Home Blog Page 248

ডাইন্যাস্টিস অব দ্য সি: দ্য শিপওনার্স অ্যান্ড ফিন্যানশিয়ারস হু এক্সপান্ডেড দ্য এরা অব ফ্রি ট্রেড

লেখক- লোরি অ্যান লারোকো

আন্তর্জাতিক মুক্ত বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে সবচেয়ে ক্ষমতাধর অবস্থানে রয়েছে বিশ্ব নৌবাণিজ্যের শীর্ষস্থানীয় শিপিং কোম্পানিগুলো। মোনাকো থেকে হংকং, লন্ডন থেকে এথেন্স, সিঙ্গাপুর থেকে অসলো-পৃথিবীর সর্বত্রই জাহাজমালিক এবং এ খাতে বিনিয়োগকারীরা বহু দিনের প্রচলিত বাণিজ্যের ধারাকে আমূল বদলে বন্দর ব্যবস্থা, শুল্কায়ন প্রক্রিয়াকে আজকের গতিশীল চেহারায় এনেছেন। ব্রাজিলের কৃষিপণ্য আরবে, অস্ট্রেলিয়ার আকরিক লৌহ চীনে, মধ্যপ্রাচ্যের খনিজ তেল আমেরিকায় চলাচলের পথ সুগম করে আক্ষরিক অর্থেই বৈশ্বিক উন্নয়নের মাধ্যমে গোটা পৃথিবীকে এক সুতোয় বেঁধে রেখেছেন তারা। আবার লাভজনক ও গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি নৌবাণিজ্যের বাজার খুবই অস্থিতিশীল। ভৌগোলিক রাজনীতি, সংস্কৃতি থেকে শুরু করে আবহাওয়ার ধাক্কা সামলে চলতে হয় এখানে বিনিয়োগকারীদের।

এত সব চালেঞ্জ জয় করে কীভাবে আন্তর্জাতিক শিপিং টাইকুন হয়ে উঠেছেন একেক জন? লোইস কর্পোরেশনের জিম টিশ, ফ্রন্টলাইন লিমিটেডের জন ফ্রেডরিকসেন, ন্যাভিওস মেরিটাইম হোল্ডিংয়ের অ্যাঞ্জেলিকি ফ্র্যানগু, টি কে কর্পোরেশনের পিটার ইভানসেন, ড্রেইফাস আর্মেচার গ্রুপের ফিলিপে লুইস-ড্রেইফাস, ডিভিবি ব্যাংকের ড্যাগফিন লুনডে, ওভারসিজ শিপহোল্ডিং গ্রুপের মর্টেন আর্নটজেন, ডব্লিউএল রস অ্যান্ড কোম্পানির উইলবার রসসহ শিপিং ইন্ডাস্ট্রির শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিকের জবানিতে লেখা হয়েছে ডাইন্যাস্টিস অব দ্য সি: দ্য শিপওনার্স অ্যান্ড ফিন্যানশিয়ারস হু এক্সপান্ডেড দ্য এরা অব ফ্রি ট্রেড। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বিভিন্ন পরিবর্তন সামলে আগামী দিনে নৌপরিবহন শিল্পের সম্ভাব্য চেহারা নিয়ে বর্তমান প্রজন্মের শিপিং ম্যাগনেটরা স্বতঃস্ফূর্ত এবং খোলামেলা আলোচনা করেছেন মার্কিন সাংবাদিক লোরি অ্যান লারোকোর বইতে। শিপিং ব্যবসায় ২০ জন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব তথা প্রতিষ্ঠানের নানা উত্থান-পতন, নাটকীয় বাঁকবদল উঠে এসেছে এখানে। যদি কারো মনে হয় শিপিং ইন্ডাস্ট্রি একঘেয়ে বা বৈচিত্র্যহীন, তাহলে সে যেন ডাইন্যাস্টিস অব দ্য সি পড়ে নেয়-এ কথা লিখেছে খোদ নিউইয়র্ক টাইমস।

২৯০ পৃষ্ঠার বইটি ২০১২ সালে প্রথমবারের মতো প্রকাশ করে মেরিন মানি ইনকর্পোরেটেড। ২৫ মার্কিন ডলারে হার্ডকভার, ১৫ ডলারে পেপারব্যাক এবং ১০ ডলারে কিন্ডল সংস্করণ মিলবে অ্যামাজনে।

আইএসবিএন ১০: ০৯৮৩৭১৬৩৩১

আইএসবিএন ১৩: ৯৭৮-০৯৮৩৭১৬৩৩৪।

ইনফোগ্রাফিক্স, মার্চ-২০১৮

৩০তম সাধারণ অধিবেশন ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন

২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর থেকে ৬ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যের লন্ডনে তাদের সদর দপ্তরে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের ৩০তম সাধারণ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ১৬৫টি সদস্য রাষ্ট্র থেকে মোট ১৪০০ জন অংশগ্রহণ করেছিলেন সেই সভায়। তাছাড়াও সরকারি এবং বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষকরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

দিক-নির্দেশনা এবং গৃহীত লক্ষ্যসমূহ

সাধারণ অধিবেশনে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়কালের জন্য গৃৃহীত কৌশলগত পরিকল্পনায় একটি সংশোধিত মিশন স্টেটমেন্ট এবং সাতটি নবচিহ্নিত দিক-নির্দেশনার পাশাপাশি প্রথমবারের মতো একটি ভিশন স্টেটমেন্ট অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর মাধ্যমে মূলত জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য ২০৩০ এজেন্ডা বাস্তবায়নে আইএমও’র অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত ও দৃঢ় করা হয়েছে।

কৌশলগত দিক-নির্দেশনাগুলো হলো :

  •      আইএমও’র প্রায়োগিক ক্ষেত্র প্রসারিত করা – সব ধরনের লক্ষ্যমাত্রার কার্যকর, ফলপ্রসূ এবং নিয়মিত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
  •      নিয়ন্ত্রণ কাঠামোতে নতুন ও আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন – সমুদ্র নিরাপত্তা সঙ্কট এবং পরিবেশের উপর বহুমুখী প্রভাবের কথা বিবেচনা করে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে ভারসাম্য আনতে হবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সহজ করে তোলার পাশাপাশি নির্মাণশিল্পে প্রযুক্তির কারণে সম্ভাব্য ব্যয় নিয়ে সচেতন থাকতে হবে। অন্যদিকে, সমুদ্রপথ ছাড়াও অন্যান্য অঙ্গনের সংশ্লিষ্ট কর্মীদের ওপর প্রযুক্তির প্রভাব বিবেচনায় আনা জরুরি।
  •      জলবায়ু পরিবর্তনে ইতিবাচক সাড়া দেওয়া – এক্ষেত্রে যথাযথ, সুদূরপ্রসারী ও বাস্তবিক সমাধান খুঁজে বের করার মাধ্যমে বায়ু দূষণে নৌবাণিজ্যের ভূমিকা কমিয়ে আনতে হবে।
  •      মহাসাগর নিয়ন্ত্রণ – যেসকল প্রক্রিয়া এবং কৌশলের মাধ্যমে মহাসাগর ও এর সম্পদের যথাযথ পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণ করা হয়, সেসবে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সহজ ও নিরাপদ করে তোলা – জাহাজ আগমন ও বহির্গমনের আনুষ্ঠানিকতা এবং দলিল ও প্রত্যয়নপত্রের ব্যবহার, এ ধরনের অফিশিয়াল রীতির দিকে লক্ষ্য রাখার মাধ্যমে সমুদ্র পরিবহন ব্যবস্থার প্রশাসনিক ভার কমিয়ে আনতে হবে।
  •      বিধিমালার কার্যকারিতা বৃদ্ধি – বাস্তবিক যেসকল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নীতি প্রণয়ন করা হয় তার উন্নতি সাধন প্রয়োজন। বাড়তি উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে সেসব নীতিকে আরো কার্যকরী করে তুলতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে আরো ভালোভাবে ও বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে বিধিমালার প্রয়োগ করা জরুরি। সদস্য রাষ্ট্র্রসমূহ ও ইন্ডাস্ট্রির তরফ থেকে যথাক্রমিক প্রতিক্রিয়া জানার মাধ্যমে আইওএম’র নিয়ন্ত্রণ কাঠামোতে সেসব অভিজ্ঞতা প্রাসঙ্গিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করাও দরকার।
  •      প্রাতিষ্ঠানিক কার্যকারিতা নিশ্চিত করা Ñ একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইএমওসহ এর সকল সদস্য রাষ্ট্র, দাতা সংস্থা, দপ্তর এবং বেসরকারি সংস্থার মতো আইনগতভাবে দায়বদ্ধ সব অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের সার্বিক কার্যদক্ষতা বাড়াতে হবে।

ভিশন স্টেটমেন্ট

সমুদ্র পরিবহন ব্যবস্থার বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রক হিসেবে নিজেদের অবস্থান বহাল রাখবে আইএমও। এই খাতের প্রয়োজনীয়তা ও সামর্থ আরো অধিক হারে জানান দেওয়ার পাশাপাশি নৌবাণিজ্যের উন্নতি অব্যাহত থাকবে। একই সাথে প্রযুক্তি ও বিশ্ব বাণিজ্যের চলমান অগ্রগতির দিকে লক্ষ্য রাখার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের জন্য ২০৩০ এজেন্ডা বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

এক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে ক্রমবর্ধমান সঙ্কটসমূহ যথাযথভাবে চিহ্নিত, পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে টেকসই উন্নয়নের জন্য ২০৩০ এজেন্ডা এর লক্ষ্যমাত্রার প্রায়োগিক নিশ্চয়তা বৃদ্ধিতে সদস্য দেশগুলোকে সহায়তা প্রদান করবে আইএমও।

কারিগরি সহযোগিতার মাধ্যমে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার প্রয়োগ

অধিবেশনটিতে তিনটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যা মূলত টেকসই উন্নয়ন অর্জন ও লক্ষ্যমাত্রার প্রয়োগে আইএমও’র কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করবে।

উত্থাপিত প্রথম প্রস্তাবে আইএমও’র কারিগরি সহযোগিতামূলক কর্মকান্ড এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য ২০৩০ এজেন্ডা এর মধ্যকার যোগসূত্রগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। যেসব কার্যক্রমের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন অর্জনের পাশাপাশি আইএমও বিধিমালার কার্যকরী প্রয়োগ ও দ্রুত অনুমোদন সম্ভব – আইএমও’র কারিগরি সহায়তা কমিটিকে সেগুলোর দিকে অধিক নজর দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশ, আফ্রিকার নৌপরিবহন ব্যবস্থা এবং উন্নয়নশীল দ্বীপ রাষ্ট্রসমূহের বিশেষ চাহিদাগুলো বিবেচনায় আনতে হবে।

দ্বিতীয় প্রস্তাবে সদস্য দেশগুলোকে জাতিসংঘ উন্নয়ন সহযোগিতামূলক কাঠামোর (ইউএনডিএএফ) সাপেক্ষে তাদের সমুদ্র সঙ্কটের সমন্বয় সাধনের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে এসব দেশ তাদের মেরিটাইম কারিগরি সহযোগিতা কার্যক্রমের সঠিক অর্থায়ন এবং সহায়তার জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো আগে চিহ্নিত করে নিতে পারবে।

তৃতীয় সিদ্ধান্তে কার্যকরী এবং টেকসই কারিগরি সহায়তা কার্যক্রমের জন্য অর্থায়ন ও অংশীদারিত্ব ব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য রাখা হয়েছে। সদস্য দেশ, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, বেসরকারি সংস্থা এবং ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে নানাবিধ উপায়ে কারিগরি সহযোগিতায় সক্রিয় অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এর মাঝে রয়েছে দাতব্য কার্যক্রম, আইএমও মাল্টি-ডোনার ট্রাস্ট ফান্ডে আর্থিক জোগানের ব্যবস্থা করা, বিবিধ দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সম্পাদন এবং অবৈতনিক পরামর্শদাতা ও দাতব্য যন্ত্রপাতি সরবরাহের মাধ্যমে অনার্থিক সহায়তা প্রদান।

সমুদ্র্রে প্লাস্টিক দূষণ

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ১৪ (সমুদ্র ও মহাসাগর সংরক্ষণ এবং তাদের সম্পদসমূহের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করা) মতে, ২০২৫ সালের মধ্যে সকল প্রকার সমুদ্র্র দূষণ রোধ করার পাশাপাশি ব্যাপক হারে তা কমিয়ে আনতে হবে। এর জন্য বিশেষ করে সামুদ্রিক আবর্জনা ও রাসায়নিক দূষণের দিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। মহাসাগর নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর অংশ হিসেবে চলমান এই প্লাস্টিক দূষণের সমস্যা আরো বেশি পর্যালোচনার দাবি রাখে বলে অধিবেশনে মন্তব্য করা হয়।

আইএমও এর মার্পোল চুক্তির ৫ নং সংযুক্তিতে জাহাজ থেকে মহাসাগরে সকল প্রকার প্লাস্টিক নিষ্কাশন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়াও লন্ডন কনভেনশন অ্যান্ড প্রোটকলের মতো বেশ কিছু সমঝোতা চুক্তি সমুদ্রে প্লাস্টিক অপসারণ নিয়ন্ত্রণ করে – সেগুলির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমেও এই দূষণ রোধ সম্ভব।

অধিবেশনে মার্পোল চুক্তির অধিভুক্ত সকল গোষ্ঠী, সদস্য রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক মহলকে জোর দেওয়া হয়েছে যেন তারা সামুদ্রিক পরিবেশ সংরক্ষণ কমিটির পরবর্তী সভায় এবং ২০১৮ সালের লন্ডন কনভেনশন অ্যান্ড প্রোটোকলের চুক্তিবদ্ধ গোষ্ঠীদের সম্মেলনে এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবনা পেশ করে।

পোলার কোডের দ্বিতীয় পর্যায়

পোলার কোড কার্যকর হয়েছিল ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে। সোলাস ও মার্পোল চুক্তির আওতায় এই বিধি মোতাবেক মেরু অঞ্চলের সমুদ্রে জাহাজ পরিচালনার ব্যাপারে বাড়তি নিয়মাবলি সংযোজন করা হয়, যা মেরু অঞ্চলের পরিবেশের নিরাপত্তা প্রদানে কাজ করে থাকে।

তবে সোলাস চুক্তিতে অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের এবং মাছ ধরার জাহাজগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তাই ২০১৮ সালের মে মাসে পোলার কোডের দ্বিতীয় পর্যায়ে সেসব সংযোজিত হবে।

মাছ ধরার জাহাজে আইএমও নাম্বারিং স্কিমের প্রয়োগ

১০০ গ্রস টনের উপরে সব ধরনের জাহাজে আইএমও নাম্বারিং স্কিম ব্যবহার করা হয়। ১০০ গ্রস টন ধারণক্ষমতা ও তার ঊর্ধ্বে সব যাত্রীবাহী জাহাজ এবং ৩০০ গ্রস টন ধারণক্ষমতা ও তার ঊর্ধ্বে সকল মালবাহী জাহাজের জন্য এই স্কিম বাধ্যতামূলক। ২০১৩ সালের অধিবেশনে নাম্বারিং স্কিমের ঐচ্ছিক অনুমোদনের জন্য ১০০ গ্রস টনের মাছ ধরার জাহাজগুলোকে নির্ধারিত করা হয়। পরবর্তী ঐচ্ছিক অনুমোদন প্রক্রিয়ায় ১০০ গ্রস টনের নিচে যাত্রীবাহী জাহাজ, ইস্পাতনির্মিত ও ইস্পাতনির্মিত নয় এমন মাছ ধরার জাহাজ এবং ১০০ গ্রস টনের নিচে সর্বোচ্চ ১২ মিটার দৈর্ঘ্যের মোটরচালিত আন্তর্জাতিক সমুদ্রে বিচরণকারী মাছ ধরার জাহাজগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

নাম্বারিং স্কিম ব্যবহার করে সমুদ্রে মাছ ধরার জাহাজ শনাক্ত করার ফলে তাদের মালিকানা নিশ্চিত করা যাবে সহজেই। ফলশ্রুতিতে অবৈধ, অনিয়ন্ত্রিত এবং বিলুপ্তপ্রায় মাছ ধরা প্রতিহত করা সম্ভব হবে। তাছাড়া এ ধরনের মাছ ধরার বিরুদ্ধে উদ্যোগ নিতে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) সাথে জড়িত আছে আইএমও।

পোর্ট স্টেট কন্ট্রোল সংশোধন

নিম্নমানের জাহাজ শনাক্ত করার জন্য পোর্ট স্টেট কন্ট্রোল চূড়ান্ত ভূমিকা রাখে। অধিবেশনে পোর্ট স্টেট কন্ট্রোলের কার্যপ্রণালী সংশোধনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

এ সিদ্ধান্ত মতে ২০১১ সালের কার্যপ্রণালী হালনাগাদ করে ইন্টারন্যাশনাল সেফটি ম্যানেজমেন্ট কোডে পরিবর্তন আনা হয়েছে। সংশোধনের ক্ষেত্রে নাবিকদের প্রত্যয়ন, বিশ্রাম ও দায়িত্ব পালনের সময়কালের পাশাপাশি ‘১৯৭৪ সোলাস সম্মেলন’ এ গৃহীত সংশোধনসমূহের ঐচ্ছিক ও দ্রুততর প্রয়োগ এবং বাধ্যতামূলক নীতিমালার ব্যাপারে আলোকপাত করা হয়।

২০১০ এইচএনএস প্রোটোকল অনুমোদনের সুপারিশ

তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো (এলএনজি) বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ সমুদ্রপথে পরিবহনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দায়বদ্ধতা তৈরির লক্ষ্যে একটি সর্বজনীন ব্যবস্থা গ্রহণের পদ্ধতি বিবেচনায় নেওয়ার জন্য অধিবেশনে উপস্থিত সদস্যদের কাছে সুপারিশ করা হয়।

সদস্য দেশগুলোকে ২০১০ সালের এইচএনএস (হ্যাজার্ডাস অ্যান্ড নকশাস সাবস্ট্যান্সেস) প্রোটোকল অনুমোদন করা বা তাতে সম্মতি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। একই সাথে এইচএনএস প্রোটোকল কার্যকর করে তোলা ও সংশ্লিষ্ট নীতিসমূহ প্রয়োগ করার জন্য এবং নতুন শাসনতন্ত্র গঠনে সকল সদস্যকে একত্রে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়।

ইন্স্যুরেন্স সার্টিফিকেট প্রদানের প্রতিনিধি নির্বাচন

১৯৯২ সালের ‘ইন্ট্যারন্যাশনাল কনভেনশন অন সিভিল লায়াবিলিটি ফর অয়েল পলিউশন ড্যামেজ’ এবং ২০১০ এইচএনএস কনভেনশনের আওতায় ইন্স্যুরেন্স সার্টিফিকেট প্রদানের প্রতিনিধি কর্তৃপক্ষ নির্বাচনের সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে অধিবেশনে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

২০১০ এইচএনএস কনভেনশন এবং ১৯৯২ সিভিল লায়াবিলিটি কনভেনশনে ইন্স্যুরেন্স সার্টিফিকেট প্রদানের জন্য প্রতিনিধি নির্বাচনের কোনো স্পষ্ট কাঠামোর উল্লেখ নেই। তবে ২০০১ এর বাঙ্কার্স কনভেনশন, ২০০২ এথেন্স কনভেনশন এবং ২০০৭ নাইরোবি রেক রিমুভাল কনভেনশনে কাঠামো সুনির্দিষ্ট করা আছে।

অধিবেশনের গৃহীত সিদ্ধান্তে বলা হয়, ২০১০ এইচএনএস কনভেনশন বা সিভিল লায়াবিলিটি কনভেনশনের আওতায় একটি রাষ্ট্র তার স্বীকৃত কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে এসকল কনভেনশনের জন্য প্রয়োজনীয় ইন্স্যুরেন্স সার্টিফিকেট ও আর্থিক নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্ব অর্পণ করতে পারবে।

একই সাথে জানিয়ে দেওয়া হয়, এই প্রতিনিধি নির্বাচন প্রক্রিয়ার ফলে সে সকল সার্টিফিকেটের প্রতি নির্বাচনকারী রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার উপর কোনো প্রভাব পড়বে না।

সতর্কবাণী ছাড়া মিসাইল নিক্ষেপকে নিন্দা

উত্তর কোরিয়ার সাম্প্রতিক মিসাইল নিক্ষেপের ফলে সমুদ্রপথে জাহাজ তথা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ভয়াবহ আশঙ্কার সম্মুখীন হয়েছিল। এ ধরনের অতর্কিত আক্রমণের প্রতি দৃঢ়ভাবে নিন্দা জানিয়েছে আইএমও কাউন্সিল।

আইএমও বাজেট চূড়ান্তকরণ

২০১৮ ও ২০১৯ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির ফলাফলভিত্তিক ও কর্মসূচির বাজেট গৃহীত হয়; যা ২০১৮ সালের জন্য ৩১,৮৬৪,০০০ পাউন্ড এবং ২০১৯ সালের জন্য ৩৩,২৪২,০০০ পাউন্ড।

আইএমও কাউন্সিল নির্বাচন

২০১৮-২০১৯ দ্বিবর্ষের জন্য ৪০ সদস্যের আইএমও কাউন্সিল নির্বাচন করা হয় এই অধিবেশনে। পুনর্গঠনের পরামর্শসহ ২০১৮ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিতব্য ১২০তম সেশনে অধিবেশনের কার্যপ্রণালী পর্যালোচনার জন্য নির্বাচিত কাউন্সিলকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

কাউন্সিল চেয়ারম্যান নির্বাচন

২০১৭ সালের ৭ ডিসেম্বর নব-নির্বাচিত কাউন্সিলের সভায় চীনের শিয়াউজি জাং-কে কাউন্সিল চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। তবে ভাইস-চেয়াম্যান নির্বাচন পিছিয়ে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান নির্বাচনের পাশাপাশি সাবেক চেয়ারম্যান, যুক্তরাষ্ট্রের জেফ ল্যান্টজের প্রতি তাঁর দায়িত্বশীলতার জন্য কাউন্সিল আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে।

ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি)

নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। সারাদেশে জালের মত ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নদী। দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন উৎপত্তিস্থল থেকে ভূখন্ডের মধ্য দিয়ে কোথাও একা আবার কোথাও এক বা একাধিক ধারা মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। নদী আর সাগরের সংযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে প্রাকৃতিক নৌযোগাযোগ ব্যবস্থার। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বড় বড় শহর, বিস্তৃতি ঘটেছে ব্যবসা বাণিজ্য আর শিল্পের। বিভিন্ন জনপথকে একসূত্রে গেঁথে দিয়েছে নদী। বড় বড় নদীগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নদী বন্দর। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা নিত্য প্রয়োজনীয় আর শিল্পপণ্য চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে লাইটার জাহাজে করে পৌঁছে যাচ্ছে এসব নদী বন্দরে। বিস্তৃত নৌযোগাযোগ ব্যবস্থা আর লাইটার জাহাজের নিরবিচ্ছিন্ন সেবা দেশের ব্যবসা বাণিজ্যকে করে তুলেছে প্রাণচঞ্চল।

চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন ও অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে এবং সারাদেশে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে পণ্য পরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে ২০০৫ সালে বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (বিসিভোয়া) ও কোস্টাল শিপ ওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব) একসাথে মিলিত হয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল বা ডব্লিউটিসি। এ সেল গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রাম বন্দরের বর্হিনোঙ্গরে মাদার ভেসেল থেকে থেকে বন্দরের জেটি কিংবা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নৌপথে আমদানিকৃত পণ্য সহজে ও কম খরচে পৌঁছে দেয়া এবং চট্টগ্রাম বন্দর তথা দেশের টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে অভ্যন্তরীণ জাহাজ দ্বারা পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা। ডব্লিউটিসি চট্টগ্রাম বন্দরের বর্হিনোঙ্গরে মাদার ভেসেলের অবস্থানকাল কমানোর পাশাপাশি বন্দরের সুনাম বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল গঠনের আগে আমদানিকারক ও লাইটার মালিকদের মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না। ফলে ভাড়া ও পণ্য পরিবহনে বিশৃঙ্খলা ছিল। ডব্লিউটিসি আমদানিকারক, কার্গো এজেন্ট এবং লাইটার জাহাজ মালিকসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের মধ্যে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আমদানিকারকের দুয়ারে পণ্য পৌঁছানোর যুক্তি সংগত ভাড়া নির্ধারণ করে দেয় ডব্লিউটিসি, ফলে অতিরিক্ত ভাড়া গ্রহণের সুযোগ নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার গন্তব্যে প্রতিটন সিমেন্ট ক্লিংকার পরিবহনে আমদানিকারককে লাইটার ভাড়া বাবদ ৪২৭ টাকা গুণতে হয়।

বর্তমানে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের অধীনে প্রায় ৭৫০ টির অধিক লাইটার জাহাজ চলাচল করে। যেগুলোর পরিবহন সক্ষমতা প্রায় ৯ লক্ষ মেট্রিক টন। ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের হিসাবমতে এসব লাইটার বছরে ১ কোটি ৮০ লক্ষ মেট্রিক টন পণ্য পরিবহন করে। ডব্লিউটিসি প্রতিষ্ঠার পর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা মাদার ভেসেল থেকে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন গন্তব্যে পণ্য পরিবহনে কাজ করছে। সঠিক সময়ে মাদার ভেসেল থেকে পণ্য খালাসে লাইটার সরবরাহ করে ডব্লিউটিসি। ফলে আমদানিকারককে মাদার ভেসেলকে কোন প্রকার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়না, এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে।

আমদানিকারকের পণ্য পরিবহনে নৌপথে চলাচলকারী জাহাজগুলোকে নির্দিষ্ট নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। বর্হিনোঙ্গর থেকে পণ্য পরিবহনে ইচ্ছুক এমন নৌযানকে পণ্য পরিবহনের আগে অবশ্যই ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলে নিবন্ধিত হতে হয়। এক্ষেত্রে সরকারি রাজস্ব পরিশোধ ও সার্ভে সার্টিফিকেট ছাড়া কোন নৌযানকে পণ্য পরিবহনের অনুমতি দেয় না ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল। ফলে সরকারি রাজস্ব আদায়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ডব্লিউটিসি। এছাড়া সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে ও রাজস্ব পরিশোধ করা হয়নি এমন পণ্য পরিবহনে লাইটার বরাদ্দ দেয় না ডব্লিউটিসি।

চট্টগ্রাম বন্দরে যেমন বর্হিনোঙ্গর থেকে জেটিতে জাহাজ ভিড়তে বার্থিং মিটিং পরিচালিত হয়, ঠিক তেমনি পণ্য পরিবহনে লাইটার জাহাজ বরাদ্দ দিতে প্রতিদিন ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের অফিসে বার্থিং মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। তবে মাদার ভেসেলের আধিক্য ও লাইটার জাহাজ স্বলতার কারণে মাঝে মাঝে বার্থি মিটিং অনুষ্ঠিত হয়না। আমদানিকারকের দেয়া লাইটার জাহাজের চাহিদার ভিত্তিতে লাইটার বরাদ্দ দেয়া হয়। আমদানিকারকের পক্ষে কার্গো বা পণ্যের এজেন্ট ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলে চাহিদা উত্থাপন করেন। শুধুমাত্র লাইটার বরাদ্দ দেয় এমন নয়, লাইটার কোন গন্তব্যে যাচ্ছে তা নিয়মিত মনিটরিংও করে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল। এছাড়া লাইটার বরাদ্দ পাওয়ার পর, আমদানিকারকের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পণ্য খালাস পর্যন্ত যে কোন সমস্যা বা সৃষ্ট জটিলতা মীমাংশায় কাজ করে ডব্লিউটিসি। ফলে আমদানিকারকে পণ্যের কোন ধরণের ঝামেলা বা সমস্যায় পড়তে হয়না সঠিক সময়ে পণ্যের প্রাপ্তি নিয়ে। এছাড়া খাদ্যদ্রব্য ও কৃষিকাজে ব্যবহৃত সার পরিবহনের তথ্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে সরবরাহ করে ডব্লিউটিসি। ফলে একদিকে যেমন খাদ্যদ্রব্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করছে, ঠিক তেমনি দেশের কৃষি উৎপাদন প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে ডব্লিউটিসি।

বন্দর শিল্পে রূপান্তর আনবে ২০১৮

আন্তর্জাতিক আইন সংস্থা ইনস অ্যান্ড কো এর মতে, বন্দর শিল্পের জন্য একটি নির্ধারণী বছর হতে যাচ্ছে ২০১৮ সাল। আর সে কারণেই সামনের বছরটিকে রূপান্তরের বছর হিসাবে আশা করতে পারেন বন্দর অপারেটররা।

অর্থনৈতিক গতিধারা পরিবর্তনের ঝোঁক, বাণিজ্য প্রবাহ এবং বিশ্বব্যাপী ডেমোগ্রাফিক নিদর্শন বদলে যাবার ফলে রূপান্তরটি ঘটবে। এর পাশাপাশি পোর্টের মালিকানা এবং আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের যে চলমান বিনিয়োগ তা, পরিবর্তনের মাধ্যমেও রূপান্তর ত্বরান্বিত হবে।

সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী বন্দরগুলোর ভাগ্য পরিবর্তিত হয়েছে। এজন্য শেষ কয়েক বছরকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়।ইনস অ্যান্ড কো এর গ্লোবাল পোর্টস অ্যান্ড মেরিটাইম ইনফ্রাসট্রাকচার প্রাকটিস প্রধান টন ভ্যান ডেন বসচ একথা বলেন।

আফ্রিকা থেকে এশিয়া, ইউরোপ থেকে আমেরিকা পর্যন্ত কোনো অপারেটরই বন্দরের কার্যাবলী এবং এর বাণিজ্যিক বাস্তবতায় যে বদল এসেছে তা এড়াতে পারে না। সকল প্রত্যাশা এবং সম্ভাবনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, এই টার্মিনালগুলো এবং তাদের চলমান উন্নয়নের জন্য ২০১৮ সাল একটি রূপান্তরযোগ্য বছর হিসাবে প্রস্তুত হয়ে আছে। এবং যেসব অপারেটর সফলভাবে এই নৌপথগুলোতে জাহাজ চলাচল অব্যাহত রাখতে পারবে তারাই প্রকৃত বাণিজ্যিক সুবিধা পাবে।

সেক্ষেত্রে চীনের বেল্ট এবং রোড ইনিশিয়েটিভই হলো এশিয়া ও আফ্রিকার পোর্টগুলোর পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি।

ধারণা করা হচ্ছে, গত ১২ মাসে চীন এককভাবে পোর্ট এবং টার্মিনালে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে।

বেল্ট এবং রোডসম্বন্ধে পশ্চিমের সচেতন হয়ে ওঠার বছর যদি হয় ২০১৭, তাহলে ২০১৮ সাল হচ্ছে সেই বছর যখন এর প্রভাব স্পষ্ট হয়ে দেখা দেবে। প্রকৃতপক্ষে, আমরা ইতিমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি বেল্ট এবং রোডের ম্যাক্রো-ইকোনমিকিক প্রভাব স্পষ্টত প্রতীয়মান হতে শুরু করেছে বিশ্বজুড়ে।

এর মধ্যে একটি হলো মালিকানার একত্রীকরণ। সম্প্রতি কসকো ও চায়না শিপিং একত্রে যৌথ সংস্থা হয়েছে। ২০২০ নাগাদ, ধারণক্ষমতায় এরা বৃহত্তম কনটেইনার টার্মিনাল অপারেটর হয়ে দাঁড়াবে। এবং এ কারণেই বৈশ্বিক র‌্যাংকিং-এ তাদের অবস্থান চতুর্থ এবং অষ্টম থেকে আরো উন্নীত হবে এ সময়কালে মধ্যে। বিশ্ব বাণিজ্য পরিচালনায় নিশ্চিতভাবেই এটি একটি নতুন ভারসাম্য আনবে।

ছোট ছোট পোর্ট অপারেটররা ভাবতে পারেন যে, এই গতি পরিবর্তনের ধারায় নিকট ভবিষ্যতে এই সেক্টরে তাদের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি বুঝতে হবে তা হলো, কেউই এই উন্নয়ন থেকে অনাক্রম্য নয়। বরং তারা সেইসব অপারেটরদের বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করবে যারা এখান থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা বের করে নিতে পারবে।

উদীয়মান এবং সীমান্তের দেশগুলোতে পোর্টের সুযোগ-সুবিধা দ্রুত বৃদ্ধি, সম্প্রসারণ এবং আধুনিকীকরণ হলো নতুন বাণিজ্য-পথ খোলা এবং ভোক্তা বাজার উদারীকরণের সরাসরি প্রতিফলন।

যদি ছোট অপারেটররা তহবিল সুরক্ষিত করতে পারে, তবে বড় বড় খেলোয়াড় দ্বারা পরিচালিত নতুন অপারেটরদের সাথে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সম্ভাবনা থাকবে। সবচেয়ে সফল হবে সেইসব কৌশল যেগুলো দীর্ঘমেয়াদী এবং ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক গতিধারাকে প্রতিফলিত করতে পারবে।

ইনস অ্যান্ড কো সংস্থা, অপারেটরদের ২০১৮ এবং তার পরের সময়ের পরিকল্পনার জন্য বিশেষ বাণিজ্যিক মান হিসাবে একটি ক্ষেত্র নির্দেশ করে যা ট্রান্সশিপমেন্ট নয়, বরং ক্রমান্বয়ে গেটওয়ে অপারেশনের দিকে ঝুঁকছে। এশিয়া ও আফ্রিকাতে বাণিজ্য প্রবাহ পরিবর্তনের এই নির্দিষ্ট কারণগুলো এখন ক্যাপটিভ মার্কেট ভেঙ্গে ফেলার জন্য প্রস্তুত হয়েছে।

ভ্যান ডেন বসচ বলেন আমরা কঙ্গো বা পূর্ব তিমুরের মতো দেশের দিকে তাকালে পরিষ্কারভাবেই দেখতে পাই যে, অপারেটররা গেটওয়ে টার্মিনাল স্থাপন করার মাধ্যমে এসব বাজারকে বিশ্ব বাণিজ্যে উন্মুক্ত করে দেবার কাজ শুরু করে দিয়েছে।

এটি এমন একটি প্যাটার্ন, বিশ্বব্যাপী যার পুনরাবৃত্তি ঘটে: বেল্ট এবং রোডের বিনিয়োগ স্থানীয় অবকাঠামো ও পরিবহন সংযোগগুলোর উন্নয়ন ঘটাচ্ছে এবং অপারেটররা নির্মাণ যজ্ঞের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সত্যি করে বলতে গেলে, সীমান্তবর্তী স্থানীয় অঞ্চলে কার্গো ভলিউমগুলোর পৌঁছানোর জন্য বিকল্প উপায় নেই বললেই চলে। যেসব পোর্ট অপারেটররা এই গতিধারা পরিচালনা করতে পারবে এবং যারা শুরুতেই এই বাজারে প্রবেশ করবে তারা নিজ নিজ দেশে স্থায়ী ও অপরিহার্য হিসাবে নিজেদেরকে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।

তবুও এই আইন সংস্থার ধারণা, উদীয়মান বাজারগুলোতে অর্থায়ন একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসাবেই থাকবে। এর পাশাপাশি কমপ্লায়েন্স, দুর্নীতি এবং ঘুষ-বিরোধী বিষয়গুলোতো থাকছেই। কিন্তু মৌলিকভাবে সংস্থাটি বিশ্বাস করে যে, আগামী বছর বিশ্বব্যাপী বন্দর শিল্পের বিনিয়োগে বিস্তৃত পরিসরে আরও বেশি গতি দেখা যাবে ।

২০১৮ সালে বন্দর বিশ্বে দেখা যাবে অটোমেশন এবং ব্লকচেইনের মতো নতুন নতুন উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ব্যবহারে অব্যাহত গবেষণা এবং উন্নয়ন প্রচেষ্টা। যদিও এটি আশা করা ভুল হবে যে, আগামী ১২ মাসের মধ্যেই এগুলোর যেকোনো একটা সত্যিকারের গেম-চেঞ্জার হয়ে উঠবে। কিন্তু আমরা এমন একটা সুস্পষ্ট প্রতিবিম্ব আশা করতেই পারি যেখানে, সম্ভাব্য বাণিজ্যিক অ্যাপ্লিকেশনগুলো এবং বন্দর পরিচালনায় প্রতিটি প্রযুক্তির সুবিধাগুলোর মেলবন্ধন ঘটবে।

ইনস অ্যান্ড কো এর প্রতিবেদন অবলম্বনে-

বন্দরবার্তা ডেস্ক

শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর

দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৯২ ভাগ পরিবাহিত হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। সরাসরি অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট এ বিশাল কর্মযজ্ঞে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে জড়িয়ে রয়েছে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান। যাদের নিরলস পরিশ্রম চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে সাথে অর্থনীতির প্রাণসঞ্চার করতে প্রতিনিয়ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। শুধুমাত্র পণ্য খালাস ও জাহাজীকরণকে চট্টগ্রাম বন্দরের মূল কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হলে এ প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে রয়েছে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর। চট্টগ্রাম বন্দরের হ্যান্ডলিং কার্যক্রমের অর্ধেকের বেশি হয়ে থাকে বহির্নোঙরে আর বাকিটুকু হয় বন্দরের নিজস্ব জেটিতে। বহির্নোঙরে হ্যান্ডলিংয়ের কাজটি করে থাকে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর। শতাংশের হিসেবে মোট কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের প্রায় ৪৫ ভাগ হ্যান্ডলিং করে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর। এককভাবে যদি খোলা পণ্য বা বাল্ক হ্যান্ডলিং হিসেব করা হয় তবে এ অংশীদারিত্ব প্রায় ৭৫ ভাগ।

কর্ণফুলী নদীকে কেন্দ্র করে কয়েকশ বছর আগে গড়ে উঠেছে এ বন্দর। চলন, বলন আর জোয়ার ভাটার কারণে কর্ণফুলীর মনমর্জি বুঝেই চলাচল করতে হয় পণ্যবাহী জাহাজকে। আর নির্দিষ্ট গভীরতার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বেশি ড্রাফটের বড় বড় জাহাজকে (মাদার ভেসেল) অবস্থান করতে হয় বর্হিনোঙ্গরে। ফলে এসব জাহাজকে বন্দরের মূল জেটিতে আনতে কর্ণফুলীর চ্যানেলের নির্দিষ্ট গভীরতায় চলাচল উপযোগী করতে আংশিক পণ্য খালাস কিংবা বহির্নোঙরে পুরো পণ্য খালাসে প্রয়োজন হয় শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরদের। এখান থেকে খালাসকৃত পণ্য লাইটার জাহাজের মাধ্যমে পৌঁছে যায় আমদানিকারকের দুয়ারে। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলরাশির কুতুবদিয়া ও মাতারবাড়ি পর্যন্ত চলে এ কার্যক্রম। বন্দরের মত শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষায় ২৪ ঘন্টা হ্যান্ডলিং কার্যক্রম চলে এখানে।

শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটররা চট্টগ্রাম বন্দরের নিবন্ধিত অপারেটর। দরপত্রের মাধ্যমে ৫ বছরের জন্য নিয়োজিত হয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানগুলো। বর্তমানে ৩০টি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পণ্য খালাসের কাজ করছে। অর্থনীতি ও দেশের চলমান উন্নয়ন কর্মকান্ডের সাথে তাল মিলিয়ে গত কয়েক বছরে চট্টগ্রাম বন্দরে বেড়েছে আমদানির পরিমাণ। এ বিশাল পরিমাণ পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরকে। বিশেষ করে অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য আমদানিকৃত নির্মাণ সামগ্রী যেমন পাথর ও অন্যান্য ভারী যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এ বিশাল পরিমাণ বাড়তি পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে চট্টগ্রাম বন্দরকে আরো বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বন্দরের পাশাপাশি উন্নয়ন প্রকল্পের এ বাড়তি হ্যান্ডলিংয়ের কাজটি করছে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটররা। বাল্ক বা খোলা পণ্যের প্রায় তিন চতুর্থাংশই হ্যান্ডলিং হচ্ছে বহির্নোঙরে। শুধুমাত্র উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য আনা সামগ্রীই নয়, নিয়মিতভাবে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটররা গম, ভুট্টাসহ অন্যান্য ফুড গ্রেইন, রেফশিট, চিনি, সিমেন্ট ক্লিংকার, স্ক্র্যাপ স্টিল, কয়লা ও ভারী যন্ত্রপাতি হ্যান্ডলিং করে আসছে। পদ্মা সেতু, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য আনা ভারি যন্ত্রপাতি হ্যান্ডলিং করে নির্দিষ্ট সময় ও গন্তব্যে পৌঁছে দিতে ভূমিকা রাখে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটররা।

বন্দরের জেটিতে জাহাজ ভিড়িয়ে পণ্য খালাস করতে যেমন নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, তেমনি বহির্নোঙরে পণ্য খালাস করতেও অনুসরণ করতে হয় নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া। শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটররা মূলত আমদানিকৃত খোলা পণ্য খালাস করে থাকে। রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ একেবারেই নগণ্য। আমদানিকারক পণ্য আমদানির জন্য প্রথমে এলসি খোলেন। শিপিং এজেন্ট আমদানিকারকের পক্ষে জাহাজে করে পণ্য আমদানির ঘোষণা দেন। এরপর শিপিং এজেন্টের মনোনীত শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর পণ্য খালাসের প্রক্রিয়া শুরু করেন। শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটররা মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজে পণ্য খালাস করে থাকে। আমদানিকারক শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরকে লাইটার জাহাজ সরবরাহ করে। এজন্য অবশ্য আমদানিকারককে লাইটার জাহাজ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের মাধ্যমে লাইটার বরাদ্দ নিতে হয়। আমদানিকারকের লাইটার জাহাজে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটররা পণ্য খালাসে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, শ্রমিক ও কর্মচারী নিয়ে বহির্নোঙরে যায়। যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে গ্রেভ, স্ক্যাভেটর, পে-লোডার ইত্যাদি। মাদার ভেসেলে পৌঁছে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরের সুপারভাইজার জাহাজের সুপারভাইজার ও ক্যাপ্টেনের সাথে যোগাযোগ করে খালাস প্রক্রিয়া শুরু করেন। এ পর্যায়ে সরকারি কাস্টম ডিউটি ও বন্দরের পাওনা চার্জসমূহ আদায় হয়েছে কিনা যাচাই বাছাই করা হয়। এরপর আমদানিকারক ও জাহাজের সার্ভেয়ার পণ্যের সার্ভে কাজ শেষ করেন। সার্ভে কাজ শেষ হওয়ার পর মাদার ভেসেলের ক্রেন ও শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরদের যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে পণ্য খালাস শুরু হয়।

চট্টগ্রাম বন্দরের নিবন্ধিত শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরদের প্রতিদিন ১০-১২ হাজার টন পণ্য খালাসের সক্ষমতা রয়েছে। বর্তমানে লাইটার জাহাজ সংকটের কারণে সক্ষমতার পুরোটা কাজে লাগানো যাচ্ছেনা। একটি মাদার ভেসেল থেকে পণ্য খালাসে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরদের ১৮-২০ দিন সময় লাগছে। যা লাইটার জাহাজ প্রাপ্তির উপর নির্ভর করে আরো হ্রাস পায়। তবে বহির্নোঙরে পণ্য খালাসের সুবিধার কারণে তা নৌপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যাচ্ছে সহজেই। চট্টগ্রাম বন্দরের বর্হিনোঙ্গরে খালাসকৃত পণ্য লাইটারে করে নারায়ণগঞ্জ, নওয়াপাড়া, খুলনা, বরিশাল ও বগুড়াসহ দেশের নানান প্রান্তে নৌবন্দরগুলোতে তথা আমদানিকারকের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে। এতে একদিকে যেমন অর্থের সাশ্রয় হচ্ছে তেমনি দ্রুততম সময়ের মধ্যে তা পৌঁছে যাচ্ছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে।

চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা

চট্টগ্রাম বন্দর দেশের সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড আবর্তিত হচ্ছে এই বন্দরকে কেন্দ্র করে। কেবল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, কল্যাণমুখী কার্যক্রম ও শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে চট্টগ্রাম বন্দর। ষাটের দশকে যখন চট্টগ্রাম অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না, তখন থেকেই এ অঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে বন্দরে কর্মরতদের পোষ্য এবং আশপাশের এলাকার ছেলেমেয়েদের শিক্ষা বিকাশে ভূমিকা রেখে আসছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ষাটের দশকের একেবারে শেষদিকে ১৯৫৯ সালে ‘পোর্ট ট্রাস্ট হাই স্কুল’ নামে ছেলেদের জন্য একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে কর্তৃপক্ষ, যা এখন বন্দর কর্তৃপক্ষ উচ্চ বিদ্যালয় নামে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। নারীশিক্ষার ক্ষেত্রেও বন্দর কর্তৃপক্ষের ভূমিকা প্রশংসনীয়। পোর্ট ট্রাস্ট হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার ৬ বছর পরেই ১৯৬৫ সালে মেয়েদের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। যেটি এখন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। এই অঞ্চলে নারী শিক্ষা প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার পাশাপাশি নানামুখী সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে প্রতিষ্ঠান দু’টি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল এবং অন্যান্য শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে এ অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি অর্জন করেছে বিদ্যালয় দু’টি।

বন্দর কর্তৃপক্ষ উচ্চ বিদ্যালয়

‘পোর্ট ট্রাস্ট হাই স্কুল’ নামে বিদ্যালয়টি যাত্রা শুরু করে ১৯৫৯ সালে। শুরুর দিকে লাল ইটের ছোট দালানে চলতো স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম। বন্দরে কর্মরতদের সন্তান ও আশেপাশের এলাকায় বসবাসরতদের সন্তানদের প্রায় বিনামূল্যে পাঠদান করা হতো। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত স্কুলটিতে সহশিক্ষা কার্যক্রম চালু ছিল। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে ‘বন্দর কর্তৃপক্ষ উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে ছেলেদের জন্য পৃথক কার্যক্রম শুরু করে। ২০১৩ সালে বিদ্যালয়ের সাথে কলেজের কার্যক্রম শুরু হলেও ২০১৫ সালে তা আবার মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত চার তলা বিশিষ্ট ভবনে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলছে। রয়েছে সুপ্রশস্ত খেলার মাঠ, মাঠের পাশে রয়েছে শহীদ মিনার, ক্যান্টিন ও অত্যাধুনিক অডিটোরিয়াম। এছাড়াও পর্যাপ্ত বই নিয়ে রয়েছে লাইব্রেরি, সুসজ্জিত মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম এবং ৪০টি কম্পিউটার সমৃদ্ধ আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব। ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ৮০০ ছাত্রকে পাঠদানের জন্য আছেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ২৪ জন অভিজ্ঞ শিক্ষক-শিক্ষিকা। জাতীয় দিবসসমূহ উদযাপন, বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা এবং বিতর্ক প্রতিযোগিতার মতো সৃজনশীল আয়োজন ছাড়াও বিদ্যালয়ে রয়েছে রেড ক্রিসেন্ট, বয়স্কাউট ও নৌস্কাউট কার্যক্রম।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে ধারাবাহিক ভালো ফলাফলের মাধ্যমে এ অঞ্চলে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মুকুট ধরে রেখেছে বিদ্যালয়টি। ২০১৩ সালে থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গত ৫ বছরে বিদ্যালয়ের ফলাফল ঈর্ষণীয়। জেএসসি পরীক্ষায় ২০১৬ সালে ১০০ ভাগ এবং সর্বশেষ ২০১৭ সালে ৯৯ দশমিক ৩২ ভাগ। এসএসসির ফলাফলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জিপিএ-৫ সহ পাশের হার এ অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বোচ্চ। ব্যবসায়, বিজ্ঞান ও মানবিক তিন শাখার সম্মিলিত ফলাফলে ২০১৬ ও ২০১৭ সালের পাশের হার যথাক্রমে ৯৭ দশমিক ১৬ ও ৮৮ দশমিক ৩৪ ভাগ। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে জুনিয়র বৃত্তির ক্ষেত্রেও বন্দর কর্তৃপক্ষ উচ্চ বিদ্যালয়ের সাফল্য রয়েছে। ২০১৫ সালে সরকারি পর্যায়ে ৭ জন ও বেসরকারি পর্যায়ে ১৪ জন এবং ২০১৬ সালে সরকারি পর্যায়ে ৪ জন ও বেসরকারি পর্যায়ে ১৬ জন ছাত্র বৃত্তি পেয়েছে।

জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ-২০১৮ তে বন্দর ও বায়েজিদ থানায় শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্মান অর্জন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়

সত্তরের দশকে নারী শিক্ষার জন্য চট্টগ্রামে হাতেগোনা কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। এসময় নারী শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করে বন্দর কর্তৃপক্ষ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। ১৯৬৫ সাল থেকে প্রতিষ্ঠার ৫৩ বছরে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছে বন্দরে কর্মরতদের পোষ্য ও আশেপাশের এলাকায় বসবাসরত মেয়েদের মাঝে। যাদের কেউ কেউ এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে কর্মরত রয়েছেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়েও। মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা নারী মুক্তিযোদ্ধা নূরজাহান বারীও এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

বিদ্যালয়ে মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদানের জন্য রয়েছে সুপরিসর চারতলা বিল্ডিং। এছাড়া লাইব্রেরি, বিজ্ঞানাগার ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম দিচ্ছে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার সকল সুবিধা। চালুর অপেক্ষায় আছে আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব। বিদ্যালয়ে যাতায়াতে শিক্ষক ও ছাত্রীদের জন্য রয়েছে নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা। বন্দরে কর্মরতদের পোষ্য ও বহিরাগতসহ প্রায় ৯০০ ছাত্রীর পাঠদানের জন্য রয়েছেন ১৮ জন অভিজ্ঞ শিক্ষক। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে বন্দর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা জাতীয় পর্যায়ে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে প্রতিষ্ঠানের জন্য বয়ে আনছে সম্মান। জাতীয় দিবস সমূহ উদযাপন ছাড়াও বিদ্যালয়ে সারা বছর ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক ও বিতর্ক প্রতিযোগিতাসহ ছাত্রীদের নিয়ে আয়োজন করা হয় সৃজনশীল বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতার।

ফলাফল, লেখাপড়ার মান ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের জন্য ২০১৬ ও ২০১৭ সালে থানা ভিত্তিক শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্মান অর্জন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা রফিয়া খাতুন ২০১৬ সাল থেকে টানা তিনবার থানা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হওয়ার সম্মান অর্জন করেছেন। এছাড়াও ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৯ জন ছাত্রী থানা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী নির্বাচিত হয়েছেন এবং ১ জন জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছেন। আঞ্চলিক পর্যায়ে আয়োজিত বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও বিজ্ঞান মেলায় অংশ নিয়ে ১ম স্থানসহ একাধিক পুরস্কার অর্জন করেছে বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ছাত্রীরা।

গত ৫ বছরের জেএসসি পরীক্ষার ফলাফলে গড়ে প্রতি বছর শতকরা ৯৮ ভাগ শিক্ষার্থী ও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে প্রতিবছর গড়ে শতকরা ৯৩ ভাগ শিক্ষার্থী কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছে। ২০১৬ সালে জেএসসি পরীক্ষায় শতকরা ১০০ ভাগ এবং ২০১৭ সালে ৯৯ দশমিক ৩৫ ভাগ শিক্ষার্থী পাশ করেছে। এসএসসির ফলাফলে ২০১৬ সালে ৯৩ দশমিক ১৭ ভাগ ও ২০১৭ সালে ৯৫ দশমিক ০৪ ভাগ ছাত্রী পাস করেছে। জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় গত ৪ বছরে ৯৪ জন ছাত্রী বৃত্তি পেয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে সরকারি পর্যায়ে ৮ জন ও বেসরকারি পর্যায়ে ২০ জন এবং ২০১৬ সালে সরকারি পর্যায়ে ৩ জন ও বেসরকারি পর্যায়ে ২২ জন ছাত্রী বৃত্তি পেয়েছে।

সিএন্ডএফ এজেন্ট

ভৌগলিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ইত্যাদি কারণে বিশ্বের কোনো দেশই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল ও অন্যান্য অনেক পণ্যের চাহিদা পূরণেই একটি দেশকে নির্ভর করতে হয় অন্য দেশের উপর। আবার কখনো কোনো পণ্য চাহিদার অতিরিক্ত উৎপাদনের ফলে উদ্বৃত্ত রয়ে যায়। চাহিদা ও যোগানের এ বিপরীতমুখী আচরণের কারণে সৃষ্টি হয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্যের।

সময়ের সাথে সাথে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে স্থানীয় বাজারে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে, উন্নয়ন কর্মকান্ডের জন্য নানাবিধ সামগ্রীর চাহিদা বেড়েছে। বাংলাদেশ যেমন সস্তা ও দক্ষ শ্রমিকের কারণে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্পে উন্নতি লাভ করেছে। তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অনুকূল সুযোগ সুবিধার কারণে ভিন্ন ভিন্ন শিল্পখাতে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। ফলে বেড়েছে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ব্যাপ্তি। সড়ক, রেল, বিমান কিংবা সমুদ্র যে পথেই পণ্য আমদানি-রপ্তানি হোক না কেনো, তাকে নির্দিষ্ট কিছু আইন-কানুন মেনে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়। আমদানি ও রপ্তানি প্রক্রিয়াতে আপাত দৃষ্টিতে শুধু আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকের ভূমিকা দৃশ্যমান হলেও এর পেছনে রয়েছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। আমদানি কিংবা রপ্তানির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বৃত্তাকারে যদি রূপরেখা আঁকা হয় তবে দেখা যাবে এর উল্লেখযোগ্য অংশে রয়েছে সিএন্ডএফ এজেন্ট। আমদানি পণ্য সমুদ্র বন্দর, স্থল বন্দর কিংবা নৌবন্দর থেকে আমদানিকারকের দৌরগোড়া পর্যন্ত পৌঁছানো এবং রপ্তানি পণ্য কারখানা থেকে বিদেশে পাঠানোর জন্য জাহাজে ওঠানে কিংবা অন্য কোনো বাহনে বোঝাই করা পর্যন্ত আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকের পক্ষে যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে সিএন্ডএফ এজেন্ট। এক কথায় বৈদেশিক বাণিজ্যে ব্যবসায়ী, বন্দর ও কাস্টম কর্তৃপক্ষের সাথে সেতুবন্ধনের কাজ করে সিএন্ডএফ এজেন্ট।

আমরা যদি আমদানিকারকের পক্ষে সিএন্ডএফ এজেন্টের ভূমিকার কথা ধরি তাহলে পণ্য পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে বন্দরে কিংবা বন্দরের আওতায় আসার পর থেকে কাজ শুরু হয় সিএন্ডএফ এজেন্টদের। এসময় আমদানিকারক সিএন্ডএফ এজেন্টের কাছে আমদানি পণ্য খালাসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে এলসি, প্যাকিং লিস্ট, আইজিএম (ইমপোর্ট জেনারেল ম্যানুফেস্ট), কনটেইনারের বিবরণ, চালান ইত্যাদি প্রয়োজনীয় দলিলাদি। বিল অব ইমপোর্টে প্রয়োজনীয় তথ্যবলী পূরণ করে কাস্টমসে দাখিল করে সিএন্ডএফ এজেন্ট। এরপর কাস্টমসের এসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে তথ্যাবলি ইনপুট দিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি রেজিস্ট্রেশন নম্বর প্রদান করে। যার মাধ্যমে পণ্য আমদানির ঘোষণা দেওয়া হয়। এ পর্যায় পর্যন্ত কাজ সিএন্ডএফ এজেন্ট তার অফিসে বসেই করতে পারে। এরপর বিল অব এন্ট্রিতে বা ইমপোর্টে দেয়া তথ্যের সমর্থনে প্রয়োজনীয় দলিলাদি উপস্থাপন করতে হয় কাস্টম হাউজে। এর ভিত্তিতে কাস্টম হাউজ পণ্যের এসেসমেন্ট করে। তবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোনো কনটেইনার যদি রেড মার্কড হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে কনটেইনারের পণ্য কায়িক পরীক্ষার পর এসেসমেন্ট করা হয়। সিএন্ডএফ এজেন্ট আমদানিকারকের পক্ষে কায়িক পরীক্ষাকালে উপস্থিত থাকেন। কাস্টম কর্তৃপক্ষ কায়িক পরীক্ষায় সন্তুষ্ট হলে অর্থ্যাৎ বিবরণ অনুযায়ী পণ্য পেলে ছাড়পত্র দিয়ে থাকেন। কায়িক পরীক্ষা শেষে এসেসমেন্ট সেকশনে পণ্যের এইচএস (হারমোনাইজড সিস্টেম) কোড দেওয়ার পর পণ্যের শুল্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ধারিত হয়ে থাকে। সঠিক এইচএস কোড দেওয়া হয়েছে কিনা তা এ পর্যায়ে পরীক্ষা করে কাস্টম কর্তৃপক্ষ। কাস্টমের ট্রেজারি সেকশনে (সোনালী ব্যাংকে) শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। শুল্ক পরিশোধের পর ট্রেজারি সেকশন থেকে রিলিজ অর্ডার দেওয়া হয়। যা কাস্টম কর্তৃক পণ্য খালাসের ছাড়পত্র। এ পর্যায়ে বন্দর থেকে পণ্য খালাসের জন্য শিপিং এজেন্টের কাছ থেকে ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) গ্রহণ করে সিএন্ডএফ এজেন্ট। তবে একই কনটেইনারে যদি একাধিক আমদানিকারকের পণ্য এসে থাকে সেক্ষেত্রে পণ্য খালাসে ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারের কাছ থেকে এনওসি  (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) নিতে হয়। এরপর সিএন্ডএফ এজেন্টকে যেতে হয় বন্দরের ওয়ান স্টপ সার্ভিসে। এখানে এ পর্যন্ত নেয়া সকল ছাড়পত্র যাচাই বাছাই করে কনটেইনার সার্টিফাইড করা হয়। এরপর বন্দরের ইয়ার্ড থেকে কনটেইনার নামানোর জন্য ইনডেন্ট দেয় সিএন্ডএফ এজেন্ট। কনটেইনার কিপডাউন হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে কনটেইনার খোলা হয় পণ্য আনস্টাফিং করার জন্য। তবে এর আগে প্রয়োজনীয় সংখ্যক লেবার বুকিং দেয়া হয়। এরপর ট্রাকে বা কাভার্ড ভ্যানে পণ্য বোঝাই করা হয়। বোঝাইকৃত পণ্য চূড়ান্তভাবে বন্দর থেকে নিয়ে যেতে বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগ থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। বন্দরের গেটে এই ছাড়পত্র প্রদর্শন করে পণ্য খালাস করে আমদানিকারকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে ৩৭টি বিশেষায়িত পণ্য প্রাইভেট আইসিডি থেকে খালাস করা হয়। সেক্ষেত্রেও একই ধরনের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমদানিকারক কনটেইনার অন চেসিস (সরাসরি জাহাজ থেকে ডেলিভারি) ডেলিভারি নিয়ে নিজস্ব ইয়ার্ডে পণ্য আনস্টাফিং করার সুযোগ পায়। এক্ষেত্রে কাস্টম হাউজ থেকে সিএন্ডএফ রিস্ক বন্ড নেয় আমদানিকারকের পক্ষে। বিশেষ করে শিল্পপণ্যের ক্ষেত্রে এমন হয়ে থাকে।

রপ্তানির ক্ষেত্রেও পণ্য কারখানা থেকে বের হওয়ার পর থেকে জাহাজে ওঠানো পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটি সিএন্ডএফ এজেন্ট সম্পন্ন করে। রপ্তানির প্রায় শতভাগ বেসরকারি আইসিডির মাধ্যমে হ্যান্ডলিং হয়ে থাকে। পণ্য রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেওয়ার পর সিএন্ডএফ এজেন্ট ডাটা-শিট তৈরি করে এসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে  দেয়। এরপর বেসরকারি আইসিডিতে থাকা কাস্টম হাউজের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা পণ্যের এসেসমেন্ট করে থাকেন। পণ্যের নির্ধারিত শুল্ক পরিশোধ শেষে কাস্টম থেকে পণ্যের শিপমেন্ট করার অনুমতি নেওয়া হয় এবং কাস্টম কর্মকর্তার উপস্থিতিতে পণ্য কনটেইনারে বোঝাই করা হয়। শিপমেন্টের অনুমতি পাওয়ার পর তা বেসরকারি আইসিডির কাছে তুলে দেওয়া হয় শিপমেন্টের জন্য। এখান থেকে আইসিডিগুলো রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার বন্দরে নিয়ে রপ্তানি কনটেইনারের জন্য নির্ধারিত ইয়ার্ডে নিয়ে যায়, যেখান থেকে শিডিউল অনুযায়ী তা জাহাজে তোলা হয়। আর এভাবেই হাজার মাইল দূরে আমদানিকারকের দুয়ারে পৌঁছে যাচ্ছে দেশে উৎপাদিত পণ্য কিংবা বিদেশ থেকে পণ্য এসে মেটাচ্ছে দেশের চাহিদা। এতে বেগবান হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকা। এই পুরো প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে থাকে সিএন্ডএফ এজেন্ট।

বিশ্ব মেরিটাইম দিবস

নৌবাণিজ্য, বন্দর এবং এর পরিচালন কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে পুরো মেরিটাইম খাত। মেরিটাইম সংশ্লিষ্ট চাকরি বৃদ্ধি, কর্মরতদের জীবনমানে উন্নয়ন এবং স্থিতি এনে দিতে এই খাত সমুদ্র পথে বাণিজ্য প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। সমুদ্র এবং ভূমি উভয় ক্ষেত্রে টেকসই ব্লু ইকোনমির বিস্তারে বন্দর এবং মেরিটাইম খাতকে সম্পদ তৈরির মাধ্যম হিসাবে নিজেদের মান বাড়াতে হবে। এটিই প্রধান বার্তা হিসেবে আজ ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে। 

‘একসুত্রে জাহাজ, বন্দর এবং জনগণ’ এই স্লোগানকে প্রতিপাদ্য করে গত ২৮ সেপ্টেম্বর ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও) এবং বৈশ্বিক নৌবাণিজ্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কনফারেন্স, সেমিনার, কর্মশালাসহ নানাবিধ কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে পালন করলো বিশ্ব মেরিটাইম দিবস। আইএমও এর সদস্যসমূহ নৌ যোগাযোগ, অবকাঠামোগত সুবিধা  এবং অন্যান্য সমস্যা মোকাবেলায় যেন একসাথে কাজ করতে পারে, সেটির উপরে জোর দেয়া দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য। জাতিসংঘের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসংগঠন হিসেবে আইএমও মেরিটাইম খাতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বদ্ধপরিকর।

বিশ্ব মেরিটাইম দিবস জাতিসংঘের স্বীকৃত একটি দিন –  নৌবাণিজ্যখাত, আইএমও এর নানাদিক এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট নৌবাণিজ্যিক কর্মকান্ড স¤পর্কে বিশ্ববাসীকে একটি স্বচ্ছ ধারণা দিতে প্রতিবছর দিনটি পালিত হয়ে থাকে। বিশ্ব মেরিটাইম দিবস ২০১৭ এর মূল বক্তব্য অনুযায়ী, বন্দর এবং জাহাজসমূহের মধ্যবর্তী দ্বিপাক্ষিক স¤পর্ক উন্নয়নে যেমন জোর দেয়া হবে, একই সাথে নিরাপদ, নিশ্চিত এবং কার্যকর নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সামনের দিনগুলোতে আইএমও রাখতে চলেছে আরও ফলপ্রসূ ভূমিকা। প্রথাগতভাবে, এদিন আইএমওর প্রধান কার্যালয়ে মেরিটাইম শিক্ষার্থী এবং তরুণ পেশাজীবীদের নিয়ে একটি ডিপ্লোমেটিক রিসিপশন এর আয়োজন করা হয়ে থাকে। নৌবাণিজ্য নির্বিঘœ রাখতে আইএমও’র নেয়া নিরাপত্তা, প্রকৌশলগত ও জনকল্যানমুখী নানা পদক্ষেপের সাথে তাঁরা পরিচিত হন। এরপর আইএমও সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বন্দর, সমুদ্রযাত্রা বিষয়ক অভিজ্ঞতার বিনিময় এবং অপারেশনাল কর্মকান্ডকে অধিকতর গতিশীল করে তোলার উদ্দেশ্যে এক প্রাণবন্ত আলোচনা সভার আয়োজন ছিল। এছাড়া দিবসটি উপলক্ষে আইএমও সদস্য রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক মনোনীত মেরিটাইম প্রতিনিধিদের সভাও অনুষ্ঠিত হয়।    

অনলাইন মিডিয়া এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবারের বিশ্ব মেরিটাইম দিবস এর কার্যক্রম বেশ জোরেশোরে দেখা গেছে। এমনকি, নিউইয়র্কের হেড কোয়ার্টার থেকে জাতিসংঘের ওয়েবসাইটের মূলপাতায় এসডিজি অর্জনে আইএমও এবং শিপিং সেক্টরের ভূমিকার গুরুত্ব তুলে ধরে বিস্তারিত রিপোর্ট করা হয়েছে।

প্রতিবছর আইএমও এই দিনটির ‘প্যারালাল ইভেন্ট’ পালনের উদ্দেশ্যে একটি দেশকে নির্বাচিত করে। ২০১৭ সালের জন্য দেশটি ছিল পানামা। অক্টোবরের ১ থেকে ৩ তারিখে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে আমেরিকান দেশ পানামা পালন করেছে বিশ্ব মেরিটাইম দিবসের প্যারালাল ইভেন্ট। এবারের থিম, ‘একসূত্রে জাহাজ, বন্দর এবং জনগণ’, কথাটি আইএমও’র এ ক্যাটাগরির সদস্য রাষ্ট্র পানামার ক্ষেত্রে খুবই প্রযোজ্য। লাতিন বন্দরগুলোর মূল কেন্দ্র হিসেবে পানামা খাল এবং সবচেয়ে বেশি বাণিজ্যতরী পানামার পতাকাবাহী হওয়ায় বিশ্ববাণিজ্যে দেশটির অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাকতালীয়ভাবে, বিশ্ব মেরিটাইম দিবস এর উদযাপনের সাথে একই বিন্দুতে মিলে গেছে পানামার আন্তর্জাতিক জাহাজ রেজিস্ট্রির শততম বছরের আনন্দ উৎসব। জাহাজ পরিবর্তন বা স্থলপথে পরিবহন, যেকোনো প্রয়োজন নিয়ে কোনো জাহাজ যখনই বন্দরে আসে, তাকে স্বাগত জানাচ্ছে পানামা। মূল উদ্দেশ্য সেই একটিই, সাধারণ জনগনের কাছে দ্রুততম সময়ে পণ্য পৌঁছে দেয়া।  

অপরদিকে, পরিবেশে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনতে যে উচ্চাকাক্সক্ষী পরিকল্পনা আইএমও এর হাতে আছে, তা বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক প্রত্যাশার চাপ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সকলের আশাবাদ, প্যারিস জলবায়ু চুক্তির সরাসরি সমর্থনকারী প্রাথমিক কৌশলপত্রটি পরবর্তী বছরের মধ্যেই সর্বত্র গৃহীত হবে। অথচ এসবই করতে হবে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিশ্ববাণিজ্যে যে বিপুল পরিমাণ পণ্য স্থানান্তর হচ্ছে বা হতে চলেছে, তাতে এতটুকু ব্যাঘাত না ঘটিয়ে, যদিও আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যবস্থার ৯০ শতাংশই হয় সমুদ্রপথে। আসলে, বৈশ্বিক শিপিং খাতে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন কমিয়ে আনার জন্য সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে আইএমও। এ কারণে সমুদ্র-বাণিজ্যের বিভিন্ন খাতে জলবায়ু বিষয়ক যে সকল অগ্রগতি হয়েছে তা ধরে রাখতে এবং এগিয়ে নিতে আইএমও এর এই নিয়ন্ত্রণ জরুরিও বটে। বিমকো, ইন্টারকার্গো এবং ইন্টারট্যাঙ্কো এর মতো শিপিং জোটগুলোর সাথে মিলে আইসিএস (ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অফ শিপিং) গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনতে সম্ভাব্য পদক্ষেপসমূহ উল্লেখ করে বিস্তারিত একটি প্রস্তাবনা সম্প্রতি আইএমওর কাছে উপস্থাপন করেছে। সংগঠনগুলোর মতে, বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা যেন অবশ্যই বিপদসীমার নিচে থাকে, সে উদ্দেশ্যে আইএমও এর সকল সদস্যদের একমত হওয়া উচিত। অবশ্য ২০৫০ সালের মধ্যে ২০০৮ এর তুলনায় কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কতখানি নিচে নামিয়ে আনা প্রয়োজন, এ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজটি করতে হবে আইএমও’কেই, মাথায় রাখতে হবে উন্নয়নশীল দেশসমূহের বাণিজ্যিক ও শিল্প উন্নয়নের ন্যায়সঙ্গত প্রভাবও। আন্তর্জাতিক নৌবাণিজ্য শিল্প সংশ্লিষ্টরাও ওয়াকিবহাল যে, আইএমও যত দ্রুত সম্ভব কার্বন কমিয়ে আনতে কাজ করে চলেছে। নিজেদের কর্মপরিকল্পনা এবং সদিচ্ছা নিয়ে এখন বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর এগিয়ে আসার পালা।

বিশ্ব মেরিটাইম দিবসের বিভিন কার্যক্রম থেকে নিশ্চিত আভাস পাওয়া যায় যে, মেরিটাইম খাতের সকল অংশে  সমন্বিত ও সার্বিক উন্নয়নের গুরুত্ব তুলে ধরতে সামনের দিনগুলোতে আইএমও আরো জোরালো ভূমিকা রাখবে।

– বন্দরবার্তা প্রতিবেদন

চট্টগ্রাম বন্দরে স্বাস্থ্যসেবা

সময়কাল ষাটের দশকের একেবারে শেষভাগ। রেল-পোর্ট ট্রাস্ট পৃথক হয়ে রেলওয়ে ও পোর্ট দু’টি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পৃথক হওয়ার সাথে সাথে পর্যায়ক্রমে একীভূত সকল সেবা কার্যক্রমও পৃথক হতে থাকে। একসময় রেলওয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সদরঘাটে পোর্ট কমিশনার অফিসে ছোট পরিসরে চালু করা হয় ডিসপেন্সারি। এখানেই আউটডোরে সেবা প্রদানের মাধ্যমে বন্দরের চিকিৎসাসেবার সূচনা হয়। এরপর আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম। ১৯৬২ সালে বন্দর স্টেডিয়াম সংলগ্ন স্থানে (বর্তমানে পুলিশ লাইন) চালু হয় ইনডোর সুবিধাসহ ১২ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল। এরপর ১৯৬৫ সালে ৩০ শয্যা ও ১৯৬৭ সালে ৭০ শয্যায় উন্নীত করা হয় হাসপাতালটিকে। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় দেশের সকল উন্নয়ন কাজ বন্ধ হয়ে গেলে হাসপাতাল উন্নয়নের কাজও বন্ধ হয়ে যায়। পরে অবশ্য কাজ পুনরায় শুরু হয়। এসময় হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বন্দরের তৎকালীন প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. কামাল এ খান। ১৯৬৮ সালে বন্দর ভবনের পশ্চিম পার্শ্বে ৫ একর জায়গার উপর নির্মাণ করা হয় এইচ আকৃতির ভবন যা ১৯৮৪ সালে দ্বিতল করার মাধ্যমে ১৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকে বন্দরের চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম। শুধুমাত্র কর্মকর্তা-কর্মচারী নয় শ্রমিকদের জন্যও ছিল পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা। ১৯৮০ সালে ডক শ্রমিক ব্যবস্থাপনা বোর্ড গঠিত হওয়ার সাথে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় ডক শ্রমিক ব্যবস্থাপনা হাসপাতাল। ২০০৮ সালে ডক শ্রমিক ব্যবস্থাপনা বোর্ড বিলুপ্তি হলে হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০১১ সালের জুলাইয়ে বন্দরের ৩ নং জেটি গেটে নতুন করে চালু হয় বন্দর শ্রমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র।

বন্দরের উৎপাদনশীলতার সাথে বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বাস্থ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মক্ষম রাখতে ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে বন্দর কর্তৃপক্ষের রয়েছে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা। একসময় ১২ শয্যা নিয়ে শুরু করা হাসপাতাল এখন ১৫০ শয্যার হাসপাতাল। নির্মাণাধীন রয়েছে চারতলা বিশিষ্ট ৫ ব্লকের আধুনিক হাসপাতাল, যা পুরোদমে চালু হলে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে বন্দরের স্বাস্থ্যসেবা।

হাসপাতালে রয়েছে সকল স্বাস্থ্যসেবা

চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতালে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের পোষ্যদের আউটডোর এবং ইনডোরে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়। এছাড়া বহিরাগত রোগীদের দেয়া হয় প্রাথমিক চিকিৎসা। এখানে রয়েছে মেডিসিন বিভাগ, সার্জারি বিভাগ, দন্ত বিভাগ, চক্ষু বিভাগ, গাইনী বিভাগ এবং নাক-কান-গলা বিভাগ। প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার অধীনে বর্তমানে ২৭ জন অভিজ্ঞ চিকিৎসক কর্মরত রয়েছেন চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে। হাসপাতালের আউটডোর ও ইনডোরে নাক-কান-গলা, চক্ষু, অর্থোপেডিক্স, জেনারেল, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, শিশু, গাইনী ও ডায়াবেটিসের চিকিৎসা দেয়া হয়। এছাড়াও আউটডোরে রয়েছে নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞের চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ। ইনডোরে পুরুষদের জন্য মেডিকেল ওয়ার্ড, সার্জিক্যাল ওয়ার্ড এবং মহিলাদের জন্য মহিলা ওয়ার্ড ও গাইনী ওয়ার্ড ও কেবিন।

থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য বন্দর হাসপাতালে সরকার কর্তৃক অনুমোদিত নিরাপদ রক্তপরিসঞ্চালন কেন্দ্র রয়েছে। যেখানে থ্যালাসেমিয়া রোগীরা ছাড়াও রক্তশূণ্যতা এবং ক্যান্সারসহ অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীরা রক্তপরিসঞ্চালন সেবা পান।  ফিজিওথেরাপি ইউনিটে পক্ষাঘাতগ্রস্থ ও ব্যথাজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য রয়েছে নিয়মিত ফিজিওথেরাপি নেয়ার সুযোগ। যক্ষা রোগীদের জন্য রয়েছে ব্র্যাক কর্তৃক পরিচালিত যক্ষারোগ নির্ণয়, চিকিৎসা ওষুধ বিতরণ কেন্দ্র। কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং তাদের পোষ্যরা ছাড়াও বন্দর এলাকার মানুষ এখানে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ পেয়ে থাকেন। হেপাটাইটিস বি ও জরায়ুর ক্যান্সারের টীকা দেয়া হয় বন্দর হাসপাতালের টীকা কেন্দ্রে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শিশু ও বন্দর এলাকার শিশুদের জন্য সিটি করপোরেশন কর্তৃক সরবরাকৃত টীকা দেওয়ার জন্য একটি ইপিআই সেন্টার রয়েছে। সিটি করপোরেশনের একজন টীকাদানকারী এই কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

রোগীদের যে কোন সাধারণ ও জটিল অপারেশনের জন্য রয়েছে অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার। এনেসথেশিয়া বিশেষজ্ঞসহ অভিজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন অপারেশন করার জন্য। প্রয়োজনে অন্য হাসপাতাল থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এনে অপারেশনের ব্যবস্থাও রয়েছে। রোগ নিরূপণের জন্য হাসপাতালে রয়েছে আধুনিক প্যাথলজি ও এক্সরে ইউনিট। স্বল্প পরিসরে হৃদরোগীদের জন্য চালু আছে সিসিইউ ইউনিট।

এছাড়া কিডনি হেমো ডায়ালাইসিস ইউনিট, ক্যান্সার রোগীদের সার্বিক সেবা ও পরিবার পরিকল্পনা ইউনিট রয়েছে এখানে।

যেভাবে সেবা দেয়া হয়

চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতালের আউটডোরে রয়েছে টিকেট কাউন্টার। টিকেট কাউন্টারে টিকেট সহকারী রোগীর নাম এন্ট্রি করার পর রোগীর সমস্যা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের কাছে প্রেরণ করেন। টিকেটের ক্রমানুযায়ী রোগীরা চিকিৎসা নেন। জরুরি বিভাগে একজন মেডিকেল অফিসার সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন। প্রাথমিক চিকিৎসায় রোগীর উন্নতি না হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ইনডোর চিকিৎসকের কাছে রেফার করেন। তখন ইনডোর চিকিৎসক রোগীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করেন। হাসপাতালের আউটডোরে প্রতিদিন গড়ে ৬০০-৭০০ রোগী চিকিৎসা নেন এবং ইনডোরে ভর্তি থাকেন গড়ে ১০০-১৫০ জন রোগী।

সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সকল চিকিৎসাসেবা ওষুধ

বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বন্দর হাসপাতালের ইনডোর ও আউটডোরসহ সকল চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ বিনামূল্যে পেয়ে থাকেন। রোগ নিরূপণী কেন্দ্রের সকল সেবাও বিনামূল্যে দেয়া হয়। ভর্তি রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসকের দেয়া কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা যদি বন্দর হাসপাতালে না থেকে থাকে সেক্ষেত্রে অন্য  কোনো রোগ নিরূপণী কেন্দ্র হতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সকল অর্থ বন্দর কর্তৃপক্ষ বহন করে। চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী বন্দর হাসপাতাল থেকে দেয়া হয় প্রয়োজনীয় সকল ওষুধ।

সার্বক্ষণিক অ্যাম্বুলেন্স সেবা

দুর্ঘটনাক্রান্ত ও মুমূর্ষু রোগীদের দ্রুততম সময়ে হাসপাতালে নিয়ে আসতে এবং অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করতে রয়েছে সার্বক্ষণিক অ্যাম্বুলেন্স সেবা। ২টি আধুনিক অ্যাম্বুলেন্সসহ রয়েছে একটি অত্যাধুনিক আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স। আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স পরিচালনায় একটি নীতিমালা তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া বন্দরের চ্যানেলে কিংবা বহির্নোঙরে দুুর্ঘটনাক্রান্ত ও অসুস্থ নাবিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনে রয়েছে অ্যাম্বুলেন্স শিপ। অত্যাধুনিক ও দ্রুত গতিসম্পন্ন এ শিপে রয়েছে প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা।

উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা

চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন স্থাপনা, দপ্তর, আবাসিক ও অনাবাসিক এলাকাসমূহ নিয়মিত পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য রয়েছে স্যানিটেশন বিভাগ। বন্দর হাসপাতালের অধীনে পরিচালিত হয় এ বিভাগ। বন্দরের সকল এলাকা নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার পাশাপাশি এন্টিম্যালেরিয়া অভিযান পরিচালনা করে স্যানিটেশন বিভাগ। এ বিভাগে কর্মরত রয়েছে প্রায় ২০০ জন।

বন্দর শ্রমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র

ডক শ্রমিক ম্যানেজমেন্ট বোর্ড বিলুপ্ত হওয়ার পর বন্দরের ইয়ার্ড, জেটি এবং মুরিংয়ে বার্থ ও টার্মিনাল অপারেটরদের নিয়োগকৃত শ্রমিকরাই কাজ করেন। বন্দরের কাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ শ্রমিক। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও দুর্ঘটনায় প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানে বন্দর শ্রমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে রয়েছে প্রয়োজনীয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা। বন্দরের ৩ নম্বর জেটি গেটে অবস্থিত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রটি বন্দরের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তার অধীনে পরিচালিত হয়। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে শুধুমাত্র আউটডোরে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ দেয়া হয়। চারজন চিকিৎসক শিফ্ট অনুযায়ী সার্বক্ষণিক চিকিৎসাসেবা দেন। বন্দর হাসপাতালের মতো এখানেও রয়েছে সার্বক্ষণিক অ্যাম্বুলেন্স সেবা। ‘শ্রমিক স্বাস্থ্যসেবা তহবিল’ থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সকল ব্যয় নির্বাহ করা হয়ে থাকে। সম্প্রতি বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান একটি অ্যাম্বুলেন্স প্রদান করেছেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে। বর্তমানে এখানে ২টি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

চট্টগ্রাম বন্দরের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম মূলত বন্দর হাসপাতালকে ঘিরে। বন্দরের পরিধি বৃদ্ধির সাথে বাড়ছে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা। এ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বাড়ানো হচ্ছে হাসপাতালের কলেবর। চারতলা বিশিষ্ট আধুনিক হাসপাতাল ভবন নির্মাণের কাজ একেবারে শেষ পর্যায়ে। কাজ শেষ হলে এখানে নিয়মিত সেবাগুলোর পাশাপাশি চালু করা হবে সিসিইউ ও আইসিইউ। এছাড়া ১৫০ শয্যা থেকে ২০০ শয্যায় উন্নীত করার পরিকল্পনাও রয়েছে কর্তৃপক্ষের।