োজনের দিকে ঝুঁকে যায়। শারীরিক উপস্থিতিতে একে অপরের সাথে উষ্ণ সম্ভাষণ, সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে আলাপন ছাড়াই অনলাইনে চলেছে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর, বহুজাতিক সম্মেলন, আইএমওসহ শীর্ষ সব শিপিং সংস্থার সাধারণ সভা। এ সভা, সেমিনার, সম্মেলনে অংশ নিতে ব্যয় হতো বহু সময়, অর্থ। দিনের পর দিন কর্মস্থল, পরিবার থেকে দূরে থাকার বদলে এভাবে সম্মেলন করেও যে প্রায় একই প্রভাব রাখা সম্ভব, তা জানা গেল এ বছরই।

ওয়ার্ক ফ্রম হোম

সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মূল চাবিকাঠি হিসেবে পৃথিবীবাসী বেছে নিয়েছে বাসায় বসে অফিসের কাজ করা। ইন্টারনেটের ব্যাপকতা যে আসলে কতখানি সেটা বোঝা গেছে মহামারিতে। যদিও দীর্ঘদিনের সহকর্মী, চেনা কর্মপরিবেশ থেকে দূরে বসে কাজ করতে অস্বস্তি হলেও প্রায় সব সেক্টরের কাজই চলেছে অনলাইনে। হাবস্টাফ ব্লগচালিত জরিপ বলছে, ৮৪.৫ শতাংশ কোম্পানি করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ার পরও জরুরি প্রয়োজনে বাসায় থেকে কাজ চালিয়ে যেতে আগ্রহী। কিন্তু সেক্ষেত্রে ব্যক্তিগত কম্পিউটার ও নেটওয়ার্কে যথাযথ সাইবার নিরাপত্তার ব্যাপারটি প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায়।

তৎপর ছিল হ্যাকাররাও

শিপিং দুনিয়ার ‘বিগ ফোর’ সিএমএ সিজিএম, এপিএম-মায়ের্স্ক, এমএসসি এবং কসকো-সব কয়টি প্রতিষ্ঠান এ বছর সাইবার আক্রমণ ঠেকাতে ব্যস্ত ছিল। সিএমএ সিজিএমের লজিস্টিক বিভাগ দুদিন পুরোপুরি বন্ধ ছিল হ্যাকারদের কবলে পড়ে। এমএসসির কাস্টমার ফেসিং সিস্টেম ডাউন ছিল এক সপ্তাহ। অনলাইনে ব্যস্ততা বৃদ্ধির বছরে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাইবার হামলার কারণে। অক্টোবরে হামলা হয় জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান, নৌবাণিজ্যের নিয়ন্ত্রক সংস্থা খোদ আইএমওতে। কেবল জাহাজের অনবোর্ড নেটওয়ার্কে হামলা নয়, শোর-বেজড নেটওয়ার্ক ও আর্থিক লেনদেন-সংক্রান্ত তথ্যও নিরাপদ ছিল না হ্যাকারদের হাতে। অনলাইনে অপতৎপরতা ঠেকাতে শিপ অপারেটরদের জন্য সাইবার সিকিউরিটি গাইডলাইন ভার্সন ৪.০ প্রকাশ করেছে আইএমও, যা নতুন বছরের প্রথম দিন থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে। এ সংস্করণে আপডেটেড রিস্ক মডেল সংযুক্ত থাকায় নতুন ম্যালওয়্যার, ফিশিং মেইল, ভাইরাস, আইওটি-বেজড অ্যাটাক চিনতে সুবিধা হবে নাবিক-অপারেটর-শিপারদের।

নৌপরিবহন ২০২০ সংকট কাটিয়ে সম্ভাবনার দিকে

সাল ২০২০। জীবন, জীবিকা নিয়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কের বছর হিসেবে ইতিহাস মনে রাখবে বছরকে। সার্স কোভ-নামক পোশাকি নামধারী ৬০ থেকে ১৪০ ন্যানোমিটার ব্যাসের অতি এক ক্ষুদ্র ভাইরাস একাই ওলটপালট করে দিয়েছে চেনা দুনিয়া। যদিও করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কার এবং ব্যাপক উৎপাদন শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই এখনো থামেনি। মৃত্যুর মিছিলের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানুষ এমন সব বাস্তবতা দেখেছে, যা পালটে দিয়েছে শিল্প-বাণিজ্যের চেহারা। ওদিকে বায়ুম-লে বিষাক্ত উপাদান কমে যাওয়া, নাবিক অধিকারে বৈশ্বিক ঐক্য, নবায়নযোগ্য শক্তিতে রেকর্ড, ডিজিটাইজেশনসহ ইতিবাচক নানা ঘটনায় শিপিং বিশ্বকে নিয়ে নতুন করে ভাবনার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

নতুন মেরুকরণ হয়েছে অর্থনীতিতে

আঙ্কটাড প্রকাশিত ‘রিভিউ অব মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট ২০২০’ অনুযায়ী, ২০১৯ সালের দুর্বল অর্থনীতির পিঠে ২০২০ সালে শক্তিশালী বাণিজ্যের আশা করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। তবে সব পূর্বাভাস মিথ্যে করে ২০০৮-২০০৯ এর পর সর্বনিম্ন অংকে নেমেছে মেরিটাইম প্রবৃদ্ধি। শুধু কোভিড-১৯ নয়, আরো বেশকিছু কারণে বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি পালটে দিয়েছে ২০২০। ব্রাজিলের বাঁধে ভূমিধস এবং অস্ট্রেলিয়ার সাইক্লোন ভেরোনিকার কারণে ২০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো আকরিক লোহার মূল্য হ্রাস পেয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে অন্তত ১.৫ শতাংশ কম। যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে সমুদ্রপথে বিশ্বের বৃহত্তম শস্য রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ব্রাজিল। বন্দরকেন্দ্রিক উন্নয়ন ও শিপারদের সুবিধা দিতে হিন্টারল্যান্ড কানেক্টিভিটি উন্নয়নে জোর দিতে শুরু করেছে বন্দরগুলো। কার্গো ভলিউমের দিক থেকে জাহাজের মালিকানার শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে চীন, গ্রিস ও জাপান। টনেজ হিসাব করলে মোট বৈশ্বিক ফ্লিটের ৪০.৩ শতাংশ এই তিন দেশের দখলে রয়েছে। পতাকা বহনের দিক থেকে শীর্ষে আছে লাইবেরিয়া, মার্শাল আইল্যান্ড ও পানামা। ধারণক্ষমতার দিক থেকে ৪২ শতাংশ এবং ফ্লিটের মূল্যের দিক থেকে ৩৩.৬ শতাংশ আছে এই দেশগুলোর কাছে।

করোনার মধ্যেই প্রথমবারের মতো পানিতে ভেসেছে এখন পর্যন্ত বিশ্বের বৃহত্তম কনটেইনারবাহী জাহাজ এইচএমএম আলজেসিরাস। এইচএমএমের (হুন্দাই মার্চেন্ট মেরিন) ২০১৮ সালে কার্যাদেশ দেওয়া প্রতিটি ২৪ হাজার টিইইউ ধারণক্ষমতাসম্পন্ন মোট ১২টি আলট্রা লার্জ কনটেইনার শিপের সবগুলো অপারেশনে এসেছে এ বছর। এশিয়ার দেশগুলোর ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম নেপথ্য চরিত্র হয়ে দৈত্যাকার সব কয়টি জাহাজ চলাচল করছে ইউরোপ-এশিয়া রুটে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে নতুন ২৪,০০০+ টিইইউ ধারণক্ষমতার জাহাজ নির্মাণের কার্যাদেশ দিয়েছে হ্যাপাগ-লয়েড, ওশান নেটওয়ার্ক এক্সপ্রেস (ওয়ান)। সদ্যবিদায়ী বছরের শেষ ১৫ দিনে অন্তত ১৮টি মেগা আকৃতির জাহাজ নির্মাণের চুক্তি হওয়ায় গতি ফিরে পেয়েছে জাহাজ নির্মাণ খাত। ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের ডেটা বলছে, ২০২০ সালে ট্রেড মার্চেন্ডাইজিংয়ের বার্ষিক ভলিউম দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৯.২ শতাংশ কমার বিপরীতে বছর শেষে ৭.২ শতাংশ গতিতে উঠে আসছে।

আকাশ ছুঁয়েছে ফ্রেইট রেট

কোভিড-১৯ এর পাশাপাশি পৃথিবী ২০২০ সালকে মনে রাখবে ওশান ফ্রেইট রেটের অস্বাভাবিক উচ্চ হারের কারণেও। আকস্মিক লকডাউনের কারণে ভীত হয়ে ‘প্যানিক বায়িং’, জরুরি খাদ্য, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ বৃদ্ধিকে এর মূল কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে। ফলে এ বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে যত অস্বাভাবিক গতিতে নিচে নেমে ছিল, তার দ্বিগুণ গতিতে উঠে এসেছে ফ্রেইট রেট। চাহিদা-জোগানের ভারসাম্য রাখতে এশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপে পণ্যের চালানের সংখ্যা বহুগুণে বাড়িয়েছে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। এর ফলে মে থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে গ্লোবাল কনটেইনার রেটের সূচক ১০৬ শতাংশ উপরে উঠেছে। এমনকি এক মাসের মধ্যে চারবার বাড়ানো হয়েছে ফ্রেইট রেট। (সূত্র: দ্য এফবিএক্স গ্লোবাল কনটেইনার ইনডেক্স)।

ঊর্ধ্বমুখী চাহিদা এবং বাংকারের নিম্ন মুখী মূল্যের মধ্যে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে কনটেইনার ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠান। অপারেশনাল শিপিং থেকে এ বছর ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মুনাফা করেছে শীর্ষ শিপিং কোম্পানিগুলো, যা আগের বছরের চেয়ে অন্তত ১৬ শতাংশ বেশি। ব্যস্ত শিপিং রুটে, বিশেষ করে ট্রান্স-প্যাসিফিক নৌপথে জাহাজের সংখ্যা ও কনটেইনার ধারণক্ষমতা আরো বাড়িয়ে বাজারে ভারসাম্য বজায় ও ফ্রেইট রেটে লাগাম টানতে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে চীনের পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল মেরিটাইম কমিশন।

লাখো নাবিকের অনির্দিষ্ট যাত্রা

বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং শিপিংয়ের সূচকগুলোকে ওঠানামা করানো ছাড়া মেরিটাইম দুনিয়ায় কোভিড-১৯ সবচেয়ে মারাত্মক ও দীর্ঘমেয়াদি ধাক্কা দিয়েছে সি ফেয়ারারদের। মহামারির মধ্যেও বৈশ্বিক অর্থনীতিকে চালু রাখতে নিরন্তর অমানুষিক পরিশ্রম করে চলেছেন নাবিকেরা। ওদিকে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণজনিত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও চলাচলে সীমাবদ্ধতা আরোপের ফলে নাবিকরা জাহাজ থেকে না পারছেন নামতে, না পারছেন নিজ দেশে ফিরতে। আবার যারা ঘরে আটকা, তারাও অপেক্ষমাণ জাহাজে আরোহণের জন্য নিকটবর্তী বন্দরে যেতে প্রয়োজনীয় এন্ট্রি বা এক্সিট ভিসা সংগ্রহ করতে পারছেন না। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৯৬ হাজার বাণিজ্যিক সমুদ্রযানে কর্মরত প্রায় ১৮ লাখ নাবিকের এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি এখন আটকা পড়ে আছেন জাহাজ বা বাড়িতে। তীরে এসেও তরী থেকে নামতে পারছেন না অন্তত চার লাখ নাবিক। কোভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় বিমাতাসুলভ আচরণ করছে বন্দরগুলো। অনেক দেশই নাবিক পরিবর্তন নিষিদ্ধ করেছে, পুরো প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত কঠোর করে তুলেছে বাদবাকি রাষ্ট্রগুলো। নিয়ম অনুযায়ী, একজন নাবিকের টানা ১১ মাসের বেশি সাগরে কোনোভাবেই অবস্থান করার কথা না থাকলেও অনেকে ১৬ মাসেরও বেশি সময় ধরে ভেসে চলেছেন একটানা। অনেকে বিপজ্জনকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। এরকম অবসন্ন নাবিকদের নিয়ে জাহাজ চালানো হলে ক্যাপ্টেনদেরই ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হতে পারে। মাসের পর মাস সমুদ্রযাত্রার ধকল এবং বাড়ি ফিরতে না পারার মানসিক চাপ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে তাদের মধ্যে।

সমুদ্রগামী নাবিকদের অর্থনীতির ‘অপরিহার্য কর্মী’ স্বীকৃতি দিয়ে সমুদ্রযানে কাজে যোগদান বা সেখান থেকে ফেরার ক্ষেত্রে মুক্তভাবে চলাচলের সুযোগ দেয়ার জন্য আইএমওর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আইটিএফ। সদস্য দেশগুলোর বন্দরে নাবিক পরিবর্তনের জন্য ১২ স্তরের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে আইএমও। জুনে আন্তর্জাতিক নাবিক দিবসে ট্রেন্ডিং থেকে ভাইরাল হয়ে ওঠে সি ফেয়ারারস আর কি ওয়ার্কার্স হ্যাশট্যাগ। বর্তমানে ক্রু চেঞ্জ ক্রাইসিস অনেকটা লাঘব হয়েছে, চালু হয়েছে নাবিক বদলের দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর প্রক্রিয়া।

তেল নিয়ে তেলেসমাতি

সাপ্লাই চেইন চেকপয়েন্টে বৈদেশিক বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা, লকডাউনের ফলে ফুয়েলের চাহিদা অনেক কমে যাওয়ায় অয়েল বিজনেস গোত্তা খেলেও অয়েল ট্যাংকার ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টোটা। এর পেছনে মূলত দুটি বিষয় একসাথে কাজ করেছে-সৌদি আরব-রাশিয়া তেলযুদ্ধ এবং মহামারি নিজে।

আন্তর্জাতিক বাজারের প্রায় ৫০ শতাংশ দখলে রেখে অয়েল প্রডাকশন অ্যান্ড এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ (ওপেক)-এর নেতৃত্বে রয়েছে সৌদি আরব। নতুন সদস্য রাশিয়াসহ এর নাম হয়েছে এখন ওপেক প্লাস। মহামারির শুরুতে তেলের চাহিদা নাটকীয়ভাবে কমে যাওয়ায় সৌদি আরবসহ পুরনো সদস্যরা দৈনিক তেল উৎপাদন অন্তত ১.৫ মিলিয়ন ব্যারেল পর্যন্ত কমিয়ে ফেলতে একমত হয়। বিন্তু রাশিয়া সাফ জানিয়ে দেয় এ সিদ্ধান্ত তারা মানবে না। ওপেক প্লাস থেকে বেরিয়ে গিয়ে তারা উৎপাদন অব্যাহত রাখে এবং শুরু হয় কুখ্যাত ‘অয়েল মার্কেট ওয়ারফেয়ার’। সৌদি নেতৃত্বাধীন ওপেক দেশগুলো তেলের উত্তোলন ও উৎপাদন না কমিয়ে বরং বাড়িয়ে দেয়। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে আগে থেকেই কমতে থাকা চাহিদার বাজারে ঢুকতে থাকে বিপুল পরিমাণে পরিশোধিত ফুয়েল অয়েল। প্রতিদিন উদ্বৃত্ত হতে শুরু করে প্রায় ২০-৩৫ মিলিয়ন ব্যারেল তেল। শীর্ষ কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম মার্চে ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত পড়ে যায়। বিগত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ অবস্থানে এসে যায় বাজারে তেলের দাম। তেল মজুদের প্রতিটি স্থাপনা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় ট্যাংকারগুলোকেই ভাড়া নিয়ে ভাসমান অয়েল স্টোরেজ হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে আরামকো, এক্সন, শেভরন, বিপি অয়েলসহ বেশির ভাগ তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। মহামারির প্রথম তিন মাসে অন্তত ১.২ বিলিয়ন ব্যারেল তেল আক্ষরিক অর্থেই ভাসছিল সাগর-মহাসাগরে। ট্যাংকার চার্টার রেট দৈনিক ২৫-৩০ হাজার মার্কিন ডলার থেকে এক লাফে বৃদ্ধি পেয়ে পৌঁছে যায় ২ লাখ মার্কিন ডলারে!

বিধ্বস্ত বৈরুত

বন্দরের ওয়্যারহাউসে রক্ষিত সার কারখানার জন্য আমদানীকৃত ২ হাজার ৭০০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বিস্ফোরণের ফলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় লেবাননের রাজধানী বৈরুত বন্দর। তাৎক্ষণিকভাবে দুইশর বেশি নিহত, হাজার অযুত আহত এবং লক্ষাধিক স্থাপনা গুঁড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ধ্বংস হয়ে যায় দেশের বৃহত্তম শস্যাগারটিও। লেবাননে কর্মরত বাংলাদেশের পাঁচজন প্রবাসী নাগরিক নিহত এবং শতাধিক আহত হন, যার বেশির ভাগ ছিলেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদস্য। দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বৈরুত বন্দরের কাছে নোঙর করে থাকা জাতিসংঘ শান্তি মিশনের দায়িত্ব পালনরত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ বানৌজা বিজয়। হিরোশিমাকে মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলা পারমাণবিক বোমা ফ্যাট বয়ের বারো ভাগের এক ভাগ শক্তি নিয়ে ঘটা বিস্ফোরণে ৩.৩ মাত্রার ভূমিকম্পের শক্তি ছিল। এমনকি ২০০ কিলোমিটার দূরে ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত সাইপ্রাসও টের পায় এ বিস্ফোরণের ধাক্কা। একই ওয়্যারহাউসে কয়েক দিন আগে ৩০ থেকে ৪০ ব্যাগ আতশবাজি রাখা হয়েছিল। কোনো কারণবশত এতে আগুন ধরে গেলে প্রাথমিক বিস্ফোরণ ঘটে। অসতর্কতার মূল্য কত ভয়ানক হতে পারে, এ শিক্ষাই দিয়ে গেছে বৈরুত ট্র্যাজেডি।

রুদ্র ছিল প্রকৃতিও

ফেব্রুয়ারিতে ব্রাজিলের সাও লুইস উপকূলে মাত্র ৬০ সেকেন্ডের মধ্যে ডুবে যায় তিন লাখ ডেড ওয়েট টনের আকরিক লোহা পরিবহনকারী সুবিশাল জাহাজ স্টেলার ব্যানার। আধুনিক ভিএলওসিগুলোর (ভেরি লার্জ ওর ক্যারিয়ার) ডিজাইন এবং গঠনগত দুর্বলতা নিয়ে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়ে স্টেলার ব্যানার ডুবে যাওয়ার পর ধস নামে ব্রাজিলের লোহার খনি ব্যবসায়। রিস্ক ম্যানেজমেন্ট হিসেবে নিজেদের ২৫ কনভার্টেড ভিএলওসিকে অপারেশনাল কর্মকা- থেকে প্রত্যাহার করে নেয় মাইনিং কোম্পানি ভেল।

গত মে মাসে মেলবোর্ন থেকে চীন যাওয়ার পথে খারাপ আবহাওয়ার কবলে পড়ায় কনটেইনার জাহাজ এপিএল ইংল্যান্ড থেকে অন্তত ৫০টি কনটেইনার নিউ সাউথ ওয়েলসের সাগরে পড়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, জাহাজে সারিবদ্ধ কনটেইনারসমূহও জাহাজের খোলের ভেতরে এলোমেলোভাবে পড়ে যায়।

সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে জুলাইয়ে। আফ্রিকার মরিশাস উপকূলে ডুবে থাকা কোরাল রিফে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায় মিৎসুই ওএসকে লাইন পরিচালিত চীন থেকে ব্রাজিলগামী জাহাজ এমভি ওয়াকাশিও। জাহাজে থাকা প্রায় চার  হাজার টন ফুয়েল অয়েলের প্রায় সবটুকু মিশে যায় পর্যটন স্বর্গ হিসেবে পরিচিত দ্বীপদেশটিতে, সৃষ্টি হয় অকল্পনীয় মাত্রায় সমুদ্র দূষণ। অত্যন্ত সমৃদ্ধ সামুদ্রিক ও উপকূলীয় জীববৈচিত্র্যকে মারাত্মক হুমকিতে ফেলা ও অদক্ষ নেভিগেশনের দায়ে ৬০ বছরের কারাদ- দেওয়া হতে পারে ইতিমধ্যেই আটক ওয়াকাশিও’র ক্যাপ্টেনকে।

বছরের শেষে হাওয়াই উপকূল থেকে ১ হাজার ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূর দিয়ে চীনের ইয়ানতিয়ান বন্দর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের লং বিচ বন্দরে যাওয়ার সময় ওশান নেটয়ার্ক এক্সপ্রেসের (ওয়ান) ১৪ হাজার ৫২ টিইইউ জাহাজ দ্য ওয়ান অ্যাপাস থেকে আঠারোশর বেশি কনটেইনার খোলা সাগরে পড়ে যায়। প্রাথমিক কারণ হিসেবে তদন্তে মৌসুমি ঝড় এবং আকস্মিক জলোচ্ছ্বাসের ফলে সৃষ্ট প্রবল রোলিংকে দায়ী করা হয়েছে।

বাজারে টিকে থাকতে অধিগ্রহণ, একীভূত হওয়ার হার বেড়েছে

এপিএম-মায়েস্ক  , এমএসসি, কসকোর মতো শীর্ষস্থানীয় শিপিং সংস্থাগুলো নয়া প্রযুক্তি ও অনশোর কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রবণতা এ বছরও বজায় রেখেছে। ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্ববাহী আঞ্চলিক হাবগুলোতে ব্যবসার সুবিধার্থে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পোর্ট লজিস্টিকস, টার্মিনাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার গড়ে তুলছে প্রতিষ্ঠানগুলো। গত এপ্রিলে মার্কিন ওয়্যারহাউজিং অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি পারফরম্যান্স টিমকে অধিগ্রহণ করেছে মায়ের্স্ক। একই সময় সাংহাইভিত্তিক ওরিয়েন্ট ওভারসিজ কনটেইনার লাইন (ওওসিএল)-এর শতভাগ শেয়ার কিনে নিয়েছে চীনা শিপিং জায়ান্ট কসকো। ডেলফিন শিপিং এলএলসির নিয়ন্ত্রণাধীন উদ্যোগের সাথে যুক্ত হয়ে যৌথ অপারেশন শুরু করেছে বৃহৎ বাল্ক ক্যারিয়ার কো¤পানি স্টার বাল্ক। এছাড়াও বহু ছোট প্রতিষ্ঠান একে অপরের সাথে যুক্ত হয়েছে নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থে।

উপসংহার

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শুরুতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প খাতের তালিকায় প্রথম সারিতে ছিল শিপিং ও মেরিটাইম। কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে অতি দ্রুত ছন্দে ফিরতে শুরু করেছে নৌবাণিজ্য। আবার নতুন ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছে সার্স কোভ-২ এর অন্য একটি ভ্যারিয়েন্ট, যা প্রথম ঢেউয়ের চেয়েও মারণঘাতী, দ্রুত ছড়াতে সক্ষম। এ পরিস্থিতিতে চিকিৎসা সরঞ্জাম, নতুন আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন বিতরণ কাজে মুখ্য ভূমিকা রাখতে যাওয়া শিপিং খাত আগের বছরের চেয়ে ভালোভাবে কাটাতে পারবে নতুন বছর, এ আশা করাই যায়।

দেশের মেরিটাইম খাতকে এগিয়ে নিতে চট্টগ্রাম বন্দরের এই প্রকাশনার উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রশংসনীয়

প্রিয় পাঠক, নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে বন্দরবার্তা অতিক্রম করল সাফল্যমণ্ডিত  পাঁচ বছর। গত পাঁচ বছরে বাংলা ভাষায় মেরিটাইম চর্চায় একক ও অনন্য ভূমিকায় অবতীর্ণ রয়েছে বন্দরবার্তা। পাঁচ বছর ধরে নিয়মিত বন্দরবার্তার প্রকাশ এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রমই বটে। মেরিটাইম সেক্টর ও বন্দরের অংশীজনদের সার্বিক কর্মকা-, ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সব উদ্ভাবনী কৌশল-পরিকল্পনা ও উত্তম চর্চাগুলো বস্তুনিষ্ঠতার সাথে তুলে আনছে বন্দরবার্তা। দেশের মেরিটাইম খাতকে এগিয়ে নিতে চট্টগ্রাম বন্দরের এই প্রকাশনার উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা নিঃসন্দেহে গর্বের। এই শুভক্ষণে বন্দরবার্তা পরিবারের সকলকে জানাই অভিনন্দন।

নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে আরো একটি নতুন বছরে পা দিল বিশ্ব। ২০২০ সালটি বিশ্বের জন্য মোটেও সুখকর ছিল না। করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিহত করতে দেশে দেশে প্রায় একযোগে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। গ্রেট লকডাউন নামেই অভিহিত হয় এই অভূতপূর্ব ঘটনা। এর ফলে স্থবির হয়ে পড়ে মানুষের কর্ম-চাঞ্চল্য, বিশ্ববাণিজ্য-পাল্টে গিয়েছে বিশ্ব অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি। লকডাউন ঘোষণা করা হয় বাংলাদেশেও। তবে ব্যতিক্রম ছিল সমুদ্রবন্দরসমূহ বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দর। ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম আর প্রয়োজনীয় পণ্যে সরবরাহ অব্যাহত রাখতে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও জীবনের ঝুঁকি নিয়েও বন্দর সচল রেখেছেন এর নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা। একই সাথে থেমে থাকেনি বন্দরবার্তাও। এই কঠিন সময়েও আমাদের চেষ্টা ছিল বন্দর ব্যবহারকারী থেকে শুরু করে মেরিটাইম-সংশ্লিষ্ট সবাইকে হালনাগাদ তথ্য সম্পর্কে অবগত করা। আগামীতেও বন্দরবার্তা এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে-ষষ্ঠ বছরে পদার্পণের শুভক্ষণে এটাই আমাদের ব্রত।

ঠিক এই সময়ে বিরাট এক রূপান্তরের মুখে দাঁড়িয়ে বৈশ্বিক নৌপরিবহন শিল্প। বছরজুড়েই করোনাভাইরাস নিয়ে অনিশ্চয়তা আর আতঙ্ক ছিল নৌপরিবহন শিল্পে। যদিও নৌপরিবহন শিল্পে নানা পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে শুরু হয়েছিল ২০২০ সাল। বেশকিছু বিধি এবং নীতিমালাতেও পরিবর্তন আসে বছরটিতে। আইএমও ঘোষিত বহু আকাক্সিক্ষত সালফার ক্যাপ ২০২০ কার্যকরী হয় বছরের প্রথম দিন থেকেই। একই সাথে সোলাস, মারপোল অ্যানেক্স এবং কিছু কোডের ক্ষেত্রেও বেশকিছু সংশোধনী কার্যকর হয়েছে। সন্দেহ নেই এসব সংশোধনী মেরিটাইম খাতকে আরো পরিবেশবান্ধব ও কল্যাণমুখী করবে এবং বৈশ্বিক নৌবাণিজ্যের ঝুঁকিগুলো কমিয়ে এনে এই শিল্প খাতকে আরো নিরাপদ করে তুলবে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে বিশ^ ২০২০-কে মনে রাখবে করোনাভাইরাসের কারণে। আঙ্কটাড প্রকাশিত ‘রিভিউ অব মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট ২০২০’ অনুযায়ী, ২০১৯ সালের দুর্বল অর্থনীতির পিঠে ২০২০ সালে শক্তিশালী বাণিজ্যের আশা করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু করোনায় বদলে গেছে সব পূর্বাভাস-২০০৮-০৯ এর পর সর্বনিম্ন অংকে নেমেছে মেরিটাইম প্রবৃদ্ধি। তবে শুধু কোভিড-১৯ নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভূরাজনীতি, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে অধিগ্রহণ-একীভূতকরণের মতো আরো বেশকিছু কারণেও ২০২০ সালে বদলে গেছে বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি। তারপরও থেমে থাকেনি, হতাশা পেছনে ফেলে আরো টেকসই শিল্প খাতে পরিণত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সেই প্রচেষ্টার ফলেই বছরের শেষ প্রান্তে এসে করোনাভাইরাসের ধাক্কা সামলে ওঠার লক্ষণ দেখা গেছে মেরিটাইম-সংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে।

এই প্রতিকূল সময়েও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে দীর্ঘমেয়াদের বেশকিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্রতী রয়েছে সরকার। করোনায় সাময়িকভাবে ব্যাহত হলেও, বন্দর ও এর হিন্টারল্যান্ড কেন্দ্রিক অবকাঠামো এবং পতেঙ্গা টার্মিনাল ও মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণ প্রক্রিয়া এগিয়ে গেছে দ্রুতগতিতে। ক্রমোন্নয়নের ধারায় লয়েড’স লিস্টের সেরা কনটেইনার বন্দরের তালিকায় এ বছর ৫৮তম স্থানে জায়গা করে নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর।

প্রিয় পাঠক, আমাদের মেরিটাইম চর্চা সমৃদ্ধ হোক আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে। নতুন বছরে বন্দরবার্তার পক্ষ থেকে সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা পাঁচ বছরের পথপরিক্রমায় সাথে থাকার জন্য।

দ্য জিওগ্রাফি অব ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমস

পরিবহন ব্যবস্থা, বিশেষ করে যাত্রী ও পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে নৌপরিবহন শিল্প পৃথিবীর ভৌগোলিক দিকগুলোর সাথে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িত। সাদা চোখে যতটুকু দেখা যায়, ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমে ভূরাজনৈতিক প্রভাব তার চেয়ে অনেক বেশি। এরই বিস্তারিত রূপ উঠে এসেছে নতুন করে পরিমার্জিত দ্য জিওগ্রাফি অব ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমস বইতে। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষক জঁ-পল রদ্রিগ সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণে নৌপরিবহন ব্যবস্থার ধারণা, পদ্ধতি, আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থার স্পেইশাল প্ল্যানিং এবং তার প্রয়োগ-সংক্রান্ত দিক উঠে এসেছে।

উত্তর আমেরিকা বা ইউরোপের সাথে পূর্র্ব এশিয়ার মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম যেমন মেলে না, মধ্যপ্রাচ্যের পরিবহন ব্যবস্থাও দক্ষিণ আমেরিকার তুলনায় অনেকটা ভিন্ন। এসব মাথায় রেখে দশ অধ্যায়ে বিভক্ত বইয়ের প্রতিটি অংশে কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর কয়েকটি করে নিবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সাপ্লাই চেইনের অবিচ্ছেদ্য বিভিন্ন অংশ যেমন নেটওয়ার্ক, মোড, টার্মিনাল, ফ্রেইট ট্রান্সপোর্ট, আরবান ট্রান্সপোর্ট, সর্বজনমান্য কিছু মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট নীতিমালা, ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানিং, পলিসি, পরিবেশের ওপর ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমের প্রভাবের মতো উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো উঠে এসেছে একেক অধ্যায়ে। শুধু আলোচনাই নয়, এ সংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্য-উপাত্তও সংযোজিত হয়েছে ১৪০টি ছবি, ফিগার, ম্যাপ, ছকে সাজানো চতুর্থ সংস্করণে। নীরস ছক আর গ্রাফ শুধু নয়, প্রচুর ইনফোগ্রাফিকও ব্যবহার করা হয়েছে বইটিতে।

রাউটলেজ থেকে ২০২০ সালে প্রকাশিত দ্য জিওগ্রাফি অব ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমসের পঞ্চম সংস্করণটির সাথে মিলিয়ে একটি সঙ্গী ওয়েবসাইটও প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করা হয়। পাঠ শেষে বইয়ের ওপর মেরিটাইম বিশেষজ্ঞ, গবেষক, পাঠকদের মতামত বা বুক রিভিউ প্রকাশের সুযোগ রয়েছে সেখানে।

বিস্তারিত জানা যাবে এখানে- https://transportgeography.org/ 

৪৮০ পৃষ্ঠা এবং ১৪০টি সাদা-কালো ইলাস্ট্রেশনসহ পেপারব্যাক বইয়ের দাম রাখা হয়েছে ৩৯.১৯ পাউন্ড, হার্ডকভারের মূল্য ৯৬ পাউন্ড। বইটির ই-বুক সংস্করণ পাওয়া যাবে ৩৯.১৯ পাউন্ডে।

আইএসবিএন ১৩: ৯৭৮-০৩৬৭৩৬৪৬৩২

তাইচাং বন্দর

সেই তৃতীয় শতক থেকে নাবিকদের কাছে লিউজিয়াগ্যাং বন্দর নামে পরিচিত হলেও নব্বইয়ের দশকে এসে চীনের জিয়াংশু প্রদেশের ব্যস্ততম বন্দরটির নতুন নামকরণ হয় তাইচাং। নানটং বন্দর থেকে ৩৩ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণ-পূব এবং সাংহাই বন্দর থেকে উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত তাইচাং ইয়াংজি নদীব্যবস্থার অন্তর্গত বন্দর। উর্বর নদী মোহনার তীরে হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে মূলত কৃষিপণ্যের আমদানি-রপ্তানি করেছে তাইচাং। দিগন্ত বিস্তৃত কৃষিজমির কারণে নাম রাখা হয়েছিল তাইচাং, মান্ডারিন চাইনিজ ভাষায় যার অর্থ ‘সবুজ প্রকৃতি’। চাল, তেলবীজ, তুলা, গবাদিপশু এবং মৎস্যসম্পদ ছিল এখানকার প্রধান রপ্তানি পণ্য। সময়ের পালাবদলে প্রথমে শিল্পায়ন এবং পরবর্তীতে বিশ্বায়নের প্রভাবে ‘স্টেট ফার্স্ট ক্লাস পোর্ট অ্যান্ড কনটেইনার ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট’ মর্যাদা পাওয়া বন্দরটি বর্তমানে চীনের অন্যতম প্রধান বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্র।

সাংহাই ইন্টারন্যাশনাল শিপিং সেন্টারের উত্তর বাহু হিসেবে ট্রাংক লাইন কনটেইনার পোর্ট হয়ে কাজ করছে তাইচাং বন্দর। ইয়াংজি নদীর তীর বরাবর ৩৮.৮ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা অত্যাধুনিক গভীর ড্রাফটের বার্থসংবলিত বন্দরটির স্থিতিশীল শোরলাইন থাকায় কনটেইনার ট্রান্সশিপমেন্ট হাব পোর্ট হিসেবে বিশে^ অন্যতম আদর্শ অবস্থানে আছে। সর্বশেষ প্রকাশিত ২০২০ সালের ব্যস্ততম শত বন্দরের লয়েড’স তালিকায় এ বন্দরের অবস্থান ৩০তম। ১৯৯১ সালে গঠিত তাইচাং ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট জোন গঠনের পর অটোমোবাইল, মেশিনারি এবং ইলেকট্রনিকের মতো ভারী শিল্পে প্রচুর জার্মান বিনিয়োগ আসতে থাকে। উপযুক্ত সরকারি সহায়তা এবং নিরবচ্ছিন্ন সাপ্লাই চেইনের কল্যাণে অন্যান্য দেশের বৃহৎ শিপিং কোম্পানিগুলোও এখানে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। মূলত এ সময় থেকেই তাইচাং বন্দরের আধুনিকায়নের যাত্রা শুরু।

মূলত কনটেইনার বন্দর হলেও ড্রাই বাল্ক কার্গো এবং পেট্রোকেমিক্যাল পণ্যও হ্যান্ডল করে তাইচাং। মোট ৪৮টি বার্থ আছে এখানে, যার মধ্যে ২৪টিতে ১০ হাজার ডিডব্লিউটি ধারণক্ষমতার জাহাজ ভিড়তে পারে। বছরে ৭৬ মিলিয়ন টন কার্গো এবং ২.৩৫ মিলিয়ন টিইইউ কনটেইনারবাহী কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের সুবিধা আছে এখানে। মোট ২ হাজার ৮০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ১০টি কনটেইনার বার্থে ১২৫ হেক্টর কনটেইনার ইয়ার্ড, ৭.৫ হেক্টর বন্ডেড ওয়্যারহাউস এবং ২.৫ হেক্টর রপ্তানিমুখী পণ্যের ওয়্যারহাউসে ১৬টি কনটেইনার ক্রেন এবং ৪৭টি গ্যান্ট্রি ক্রেনের সাহায্যে বছরে মোট ৪.৩৫ মিলিয়ন টিইইউ কনটেইনার ওঠা-নামা করানো হয়। বন্দরে অ্যাপ্রোচ চ্যানেলে নেভিগেশনযোগ্য গভীরতা যেকোনো সময় অন্তত ১২.৫ মিটার হওয়ায় ৭০ হাজার ডিডব্লিউটি পর্যন্ত বাল্ক ভেসেল এবং চতুর্থ প্রজন্মের কনটেইনার জাহাজ প্রবেশ করতে সক্ষম। জোয়ারের সময় এ সক্ষমতা বেড়ে ২ লাখ ডিডব্লিউটি বাল্ক ক্যারিয়ার এবং পঞ্চম ও ষষ্ঠ প্রজন্মের কনটেইনার জাহাজে পৌঁছায়। মাসে গড়ে ৯০০টির কিছু বেশি কনটেইনার জাহাজ আসে তাইচাং বন্দরে।

২১টি বার্থ থেকে বাল্ক জাহাজকে সেবা দেওয়া হয় তাইচাংয়ে। যার মধ্যে আছে উগ্যাং আকরিক টার্মিনাল, জিউলং পেপার ব্রেক বাল্ক টার্মিনাল, ওয়ানফ্যাং ব্রেক বাল্ক টার্মিনাল, হুয়ানেং পাওয়ার প্লান্ট কোল টার্মিনাল এবং পরিবেশবান্ধব পাওয়ার প্লান্ট কোল টার্মিনাল। মোট ৪ কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘ্যরে বার্থগুলোতে বার্ষিক প্রায় ৭১ মিলিয়ন টন বাল্ক পণ্য হ্যান্ডল করা হচ্ছে।

পোর্ট অব তাইচাংয়ের পেট্রোকেমিক্যাল ডকগুলোর অপারেটর সংস্থা হলো মোবিল (চীনা), চ্যাংজিয়াং এবং ইয়ানহং পেট্রোকেমিক্যালস। মোট ১ হাজার ৩৫৪ মিটার বার্থে ৭.০৫ মিলিয়ন টন পেট্রোকেমিক্যাল দ্রব্য লোড-আনলোড করা যায়। সংরক্ষণ ট্যাংকের মোট ধারণক্ষমতা ৮ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার।

অন্তত পাঁচটি সমুদ্রগামী কনটেইনার শিপিং লাইন, ১৯টি অভ্যন্তরীণ কনটেইনার লাইন এবং ইয়াংজি নদী দিয়ে চলাচলকারী ৪৫টি ফিডার সার্ভিস কোম্পানির হোম পোর্ট তাইচাং। তাইওয়ান, কোরিয়া এবং জাপানের সাথে চারটি শর্ট-রেঞ্জ সার্ভিসও পরিচালিত হয় এখান থেকে।

সংবাদ সংক্ষেপ – জানুয়ারী

দক্ষিণ আটলান্টিকে ভাঙছে বৃহত্তম হিমবাহ 

সাউথ আটলান্টিক আইল্যান্ডে রুটিন টহল চলাকালীন সময় বিশ্বের বৃহত্তম আইসবার্গে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করে ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্স। প্রথমে আরএএফ এয়ারবাস ৪০০এম ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্র্যাফট ব্যবহার করে এবং পরে সম্প্রতি তোলা স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, এ৬৮এ নামক আইসবার্গটির উত্তর অংশে অন্তত ৫৫ বর্গমাইল আয়তনের বরফখ- ভেঙে বেশ কয়েকটি ছোট অংশে পরিণত হয়েছে। মূল হিমবাহটি সাউথ জর্জিয়ার ৩০ নটিক্যাল মাইল দূর দিয়ে স্রোতের টানে ভেসে চলেছে।    

ধীরে-সুস্থে বিডব্লিউএমএস ইনস্টলেশন বাঁচাবে ব্যয় জায়গা

২০২৪ সালের মধ্যে সমুদ্রগামী সকল জাহাজের জন্য ব্যালাস্ট ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (বিডব্লিউএমএস) ইনস্টলেশন  বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। জাহাজের জন্য প্রয়োজনীয় বিডব্লিউএমএস  কেনার আগে খরচ কমানো এবং টেকসই ইনস্টলেশনের উদ্দেশ্যে কিছু গাইডলাইন দিয়ে নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক বিডব্লিউএমএস প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান টেকক্রস। তাদের মতে, সঠিক বিডব্লিউএমএস বেছে নেওয়ার প্রথম শর্ত হলো, একে অবশ্যই পরিবেশ সুরক্ষা সম্পর্কিত সকল বিধিমালা মেনে চলার উপযোগী হতে হবে। এতে ক্রয়, মেরামত এবং সংরক্ষণ ব্যয়ও কমবে।      

নিজস্ব শিপিং জোট গঠনের পরিকল্পনা দক্ষিণ কোরিয়ার

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চলাচলকারী নিজেদের পাঁচ শিপিং কোম্পানিকে নিয়ে বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্রীয় শিপিং অ্যালায়েন্স গঠনের ঘোষণা দিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। এসএম মার্চেন্ট মেরিন, এইচএমএম, জ্যাংগিউম মার্চেন্ট মেরিন, প্যান ওশান এবং হিউংয়ে লাইন মিলে কোরিয়ায় আমদানি-রপ্তানি হওয়া পণ্যের অর্ধেক আনা-নেওয়া করে। দেশটির পরিবহন মন্ত্রণালয় ঘোষিত এ জোট গঠিত হলে অপারেশনাল ব্যয় হ্রাস করার মাধ্যমে অন্য দেশের সাথে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধিতে এক ধাপ এগিয়ে যাবে কোরিয়া।। 

ইইউ শিপ রিসাইক্লিং পদ্ধতির গলদ নির্ণয়ের চেষ্টায় বিমকো

যদিও ইইউ অনুমোদনপ্রাপ্ত পরিবেশবান্ধব উপায়ে রিসাইক্লিং ইয়ার্ডের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু বৃহৎ আকারের বাণিজ্যিক জাহাজের ক্ষেত্রে এসব ইয়ার্ডের কার্যক্ষমতা এখনো সন্তোষজনক নয়। জাহাজ মালিক, এজেন্ট, ব্রোকারদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বিমকোর মতে, ইইউ নির্ধারিত নীতিমালা মেনে গোটা ইউরোপে পানাম্যাক্স আকারের জাহাজ রিসাইক্লিং করার ক্ষমতা রাখে কেবল তুরস্ক। ফলে ইউরোপীয় জাহাজ মালিকদের সামনে জাহাজের অন্তিম সময়ে পতাকা পরিবর্তন করে ইউরোপের বাইরে পাঠানো ছাড়া অন্য উপায় থাকে না। আবার দক্ষিণ এশিয়ায় রিসাইক্লিংয়ে বেশি অর্থ পাওয়া যায় বলে ইউরোপীয় মালিকেরা এখানে শিপব্রেকিংয়ে অধিকতর আগ্রহী।

দেশের পশ্চিমে স্থলবন্দর নির্মাণ করবে নেপাল

পরিকল্পনা অনুযায়ী এ ইনল্যান্ড টার্মিনাল নির্মাণ করা গেলে ভারতের সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দর মুম্বাইয়ের জেএনপিটির সাথে যোগাযোগ সহজ হবে। দেশের পশ্চিম সীমান্ত-সংলগ্ন নেপালের কাঞ্চনপুর জেলার দোধারা চান্দানিতে নির্মিতব্য এ স্থলবন্দর থেকে মুম্বাইয়ের আরব সাগর উপকূল সবচেয়ে কাছে। ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে জেএনপিটিকে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যেই প্রাথমিক সম্মতি দিয়েছে ভারত। মুম্বাই থেকে রেল সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে দুই বন্দরকে যুক্ত করা হবে এবং তাতে নেপালের মূল সমুদ্রবন্দর হিসেবে কলকাতার ওপর চাপ কমবে। পাশাপাশি দোধারা-চান্দানি-বানবাসা এলাকায় আন্তঃদেশীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার সম্ভাব্যতা যাচাই করবে নেপাল। 

ধর্মঘটে পিছিয়ে গেল শস্যবাহী ১৪০ জাহাজের লোডিং 

নতুন বেতনস্কেলে চুক্তির দাবিতে পোর্ট-সাইড তেলবীজ শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটের কারণে ১৪০টির বেশি জাহাজে শস্যবোঝাইয়ের কাজ পিছিয়ে গেছে আর্জেন্টিনায়। দেশটিতে সম্প্রতি চলমান অস্বাভাবিক মুদ্রাস্ফীতির কারণে ক্ষতিপূরণের দাবিতে তেলবীজ শ্রমিকদের দুই প্রধান ইউনিয়নকে সাথে নিয়ে আর্জেন্টাইন সরকারের সাথে আলোচনায় বসতে যাচ্ছেন সয়া বাইপ্রডাক্ট ম্যানুফ্যাকচারাররা। আসছে আগস্টের মধ্যে এক লাফে ২৫ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন শ্রমিকরা। কোষাগারে বৈদেশিক মুদ্রার অভাব থাকায় সরকারের এ বেতন বৃদ্ধি অন্তত তিন দফায় করার প্রস্তাব দিয়েছে।

কনটেইনার টার্মিনাল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিচ্ছে জেএনপিটি

কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন দেশের বৃহত্তম বন্দরের কনটেইনার টার্মিনালকে প্রাইভেটাইজেশনের উদ্দেশ্যে প্রস্তাবনা পাস করেছে জওহরলাল নেহরু পোর্ট ট্রাস্টের পরিচালনা পর্ষদ। বোর্ডসভায় ছয়জন সদস্যের প্রত্যেকেই পক্ষে ভোট দিলেও দুই শ্রমিক নেতা এর বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। প্রায় ৮০০ কোটি রুপির পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) ভিত্তিতে বেসরকারি খাতে কনটেইনার পরিচালনার প্রস্তাবনাটি অনুমোদনের জন্য পাঠানো হচ্ছে দেশের পোর্টস, শিপিং অ্যান্ড ওয়াটারওয়েজ মিনিস্ট্রিতে। দিন দিন কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ কমতে থাকার প্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নিল জেএনপিটি পোর্ট ট্রাস্ট।

বসন্ত পর্যন্ত থমকে থাকবে নৌপর্যটন

নিয়মিত কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা বর্ধিত করায় ক্রুজ ইন্ডাস্ট্রিতে অনিশ্চয়তার মেঘ সহসা কাটছে না। কোভিড-১৯ টিকা দান শুরু হওয়ায় অচলাবস্থা কাটিয়ে সদ্যবিদায়ী বছরের শেষে হয়তো স্বাভাবিক হবে নৌপর্যটন খাত; সংশ্লিষ্টদের আশাভঙ্গ করে বেশির ভাগ দেশ আগামী বসন্তকাল তথা মধ্য-মার্চ পর্যন্ত কার্যক্রম স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নরওয়ের পর সর্বশেষ দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক ভ্রমণ ও নৌপর্যটনে কড়াকড়ি আগামী তিন মাস পর্যন্ত বাড়িয়েছে অস্ট্রেলিয়া।

স্বয়ংক্রিয় জাহাজ বহর নির্মাণ করবে রাশিয়া

অভ্যন্তরীণ কার্গো ও প্যাসেঞ্জার জাহাজে অটোনোমাস নেভিগেশন সিস্টেম ইনস্টলে মোরসপেটসার্ভিস এবং সিএনার্জি শিপিং কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ রাশিয়ান প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ক্রনশট্যাড টেকনোলজিস যৌথভাবে স্বয়ংক্রিয় জাহাজের বাণিজ্যিক বহর গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে রাশিয়ার পতাকাবাহী অন্তত ১০০ অটোনোমাস ভেসেল নির্মাণের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে দশ শাখালিন কার্গো-প্যাসেঞ্জার ভেসেল এবং শাখালিনেট মাল্টিপারপাস হাই-স্পিড ক্যাটামারান নিয়ে কাজ করবে মোরসপেটসার্ভিস, যার প্রথম দুই অটোনোমাস শিপ এমএসএস পাইওনিয়ার এবং এমএসএস অ্যাভানগার্ডে ২০২১ সাল স্বয়ংক্রিয় নেভিগেশন সিস্টেম ইনস্টল করা হবে।   

নিজেদের নির্মিত আফরাম্যাক্স ট্যাংকার আনল ইরান

আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে নিজ দেশে জাহাজ নির্মাণ প্রযুক্তি বিকাশের ঘোষণা দেওয়ার দুই বছর পর দেশে নির্মিত মাঝারি আকৃতির ট্যাংকার নির্মাণকাজ প্রায় শেষ করে এনেছে ইরান। অজ্ঞাতনামা বিদেশি ক্রেতার জন্য নির্মীয়মাণ ৮২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে এবং ১ লাখ ১২ হাজার ডেড ওয়েট টনের ট্যাংকারটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ছবি প্রকাশ করেছে দেশটির বার্তা সংস্থাগুলো। পারস্য উপসাগরের বুশেহর উপকূলে ইসলামিক রেভোলিউশন গার্ডস কর্পস পরিচালিত সাদরা কোম্পানি নির্মাণ করছে এটি। ২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিক নাগাদ আফরাম্যাক্স ট্যাংকারটি ক্রেতার হাতে পৌঁছানোর কথা রয়েছে।  

ডিজিটাইজেশনে দরকার ব্যয় হ্রাস এবং পরিচালনে দক্ষতা

২০২০ সালের মে মাসে ইনমারস্যাট এবং লয়েড’স লিস্ট কর্তৃক যৌথভাবে পরিচালিত এক জরিপ বলছে, শিপিং ইন্ডাস্ট্রিতে ডিজিটাইজেশনের মূল চাবিকাঠি হলো ব্যয় সাশ্রয় এবং অপারেশনাল দক্ষতা বৃদ্ধি (৭১ শতাংশ ভোটদাতার মতে)। ৬০ শতাংশ বলেছে শক্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থার কথা। এবিবি, ব্যুরো ভেরিটাস, জিটুওশেন এবং হেমপেলে কর্মরত নৌবাণিজ্যে জড়িত ব্যক্তিদের কাছে টেকনোলজি ট্রান্সফার-বিষয়ক মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল। নুন রিপোর্টের মতো ম্যানুয়েল পদ্ধতি ব্যবহার করে ভেসেলের রিয়েল-টাইম ডেটা প্রাপ্তির প্রয়োজনীয়তাও উঠে এসেছে রিপোর্টে।

শিপ রিসাইক্লিংয়ে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিচ্ছে চীন

২০১৮ সালের শেষ নাগাদ নিজেদের উপকূলে বিদেশি জাহাজ রিসাইক্লিং নিষিদ্ধ করার পর থেকেই এ নিয়ম তুলে নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক চাপে আছে বেইজিং। নিষেধাজ্ঞার ফলে চীনা ইয়ার্ডগুলো ব্যবসা হারালেও ভারত ও বাংলাদেশের শিপব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোর ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে। আগের চেয়ে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে জাহাজ ভাঙার শর্তে রিসাইক্লিং ব্যান তুলে নেওয়া হলে দূষণের দায়ে অভিযুক্ত দক্ষিণ এশিয়ার বাদবাকি ইয়ার্ডগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দূষণ নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত দক্ষ চীনের দেখানো পথে হাঁটবে, আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা।

সংবাদ সংকেত – জানুয়ারী

২০২৩-২৪ এর মধ্যে প্রতিটি ২৪ হাজার টিইইউর বেশি ধারণক্ষমতার মোট ছয়টি জাহাজ নির্মাণের জন্য শিপ লিজিং প্রতিষ্ঠান ইমাবারি শিপবিল্ডিংয়ের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে ওশান নেটওয়ার্ক এক্সপ্রেস (ওয়ান)। নির্মাণ শেষে এগুলো হবে বিশ্বের  বৃহত্তম কনটেইনার জাহাজ।

দায়িত্বে অবহেলার দায়ে বৈরুত বিস্ফোরণের ঘটনায় লেবাননের তৎকালীন এবং বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব এবং তাঁর মন্ত্রিসভার আরো চার সদস্যের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়েছে।

২০২১ সালের মধ্যে শিপিং ইন্ডাস্ট্রি থেকে সিঙ্গেল-ইউজ প্লাস্টিক নির্মূলের উদ্দেশ্যে নীতিমালা ও রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে ইউকে চেম্বার অব শিপিং। 

২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এশিয়া-ইউরোপ নৌপথে ভাড়া বৃদ্ধি করতে যাচ্ছে এমএসসি। ইতিমধ্যেই শ্রীলংকা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত, পাকিস্তান থেকে অ্যান্টুয়ার্প ও ভ্যালেন্সিয়া বন্দরগামী পণ্যের সংশোধিত ভাড়ার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।

আফ্রিকার বৃহত্তম প্রকল্প হিসেবে সেনেগালে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে নতুন গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তুলবে ডিপি ওয়ার্ল্ড। ১ হাজার ৫০০ একর স্থাপনায় ৭০০ একরজুড়ে কনটেইনার টার্মিনালের পাশাপাশি থাকবে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল।

লা হাভরে থেকে রাশিয়া ও ফিনল্যান্ডে সরাসরি সাপ্তাহিক শর্টসি সার্ভিস চালু করল কসকো। ফলে ফ্রান্স থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গ ও কোটকাতে ৪-৫ দিনেই পণ্য আনা-নেওয়া করা যাবে।

৫ মিলিয়ন টন ভেরি লো সালফার ফুয়েল অয়েল রপ্তানির জন্য একটি বেসরকারি পরিশোধনাগারের পাশাপাশি দেশীয় পাঁচ কোম্পানিকে অনুমোদন দিয়েছে চীন।

অস্ট্রেলিয়ার নিষেধাজ্ঞার পরও মে মাস থেকে অপেক্ষমাণ কয়লাবাহী কার্গো জাহাজকে বন্দরে ভেড়ার অনুমতি দিল চীন। ২০১৮ সালে হুয়াওয়েকে অস্ট্রেলিয়ার ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার সুযোগ বঞ্চিতের পর থেকে দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছেছে।

দক্ষিণ এশিয়ার দুই বৃহত্তম জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হুন্দাই হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ এবং দায়ু  শিপবিল্ডিং অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং একীভূত হয়ে যাওয়ার প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছে চীনা নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউয়ের ফলে কলম্বো বন্দরে ট্রান্সশিপমেন্ট ভলিউম নভেম্বরে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ কমেছে; যা গত বছরের এ সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৩ শতাংশ কম। 

দায়ু শিপবিল্ডিংকে প্রতিটি ২৩ হাজার ৫০০ টিইইউ ধারণক্ষমতার ছয়টি আলট্রা লার্জ জাহাজ নির্মাণের জন্য ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কার্যাদেশ দিয়েছে হ্যাপাগ-লয়েড।

ব্রিটিশ উইন্ড ফার্মে ডেনমার্ক ট্যাক্স অথরিটির বসানো ১ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কর প্রদানের বিরুদ্ধে ড্যানিশ ট্যাক্স আপিল এজেন্সিতে অভিযোগ করবে বিশে^র বৃহত্তম অফশোর বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ওরস্টেড।

এসএমএসে অন্তর্ভুক্ত হলো সাইবার নিরাপত্তা

মেরিটাইম শিল্পের জন্য সাইবার নিরাপত্তা এখন অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে আন্তর্জাতিক মেরিটাইম সংস্থা (আইএমও) জাহাজের সেফটি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে (এসএমএস) সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে ২০২১ সাল জাহাজ পরিচালনাকারীদের জন্য এক নতুন যুগের সূচনা করেছে।

শিপিং শিল্পে সাইবার ঝুঁকির হুমকি বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি আইএমও খাতসংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোকে মেরিটাইম সেফটি কমিটির (এমএসসি) রেজল্যুশন এমএসসি.৪২৮(৯৮) গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সম্ভাব্য সাইবার ঝুঁকি শনাক্তের অনুরোধ জানিয়েছে। ওই রেজল্যুশন অনুযায়ী, শিপ অপারেটরদের নিশ্চিত করতে হবে যে, তাদের বিদ্যমান এসএমএস যথাযথভাবে সাইবার নিরাপত্তার ঝুঁকি মোকাবিলা করতে সক্ষম। ঝুঁকিগুলোর মধ্যে রয়েছে ম্যালওয়্যার আক্রমণ, এনক্রিপ্টেড হুমকি, ক্রিপ্টো জ্যাকিং, সার্ভার বা সিস্টেমে অনুপ্রবেশের চেষ্টা, র‌্যানসমওয়্যার আক্রমণ এবং আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস) ম্যালওয়্যার।

সাইবার ঝুঁকি মোকাবিলায় আইএমও একগুচ্ছ নির্দেশনা প্রদান করেছে, যেখানে মেরিটাইম খাতে ঝুঁকিগুলো শনাক্তের পাশাপাশি সেগুলো মোকাবিলা বা ব্যবস্থাপনায় বিস্তারিত সুপারিশমালা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এসব সুপারিশ বিদ্যমান এসএমএস ম্যানুয়ালে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার লক্ষ্য শিপিং খাতের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সহায়তা করা।

জাহাজের যেসব সিস্টেমে সাইবার হামলার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্রিজ সিস্টেমস, কার্গো হ্যান্ডলিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমস, প্রপাালশন অ্যান্ড মেশিনারি ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড পাওয়ার কন্ট্রোল সিস্টেমস, অ্যাকসেস কন্ট্রোল সিস্টেমস, প্যাসেঞ্জার সার্ভিসিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমস, প্যাসেঞ্জার ফেসিং পাবলিক নেটওয়ার্কস, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যান্ড ক্রু ওয়েলফেয়ার সিস্টেমস এবং কমিউনিকেশন সিস্টেমস।

সাইবার ঝুঁকি সম্পর্কে আইএমওর এ গাইডলাইন সংশ্লিষ্ট অন্য নীতিমালাগুলোর আলোকে একটি উপযুক্ত সাইবার ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কৌশলপত্র প্রণয়নে সহায়তা করবে বলে শিল্পসংশ্লিষ্টরা অভিমত প্রকাশ করেছেন।