Home Blog Page 249

বন্দরে আধুনিক স্পোর্টস কমপ্লেক্স

চট্টগ্রাম বন্দর হলো নগরের ভেতর আরেক নগর। বন্দরের অবকাঠামোর বাইরে কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার জন্য রয়েছে সকল নাগরিক সুবিধা। থাকার জন্য বাসাবাড়ি, ছেলে মেয়েদের পড়ালেখার জন্য স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা আর চিকিৎসার জন্য রয়েছে আধুনিক হাসপাতাল। সেখানে খেলাধুলার ব্যবস্থা থাকবেনা তা কি করে হয়। শিশু-কিশোরদের নিয়মিত ক্রীড়া চর্চার মাধ্যমে মানসিকভাবে উৎফুল্ল ও সুস্থ-সবল রাখার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক স্পোর্টস কমপ্লেক্স। রয়েছে আধুনিক সুযোগ সুবিধাসহ ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, বাস্কেটবল ও দাবা প্রশিক্ষণের সুযোগ। যা চট্টগ্রাম থেকে জাতীয় পর্যায়ের ক্রীড়াবিদ তৈরির প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে বলে সংশ্লিষ্ট সকলের আশা।

বন্দর স্পোর্টস কমপ্লেক্সের যাত্রা শুরু হয় ২০১৫ সালে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তৎকালীন চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ এর ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেন। পরবর্তী বছর অর্থ্যাৎ ২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করেন নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান এমপি।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানেরা ছাড়াও ক্রীড়া অনুরাগী অন্য শিশু-কিশোররাও প্রশিক্ষণ নিতে পারেন এখানে। বয়স ও শ্রেণিভেদে শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা প্রশিক্ষণের সুযোগ। ১ম থেকে ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী আর ৬ষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পৃথকভাবে প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে। প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য রয়েছে ২৪ হাজার বর্গফুটের আউটডোর ও ২২ হাজার বর্গফুটের ইনডোর স্পোর্টস জোন। আউটডোরে প্রাথমিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা ক্রিকেট ও ফুটবল অনুশীলন করে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা অনুশীলন করে কমপ্লেক্সের সাথে লাগোয়া বন্দর স্টেডিয়ামে। ক্রিকেট ও ফুটবল অনুশীলনের জন্য স্টেডিয়ামে নির্ধারণ করা আছে আলাদা আলাদা জায়গা।

স্পোর্টস কমপ্লেক্সের ইনডোর জোন একদিকে যেমন দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা হয়েছে, তেমনি সমৃদ্ধ আধুনিক সব ক্রীড়া সরঞ্জামে। এখানে রয়েছে দুটি করে টেবিল টেনিস ও ব্যাডমিন্টন কোর্ট এবং একটি করে বাস্কেট বল ও ভলিবল কোর্ট। এছাড়াও রয়েছে ক্রিকেট অনুশীলনের জন্য আন্তর্জাতিক মানের কৃত্রিম টার্ফ। যেখানে আন্তর্জাতিক ম্যাচে অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়রাও স্বাচ্ছন্দ্যেই অনুশীলন করতে পারবে। প্রশিক্ষণার্থীরা ছাড়াও বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সন্ধ্যার পর কমপ্লেক্সে খেলাধুলা করতে পারেন।

ক্রীড়া সরঞ্জামের পাশাপাশি অন্যান্য সকল সুযোগ সুবিধা রয়েছে ইনডোর জোনে। জোনের একপাশে তিনতলা ভবনের নীচতলায় রয়েছে ছেলে ও মেয়েদের জন্য পৃথক ড্রেসিং রুম। রয়েছে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ও আধুনিক সরঞ্জাম সমৃদ্ধ ব্যায়ামাগার। যা শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তাদের অভিভাবকরাও ব্যবহার করতে পারেন। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে শিক্ষার্থীদের পাঠদান কক্ষ, সভা কক্ষ, প্রধান উপদেষ্টা, পরিচালক, উপ-পরিচালক, দাবা প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত কক্ষসমূহ। তৃতীয় তলা ব্যবহৃত হয় অভিভাবক সমাবেশ ও সেমিনার আয়োজনে, যেখানে আগামীতে কারাতে প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা রয়েছে।

স্পোর্টস কমপ্লেক্স শুধু শিক্ষার্থীদের দক্ষ ক্রীড়াবিদ হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছে এমন নয়। ক্রীড়া চর্চার বাইরে নিয়মিত মনিটরিং করছে স্বাস্থ্য ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য স্পোর্টস কমপ্লেক্স কার্যালয়ের একটি কক্ষে রয়েছে উন্নতমানের হালকা খাবার ও কোমল পানীয়ের ব্যবস্থা। অপরকক্ষে রয়েছে হিট স্ট্রোক এন্ড ট্রমা সেন্টার, যেখানে যাবতীয় ওষুধসহ সকল চিকিৎসা সেবা মেলে। অনুশীলনের সময় কেউ আঘাতপ্রাপ্ত হলে চিকিৎসা দিতে রয়েছেন স্পোর্টস মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। প্রশিক্ষণার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমে যাতে কোনো ব্যঘাত না ঘটে সেজন্য প্রতিদিন বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ও সপ্তাহে তিন দিন করে (শনি, সোম, বুধ ও রবি, মঙ্গল, বৃহস্পতি) দুই শিফটে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণার্থীদের প্রত্যেক একাডেমিক পরীক্ষার ফলাফল বিবরণী জমা দিতে হয় কমপ্লেক্সে। ফলাফল বিবেচনায় তা নেতিবাচক হলে ছয় মাস পর্যন্ত প্রশিক্ষণ থেকে বিরত রাখার বিধান রয়েছে। এছাড়া তাদের খেলাধুলা, পড়ালেখা ও স্বাস্থ্যের উন্নতিকল্পে নিয়মিত অভিভাবক সমাবেশের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ ও নির্দেশনা প্রদান করা হয়।

স্পোর্টস কমপ্লেক্সে ভর্তি হতে নির্দিষ্ট ফর্মে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান পূর্বক আবেদন করতে হয় আগ্রহীদের। এসময় দুই কপি ছবি, জন্ম নিবন্ধন সনদ ও বাবা মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দিতে হয়। যেসব তথ্যের ভিত্তিতে প্রশিক্ষণার্থীদের ব্যক্তিগত অনলাইন প্রোফাইল তৈরি করা হয়। প্রত্যেককে দেয়া হয় পরিচয় পত্র, যা পাঞ্চ করার মাধ্যমে অনুশীলনে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত হয়।

পথচলার দুইবছরে স্পোর্টস কমপ্লেক্সে যুক্ত হয়েছেন জাতীয় পর্যায়ের সুনামধন্য সাবেক ক্রীড়াবিদরা, যাদের হাত ধরে সাফল্যও ধরা দিয়েছে। প্রধান ক্রিকেট কোচ হিসেবে রয়েছেন জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড় আফতাব আহমেদ চৌধুরী ও ফুটবল প্রশিক্ষক হিসেবে রয়েছেন ঢাকা মোহামেডেনের সাবেক খেলোয়াড় জামাল উদ্দিন আহমেদ ফারুক। এছাড়া বাস্কেটবল ও ব্যাডমিন্টনে প্রশিক্ষণেও রয়েছে একজন করে প্রশিক্ষক। কমপ্লেক্সের খেলোয়াড় শাহরিয়ার আলম মাহিম ডাক পেয়েছেন অনূর্ধ্ব-১৪ ক্রিকেট দলের জাতীয় ক্যাম্পে। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপে কিশোরগঞ্জের আজিম উদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন কমপ্লেক্সের প্রশিক্ষণার্থী সানিয়া জাহান রিয়া। যিনি নিজ দলের অধিকাংশ খেলায় ম্যান অব দ্যা ম্যাচ নির্বাচিত হয়েছেন এবং ফাইনালে পুরষ্কার নিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। এছাড়া ক্রিকেটে চট্টগ্রাম জেলা অনূর্ধ্ব-১৪ দলে ১ জন, অনূর্ধ্ব-১৬ তে ২ জন ও অনূর্ধ্ব-১৮ তে ২ জন ডাক পেয়েছেন। চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা (সিজেকেএস) আয়োজিত লীগে বিভিন্ন দলের হয়ে খেলেছেন ১২ জন। ফুটবলে গত বছর সিজেকেএস আয়োজিত কিশোরলীগে অংশ নিয়ে নৈপূণ্যপূর্ণ খেলা প্রদর্শনের সুবাদে ১ জন জেলা দলে ডাক পেয়েছে। এবছর ডাক পেয়েছেন আরো ৩ জন। 

স্বল্প সময়ে সফলতার সাথে ‘চেয়ারম্যান’স কাপ’ শিরোনামে অনূর্ধ্ব-১৫ ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছে স্পোর্টস কমপ্লেক্স। এতে নগরীর আটটি প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেট একাডেমি অংশ নিয়েছে। কমপ্লেক্সের ক্রিকেট দল অংশগ্রহণ করে টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। আগামী বছরের শুরুতে আরো বড় আকারে অনূর্ধ্ব-১২ ও অনূর্ধ্ব-১৫ ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করতে যাচ্ছে স্পোর্টস কমপ্লেক্স।

স্পোর্টস কমপ্লেক্সকে আরো আধুনিক ও কলেবর বাড়াতে বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম খালেদ ইকবালের নির্দেশনায় বাস্কেটবল গ্রাউন্ড, লন টেনিস ও সুইমিং পুল তৈরির পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এছাড়া ক্রিকেট অনুশীলন ব্যবস্থা আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে ইংল্যান্ড থেকে আনা হচ্ছে বোলিং মেশিন। আগামীতে এ অঞ্চলে ক্রীড়া চর্চা ও ক্রীড়াবিদ তৈরির সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম হবে বন্দর স্পোর্টস কমপ্লেক্স তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। যে বন্দরকে কেন্দ্র করে বিস্তৃত হয়েছে চট্টগ্রাম শহর, সেই শহরের খেলাধুলা, সংস্কৃতিতে নেতৃত্বের আসনে বন্দরই থাকবে, সেটাই প্রত্যাশা।

বিগ ডেটা, ব্লকচেইন এবং ভিটিএমএস

হ্যাঁ, সমুদ্র বাণিজ্যেও শুরু হয়ে গেছে বিগ ডাটার ব্যবহার। শুধুমাত্র বন্দর নয়, পণ্য আদান-প্রদানের সম্পূর্ণ ভেল্যু চেইনকে গতিশীল ও সমন্বিত রাখতে, উন্নত পরিসেবা নিশ্চিত করতে বন্দরের প্রতিটি সূক্ষ তথ্যও এখন অতিজরুরী। বলা হচ্ছে গত ৩০০ বছরে মেরিটাইম বিশ্ব যেভাবে এগিয়েছে আগামী ১০ বছরেই পাল্টে যাবে আরও বেশি। তথ্যপ্রযুক্তির নতুন ব্যবস্থা বা বিদ্যমান ব্যবস্থার রূপান্তরের মাধ্যমে বন্দরগুলোকেই থাকতে হবে সকল উৎপাদন প্রবৃদ্ধির আলোচনার কেন্দ্রে।

শিপিং খাতকে যদি অর্থনীতির মূল স্তম্ভ বলা হয়, তাতে বোধ হয় খুব একটা ভুল হবেনা। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় অর্থনীতির এই বিভাগটি এখনও সেকেলেই রয়ে গেছে। তবে বর্তমানে পরিবর্তনের একটা স্পষ্ট লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এই পরিবর্তনে গতি আনয়নে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিঃসন্দেহে অধিকতর উপযোগী ডেটা (তথ্য), বিশেষ করে তথ্য-উপাত্তের বিশ্লেষণধর্মী ব্যবহার। তাই ডেটা কেন্দ্রিক এই পরিবর্তনকে সামনে রেখে কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে।

কী করে বন্দরসমূহ এই তথ্য-উপাত্ত তৈরি করতে কিংবা তা ব্যবহার করে আরো বেশি কার্যকরী হওয়ার মাধ্যমে নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারে? এবং এই পরিবর্ধনশীল তথ্য-উপাত্ত ও তাদের বিশ্লেষণধর্মী ব্যবহার কি বন্দরসমূহের জন্য সুযোগ হিসাবে দেখা দিবে নাকি হুমকি হিসাবে? এই সকল তথ্য কী উপায়ে বন্দরকে সাপ্লাই চেইনের বিশাল ল্যান্ডস্কেপে নিজেকে সমন্বয় করে নিতে সাহায্য করবে এবং তাদের ভোক্তাদের আরো কার্যকর সেবা দিতে পারবে?

জাহাজমালিক, ব্যবস্থাপক, ব্রোকারেজ হাউজ, ফরোয়ার্ডিং এজেন্ট তথা বন্দরের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলে এখানে অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে থেকে কাজ করে। আমাজন, ওয়ালমার্ট, আলীবাবার মত জায়ান্ট কোম্পানিগুলো যারা নিজস্ব চার্টার্ড জাহাজের পাশাপাশি আলাদা টার্মিনাল লীজ নেয়ার কথা ভাবছে, তারাও কাঠামোগত পরিবর্তনের পথেই হাঁটছে। বিশ্ব বাণিজ্যের ৯০% শতাংশ সমুদ্রপথে হলেও মেরিটাইম দুনিয়ার শেষ উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারটি এসেছিল ১৯৫০ এর দশকে, যখন আইএসও কনটেইনার যাত্রা শুরু করে। কালের নিয়ম মেনে স্বাভাবিকভাবেই, প্রচলিত পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা একটি অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে।

তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বাজার এবং ক্ষুরধার অর্থনীতির সময়ে বহু মালিক, অপারেটর এবং চার্টারিং সংস্থার কাছে প্রায়শই দরকারি তথ্যসমূহ পাওয়ার কোনো উপায় থাকে না। ফলস্বরূপ, পণ্য পরিবহন সিস্টেমের সামগ্রিক চিত্রটি সাধারণ জনগণ দূরের কথা, সংশ্লিষ্ট অনেকের কাছেও পরিষ্কার নয়। এ কারণে সামনে চলে আসছে মেরিটাইম বিশ্বের নতুন সব প্রযুক্তিগত অবদানের কথা। শিপিং ইন্ডাস্ট্রি এখন সর্বশেষ হালনাগাদ করা বিপুল তথ্যভান্ডার দ্বারা সুসজ্জিত, সেখান থেকে সমুদ্রগামী ভেসেলের সর্বশেষ অবস্থান, পণ্য এবং কার্গোর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, নিরবচ্ছিন্ন সাপ্লাই চেইন, বন্দরে জাহাজজটের খবর – সহজেই জেনে নিতে পারছে বন্দর এবং তার স্টেকহোল্ডাররা।

নতুন এ ব্যবস্থায়, বিস্তারিত ডেটা অ্যানালাইসিস এর সাথে যোগ হচ্ছে বিশ্লেষণধর্মী, দূরদর্শী ও কৌশলগত লজিস্টিক ম্যানেজমেন্ট। এটি নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, অপার ক্ষমতাশালী এসব যন্ত্র, তথ্য এবং পদ্ধতি ভবিষ্যতে বন্দর ও সমুদ্র বাণিজ্যের চেহারাই বদলে দিবে। মেরিটাইম দুনিয়ার সাথে জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, যারা দ্রুত ও ঝামেলাবিহীন বাণিজ্যে আগ্রহী তাদের জন্যও তা হবে আশীর্বাদস্বরূপ। উদাহরণে বলা যায়, সময়মতো উপযুক্ত তথ্যের অভাবে অনেক সময় বন্দরে জাহাজ নোঙর করা, অথবা ছেড়ে যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে এসে নিতান্ত তাড়াহুড়োয় যাত্রার খুঁটিনাটি নিশ্চিত করতে হয়। অথচ সঠিক সময়ে দরকারি সব তথ্য হাতে পেলে পুরো প্রক্রিয়াটি হয়ে উঠতে পারে আরো নিখুঁত। পণ্যের জরুরি চাহিদা মোতাবেক আমদানিকারক হয়তো সেটাকে খুব দ্রুত বিক্রেতা দেশ বা কোম্পানি কাছ থেকে কিনলেন। এরপর সর্বোচ্চ গতিতে জাহাজ ছুটিয়ে এনে কেনো কেবলমাত্র বন্দরে জাহাজজটের কারণে ঢিমে তালে চলতে হবে বা অলস বসে থাকতে হবে, যেখানে বহু আগেই এ ধরনের অনাকাঙ্খিত সমস্যাগুলোর কথা জানা সম্ভব? এ কারণে প্রয়োজনীয় তথ্যের অধিকার হাতে পেলে তাতে কেবল বন্দরই যে উপকৃত হবে তা নয়, বরং ভোক্তা পর্যায়েও পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থার উপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বলা যায়, পোর্ট এবং শিপিং খাত আমূল বদলের দ্বারপ্রান্তে। আবার, কাঙ্খিত ফল লাভের জন্য ইনফরমেশন সিস্টেমে ঠিক কোন ধরনের বা কতটা প্রাসঙ্গিক তথ্য ইনপুট হিসেবে যাচ্ছে সেটি দেখা দরকার। সদা ব্যস্ত শিপিং এজেন্সিগুলো তাদের মুঠোফোনে এক ক্লিকেই আজকাল জানতে পারে তাদের ভেসেল এই মূহুর্তে কোথায় আছে। খোলা সাগরে কঠিন বিপদসংকুল আবহাওয়া, আকস্মিক দুর্ঘটনা, জলদস্যুর উৎপাত এড়িয়ে যাত্রাপথ নির্বিঘœ রাখা সহজ কথা না। এ কারণে, স¤পূর্ণ মানষের হাতে ছেড়ে না দিয়ে প্রযুক্তির আশীর্বাদ গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

যেকোনো বন্দরের মূল কাজ শেষ পর্যন্ত নিজেদের দুর্বলতা ও শক্তির জায়গাটি চিহ্নিত করে সামর্থ্য ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে সর্বোচ্চ জোর দেয়া। আর অগ্রগামী ও কার্যকর বন্দর গড়ে তুলতে তথ্য আদান-প্রদানের সত্যিই কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে অবশ্য পুরোধা হিসেবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে শিপিং টাইকুন মায়ের্¯‹, ইন্ডাস্ট্রিতে লঞ্চ করতে যাচ্ছে ‘ব্লকচেইন’ – ইলেকট্রনিক ডকুমেন্টেশন এবং  ট্র্যাকিং-এর এক বিশেষায়িত সিস্টেম। ব্লকচেইন এমন এক ডেটা ব্যবহার পদ্ধতি, যার মাধ্যমে সরবরাহ ব্যবস্থার যেকোনো প্রান্তের স্টেকহোল্ডার বা শিপমেন্ট এজেন্ট যেকোনো স্থানে থাকা কার্গো এবং দরকারি ফাইল ট্র্যাক করতে পারবে। নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ চক্রের ক্ষেত্রে এটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। মায়ের্¯‹ এর চীফ ডিজিটাল অফিসার ইব্রাহিম গকচেন এর মতে, “সংস্কৃতি বদল হবে, বদলাবে দক্ষতার পরিভাষা, সহযোগিতার ক্ষেত্র, পাল্টাবে আরো অনেক কিছুই। আর সব কিছুর নিয়ামক থাকবে ভোক্তার চাহিদা।”

এ ধরনের ডিজিটালইজেশনের ফলে খরচের খাতা নীচে নামিয়ে আনার সাথে সময় সাশ্রয় এবং কর্মদক্ষতা বাড়ানোও সম্ভব হবে। মায়ের্স্ক এর প্রধান অর্থ কর্মকর্তা পিয়েরে ড্যানেট এবিষয়ে বলেন, “গত অর্থবছরে আমরা ভেসেলের কর্মদক্ষতার ৯৩ শতাংশ ব্যবহার করেছি। এই সংখ্যাকে আর ৯০ শতাংশের নীচে নামতে দেয়া হবে না। আমরা আর কখনোই ৮৮ শতাংশের দিনে ফেরত যাচ্ছি না।” বিশ্বখ্যাত আইটি প্রতিষ্ঠান আইবিএম এর সাথে মিলে মায়ের্স্ক রটারড্যাম এবং নিউয়ার্ক বন্দরে পরীক্ষামূলকভাবে ইতিমধ্যেই ব্লকচেইন সিস্টেম চালু করেছে। ড্যানেট বিশ্বাস করেন, পণ্য স্থানান্তরের তথ্য যত স্বচ্ছ ও হালনাগাদ করা হবে, পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা তত ভালোভাবে সাজানো সম্ভব। এতে ব্যয় সংকোচন এবং জাহাজজট পরিস্থিতির বৈপ্লবিক উন্নতি হতে বাধ্য। ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি মানে কিন্তু কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের হ্রাস পাওয়া। ড্যানেটও তা স্বীকার করলেন, তবে সাথে এও যোগ করেন, “গতবছর আমাদের মোট খরচ ছিল প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলার। বিক্রয় ও প্রশাসনিক কাজের মত পেপারওয়ার্কে যেখানে ২ বিলিয়নের চাইতে কম খরচ, অপারেশনাল কার্যক্রম চালু রাখা, টার্মিনাল ফি, ভেসেল এবং ইকুইপমেন্ট মেইনট্যানেন্স ফি, কর্মীদের ট্রান্সশিপমেন্ট এর মত টেকনিক্যাল কাজে ব্যয় Text Box: বিগ ডেটা কি: বিগ ডেটা এমন একটি শব্দবন্ধ যেটি বিশাল আয়তনের তথ্যভান্ডারকে নির্দেশ করে, কাঠামোবদ্ধ অথবা কাঠামোবিহীন। তবে এখানে তথ্যের পরিমাণগত প্রাচুর্যতা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং সংস্থাগুলো সেই তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কী করছে, সেটিই আসল কথা। বিগ ডেটাকে বিশ্লেষণ করে যে ইনসাইট পাওয়া যাবে তা দিয়ে ব্যবসা পরিচালনায় অধিকতর দূরদর্শী এবং কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব। এর বৃহৎ এবং জটিল কলেবরের কারণে সাধারণ প্রচলিত ডাটা প্রসেসিং সফটওয়্যার দিয়ে বিগ ডাটা বিশ্লেষণ প্রায় অসম্ভব।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ: বিগ ডেটার মাধ্যমে আপনি যেকোনো উৎস থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত নিতে পারেন, কাজে লাগাতে পারেন বাণিজ্যের নানান চিরন্তন সমস্যার উপায় খুঁজতে, যেমন খরচ নীচের কোঠায় রাখা, সময় কমিয়ে আনা, নতুন পণ্যের উদ্ভাবন অথবা তার উন্নয়ন, সর্বোপরি বুদ্ধিমত্তার সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা। বিগ ডেটাকে যখন উচ্চতর দক্ষতার সাথে বিশ্লেষণ করা হয়, তখন বাণিজ্য-সংক্রান্ত বেশ কিছু অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়। যথা: যেকোনো সমস্যা, ব্যর্থতা বা অপূর্ণতার মূল যথাসম্ভব রিয়েল টাইমে খুঁজে বের করা; ক্রেতার পণ্য কেনার ঝোঁক বা অভ্যাস বুঝে তৎক্ষণাৎ বিক্রয় কৌশল প্রবর্তন; মুহূর্তের মধ্যে সকল বাণিজ্য ঝুঁকি হিসাব করে ফেলা; ক্ষতিগ্রস্ত হবার পূর্বেই প্রতারণামূলক ঘটনা চিহ্নিত করা। 
এটি মনে রাখতে হবে যে, বিগ ডেটার কার্যকারিতা কখনোই সরাসরি এর প্রাথমিক ডেটা ভান্ডার থেকে আসে না। বরং এর সঠিক প্রক্রিয়াকরণ এবং বিশ্লেষণ করা গেলেই সেখান থেকে উঠে আসে অপরিসীম সম্ভাবনা।
ইতিহাস: বিগ ডেটা শব্দটি তুলনামূলক নতুন শোনা গেলেও ইন্টারনেট দুনিয়ায় এর ধারণাটি বেশ পুরনো। একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইন্ডাস্ট্রি বিশ্লেষক ডাগ লেনি এই বিগ ডেটা ধারণাকে তিনটে ‘ভি’ দ্বারা সংজ্ঞায়িত করেন - ভলিউম, ভেলোসিটি, ভ্যারাইটি -আয়তন, গতি, বৈচিত্র্য। 
বিগ ডেটার ব্যবহার: বর্তমানে প্রধান যে ক্ষেত্রগুলোতে বিগ ডেটার ব্যবহার হচ্ছে সেগুলো হল- ক্রেতাকে বোঝা ও খোঁজার জন্য; ব্যবসায় চলতি ধারার পূর্বাভাস জানতে; জনস্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য সেবা ও শিক্ষা ব্যবস্থায় উন্নয়নে; খুচরা ব্যবসায়; ভ্রমণ ও হসপিটালিটি খাতে; বৈজ্ঞানিক গবেষণায়; ক্রীড়া নৈপুণ্য উন্নয়নে; অপরাধ ঠেকাতে; শেয়ার মার্কেট ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ট্রেডিংয়ে; মেশিন ও ডিভাইসের উন্নতি ঘটাতে; আমাজন বা ইউপিএস এর মত কুরিয়ার সার্ভিস পরিচালনায়।

হয়েছে ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! তাই আমরা যতই প্রযুক্তিগত দিকে সমৃদ্ধ হব, চাকরির ক্ষেত্র সংকুচিত নয়, পালটে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।”

কয়েকটি বন্দরে ব্লকচেইনের পাইলট স্টাডিজের পর এ বছরের শেষ দিকে এসে স্নেহেইডার ইলেকট্রিক্সের সাথে মিলে এটিকে পুনঃনিরীক্ষা করছে মায়ের্স্ক। “বারবার পরীক্ষা করার মাঝে আসলে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে সমগ্র সাপ্লাই সিস্টেমের ঠিক কোন জায়গা বা কোম্পানি এই নতুন সফটওয়্যারে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি সাধারণ সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, যেখানে পরীক্ষায় উৎরে গেলে একে অপারেশনে আনা হয়।”

নতুন ধারার কনটেইনার শিপমেন্ট থেকে উপকৃত হতে গেলে এর প্রতিটি ধাপ ডিজিটাল হতে হবে, সমগ্র প্রক্রিয়া থেকে কাগজের ব্যবহার অবলুপ্ত হবে এবং পরিবহন ব্যবস্থার সাথে জড়িত সকলে একই তথ্য পাবে বলে স¤পূর্ণ স্বচ্ছতা বজায় থাকবে। “শিপাররা প্রায়ই জানতে চায় যে তাদের বক্সটা এখন কোথায় আছে। এখন শিপমেন্ট-ট্রান্সশিপমেন্ট প্রক্রিয়ায় যতবার কনটেইনার কোনো পোর্টে প্রবেশ করে বা বেরিয়ে যায়, ততবার বিস্তারিত এবং সময়সাপেক্ষ কার্গো চেকিং এবং ডকুমেন্টেশন প্রক্রিয়া পার হতে হয়। এটি যথেষ্ট বিরক্তিকর।” বলছিলেন গকচেন। প্রতি বছর এভাবে শিপিং লাইনগুলোর ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হয় শুধু পণ্যের বৈধতার কাগজ সংগ্রহ করতে। সুতরাং আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে নতুন প্রবর্তিত পদ্ধতিটি দ্বারা এ ধরনের অনাকাঙ্খিত ব্যয়ের লাগাম টানা সহজ হবে। তবে ব্লকচেইন কখনই ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ার শেষ কথা নয়, একে বলা যেতে পারে পরিবর্তিত বন্দর ব্যবস্থার একটি অংশ।

বন্দর পরিচালনা এবং দক্ষতা বৃদ্ধির কাজটি আগের চাইতে এখন অনেকটাই সহজতর করে তোলার পিছনে প্রযুক্তিগত যেসব ব্যাপার নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ভিটিএমএস)। প্রাথমিক পর্যায়ে বন্দর ব্যবহারকারী জাহাজসমূহের গতিবিধি পরিচালন সুবিধা এবং নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে যার উদ্ভব। এটি এমন এক সমন্বিত ব্যবস্থা, যা দুর্ঘটনা এড়িয়ে, পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত না করে এবং অবশ্যই নিরাপদে সমুদ্রগামী জাহাজের ডকিং প্রক্রিয়া পরিচালনা করতে সক্ষম। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজরদারি নিশ্চিত করে খোলা সাগরে জলদস্যু কিংবা অন্যান্য বিপদ থেকে জাহাজের নিরাপত্তা বিধানেও পারঙ্গম এই পদ্ধতিটি। তবে তথ্য-প্রযুক্তির এই বিশ্বায়নের যুগে সময়ের পরিক্রমায় এটি আরো সমৃদ্ধ ও বহুমুখী হয়ে ওঠার অপেক্ষায়। ভিটিএমএস এখন এমনভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে যে, অদূর ভবিষ্যতে এটি বিশ্ব বাণিজ্যের নীতি নির্ধারক, অবিচ্ছিন্ন পণ্য পরিবহন এবং পরিবেশবান্ধব হিসেবে দারুণ কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে জায়গা করে নিবে। এই পদ্ধতি থেকে সর্বোচ্চ ফায়দা পেতে হলে বন্দরগুলোকে তথ্য আদান-প্রদানের ধারনার ব্যাপারে ভিন্নভাবে চিন্তা করতে হবে। স্টেকহোল্ডারদেরও ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম এবং এর কর্মকান্ড সম্পর্কে চিরাচরিত যে দৃষ্টিভঙ্গি, তা বদলানো অনিবার্য।

এতে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই যে, জাহাজ, বন্দর এবং টার্মিনালসমূহের মধ্যে সর্বক্ষণ ত্রিমুখী যোগাযোগ থাকা আবশ্যক। প্রত্যেকের অপারেশনাল ইনফরমেশন কম সময়ে আরো বেশি শেয়ার হওয়া দরকার। প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠুভাবে স¤পন্ন করতে বিভিন্ন সেক্টরে বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে এখনই। ব্যবহারকারীরা যেন বন্দর থেকে সর্বোচ্চ সেবা লাভ করতে পারে, সে জন্য ভিটিএমএস সিস্টেমকে দেখা হচ্ছে সমুদ্রযাত্রাকে অধিকতর পরিকল্পিত এবং ভেসেল ট্রাফিক সুচারুরূপে পরিচালনা করার অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে। কিন্তু এখনো বন্দরগুলো যার যার অভ্যন্তরীণ তথ্যের ব্যাপারে যথেষ্ট রক্ষণশীল আচরণে অভ্যস্ত। প্রতিযোগিতার দুনিয়ায় কখনো হয়তো এটি স্বাভাবিকই।

ইদানিং অবশ্য আঞ্চলিক বা প্রতিবেশী বন্দরগুলোর মধ্যে অবিচ্ছিন্ন উপকূল গড়ে তোলার লক্ষ্যে তথ্য আদানপ্রদানের মাধ্যমে মাদার এবং সিস্টার ভেসেল ট্রাফিক কন্ট্রোলের একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে এবং তাঁর ফলও বন্দরগুলো হাতে হাতে পাচ্ছে। ফিনল্যান্ড উপসাগরে এস্তোনিয়া, রাশিয়া, ফিনল্যান্ডের বন্দরগুলো এর আদর্শ উদাহরণ। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে আইসল্যান্ড-নরওয়ে গড়ে তুলেছে ‘সেফ-সী-নেট’ নামক এক অনন্য নেটওয়ার্ক। ফলাফল: এর সব কয়টি বন্দর বিগত বছরের তুলনায় রেকর্ড সংখ্যক টিইইউস পণ্য পরিবহন করেছে। প্রকৃতপক্ষে, ভিটিএস কে সাধারণ একটি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যার না ভেবে আগামী প্রজন্মের বন্দরকে নেতৃত্বদানকারী আবশ্যিক একটি উপাদান হিসেবে ভাবতে হবে। কারণ, উন্নত বিশ্বে এরই মধ্যে সিস্টেমটিকে কেন্দ্রে রেখে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে চলেছে। বন্দরে নিরাপত্তা আর টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে সুইডিশ মেরিটাইম এজেন্সি চালু করতে যাচ্ছে সী-ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম। ইইউ এর তহবিল থেকে প্রস্তুতকৃত মোনালিসা প্রজেক্টের বিস্তৃত রূপ এটি, যার ভিত্তিই হল বিভিন্ন পোর্টের মাঝে অবাধ তথ্যপ্রবাহ।

কানাডার পূর্ব উপকুলের সেইন্ট জন নদীর মোহনায় অবস্থিত সেইন্ট জন বন্দর – কার্গো ধারণক্ষমতার দিক থেকে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম বন্দর। অতি সম্প্রতি তারা ভিটিএস হালনাগাদ করেছে, মূল উদ্দেশ্য সেই একটিই – বন্দর এবং স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে দ্রুততর তথ্য আদান-প্রদান নিশ্চিত করা। আজ থেকে দুই কি তিন বছরের মধ্যে ছোট-বড় সব ধরনের ভেসেল স্যাটেলাইট আপলিংকের মাধ্যমে ভূমির সাথে ২৪ ঘন্টা যুক্ত থাকবে, দশ বছর আগে যাকে কল্পনা বলে মনে করা হত। সবার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে তাই একটি সার্বজনীন ডাটাবেজের সাথে যুক্ত থাকা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। এর জন্য প্রযুক্তিগত দিক থেকে লাগবে একটি ওপেন সোর্স ইন্টারফেস, সহজেই যে কেউ তথ্য জমা করতে পারবে সেখানে। তবে তার চাইতে বড় চ্যালেঞ্জ হল, মানসিকতায় পরিবর্তন আনা। ভিটিএমএস ডাটা শেয়ারিং সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।

-আফরোজা বীথি

নারীদের প্লাটফর্ম আইএপিএইচ উইমেন্স ফোরাম

নানা রকম বিধিনিষেধের বেড়ার ফাঁদে পড়ে এক সময় পর্দার আড়ালে থাকা নারী আজ নিজ যোগ্যতায় ছড়িয়ে পড়েছে সর্বক্ষেত্রে। মহাকাশচারী থেকে সাগরের অতলে গবেষণা, আকাশযানে উড়ান থেকে ন্যানোপ্রযুক্তির উদ্ভাবক – কোথায় নেই সে! কিন্তু বিস্ময়কর ভাবে পোর্ট ম্যানেজমেন্টে, সমুদ্র যাত্রায়, নৌ-প্রকৌশলে নারীদের স¤পৃক্ততার হার খুবই কম। আমাদের দেশে তো বটেই, উন্নত দেশগুলোতেও এই সংখ্যা খুব একটা বেশি না। বিশ্বব্যাপী পুরুষশাসিত মেরিটাইম ইন্ডাস্ট্রিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, বিভিন্ন বন্দরে যারা ইতিমধ্যে কর্মরত আছেন তাদের উন্নত প্রশিক্ষণ, বন্দর বা এর সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বতন পদে কাজ করার সক্ষমতার হার বাড়ানোর লক্ষ্যে আইএপিএইচ (ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব পোর্টস এন্ড হারবারস) ২২ মে, ২০১২ সালে জেরুজালেমে অনুষ্ঠিত বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের বার্ষিক সাধারণ সভায় তাদের অঙ্গসংগঠন আইএপিএইচ উইমেন্স ফোরামের ঘোষণা দেয়। এই ফোরামটি আইএপিএইচ সদস্য বা সদস্য নয়, এমন সকল বন্দরের নারী কর্মকর্তাদের জন্য উন্মুক্ত। সুবিশাল নৌ-নেটওয়ার্কের অংশ হয়ে কাজ করে পেশাগত চ্যালেঞ্জ সমাধানে আগ্রহী, একত্রে কাজ করে কর্মক্ষেত্রে আরও সক্রিয় অবদান রাখতে ইচ্ছুক যে কোন নারীর জন্য এই ফোরামের দরজা খোলা।

ফোরামের প্রথম চেয়ারপারসন ছিলেন নিউজিল্যান্ড পোর্ট অফ অকল্যান্ডের জেনারেল ম্যানেজার ডায়ানে এডওয়ার্ডস। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্টেইনবার্গ এন্ড অ্যা¤প অ্যাসোসিয়েটস এর নাওমি কোগোন-স্টেইনবার্গ দায়িত্ব নেন। ফোরামের বর্তমান চেয়ারপারসন হিসেবে ২০১৬ সালের  জানুয়ারি মাসে দায়িত্ব নেন মালয়েশিয়ার সাবাহ বন্দরের জেনারেল ম্যানেজার সিতি নুরাইশাহ বিনতি আজিজান। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “শিপিং সেক্টরের মত পুরুষ প্রাধান্য পাওয়া পেশায় নারীদের টিকে থাকা মুশকিল – এই ধারণা বহু আগেই বাতিলের খাতায় চলে গেছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনো অনেক পথ পেরোনো বাকী। বেশ কিছু দেশে স্থানীয় সংস্কার ও রীতি-নীতির কারণে নারীরা যথেষ্ট যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নৌ-খাতের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে উঠে আসতে পারছে না। কখনো কখনো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেই লুকিয়ে থাকে নানান অদৃশ্য বাধা, যাতে নারীরা যোগ্যতা সত্তেও উর্ধ্বতন পদে নিয়োগ পান না। আমার মতে, মেয়েদের জীবনের সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ব্যক্তিগত-পেশাগত জীবনে ভারসাম্য রক্ষা করা। মাতৃত্ব, পরিবার ইত্যাদি নিয়ে একটি মেয়ে যেভাবে ভূমিকা রাখে, সেটা করতে গিয়ে স্বভাবতই তাকে অনেক  সময় সমকক্ষ পুরুষটির চেয়ে কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হতে হয়। সমুদ্র বিষয়ে নানা রকম সামাজিক ও ধর্মীয় রক্ষণশীল আচরণও এতে প্রভাব ফেলে। আমাদের সংগঠনের উদ্দেশ্য হল এই বাধাগুলো যথাসম্ভব অপসারণ করে নৌবিজ্ঞান ও বাণিজ্যে নারীর সমান অংশগ্রহণের পথ প্রশস্থ করা। সুযোগ পেলে নারী যোগ্যতায় পুরুষের চাইতে কম নয়, এটি প্রমাণিত সত্য।”

শতাধিক সদস্য সংখ্যার আইএপিএইচ উইমেন্স ফোরামের একটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ হল নারীদের বন্দর সম্পর্কিত বিষয়ে উচ্চতর পড়াশোনা ও বিষয়ভিত্তিক ট্রেনিং এর সুযোগ প্রদান। ফোরামটি দুই ধরনের বৃত্তি প্রদান করে থাকে। প্রথমটি হলো, ট্রেনিং স্কলারশিপ, যা প্রতি দুই বছরে একবার দেয়া হয়, এটি সাধারণত বন্দরে প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনামূলক কাজে কর্মরত সিনিয়র নারী কর্মকর্তাদের জন্য প্রযোজ্য। উচ্চতর পড়াশোনার ব্যবস্থার পাশাপাশি পুরস্কারের অর্থমূল্য ১৫,০০০ ইউএস ডলার, সাথে থাকছে ভ্রমণ খরচসহ ফোরামের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে আমন্ত্রণ, সেখানে নিজের গবেষণাপত্র উপস্থাপনের সুযোগ। ২০১৫ সালে প্রথমবার এ বৃত্তিটি পেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ওকল্যান্ড বন্দরের অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যানালিস্ট লুয়ানা এ¯পানা।

অপর বৃত্তিটি বছরে একবার করে দেয়া হয়। এটি বিভিন্ন বন্দরে কাজ করেন এমন সকল নারী কর্মীদের জন্য, যারা পেশাগত দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে আগ্রহী, সাফল্যের সাথে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন অথবা বন্দরের উল্লেখযোগ্য কোনো প্রকল্পের সাথে যুক্ত ছিলেন। বিজয়িনী ৫,০০০ ইউএস ডলার প্রাপ্তির সাথে পাবেন আইএপিএইচ এর বার্ষিক সাধারণ সভায় অংশগ্রহণ ও প্রবন্ধ পাঠের মাধ্যমে নিজের সফল প্রকল্পটি বিশ্বব্যাপী প্রচারের গৌরব। এক্ষেত্রেও সুযোগটি থাকবে ভ্রমণ খরচসহ। কেনিয়ার মোম্বাসা পোর্টের হিউম্যান রিসোর্স অফিসার সাইওভাতা এমবান্দি জিতে নিয়েছিলেন এ সম্মানটি।

২০১৭ সালের মে মাসে ইন্দোনেশিয়ার পর্যটন দ্বীপ বালিতে হয়ে গেল ফোরামের দ্বিবার্ষিক সম্মেলন। এবারের ট্রেনিং স্কলারশিপটির বিজেতা পানামা মেরিটাইম অথরিটিতে সিগন্যাল বিভাগে কর্মরত নিটজেরিয়া অলিভেট ওয়াটসন স্টুয়ার্ট। তিনি জিতে নিয়েছেন নগদ ১৫,০০০ ডলারের সাথে স্পেনের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট  অফ কাতালোনিয়াতে মেরিটাইম ল এন্ড পোর্ট ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে মাস্টার্স শ্রেণিতে পড়াশোনার সুযোগ, থাকছে ২০১৯ সালে চীনের গুয়াংজুতে অনুষ্ঠিতব্য ফোরামের পরবর্তী দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে নিজ রিসার্চ পেপার উপস্থাপনের আমন্ত্রণ। ১৬ প্রতিযোগীকে পিছনে ফেলে স্কলারশিপ পাওয়ায় স্টুয়ার্ট স্বাভাবিক ভাবেই দারুণ উচ্ছ্বসিত। ট্রেনিং শেষে প্রাপ্ত শিক্ষা ও দক্ষতা দিয়ে তিনি নিজ কর্মক্ষেত্র তথা দেশে অবদান রাখার পাশাপাশি ভবিষ্যতে বিশ্বের যেকোনো বন্দরের নারী কর্মীদের আজীবন বিনামূল্যে পেশাগত পরামর্শ দিতে চান।

নাইজেরিয়ান পোর্টস অথরিটির অকুপেশনাল হেলথ শাখার অ্যাসিস্টেন্ট জেনারেল ম্যানেজার এনগোজি ওবিকিলি পেয়েছেন বাৎসরিক অপর বৃত্তিটি। ৫,০০০ ডলারের সাথে তিনি পাচ্ছেন ২০১৮ সালে আজারবাইজানের বাকুতে হতে যাওয়া আইপিএএইচ এর বার্ষিক সভায় নিজের প্রবন্ধ পাঠের সম্মান। তার দৃষ্টিতে, এই পুরষ্কার প্রাপ্তির ফলে তিনি আসলে পেয়েছেন বিশ্বের নানা দেশের, হরেক ভাষার, বিভিন্ন জাতির মানুষের সাথে দেখা করার এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুবর্ণ সুযোগ। পেশাগত সমস্যা সমাধানের বিভিন্ন কৌশল, বন্দর ব্যবস্থাপনা কি করে আরো শক্তিশালী করা যায় বা বন্দরভিত্তিক কর্মক্ষেত্রে নারীদের বিগ্ন মোকাবেলার উপায় – এ ধরণের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেয়ার করার জন্য বৈশ্বিক একটি প্ল্যাটফর্মে যেতে পারছেন তিনি।

প্রতিষ্ঠানের প্রচারণামূলক বা নারীদের অধিক হারে সম্পুক্ত করার জন্য বৃত্তি প্রদান ছাড়া আর কী ধরনের উদ্যোগ আছে? এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারপারসন বিনতি আজিজান আশাব্যঞ্জক জবাব দেন। “বিভিন্ন বন্দরের মধ্যে কর্মকর্তা ও কর্মচারী – উভয় স্তরে অচিরেই আমরা এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম চালু করতে যাচ্ছি। এছাড়া বন্দর বিশেষজ্ঞদের সাথে নবীন নারী কর্মকর্তাদের বিশেষ ট্রেনিং সেশন থাকবে। এছাড়াও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে মেরিটাইম ও লজিস্টিক সাপোর্ট সিস্টেম ব্যবহার করে দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ থাকছে। শিপিং দুনিয়ার অন্যান্য সংগঠনগুলো, যারা আমাদের মত একই উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে, তাদের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি, একই ইস্যুতে একযোগে কাজ করতে চাই। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ডব্লিউআইএসটিএ (উইমেন্স ইন্টারন্যাশনাল শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং অ্যাসোসিয়েশন), আইএমও-ডব্লিউআইএমএ (উইমেন ইন মেরিটাইম অ্যাসোসিয়েশন), আংকটাড নারী উদ্যোগ কর্মসূচী এবং ডব্লিউআইএলএটি (উইমেন ইন লজিস্টিক অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট।”

আইএপিএইচ তালিকাভুক্ত চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মরত নারীদের সামনেও রয়েছে ফোরামের দুই ধরনের বৃত্তি অর্জনের হাতছানি। এবারের আয়োজনের পালা ফুরিয়ে গেছে, কিন্তু আগামী বছরের জন্য চোখ রাখুন এই ঠিকানায়: www.iaphworldports.org/news| যোগ দিতে পারেন ফেসবুক IAPH Women’s Forum গ্রুপে।

চট্টগ্রামের ইতিহাসে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি

ততদিনে ভারতবর্ষে শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসেছে পর্তুগিজেরা। কিন্তু বাণিজ্য করতে এসে দস্যুবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়া এবং স্থানীয় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের কারণে ভারতের বিভিন্ন রাজা পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সে সময় বাংলার দৃশ্যপটে আর্বিভূত হয় ওলন্দাজরা। পর্তুগীজ নাবিকদের দৌরাত্মের কারণে স্থানীয় শাসকদের ওলন্দাজদের উপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যায়। আর এ কারণে তারা দ্রুত ব্যবসায় উন্নতি সাধন করতে থাকে।

ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্ম ১৬০২ সালে। ইন্দোনেশিয়ার বাটাভিয়া শহরকে কেন্দ্র করে তারা এশিয়া অঞ্চলে বাণিজ্য বিস্তার করে। এই সময় আরাকান ও বাংলার সিল্ক, কটন, চাল ও দাসের চাহিদা ছিল প্রচুর। ওলন্দাজ বণিকদের চড়া দামে এই সব পণ্য অন্যদের কাছ থেকে কিনে নিতে হতো ফলে লাভ হতো কম। তাই তারা সরাসরি বাণিজ্যের জন্য আরাকান ও বাংলায় বাণিজ্য ঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনা করে। বাটাভিয়ার ডাচ কুঠির প্রধান জ্যান গাফ ১৬১৫ সালের মে মাসে দ্যুইভে নামের জাহাজে করে আরাকান ও বাংলার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। 

সেই সময় আরাকানের শাসক ছিলেন মেং খোমাং, যার আরেক নাম ছিল হুসেন শাহ। ১৬১২ সালে আরাকানের সিংহাসনে আরোহণের পর তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয় আরাকান ও চট্টগ্রাম অঞ্চলথেকে পর্তুগীজদের বিতাড়িত করা। কারণ পর্তুগীজরা এই সময় রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে চট্টগ্রামের আরাকানী শাসকদের পক্ষ অবলম্বন করে।

ইতিহাসের এই প্রেক্ষাপটে আরাকানে আসে ওলন্দাজেরা। জ্যান গাফ আরাকান পৌঁছে রাজার কাছে সরাসরি বাণিজ্যের অনুমতি প্রার্থনা করেন। আরাকানে ব্যবসার সুযোগ মিললেও এই যাত্রায় তাদের আর বাংলায় পৌঁছা হয় না। সমুদ্র প্রচ- অশান্ত থাকায় গাফকে বাটাভিয়ায় ফিরে যেতে হয়। যেহেতু চট্টগ্রাম সে সময় আরাকান অধীনে ছিল তাই এই অভিযানের মধ্য দিয়েই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ওলন্দাজদের বাণিজ্যের পথ সুগম হয়।

আরাকানে বাণিজ্যের অনুমতি লাভের পর চট্টগ্রামের কাছে ডিয়াং নামক এলাকা ওলন্দাজদের অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়। এশিয়ায় তখন বাণিজ্য এবং উপনিবেশ বিস্তার নিয়ে পর্তুগীজ ও ওলন্দাজদের মাঝে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। তবে চট্টগ্রামে ওলন্দাজরা তাদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী পর্তুগীজদের সাথে সরাসরি কোনো ধরনের সংঘর্ষে লিপ্ত হয়নি। বরং ফিরিঙ্গিরা তখন বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন অপহরণ করে চট্টগ্রামে নিয়ে আসত। আর রাজা, রাজার প্রতিনিধি কিংবা ওলন্দাজরা তাদের কিনে নিত। পরবর্তীতে ওলন্দাজরা তাদের ক্রীতদাস হিসেবে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে বিক্রি করে দিত। এছাড়া তারা বাংলার চাল, সিল্ক ও কটনের বাণিজ্যেও বেশ লাভবান হয়ে ওঠে।

এই সময় বার্মায় ওলন্দাজ জাহাজের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। কারণ বার্মা রাজার সন্দেহ ছিল আরাকানের নৌবাহিনীকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে ওলন্দাজরা সাহায্য করছে। এরপর ১৬২১ সালে ভারতের মুঘল বাদশা জাহাঙ্গীরের সেনাপতি ইব্রাহিম খান চট্টগ্রাম আক্রমণ করলে ওলন্দাজরা আরাকানের নৌশক্তিকে সাহায্য করে। এ যুদ্ধে বাদশা জাহাঙ্গীর পরাজিত হন। এতে এই অঞ্চলে ওলন্দাজদের প্রতিপত্তি বেড়ে যায়।

থিরি থুডাম্মা বা সালিম শাহ ১৬২২ সালে আরাকানের সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনি তার ভাইকে চট্টগ্রামের শাসক হিসেবে নিয়োগ দেন। পর্তুগীজদের প্রতি কঠোর অবস্থানের কারণে রাজা ওলন্দাজদের বিশেষ সুবিধা প্রদান করেন।

১৬২৪ সালে আরাকান রাজা ওলন্দাজদের কাছে বছরে ২,০০০ থেকে ৩,০০০ দাস বিক্রির প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। দাস ব্যবসা বৃদ্ধির কারণে ১৬২৫ সালে বাংলা থেকে ১০,০০০ নাগরিককে আরাকানে তুলে আনা হয়। কিন্তু এক মহামারিতে ৪,০০০ বন্দীর করুণ মৃত্যু ঘটে। অবশিষ্টদের স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়ে। ফলে দাস ব্যবসায় দারুণ মন্দা দেখা দেয়। 

অন্যদিকে ১৬৩১ সালে স্থানীয় ওলন্দাজ প্রধানের বাটাভিয়ায় পাঠানো এক তথ্যে জানা যায়, আরাকান এবং বাংলায় কয়েক বছর ধরে তেমন চাল উৎপন্ন হয়নি। এতে চাল ব্যবসায় মন্দা এবং এই অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এর প্রভাব ওলন্দাজ বাণিজ্যের উপর পড়ে। 

রাজা নারাপাতি আরাকানের সিংহাসনে আরোহন করার পর চট্টগ্রামে ওলন্দাজদের ব্যবসা আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে – এটা ১৬৩৮ সালের কথা। রাজার অনুমতিক্রমে সে সময় ওলন্দাজদের একটি নৌবহর আরাকান রাজ্যে ঘুরে বেড়াতো মূলত এই অঞ্চলে ওলন্দাজ বাণিজ্য জাহাজের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য।  

১৬৪৩ সালে রাজা নারাপাতি অসুস্থ হয়ে পড়লে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে রাজার নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে। এই সময় ওলন্দাজ বাণিজ্য বহরটিকে মরুহাং-এ আটকে ফেলা হয়। এর সকল পণ্য বাজেয়াপ্ত এবং ক্যাপ্টেনসহ নাবিকদের বন্দী করা হয়। যার ফলে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ওলন্দাজদের ব্যবসা ও প্রভাব দুই দারুণ হ্রাস পায়।         

বাংলার নবাব শায়েস্তা খান ১৬৬৬ সালে তার চট্টগ্রাম অভিযানে ওলন্দাজদের নৌযান দিয়ে সাহায্য করতে বলেন। বিনিময়ে নবাব চট্টগ্রামের কিছু অঞ্চল প্রদান এবং এই বন্দরে ওলন্দাজদের বাণিজ্য শুল্ক মওকুফের বিষয়টি বিবেচনার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। ওলন্দাজরা নবাবকে সাহায্য করতে রাজী হলেও বাটাভিয়া থেকে সে সাহায্য এসে হাজির হয় ১১ অক্টোবর ১৬৬৬ তারিখে। কিন্তু তার নয় মাস আগেই বুজুর্গ উম্মিদ খানের হাতে চট্টগ্রামের পতন ঘটে। এ অঞ্চলে তাদের বাণিজ্যে ভাটা পড়ার এটিও একটি কারণ। তবে অচিরেই সেই মন্দাভাব কাটিয়ে আঠারো শতকের ৩০-এর দশক পর্যন্ত এ অঞ্চলে তারা বাণিজ্য বিস্তার অক্ষুণœ রাখে।

চট্টগ্রাম বন্দরের আবাসন ব্যবস্থা

চট্টগ্রাম বন্দরের অব্যাহত সাফল্যের পেছনে  রয়েছে কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, কর্মনিষ্ঠা ও নিরলস পরিশ্রম। তাদের উৎপাদনশীলতার সর্বোচ্চ স্তরকে কাজে লাগিয়ে ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির চাহিদা পূরণে কাজ করছে বন্দর। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্পৃহা বাড়াতে কর্তৃপক্ষের রয়েছে প্রণোদনামূলক আয়োজন। জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের সাথে সাথে মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের উপর জোর দিচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রায় সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের পোষ্যদের জন্য রয়েছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত আবাসন ব্যবস্থা, হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, ক্লাব, খেলার মাঠ, হাট-বাজার ও ধর্মীয় উপসানালয়।

বন্দরের কাজের বিশেষ ধরন ও প্রকৃতির জন্য নির্বিঘেœ এবং সূচারুভাবে তা পরিচালনার জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থলের কাছাকাছি থাকার ধারণা থেকেই আবাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠে। এখনকার আধুনিক সুযোগ-সুবিধাপূর্ণ আবাসন ব্যবস্থা অল্প সময়ের ব্যবধানে গড়ে ওঠেনি। আবাসনের ইতিহাস বন্দরের ইতিহাসের মতো পুরোনো না হলেও ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই বন্দরে নিয়োজিত শ্রমিক-কর্মীদের জন্য আবাসন সুবিধা গড়ে তুলতে সেসময়কার কর্তৃপক্ষের তৎপরতা দেখা যায়। পাকিস্তান আমলের (১৯৬৫-১৯৬৬) শেষ দিকে সদরঘাট থেকে বন্দর ভবন বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত হওয়ার পর থেকে বন্দর ভবনের কাছেই বর্তমান হাইস্কুল কলোনি, উত্তর ও দক্ষিণ আবাসিক এলাকায় ভবন গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। এসময়ে রেল-পোর্ট ট্রাস্টের অধীনে বন্দর পরিচালিত হতো বলে রেলওয়ের অনেক জায়গায় বন্দরে কর্মরতদের জন্য আবাসিক ভবন তেরি করা হয়। পরবর্তীতে রেলওয়ে ও পোর্ট আলাদা হওয়ার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এসব ভবন ও জায়গার মালিকানার ক্ষেত্রে সৃষ্ট জটিলতা মীমাংসা করা হয়।

ষাটের দশকের মাঝামাঝি চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) এলাকার মহেশখাল সেতু এলাকায় বন্দরের নিজস্ব জায়গায় ৪র্থ শ্রেনির শ্রমিকদের নিজ উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল একটি কলোনি, যা ‘ঢাকা কলোনি’ হিসেবে পরিচিত ছিল। কর্মচারীরা নিজেরা কাঁচা ঘর গড়ে তোলে কলোনিতে। পরবর্তীতে অবশ্য বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের জন্য আবাসনের সকল সুযোগ-সুবিধা সরবরাহ করে। ১৯৮০ সালের দিকে কনটেইনার টার্মিনাল তেরির উদ্যোগ নেয়া হলে অন্যত্র সরিয়ে দেয়া হয় কলোনিটি।

বন্দরের সম্প্রসারণের প্রয়োজনে একসময় জেটির কাছাকাছি থাকা আবাসিক এলাকাগুলো স্বল্প দূরত্বে সরিয়ে নেয়া হয়। নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল তৈরির উদ্যোগ নেয়া হলে ১৯৯০ সালের দিকে ভেঙ্গে ফেলা হয় এ এলাকায় থাকা প্রায় ৫৭ ইউনিট বাসা। আর শ্রমিকদের বৃহত্তম আবাসিক এলাকা যা ‘লেবার কলোনি’ বলে পরিচিত ছিল ডক শ্রমিক ম্যানেজমেন্ট বোর্ড বিলুপ্তির সাথে সাথে এ কলোনিরও সমাপ্তি ঘটে। ২০০৮ সালে শ্রম অধ্যাদেশ গেজেট আকারে প্রকাশিত হলে সকল নিবন্ধিত শ্রমিকদের আত্মীকরণ করা হয়। এখন বেসরকারিভাবে বার্থ  ও টার্মিনাল অপারেটররা শ্রমিক নিয়োগের কাজটি করছে।

স্বাধীনতার পর বন্দর পরিচালনায় নতুন গতি আসে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান বন্দর হিসেবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন। আবাসন সুবিধা বৃদ্ধির অংশ হিসেবে বর্তমান হাইস্কুল কলোনিতে তৈরি করা হয় ৪-৫টি নতুন ভবন। মূলত এ সময় থেকে আধুনিক আবাসন ব্যবস্থার সূচনা ঘটে। এরপর ধাপে ধাপে বন্দরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী-শ্রমিকদের জন্য গড়ে তোলা হয় আবাসিক এলাকা। বাসা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা, সড়ক বাতি, খেলার মাঠ ও পার্কসহ পরিপূর্ণ আবাসন সুবিধা রয়েছে এসব এলাকাগুলোতে। আবাসিক এলাকাগুলোর সাথে হাসপাতাল ও বাজারের রয়েছে উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। নিয়মিত পানি সরবরাহ ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা রয়েছে প্রত্যেকটি ভবনে।

অধুনা বন্দরের পুরাতন ভবনগুলো ভেঙে পুনরায় আরো বেশি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত আবাসিক ভবন তৈরি করা হচ্ছে। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে তৈরি করা হচ্ছে এসব আবাসিক ভবন। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের বিস্তৃতির সাথে সাথে বাড়ছে বন্দরের কর্মকান্ডের ব্যাপ্তি, উন্নয়ন কর্মকান্ড ও অপারেশনাল কার্যক্রম। ফলে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী। নতুন-পুরাতন সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছে কর্তৃপক্ষ।

বন্দর কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা আবাসিক এলাকা। বন্দরের মূল এলাকা থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যেই প্রায় সকল আবাসিক এলাকা তৈরি করা হয়েছে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সহজেই কর্মস্থলে যাতায়াত সুবিধা রয়েছে বলে সঠিক সময়ে কাজে যোগ দিতে পারেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এতে তারা যেমন মানসিক প্রশান্তি পান, তেমনি বন্দরের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতেও তা প্রতিনিয়ত ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

আবাসিক ভবন তৈরি, মেরামত ও বরাদ্দের মূল কাজটি করে থাকে প্রকৌশল বিভাগ। নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বাসা বরাদ্দ পেয়ে থাকেন বন্দর কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এজন্য বন্দরের রয়েছে নিজস্ব আবাসন নীতিমালা। নীতিমালা অনুযায়ী কর্মচারীরা এ, বি, সি টাইপের  (বাসার ধরন) বাসা, ২য় শ্রেনির কর্মকর্তারা ডি টাইপের বাসা ও প্রথম শ্রেনির কর্মকর্তারা ই এবং এফ টাইপের বাসা পেয়ে থাকেন। বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, বোর্ড সদস্য, পরিচালক, বিভাগীয় প্রধান ও উপ-প্রধানদের জন্য  রয়েছে বাংলো। অবিবাহিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য রয়েছে ডরমেটরি সুবিধা। শ্রেনিভেদে বাসার আকার ও আয়তনে ভিন্নতা থাকলেও সকল আবাসিক এলাকায় সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান। রয়েছে উন্নত পানি-নিষ্কাশন ব্যবস্থা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আবাসিক এলাকাগুলোতে ভবন তৈরি করে প্রকৌশল বিভাগ। পরবর্তীতে এগুলোর সংরক্ষণ ও সংস্কারের কাজটিও এ বিভাগ করে থাকে। ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর প্রকৌশল বিভাগ আনুপাতিক হারে বন্দরের বিভিন্ন বিভাগকে বাসা বরাদ্দ দিয়ে থাকে। সংশ্লিষ্ট বিভাগ নিজস্ব কর্মচারীদের গ্রেড, বেতনস্কেল ও জ্যোষ্ঠতার ভিত্তিতে বাসা বরাদ্দ দেয়। তবে কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে প্রকৌশল বিভাগ নিজেই বরাদ্দ দিয়ে থাকে। বরাদ্দের সময় উভয় ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণভাবে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। প্রতি বছর বাসা খালি থাকা সাপেক্ষে এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষ।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের আবাসন ব্যবস্থাপনার অধীনে ৪টি বড় আবাসিক এলাকা রয়েছে। এগুলো ছাড়াও বন্দরের আশেপাশের এলাকা ও স্বল্প দূরত্বে আরো ১০টি স্থানে রয়েছে বন্দরের নিজস্ব আবাসিক ভবন। বড় আবাসিক এলাকাগুলোর মধ্যে বন্দর উত্তর আবাসিক এলাকা, বন্দর পূর্ব আবাসিক এলাকা, বন্দর হাইস্কুল কলোনি, বন্দর দক্ষিণ আবাসিক এলাকা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সদরঘাট, অভয়মিত্রঘাট, বন্দর স্টেডিয়াম সংলগ্ন, আগ্রাবাদ ডেবার পাড়, স্টেশন কলোনি, চাক্তাই, এনায়েত বাজার, টাইগারপাস, আমবাগান ও ওয়্যারলেস কলোনিতে রয়েছে আবাসিক ভবন ও বাংলো। আবাসিক এলাকার ভেতরে ও বাইরে মোট ৭৩৪টি পাকা ও টিনশেড বিল্ডিংয়ে ৩ হাজার ৫৫ ইউনিট বাসা রয়েছে। এরমধ্যে উত্তর আবাসিক এলাকায় অবিবাহিতদের জন্য ৩২০টি ও সদরঘাটে ২৪০টি সিট রয়েছে। সর্বাধিক আবাসিক ভবন রয়েছে বন্দর উত্তর আবাসিক এলাকায়। ফ্যামিলি বাসা ও ডরমেটরি মিলিয়ে এখানে ৪১৮টি ভবনে ৮১২টি ফ্যামিলি এবং ১০টি ভবনে ৩২০ জন ব্যাচেলর থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। বন্দর পূর্ব আবাসিক এলাকায় রয়েছে ৫৩টি ভবন, যেখানে ৯৫০ ইউনিট ফ্যামিলি বাসা রয়েছে। বন্দর হাইস্কুল কলোনিতে ৩০টি ভবনে ১৮৭ ইউনিট ফ্যামিলি বাসা, বন্দর দক্ষিণ আবাসিক এলাকায় ৭৮টি ভবনে ১১৪ ইউনিট ফ্যামিলি বাসা রয়েছে। দক্ষিন আবাসিক এলাকায় রয়েছে সর্বাধিক ৩৭টি বাংলো যা মূলত বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালকবৃন্দ, বিভাগীয় প্রধান ও উপ-প্রধানরা পেয়ে থাকেন।

আবাসিক এলাকাগুলোর বাইরে সর্বাধিক আবাসিক ভবন রয়েছে মনোহরখালীতে। এখানে ২৬টি ভবনে ১০৮ ইউনিট ফ্যামিলি বাসা ও অবিবাহিতদের জন্য ২৪০টি সিট রয়েছে। এরপরে যথাক্রমে সদরঘাটে ১৩টি ভবনে ৮৩ ইউনিট ফ্যামিলি বাসা, অভয়মিত্রঘাটে ১১টি ভবনে ৮২ ইউনিট ফ্যামিলি বাসা, আগ্রাবাদে ৬৮টি ভবনে ৬৯ ইউনিট ফ্যামিলি বাসা, এনায়েত বাজার এলাকায় ৫টি ভবনে ৫ ইউনিট বাসা  ও ২টি বাংলো রয়েছে, স্টেশন কলোনিতে ৪ টি ভবনে ৪ ইউনিট ফ্যামিলি বাসা, চাক্তাইয়ে ২টি ভবনে ২ ইউনিট বাসা, ওয়্যারলেসে ১টি ভবনে ১ ইউনিট ফ্যামিলি বাসা, আমবাগান এলাকায় ২টি ভবনে ২ ইউনিট বাসা ও টাইগারপাসে ২টি ভবনে ২ ইউনিট ফ্যামিলি বাসা রয়েছে।

এছাড়াও সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অধীনে নতুন নতুন আবাসিক ভবন গড়ে তোলা হচ্ছে। ২০০৯ সাল থেকে অদ্যাবধি গত ৮ বছরে বন্দর উত্তর ও পূর্ব আবাসিক এলাকায় বিভিন্ন টাইপের ৪১২ ইউনিট বাসা তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া আরো ৫৭০ ইউনিট বাসা তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের জন্য ৩৬ ইউনিট, কর্মচারীদের জন্য এ, বি ও সি টাইপের যথাক্রমে ৩০, ৪৬৮ ও ৩৬ ইউনিট বাসা রয়েছে। মাস্টার প্ল্যানের অধীনে বন্দর হাইস্কুল কলোনিতে ১ম শ্রেনির কর্মকর্তাদের জন্য ৯ তলা বিশিষ্ট আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত ভবন নির্মাণের কাজ  শুরুর পথে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কনসালটেন্ট নিয়োগ করা হয়েছে। কর্মচারীদের জন্য বন্দর উত্তর আবাসিক এলাকায় প্রায় ৫০ একর জায়গার উপর ১০১টি ভবন নির্মাণের প্রকল্প এগিয়ে চলছে। যেখানে এ, বি ও সি টাইপের প্রায় ৩ হাজার ৬৬০ ইউনিট বাসা নির্মাণ করা হবে। ইতিমধ্যে ৭২ ইউনিট অর্থ্যাৎ ২টি ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। পর্যায়ক্রমে শতভাগ আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নতুন প্রকল্প গ্রহণ করার পরিকল্পনা রয়েছে কর্তৃপক্ষের।

বন্দরের জন্য ভবিষ্যৎ বার্তা

২০১৭ সাল শেষ অর্ধে এসে অন্যান্য সময়ের তুলনায় শিপিং ব্যবসায় বেশ মন্দা ভাব দেখা যাচ্ছে। তাই বিশ্ববাণিজ্যের হৃদপিন্ড হিসেবে পরিচিত এই খাতকে ফের চাঙা করে তুলতে বন্দর আর সংশিষ্ট টার্মিনালগুলো যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে সেগুলো বিবেচনায় আনা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

বর্তমান চিত্রটা বেশ পরিষ্কার

ক্রমবর্ধমান আয়তনের জাহাজগুলোর প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে লভ্যাংশ থাকছে খুবই কম। এতে বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়ছে। এ থেকে উত্তরণে বন্দরসমূহের উচিত ২০২০ বা এর পরবর্তী সময়ের জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখা এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়নের মূল কেন্দ্রগুলো চিহ্নিত করা। কানাডিয়ান আইস হকি খেলায় যেমনটা বলা হয়ে থাকে ‘বল যেখানে আছে, সেখানে নয়, বরং যেখানে যাবে, সেখানেই তোমার থাকা উচিত।’

তবে বন্দরের মতো বিশাল এক অবকাঠামো, যেটি প্রতি মুহূর্ত কর্মচঞ্চল থাকে, প্রতিটি দিন যেখানে আসে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এবং প্রতি মাসে আবশ্যিক কাজের তালিকা যায় বদলে – সেখানে ব্যবসা, বিনিয়োগ, নির্মাণ ও কৌশলগত আগাম পূর্বাভাস এবং তা বাস্তবায়ন করা কতখানি কঠিন তা বলা বাহুল্য। যথোপযোগী কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে বাহবা নেয়া যতটা সহজ, ব্যর্থতার দায়ভার নেয়াটা ততোধিক কঠিন। কারণ বন্দর নিয়ে আমাদের আজকের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি, সঠিক পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের উপর নির্ভর করছে নৌবাণিজ্যে ভবিষ্যত প্রজন্মের সাফল্য। ২০২০ বা ২০৩০ এর দশকে বৃহদাকার যে সব বাণিজ্য তরী সাগরে ভাসতে চলেছে, তাদের মোকাবেলা করতে আমাদের অধিকতর কৌশলী এবং বিচক্ষণ কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষেত্রে পরবর্তী দশকজুড়ে বন্দরে বিনিয়োগ নিয়ে দুটি ধারণা বহাল থাকবে Ñ বন্দরে ডিজিটাল বিপ্লব ঘটানো এবং নিরবচ্ছিন্ন পণ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণে এর প্রধান ভূমিকা অব্যাহত রাখা।

প্রথমত বন্দরের কার্যক্রম আরো গতিশীল করে তুলতে ডিজিটাল বিপ্লবের বিকল্প নেই। স¤পূর্ণ ডকিং এরিয়া ভেঙ্গেচুরে নতুন করে নির্মাণ শুধু সময়সাপেক্ষই নয়, অত্যন্ত ব্যয়বহুল। অত সময় এবং অর্থ – দু’ই বন্দর কর্তৃপক্ষের জন্য জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়ে। এর একটি সমাধান হতে পারে স¤পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে কার্গো হ্যান্ডলিং প্রক্রিয়া পরিচালনা করা। সেক্ষেত্রে ডিজিটাইলেজেশন কান্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। তবে নৌবাণিজ্যে ডিজিটাল প্রযুক্তি এসে সবকিছু এক মুহূর্তে সহজ করে দেবে – এরকম ধারণা নিয়ে থাকা ভুল হবে। আমাদের স্মরণে রাখতে হবে বিজ্ঞানের এই উৎকর্ষের যুগেও নৌপ্রযুক্তি সর্বব্যাপী হয়ে উঠেনি। দূরবর্তী দূরত্বে পরিচালনের ক্ষেত্রে বলা যায়, অনিচ্ছায় হলেও জাহাজ চলাচল এখন হামাগুড়ি দিয়ে চলছে – যেহেতু অটোমেশন ঘিরে প্রাথমিক উদ্দীপনা হ্রাস পেয়েছে বহুলাংশে। সমস্যাটা প্রযুক্তির নয় মোটেও – তা গ্রহণ করার মানসিকতায়।

অবশ্য মাঝারি দূরত্বে চলাচলকারী জাহাজগুলোতে আজকাল সার্বক্ষণিক স্যাটেলাইট যোগাযোগ রয়েছে। যার মানে হলো জলের জাহাজ স্থলের বন্দর বা অফিসের সাথে ২৪ ঘন্টাই সংযুক্ত থাকছে। যেসব সিদ্ধান্তশুধু জাহাজের ব্রীজে বা ইঞ্জিনরুমে নেয়া হতো, তা এখন একই সময়ে তিন হাজার মাইল দূরের অফিসে বসেও নেয়া যায়।

ঠিক এই ধরনের উন্নয়ন বন্দরের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। গত বছরের এপ্রিলে ইউএস শ্রমমন্ত্রী থমাস পেরেজ এবং বাণিজ্যমন্ত্রী পেনি প্রিটজকার জার্মানির হামবুর্গ বন্দর পরিদর্শন করেন। সেখানে তাঁরা গিয়েছিলেন অল্টেনভের্ডার কন্টেইনার টার্মিনালে, যা পুরোপুরি অটোমেটেড। মন্ত্রী পেরেজ সেখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলেন। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিক চাহিদা মেটাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বন্দরের জন্য নেয়া প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কিছু পদক্ষেপ তুলে ধরেন তিনি। পোর্ট অব লস এঞ্জেলস এবং পোর্ট অব লং আইল্যান্ড বিভিন্ন প্রকল্পে বেশ বড় অংকের বিনিয়োগ করেছে, অর্থাৎ বন্দর পরিচালন ক্ষমতা এবং দক্ষতা দুটোই বাড়বে সন্তোষজনক হারে। ভার্জিনিয়া বন্দর বলছে, পণ্যবাহী কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে অটোমেটিক স্ট্যাকিং ক্রেন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম, যা আবার পরিবেশ বান্ধবও বটে। আসছে স্বয়ংক্রিয় প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং দূর নিয়ন্ত্রিত মনুষ্যবিহীন জলযান এবং স্ট্র্যাডল ক্যারিয়ার। এছাড়া রয়েছে স্বয়ংক্রিয় মুরিং ও বার্থিং সিস্টেম, অনশোর পাওয়ার এবং ক্রেন সুবিধা।

গ্লোবাল ইনস্টিটিউট অফ লজিস্টিকসের সিইও কাইরান রিং এর বিশ্বাস, একুশ শতকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ নিদর্শন থাকবে পোর্ট ম্যানেজমেন্ট এর ক্ষেত্রে। বিনিয়োগকারী ও নীতিনির্ধারণী মহলে প্রাথমিকভাবে হয়তো এসব প্রকল্প উচ্চাভিলাষী মনে হতে পারে। কিন্তু বন্দরের চিরকালীন কিছু সমস্যা যেমন: শ্রমিক অসন্তোষ, রাজনৈতিক অস্থিরতা অথবা সীমিত জায়গা Ñ এসবের স্থায়ী সমাধান মিলবে।

স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি যে শুধু জেটি বা টার্মিনালে তৎপর থাকবে, তা নয়। বরং বন্দরের ভেতরে অথবা চারপাশের সকল ক্ষেত্র অটোমেশনের আওতায় আনা উচিত, একেবারে প্রবেশদ্বার থেকে শুরু করে। এতে সমুদ্রগামী ভেসেল এবং অফশোরে এর পরিচালন, লোডিং, ডকিং প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত সকলের মধ্যে একই ছন্দে কাজ করার স্বাচ্ছন্দ্য ও গতি আসবে। বন্দরের যন্ত্রপাতি, টার্মিনাল এবং বিভিন্ন পরিসেবা – সকলে সমন্বয়ের মাধ্যমে কার্য সম্পাদন করলে সাশ্রয় হবে শ্রম এবং সময়ের। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বন্দরে ভিক্টোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল কনটেইনার টার্মিনালে প্যানাম্যাক্স জাহাজের উপযোগী ছয়টি শিপ-টু-শোর গ্যান্ট্রি ক্রেন সমন্বিতভাবে কাজ করছে স্বয়ংক্রিয় ইয়ার্ড ক্রেনের সাথে যা টার্মিনালটিকে একটি ‘পেপারলেস টার্মিনাল’ এ পরিণত করেছে। লিভারপুল ২ পীল পোর্টে আছে অত্যাধুনিক অটোগেট প্রযুক্তি। এ সকল কর্মকান্ডের  উদ্দেশ্য আনলোডিংকারী ক্যারিয়ার ট্রাক টার্মিনালে প্রবেশের পূর্বেই পণ্যের নিরাপত্তা প্রদান, ঝুঁকি হ্রাস এবং দ্রুততর সময়ে আমদানি-রপ্তানি নিশ্চিত করা।

যখন পরিবহন সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে, অবাধ তথ্যপ্রবাহ এবং পুনরাবৃত্তিমূলক সেবা যখন নিশ্চিত হয়, তখন কনটেইনার ভিত্তিক নৌবাণিজ্য সর্বোত্তমভাবে কাজ করছে বলা যায়। অতএব সহজেই অনুমেয়, কেন কনটেইনার খাতে অটোমেশন প্রকল্পে পূর্বের তুলনায় বেশি বরাদ্দ থাকা উচিত। সেক্ষেত্রে তেলবাহী ট্যাংকার, রো-রো, শুকনো বাল্ক জাহাজ বা কোস্টাল শিপিং সার্ভিসে ডিজিটাল সামর্থ্য কাজে লাগিয়ে অধিকতর লাভবান না হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা আশা করতে পারি পর্যটন জাহাজসমূহও স্বয়ংক্রিয়তার দিকে দ্রুত অগ্রসর হয়ে বিশ্ব পর্যটন-পরিবহনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলবে, যদিও নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে যন্ত্রের তুলনায় মানুষই বেশি নির্ভরযোগ্য।

পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নহীন রাখতে বন্দর কর্তৃপক্ষগুলো এখন আরো স্বচ্ছ, দক্ষ ও সমন্বিত। বন্দরের সকল বিভাগ, দপ্তর ও ব্যবহারকারী নিজেদের মধ্যে সুসংগঠিত থেকে একযোগে কাজ করার পাশাপাশি হিন্টারল্যান্ড এবং অন্যান্য বন্দরের সাথে যুক্ত থাকার নীতি গ্রহণ করছে। পোর্ট ম্যানেজমেন্ট এখন আর বিচ্ছিন্ন থেকে নয়, বরং আরো বিস্তৃত সুবিধা দেয়া এবং ডিজিটালি সংযুক্ত বিশাল নেটওয়ার্কের অংশ হওয়ার কথা ভাবছে। যেখানে জল এবং স্থল, দুই দিকেই সমান গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

কাইরান রিং বলেন, “নৌবাণিজ্যে স্বয়ংক্রিয়তা আনাটা অত্যাবশ্যক, তবে মূল লক্ষ্য নয়। উদ্দেশ্য হলো প্রস্তুতকারক, সরবরাহকারী হয়ে আমদানিকারক ও ভোক্তা – সকলকে একই সুতায় বাঁধা। তাই কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে আমরা যতই আধুনিক হই না কেন, সঠিক সমন্বয় না থাকলে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির খরচ এবং সময় কিছুতেই কমিয়ে আনা সম্ভব নয়।”

সকল বন্দরকে অভিন্ন সিস্টেমের অংশ হয়ে উঠতে এখনো বহুদূরের পথ পাড়ি দিতে হবে। প্রশ্ন এসে যায় – পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাকে একই শৃঙ্খলায় নিয়ে আসার সঠিক পথ তবে কী? পুরো ব্যবস্থাটির নিয়ন্ত্রণ আসলে কার হাতে থাকা উচিত এবং ঠিক কতখানি কার্যকর হবে সেটি? একটা উপায় হতে পারে যে, বন্দরে একটি অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা পরিচালনা করা যে, সকল বন্দরের জন্য অভিন্ন পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে ফলপ্রসূ হবে কিনা? যেমনটা দেখা গেছে পোর্ট অব ভার্জিনিয়াতে। সেখানে নিরীক্ষা শেষে দেখা যায় ফুল অটোমেটেড টার্মিনালের কারণে দারুন ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে সম্পূর্ণ লজিস্টিক সিস্টেমের উপর। ধীরে ধীরে সকল বন্দর এই রূপান্তরের অংশীদার হতে যাচ্ছে, এ আশাবাদ করাই যায়।

অটোমেটেড টার্মিনালে কনটেইনার নামানোর সময়ের সাথে মিলিয়ে এটিকে খালাসের জন্য প্রাইম মুভার বা কনটেইনারবাহী ট্রাক আনানো হয়। ফলশ্রুতিতে মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে আমদানিকৃত পণ্য বন্দর ত্যাগ করতে সক্ষম হয় এবং পণ্যজট অনেকাংশে হ্রাস পায়। কালক্ষেপণ যত কম, আমদানি খরচও তত নীচের দিকে থাকে। রেল ওয়াগন ব্যবহার, নতুন রেল ট্র্যাক স্থাপন ও সঠিক ব্যবহার, রেলের জন্য মার্শালিং ইয়ার্ড তৈরি – পণ্য স্থানান্তরে দ্রুততার নির্দেশক। যার সুফল ভোগ করে সাধারণ ভোক্তা।

জিপিএস ট্র্যাকিং সেন্সর এবং স্যাটেলাইট প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নয়নের ফলে তথ্য এখন খুবই সহজলভ্য। যদিও এ ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা খোলা সাগরে সবসময় সংযুক্ত থাকার ১০০% নিশ্চয়তা দেয় না, তবুও অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে নৌযোগাযোগ বর্তমানে ভালো অবস্থানে আছে। শেষ পর্যন্ত চৌকস বন্দর মানে দাঁড়ায় নৌবাণিজ্যের সফল পরিচালক। আর দিন শেষে বাণিজ্য মানে হল উচ্চতর লভ্যাংশ। এ কারণে ভবিষ্যতের বন্দরের জন্য এ সকল পদক্ষেপ খুবই জরুরি।

উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা তাকেই বলে যখন অবাধে তথ্য পাওয়ার সুবিধা থাকে। কেবলমাত্র তখন সামগ্রিক উন্নয়নের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে বন্দরসমূহ একটি দেশকে নেতৃত্ব দিতে পারে। পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় ডিজিটালাইজেশন আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে গতি আনে, দক্ষতার ক্ষেত্রে প্রাণ সঞ্চার করে। অঞ্চলভিত্তিক বন্দরগুলো প্রতিযোগী নয়, বরং সহযোগী হিসেবে সমন্বয়ের মাধ্যমে করে মাধ্যমে আঞ্চলিক সমৃদ্ধিতে নিজ নিজ দেশের নেতৃত্ব দিতে পারে।

– রিচার্ড ক্লেটন: প্রধান মেরিটাইম করসপনডেন্ট, ফেয়ারপ্লে

ভাষান্তর: আফরোজা বিথী

১৬৮৫ সালেই চট্টগ্রাম দখলের চেষ্টা ব্রিটিশদের

ব্রিটিশদের দখলে চট্টগ্রাম

ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের আগমন ব্যবসায়ী হিসেবে। কিন্তু ব্যবসা ও ক্ষমতা নিরঙ্কুশ বিস্তারের লক্ষ্যে ক্রমশ তারা এখানকার রাষ্ট্রনীতিতে হস্তক্ষেপ শুরু করে। অবস্থানগত কারণে ব্রিটিশদের বাণিজ্য প্রসারে চট্টগ্রাম বন্দর ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে বাংলার শাসকদের সাথে দ্বন্দ্ব, অন্যদিকে মগ জলদস্যু এবং অন্যান্য ঔপনিবেশিক দেশগুলোর উপর আধিপত্য বিস্তার করতে ১৬৮৫ সালে ব্রিটিশরা প্রথম চট্টগ্রাম দখলের চেষ্টা চালায়। এডমিরাল নিকেলসনের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নৌবহরের চট্টগ্রাম বন্দর দখলের প্রচেষ্টা সেবার ব্যর্থ হয়। অবশেষে ১৭৬০ সালে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব মীর কাশেম বর্ধমান ও মেদিনীপুরসহ চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চিফ ভেরলেস্টের কাছে হস্তান্তর করেন।

ব্রিটিশ-বার্মা যুদ্ধ

১৭৮৪ সালে বার্মার শাসক আরাকান রাজ্য দখল করে নেয়। স্বাধীনতা লাভের প্রচেষ্টায় আরাকানের কিছু নাগরিক বার্মার শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যায়। এরা মূলত চট্টগ্রাম, আসাম ও মণিপুরের জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে বার্মা রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করত। ১৮২৪ সালে আরাকানে নিযুক্ত বার্মিজ গভর্নর এই বিদ্রোহীদের নিশ্চিহ্ন করতে আসামের কাছাড়, জৈন্তাপুর এবং চট্টগ্রামের গভীর জঙ্গলে একদল সেনা পাঠায়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বার্মা সরাসরি ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। আরাকান সেনাদলটি নাফ নদীর তীরে অবস্থিত শাহপরী দ্বীপ দখল করে নেয়। এরপর সেখান থেকে ৮০০০ বার্মিজ সেনার একটি দল চট্টগ্রাম শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পথে তারা রামুতে অবস্থিত ব্রিটিশ সেনা ছাউনিতে হামলা চালায়। এই ঘাঁটির দায়িত্বে ছিল ৩০০ দেশীয় সিপাহী, যাদের কাছে ছিল কিছু দেশি অস্ত্র আর দুটি বন্দুক। এই সেনাদলকে সহজেই পরাজিত করে বার্মিজ বাহিনী চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। তবে তাদের এই অভিযান বর্ষার কারণে থেমে যায়। প্রবল বৃষ্টিপাতে পাহাড়ি রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়লে তারা রামুতে অবস্থান করতে থাকে। কিন্তু ইতিমধ্যে ব্রিটিশরা বার্মার রাজধানী রেঙ্গুন আক্রমণ করলে বার্মিজ এই বাহিনীকে রাজধানী রক্ষার লড়াইয়ে সেখানে ফিরে যেতে হয়। এভাবেই বার্মার শাসকদের চট্টগ্রাম অভিযানের ইতি ঘটে।

চট্টগ্রামে সিপাহী বিদ্রোহ

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের সময় চট্টগ্রাম অঞ্চল কোম্পানির কাছে শান্তিপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত ছিল। তবে ১৮৫৭ সালে সারা ভারতে সিপাহী বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লে চট্টগ্রামেও তার প্রভাব পড়ে। চট্টগ্রামে ১৮৫৭ সালের ১৮ নভেম্বরে দেশীয় সিপাহীদের নিয়ে গঠিত ৩৪ নেটিভ ইনফেন্ট্রি বাহিনীর দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ কোম্পানি বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তারা প্রথমে জেলখানায় হামলা চালায় এবং সেখানকার কারাবন্দীদের মুক্ত করে দেয়। এরপর বিদ্রোহীরা সরকারি তিনটি হাতি এবং ট্র্রেজারি লুট করে। ট্রেজারি থেকে লুট করা ২৭,৮০০ পাউন্ড অর্থ এবং হাতি নিয়ে সিপাহীরা ত্রিপুরার (কুমিল্লা) পাহাড়ি অঞ্চলে চলে যায়। ট্রেজারি লুটের সময় দেশীয় একজন পুলিশ কনস্টেবল বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়। যদিও সিপাহীদের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা, এদেশি মানুষের রক্তপাত ঘটানো নয়। বিদ্রোহীরা পাহাড়ি এলাকায় পৌঁছালে ত্রিপুরার রাজা এবং স্থানীয়রা তাদের আটক করে ব্রিটিশদের কাছে হস্তান্তর করে।

বন্দরের প্রাণ ফিরল আসামের চা’য়ে!

ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে কলকাতা বা চট্টগ্রাম নয়, বন্দর হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের হুগলীর সমৃদ্ধি ঘটে। তবে সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবহার বাড়তে শুরু করে। ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত ব্রিটিশ ইম্পিরিয়াল গেজেটে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের আগমন বাড়তে থাকার বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়। সেখানে দেখা যায় ১৮৮১-৮২ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের আগমন এবং এই বন্দর দিয়ে আমদানি ও রপ্তানির পরিমাণ বিগত বছরগুলোর তুলনায় দারুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই কারণে বন্দরে পণ্য পরিবহনে গতি আনতে ১৮৮৩ সালে ব্রিটিশ সরকার চটগ্রাম থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

১৮৬০-৬১ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে ৬৬টি জাহাজ প্রবেশ করে। সে বছর এই বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির সামগ্রিক পরিমাণ ছিল ৯,৭৪৩ টন। পরবর্তী পাঁচ বছরে চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবহার নাটকীয় রকমের বৃদ্ধি পায়। ১৮৬৫ সালে মোট ২২১টি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবেশ করে এবং মোট রপ্তানি-আমদানি পণ্যের পরিমাণ ছিল ৪৪,২৮২ টন।

১৮৮১-৮২ সালে এই বন্দরে ৭৭১টি জাহাজ ভেড়ে  এবং এই সময়ে ১,৭৩৬,৪৮০ সেন্টাম ওয়েট বা হাইড্রোওয়েট টন (এক সেন্টাম বা হাইড্রোওয়েট টন সমান ১১২ পাউন্ড) পরিমাণ পণ্য আমদানি করা হয়, যার মূল্য ছিল  ৪৭১,৮৬১ পাউন্ড। চট্টগ্রাম থেকে রপ্তানি পণ্য নিয়ে ৭৭৩টি জাহাজ বন্দর ত্যাগ করে, যার পরিমাণ ছিল ২৫১,৩৪৩ সেন্টাম বা হাইড্রোওয়েট টন, আর এর মূল্য ছিল ১৪০,৮৩০ পাউন্ড। এই অর্থ বছরে বন্দরের মোট আয়ের পরিমাণ ছিল ৬,০৮২ পাউন্ড।

বন্দরের এই প্রবৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ আসামের চা। সেই সময় ইংল্যান্ডকে চড়া মূল্যে – শুধু রূপার পরিবর্তেই চা কিনতে হত চীন থেকে। তাই স্কটল্যান্ডের নাগরিক রবার্ট ব্রুস ১৮২৩ সালে আসামে চায়ের গাছ আবিস্কার করলে, সেখানে চা বাগান তৈরির হিড়িক পড়ে যায়। এই চা রপ্তানির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত বন্দর হিসেবে বিবেচিত হয় চট্টগ্রাম। যার ফলে চাল ও পাটের সাথে আসামের চা ঊনবিংশ শতকের শেষ পর্যায়ে চট্টগ্রাম বন্দরের পুরোনো গৌরবের অনেকটা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।

বার্ষিক সাংস্কৃতিক পরিবেশনা মেধাবী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা

চট্টগ্রাম বন্দর যেমন দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে তেমনি সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে পরিচালনা করে আসছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ১০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বন্দর পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ভাল ফলাফল ও সহ-পাঠ্য কার্যক্রম  চর্চার মাধ্যমে এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। শিক্ষার্থীদের ভাল ফলাফলে অনুপ্রাণিত করতে রয়েছে পুরস্কার। আর সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে শিক্ষার্থীদের নানান পরিবেশনা নিয়ে আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। বন্দর কর্তৃপক্ষ উচ্চ বিদ্যালয়, বন্দর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং পিএসসি, জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের ‘চেয়ারম্যানস্ অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল ২২, ২৩ ও ২৪ মে। টানা তিনদিন তিনটি অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলেছে পুরো মাস জুড়ে। অনুষ্ঠান ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিল উৎসাহ উদ্দীপনা আর বিদ্যালয়গুলোতে ছিল উৎসবের আমেজ। বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সরব উপস্থিতি এসব অনুষ্ঠানকে দিয়েছে বাড়তি মাত্রা।

সেরাদের জন্য চেয়ারম্যানস্ অ্যাওয়ার্ড

বন্দর পরিচালিত স্কুলসমূহের কৃতি ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহিত করতে ২০০৪ সালে ‘চেয়ারম্যানস্ অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান চালু করেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তৎকালীন চেয়ারম্যান একেএম শাহাদাত হোসেন। এরই ধারাবাহিকতায় এবারো পিএসসি, জেএসসি, জেডিসি, দাখিল ও এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ছাত্রছাত্রীদের দেয়া হয়েছে এ পুরস্কার। গত ২৪ মে শহীদ মুন্সী ফজলুর রহমান অডিটোরিয়ামে বন্দর পরিচালিত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ২৪৬ জন ছাত্রছাত্রীকে দেয়া হয় এ পুরস্কার। বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম খালেদ ইকবাল প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে ছাত্রছাত্রীদের হাতে সনদ ও প্রাইজমানি তুলে দেন। অনুষ্ঠানে বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (প্রশাসন) সাদেকা বেগমের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য- কমডোর জুলফিকার আজিজ, জাফর আলম, কমডোর শাহীন রহমান এবং কামরুল আমিন।

বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম খালেদ ইকবাল বলেন, ‘ধারাবাহিকভাবে ভাল ফলাফল করতে হবে। নির্দিষ্ট সময় পড়ালেখার বাইরে নিয়মিত খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চা করতে হবে।’

এবারের চেয়ারম্যানস্ অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে ২০১৫ সালের পিএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত বন্দরের চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬৪ জন, এবতেদায়ী পরীক্ষায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত বন্দর মোহাম্মদীয়া দাখিল মাদ্রাসার ৩ জন, বন্দর কর্তৃপক্ষ উচ্চ বিদ্যালয়ের ২০১৫ সালের জেএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ৮ জন, সাধারণ জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ১৬ জন, এসএসসি পরীক্ষায় ২০১৫ ও ২০১৬ সালে গোল্ডেন জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ৭ জন, সাধারণ জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ২৩ জন, বন্দর কর্তৃপক্ষ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ২০১৫  সালের জেএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ১৪ জন, সাধারণ জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ৩২ জন, ২০১৫ ও ২০১৬ সালের এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ১১ জন ও সাধারণ জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ৩১ জন এবং বন্দর মোহাম্মদীয়া দাখিল মাদ্রাসার ২০১৫ সালের জেডিসি পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ২ জন, সাধারণ জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ৫ জন, ২০১৫ ও ২০১৬ সালের দাখিল পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ১ জন ও সাধারণ জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ১৯ জনকে সনদ ও প্রাইজমানি প্রদান করা হয়। এছাড়া বন্দর কর্তৃপক্ষ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও বন্দর কর্তৃপক্ষ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেধা ও বুদ্ধিমত্তার বিচারে ৫ জন করে ১০ জন চৌকষ শিক্ষার্থীকে চেয়ারম্যানস্ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়।

শতাধিক ছাত্রীর অংশগ্রহণে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

প্রত্যেকটি শিশুরই একটি নিজস্ব জগৎ আছে। পড়ালেখার পাশাপাশি ছবি আঁকা, গান, নাচ, খেলাধুলা ও নিজেদের ভালোলাগার বিষয়গুলো নিয়ে থাকতে চায় তারা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়ে উঠে না। অভিভাবকদের চাওয়া পাওয়ার ভীড়ে হারিয়ে যায় শিশুদের স্বকীয়তা। চলমান জীবনের এই বাস্তবচিত্র নাটকের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন বন্দর কর্তৃপক্ষ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। ‘লেখাপড়া’ শিরোনামের এই নাটকের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শিশুদের উপর কোনো কিছু চাপিয়ে না দিয়ে তাদের স্বকীয়তা ও স্বতঃস্ফূর্ততার উপর অভিভাবকদের গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। গত ২৩ মে বিদ্যালয়ের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে চমকপ্রদ এ উপস্থাপনা প্রশংসা কুড়িয়েছে সবার।

নাটকের পর যাপিত জীবনের আরেক সমস্যা ‘মোবাইল ফোনের বিড়ম্বনা’ নিয়ে ব্যতিক্রমী মূকাভিনয় উপস্থাপন করে শিক্ষার্থীরা। ‘আমি তাকডুম তাকডুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’ গানের সাথে নৃত্যের তালে তালে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শুরু হয়। এরপর একে একে আধুনিক গান, যন্ত্রসংগীতের সুরে নৃত্য, জারিগান, ভাওয়াইয়া গান, আবৃত্তি, আধুনিক ও পাহাড়ী নৃত্য নিয়ে মঞ্চে আসেন শিক্ষার্থীরা। প্রায় শতাধিক ছাত্রীর এসকল পরিবেশনা মুগ্ধ করে দর্শকদের।

অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে বিদ্যালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা রাফিয়া খাতুন। এরপর একাডেমিক ফলাফলে মেধাস্থান অর্জনকারী শিক্ষার্থী, জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী, রচনা প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী সকল শিক্ষার্থীকে পুরস্কৃত করা হয়।

পুরস্কারে অনুপ্রাণিত হলো বালকেরাও

বন্দর কর্তৃপক্ষ উচ্চ বিদ্যালয়ের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান গত ২২ মে শহীদ মুন্সী ফজলুর রহমান অডিটোরিয়ামে উদ্যাপিত হয়েছে।

বিদ্যালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন প্রধান শিক্ষক মো. মোকতার হোসাইন। বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. রেজাউল আবেদীনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বন্দরের পর্ষদ সদস্য জাফর আলম এবং কামরুল আমিন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার পাশাপাশি আধুনিক বিশ্বে নিজেকে একজন যুগোপযোগী ও চরিত্রবান মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে হবে। শিক্ষা অর্জনের মূল উদ্দেশ্য সনদ অর্জন নয়, মূল উদ্দেশ্য হতে হবে দেশ ও মানুষের কল্যাণে একজন আত্মপ্রতিষ্ঠিত সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠা।’

দ্বিতীয় পর্বে অতিথিরা ৭ম-১০ম শ্রেণির বার্ষিক পরিক্ষায় শীর্ষ স্থানের ৩ জন, জেএসসি ও এসএসসি পরিক্ষায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগীতার বিজয়ী ছাত্রদের পুরস্কার প্রদান করা হয়। এছাড়া নৌস্কাউটে প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত ১০ম শ্রেণির ছাত্র আলজবি হোসেনকে বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয়। এরপর ছাত্রদের অংশগ্রহণে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা অনুষ্ঠিত হয়। আধুনিক গান, আঞ্চলিক গান, জারিগান, নাচ, আবৃত্তি এবং কৌতুক পরিবেশনের মাধ্যমে অতিথি ও দর্শকদের মুগ্ধ করেন ছাত্ররা।

বিশ্বের প্রথম মিথানল চালিত ফেরি চালু করছে স্টেনা লাইন

ভবিষ্যতের জন্য টেকসই ও পরিবেশবান্ধব সমুদ্রপরিবহন ব্যবস্থা বিনির্মাণে প্রয়োজন উন্নততর প্রযুক্তি। এজন্য বিকল্প জ্বালানি হিসেবে স্টেনা লাইন বেছে নিয়েছে মিথানলকে। সুইডেনের কিয়েল-গোথেনবার্গ জলপথে প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি চালু করেছে বিশ্বের প্রথম মিথানল চালিত ফেরি।

২৬ মার্চ ‘স্টেনা জার্মানিকা’ ফেরিটি দু’মাসের রূপান্তর প্রক্রিয়ার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে পুনরায় কার্যক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। এরই মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম শিপিং কোম্পানি হিসেবে স্টেনা লাইন পরিবেশবান্ধব মিথানলকে প্রধান জ্বালানী হিসেবে ব্যবহারকারী জাহাজের পরিচালনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিল। এই মাইলফলককে স্মরণীয় করে রাখতে ২৭ মার্চ কিয়েলে এবং ৩০ মার্চ গোথেনবার্গে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। 

স্টেনা লাইনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কার্ল জোহান হ্যাগম্যান বলেন. ‘মিথানলের সম্ভাবনা নিয়ে আমরা নিঃসন্দেহে আশাবাদী, নৌপরিবহন খাতের ভবিষ্যৎ জ্বালানি হতে যাচ্ছে এটি। সাথে পরিবেশ সুরক্ষায় যা নৌখাতে একটি অভূতপূর্ব বিপ্লবের সূচনা করবে’।

মিথানল সহজে পচনশীল, পরিবেশবান্ধব এবং সাশ্রয়ী। এর ব্যবহারের ফলে নৌযানসমূহ থেকে সালফার ও অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান নিঃসরণের হার ৯৯% পর্যন্ত হ্রাস পাবে। শিপইয়ার্ডে স্টেনা জার্মানিকার ফুয়েল সিস্টেম ও ইঞ্জিন পরিবর্তনের কাজটি সম্মিলিতভাবে করেছে স্টেনা লাইন ও ওয়ার্টসিলা। ফেরিটিতে ব্যবহৃত প্রযুক্তিকে বলা হয় ডুয়াল ফুয়েল প্রযুক্তি যেখানে মিথানল প্রধান জ্বালানি হিসেবে থাকলেও জরুরি মুহূর্তে মেরিন গ্যাস অয়েল (এমজিও) ব্যবহারের সুযোগ থাকবে।

স্টেনা জার্মানিকার রূপান্তরিকরণ হয়েছে পোল্যান্ডের ড্যানস্ক শহরের রেমোনতোভা শিপইয়ার্ডে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘মোটরওয়েজ অফ দ্য সিজ’ উদ্যোগ এই প্রকল্পে সহযোগিতা প্রদান করেছে। মোট ২২ মিলিয়ন ইউরো ব্যয়ে সম্পন্ন এই প্রকল্প এরই মাঝে প্রযুক্তির সৃষ্টিশীল ব্যবহার এবং পরিবেশগত সুরক্ষার জন্য প্রশংসিত হয়েছে।  

স্টেনা লাইন বহু বছর ধরে এনার্জি সেভিং প্রোগ্রামে (ইএসপি) বিনিয়োগ করে আসছে যা টেকসই পরিবেশ উন্নয়নে প্রতিষ্ঠানটির অঙ্গীকারেরই প্রকাশ। 

মিথানলের নানাদিক

মিথানল একটি বর্ণহীন তরল পদার্থ যা উৎপন্ন হয় মূলত প্রাকৃতিক গ্যাস. কয়লা, জৈববর্জ্য অথবা কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে। জ্বালানি হিসেবে মিথানলের ব্যবহারে অন্যান্য আন্তর্জাতিক জ্বালানির তুলনায় সালফারের নিঃসরণ ৯৯% এবং নাইট্রোজেনের নিঃসরণ ৬০% পর্যন্ত হ্রাস পায়। এছাড়াও এটি ব্যবহারে ক্ষতিকর পার্টিকেলের (পিএম) নিঃসরণ ৯৫% এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের নিঃসরণ ২৫% কমে যায়। মিথানল থেকে নিঃসরিত উপাদানের পরিমাণ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) হতে নিঃসরিত উপাদানের প্রায় সমান। কিন্তু মিথানলের উৎপাদন প্রক্রিয়া তুলনামূলক সহজ এবং এর ব্যবহারে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত চাহিদাও কম।

সূত্র: প্রেস রিলিজ, স্টেনা লাইন ডট কম

অনুলিখন- মনীষ দাশ

প্রদায়ক, বন্দরবার্তা

শায়েস্তা খানের আমলে মুঘলদের দখলে এলো চট্টগ্রাম

আরাকান আমলে চট্টগ্রাম বন্দরের সমৃদ্ধি ঘটলেও সে সময় দৌরাত্ম বেড়ে যায় পর্তুগীজ এবং মগ জলদস্যুদের। এরা চট্টগ্রামের আশেপাশে সন্দ্বীপের মত দ্বীপে ঘাঁটি গেড়ে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে লুটপাট করত এবং লুটের সামগ্রী চট্টগ্রাম বন্দরে এনে বিক্রি করত। মূল্যবান সামগ্রী ছাড়াও তারা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কিশোর-কিশোরী কিংবা সাধারণ নাগরিকদের তুলে নিত দাস হিসেবে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে।

বাংলায় যখন জলদস্যুরা অত্যাচার চালাচ্ছিল সে সময় সম্রাট শাহজাহানের চার পুত্রের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে দ্বন্দ্বে পরাজিত শাহ সুজা পালিয়ে আরাকানে আশ্রয় নেন। শাহ সুজার কন্যাকে আরাকান রাজ বিয়ে করতে চান, কিন্তু মুঘল যুবরাজ শাহ সুজা কিছুতেই আরাকান রাজার কাছে তার কন্যাকে বিয়ে দেবেন না। এই নিয়ে সংঘর্ষে শাহ সুজা সপরিবারে নিহত হন। মুঘল সিংহাসন দখলে শাহ সুজা ছিলেন আওরঙ্গজেবের প্রতিদ্বন্দ্বী। তবুও  ভ্রাতৃ হত্যা মেনে নিতে পারেন নি সম্রাট আওরঙ্গজেব। অবিলম্বে তিনি চট্টগ্রামকে আরাকান মুক্ত করতে তার অন্যতম সেরা সেনাপতি শায়েস্তা খানকে অভিযানের আদেশ প্রদান করেন। তবে চট্টগ্রাম দখল এত সহজ ছিল না, কারণ চট্টগ্রাম ছিল আরাকানদের এক সমৃদ্ধ বন্দর, যেখানে ছিল এক শক্তিশালী নৌঘাঁটি এবং দুর্ভেদ্য দুর্গ। এই বাহিনীতে ছিল ঘুরবা, জালবা, খালুস ও ঢুমাস নামের নৌযান। এগুলো এমন শক্ত কাঠ দিয়ে বানানো হত যে ছোট আকারের কামানের ঘায়েও ক্ষতিগ্রস্ত হত না।

শায়েস্তা খান যখন বাংলার সুবেদার বা শাসক হয়ে আসেন সে সময় চট্টগ্রাম মারাক-উ নামের এক আরাকান রাজ্যের প্রধান বন্দর। ফলে বন্দরের নিরাপত্তার জন্য আরাকান সম্রাট এক  শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠন করেছিল। তবে চট্টগ্রামের নিযুক্ত বেশ কিছু আরাকানী শাসকের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে আরাকান সম্রাট প্রতি বছর চট্টগ্রামে  নতুন করে একদল সেনা পাঠাতেন।

চট্টগ্রাম বন্দর এবং দুর্গ ছিল আরাকান সাম্রাজ্যের গর্ব। চারপাশের সুউচ্চ পাহাড় আর ঘন জঙ্গল দ্বারা প্রাকৃতিক ভাবে সুরক্ষিত ছিল তা। চট্টগ্রাম থেকে ফেনী যেতে ৯৯টি নালা পার হতে হত। এই সকল নালা বর্ষকালে থাকত খুবই খরস্রোতা। দুর্গটি ছিল কর্ণফুলী নদীর পাড়ে। দুর্গের একপাশে প্রায় ৮ গজ প্রশস্ত এক গভীর পরিখা খনন করা হয়। দুর্গের ভেতর দুটি ঝর্ণা প্রবাহিত ছিল। ঝর্ণা দুটির পানি এসে কর্ণফুলী নদীতে পড়ত। বর্ষাকালে এই ঝর্ণা বেশ বড় আকারের খালে পরিণত হত।

৮ মার্চ, ১৬৬৪ সালে শায়েস্তা খান বাংলার সুবেদার হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। ঢাকায় এসে তিনি একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তৈরি হয় ৭৬৮টি নৌকার সশস্ত্র এক বহর। তার এই নৌবহরের অবস্থান ছিল ঢাকায়। এই বাহিনীতে ৯২৩ জন ফিরিঙ্গি বা পর্তুগীজ নাবিক ছিলেন। নবাব মূলত হুগলীর পর্তুগীজদের তার নৌবহরে অর্ন্তভুক্ত করে নেন। পুরো এই নৌবহর প্রতিপালনে বার্ষিক ব্যয় হত তখনকার ৮ লাখ রুপি। এই অর্থ আসত নবাবের ১১২টি মহল বা জমিদারী থেকে যেগুলো নাওয়ারা নামে পরিচিত ছিল। চট্টগ্রাম অভিযানের প্রস্তুতি হিসেবে নবাব হুগলী বন্দরে অবস্থিত ডাচ বা ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে আদেশ করেন তার সেনাদলকে সাহায্য করার জন্য।

চট্টগ্রাম অভিযানের আগে মীর মুর্তাজা খান নামে নবাবের এক সেনাপতি ঢাকা এবং এর আশেপাশের এলাকা থেকে প্রায় হাজার খানেক কুঠার সংগ্রহ করেন। এই সকল কুঠার চট্টগ্রামের জঙ্গল কাটার জন্য ব্যবহার করা হয়। যাত্রা শুরুর কয়েকদিনের মধ্যে নবাবের পুত্র বুজুর্গ উম্মিদ খান সমস্ত সেনাদল নিয়ে ফেনী নদী পার হন। তিনি ছিলেন এই বাহিনীর প্রধান সেনাপতি। ফেনী নদীর অপর পাড় থেকে শুরু হত আরাকান রাজত্ব। ফেনীর কাছে জাগদিয়া নামক এলাকায় একটি মুঘল ঘাঁটি ছিল। মুঘল সেনাদল এই ঘাঁটি থেকে চট্টগ্রামে চূড়ান্ত হামলার জন্য প্রস্তুতি নেয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় স্থল এবং নৌপথে হামলা চালানো হবে।

নবাবের বাহিনীতে ২৮৮টি নৌযান ছিল। এগুলোর মধ্যে ছিল ঘুরাব, সালাব, কোষা, জালবা, বাচারি, পারেন্দা নামক নৌকা। ২৩ জানুয়ারি, ১৬৬৬ সালে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় মুঘল নৌবাহিনী আরাকান নৌবাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। দুইদিনের মধ্যেই মুঘল বাহিনীর নৌযুদ্ধ কৌশলের কাছে আরাকান নৌবাহিনী হার মানতে বাধ্য হয়। এই নৌযুদ্ধে নবাবের বাহিনী শত্রুপক্ষের ১৩৫ টি নৌযান দখল করে। তবে চট্টগ্রাম দুর্গ থেকে আরাকান সেনারা প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছিল। নৌযুদ্ধের পরাজয়ের পর তাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে ফলে দুর্গ রক্ষায় নিয়োজিত আরাকানী সেনারা পালিয়ে যেতে শুরু করে। ১৬৬৬ সালের ২৬ জানুয়ারি আরাকান দুর্গের পতন ঘটে। চট্টগ্রামের আরাকানী শাসককে সপরিবারে বন্দী করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। শায়েস্তা খানের চট্টগ্রাম জয়ের মধ্যে দিয়ে এই অঞ্চল এবং বন্দর মুঘল ভারতের বাংলা পরগণা বা প্রদেশের এক অংশে পরিণত হয় যা আজ বাংলাদেশের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।