Home Blog Page 250

মেরিটাইম বিশ্বে সাইবার নিরাপত্তা

২০১১ সালের জুন মাস, বেলজিয়ামের অ্যান্টওয়ার্প বন্দরের কম্পিউটারাইজ্ড কার্গো ট্র্যাকিং ব্যবস্থায় সবার অলক্ষ্যে ঢুকে পড়ল একদল হ্যাকার। তাদের উদ্দেশ্য মাদক লুকানো কার্গোগুলো কোথায় আছে সেই তথ্য মাদক চোরাকারবারীদের কাছে পাচার করা। চোরাকারবারীরা মাদক সরিয়ে ফেললে হ্যাকাররা কার্গোগুলোর সকল তথ্য গায়েব করে দিত, ফলে কেউ জানতো না কিভাবে আসছে মাদকের চালান। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে দুইবছর ধরে হ্যাকাররা এই অপতৎপরতা চালিয়ে আসছিল।  এতে দেশটিতে বাড়তে থাকে মাদক অপরাধের সংখ্যা। কিন্তু মূল অপরাধীদের নাগাল পাচ্ছিল না পুলিশ। অবশেষে ২০১৩ সালে বন্দরে বেলজিয়াম ও ডাচ পুলিশের যৌথ অভিযানের মাধ্যমে অপরাধী হ্যাকার চক্রটি ধরা পড়ে।

এটা ছোট একটা ঘটনার উদাহরণ মাত্র। অন্যান্য সেক্টরের মত মেরিটাইম বিশে^ও ইন্টারনেটের অবাধ প্রসার এবং ব্লু টুথ, ওয়াইফাইসহ ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কের সহজপ্রাপ্যতার কারণে একজন সাইবার অপরাধী এখন খুব সহজেই সুরক্ষিত কম্পিউটার ব্যবস্থায় ঢুকে কিংবা ব্যবহারকারীর অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এবং ক্ষতিকর প্রোগ্রাম (স্প্যাম, ভাইরাস, ম্যালওয়্যার ইত্যাদি) পাঠিয়ে কম্পিউটার ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে। এই খাতে অসচেতনতা ও দক্ষ প্রযুক্তিবিদের অপ্রতুলতা সেই ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, যেকোনো সময় সাইবার আক্রমণের শিকার হতে পারে নৌপরিবহন খাত।

ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্র যতই প্রসারিত হচ্ছে, ততই বাড়ছে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার। অর্থাৎ বাড়ছে সফ্টওয়্যার নির্ভরতা। সফ্টওয়্যারগুলো তৈরি হয় অসংখ্য কোডের সমন্বয়ে। একজন প্রোগ্রামার যখন কোনো সফ্টওয়্যারের কোড লেখেন তখন প্রতি হাজার লাইন কোডে গড়ে ১০ থেকে ৫০টি ভুল থাকে। বড় কর্পোরেশনগুলোর তৈরি সফ্টওয়্যারের ক্ষেত্রে ভুলের এই পরিমাণ প্রতি হাজার লাইনে ০.৫টি পর্যন্ত নেমে আসে। আপাতদৃষ্টিতে নগণ্য মনে হলেও যখন আমরা জানতে পারি যে মাইক্রোসফটের উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমে ৫০ মিলিয়ন লাইন কোড এবং গুগলে সর্বমোট ২ বিলিয়ন লাইন কোড রয়েছে, তখন কোডের এই মহাসাগরে ভুলের পরিমাণ হিসাব করলে তা একটি সফল সাইবার অ্যাটাক ঘটানোর জন্য যথেষ্ট।

কেপিএমজি, ইওয়াই, রিস্ক ডট নেট এর মতো ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় উঠে এসেছে ‘সাইবার আক্রমণ’ বর্তমানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালন ঝুঁকিসমূহের মধ্যে অগ্রগণ্য। নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করে সাইবার অপরাধীরা হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ এবং মূল্যবান তথ্য। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ড্রাইডেক্স ম্যালওয়ার ব্যবহার করে অপরাধীরা নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হাতিয়ে নেয় যার পুরোটা এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী ওয়ানাক্রাই র‍্যানসমওয়্যার ক্রিপ্টোওয়ার্মের আক্রমণে হাজার হাজার কম্পিউটার অচল হয়ে পড়ে। বিশ্বের মোট বাণিজ্যের সিংহভাগ নৌপরিবহন খাতের মাধ্যমে হয় বলে এই শিল্প আক্রান্ত হবার ঝুঁকিও বেশি।

সাইবার নিরাপত্তা খাতে বিনিয়োগে বড় সমস্যা হচ্ছে, অনেক জাহাজ কোম্পানি সরাসরি সাইবার আক্রমণে কোনো ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন না হলেও তাদের ব্যবহৃত সফ্টওয়্যারের রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তায় প্রচুর অর্থ খরচ করে। ফলে কোম্পানি পরিচালনায় নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। এতে তারা সাইবার নিরাপত্তায় অর্থ খরচে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। আবার অনেক কোম্পানি আছে যারা সাইবার নিরাপত্তার বিষয়ে অবস্থান নেবার মতো সুসংগঠিত অবস্থায় নেই। ‘সি এশিয়া’য় প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী নৌপরিবহন খাতের ৫৫% কোম্পানিই স্বীকার করেছে সাইবার আক্রমণ ঠেকাতে তাদের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। সাইবার নিরাপত্তা খাতের কনসালটেন্সি ফার্ম সাইবারকিলের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এই শিল্পের সাথে জড়িত এবং উইন্ডোজ ওয়েবসার্ভার ব্যবহারকারী কোম্পানিগুলোর মাঝে ৩৭ শতাংশই মাইক্রোসফ্টের সিকিউরিটি প্যাচ ইনস্টল করেনি। এতে করে কোম্পানিগুলোর সার্ভার হ্যাকারদের আক্রমণের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।

প্লাইমাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, অনেক জাহাজ পরিচালনাকারী কোম্পানি পুরনো সফ্টওয়্যার সিস্টেম ব্যবহার করার কারণে বিপদজ্জনক অবস্থার সম্মুখীন হতে পারে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও নৌপরিবহন শিল্প সাইবার হামলার ঝুঁকিতে আছে জানিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছে। প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তনের কারণে অপরাধীরা সহজেই অরক্ষিত সিস্টেমে ঢুকে পড়ছে। সমুদ্রগামী জাহাজগুলোর সাথে ডাঙ্গার স্থাপনাসমূহের অব্যাহত যোগাযোগ, স্মার্ট ফোন, ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের প্রসার- সবকিছুই নৌখাতের এই ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।

নৌখাত সামনের দিনগুলিতে যেসব সাইবার হামলার মুখোমুখি হতে পারে

  • ইমেইল স্পুফিংয়ের মাধ্যমে ভুয়া অ্যাকাউন্টে ফান্ড ট্রান্সফার
  • জিপিএস সিস্টেম হ্যাক করে জাহাজকে ভুল গন্তব্যে পরিচালিত করা
  • ভাসমান তেল প্ল্যাটফর্মের ভারসাম্য নষ্ট করে দিয়ে সেটিকে বন্ধ করে দেয়া
  • কার্গো/কনটেইনার ম্যানেজমেন্ট নেটওয়ার্কে প্রবেশ করে সবার অলক্ষ্যে চোরাই পণ্যবাহী কার্গো/কনটেইনার সরিয়ে ফেলা
  • শিপিং কোম্পানির কম্পিইটার হ্যাক করে মূল্যবান কার্গোবাহী ও অপ্রতুল নিরাপত্তা ব্যবস্থাসম্পন্ন জাহাজ খুঁজে নিয়ে সেটিকে হাইজ্যাক করা

সাইবার হামলা ঠেকানোর কোনো সুনির্দিষ্ট সমাধান নেই। সাইবার নিরাপত্তায় বিশেষজ্ঞরা পাঁচটি ভিত্তির কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথমেই ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এমন ঝুঁকি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক হতে পারে। এরপর আসবে ঝুঁকি সনাক্তকরণ। এছাড়া অন্য ভিত্তিগুলো হলো- প্রতিরোধ, সম্ভাব্য সাইবার ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রস্তুতি ও হামলা পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম পুনরুদ্ধার। ২০১৫ সালে প্রকাশিত লন্ডনের লয়েড সাময়িকীর মতে প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে সাইবার হামলার কারণে নৌপরিবহন খাতে কোম্পানিগুলোর ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। এর পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষতির পরিমাণও কম নয়।

সাইবার হামলা ঠেকাতে করণীয়

  • ডাঙ্গার কর্মীবাহিনী থেকে শুরু করে জাহাজের নাবিক, নৌখাতের সকল স্টেকহোল্ডারদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধিই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কারণ সাইবার আক্রমণকারীরা মূলত মানুষের ভুলকে পুঁজি করেই তাদের আক্রমণ পরিচালনা করে থাকে। ৯৭% ক্ষেত্রে তারা মানবীয় আবেগকে হাতিয়ার বানিয়ে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে তাদের কাজ হাসিল করে নেয়।
  • গবেষণায় দেখা গেছে হ্যাকাররা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেভিগেশন, প্রপালশন কিংবা কার্গো সম্পর্কিত সিস্টেমগুলোকে টার্গেট করে। বিশ্ববাণিজ্যের ৯০% সম্পন্ন হয় নৌপরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে। তাই এই শিল্পের নিরাপত্তা বিধানে ব্যবহার করতে হবে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। এই শিল্পের সাথে জড়িত কোম্পানিগুলোর উচিত নিয়মিত তাদের নেটওয়ার্কের অবস্থা পর্যালোচনা করা। অপারেটিং সিস্টেম, এন্টিভাইরাস সফ্টওয়্যার, ওয়েব ব্রাউজার, ফায়ারওয়াল- সবকিছুকেই পর্যবেক্ষণ ও হালনাগাদের আওতায় রাখতে হবে। একইসাথে এসব বিষয়ে কর্মীদের সচেতন করার লক্ষ্যে নিয়মিত প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই।
  • বিশ্বে সাইবার হামলার অধিকাংশই ঘটে থাকে দুর্বল পাসওয়ার্ড হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে। কোম্পানিগুলোর উচিত তাদের পাসওয়ার্ডগুলো যথাযথভাবে নির্বাচন করা এবং নিয়মিত সেগুলো পরিবর্তন করা। খেয়াল রাখতে হবে যাতে একই পাসওয়ার্ড একাধিক নেটওয়ার্কে ব্যবহৃত না হয় এবং নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গব্যতিত পাসওয়ার্ড অন্যদের নিকট না পৌঁছায়।
  • সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ত্রুটি খুঁজে পাবার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে একাজে একদল পেশাদার কর্মী নিয়োগ করা। এরকম দলকে বলা হয় এথিক্যাল হ্যাকার যারা কোম্পানিগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ত্রুটি খুঁজে পেতে নিজেরাই সীমিত পরিসরে সাইবার হামলা চালায় এবং সেই ত্রুটিগুলো কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। এই ব্যবস্থা এতটাই ফলদায়ী যে গুগল, ফেসবুকের মতো টেকজায়ান্টদেরও এথিক্যাল হ্যাকারদের শরণাপন্ন হতে হয়। আপাতদৃষ্টিতে এই পদ্ধতি ব্যয়বহুল মনে হলেও এতে করে কোম্পানির মূল্যবান সম্পদ ও সুনাম সাইবার আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকে।
  • বৈশ্বিক নৌপরিবহনখাত বিভিন্ন ধাপে বিভক্ত (জাতীয়, আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক) হওয়ায় ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও) এর উচিত সদস্য দেশগুলোকে সাথে নিয়ে সাইবার হামলা মোকাবেলায় সুনির্দিষ্ট কার্যতালিকা এবং নীতিমালা ঠিক করা। বর্তমানে এই খাতের বাহ্যিক নিরাপত্তা বিষয়ে নীতিমালা (আইএসপিএস) থাকলেও সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। একইসাথে এই শিল্পের সাথে সংযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোরও উচিত নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষায় অভ্যন্তরীণ নীতিমালা প্রণয়ন করা যাতে করে হামলাকারীরা সহজে তাদের নেটওয়ার্কে প্রবেশ করতে না পারে। 

আধুনিক নৌযানগুলোতে সংযুক্ত হয়েছে এমন সব ‘সিস্টেম’ যেখানে জাহাজ পরিচালনা ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে। ভবিষ্যতের সফ্টওয়্যার নির্ভর পৃথিবীতে টিকে থাকতে এই খাতে প্রযুক্তিজ্ঞানে প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী তৈরি করা আবশ্যক যারা সফ্টওয়্যার পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে হবেন স্বাবলম্বী।

বাংলাদেশের বন্দরগুলোর সক্ষমতা বাড়ছে, হচ্ছে অবকাঠামোগত আধুনিকায়ন। আসছে নতুন নতুন বন্দর। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে মেরিটাইম সেক্টরেও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে সমানুপাতিক হারে। তাই সচেতনতা তৈরি হচ্ছে সাইবার নিরাপত্তা নিয়েও। সেই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তায় ২০০৪ সাল থেকে আইএসপিএস কোড মানা হচ্ছে। নেয়া হচ্ছে বিশেষ পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা। নিরাপত্তা বিষয়ে সর্বাধুনিক উদ্ভাবন সম্পর্কে জানতে মেরিটাইম সিকিউরিটি নিয়ে আয়োজিত হতে পারে আন্তর্জাতিক সেমিনার ও ওয়ার্কশপ। নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে প্রাধিকার বিবেচনা করে বাংলাদেশের মেরিটাইম সেক্টরকে এগিয়ে নিতে হবে নিñিদ্রভাবে।

সূত্র: সী ট্রেড মেরিটাইম নিউজ, সাইবার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে আইএমও গাইডলাইন ও ইএনআইএসএ

মনুষ্যবিহীন জাহাজ: নৌপরিবহনের ভবিষ্যৎ

সড়ক পথে এমন গাড়ির কথা আমরা শুনতে পাচ্ছি, যা চালক ছাড়াই চলে যাবে নিজ গন্তব্যে। সেক্ষেত্রে সামুদ্রিক জাহাজ কেন পিছিয়ে থাকবে! এই প্রেক্ষাপটে জাহাজ মালিকেরা চাইছে এমন এক ধরনের জাহাজ যা নাবিক ছাড়াই তরতর করে এগিয়ে যাবে তার গন্তব্যে। এ ধরনের জাহাজ নির্মাণে হাত দিয়েছে রোলস রয়েস নামের এক কোম্পানি, আশা করা হচ্ছে আগামী দশ থেকে পনের বছরের মধ্যে সমুদ্রে নামতে যাচ্ছে এই জাহাজ। এটি মূলত রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে চলবে। 

সমুদ্রে যে সমস্ত দূর্ঘটনা ঘটে তার কারণ নাবিক কিংবা ক্যাপ্টেনের ভুল সিদ্ধান্ত, যাদের অনেক সময় চাপের মুখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। অনেক সময় একটানা কাজের কারণে নাবিকেরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে, যার ফলে তারা ভুল করে বা এই অবস্থায় মানবিক ত্রুটির ঘটনা ঘটে। সমুদ্রে অনেক সময় দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়, সে সময় অনেক ক্যাপ্টেন কিংবা নাবিক ধীর গতিতে তাদের প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জাহাজে যন্ত্রপাতি মেরামত কিংবা রক্ষণাবেক্ষণে ত্রুটি দেখা দেয়, ফলে সমুদ্রগামী জাহাজ যে কোন সময় দূর্ঘটনায় পড়তে পারে। জাহাজ বীমা শিল্পের সাথে যুক্ত কোম্পানিগুলোর জন্য এই ধরনের মানবীয় ভুল সবচেয়ে উদ্বেগের কারণ।    

অ্যাালিয়াঞ্জ এস.ই-এর তথ্য অনুসারে শতকরা ৭৫ শতাংশ জাহাজ দূর্ঘটনার কারণ নাবিকেরা, যাদের গ্রহণ করা সিদ্ধান্ত ভুল হওয়ার ফলে জাহাজের দূর্গতি ঘটে।  নরওয়ের ‘সুরক্ষা ও ক্ষতিপূরণ’ ভিত্তিক ক্লাব ‘গার্ড এজ’ সংবাদ প্রদান করছে যে ৭০-৮০ শতাংশ জাহাজ দূর্ঘটনার পেছনে দায়ী মানবীয় ত্রুটি। আগামীতে মনুষ্যবিহীন জাহাজ হতে যাচ্ছে এই ধরনের মানবীয় ত্রুটির এক সমাধান। তবে, এটাই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সমাধান হবে কী না, ভাবনাটা তাই নিয়ে।

কেবল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়াও মনুষ্যবিহীন জলযান মালিকের খরচ কমিয়ে আনবে। কারণ এর জন্য মালিককে নাবিক নিয়োগ করতে হবে না, এই ধরনের জাহাজে নাবিকদের থাকার জন্য বাড়তি জায়গার প্রয়োজন হবে না। এর ফলে জাহাজ আরো কার্যকর ও দ্রুত গতিতে চলতে সক্ষম হবে।  জাহাজ মালিকেরা এই ধরনের জাহাজের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে, কারণ এই ধরনের জাহাজ রক্ষণাবেক্ষণ ও চলাচলের খরচ কমিয়ে আনতে সক্ষম। রোলস রয়েস-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে মনুষ্যবিহীন জাহাজে জলদস্যুরা হানা দিতে আগ্রহী হবে না। জলদস্যুরা মূলত নাবিকদের বন্দী করে মুক্তিপণ আদায় করে। যদি জাহাজে কোন নাবিক না থাকে তাহলে তারা কাকে বন্দী করে মুক্তিপণ আদায় করবে? তবে এই যুক্তির যারা বিপক্ষে তারা বলছেন, মানুষ ছাড়া যে সমস্ত যান সমুদ্রে চলাচল করবে সেগুলোতে জলদস্যুদের হামলার সম্ভাবনা আরো বেশি, কারণ কেবল সশস্ত্র নিরাপত্তা কর্মীরাই পারে জলদস্যুদের প্রতিহত করতে। তবে ড্রোন-এর মত প্রযুক্তি হয়তো নাবিকবিহীন জাহাজগুলোর চলাচলকে নিরাপদ করতে পারে।

একটা জাহাজ নিজে নিজে চলছে, আর নাবিকদের বদলে জাহাজ চালাচ্ছে সেফ মেশিন- এমন চিন্তা নতুন কিছু নয়। যেমন, আধুনিক জাহাজগুলো কাগজের চার্টের বদলে সূক্ষ্ম ইলেক্টনিক চার্ট এবং অটোমেটিক রাডার প্লটিং এইড (এআরপিএ) পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল, এছাড়াও আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে অনেক জাহাজে এখন আনম্যান্ড মেশিনারি স্পেস বা ইউএমএস নামক যন্ত্র বসানো হয়েছে। এই যন্ত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেশিন রুমের তাপমাত্রা বাড়ার বিষয়টি বুঝতে সক্ষম, এছাড়াও মেশিন রুমে আগুন লাগলে কিংবা পানি ঢুকে গেলে এই যন্ত্র সাথে সাথে সঙ্কেত প্রদান করতে থাকে। এতে নাবিকদের পক্ষে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাহাজে ইউএমএস প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। জাহাজের নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এটি এক গুরুত্বপুর্ণ যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। স্বয়ংক্রিয় নৌযান কী পরিমাণ নাবিক কমিয়ে আনবে, তার এক ধারণা দিচ্ছে বিশাল আকারের কনটেইনার পরিবাহী জাহাজগুলো। যেমন,  ১,৮০,০০০ হাজার টন পর্যন্ত কনটেইনার বহন করতে পারা মারেস্ক ট্রিপল-ই শ্রেণীর জাহাজ চলানোর জন্য মাত্র ১৩ জন নাবিকের প্রয়োজন।              

বর্তমানে প্রযুক্তি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে এটা নিশ্চিত যে আগামীতে এমন সব জাহাজ নির্মাণ করা হবে যেগুলো মাটি থেকে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে চালানো সম্ভব।

এ ধরনের জাহাজ কী কী ধরনের সুবিধা প্রদান করতে যাচ্ছে সে বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। জাহাজ নির্মাতা কোম্পানিগুলোর প্রযুক্তিগত দক্ষতা এখন এমন এক পর্যায়ে চলে এসেছে যে কোম্পানিগুলো এই ধরনের জাহাজ নির্মাণের খুব কাছে চলে এসেছে। কিন্তু তারপরেও এই ধরণের জাহাজ নির্মাণে বেশ কিছু বাধা রয়েছে। মূলত জাহাজ মালিক, জাহাজ বীমাকারী প্রতিষ্ঠান ও শিপিং কোম্পানিগুলোকে এই সকল বাধা পার হতে হবে। মনুষ্যবিহিন জাহাজ নির্মাণের প্রথম বাঁধা হচ্ছে এই সংক্রান্ত আইন, কারণ এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে কোন আন্তর্জাতিক আইন নেই। বাণিজ্যিক কার্যক্রমের উদ্দেশ্যে এই ধরনের জাহাজ পরিচালনার জন্য প্রয়োজন হবে আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনের। যেমন, কীভাবে এই সকল জাহাজ চলাচলের সময় নির্ধারণ করা হবে এবং এই সমস্ত জাহাজের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বীমার ধরণ কেমন হবে সেগুলো নির্ধারণ করতে হবে। তবে আন্তর্জাতিক নিয়ম সংশোধন না করলেও, এই ধরণের মনুষ্যবিহীন জাহাজকে সমুদ্রে জীবনের নিরাপত্তা বিষয়ক সম্মেলন (সোলাস) এর নীতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নীতি (আইএসএম) মেনে চলতে হবে ।

সোলাস, সমুদ্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করে থাকে, যার মধ্যে রয়েছে নৌযান পরিচালনা ও জাহাজের নিরাপত্তা, যা নাবিকদের নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। মনুষ্যবিহীন জাহাজ হয়তো এই সকল আইন মেনে চলতে সক্ষম হবে না, কারণ বর্তমান আইনে জাহাজ পরিচালনার জন্য জাহাজে অন্তত কয়েকজন নাবিকের উপস্থিতি প্রয়োজন। ফলে সমুদ্রে এই ধরণের জাহাজ চলাচল হবে অবৈধ এবং সমুদ্র আইন বিরোধী। তবে ‘উপকূল ধরে চলা জাহাজ’ কিংবা ‘ক্রু-অপারেশন সেন্টার’ যেভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করে, সেক্ষেত্রে এই ধরণের আইন প্রয়োজ্য নয়, যার ফলে এই ধরনের নিয়মের আওতায় মনুষ্যবিহীন জাহাজ পরিচালনা করা সম্ভব হবে। আগামী  সোলাস সম্মেলনে এই ধরণের জাহাজ চলাচলে নিরাপত্তার সংজ্ঞা সংশোধন করা হবে কি না, বা এই বিষয়ে আইন তৈরি করা হবে কি না, সেটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার, মনুষ্যবিহীন জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এবং সোলাস একই লক্ষ্যে কাজ করছে, আর সেটা হচ্ছে সমুদ্রে জাহাজের নিরাপত্তা।

বীমার ক্ষেত্রে কী ধরনের ঝুঁকি আসতে পারে  তার হিসেব করা হয় সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে। নির্মাতারা কী কী উপাদান দিয়ে মনুষ্যবিহীন জাহাজ তৈরি করছে, এই তথ্য ছাড়া এই জাহাজ কী ধরণের ঝুঁকিতে পড়তে পারে সে বিষয়ে কোন গ্রহণযোগ্য তথ্য নেই। কীভাবে এই রিমোট কন্ট্রোল জাহাজ পরিচালনার করা হবে, তার উপর ভিত্তি করে এর বীমার ধরণ নির্ধারণ করা হবে। এই ধরণের জাহাজে নিরাপত্তা ঝুঁকি কম থাকবে, সেটা পরিষ্কার, তবে এই ধরণের জাহাজে নতুন ঝুঁকি দেখা দিতে পারে, যেমন ইন্টারনেট বা সাইবার হামলার মত ঝুঁকি। এই ধরণের জাহাজে যে সমস্ত সিস্টেম ও সফটওয়্যার ব্যবহার করা হবে সেগুলোতে যে হামলা হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? এগুলোর সিস্টেমের মাঝে ভাইরাস বা ম্যালওয়ার প্রবেশ করতে পারে, এমন কী এর সিস্টেম কেউ হয়তো হ্যাকও করে নিতে পারে।

প্রযুক্তির উন্নয়নের একটা বড় কারণ হচ্ছে সমুদ্রে চলাচল করা জাহাজের নিরাপত্তার উন্নতি ঘটানো। তবে প্রযুক্তি নিজে সব কিছু করতে পারে না, প্রযুক্তিকে পরিচালনার জন্য প্রয়োজন মানুষের। এই সকল জাহাজ পরিচালনার আইনগত ভিত্তি ও নীতি নির্ধারণে মানুষের ভাবনা অনিবার্য, যে সকল আইনের মধ্যে দিয়ে এই সমস্ত জাহাজ তার বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এই আইনের ভিত্তি যথাযথ না হলে মনুষ্যবিহীন জাহাজ চলাচলের চিন্তা কেবল কাগজে কলমে থেকে যাবে। এখন এই বিষয়ে আইন ও নীতি তৈরির করার জন্য চাপ ক্রমশ বাড়ছে, আশা করা হচ্ছে ‘সোলাস ২০২৪’ সম্মেলনে মনুষ্যবিহীন জাহাজ চলাচল সংক্রান্ত আইন প্রস্তুত করা হবে, যা হবে ইউএমএস অনুরূপ এক আইন, যে আইন ইতোমধ্যে বিদ্যমান।

যে বিষয়টি এখন পরিষ্কার সেটি হচ্ছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে সক্ষম হবে এমন জাহাজ নির্মাণের দিকে পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে, যা হবে নিরাপদ জাহাজ চলাচলের এক পরবর্তী যৌক্তিক পদক্ষেপ। এই শিল্পের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা এখন জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সাথে মিলে ভবিষ্যতের জাহাজ নির্মাণের আইনগত ও বাণিজ্যিক পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে কাজ শুরু করতে যাচ্ছে।

সূত্র:

ঝযরঢ়ং, চড়ৎঃং ম্যাগাজিনের ২০ মার্চ ২০১৭ সংস্করণ থেকে

অনুলিখন: বিজয় মজুমদার     

পথচলায় চট্টগ্রাম পৌরসভা

বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব মীর কাশেম-এর সাথে ১৭৬১ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চুক্তি অনুসারে চট্টগ্রাম শহরের শাসনভার বৃটিশদের হাতে ন্যস্ত হয়। তখন মূলত সিভিলিয়ান বা সরকারি কর্মচারীরা শহরের দেখাশুনা করত। এই সময় চট্টগ্রাম ছিল বৃটিশ ভারতের এক ছোট্ট শহর, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এর পরিধি ক্রমশ বাড়তে থাকে। এ কারণে চট্টগ্রাম শহরের উন্নতির লক্ষ্যে ১৮৫৬ সালে এক নগর উন্নয়ন কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির প্রথম কাজ নির্ধারণ করা হয় শহরের নাগরিকদের জীবন যাত্রার উন্নতিকরণ। চট্টগ্রাম শহর মিউনিসিপাল বোর্ড গঠন হওয়ার আগে নগরের উন্নয়নের জন্য এটাই ছিল প্রথম কোনো কমিটি। এই কমিটির একটা নামও প্রদান করা হয়, সরকারি নথিতে এই কমিটির নাম লেখা আছে “চট্টগ্রাম শহরের পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়ন কমিটি”। তবে কমিটি কেবল শহরের ময়লা পরিস্কার নয়, সাথে শহরের চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক খালসমূহের নিস্কাশন এবং রাস্তাঘাট নির্মাণের কাজেও হাত দেয়। সরকারি নথিতে আরো জানা যাচ্ছে এই কমিটির প্রথম আলোচনা সভার দিনটি হচ্ছে ১৮৫৬ সালের ১৪ মে। বিভাগীয় কমিশনার সি. স্টেয়ার ছাড়াও কমিটির বাকী বৃটিশ সদস্যরা হলেন সি চ্যাপম্যান, ডাব্লিউ বিটসন, এইচ জে বেমবার, ডাব্লিউ এইচ হেন্ডারসন এবং জি সি ফ্লেচার। এই কমিটিতে স্থানীয় নাগরিকদের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে দুজন। এদের নাম  ঠাকুর বক্শ তিওয়ারি এবং হর চন্দ্র রায়। কমিশনার স্টেয়ার সাহেব পদাধিকার বলে এই কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। 

কমিটির প্রথম সভায় আলোচনার বিষয় ছিল শহরের জলনিস্কাশন ব্যবস্থা। এই সময়ে চট্টগ্রাম শহরের চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক খালগুলোতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এছাড়া শহরের পানীয় জলের সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করে, বিশেষ করে যারা সে সময় শহরের সীমানায় বাস করত, তাদের জন্য। এই খালগুলোর উন্নতির জন্য কমিটি বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

এই খালসমূহের উন্নয়ন কাজ শুরু করার আগে এলাকার ভূমি, খাল ও পুকুর নিয়ে এক জরিপ পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। মেসার্স জার্ভিস এন্ড রাসেল কোম্পানিকে এই কাজের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। কোম্পানি যাতে দ্রুত কাজ সমাপ্ত করতে পারে তার জন্য লেফটেনেন্ট গভর্ণর অগ্রীম ১০০০ টাকা প্রদানের আদেশ দেন।            

একই সভায় এই কমিটি আরেকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। গাছ কাটার পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা। কারণ এই সময়ে শহরের চারপাশ জুড়ে জঙ্গল ছিল। এমনকি দিনের বেলায় এই সকল জঙ্গলে বাঘ দেখা যেত। বাঘের হাতে মানুষের আহত বা নিহত হওয়ার ঘটনা শোনা যেত চারপাশে। যার ফলে জঙ্গল পরিস্কার করতে গিয়ে গাছ কাটার জন্য প্রচুর কাঠুরিয়ার প্রয়োজন হত। তাই সভায় অন্য যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়, সেটি হচ্ছে কীভাবে স্থানীয় কারাবন্দীদের গাছ কাটার কাজে লাগানো যায়। এই কমিটি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অনুরোধ জানায়, যেন কারাগারে অবস্থিত বন্দীদের খাল ও ঝোপঝাড় কাটার কাজে লাগানো হয়। কিন্তু কাজের শুরুতে এই কমিটি আর্থিক সঙ্কটে পড়ে যায়। যার ফলে প্রাদেশিক সরকার প্রধান লেফটেনন্ট গভর্ণর-এর কাছে কমিটির সভাপতি আনুরোধ জানাল যেন এই কাজের জন্য আরো ১০,০০০ টাকা প্রদান করা হয়। 

জরিপ কাজের দায়িত্ব প্রাপ্ত জার্ভিস এন্ড রাসেল সে বছরই চট্টগ্রামে এসে উপস্থিত হয় এবং দ্রুত কাজ শুরু করে। এই কাজের জন্য প্রতিষ্ঠানটি মুনু নামের একজন সার্ভেয়ারকে নিযুক্ত করে। এই কাজের জন্য সার্ভেয়ারের পারিশ্রমিক ধরা হয় ৩০০ টাকা।

বন্দরের গতিশীলতা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে। বেশি সংখ্যক জাহাজ ভেড়ার ফলে প্রয়োজন হয়ে পড়ে বাড়তি কুলির। অনেকে বিভিন্ন স্থান থেকে কাজের সন্ধানে চট্টগ্রামে এসে কুলিতে পরিণত হয়। এদের অনেকে বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে। প্রশাসনের কাছে এরা ‘ডেনজার কুলি’ বা ‘বিপজ্জনক কুলি’ হিসেবে অভিহিত হয়। অজ্ঞাতনামা এইসব কুলিদের দ্বারা সংঘঠিত অপরাধের পরিমাণ বাড়তে শুরু করলে বৃটিশ প্রশাসন চিন্তিত হয়ে পড়ে। ১৫ জুলাই, ১৮৫৬ সালে কমিটি দ্বিতীয়বারের মত আলোচনায় বসে, আলোচনার বিষয়বস্তু হিসাবে নির্ধারণ করা হয় কীভাবে ডেনজার কুলিদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় বন্দরে বাড়তে থাকা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এই সমস্ত কুলিদের উপর নজর রাখা হবে। শহরের সার্ভেয়ার বা জরিপের দায়িত্বে নিয়োজিত মি. রিভেট- এর পক্ষে সকল কুলিদের উপর নজর রাখা সম্ভব ছিল না। ফলে মি. এভেরিকে এই কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করতে বলা হয়।

উন্নয়ন কমিটির একার পক্ষে ক্রমবর্ধমান সকল কাজ সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ে। সরকার শহরের দায়িত্ব শহরের নিজস্ব প্রশাসনের হাতে প্রদান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, আর এই সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে জন্ম নেয় ‘চিটাগং মিউনিসিপালিটি’ বা ‘চট্টগ্রাম পৌরসভা’।  

২২ জুন, ১৮৬৩ সালে চট্টগ্রাম শহর আনুষ্ঠানিক ভাবে পৌরসভায় পরিণত হল। সদ্য গঠিত পৌরসভাকে পাঁচটি ওয়ার্ডে ভাগ করা হয়, যাদের অভিহিত করা হত এ, বি, সি, ডি এবং ই ওয়ার্ড নামে। পৌরসভার প্রথম প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন মি. জে ডি ওয়ার্ড।

আজকের এই বিশাল বাণিজ্যিক মহানগরী চট্টগ্রামকে দেখে কল্পনা করা মুশিকল যে সদ্য গঠিত পৌরসভাটি ছিল অতি ক্ষুদ্র এক নগরী। তখনকার চট্টগ্রামের আয়তন ছিল মাত্র ছয় বর্গ মাইল। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে সেই চট্টগ্রাম আজ বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী।

অপারেশন জ্যাকপট নিয়ে চলচ্চিত্র

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অবস্থানের বিষয়টি যুদ্ধে লিপ্ত সব পক্ষের সমর বিশারদদের যুদ্ধ পরিকল্পনা ও রণনীতি নির্ধারণে অন্যতম বিবেচ্য ছিল। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী চেয়েছিল যে কোন মূল্যে কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা ও চট্টগ্রাম বন্দর সচল রেখে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তাদের সরবরাহ ব্যবস্থা অক্ষুণœ ও নিরাপদ রাখতে। অপরদিকে মুক্তিবাহিনী এবং তাদের সহায়তাকারী বন্ধুদেশ ভারতের লক্ষ্য ছিল প্রতিপক্ষকে হীনবল করতে তাদের প্র্রধান পশ্চাদসুবিধা চট্টগ্র্রাম বন্দর অচল করে দেয়া। এ প্রেক্ষাপটেই কর্ণফুলী নদীতে অবস্থানরত বিদেশী জাহাজ বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে ডুবিয়ে দিয়ে বন্দরকে অচল করা এবং একই সাথে বিশ্ববাসীকে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপকতা সম্পর্কে জানান দেয়া। এই অভিযান পরিকল্পনারই নাম ‘অপারেশন জ্যাকপট’। এটা ছিল ১৯৭১ এর ১৫ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরে ৩৯ জন নৌকমান্ডোর এক মৃত্যুঞ্জয়ী দুঃসাহসী অভিযান। ঐ রাতে কর্ণফুলী নদীতে ৯টি জাহাজ লিমপেট মাইন দিয়ে বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে ডুবিয়ে দেয় নৌকমান্ডোরা। একই দিন মংলা সমুদ্রবন্দর, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুর নদীবন্দরেও আলাদা আলাদা দলে নৌকমান্ডোদের যুগপৎ অভিযান চলে। পৃথিবীর নৌযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ এক অনবদ্য কীর্তি। সামান্যতম ক্ষয়ক্ষতির শিকার না হয়ে এ ছিল শতভাগ সফল এক অভিযান এবং বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়া এই সমর কুশলতা আজ যুদ্ধবিদ্যা ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) এই বীরত্বপূর্ণ ও গৌরবময় কীর্তিকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে একটি অনুপম উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অপারেশন জ্যাকপটের লোমহর্ষক, রোমাঞ্চকর কাহিনী সহ বন্দরের মুক্তিযুদ্ধ ও সোয়াত জাহাজ প্রতিরোধের ঘটনাবলী নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের প্র্রযোজনায় নির্মিত হতে যাচ্ছে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য যুদ্ধ চলচ্চিত্র। বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান এবং বর্তমান নৌপ্রধান এডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ মুক্তিযোদ্ধা নৌমন্ত্রী শাজাহান খান এর অনুপ্রেরণায় চলচ্চিত্রটি নির্মাণের এই ব্যতিক্রমী আয়োজনের উদ্যোগ নেন ও প্রস্তুতি কাজের সূচনা করেন। পরবর্তীতে মাননীয় নৌমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধ, তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রীদের সাথে আলোচনা করে চলচ্চিত্রটি দ্রুত এগিয়ে নেবার নির্দেশ দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে চবক এর বর্তমান চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম খালেদ ইকবাল এই চলচ্চিত্র নির্মাণকে তার অন্যতম অগ্রাধিকারমূলক কাজ হিসেবে গণ্য করছেন। এ কাজের সাথে যুক্ত সকলকে তিনি নিরন্তর প্রেরণা ও উৎসাহ যুগিয়ে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ শুরুর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছেন।

চলচ্চিত্রটি নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যেই তখনকার চট্টগ্রাম বন্দর ও সংলগ্ন এলাকার দৃশ্যপট ও জীবনধারা সম্পর্কে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ এবং আনুষাঙ্গিক গবেষণা প্র্রায় শেষ হয়ে এসেছে। পাশাপাশি ছবির পান্ডুলিপি প্রণয়নের কাজও অনেকদূর এগিয়েছে। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে মেধাসম্পন্ন ও প্রথিতযশা ব্যক্তিবর্গ এ কাজে যুক্ত রয়েছেন। বন্দর কর্তৃপক্ষ এই চলচ্চিত্র নির্মাণকে তাদের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ কাজ হিসেবে গণ্য করছেন এবং এ চ্যালেঞ্জ সফলতার সাথে সম্পন্ন করতে তারা দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ। সৃজনশীল এই প্রয়াসকে সফল করতে চবক এর সদস্য জাফর আলম, সচিব ওমর ফারুক, হিসাব বিভাগের কর্মকর্তা সন্দীপন চৌধুরী ও এস এম মারুফ সহ বন্দর কর্মকর্তাদের একটি দল নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।

আ.ক.ম. রইসুল হক বাহার

মুক্তিযোদ্ধা, প্রাক্তন বন্দর কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও লেখক, অপারেশন জ্যাকপট চলচ্চিত্র গবেষণা দলের সদস্য

স্বপ্নের শহর হবে চট্টগ্রাম

বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। মানচিত্রের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত এ শহরটিকে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে অভিহিত করা হয়। পাহাড়, সমুদ্র এবং উপত্যকায় ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য প্রাচ্যের রাণী হিসেবেও যার নাম ছড়িয়েছে। এশিয়ায় ৭ম এবং বিশ্বের ১০ম দ্রুততম ক্রমবর্ধমান এই নগরী উন্নয়নের পথযাত্রায় হতে চলেছে বাংলাদেশের সিঙ্গাপুর! এ প্রতিতুলনা একটু অবাক শোনালেও উন্নয়ন সংশ্লিষ্টরা এমনই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

নতুন নতুন প্রকল্পে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ মাথাপিছু আয়ের শহর হতে পারে চট্টগ্রাম। বিশেষজ্ঞদের মতে, দুই লাখ কোটি টাকার ধারাবাহিক বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা আর চীন-ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সংযোগকে গুরুত্ব দিয়ে নিকট ভবিষ্যতেই এ বন্দরনগরী একটি সমৃদ্ধ মেগাসিটিতে রূপান্তর হতে পারে।

২০১৬ সালের শুরুতেই চীন ও চট্টগ্রামের সংযোগ ঘিরে জাতীয় অগ্রগতির স্বপ্ন বুনেছিল দেশ। সে সময় ঢাকায় চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং-ইর নেতৃত্বে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে চট্টগ্রাম-মিয়ানমার হয়ে কুনমিং পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ, রামু-কক্সবাজার, রামু-গুনধুম ডুয়েলগেজ রেললাইন এবং মিরসরাই ও আনোয়ারায় ‘স্পেশাল ইকোনমিক জোন’ স্থাপনে আশাবাদ উঁকি দেয়। আর এই আশাবাদ চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে কার্যকর হওয়ার পথ উন্মুক্ত করে।

চট্টগ্রামকে ঘিরেই হচ্ছে কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মহেশখালী এলপিজি টার্মিনাল, বাঁশখালী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রাউজানে ষষ্ঠ বিসিক শিল্প নগরী, বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বে-টার্মিনাল, ফ্লাইওভার ও পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে পারকি সৈকতে হোটেল ও অন্যান্য সুবিধা।

এর মধ্যে স্বপ্নের কর্ণফুলী টানেল নিয়ে নতুন করে আশার আলো দেখছেন স্থানীয় উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, বৃহত্তর চট্টগ্রাম তথা গোটা দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনবে এই টানেল। নদীর তলদেশে যোগাযোগের এমন পথ বদলে দিয়েছে বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতি। মিয়ানমার হয়ে চীনের সঙ্গে সড়কপথে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার যে অপার সম্ভাবনা, তারও মাধ্যম হতে পারে এই টানেল।

এ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি বলেন, ‘চীনের সাংহাই সিটির মতো চট্টগ্রাম নগরীতে পরিকল্পিত দুটি শহর গড়ে তুলতে চায় সরকার। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শীঘ্রই নির্মাণ কাজ শুরু হবে। নির্ধারিত সময়ে (চার বছর) নির্মাণকাজ শেষ হবে।’

সব ঠিক থাকলে আগামী ২০১৮-২০ সালের মধ্যে বৃহৎ আকারের প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হবে। জানা গেছে, বিনিয়োগ আকর্ষণে চীনা উদ্যোক্তাদের জন্য আনোয়ারায় ৭৭৪ একর জমির ওপর আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। বেজা সূত্র জানায়, দেশের রফতানিমুখী জাহাজ নির্মাণ শিল্প, ইলেকট্রনিকস পণ্যসামগ্রী, ফার্নেস ও সিমেন্ট শিল্পকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়ে আনোয়ারায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে। এছাড়া রাউজানে চট্টগ্রামের ষষ্ঠ বিসিক শিল্প নগরী প্রতিষ্ঠা হচ্ছে যার নির্মাণ কাজ ২০১৯ সালের মধ্যে শেষ হবে।

এদিকে আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেডটিতে বেশ কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে বিনিয়োগ করেছে। অন্যদিকে মিরসরাইয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনে উপযোগী করার জন্য ইতোমধ্যে সাড়ে ৫০০ একর ভূমিতে কাজ শুরু হয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলটি স্থাপিত হলে এখানে আগামী ১৫ বছরে ৩০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এখানে গড়ে উঠবে বিমানবন্দর, ছোট নৌবন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, জাহাজ নির্মাণ শিল্প ও অটোমোবাইলসহ ভারী শিল্প-কারখানা। খুলে যাবে অর্থনীতির নতুন দুয়ার।

এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বে-টার্মিনাল নির্মাণ, লালদিয়া, পতেঙ্গা ও অত্যাধুনিক কর্ণফুলী কনটেইনার টার্মিনাল, অনুমোদনপ্রাপ্ত কয়লাবিদ্যূৎ কেন্দ্রের কয়লা ল্যান্ডিংয়ের জন্য বার্থ তৈরি, হিন্টারল্যান্ড সংযোগ, ‘গ্রিনপোর্ট’ কনসেপ্টকে ধারণ করে দূষণমুক্ত বন্দর প্রতিষ্ঠায় নানা প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। রয়েছে উড়াল সেতু, সড়ক সংস্কার, খাল-নদী খনন, পানি সরবরাহ প্রকল্পসহ বন্দর কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন, সিডিএ, ওয়াসা ইত্যাদি সংস্থায় হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। স্পেশাল ইকোনমিক জোন, টানেল নির্মাণসহ বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোতে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলেও আশাবাদ রয়েছে চট্টগ্রামবাসীর।

চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য, মঈন উদ্দিন খান বাদল জানান, চট্টগ্রামের উন্নয়নে দুই লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগের স্বপ্ন দেখা হচ্ছে। চট্টগ্রামের উন্নয়ন মানেই বাংলাদেশের উন্নয়ন, এটি জাতীয় উন্নয়নের সমার্থক। চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে বিনিয়োগের যে বৈশ্বিক আগ্রহ, এটিকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে চট্টগ্রাম অবশ্যই সিঙ্গাপুর হবে।’

চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, ‘বিশ্বমানের নগরী গড়তে হলে বিনিয়োগ ও কাজে গতিশীলতার পাশাপাশি নাগরিক সমর্থন-সহায়তাও প্রয়োজন’।

হাজার বছর ধরে শিল্প বাণিজ্যের জন্য চট্টগ্রাম ঐতিহাসিকভাবেই আদর্শ জায়গা। চট্টগ্রামকে একটি অত্যাধুনিক নগরীতে রূপান্তরের সব সম্ভাবনাই এখন হাতের নাগালে, তবে এজন্য সর্বাগ্রে চাই স্বচ্ছতার সাথে সঠিক সমন্বয় ও উন্নয়ন কাজের গতিশীলতা। আর একটি উন্নত নগরীর নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষনে প্রয়োজন নাগরিকদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহন।

১১ ধাপ এগিয়ে পৃথিবী সেরা ১০০ বন্দরের তালিকায় ৭৬ তম চট্টগ্রাম বন্দর

বিশ্ববাণিজ্যের ধীরগতিও প্রভাব ফেলেনি চট্টগ্রাম বন্দরের অগ্রযাত্রায়। ১১ ধাপ এগিয়ে কর্মমুখর চট্টগ্রাম বন্দর এখন বিশ্বসেরা ১০০ বন্দরের তালিকায় ৭৬তম। এ কথা জানিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো চলমান প্রকাশিত জার্নাল ‘লয়েড’স লিস্ট’। ২০১৫ সালে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সংখ্যা হিসাব করে তারা এই অবস্থান নির্ধারণ করেছে। লয়েড’স লিস্ট বলছে, বিশ্ববাণিজ্যে ধীরগতি সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বন্দর এই প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।

১৭৩৪ (মতান্তরে ১৬৯২) সালে লন্ডনের লয়েড’স কফি হাউজ থেকে সাপ্তাহিক হিসেবে আত্বপ্রকাশ ক’রে, মাঝে দ্বি-সাপ্তাহিক থেকে দৈনিকে রূপান্তরিত হয়ে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৬০,৮৫০ তম সংখ্যা প্রকাশের পর ছাপানো সংস্করণ বন্ধ করে লয়েডস লিস্ট। এরপর থেকে তারা ডিজিটাল সংস্করণে প্রতিমুহুর্তে মেরিন ও শিপিং সম্পর্কিত তথ্য হালনাগাদ করে যাচ্ছে।  প্রায় একই সময়ে ১৭৬০ সালে লয়েড’স রেজিস্টার নামে যাত্রা শুরু করা লয়েড’স এর আরও একটি প্রতিষ্ঠান বর্তমানে বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং এর গবেষণা ও শিক্ষাখাতে বিশ্বব্যাপি ৭৪টি দেশে সক্রিয় আছে।

জানা যায়, বিশ্ববাণিজ্যে ধীরগতির কারণে ২০১৫ সালে অনেক বন্দরই কনটেইনার পরিবহনে পিছিয়ে ছিল। সেরার তালিকায় স্থান পাওয়া ১০০টি বন্দরের মধ্যে ৩৬টি বন্দরেই কনটেইনার পরিবহন কমেছে যার মধ্যে ব্যতিক্রম অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর।

বন্দর কর্তৃপক্ষের ভাষ্যে, কনটেইনার পরিবহনের হার বাড়তে থাকায় বন্দর এই স্থান অর্জন করে নিয়েছে। যেভাবে কনটেইনার পরিবহন বাড়ছে তাতে বন্দরের অবকাঠামো দ্রুত সম্প্রসারণে যাওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। এ জন্য ব্যাপক আকারে সম্প্রসারণের কাজে হাত দেওয়া হচ্ছে।

হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে এই বন্দর দিয়ে কনটেইনার ওঠা-নামা হয় ২০ লাখ ২৪ হাজার ২০৭ টিইইউস। আগের বছরের চেয়ে কনটেইনার পরিবহন বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৫ লাখ টিইইউস কনটেইনার পরিবহন হয়েছে। বছর শেষে তা ২৩-২৪ লাখে পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শিল্পকারখানার কাঁচামাল ও মেগা প্রকল্পের যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম আনার কারণে কনটেইনার পরিবহনের হার দ্রুত বাড়ছে।

আনন্দের কথা এই, কনটেইনার পরিবহনের এই হার বৃদ্ধি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নির্দেশ করছে। কারণ, রফতানি পণ্যের প্রায় পুরোটাই পরিবহন হয় কনটেইনারে করে। আবার কনটেইনারে আমদানি পণ্যের সিংহভাগই শিল্পের কাঁচামাল। পোশাক রপ্তানির পরিমাণ বাড়ার কারণে বন্দরে কনটেইনার পরিবহনে অগ্রগতি হচ্ছে। কনটেইনার আমদানি-রপ্তানির বড় অংশই পোশাকশিল্পের কাঁচামাল এবং তৈরি পোশাক। এ ছাড়া ওষুধশিল্প, ইস্পাত কারখানাসহ অসংখ্য কারখানার কাঁচামাল আনা-নেওয়া হয় এই কনটেইনারে করেই।

গত ৭ অক্টোবর অগ্রগতির সনদ নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান, এমপি’র উপস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম খালিদ ইকবালের হাতে তুলে দেন লয়েড’স লিস্টের প্রতিনিধি ক্যাপ্টেন জিল্লুর রহমান।

বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল খালিদ ইকবাল বলেন, ‘সাত বছরের ব্যবধানে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার ওঠানামা দ্বিগুণ হয়ে ২০ লাখ এককে উন্নীত হয়েছে। এ বছর শেষে এই ওঠানামা ২২ লাখ একক ছাড়িয়ে যাবে। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আমরা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি।’

ওয়ার্ল্ড পোর্ট সোর্স ওয়েব পোর্টাল অনুযায়ী, বিশ্বে আনুমানিক ৪ হাজার সক্রিয় বন্দর রয়েছে। তবে নিয়মিত কনটেইনার ওঠানো নামানো হয় এমন বন্দর আছে ৫০০টি।

সেরা তালিকার এক নম্বরে চীনের সাংহাই। ২০১৫ সালে এই বন্দর দিয়ে পরিবহন হয় ৩ কোটি ৬৫ লাখ একক কনটেইনার। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুর বন্দর। সেরা ১০টি বন্দরের মধ্যে চীনের রয়েছে সাতটি বন্দর।

আরও আনন্দের যে, সেরা ১০০ বন্দরের তালিকার পাশাপাশি লয়েড’স লিস্ট প্রকাশিত চীন ব্যতীত অন্যান্য এশিয়ান বন্দর সমূহের মধ্যে দ্রুতবর্ধনশীল বন্দরের তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। লয়েড’স লিস্ট এর সেই তালিকার একাংশ নিচে দেয়া হল।

বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে ভারী যন্ত্রপাতি কেনার উদ্যোগ

দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রামে শিগগিরই পর্যাপ্ত অত্যাধুনিক ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জাম সংগ্রহের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) নিজস্ব তহবিল থেকে এর জন্য অর্থায়ন করা হবে। মোট ১১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫১ ধরনের অত্যাধুনিক ভারী যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে। এর মধ্যে ১০টি ‘কী-গ্যান্ট্রি’ ক্রেন ছাড়াও রয়েছে রাবার টায়ারড গ্যান্ট্রি (আরটিজি) ক্রেন, স্ট্র্যাডল ক্যারিয়ার, রিচ স্ট্র্যাকার, কনটেইনার মুভার, রেল মাউন্টেড গ্যান্ট্রি ক্রেন, যার সবগুলোই কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের উপযোগী ভারী যন্ত্রপাতি।

দীর্ঘ এক যুগ পর চট্টগ্রাম বন্দরে এসব সরঞ্জাম সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রধান সমুদ্র বন্দরের গত ১৫ বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বার্ষিক ১২ থেকে ১৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে কনটেইনার হ্যান্ডলিং। এমন অবস্থায় যান্ত্রিক সরঞ্জামাদি কেনা সম্পন্ন হলে যন্ত্রপাতির ঘাটতি নিরসনসহ বন্দরের সক্ষমতা বাড়বে বলে আশাবাদ পোর্ট-শিপিং-কাস্টমস খাতের ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তা তথা বন্দর ব্যবহারকারীদের। 

বন্দর কর্তৃপক্ষের বোর্ড সদস্য মো. জাফর আলম জানান, আগামী ২০২০ সাল নাগাদ চট্টগ্রাম বন্দরে বার্ষিক অন্ততপক্ষে ২৯ লাখ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করতে হবে। এই লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের উপযোগী ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হচ্ছে। আগামী ১ থেকে ২ মাসের মধ্যে যান্ত্রিক সরঞ্জামের ক্রয় প্রক্রিয়া শুরু করার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। অত্যাধুনিক ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জাম সংযোজিত হলে চট্টগ্রাম বন্দরের গতিশীলতা, সক্ষমতা ও সার্বিক উৎপাদনশীলতা আরও বৃদ্ধি পাবে।

জানা গেছে, বর্তমানে এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা মূল্যের ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জামের ঘাটতি রয়েছে। কারিগরি হিসাবে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জামের ঘাটতি বিরাজ করছে। গত বছরের অক্টোবরে এক কিলোমিটার দীর্ঘ পাঁচটি জেটি-বার্থ সমন্বিত বহুল আলোচিত ও সর্ববৃহৎ কনটেইনার স্থাপনা নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পুরোদমে চালু হওয়ায় বন্দরে ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জামের আরও বেশি প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। তাছাড়া পুরনো জেটি-বার্থ, ইয়ার্ড, শেডগুলোতে কনটেইনারজাত এবং খোলা সাধারণ (ব্রেক বাল্ক) কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের উপযোগী যান্ত্রিক সরঞ্জামের প্রাপ্যতা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম রয়েছে। প্রতিবেশী বন্দরগুলোর সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরকে সত্যিকার অর্থে প্রতিযোগী করে তুলতে এমনকি সমান্তরালে দাঁড় করাতে হলে বন্দরের যান্ত্রিক সরঞ্জামের সংকট ও সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে তোলা ছাড়া বিকল্প নেই।

আগামী ১০ বছরে দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী পণ্যসামগ্রী হ্যান্ডলিংয়ের প্রবৃদ্ধির যে ধারা বজায় রয়েছে তা অনায়াসে সামাল দেয়ার জন্য কাছাকাছি সক্ষমতা রয়েছে প্রধান এ সমুদ্রবন্দরের। তবে এক্ষেত্রে বড় সমস্যা ভারী যন্ত্রপাতির। চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি, সিসিটি, জেসিবি মিলিয়ে রয়েছে ১৯টি জেটি-বার্থ। এর মধ্যে ১১টিতে আছে শ্যোর হ্যান্ডলিং ক্রেন। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য সর্বাধুনিক প্রযুক্তির (৫০ টনী) শিপ টু শ্যোর কী-গ্যানট্রি ক্রেন (এসএসজি) রয়েছে চারটি। ৪০ টনী রাবার টায়ারড গ্যানট্রি ক্রেন (আরটিজি) রয়েছে ১১টি। রেললাইনের সংযোগ আছে পাঁচটি জেটির সঙ্গে। বন্দরে ১০টি ট্রানজিট শেড রয়েছে। ভারী, মাঝারি ও ছোট আকৃতি ও অনুরূপ শক্তিসম্পন্ন বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক উপকরণের ঘাটতির কারণে কনটেইনারসহ দৈনন্দিন কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। সময়ক্ষেপণ, আর্থিক অপচয় ও বন্দর-ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।

জাহাজ থেকে কনটেইনার খালাস, ওঠানামা, স্থানান্তর, মজুদের উপযোগী যান্ত্রিক সরঞ্জামের উল্লেখযোগ্য ঘাটতি পুরণে তিনধাপে যন্ত্রপাতি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রথম ধাপে, ৬টি কী গ্যানট্রি ক্রেন, ১১টি রাবার টায়ারড গ্যানট্রি ক্রেন, ১টি রেল মাউন্ডেন্টড গ্যানট্রি ক্রেন, সার্বক্ষণিক কনটেইনার হ্যান্ডলিং কাজে অপরিহার্য ৪টি (ফোর হাইটের ৪০ টনী) স্ট্র্যাডল ক্যারিয়ার, ৪টি সাত টন থেকে ৪৫ টনী রীচ স্টেকার, ৫টি কনটেইনার মুভার ও ১টি মোবাইল হারবার ক্রেন কেনার কথা রয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে, ৪টি কী গ্যানট্রি ক্রেন, ৬টি রাবার টায়ারড গ্যানট্রি ক্রেন, ৬টি (ফোর হাইটের ৪০ টনী) স্ট্র্যাডল ক্যারিয়ার কেনার কথা রয়েছে। তৃতীয় ধাপে ৩টি রাবার টায়ারড গ্যানট্রি ক্রেন কেনার মধ্য দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আপাত ঘাটতি পূরণের পরিকল্পনা করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।

জীববৈচিত্র্যে বঙ্গোপসাগর: রূপে-রঙে-রসে

পৃথিবীর অন্যান্য সাগর থেকে বঙ্গোপসাগরকে আলাদা করেছে এর তলদেশের পুরু পলির স্তর এবং মিঠা পানির প্রাচুর্য। একই কারণে এখানে বিশ্বের বৃহত্তম ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানী ভান্ডার থাকার সম্ভাবনা দেখেন বিশেষজ্ঞরা। আর জানেন তো ইলিশের বৈশ্বিক চাহিদার ৫০-৬০ শতাংশ মেটায় এ সাগরের বাংলাদেশ অংশ।

প্রথম প্রাণের বিকাশ, মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো!

পানির ভুবন প্রাণবৈচিত্র্যময়। ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন কিংবা জুপ্ল্যাঙ্কটনের মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এমন অনেক প্রাণ রয়েছে এখানে যেগুলো খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়। আবার সেখানেই রয়েছে বিশালাকৃতির সেটাসিয়ান প্রজাতির সদস্য, যেমন, তিমি। কখনও ৩০ মিটারের অধিক ছাড়িয়ে যেতে পারে যাদের দৈর্ঘ্য।

সামুদ্রিক প্রতিবেশ আমাদের স্থলজ পৃথিবীর বিবিধ কাজে লাগে। এ কথা বলা যায় সন্দেহাতীতভাবে যে, তার অবদান বিনা বস্তুত এমন অনায়াস হতো না আমাদের আজকের জীবন। সমুদ্র আমাদের খাদ্য আর খনিজের জোগানদার। পৃথিবীর নৈমিত্তিক জলবায়ু ব্যবস্থাপনাতেও সমুদ্রের অবদান অপরিমেয়। আমাদের উদগীরিত কার্বনের বড় অংশটাই শেষ পর্যন্ত গিয়ে বিলীন হয় এই পানির পৃথিবীতে।

একুশ শতকের প্রেক্ষিতে বিশ^ব্যাপী সমুদ্র অর্থনীতির অমিত সম্ভাবনা আবিষ্কার ও তার যথাযথ বিকাশে প্রথমেই আবশ্যক সমুদ্রের সঙ্গে আমাদের অর্থপূর্ণ পরিচিতি। তাকে যথাযথ জানার মধ্য দিয়ে সম্ভব নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্র আবিষ্কার ও তার কার্যকর বাস্তবায়ন। এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে কাজটি শুরু হতে পারে বাড়ির আঙ্গিনাবর্তী বিশ্বের বৃহত্তম উপসাগর বঙ্গোপসাগরের চিরায়ত  অধিবাসীদের সঙ্গে সম্যক পরিচিতি ঘটার মধ্য দিয়েই।

ভূস্তরবর্তী অবস্থান ও তজ্জনিত প্রাণপুঞ্জ

ভারত মহাসাগরের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শাখা বা উপসাগরটির নাম বঙ্গোপসাগর। আন্দামান সাগর এবং আন্দামান দ্বীপপুঞ্জকে হিসেবের বাইরে রেখে মানচিত্রে এর বিস্তার উত্তরে ৬ ডিগ্রি অক্ষাংশ থেকে পূর্বে ৯৫ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত। ভারত মহাসাগরের বর্ধিত শাখা হিসেবে তার অনুরূপ মৌসুমী বায়ুপ্রবাহ এবং ঘূর্ণিঝড়সহ বহুবিধ বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছে এই উপসাগর। পাশাপাশি, এটি আন্দামান সাগর, মালাক্কা প্রণালী ও পক প্রণালীর সঙ্গে প্রত্যক্ষরূপে সংযুক্ত। ১১শ শতাব্দীতে এর নাম ছিল চোলা লেক।

পৃথিবীর অন্যান্য সাগর, যেমন, ভূমধ্যসাগর, লোহিত সাগর, কিংবা চীন সাগরের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে কতিপয় অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী আমাদের বঙ্গোপসাগর। গড়পড়তায় এটি উল্লিখিত সাগরগুলোর তুলনায় এক থেকে দুই কিলোমিটার অগভীর। ফলত এখানকার সমুদ্র তলদেশে যে কোনো ধরনের খনন কিংবা স্থাপনা প্রকল্প কিংবা উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নেয়া অন্যান্য সাগরের চেয়ে তুলনামূলক সহজ এবং সাশ্রয়ী। উপরন্তু এখানে সন্নিবেশ ঘটেছে গোটা বিশ্বের মাঝে সবচেয়ে বেশি পুরু স্তরের (সর্বোচ্চ পুরুত্ব ২১-২২ কিমি এবং গড় পুরুত্ব ১৬.৫ কিমি) পলল জমিনের। ফলত বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন এখানেই গড়ে ওঠা সম্ভব বিশ্বের বৃহত্তম ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানির ভাণ্ডার।

মিষ্টি পানির অমিত প্রাচুর্য্য বঙ্গোপসাগরের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য। এর বুকে বছরে ১.৬ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার মিষ্টি পানির প্রবাহ উগরে দিচ্ছে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনাসহ বিশ্বের বৃহত্তম কয়েকটি নদী। ভূপৃষ্ঠের অন্যান্য সাগরে গড় লবণাক্ততার পরিমাণ যেখানে ৩৫ পিপিটি, সেখানে আমাদের প্রাচীন প্রতিবেশি এ উপসাগরে তার মাত্রা উপকূলীয় এলাকায় শূন্যথেকে আরম্ভ করে সর্বোচ্চ ৩০ পিপিটি মাত্র।

সাগরের অনন্য এ বৈশিষ্ট্যের প্রভাব স্বভাবতই প্রতিফলিত হয়েছে এখানকার জীববৈচিত্র্যের মাঝে। যেমন, সাগরের নিচের দিককার লবণাক্ত এবং ভারি পানির তুলনায় ওপরের স্তরের পানি অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার এবং হালকা, যার ফলে প্রাথমিক প্রাণকণা গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিসমৃদ্ধ নিচের পানি ওপরে উঠে আসতে পারে না সহজে।

পাশাপাশি, হিমালয় থেকে নেমে আসা নদীখাতসমূহ প্রায় খাড়া ঢাল বেয়ে আসার ফলে এসব নদীস্রোতের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে জমা হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পলিভাণ্ডার। এর পরিমাণ বছরে প্রায় ৬৬৫ মিলিয়ন টন। ফলত সারাবছর তুলনামূলক ঘোলা থাকছে এখানকার পানি যা বস্তুত সহায়ক ভূমিকা পালন করছে বিশেষ প্রজাতির মাছ (যেমন, ইলিশ) বা প্রাণকোষের জন্য। পানিস্তরের এ বৈশিষ্ট্যের দরুণ সূর্যের আলো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পানির গভীরে যাবার পথে, যে কারণে পানির তলদেশের উদ্ভিজভুবনে সালোক- সংশ্লেষণ ঘটতে পারছে কম এবং বাধাগ্রস্থ হচ্ছে জলজ উদ্ভিদের বিকাশ। 

পৃথিবীর অন্যান্য সাগরের তুলনায় বঙ্গোপসাগরের ¯্রােতধারার রয়েছে অনন্য বৈশিষ্ট্য। গ্রীষ্মের মৌসুমে এর গতিমুখ থাকে ঘড়ির কাঁটার অভিমুখে এবং শীতকালে তা আবর্তিত ঘড়ির কাঁটার বিপরীত মুখে। বঙ্গোপসাগরের অগভীর এলাকায় (১০০-২০০ মিটার) প্রায় পুরোটাই অক্সিজেন সমৃদ্ধ যা এই পরিবেশ উপযোগী জীববৈচিত্র্যের অনুকূল। পক্ষান্তরে এর চেয়ে গভীরে গেলেই তৈরি হচ্ছে অক্সিজেনের স্বল্পতা যে কারণে অক্সিজেনের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল বিশেষ জাতীয় প্রাণীর পক্ষে সেখানে বসবাস কিংবা টিকে থাকা অসম্ভব। তুলনামূলক বিবেচনায়, বিশেষত গ্রীষ্ম মৌসুমে আরব সাগরের চেয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রাণীজ উৎপাদনশীলতা কম, যে কথার অর্থ, বঙ্গোপসাগরে মাছ কিংবা অন্যান্য জীবকুল পরিমাণগতভাবে কম হলেও বৈচিত্র্যবিচারে তা অত্যন্ত সমৃদ্ধ।                       

বৈচিত্রময় প্রাণীকুল

বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ৬৪টি জীববৈচিত্র্য এলাকার অন্যতম বঙ্গোপসাগর। এখানে পাওয়া যায় কেরিলিয়া জারদোনি নামের এক বিরল প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ। আরও আছে ব্রাইডস হোয়েল নামে এক প্রকার তিমি ওজনের বিচারে যেটির অবস্থান সারা বিশ্বের মধ্যে দশম। পাশাপাশি রয়েছে মারলিন (হেমিংওয়ের বিখ্যাত ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি গল্পের সেই বুড়ো জেলে শিকার করেছিল যেই মাছ), ব্যারাকুডা এবং স্কিপজ্যাক টিউনা। এছাড়া আছে হলুদ ডানার টিউনা, কুঁজঅলা ডলফিন এবং ব্রাইডহোয়েল জাতের তিমি।

আমাদের উপকূলীয় জীববৈচিত্র্যের মধ্যে রয়েছে ৪৫৩ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী জীব, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ বা রেপটাইল এবং ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী যার একটা বিরাট অংশই রয়েছে বিপন্ন হবার ঝুঁকির মাঝে। উপকূলীয় অঞ্চলে গবেষণা চালিয়ে মোহনায় পাওয়া গেছে ৩০১ প্রজাতির মোলাস্ক (অমেরুদণ্ডী শামুক, ঝিনুক, অক্টোপাস জাতীয়), বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক ৫০ প্রজাতির চিংড়িজাতীয় প্রাণী এবং ৭৬ প্রজাতির মৎস। বিপন্ন হবার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে পাঁচ প্রকার স্তন্যপায়ী, ২৫ ধরনের পাখি, ১৪ প্রকার সরীসৃপ এবং দুই প্রজাতির ব্যাঙ। বিপন্নের তালিকায় আরো আছে অলিভ, রিডলি, কচ্ছপ।

আমাদের সমুদ্রভুবনে আরও আছে ৪৪২ প্রজাতির মাছ এবং ৩৬ প্রজাতির সামুদ্রিক চিংড়ি জাতীয় প্রাণী। সনাক্ত করা হয়েছে ১৫১ গোত্রের ৩৩৬ প্রজাতির ঝিনুক-শঙ্খ জাতীয় জীব। আমাদের সমুদ্রসীমায় বসবাস করছে ৩ প্রকার লবস্টার এবং ৭ প্রজাতির কূর্ম ও কচ্ছপ, ১৬৮ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ৩ প্রকার স্পঞ্জ, ১৬ প্রজাতির কাঁকড়া, ১০ প্রজাতির ব্যাঙ, ৩ প্রকার কুমির, ২৪ প্রজাতির সাপ, ৩ প্রজাতির ভোঁদড়, এক প্রকার সজারু, ৯ প্রজাতির ডলফিন এবং ৩ প্রজাতির তিমি। এছাড়া অভিবাসী শ্রেণীভুক্ত প্রাণীভুবনে বিপদাপন্ন হবার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ৪ প্রজাতির মাছ, ৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬ প্রজাতির পাখি এবং ৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী জীব।

কেবল সেন্ট মার্টিন দ্বীপেই সনাক্ত করা হয়েছে ২৩৪ প্রজাতির মাছ। এর মধ্যে প্রবালজাতীয় রয়েছে ৯৮টি প্রজাতি। এখানে ঝিনুক-শঙ্খ জাতীয় প্রাণীর সংখ্যা ১৮৭। কাঁকড়া জাতীয় প্রাণী রয়েছে সাত প্রকার। প্রবাল জাতীয় প্রাণীর সংখ্যা ৬৬ যার মধ্যে ১৯ প্রজাতি হচ্ছে প্রবালের জীবাশ্ম। সামুদ্রিক শৈবাল রয়েছে ১৪ প্রকার।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

বঙ্গোপসাগরে উপকূলীয় অঞ্চলের একটা বড় অংশ জুড়ে গড়ে উঠেছে বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বিশে^র বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। এসব বনাঞ্চলের মধ্যে রয়েছে ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবন। বরিশাল, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম আর কক্সবাজারের উপকূলীয় অঞ্চলের বনাঞ্চল এই হিসেবের মধ্যে নিলে ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের পরিমাণটি দাঁড়ায় দেশের মোট বনাঞ্চলের প্রায় অর্ধেক। সুন্দরবন তার আয়তনবিচারে আমাদের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৭৪ শতাংশ। এসব বনাঞ্চলে যেসব জীববৈচিত্র্য বিরাজমান তার মধ্যে রয়েছে স্তন্যপায়ী প্রাণীকুল, পাখি, উভচর, সরীসৃপ এবং চিংড়িজাতীয় প্রাণী। বিগত চার দশক কিংবা তারও বেশি সময় ধরে চিংড়ি চাষ বড় ধরনের অবদান রাখছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ছয় লাখ মানুষ সরাসরি জড়িত রয়েছে এই শিল্পে।  

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের আলোচনায় ফেরা যাক। দেশের স্থলভাগের আয়তন ১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৪ বর্গকিলোমিটার। পক্ষান্তরে আমাদের সমুদ্র এলাকার আয়তন ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার। এর উত্তর, পশ্চিম আর উত্তর-পশ্চিমে ভারত, পূর্বে আর দক্ষিণপূর্বে মায়ানমার আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগরের মোট আয়তন ২১ লাখ ৭২ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং এর গড় গভীরতা ২৬০০ মিটার, বা কমবেশি আড়াই কিলোমিটার। উপসাগরের সঙ্গে আমাদের উপকূলরেখার দৈর্ঘ্য ৭১০ কিলোমিটার। বঙ্গোপসাগরের আমাদের সমুদ্রঅঞ্চলে গড়ে ৫০ মিটার গভীরতার কনটিনেন্টাল শেলফের আয়তন ৩৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। এটি বর্তমানে আমাদের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন, বা একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত।

সম্ভাবনার শীর্ষে ইলিশ আর চিংড়ি

বঙ্গোপসাগরে জেলেদের হাতে ধরা পড়া মৎসসম্পদের পরিমাণ ২০১২-১৩ সালে ছিল ৫৮৮,৯৮৮ টন। এর বছর দশেক আগে পরিমাণটি ছিল ৩৭৯,৪৯৭ টন। এ মৎসসম্পদের অধিকাংশই শেষ পর্যন্ত হিমায়িত আকারে রফতানি হয়ে যায় বিদেশে এবং বিশ্বের বড় বড় শহরে। অতি অল্পই গিয়ে বিক্রি হয় স্থানীয় বাজারে। এরও আবার একটা অংশ লবণে জারিত করে শুকানো হয় খাদ্যসামগ্রী হিসেবে সংরক্ষণের জন্য। দেশের মধ্যে মৎস এবং হাস-মুরগির খামার বৃদ্ধির দরুণ শুটকির ব্যবহারও বেড়ে চলেছে দিনে দিনে।

বঙ্গোপসাগরে আহরিত এসব মাছের মধ্যে সবচেয়ে অর্থকরী এবং জনপ্রিয় মাছের নাম ইলিশ। এর বৈজ্ঞানিক নাম টেনুয়ালোসা ইলিশা। প্রতিবছর জেলেদের জালে ধরা পড়ছে প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান এবং উপার্জন ঘটছে প্রায় ২৫ লাখ মানুষের। প্রতিবছর জাতীয় পর্যায়ে এ থেকে আয়ের পরিমাণ ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অত্যন্ত গর্বের বিষয়, বর্তমানে সারা পৃথিবীতে যতো ইলিশ আহরণ করা হয় তার ৫০-৬০ শতাংশই আসছে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগর এলাকা থেকে। মায়ানমারে ধরা পড়ে ২০-২৫ শতাংশ, ভারতে ১৫-২০ শতাংশ এবং বাকি ৫-১০ শতাংশ আসে বিশ্বের বাদবাকি দেশসমূহ থেকে। বিশ্বে ৩১% জেলে এ অঞ্চলে বাস করে। বছরে গড়ে ৬০ লক্ষ টন মাছ ধরা হয় এ এলাকা থেকে।

এগুলোর পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরে রয়েছে বাগদা চিংড়ি আর গলদা চিংড়ির বিশাল সম্ভাবনা। ২০১২-১৩ সালে বঙ্গোপসাগর থেকে আহরণ করা হয় ৪৬ হাজার ৫৬৮ মেট্রিক টন বাগদা চিংড়ি (বৈজ্ঞানিক নাম পেনাউস মনোডন) যার শেষ গন্তব্য ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর জাপানের বাজার। গত ১০-১৫ বছর যাবৎ পূর্ব এশীয় দেশগুলোয় রফতানি করা হচ্ছে বিশালকৃতির মেটে কাঁকড়া (স্কিলা সেরাটা) এবং মোহনা এলাকার ঈল মাছ (মরেনেসক্স বেজিও)। রফতানিকৃত এসব জ্যান্ত কাঁকড়ার ২০ শতাংশের কিছু কম পরিমাণ পাওয়া যাচ্ছে বস্তুত সাতক্ষীরা, বাগেরহাট আর কক্সবাজারের কাঁকড়াচাষীদের কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ প্রকল্প থেকে।

পরিশেষে

বর্তমান সরকারের জোর প্রচেষ্টায় সমূদ্রসীমায় নিজস্ব অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশ। আর্ন্তজাতিক আদালতের একাধিক রায় ইতিমধ্যে আমাদের পক্ষে এসেছে। যারই ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয়েছে বিপুল সম্পদরাজি সংগ্রহের অপার সম্ভাবনা। কালবিলম্ব না করে এখনি এই সম্ভাবনা কাজে লাগানোর প্রস্তুতি নিতে হবে, করতে হবে অর্থ ও মেধার বিনিয়োগ।

জোয়ারভাটা থেকেই জ্বালানিশক্তি

বিপুলা জলরাশির জোয়ারভাটা থেকে জ্বালানিশক্তি উৎপাদনের জাদু আয়ত্ত্ব করতে পারলে আমরা প্রতিদিন প্রাকৃতিক আবর্তনের সূত্র ধরেই অন্তত দুই দফা জ্বালানি আহরণের সুযোগ পাব। এতে আমাদের পুনর্বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই বললেই চলে। মহাকালের  বিধানে স্বয়ংক্রিয় চালু থাকবে এই উৎপাদন প্রক্রিয়া। এবং সংশ্লিষ্ট সবাই আশাবাদী, এটাই হয়ে উঠতে পারে আমাদের নবায়নযোগ্য শক্তি আহরণের অন্যতম সম্ভাবনাময় মাধ্যম।

প্রতিদিন দুইবার, নদী কিংবা সাগরের, জোয়ার-ভাটার প্রবল শক্তির টানাপড়েন কাজে লাগিয়ে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় শক্তিটুকু আহরণ করতে পারি। তার জন্য প্রথমে একটা বিশেষায়িত বাঁধ বসাতে হবে নদী অথবা সাগরের মুখে। এই পদ্ধতিতে জোয়ারের সময় পানি এসে ঢুকবে বাঁধের এপারের রিজারভয়েরে। ভাটার সময় তা বেরিয়ে যাবে পুনরায়- ওই একই পথে। চাষাবাদ এবং আরও নানাবিধ কাজে জোয়ারভাটা চক্রের একটি নির্দিষ্ট সময়ে স্লুইচ গেট নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই কাজটি করা হয়ে থাকে। আমাদের যা করতে হবে তা হচ্ছে, একটা করে শক্তি উৎপাদনক্ষম টারবাইন বসাতে হবে এই স্লুইচ গেটগুলোয়- যাতে তা দিয়ে আমরা একত্রে বিপুল জলরাশির অবিরাম আসা-যাওয়ায় কারণে উৎপন্ন হওয়া শক্তি থেকে নিজেদের প্রয়োজনীয় শক্তিটুকু আহরণ করে নিতে পারি।   

৭১০ কিলোমিটার আমাদের উপকূলরেখার দৈর্ঘ্য। পৃথিবীর খুব অল্প দেশের রয়েছে সমুদ্রের সাথে এই বিপুল নৈকট্য। মহাস্রোত কাজে লাগিয়ে অমিত জ্বালানিশক্তি উৎপাদনের সৌভাগ্য। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে যদি, আরইটি বা রিনিউয়েবল এনার্জি টেকনোলজি, বাংলায় বললে, নবায়নযোগ্য শক্তি আহরণ প্রযুক্তি একটি সম্ভাব্য বাস্তবতা হয়ে উঠতে পারে তাহলে সমুদ্রখাতে যেসব বিষয় আমাদের প্রধান মনোযোগ কেড়ে নেবে তা হচ্ছে:

  •      জোয়ার
  •      তরঙ্গ
  •      সমুদ্রের তাপশক্তির রূপান্তর

জোয়ার-ভাটার কাব্য

চাঁদের সাথে পৃথিবীর সম্পর্ক বহুদিনের পুরনো। যে গল্প প্রায় ভুলেই বসে আছি আমরা। কিন্তু প্রতিদিন দুই দফা সেকথা মনে করিয়ে দিতেই বুঝি তিনভাগের দখল নিয়ে বসে থাকা মহাসমুদ্রগুলোর বুকে লাগে অভিকর্ষের টান, পালে বাতাস লেগে ফুলে ওঠে তার প্রবাহ তখন যেন তারা ছুটে যেতে চায় চাঁদের পানে। আমরা একে বলি জোয়ার। কিছু সময় পর আবার যখন নেমে যায় এই জল তখন বলি ভাটা। চাঁদসূর্যপৃথিবীর এই সম্পর্কজনিত রসায়নে সাগরের বুকে প্রতিদিন দুইদফা উৎপন্ন জোয়ার ভাটার শক্তির গলায় শেকল পরিয়ে তার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি শক্তি উৎপাদন করতে পারি আমরা।

সূর্যের চারদিকে ঘূর্ণিরত পৃথিবীর বিরতিহীন আবর্তনও ঢেউ-তরঙ্গ-জোয়ার সৃষ্টির একটি কারণ।

জোয়ারে নিহিত শক্তি থেকে উৎপাদিত শক্তি হবে দূষণমুক্ত নবায়নক্ষম। এর জন্য আমাদের স্লুইচ গেট বা নিষ্কাশন ফটকগুলোয় স্বল্প ব্যয়ে টাইডাল হুইলবা জোয়ারচক্র বানাতে হবে যেখান থেকে তৈরি হবে বিদ্যুৎ। বাংলাদেশে উপকূলীয় এলাকায় ধেয়ে আসা জোয়ারের ঢেউয়ের উচ্চতা সাধারণত ২ থেকে ৮ মিটারের মধ্যে সীমিত থাকে। গড়ে ৭ মিটারের জোয়ারেই বাণিজ্যিক লাভজনক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।

বাংলাদেশের সন্দ্বীপে এ ধরনের একটি প্রকল্প নিয়ে ভাবছে অস্ট্রেলিয়ার মারডক ইউনিভার্সিটির আইএসটিপি। টাইডাল ইলেকট্রিক ইনক নামে শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি আছে একটা যারা কাজ করছে বিশে^র বিভিন্ন দেশে জোয়ারভাটার শক্তি রূপান্তরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মিশন নিয়ে। বঙ্গোপসাগরে আমাদের দুই প্রতিবেশি ভারত আর মায়ানমারেও তারা বেশ সক্রিয়। ভারতের গুজরাটে ১,০০০ মেগাওয়াটের টাইডাল পাওয়ার প্ল্যান্টগড়ে উঠছে দ্রুতগতিতে।

এছাড়াও সমুদ্রে সতত বহমান তরঙ্গ হতে পারে  নবায়নক্ষম শক্তির উৎস। বায়ুপ্রবাহের দরুণ সাগরপৃষ্ঠে দোলা লাগে অবিরাম। তৈরি হয় ঢেউ। সঞ্চিত শক্তি নিয়ে এসব ঢেউ বয়ে যায় হাজার হাজার মাইল। যাত্রাপথে শক্তিক্ষয় ঘটেও অতি কম। সাধারণত বিষুব অঞ্চলের তুলনায় মেরু অঞ্চলে ঢেউয়ের মধ্যে সঞ্চিত থাকে বেশি শক্তি।

‘সম্ভাবনার নতুন দরোজা খুলে দিয়েছে সমুদ্র অর্থনীতি’

সচিব, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশিত রূপকল্প-২০২১ এবং রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়ন করতে হবে। এ লক্ষ্যে, ত্রিশ বছরের কৌশলগত মহাপরিকল্পনা নিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে চট্টগ্রাম বন্দর। বিগত সময়ে বন্দরের ওপর থেকে নিচ সর্বস্তরের কার্যক্রম ডিজিটাইজ করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে শতভাগ নিরাপদ হয়েছে বন্দর। পুরোপুরি কনটেইনার বন্দর হয়ে ওঠার লক্ষ্যে অত্যাধুনিক অবকাঠামো এবং যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ নতুন নতুন টার্মিনাল তৈরি হচ্ছে। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর হবার পাশাপাশি রিজিওনাল হাব হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। বন্দরে চ্যানেলের দৈর্ঘ্য আর ড্রাফটের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে বে টার্মিনালের মতো বৃহদাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে। আঞ্চলিক প্রতিবেশি অনেকগুলো দেশের সঙ্গে উপকূলীয় যোগাযোগ শুরু হবার ফলে অসীম সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত খুলে গেছে। বঙ্গোপসাগরে নতুন সমুদ্রএলাকা অর্জনের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে চট্টগ্রাম বন্দরকেই ব্যাপক আয়োজন সহযোগে প্রস্তুতি নিতে হবে, এখনই।

এবম্বিধ পরিমার্জন আর পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে দ্রুততম সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরকে সিঙ্গাপুর, সাংহাই কিংবা রট্যারড্যামের মতো বিশ্বমানের বন্দর হিসেবে দাঁড় করানোর লক্ষ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে সরকারের নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। এসব বিষয়ের পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দর ঘিরে আজ এবং আগামী দিনের নীতি ও পরিকল্পনা নিয়ে বন্দরবার্তা সম্পাদক জাফর আলম-এর সঙ্গে আলাপচারিতায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মাননীয় সচিব জনাব অশোক মাধব রায়ের সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাতকার।   

বন্দরবার্তা:

বাংলাদেশের নৌপরিবহন খাতের সামগ্রিক উন্নয়ন, যেমন, নৌবন্দরের আধুনিকায়ন, কিংবা চ্যানেলের নাব্যতা ধরে রাখা, ইত্যাদি চলমান কার্যক্রম সম্পর্কে বলুন। এগুলো বাস্তবায়নের ফলে কী ধরনের উপকার পেতে যাচ্ছি আমরা?

সচিব:

নদীবাহিত বাংলাদেশে নৌ-পরিবহন খাত মানুষের যাতায়ত ও ব্যবসা-বাণিজ্য এবং পণ্যপরিবহনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত। নদীর উন্নয়নের ওপরই নির্ভরশীল নৌপরিবহনের সামগ্রিক উন্নয়ন। একারণে নদী রক্ষার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছি আমরা। তিন শর ওপর নদী রয়েছে আমাদের। এগুলো শতভাগ নৌ-চলাচল উপযোগী। কিন্তু এগুলো ছাড়া আরও অনেক নদী নাব্যতা হারিয়েছে বিগত সময়ে। সেগুলো পুনরায় বাঁচিয়ে তোলার জন্য বর্তমান সরকারের উৎসাহ এবং মাননীয় নৌ-পরিবহনমন্ত্রীর নির্দেশনায় নানাবিধ কার্যক্রম হাতে নিয়েছি আমরা। নদী বিষয়ক টাস্ক ফোর্স গঠন করেছি। অবৈধ নদীদখল আর দূষণ প্রতিরোধে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে তারা। ৫৩ টি নৌপথ খননের মাধ্যমে সেগুলো চলাচল উপযোগী করে তোলার লক্ষ্যে পঞ্চাশ কোটি ডলারের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। আমাদের নদীগুলোর পানিধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ কারণে অভ্যন্তরীণ নৌ-পথে ৯০ লক্ষ ঘনমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিং করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমরা মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং পদ্ধতি অনুসরণ করছি। এখানে কেবল একবার ড্রেজিং করেই কোম্পানির দায়িত্ব শেষ হয়ে যাচ্ছে না, নদীর নাব্যতা যথাযথ বজায় আছে কিনা, পলি জমে নদীর তলদেশ আবারও ভরাট হয়ে পড়ছে কিনা, সেদিকে নজরদারি করাটাও একই কোম্পানির দায়িত্ব। শিল্প কলকারখানায় ইটিপি স্থাপন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অনেকে ইটিপি করেছেন কিন্তু এগুলো চালু রাখেন না। এসব অভিযোগে অনেকগুলো কারখানায় শতাধিক কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এসব কারণে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। ইটিপি না থাকলে, কিংবা তা থাকার পরও চালু না রাখলে ওইসকল কলকারখানা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।          

বন্দরবার্তা:

নিজেদের উদ্যোগে এই প্রথম ত্রিশ বছরের কৌশলগত মহাপরিকল্পনা প্রণয়ণ করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে বন্দরের এ মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন কী ধরনের ইতিবাচক অভিঘাত তৈরি করবে?

সচিব:

১৯৬৬ সালের এবারই প্রথম চট্টগ্রাম বন্দরের ত্রিশ বছরের জন্য ব্যাপকভিত্তিক মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হলো। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে এই কৌশলগত মহাপরিকল্পনা বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। জার্মানির হামবুর্গ পোর্ট কনসালট্যান্টস (এইচপিসি) স্থানীয় কেএস কনসালট্যান্টের সাথে যৌথভাবে প্রায় সাত কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করে। গত বছর ২০ মিলিয়ন কনটেইনার হ্যান্ডল করেছে চট্টগ্রাম বন্দর। ২০১২ সালে বন্দরের মোট হ্যান্ডলিং পরিমাণ ছিল ৪২ মিলিয়ন টন। ২০৪৩ সাল নাগাদ এ চাহিদা উন্নীত হবে ১২৪ মিলিয়ন টনে। শুধু কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের হিসাব বিবেচনায় নিলেও দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালে আমাদের হ্যান্ডল করতে হবে প্রায় তিন মিলিয়ন কনটেইনার। ২০৩৬ সালে চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে ৫.৬ মিলিয়নে। এদিকে সোনাদিয়াতে গভীর সমুদ্র বন্দরটি ২০২৬ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করলে ২০৪৩ সালে গিয়ে দেশের কনটেইনার বাণিজ্যের ৫০ শতাংশই হ্যান্ডল করা হবে এখানে। মহাপরিকল্পনা অনুসারে চট্টগ্রাম বন্দরের বিরাজমান অবকাঠামোর সাথে বে কনটেইনার টার্মিনাল এবং কর্ণফুলি কনটেইনার টার্মিনাল (কেসিটি) নির্মাণ করা হলে পরবর্তী ত্রিশ বছর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রবৃদ্ধি চাহিদা অনুযায়ী কনটেইনার ওঠানামার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা থাকবে না। সে লক্ষ্যে ২০১৮ সালের মধ্যে প্রস্তাবিত কেসেটির নির্মাণকাজ শেষ এবং ২০২৩ সালের মধ্যে বে-টার্মিনালের নির্মাণকাজ শেষ করে অপারেশনে আনতে হবে।   

বন্দরবার্তা:

মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে মূল প্রতিবন্ধক কী বলে মনে করছেন? সেগুলো উত্তরণে কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন?

সচিব: 

চট্টগ্রাম বন্দরের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে বন্দরের অনেকগুলো সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমানে বন্দরে ১৯০ মিটারের বড় এবং ৯.৫ মিটারের বেশি গভীরতার জাহাজ ভিড়তে পারে না। একটি ফিডার জাহাজে সর্বোচ্চ ১৫০০ কনটেইনার ধারণ করা সম্ভব। তাছাড়া কর্ণফুলিতে ট্রাফিক বেশি। চব্বিশ ঘন্টায় প্রায় তিন হাজার নৌযান চলাচল করে এখানে। রফতানি পণ্যবাহী কনটেইনার সরাসরি জাহাজে লোড করা হয়। ফলে একটি জাহাজকে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয়। আমার উদ্যোগ নিচ্ছি রফতানি পণ্য নতুন চালু হওয়া কনটেইনার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিটিএমএস) এর আওতায় আনা হলে এই প্রতিবন্ধকতা দূর হবে।  

বন্দরবার্তা:

প্রতিবেশি ভারতের সঙ্গে আমাদের উপকূলীয় যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। শিগগির অন্যদের সাথেও সম্প্রসারিত হতে যাচ্ছে তা। উপকূলীয় যোগাযোগ থেকে কী জাতীয় সুবিধাপ্রাপ্তির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে আমাদের সামনে?

সচিব:

প্রতিবেশি ভারতের সঙ্গে আমাদের উপকূলীয় জাহাজ চলাচল আনুষ্ঠানিক শুরু হয়েছে গত ২২ মার্চ। ওইদিন ১৭৬ টিইইউস ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এমভি হারবার-১ জাহাজটি কৃষ্ণপাটনাম বন্দরের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম ছেড়ে যায়। এর আগে গত বছরের ৬ জুন সেদেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বাংলাদেশ সফরকালে দুই দেশের মধ্যে উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি হয়। পরবর্তীতে চুক্তি কার্যকর করার লক্ষ্যে একই বছর ১৫ নভেম্বর নয়াদিল্লীতে দুই দেশের মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) চুক্তি হয়। দুই দেশের মধ্যেকার বাণিজ্য সম্পর্ক এক ধাপ এগিয়ে নিতে ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি করেছে এই কার্যক্রম। অনেক কাজ এখনও বাকি রয়ে গেছে যেগুলো রয়েছে আশু নিষ্পত্তির প্রক্রিয়ায়। আপাতত চুক্তির আওতায় জাহাজগুলো এক ট্রিপে ছয় হাজার টনের বেশি পণ্য পরিবহন করতে পারবে না। আমাদের সমুদ্র বন্দরের মধ্যে স্থানিক দূরত্ব তিন শথেকে পাঁচ শমাইলের মতো। অথচ এতোকাল পণ্য পরিবহনে আমাদেও জাহাজগুলোকে সিঙ্গাপুর হয়ে প্রায় দুই হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আসতে হতো। সময় লাগত পনের থেকে বিশ দিন। এখন তা নেমে এসেছে মাত্র তিন দিনে। বর্তমান ব্যবস্থায় উপকূলীয় নৌযোগাযোগ শুরু হবার কারণে ব্যবসায়ীদের পণ্য আদানপ্রদানে প্রায় খরচ ও সময় দুটোই দুই-তৃতীয়াংশ বেঁচে যাবে।     

বন্দরবার্তা:

রিজিওনাল হাবহয়ে ওঠার লক্ষ্যে আমাদের এ বন্দরের কী ধরনের প্রস্তুতি থাকতে হবে? এ লক্ষ্যে কী ধরনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে ইতোমধ্যেই?

সচিব:

উপকূলীয় জাহাজ চলাচলের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল-ভূটান উপ-আঞ্চলিক জোটের ধারণা রূপ পেতে যাচ্ছে। ফেণী নদীর ওপর সেতু নির্মাণ হলে বাংলাদেশ ও ত্রিপুরার মধ্যে সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এর মধ্য দিয়ে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা এবং বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল-ভূটানে পণ্য পরিবহন সম্ভব হবে। ফলত আঞ্চলিক প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোতে এখনই সাজাতে হবে চট্টগ্রাম বন্দরকে। স্থলবেষ্টিত নেপাল, ভূটান কিংবা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসাম, মেঘালয়, অরুণাচল, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা- কিংবা চীনের দক্ষিণাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চীয় মায়ানমার- এই সমগ্র অঞ্চলের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম। এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে কনটেইনার হ্যান্ডলিং, সংরক্ষণ ও পরিবহনের মাধ্যমে কমপক্ষে দশ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। বন্দরের উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রণীত ত্রিশ বছরের কৌশলগত মহাপরিকল্পনায় বিবেচনায় নেয়া হয়েছে বিষয়গুলো। বন্দরের অবকাঠামো আধুনিকায়ন করা হয়েছে প্রতিটি স্তরে। চ্যানেলের নাব্যতা ধরে রাখতে ড্রেজিং কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। কনটেইনার প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সামর্থ্য বাড়ানোর লক্ষ্যে নতুন টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে।     

বন্দরবার্তা:

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ব্লু-ইকোনমি কী ধরনের সম্ভাবনা ধারণ করে আছে? এক্ষেত্রে আগামীতে কী ধরনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে চট্টগ্রাম বন্দর?

সচিব:

বর্তমান বিশ্বে টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন কার্যক্রমের প্রেক্ষাপটে ব্লু-ইকোনমি ধারণাটি অত্যন্ত দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠা একটি ধারণা। বাংলাদেশের মতো উপকূলীয় রাষ্ট্রের জন্য বিষয়টি অতীব তাৎপর্য বহন করে। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে মায়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির পর প্রায় এক লাখ আঠারো হাজার বর্গ কিলোমিটার সমুদ্রএলাকার ওপর নিজেদের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি আমরা। চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানে অবস্থিত সকল প্রকার প্রাণিজ ও খনিজ সম্পদের ওপর আমাদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা হয়েছে। কেবল এরই কারণে আগামী দিনে উন্নয়নের লক্ষ্যে বিপুল সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেছে আমাদের সামনে। প্রতিবছর প্রায় ৮০০ মিলিয়ন টন মাছ ধরা হয় বঙ্গোপসাগরে। এর মধ্যে বাংলাদেশের জেলেরা পায় মাত্র ৭০ মিলিয়ন টন। এতোকাল এই বাকি মাছ নিয়ে যেত থাইল্যান্ড, মায়ানমার আর ভারতীয় জেলেরা। প্রায় সাড়ে চার শপ্রজাতির মূল্যবান ও পুষ্টিকর মাছ রয়েছে বঙ্গোপসাগরে। বিদেশে বিপুল চাহিদা রয়েছে এর। সমুদ্র থেকে আহরিত খনিজ লবণ নানা ধরনের রসায়নশিল্পে প্রয়োজন হয়ে থাকে। নানা প্রকার জীবনরক্ষাকারী অষুধের উৎস আমাদেও সমুদ্রভা-ার। ১২৫ কিলোমিটারের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত রয়েছে এখানে। পর্যটকদের জন্য কক্সবাজার আর প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিনকে আকর্ষণীয়রূপে গড়ে তুলতে পারলে বিদেশি পর্যটকের ঢল নামবে এখানে। আধুনিক ব্যবস্থাপনা এবং প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে ইউরোপের উপকূলীয় দেশগুলো সমুদ্র অর্থনীতি থেকে প্রতিবছর ৫০০ বিলিয়ন ইউরো আয় করছে। সম্ভাবনাগুলো যথাযথ কাজে লাগাতে পারলে আমাদের পক্ষেও অনুরূপ সাফল্য অর্জন সম্ভব।      

বন্দরবার্তা:

সাগরলালিত নদীবিধৌত বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মের মধ্যে নৌচেতনা ছড়িয়ে দিতে কী ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ গ্রহণের চলমান কার্যক্রম ও আগামী পরিকল্পনা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের?

সচিব: 

আগামী দিনের অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি খাত হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে মেরিটাইম খাত। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের মধ্যে নৌচেতনা গড়ে তুলতে বহুমাত্রিক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি আমরা। আমাদের নাবিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট আইএসও ৯০০১ : ২০০৮ স্বীকৃতি পেয়েছে দুই বছর আগে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমি থেকে ৫০ তম ব্যাচের স্নাতক সম্পন্ন হলো এ বছর। এখান থেকে ইতোমধ্যেই উত্তীর্ণ হয়ে বেরিয়ে দেশ-বিদেশে সুনামের সাথে কাজ করছে চার হাজারের ওপর মেধাবী তরুণ। নৌখাতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার আকাঙ্খায় আরও চারটি মেরিন একাডেমি গড়ে তোলা হচ্ছে। সমুদ্র অর্থনীতির বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমুদ্রবিজ্ঞান বিষয়টিকে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। 

বন্দরবার্তা:

অনেক তথ্য জানা গেল। আমাদের মূল্যবান সময়টুকু দেয়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।

সচিব: 

আপনার মাধ্যমে বন্দরবার্তা এবং তার পাঠকদেরও আমার পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।

জীবনীসংক্ষেপ:

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব জনাব অশোক মধাব রায় বিসিএস (প্রশাসন) ১৯৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তা। ১৯৫৭ সালে হবিগঞ্জে জন্ম, ১৯৭৩ সালে শায়েস্তাগঞ্জ হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৭৫ সালে হবিগঞ্জ বৃন্দাবন সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি (অনার্স) এবং এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। টাঙ্গাইল জেলায় সহকারী কমিশনার হিসাবে চাকুরিজীবন শুরু করেন। ২০০৯ সালে যুগ্মসচিব এবং ২০১২ সালে সরকারের অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পান। ২০১৫ সালের ৩ ডিসেম্বর নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। এর আগে তিনি স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) পদে কর্মরত ছিলেন। বিভিন্ন সরকারি সফরে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড সফর করেছেন। তিনি বিবাহিত এবং এক পুত্র সন্তানের জনক।