Home Blog Page 247

ইরান সংশ্লিষ্টতায় মার্কিন কালো তালিকায় চীনা প্রতিষ্ঠান

ইরানের শিপিং কোম্পানি ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান শিপিংকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর কাজে সহযোগিতার অভিযোগে দুই চীনা নাগরিক এবং ছয় চীনা প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কোম্পানি ছয়টি হচ্ছে রিচ হোল্ডিং গ্রুপ, রিচ শিপিং লাইনস, ডিলাইট শিপিং, গ্রেসিয়াস শিপিং, নোবল শিপিং এবং সুপ্রিম শিপিং কোম্পানি। এছাড়া দুই ব্যক্তির মধ্যে রয়েছে রিচ হোল্ডিং গ্রুপের প্রধান নির্বাহী এরিক চেন এবং প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল ওয়াই। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এক বিবৃতিতে বলেন, বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন অংশীজনকে আমরা সতর্ক করে বলতে চাই, যদি কেউ ইরানের শিপিং কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসায় জড়ায়, তাহলে তারা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। এর পরপরই তিনি ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।

সিফেরার ক্রাইসিস অ্যাকশন টিম গঠন আইএমওর

করোনাভাইরাসের কারণে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও বন্দরসংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিধিনিষেধের কারণে মেরিটাইম খাতে নাবিক বদলের বিষয়টি এক মহাসংকট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। চলমান সংকট থেকে উত্তরণে আন্তর্জাতিক মেরিটাইম সংস্থা (আইএমও) গঠন করেছে সিফেরার ক্রাইসিস অ্যাকশন টিম (এসসিএটি)।

মহামারির কারণে সৃষ্ট বেশকিছু জটিল পরিস্থিতির কারণে নাবিকদের একটি বড় অংশ এবং তাদের স্বজনরা উদ্বেগ জানিয়েছে আইএমওর হস্তক্ষেপ কামনা করে। নাবিক বদলের এ সংকট কাটিয়ে উঠতে সংস্থাটি গঠন করেছে এসসিএটি। গঠিত দলটির মূল লক্ষ্য উদ্ভূত পরিস্থিতির সমাধান খুঁজতে বিভিন্ন দেশের সরকারি প্রতিনিধি, এনজিও, ট্রেড ইউনিয়ন বা সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর জন্য যোগাযোগ রক্ষা বা উপযুক্ত সংস্থাগুলোর সঙ্গে নাবিকদের পরিচিত করে তোলা।

এসসিএটি কীভাবে নাবিকদের সহায়তা করতে পারে তার উদাহরণ হিসেবে আইএমও চলতি বছরের ১০ মে সংঘটিত এক ঘটনার কথা উল্লেখ করেছে। একটি অফশোর সাপোর্ট ভেসেলে অবস্থানরত শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত এক নাবিক আইএমওর সঙ্গে যোগাযোগ করে। ওই নাবিকসহ তার অনেক সহকর্মী কোনো বিরতি ছাড়াই অফশোরে ১০০ দিনের বেশি কাটায়। মালিকপক্ষ তাদের কর্মচুক্তি আরো দুই মাসের জন্য বাড়াতে পারে-এ সম্ভাবনায় ওই নাবিক খুবই উদ্বিগ্ন হয়েই আইএমওর দ্বারস্থ হয়। আইএমও ওই বার্তাটি সংশ্লিষ্ট এনজিওর নজরে আনে এবং জাহাজটি যে দেশে নিবন্ধিত, সেই দেশের মেরিটাইম ও বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে। আইএমওর হস্তক্ষেপের কারণেই সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো ওই জাহাজে নাবিক বদলের বিষয়টি নিশ্চিত করে এবং তাকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়।

২০৫০ নাগাদ গ্রিন পাওয়ার আকৃষ্ট করবে ১১ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ

নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদন ব্যয় কমার কারণে পরিবেশবান্ধব শক্তিতে আগামী দশকগুলোয় বিনিয়োগ ১১ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। ব্লুমবার্গএনইএফ (বিএনইএফ) তাদের বার্ষিক ‘নিউ এনার্জি আউটলুক’ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। আগামীর জ্বালানি মিশ্রণে জীবাশ্ম জ্বালানিকে সস্তা নবায়নযোগ্য জ্বালানি কীভাবে হটিয়ে দেবে তারই ইঙ্গিত মিলেছে এ প্রতিবেদনে।

বিশাল অংকের এ বিনিয়োগ পূর্বাভাস সত্ত্বেও বিএনইএফ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, চলতি শতক শেষে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে নতুন নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের গতি আরো বাড়ানোর প্রয়োজন হবে। নবায়নযোগ্য শক্তি এবং ব্যাটারি প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ সর্বোচ্চে পৌঁছাবে ২০২৭ সালে। আর পরের বছরগুলো থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত নিঃসরণ হার বছরে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ হারে কমতে থাকবে। আর এ সময়ের মধ্যে বৈশ্বিক বিদ্যুতে সৌর ও বায়ুবিদ্যুতের অবদান দাঁড়াবে ৫৬ শতাংশ।

বিএনইএফের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জন মুর নতুন প্রতিবেদন প্রসঙ্গে বলেন, ‘জ্বালানি রূপান্তরের ক্ষেত্রে আগামী ১০ বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনে গতিবৃদ্ধি, ইলেকট্রিক ভেহিকলে ভোক্তাদের আগ্রহ এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসন্ন বছরগুলোয় জীবাশ্ম জ্বালানিগুলোর মধ্যে কেবল গ্যাসেরই চাহিদা বাড়বে। ভারী শিল্পের পাশাপাশি ভবন উষ্ণ রাখতে এর ব্যবহার বাড়বে। এছাড়া ইলেকট্রিক ভেহিকলের চাহিদার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে তেলের চাহিদার ভাগ্য। ২০৩৫ সালে তেলের চাহিদা সর্বোচ্চে পৌঁছবে এবং তার পর থেকে ধীরে ধীরে কমতে থাকবে। ২০৫০ নাগাদ প্যাসেঞ্জার-ভেহিকল কিলোমিটারের ৬৫ শতাংশ ইলেকট্রিক ভেহিকলের মাধ্যমে পূরণ হবে। ইলেকট্রিক ভেহিকলের বিদ্যমান বহর দিনে ১০ লাখ ব্যারেল তেলের চাহিদা হ্রাস করছে।

নতুন জাহাজের বৈশ্বিক চাহিদা এখন তলানিতে

বিশ^ব্যাপী নতুন জাহাজ নির্মাণাদেশ ৩০ বছরের সর্বনিম্ন এসে ঠেকেছে। ডেনমার্কের মেরিটাইম শিল্পের স্বার্থসুরক্ষাকারী সংগঠন ড্যানিশ শিপিংয়ের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮৯ সালের পর চলতি বছর সবচেয়ে কম নতুন জাহাজ নির্মাণের কার্যাদেশ পাওয়া গেছে।

বাজার অনিশ্চয়তা এবং করোনাভাইরাসের কারণে চাহিদায় ঘাটতি নতুন জাহাজ নির্মাণাদেশ কমার কারণ বলে জানিয়েছে সংগঠনটি। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডেড ওয়েট টনেজে পরিমাপকৃত বিদ্যমান বৈশ্বিক বহরের অনুপাতে নতুন জাহাজের নির্মাণাদেশ কমেছে ৭ শতাংশ, যা ১৯৮৯ সালের পর সর্বনিম্ন। আর ২০১৫ সালের পর নতুন জাহাজ নির্মাণাদেশের সংখ্যা কমেছে ৪১ শতাংশ। ড্যানিশ শিপিংয়ের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, গত বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছর নতুন কনটেইনার, ট্যাংকার বা ড্রাই কার্গো ভেসেল নির্মাণের আগ্রহ এখন প্রায় তলানিতে।

চলতি শতকের শুরুতে জাহাজ নির্মাণে জোরালো প্রবৃদ্ধি দেখা যায়। তবে নির্মাণাদেশ সর্বোচ্চে পৌঁছে ২০০৯ সালে। ওই বছর নতুন কার্যাদেশ আসে বৈশ্বিক বিদ্যমান বহরের প্রায় ৫২ শতাংশ। পরের বছরগুলোয় নির্মাণাদেশে কিছুটা স্লথতা দেখা দেয়, যদিও ২০১৪ সালে তা সামান্য বাড়ে।

ড্যানিশ শিপিং কোম্পানিগুলো চলতি বছর সেই একই প্রবণতা অনুসরণ করছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় চলতি বছরের অক্টোবরে নতুন জাহাজের কার্যাদেশ কমেছে ৪৫ শতাংশ। বর্তমানে ৫১টি ভেসেল নির্মাণের কার্যাদেশ রয়েছে, যার মোট ওজন মাত্র ১৫ লাখ টন। ড্যানিশ শিপিং জানিয়েছে, নতুন জাহাজ নির্মাণাদেশে অনাগ্রহ করোনাভাইরাস মোকাবিলার প্রচেষ্টাকে তুলে ধরেছে। চাহিদা কমায় শিপিং কোম্পানিগুলো কিছুটা রক্ষা পাচ্ছে। কারণ বহরের আকার কমার অর্থ হচ্ছে ভাড়ার হার বৃদ্ধি।

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প নিয়ে পূর্ব ইউরোপে সন্দেহ ঘনীভূত

পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের (সিইই) সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে ২০১২ সালে গঠিত হয় ১৭+ উদ্যোগ। দেশটির বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের সম্প্রসারণ হিসেবে একে দেখা হলেও ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে এটা নিয়ে আগ্রহের পাশাপাশি ছিল দ্বিধা ও সন্দেহ। গঠনের প্রায় এক দশকেও চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে সেই বিভ্রান্তির অবসান হয়নি, বরং বেড়েছে বহুগুণ।

মূলত তিনটি কারণে চীন সম্পর্কে ইউরোপীয়দের দ্বিধা এখনো কাটেনি। প্রথমত, ১৭+ সম্মেলনগুলোয় চীনের জোরালো প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সিইই দেশগুলোয় দেশটির বিনিয়োগ হয়েছে সামান্যই। অবকাঠামো, প্রযুক্তি ও নবায়নযোগ্য শক্তিতে চীনের ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ এখনো প্রতিশ্রুতিই রয়ে গেছে। ১৭+ উদ্যোগের অধীনে নেওয়া ৪০টির মতো প্রকল্পের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে মাত্র চারটি।

দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ সিইই দেশ এখন চীনের ওপর অতি নির্ভরশীলতার রাজনৈতিক ফল নতুন করে মূল্যায়ন করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন শুরু থেকেই চীনের এ উদ্যোগকে মহাদেশটিকে বিভক্ত করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখে আসছে। সেই অবিশ্বাসের মধ্যে চেক, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড ও স্লোভাকিয়া নিয়ে গঠিত ভাইজগ্রাদ গ্রুপকে চীন আলাদা শক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করলে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়। কারণ অভিবাসন এবং মানবাধিকার নিয়ে ব্রাসেলসের সঙ্গে দেশগুলোর মতানৈক্য রয়েছে।

তৃতীয়ত, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান উত্তেজনা অধিকাংশ সিইই দেশকে আরো সতর্ক করে তুলেছে। কারণ এতে তাদের অন্য মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে। ফাইভজি নিয়ে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে হুয়াওয়ে বিতর্ক ক্রোয়েশিয়া, চেক, এস্তোনিয়া, রোমানিয়া, সার্বিয়া ও স্লোভেনিয়াকে সাবধান করেছে। 

সামগ্রিক পরিস্থিতিতে চীনের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সিইই দেশগুলোর মধ্যে আস্থার ঘাটতি তৈরি করেছে, যা ১৭+ উদ্যোগের সমাপ্তি ঘটাতে পারে।

আন্তর্জাতিক সীমানায় বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ

প্রাক-কথন

বাংলা তথা এই অঞ্চলের সমুদ্রগামী জাহাজ শিল্পের গতি-প্রকৃতি বুঝতে হলে আমাদের ফিরতে হবে দূর অতীতে। চোখ রাখতে হবে প্রাচীন ভারতে। পার্সিয়ান ইতিহাসবিদ হামজা আল ইস্পাহানি সেই পঞ্চম শতকেই যখন ফোরাত নদীতে ভারতীয় জাহাজকে নোঙর ফেলতে দেখেছিলেন। সমুদ্রগামী এইসব জাহাজ চলত সিন্ধু ও গুজরাটের ধনাঢ্য বণিকদের তত্ত্বাবধানে।

অভিযাত্রী মার্কো পোলো তেরো শতকে ভারত দর্শনে এসে এই অঞ্চলের জাহাজের নির্মাণশৈলী দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। মার্কো পোলোর বয়ানে, একেকটি বড় জাহাজে থাকত ১০টি করে ছোট নৌকা-আজকের দিনে লাইফবোটের মতো অনেকটা। রেইন ডেকের নিচে আবার সুসজ্জিত ৬০টির মতো কেবিন। অন্যান্য ইউরোপীয় পরিব্রাজকের বয়ানেও এই অঞ্চলের জাহাজ শিল্পের সোনালি অধ্যায় বিবৃত হয়েছে। ইতালিয়ান বণিক নিকোলো দ্য কন্তি তো বলেইছিলেন, ভারতীয় জাহাজগুলো আমাদের চেয়েও বড়।

সমুদ্রগামী জাহাজ শিল্পে ভারতীয় উপমহাদেশ তথা এই অঞ্চলের কর্তৃত্ব ১৭ শতক পর্যন্তও জারি ছিল। কিন্তু পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজ উদ্দৌলা ও মহিসুর যুদ্ধে টিপু সুলতানের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে দৃশ্যপট বদলাতে থাকে। সমুদ্রপথে বাণিজ্য বাড়তে থাকলেও এতে স্থানীয়দের কর্তৃত্ব হাতছাড়া হতে থাকে। বলতে গেলে, সমুদ্রগামী জাহাজ শিল্পের পুরোধারা একে একে দৃশ্যের বাইরে চলে যান। ব্রিটিশ নাবিক ছাড়া কোনো ভারতীয় জাহাজ যাতে লন্ডন বন্দরে প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যবস্থাও সেরে ফেলা হয় একসময়।

এসবের মধ্য দিয়েই এই অঞ্চলের স্থানীয় জাহাজ শিল্পকে মেরে ফেলার একটা চেষ্টা চলে। কিন্তু প্রকৃতিগত কারণেই এখানকার জাহাজ শিল্প একেবারে না হারিয়ে টিকে থাকে জাহাজ খুইয়ে, সংখ্যালঘু হয়ে। সেই সময়ের পরিসংখ্যানে চোখ রাখলেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে। ১৮৩৬ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্তও ভারতে নিবন্ধিত জাহাজ পরিচালনাকারী কোম্পানি ছিল ৮০টির মতো। ১৯৪৬ সালে এসে কোম্পানির সংখ্যা নেমে আসে মাত্র সাতটিতে। তাও আবার ছোট পরিসরে।

ভারত ভাগের পর পূর্ব বাংলায় বেসরকারি খাতের সমুদ্রগামী জাহাজ কোম্পানি বলতে ছিল কেবল পাকিস্তান স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি। এ কে খান প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রামভিত্তিক কোম্পানিটির বহরে ছিল দুটি সমুদ্রগামী জাহাজ-ফতেহাবাদ ও জাহাঙ্গীরাবাদ। ১৯৬৯ সালের পর সেগুলো বন্ধ হয়ে যায়। পাকিস্তান ন্যাশনাল শিপিং কর্পোরেশন অধীনে যে কয়েকটি জাহাজ ছিল, মুক্তিযুদ্ধের পর সেগুলোও ফিরিয়ে নিয়ে যায় পাকিস্তান সরকার। ফলে স্বাধীনতার পর সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই কার্যত জাহাজশূন্য হয়ে পড়ে বাংলাদেশ।

পুনর্গঠন পর্ব

সমুদ্র আছে, সমুদ্র বন্দর আছে অথচ সমুদ্রগামী জাহাজ নেই। সদ্য স্বাধীন দেশের সামনে এটাই ছিল তখনকার বাস্তবতা। কিন্তু বহির্বিশ্বের সাথে খাদ্যদ্রব্য, জ্বালানি, ভোজ্যতেল, চা, চামড়া ও রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি-রপ্তানি তথা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নতুন করে শুরু করতে আন্তর্জাতিক রুটে জাহাজ পরিচালনার বিকল্প ছিল না। এছাড়া সমুদ্র তীরবর্তী নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বেশির ভাগ পণ্যই পরিবাহিত হতো সমুদ্রপথে। এই বাস্তবতার নিরিখে ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতির আদেশবলে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি)। প্রতিষ্ঠান তো হলো কিন্তু জাহাজ? এবার মনোযোগ দেওয়া হয় জাহাজ সংগ্রহে। প্রতিষ্ঠার পাঁচ মাসের মাথায় বহরে প্রথম জাহাজের দেখা পায় বিএসসি। এরপর একে একে আরো জাহাজ যুক্ত হতে থাকে বহরে। একসময় বিএসসির বহরে জাহাজের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৮টিতে।

ব্যক্তিখাত খুলে দেওয়ার পর বেসরকারি বিনিয়োগকারীরাও আগ্রহী হয়ে ওঠে খাতটিতে। সত্তরের দশকের শেষ ভাগে দেশে আসে সমুদ্রগামী প্রথম জাহাজ। আরো পরের দিকে এসে এ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ গতি পায়। নতুন নতুন কোম্পানি খাতটিতে নাম লেখাতে থাকে। বাড়তে থাকে জাহাজের সংখ্যা। স্বাধীনতার পাঁচ দশকে এসে এখন বলাই যায়, শিপিং জাতি হয়ে ওঠার পথেই আছে বাংলাদেশ। সরকারি-বেসরকারি মিলে ৬২টি সমুদ্রগামী জাহাজ এখন পণ্য পরিবহন করছে সুনীল সাগরে।

সরকারি খাতের সোনালি অধ্যায়

স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন পাকিস্তান ন্যাশনাল শিপিং কর্পোরেশনের (এনএসসি) সবগুলো জাহাজ সরিয়ে নেওয়া হয় বাংলাদেশ থেকে। স্বাধীনতার পর এগুলো আর ফিরে আসেনি। ফলে একেবারে শূন্য হাতে নতুন করে শুরু করতে হয় সদ্য স্বাধীন দেশের সরকারকে। বহরে নিজস্ব জাহাজ না থাকায় প্রতিষ্ঠার পর প্রথম দিকে আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলকারী জাহাজের এজেন্সি হিসেবে কাজ শুরু করে বিএসসি। বহরে প্রথম জাহাজ হিসেবে যুক্ত হয় ‘বাংলার দূত’ নামে ১২ হাজার ৮১২ ডিডব্লিউটি সক্ষমতার একটি জাহাজ। তাও প্রতিষ্ঠার পাঁচ মাস পর। এর কাছাকাছি সময়ে যুক্ত হয় ‘বাংলার সম্পদ’ নামে আরো একটি জাহাজ। এরপর একে একে বহরে জাহাজের সংখ্যা বাড়াতে থাকে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বিএসসি। ১০ বছরের ব্যবধানে ১৯৮২ সালে বিএসসির বহরে জাহাজের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭টিতে। ১৯৯১ সালে এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৩৮টিতে। এটা ছিল বিএসসির ইতিহাসে বর্ণিল সোনালি অধ্যায়ের পরের অধ্যায় একেবারে অন্যরকম-বিবর্ণ ও ধূসর।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচেষ্টায় ১৯৭২ সালের ১০ জুন স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদশেে বিএসসি বহরে সংযোজিত হয় জাতীয় পতাকাবাহী প্রথম জাহাজ ‘বাংলার দূত’

ঘুরে দাঁড়ানোর পালা

১৯৯১ সালের পর দীর্ঘদিন বিএসসির বহরে নতুন কোনো জাহাজ যুক্ত হয়নি। ওদিকে বহরে থাকা জাহাজগুলোও ক্রমে আয়ুষ্কাল খুইয়ে সক্ষমতা হারাতে থাকে। ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে আসতে থাকে বিএসসির জাহাজের বহর। ২০১২-১৩ অর্থবছরে জাহাজের সংখ্যা ১৩টিতে নেমে আসে। অলাভজনক হওয়ায় পরের অর্থবছর পাঁচটি জাহাজ বিক্রি করে দেয় বিএসসি। কমতে কমতে ২০১৮ সালে বহরে জাহাজের সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র দুটিতে।

তবে বর্তমান সরকার বিএসসিকে আবার গতিশীল করার উদ্যোগ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রায় ১ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ে চীন থেকে ছয়টি জাহাজ সংগ্রহ করেছে বিএসসি। সংগৃহীত জাহাজগুলোর মধ্যে তিনটি প্রডাক্ট ট্যাংকার ও তিনটি বাল্ক ক্যারিয়ার। জাহাজগুলো সমুদ্রপথে কার্যক্রম শুরুও করেছে। দুটি ট্যাংকারসহ বিএসসির বহরে সমুদ্রগামী জাহাজ রয়েছে বর্তমানে আটটি।

পরিকল্পনায় আরো জাহাজ

বিএসসির দৃষ্টি এখন আরো দূরে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নেতৃস্থানীয় শিপিং কোম্পানিতে উন্নীত হতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। সে লক্ষ্য সামনে রেখে বহর শক্তিশালী করতে আগামীতে আরো কিছু জাহাজ ক্রয়ের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ৮০ হাজার টনের দুটি মাদার বাল্ক ক্যারিয়ার ও ১০ থেকে ১৫ হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন ১০টি বাল্ক ক্যারিয়ার ক্রয় প্রকল্প এর মধ্যে অন্যতম। এর বাইরে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ক্রুড অয়েল পরিবহনের জন্য প্রতিটি এক লাখ টন থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি মাদার ট্যাংকার ক্রয়ের পরিকল্পনাও রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের আমদানি করা ডিজেল ও জেট ফুয়েল যাতে পরিবহন করা যায়, সেজন্য কেনা হচ্ছে ৮০ হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি মাদার প্রডাক্ট অয়েল ট্যাংকার।

দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটাতে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। আমদানি করা এই এলএনজি যাতে নিজস্ব জাহাজে পরিবহন করা যায়, সেজন্য প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটারের দুটি, প্রায় ১ লাখ ৭৪ হাজার ঘনমিটারের দুটি এবং প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার ঘনমিটারের আরো দুটি এলএনজি ভেসেল বিএসসির বহরে যুক্ত করার প্রাথমিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

শ্রীলংকাসহ বিমসটেকের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ফিডার সার্ভিস চালুর বিষয়ে আলোচনা চলছে। এটি বিবেচনায় নিয়ে প্রতিটি ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টিইইউ ধারণক্ষমতার চারটি নতুন সেলুলার কনটেইনার জাহাজ ক্রয়ের আরো একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। সেলুলার কনটেইনার জাহাজগুলো ডেনমার্ক সরকারের সহায়তায় নির্মিত হবে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানিতে উন্নীত হবে।

বেসরকারি খাতের পত্তন

স্বাধীনতা-পূর্ব পূর্ব পাকিস্তানেও সমুদ্রগামী জাহাজ শিল্পে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ সে অর্থে খুব একটা ছিল না। চট্টগ্রামভিত্তিক এ খাতের একমাত্র প্রতিষ্ঠান ছিল এ কে খান প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় ছিল ফতেহাবাদ ও জাহাঙ্গীরাবাদ নামে দুটি সমুদ্রগামী জাহাজ, যেগুলো ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের কাজে নিয়োজিত ছিল। এরপর বেসরকারি খাতে স্বাধীনতা-পূববর্তী সময়ে আর কোনো প্রতিষ্ঠান সমুদ্রগামী জাহাজ ব্যবসায় নামেনি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনই ছিল সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনাকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান। বিএসসির বহরে এ সময় একে একে সমুদ্রগামী জাহাজ যুক্ত হতে থাকলেও বেসরকারি খাতে কোনো উদ্যোগ সে অর্থে দেখা যায়নি। এর পেছনে অবশ্য যৌক্তিক কারণও ছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকারের শিল্পের সরকারীকরণ নীতিমালা এক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। পরবর্তীতে বেসরকারি খাত উন্মুক্ত হওয়া শুরু করলে অন্যান্য শিল্পের মতো সমুদ্রগামী জাহাজ শিল্পেও আগ্রহ তৈরি হতে থাকে।

সমুদ্রগামী জাহাজ শিল্পে ব্যক্তি বিনিয়োগের পুরোধা ছিলেন সানাউল্ল্যাহ চৌধুরী। ১৯৫৫ সালে শ ওয়ালেস (পাকিস্তান) লিমিটেডে শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগদানকারী সানাউল্ল্যাহ অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জার্মান শিপিং কোম্পানি হানসা লাইনসের কর্তাব্যক্তিদের নজরে পড়ে যান। এরপর হানসা লাইনসের সদর দপ্তর ব্রেমেনে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ পেয়ে যান। জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়ামের শিপিং শিল্প সম্পর্কে বিস্তর জ্ঞান লাভের পর দেশে ফিরে আসেন সানাউল্ল্যাহ চৌধুরী। ১৯৬৬ সালে শ ওয়ালেসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে পারিবারিক ব্যবসা অ্যাটলাস শিপিং সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীনতার পরপরই তিনি স্কিন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন অব ইন্ডিয়া ও ইন্ডিয়া স্টিমশিপ কোম্পানির এজেন্সি পেয়ে যান। পরের দিকে শিপিং কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়ার এজেন্টও হন। এভাবে ধীরে ধীরে এজেন্সি, চার্টারিং, ব্রোকারেজ এবং অন্যান্য খাতের মাধ্যমে ব্যবসায় বৈচিত্র্য আনেন।

কিন্তু সানাউল্ল্যাহ চৌধুরীর স্বপ্ন ছিল আরো বড়। ১৯৭৮ সালে এসে সেই স্বপ্ন ধরা দেয়। সূচনা হয় বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে শিপিং ব্যবসার নতুন এক অধ্যায়ের। ১০ হাজার জিআরটির একটি পুরনো জাহাজ কিনে সমুদ্রগামী জাহাজের ব্যবসা শুরু করে অ্যাটলাস শিপিং। আল-সালমা নামের জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের নামে নিবন্ধিত হয়। এটিই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে বেসরকারি মালিকানাধীন প্রথম সমুদ্রগামী জাহাজ। এরপর তিনি একের পর এক জাহাজ কিনতে থাকেন এবং পুরনো জাহাজগুলো স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করে দিতে থাকেন। অ্যাটলাস শিপিংয়ের বহরে ১৯৮০ সালে যুক্ত হয় আল-শারমিন, ১৯৮১ সালে আল-শায়েস্তা, ১৯৮৫ সালে আল-সানা, আল-সালমা-২, ১৯৮৬ সালে আল-শমরুজ, ১৯৮৯ সালে সাফার এবং ১৯৯৭ সালে আল-সালমাস। অ্যাটলাস শিপিংয়ের হাতে একসময় সর্বোচ্চ চারটি সমুদ্রগামী জাহাজ ছিল। প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ জাহাজ ছিল সাফার, যা ১৯৯৯ সালে স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করে দেন। এ জাহাজটি বিক্রির মাধ্যমে সমুদ্রগামী জাহাজ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানটির ইতি ঘটে।

অ্যাটলাস শিপিংয়ের জাহাজগুলো পূর্বদিকে জাপান থেকে দক্ষিণ কোরিয়া এবং পশ্চিমে পাকিস্তান থেকে পারস্য উপসাগরে চলাচল করত। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশি নাবিকদের নিয়োগদানের মধ্য দিয়ে বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করেছিল। এখনো বিশে^র বিভিন্ন প্রান্তে যে বিপুল সংখ্যক মেরিনার ছড়িয়ে আছেন, অ্যাটলাস শিপিং দিয়েই তাদের কর্মজীবন শুরু।

অ্যাটলাস শিপিংয়ের পর আবুল খায়ের চৌধুরীর সমুদ্র যাত্রা শিপিং, ওয়াসিউর রহমান চৌধুরীর অ্যাকুয়াটিক শিপিং, আবদুল আউয়াল মিন্টুর বেঙ্গল শিপিং এবং শাহ আলমের কন্টিনেন্টাল লাইনার সমুদ্রগামী জাহাজ শিল্পে যুক্ত হয়।

আধিপত্য এখন বেসরকারি খাতের

সানাউল্ল্যাহ চৌধুরীর হাত ধরে শুরু হওয়া বেসরকারি খাতে এখন ডজনখানেক প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক রুটে জাহাজ পরিচালনা করছে। সমুদ্রগামী জাহাজ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ওশান গোয়িং শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যভুক্ত এসব কোম্পানি হলো চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্প গ্রুপ কেএসআরএমের মালিকানাধীন এসআর শিপিং, আকিজ গ্রুপের মালিকানাধীন আকিজ শিপিং লিমিটেড, সরকারি মালিকানাধীন বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন, মেঘনা গ্রুপ, এমআই সিমেন্ট, ভ্যানগার্ড মেরিটাইম লিমিটেড, বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন বসুন্ধরা লজিস্টিকস, বিএসএ শিপিং লিমিটেড, ইস্ট কোস্ট গ্রুপের মালিকানাধীন ইস্ট কোস্ট শিপিং লাইন্স লিমিটেড, ওরিয়ন গ্রুপের মালিকানাধীন ওরিয়ন অয়েল অ্যান্ড শিপিং লিমিটেড ও কর্ণফুলী গ্রুপের মালিকানাধীন এইচআর লাইন্স। সংগঠনের বাইরেও আরো বেশকিছু প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক রুটে জাহাজ পরিচালনা করে আসছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের বহরে থাকা সবগুলো জাহাজ এখন পণ্য পরিবহন করছে না।

র্কণফুলী গ্রুপের মালিকানাধীন এইচআরসি লাইন্স লিমিটেড চট্টগ্রাম থকেে সিংগাপুর ও মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং রুটে চালু করছেে সাহারে ও সারেরো নামরে দুটি কনটইেনার জাহাজ

কার কী অবস্থান

সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনাকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ২০০৪ সালে এ খাতে বিনিয়োগে আসা চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্প গ্রুপ কেএসআরএমের মালিকানাধীন এসআর শিপিং। প্রতিষ্ঠানটির বহরে প্রথম যুক্ত হওয়া জাহাজ এমভি ফাতেমা জাহান। এসআর শিপিংয়ের মালিকানায় সমুদ্রগামী জাহাজ রয়েছে বর্তমানে ২২টি। বাংলাদেশে নিবন্ধিত সবগুলো জাহাজই বাল্ক পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত। প্রতিষ্ঠানটির বহরে থাকা জাহাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় এমভি নাজিয়া জাহান। ৫৮ হাজার ১১০ ডেড ওয়েট টনের বাল্ক ক্যারিয়ারটি নির্মিত হয়েছে ২০১০ সালে।

এসআর শিপিংয়ের পর বহরে সবচেয়ে বেশি জাহাজ রয়েছে আকিজ গ্রুপের মালিকানাধীন আকিজ শিপিং লাইন লিমিটেডের। ২০১০ সালে আকিজ গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা করা আকিজ শিপিং লাইন লিমিটেডের বহরে সমুদ্রগামী জাহাজ আছে বর্তমানে ১০টি এবং সবগুলোই বাল্ক ক্যারিয়ার। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, তাদের বহরে যুক্ত জাহাজগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আকিজ গ্লোরি, আকিজ হেরিটেজ, আকিজ পার্ল, আকিজ ওশান, আকিজ নূর, আকিজ ওয়েভ ও আকিজ গ্লোব। ৭৬ হাজার ৩০২ ডেড ওয়েট টনের সবগুলো জাহাজই ২০০৬ সালে জাপানে নির্মিত। এছাড়া ২০০৬ সালে নির্মিত ৫৮ হাজার ৭১০ ডেড ওয়েট টনের আকিজ নোবেল নামে একটি কার্গো জাহাজও রয়েছে মাত্র ১০ বছরের পুরনো শিপিং লাইনটির বহরে। আকিজ শিপিং লাইনের বহরে থাকা আরো দুটি জাহাজ হলো আকিজ মুন ও আকিজ স্টার।

শিপিং ব্যবসা রয়েছে চার দশকের বেশি সময় ধরে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসা দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপেরও। মেঘনা গ্রুপের মালিকানায় সমুদ্রগামী জাহাজ রয়েছে মোট সাতটি। এমভি মেঘনা প্যারাডাইস, এমভি মেঘনা রোজ, এমভি মেঘনা এনার্জি, এমভি মেঘনা অ্যাডভেঞ্চার, এমভি মেঘনা হারমনি, এমটি মেঘনা প্রাইড ও এমটি মেঘনা ট্রেডার নামে কার্যক্রম পরিচালনা করছে জাহাজগুলো।

চট্টগ্রামভিত্তিক আরেক শিল্প গ্রুপ এমআই সিমেন্ট ফ্যাক্টরিরও আলাদা শিপিং ব্যবসা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বহরে সমুদ্রগামী জাহাজ রয়েছে বর্তমানে চারটি। এমভি ক্রাউন ভিক্টরি, এমভি ক্রাউন ভয়েজার, এমভি ক্রাউন ভিশন ও এমভি ক্রাউন ভার্চু নামে চারটি জাহাজের মাধ্যমে শিপিং ব্যবসা পরিচালনা করছে এমআই সিমেন্ট ফ্যাক্টরি লিমিটেড।

এর বাইরে ভ্যানগার্ড মেরিটাইম লিমিটেডের মালিকানায় সমুদ্রগামী জাহাজ রয়েছে বর্তমানে তিনটি। গ্র্যান্ড রয়্যাল, স্টার রয়্যাল ও গ্র্যান্ড রয়্যাল নামে জাহাজ তিনটির মাধ্যমে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন করছে চট্টগ্রামভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি।

ক্রমবর্ধমান চাহিদার কথা বিবেচেনায় নিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প পরিবার বসুন্ধরা গ্রুপ ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা করে বসুন্ধরা লজিস্টিকস। প্রতিষ্ঠানটির লাইটার জাহাজের বড় বহর থাকলেও সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা সে তুলনায় নগণ্য। বর্তমানে বসুন্ধরা-৬ ও বসুন্ধরা-৮ নামে দুটি সমুদ্রগামী জাহাজ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায়।

এর বাইরে ব্রেফ রয়্যাল ও গ্রেট রয়্যাল নামে দুটি সমুদ্রগামী জাহাজ রয়েছে চট্টগ্রামভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বিএসএ শিপিং লিমিটেডের মালিকানায়। এছাড়া এমটি ওমেরা কুইন ও এমটি ওমেরা লিগ্যাসি নামে দুটি জাহাজ রয়েছে ইস্ট কোস্ট শিপিং লাইনের মালিকানায়। আর ওরিয়ন অয়েল অ্যান্ড শিপিং লিমিটেডের মালিকানায় ওরিয়ন এক্সপ্রেস এবং এইচআরসি শিপিংয়ের মালিকানায় রয়েছে সাহারে ও সারেরা নামে দুটি কনটেইনার জাহাজ।

বেসরকারি খাতের আগ্রহ যে কারণে

গত এক দশকে দেশের অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন হয়েছে। শিল্পের বিকাশ, নতুন নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, সরকারের নীতি সুবিধা ও বড় বড় প্রকল্প অর্থনীতিকে নতুন রূপ দিয়েছে। ফলে আমদানি বেড়েছে কয়েক গুণ, বেড়েছে রপ্তানিও। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বেসরকারি খাত নিজেদের পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি অন্যান্য পণ্য পরিবহনে সমুদ্রগামী জাহাজ কেনার প্রতি ঝুঁকছে।

সরকারের নীতিসহায়তাও বেসরকারি খাতের মধ্যে এ শিল্পের প্রতি বাড়তি আগ্রহ তৈরি করেছে। সমুদ্রগামী জাহাজ আমদানির ক্ষেত্রে সরকার শুল্ক সুবিধা দিচ্ছে। সরকারি নীতিমালার কারণে ২২ বছরের কম পুরনো ও পাঁচ হাজার ডেড ওয়েট টনের জাহাজ আমদানির ক্ষেত্রে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে কোনো ধরনের শুল্ক পরিশোধ করতে হচ্ছে না। আগে যেখানে সমুদ্রগামী জাহাজ আমদানিতে প্রায় ২৭ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। এই উচ্চ শুল্কের কারণে ব্যবসায়ীরা আগে এ খাতে বিনিয়োগে খুব বেশি আগ্রহ দেখাতেন না। একই কারণে সমুদ্রগামী অনেক জাহাজ মালিক বাংলাদেশে জাহাজের নিবন্ধন নেওয়ার ক্ষেত্রেও উৎসাহ হারাতেন। 

সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্রগামী জাহাজ আমদানি বেড়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ করোনাভাইরাস মহামারির ফলে বিশ^ব্যাপী জাহাজের মূল্য হ্রাস। সুযোগটি কাজে লাগিয়ে গত আট মাসে দেশে জাহাজ নিবন্ধন লক্ষণীয় হারে বেড়েছে। এর বাইরে ঝামেলাবিহীন রেজিস্ট্রেশন, কম বেতনে অভিজ্ঞ মেরিনারপ্রাপ্তি, ৫০ ভাগ পণ্য দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজে পরিবহনের বাধ্যবাধকতা এ খাতকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখছে।

কখন কতটি জাহাজ পণ্য পরিবহন করেছে

২০০৫ সাল থেকে গত দেড় দশকে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ ছিল ২০১১, ২০১২ ও ২০১৩ সালে। এ সময় সর্বোচ্চ ৬৭টি জাহাজ ছিল। সমুদ্র বাণিজ্য দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৫ সালে ৩১টি, ২০০৬ সালে ২৮টি, ২০০৭ সালে ২৮টি, ২০০৮ সালে ২৭টি, ২০০৯ সালে ৩৪টি, ২০১০ সালে ৪৬টি, ২০১৪ সালে ৬৩টি ও ২০১৫ সালে ৪৭টি সমুদ্রগামী জাহাজ পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত ছিল। পরবর্তী বছরগুলোর মধ্যে ২০১৬ সালে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত ৪৫টি, ২০১৭ সালে ৩৮টি, ২০১৮ সালে ৩৭টি, ২০১৯ সালে ৪৭টি এবং চলতি বছর ৬২টি সমুদ্রগামী জাহাজ।

নিবন্ধিত জাহাজ

সমুদ্র বাণিজ্য দপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের আটটি জাহাজসহ মোট ৬২টি জাহাজ বর্তমানে আন্তর্জাতিক রুটে পণ্য পরিবহন করছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৯৮৮ সালে নিবন্ধিত বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের দুটি জাহাজ বাংলার জ্যোতি ও বাংলার সৌরভ। এর পরের দুই দশকে আর কোনো নিবন্ধিত জাহাজ বর্তমানে পণ্য পরিবহনে সচল নেই। দুই দশক পর ২০০৯ সালের তিনটি, ২০১০ সালের তিনটি, ২০১১ সালের সাতটি, ২০১২ সালের একটি, ২০১৩ সালের নয়টি, ২০১৪ সালের চারটি, ২০১৬ সালের তিনটি, ২০১৭ সালের দুটি, ২০১৮ সালের চারটি এবং ২০১৯ ও ২০২০ সালে নিবন্ধিত ১১টি করে সমুদ্রগামী জাহাজ পণ্য পরিবহন করছে। ২০১৩ সালের পর সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে ২০১৯ ও ২০২০ সালে সর্বাধিক ১১টি করে জাহাজ নিবন্ধিত হয়েছে। এ খাতের জন্য সবচেয়ে সুখবর হলো বাংলাদেশে করোনা মহামারির মধ্যেই ছয়টি জাহাজ নিবন্ধিত হয়েছে।

কনটেইনার জাহাজের নবযাত্রা

স্বাধীনতার পর ১৯৭৮ সালে সানাউল্ল্যাহ চৌধুরীর হাত ধরে সমুদ্রগামী জাহাজের যাত্রা শুরু হলেও এরপর প্রায় দুই দশক পর্যন্ত যুক্ত হওয়া সবগুলো জাহাজই ছিল বাল্ক ক্যারিয়ার ও অয়েল ট্যাংকার। ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার ওঠানামার কাজ শুরু হলেও এ সময়কালে দেশের মালিকানায় কোনো কনটেইনার জাহাজ ছিল না। আমদানি-রপ্তানিতে কনটেইনার পরিবহন শুরুর প্রায় এক দশক পর ১৯৯৬-১৯৯৮ সালের মধ্যে এইচআরসি শিপিং কোম্পানি ও কিউসি শিপিং লাইনের হাত ধরে সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজ শিল্পে বাংলাদেশের পদচারণা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন সময় প্রতিষ্ঠান দুটির মধ্যে এইচআরসির বহরে ১০টি ও কিউসি শিপিং লাইনের বহরে সাতটি জাহাজ ছিল। কিন্তু বিশ্ব বাণিজ্যে মন্দা, পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধিসহ নানা কারণে ২০০৭ সালে কিউসি শিপিং লাইন ও ২০১০ সালে এইচআরসি শিপিং এ খাত থেকে পুরোপুরি সরে আসে। এর পরের এক যুগে আর কোনো প্রতিষ্ঠান কনটেইনার জাহাজ পরিচালনায় যুক্ত হয়নি। ফলে পুরো সময়টাতে কনটেইনার পরিবহনে দেশীয় আমদানি-রপ্তানিকারকদের নির্ভর করতে হয়েছে বিদেশি জাহাজের ওপর। ফলে কনটেইনার পরিবহন বাবদ ফ্রেইট চার্জের পুরোটাই গেছে বিদেশি শিপিং লাইনগুলোর পকেটে।

চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে কনটেইনার পরিবহন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন করে হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে কর্ণফুলী লিমিটেড। ১১৬ কোটি টাকা বিনিয়োগে কর্ণফুলী গ্রুপের মালিকানাধীন এইচআরসি শিপিং লাইন চট্টগ্রাম থেকে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং রুটে চালু করেছে সাহারে ও সারেরা নামের দুটি কনটেইনার জাহাজ। ১ হাজার ৫৫০ টিইইউ কনটেইনার পরিবহনে সক্ষম জাহাজ দুটি নিয়মিত চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এসব রুটে পণ্য পরিবহন করছে।

আয়ের সুযোগ বাড়ছে

বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনে সমুদ্রগামী জাহাজের চাহিদার যে গ্রাফ কয়েক বছর ধরেই, সেটি বেশ ঊর্ধ্বমুখী। উপাত্ত বলছে, ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে বাংলাদেশে আমদানি ও রপ্তানি পণ্য পরিবাহিত হয়েছিল সাকল্যে ১ কোটি ৮১ লাখ ৪৮ হাজার টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৯ কোটি ৪৭ লাখ ৬৪ হাজার টনে। দীর্ঘ এই সময়ে মাত্র একবারই দেশে আমদানি-রপ্তানি পণ্যের পরিবহন কমেছিল এবং সময়টি ছিল ২০১১-১২ অর্থবছর। অর্থবছরটিতে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন ২০১০-১১ অর্থবছরের ৪ কোটি ৬৬ লাখ ৯১ হাজার টন থেকে ৪ কোটি ৩৫ লাখ ৪১ হাজার টনে নেমে এসেছিল। শুধু এটুকু ব্যতিক্রম বাদ দিলে সমুদ্রপথে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন বাড়ছেই। একই সাথে বাড়ছে সমুদ্রগামী জাহাজের চাহিদা। বর্ধিত এই চাহিদা কাজে লাগাতে বেশ কয়েক বছর ধরে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান সমুদ্রগামী জাহাজ শিল্পে বিনিয়োগে আসছে। নিবন্ধিত হচ্ছে নতুন নতুন জাহাজ।

ইউনাইটেড নেশন্স কনফারেন্স ফর ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আঙ্কটাড) উপাত্ত অনুযায়ী, ২০০৫ সালে বাংলাদেশের শিপিং শিল্পের বাজার ছিল প্রায় ১৭২ কোটি ডলারের। ২০১৭ সালেই তা ৬৯৮ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে এই শিল্পের বাজার আরো বড় হয়েছে।

তবে বাংলাদেশে সমুদ্রগামী জাহাজ না থাকায় এই বাজারের সিংহভাগই এতদিন বিদেশিদের দখলে ছিল। এখনো যে পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়েছে তেমন নয়। তবে বিদেশি শিপিং লাইনগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশি পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজের আয়ও আগের চেয়ে বেড়েছে।

আঙ্কটাডের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায়, ২০০৫ সালে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন বাবদ বিদেশি জাহাজ পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলো আয় করে ১৫৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার। বাংলাদেশের বাজার থেকে বিদেশি শিপিং লাইনগুলোর আয় উত্তরোত্তর আরো স্ফীত হয়েছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন বাবদ বিদেশি শিপিং কোম্পানিগুলোর আয় বেড়ে ৩৪৪ কোটি ২০ লাখ ডলারে উন্নীত হয়। ২০১৫ ও ২০১৭ সালে তাদের আয় আরো বেড়ে হয় যথাক্রমে ৫৭৭ কোটি ৪০ লাখ ও ৬৪৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার।

এ শিল্পে নতুন নতুন স্থানীয় কোম্পানি যুক্ত হওয়ায় এই বাজারে বাংলাদেশের হিস্যাও আগের চেয়ে বেড়েছে। আঙ্কটাডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৫ সালে সমুদ্রপথে আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন বাবদ বাংলাদেশি শিপিং কোম্পানিগুলোর আয় ছিল মাত্র ১২ কোটি ২০ লাখ ডলার। ২০১৭ সালে আয়ের পরিমাণ ৫০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। ৫০ শতাংশ পণ্য বাংলাদেশি জাহাজে পরিবহনের বিধান যুক্ত করায় এই বাজারে স্থানীয় কোম্পানিগুলোর অবস্থান আরো শক্ত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন বাবদ বাংলাদেশি পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজের আয় ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন এতদিন এর বিপরীত পথে হেঁটেছে। ২০০৫ সালে এ বাবদ প্রতিষ্ঠানটি ৫ কোটি ২০ লাখ ডলার আয় করলেও ২০১৭ সালে তা ১ কোটি ২৬ লাখ ৬০ হাজার ডলারে নেমে আসে। তবে প্রতিষ্ঠানটির বহরে নতুন ছয়টি জাহাজ যুক্ত হওয়ায় এবং আরো জাহাজ কেনার প্রক্রিয়া চলমান থাকায় আগামীতে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের আয় বাড়বে বলে ধারণা করা যায়।

শেষ কথা

দীর্ঘ খরা কাটিয়ে মেরিটাইম সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচনে নতুন পথে হাঁটছে বাংলাদেশের সমুদ্রগামী জাহাজ শিল্প। মূলত বেসরকারি খাতের ওপর ভর করে সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনে (আইএমও) বাংলাদেশের মর্যাদাও। কারণটা খুবই স্বাভাবিক। যে দেশে জাহাজের গ্রস রেজিস্টার টনেজ (জিআরটি) যত বেশি, আন্তর্জাতিক মেরিটাইম সংস্থার কাছে সে দেশের মর্যাদাও তত বেশি। শুধু এই বিবেচনায় বলা যায়, মেরিটাইম জাতি হওয়ার লক্ষ্যে ঠিক পথেই আছে বাংলাদেশ। এর চেয়েও বড় কথা, বিদেশি শিপিং কোম্পানিগুলোকে ফ্রেইট চার্জ হিসেবে পরিশোধ করা বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয়েরও সুযোগ তৈরি হয়েছে। কারণ বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা শুধু ফ্রেইট চার্জ বা জাহাজভাড়া বাবদই প্রতি বছর ব্যয় করেন ৮-৯ বিলিয়ন ডলার। সমুদ্রগামী জাহাজস্বল্পতায় এর মাত্র ২ শতাংশ নিজেদের ঘরে আনার সুযোগ ছিল। বর্তমানে জাহাজের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে ফ্রেইট চার্জে নিজেদের হিস্যা বাড়ানোরও সুযোগ তৈরি হচ্ছে। মেরিটাইম শিল্পের বিশেষজ্ঞরাই এখন অংক কষে বলছেন, বাংলাদেশে সমুদ্রগামী জাহাজ শিল্পের যে সম্ভাবনা, তার সবটুকু কাজে লাগানো গেলে জাতীয় অর্থনীতিতে বার্ষিক ২ শতাংশ বাড়তি প্রবৃদ্ধি যোগ করা সম্ভব।

বাংলাদেশের মেরিটাইম বিষয়ক চর্চাকে এগিয়ে নিতে সারথির ভূমিকায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ

প্রিয় পাঠক, সময় পরিক্রমায় আমরা পৌঁছেছি ছোট এক মাইলফলকের সামনে- বন্দরবার্তার অর্ধশততম সংখ্যাটি এ মুহূর্তে আপনার হাতে! বাংলাদেশে অপ্রতুল মেরিটাইম বিষয়ক চর্চার পটভূমিতে এ খাতের টেকনিক্যাল ও একাডেমিক নানা বিষয়সমূহ নিয়মিতভাবে বাংলা ভাষায় রচনা ও প্রকাশ নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেজ্ঞ। বন্দরবার্তা প্রকাশের মাধ্যমে এদেশে মেরিটাইম জ্ঞানভিত্তি এগিয়ে নিতে সারথির ভূমিকা নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। ঠিক যে মুহূর্তে বাংলাদেশের মেরিটাইম শিল্প একটি বড় পরিবর্তনের সামনে দাঁড়িয়ে, গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে সমুদ্র অর্থনীতির সুবিশাল কর্মযজ্ঞ, উচ্চ আয়ের দেশ হওয়ার পথে যে মেরিটাইম খাত থেকে পেতে হবে সবচেয়ে বড় সহযোগিতা- আমাদের অভিনিবেশ স্বার্থক হবে যদি বন্দরবার্তা সেখানে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখতে পারে। বন্দর কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ, বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য আশা জাগানিয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ এই খাতটিকে জনপ্রিয় ও সংবেদনশীল করে তোলার স্বতপ্রণোদিত এই মহৎ উদ্যোগ নেওয়ার জন্য।

যে বিশাল কর্মযজ্ঞের সামনে দাঁড়িয়ে এই খাত, সেখানে দক্ষ কর্মশক্তি হিসেবে যথাযথভাবে তরুণদের তৈরি করা একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। প্রথম থেকেই বন্দরবার্তা চেষ্টা করে যাচ্ছে মেরিটাইম বিষয়াবলির প্রাঞ্জল উপস্থাপনের মাধ্যমে তরুণদের এই খাতটিতে উৎসাহী করে তুলতে। সরকারের আন্তরিক উদ্যোগ, বাংলাদেশের মেরিটাইম খাতের ক্রমোন্নতি ও চ্যালেজ্ঞসমূহ বিশ্লেষণের পাশাপাশি দেশীয় বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং নীতিনির্ধারক মহলকে এই খাতের বৈশ্বিক পরিবর্তনের হালনাগাদ তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করে চলেছে বন্দরবার্তা।

সাথে থাকার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ পাঠকদের কাছে। বন্দরবার্তা ঘিরে আপনাদের উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা আমাদের জুগিয়েছে অবিরাম অনুপ্রেরণা। প্রিয় পাঠক, আপনাদের প্রয়োজনে প্রতিনিয়ত আমরা বদলে ফেলছি বন্দরবার্তাকে- বিষয়সমূহে রাখছি বৈচিত্র্য, গুণগত মানে হয়েছি আরো তাৎপর্যপূর্ণ, অঙ্গসজ্জায় এনেছি নতুনত্ব। বন্দরবার্তা হয়েছে নবীনতর থেকে অভিজ্ঞতালব্ধ। এই সাফল্যের ভাগীদার তাই আপনিও, প্রিয় পাঠক।

বিশ^ অর্থনীতি যখন এখনো করোনাভাইরাস মহামারির বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার উপায় হাতড়ে বেড়াচ্ছে তখনই স্রোতের বিপরীতে বেশ প্রতাপের সাথে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। দূর্যোগকালে পুরোদমে সচলথাকা বন্দর ব্যবস্থাপনা ও অংশীজনদের সহযোগিতায় দ্রুতই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে আমাদের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য। সংকটকালীন সময়েও বাংলাদেশের মেরিটাইম বাণিজ্য আরেকটি সুখবর নিয়ে এসেছে। আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে বাংলাদেশ তার অবস্থান আরো পোক্ত করে নিচ্ছেÑ তরতরিয়ে বাড়ছে লাল সবুজের পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ১৬টি জাহাজ যুক্ত হয়েছে আমাদের সমুদ্রগামী জাহাজ বহরে। সরকারি ও ব্যক্তি খাত মিলে ৬২টি সমুদ্রগামী জাহাজ এখন পণ্য পরিবহন করছে সুনীল সাগরে। অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে আরো দুটি জাহাজ। স্বাধীনতার পাঁচ দশকে এসে এখন বলাই যায়, মেরিটাইম জাতি হিসেবে পুনরুত্থানের পথে বাংলাদেশ।

সমুদ্রগামী জাহাজ শিল্পের এই উল্লম্ফনের পিছনে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করছে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ (সুরক্ষা) আইন ২০১৯। আইনটি ব্যবসাবান্ধব হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা পুনরায় এই খাতে পুঁজি লগ্নি করছেন। এছাড়া করোনার কারণে পুরনো জাহাজের দাম বেশ কমে যাওয়ায় তা আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের লগ্নিকারকদের কাছে। এবারের প্রধান রচনায় থাকছে বাংলাদেশের সমুদ্রগামী জাহাজ শিল্পের আদ্যোপান্ত।

কোভিড-১৯ মহামারি বিশ্বব্যাপী জাহাজ চলাচলের গতি কমিয়ে আনলেও আর্কটিক দিয়ে জাহাজ চলাচলে রাশ টানতে পারেনি। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বরফ গলে উন্মুক্ত হয়ে পড়ায় এই অঞ্চলে জাহাজ যাত্রা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অঞ্চলটির সাইবেরিয়ার উপকূল বরাবর ব্যস্ততম লেনটি দিয়ে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত জাহাজ চলাচল ৫৮ শতাংশ বেড়েছে। করোনাকালীন সময়ে ২০২০ সালের প্রথমার্ধে জলপথটি দিয়ে জাহাজগুলো ৯৩৫টি যাত্রা সম্পন্ন করেছে। পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ে যেখানে যাত্রার সংখ্যা ছিল ৮৫৫টি। আর্কটিকে জল মাড়িয়ে জাহাজ চলাচলের এই যে উল্লম্ফন, তাতে চাপ বাড়ছে পরিবেশের ওপর, যা এই অঞ্চলের উষ্ণতা বৃদ্ধিতে গতি সঞ্চার করছে। আর্কটিকে উষ্ণায়ন ও জাহাজ চলাচল নিয়ে বিস্তারিত রয়েছে বিশেষ রচনায়।

মেরিটাইম পরিবহন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ সেবা প্রদান সম্ভব হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না অংশগ্রহণকারীরা অর্জন ও সমস্যা সম্পর্কে সঠিক তথ্য সরবরাহ এবং গ্রাহকদের চাহিদার ভিত্তিতে প্রণীত তাদের পরিকল্পনার একক পদ্ধতি তৈরি না করছে। এছাড়া আধুনিক, দক্ষ ও নির্ভরযোগ্য মেরিটাইম সরবরাহ ব্যবস্থা সন্তোষজনকভাবে পরিচালনার জন্য যেটা দরকার হয় তা হলো সক্রিয় অংশীজনদের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতার স্বীকৃতি দেওয়া। এটা করতে হলে এ খাতের অংশীজনদের সার্বক্ষণিক তথ্য বিনিময়ের কাজটা রপ্ত করতে হবে। বন্দর ও অংশীজনদের মধ্যে নিয়মিত ডেটা বিনিময়ের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে থাকছে বিশেষ প্রতিবেদন।

প্রিয় পাঠক, আপনাদের সাথে নিয়ে বাংলাদেশের মেরিটাইম সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাব আরো অনেক দূর, সেই প্রত্যাশা রাখছি। সবাইকে বন্দরবার্তা পঞ্চাশতম সংখ্যা উদ্যাপনের শুভেচ্ছা। বাংলাদেশে প্রায়-অকর্ষিত এই পথে আমরা আরো সমৃদ্ধ হব সামনের দিনগুলোতে, এই আশা আর অমূলক নয়।

হাই ফং বন্দর, ভিয়েতনাম

ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয় থেকে মাত্র ১২১ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত হাই ফং বন্দর প্রকৃতপক্ষে একটি পোর্ট গ্রুপ। কুনমিং-লাও চাই-হ্যানয়-হাই ফং ইকোনমিক করিডোরের শেষ প্রান্তে অবস্থিত হওয়ায় চীনের সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর নৌ যোগাযোগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে হাই ফং। লয়েড’স থেকে ২০২০ সালে প্রকাশিত ব্যস্ততম কনটেইনার বন্দরের তালিকায় ৩১তম অবস্থানে থাকা উত্তর ভিয়েতনামের বৃহত্তম বন্দর হাই ফং পোর্ট গ্রুপ মূলত পাঁচটি শাখা বা ইউনিটে বিভক্ত। গ্রুপের ইউনিটগুলো হলো চুয়া ভে পোর্ট ব্রাঞ্চ, ট্যান ভু পোর্ট ব্রাঞ্চ, হোয়াং দিউ পোর্ট ওয়ান মেম্বার এলএলসি, হাই ফং পোর্ট মেডিকেল সেন্টার ওয়ান মেম্বার এলএলসি এবং কোম্পানি হাই ফং পোর্ট অপারেশনস টেকনিক্যাল ট্রেনিং ওয়ান মেম্বার এলএলসি। উত্তর ভিয়েতনামের অন্তত ১৭টি প্রদেশ, লাওসের উত্তর ভাগ এবং দক্ষিণ চীনের সাপ্লাই চেইনের অন্যতম শক্তিশালী স্তম্ভ এই বন্দর। 

১৮৭৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হাই ফং বন্দর তার ইতিহাসের গোটা সময়জুড়ে দেশটির উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। বেতন-ভাতা বৃদ্ধি এবং সুপেয় পানির মৌলিক চাহিদা বন্দোবস্তের দাবিতে ঔপনিবেশিক দখলদারদের বিরুদ্ধে ১৯২৯ সালের নভেম্বরে এক ঐতিহাসিক আন্দোলনে নামেন হাই ফং বন্দরের ডক শ্রমিকরা। শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে অন্যতম অর্থবহ ও সংঘবদ্ধ প্রতিবাদের পর নিজেদের দাবি আদায় করে নেন কর্মীরা। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে মিত্রপক্ষের কৌশলগত ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার হওয়ার পর ১৯৫৫ সালে ফরাসি শাসনমুক্ত হয় হাই ফং বন্দর। প্রেসিডেন্ট হো চি মিনের নেতৃত্বে এর আধুনিকায়নের কাজ শুরু হয়। ২০১৪ সালে সরাসরি ভিয়েতনাম মেরিটাইম কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে লিমিটেড লায়াবিলিটি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি হিসেবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় বন্দরটি।   

হাই ফংয়ের চুয়া ভে পোর্ট ব্রাঞ্চে মোট ৮৪৮ মিটার দৈর্ঘ্যরে পাঁচটি ব্রিজ রয়েছে, যেখানে সাধারণত সাধারণ কার্গো এবং কনটেইনার আসা-যাওয়া করে। বার্ষিক পাঁচ লাখ টিইইউ কনটেইনার ধারণক্ষমতার এ টার্মিনালে সর্বোচ্চ ২০ হাজার ডেড ওয়েট টনের জাহাজ ভিড়তে সক্ষম। ৯৮০ দশমিক ৬ মিটার দৈর্ঘ্যরে ট্যান ভু ব্রাঞ্চে পাঁচটি ব্রিজ থাকলেও আয়তনে এটি চুয়া ভে-এর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। ৫৫ হাজার ডিডব্লিউটি সক্ষমতার জাহাজ ভিড়তে পারে এখানকার টার্মিনালে, কনটেইনার ধারণক্ষমতা বার্ষিক ১০ লাখ টিইইউ। সাধারণ কার্গো পণ্যের জন্য বিশেষায়িত হোয়াং দিউ পোর্ট ওয়ান মেম্বার এলএলসিতে রয়েছে মোট ১ হাজার ৩৮২ মিটার দৈর্ঘ্যরে নয়টি ব্রিজ, বার্ষিক ধারণক্ষমতা ৬০ লাখ টন। সর্বোচ্চ ৫০ হাজার ডিডব্লিউটি অফলোডের জাহাজ ভিড়তে পারে এখানে। ক্রুজ শিপ টার্মিনালও রয়েছে হাই ফংয়ে, রাজধানীর একেবারে নিকটে হওয়ায় আন্তর্জাতিক যাত্রীবাহী বন্দর হিসেবেও পরিচিত এটি। 

হাই ফংয়ে আছে তিনটি আলাদা ট্রানশিপমেন্ট এরিয়া। বেন গট-ল্যাক হুয়েন ট্রান্সশিপমেন্ট এরিয়ায় আছে একটি অ্যাংকর পয়েন্ট, যেখানে সর্বোচ্চ ২০ হাজার ডিডব্লিউটি জাহাজ ভিড়তে পারে। হা লং ট্রান্সশিপমেন্ট এরিয়ায় অ্যাংকর পয়েন্ট তিনটি, জাহাজ ভিড়তে পারে ৩০ হাজার ডিডব্লিউটি পর্যন্ত। ল্যান হা ট্রান্সশিপমেন্ট অ্যাংকর পয়েন্ট তিনটি থাকলেও সর্বোচ্চ ৪০ হাজার ডিডব্লিউটি জাহাজকে সেবা দেওয়া হয় এখানে।

বন্দরের সকল টার্মিনালে আগামীতে যেন ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার ডিডব্লিউটি জাহাজ ডকিং করানো যায়, সেজন্য ব্যাপক উন্নয়নযজ্ঞ চলছে হাই ফংয়ে। উপকূলবর্তী একটি দ্বীপের সাথে মেইনল্যান্ডকে সংযুক্তকারী সেতু নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। সেখানে নতুন একটি বাল্ক টার্মিনাল এবং তিনটি কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে। নতুন এসব স্থাপনা এবং হাই ফং পোর্ট গ্রুপসহ পুরো বন্দর ব্যবস্থার নাম রাখা হবে ল্যাচ হুয়েন।

ক্রস স্টাফ

প্রাচীন ও মধ্যযুগে বহুল ব্যবহৃত নেভিগেশনাল ইকুইপমেন্ট ক্রস স্টাফ, যাকে স্থানভেদে ফোর-স্টাফ বা জ্যাকব’স স্টাফ নামে ডাকা হতো। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ শতক থেকে শুরু করে ১৮ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত সমুদ্রপৃষ্ঠ এবং দিগন্ত রেখায় কোনো বস্তুর উচ্চতা ও দূরত্ব মাপতে নাবিকদের কাছে নির্ভরযোগ্য যন্ত্র ছিল এটি। দিগন্ত রেখার সাথে দিনের বেলায় সূর্য এবং রাতে শুকতারা বা অপর কোনো উজ্জ্বল নক্ষত্র যে কোণ উৎপন্ন করে, সেটি মাপা যায় ক্রস স্টাফের ১০, ৩০, ৬০ ও ৯০ ডিগ্রি কোণ চিহ্নিত ট্রানসম নামক একটি অংশের সাহায্যে। কৌণিক মান জানা থাকলে একজন নাবিক সহজেই নিজের অবস্থান, জাহাজের অভিমুখ, ল্যাটিচিউড এবং লংগিচিউড বের করতে পারেন।

ইতিহাসবিদদের মতে, প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার (বর্তমান ইরাক) ক্যালডীয় সভ্যতার নাবিকদের হাতে ক্রস স্টাফের জন্ম হলেও একে নিখুঁত করে তোলার কৃতিত্ব আরবদের। ধীরে ধীরে পারস্য অঞ্চলেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ক্রস স্টাফ। দ্বাদশ শতাব্দীতে ইউরোপ-এশিয়ার মধ্যবর্তী বাণিজ্য বৃদ্ধি পেলে ক্রস স্টাফ প্রথমে দক্ষিণ, পরে উত্তর ইউরোপেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কাঠের নির্মিত এবং নড়ানো যায় এমন চারটি কাঠের হাতল পরস্পর ছেদ করে যে ক্রস আকৃতি তৈরি করে, তার ছেদন বিন্দুকে চোখের কাছে ধরে একজন নেভিগেটর কোনো কিছুর উচ্চতা নির্ণয় করতে পারেন। ক্রস স্টাফ ব্যবহারে চ্যালেঞ্জও কম ছিল না। সূর্যের দিকে তাকিয়ে যেসব নাবিক নিয়মিত কোণ মাপতেন, তাদের চোখের স্থায়ী ক্ষতি বা দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলার মতো ঘটনা ঘটত প্রায়ই। আবার ক্রস স্টাফ ব্যবহারকারীকে দুদিকে একই সাথে চোখ রাখতে হতো, যন্ত্রের নিচের অংশ দিগন্তে এবং উপরের অংশ সূর্য বা নক্ষত্রের দিকে। নইলে হিসাবে বড় ধরনের গরমিল দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ১৭৫০ সালের দিকে অকটেন্ট আবিষ্কার হওয়ার পর ধীরে ধীরে কালের গহ্বরে হারিয়ে যায় ক্রস স্টাফ।

টম ক্রিয়েন

বিশ শতকের একেবারে প্রথমদিকে পরিচালিত তিনটি অ্যান্টার্কটিক অভিযানের সদস্য ছিলেন বিশ্বখ্যাত সমুদ্র অভিযাত্রী টম ক্রিয়েন। আয়ারল্যান্ডের গর্টাকুরাউনে ১৮৭৭ সালে জন্ম নেওয়া এ দুঃসাহসী নাবিক অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় মাত্র ১৫ বছর বয়সে পিতা-মাতাকে না বলেই নাম লেখান ব্রিটিশ রয়েল নেভিতে। ১৯০১ সালে নিউজিল্যান্ডে দায়িত্ব পালনের সময় রবার্ট ফ্যালকন স্কটের ১৯০১-১৯০৪ ডিসকভারি জাহাজের অ্যান্টার্কটিক এক্সপিডিশনে যোগ দেন। ১৯০২ সালের শীত মৌসুমে অ্যান্টার্কটিক প্যাক আইসে আটকে যায় ডিসকভারি। জাহাজসহ পুরো শীতকাল বরফে আটকে থাকার পর ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বরফ গলে আসার বদৌলতে ক্রিয়েনসহ বাকি নাবিকেরা মুক্তি পান।

১৯১০ সালে টেরা নোভা এক্সপিডিশনের জন্য আবারো ক্রিয়েনকে বেছে নেন স্কট। অভিযানের এক পর্যায়ে চরম প্রতিকূল অবস্থায় টানা ১৮ ঘণ্টা ট্রেকিং করে সঙ্গী লেফটেন্যান্ট ইভানসের জীবন বাঁচান ক্রিয়েন। অদম্য শারীরিক-মানসিক শক্তি এবং মানবিকতা প্রদর্শনের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে সম্মানজনক অ্যালবার্ট মেডালে ভূষিত করে ব্রিটিশ সরকার।

১৯১৪ সালে তৃতীয় এবং শেষবারের অ্যান্টার্কটিক অভিযানে টম ক্রিয়েনদের জাহাজ এনডুরেন্সও বরফে আটকে যায় এবং শেষ পর্যন্ত বরফের চাপে চূর্ণ হয়ে যায়। এর আগেই ছোট কয়েকটি লাইফবোটে করে নাবিকেরা জীবন বাঁচান, দাঁড় টেনে উপস্থিত হন এলিফ্যান্ট আইল্যান্ডে। সেখান থেকে টম ক্রিয়েনসহ ছয়জন সাহায্যের আশায় জেমস কেয়ার্ডের লাইফবোটে বেরিয়ে পড়েন। তাদের অসীম বীরত্বপূর্ণ অভিযানের ফলেই এলিফ্যান্ট আইল্যান্ডে আটকে পড়া বাকি ২২ নাবিককে পরবর্তীতে উদ্ধার করা সম্ভব হয়।

১৯৩৮ সালে অ্যাপেনডিক্স ফেটে মৃত্যু হয় এই অসম সাহসী নৌ-অভিযাত্রীর।