বন্দরে আধুনিক স্পোর্টস কমপ্লেক্স

চট্টগ্রাম বন্দর হলো নগরের ভেতর আরেক নগর। বন্দরের অবকাঠামোর বাইরে কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার জন্য রয়েছে সকল নাগরিক সুবিধা। থাকার জন্য বাসাবাড়ি, ছেলে মেয়েদের পড়ালেখার জন্য স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা আর চিকিৎসার জন্য রয়েছে আধুনিক হাসপাতাল। সেখানে খেলাধুলার ব্যবস্থা থাকবেনা তা কি করে হয়। শিশু-কিশোরদের নিয়মিত ক্রীড়া চর্চার মাধ্যমে মানসিকভাবে উৎফুল্ল ও সুস্থ-সবল রাখার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক স্পোর্টস কমপ্লেক্স। রয়েছে আধুনিক সুযোগ সুবিধাসহ ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, বাস্কেটবল ও দাবা প্রশিক্ষণের সুযোগ। যা চট্টগ্রাম থেকে জাতীয় পর্যায়ের ক্রীড়াবিদ তৈরির প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে বলে সংশ্লিষ্ট সকলের আশা।

বন্দর স্পোর্টস কমপ্লেক্সের যাত্রা শুরু হয় ২০১৫ সালে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তৎকালীন চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ এর ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেন। পরবর্তী বছর অর্থ্যাৎ ২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করেন নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান এমপি।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানেরা ছাড়াও ক্রীড়া অনুরাগী অন্য শিশু-কিশোররাও প্রশিক্ষণ নিতে পারেন এখানে। বয়স ও শ্রেণিভেদে শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা প্রশিক্ষণের সুযোগ। ১ম থেকে ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী আর ৬ষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পৃথকভাবে প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে। প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য রয়েছে ২৪ হাজার বর্গফুটের আউটডোর ও ২২ হাজার বর্গফুটের ইনডোর স্পোর্টস জোন। আউটডোরে প্রাথমিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা ক্রিকেট ও ফুটবল অনুশীলন করে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা অনুশীলন করে কমপ্লেক্সের সাথে লাগোয়া বন্দর স্টেডিয়ামে। ক্রিকেট ও ফুটবল অনুশীলনের জন্য স্টেডিয়ামে নির্ধারণ করা আছে আলাদা আলাদা জায়গা।

স্পোর্টস কমপ্লেক্সের ইনডোর জোন একদিকে যেমন দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা হয়েছে, তেমনি সমৃদ্ধ আধুনিক সব ক্রীড়া সরঞ্জামে। এখানে রয়েছে দুটি করে টেবিল টেনিস ও ব্যাডমিন্টন কোর্ট এবং একটি করে বাস্কেট বল ও ভলিবল কোর্ট। এছাড়াও রয়েছে ক্রিকেট অনুশীলনের জন্য আন্তর্জাতিক মানের কৃত্রিম টার্ফ। যেখানে আন্তর্জাতিক ম্যাচে অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়রাও স্বাচ্ছন্দ্যেই অনুশীলন করতে পারবে। প্রশিক্ষণার্থীরা ছাড়াও বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সন্ধ্যার পর কমপ্লেক্সে খেলাধুলা করতে পারেন।

ক্রীড়া সরঞ্জামের পাশাপাশি অন্যান্য সকল সুযোগ সুবিধা রয়েছে ইনডোর জোনে। জোনের একপাশে তিনতলা ভবনের নীচতলায় রয়েছে ছেলে ও মেয়েদের জন্য পৃথক ড্রেসিং রুম। রয়েছে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ও আধুনিক সরঞ্জাম সমৃদ্ধ ব্যায়ামাগার। যা শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তাদের অভিভাবকরাও ব্যবহার করতে পারেন। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে শিক্ষার্থীদের পাঠদান কক্ষ, সভা কক্ষ, প্রধান উপদেষ্টা, পরিচালক, উপ-পরিচালক, দাবা প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত কক্ষসমূহ। তৃতীয় তলা ব্যবহৃত হয় অভিভাবক সমাবেশ ও সেমিনার আয়োজনে, যেখানে আগামীতে কারাতে প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা রয়েছে।

স্পোর্টস কমপ্লেক্স শুধু শিক্ষার্থীদের দক্ষ ক্রীড়াবিদ হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছে এমন নয়। ক্রীড়া চর্চার বাইরে নিয়মিত মনিটরিং করছে স্বাস্থ্য ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য স্পোর্টস কমপ্লেক্স কার্যালয়ের একটি কক্ষে রয়েছে উন্নতমানের হালকা খাবার ও কোমল পানীয়ের ব্যবস্থা। অপরকক্ষে রয়েছে হিট স্ট্রোক এন্ড ট্রমা সেন্টার, যেখানে যাবতীয় ওষুধসহ সকল চিকিৎসা সেবা মেলে। অনুশীলনের সময় কেউ আঘাতপ্রাপ্ত হলে চিকিৎসা দিতে রয়েছেন স্পোর্টস মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। প্রশিক্ষণার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমে যাতে কোনো ব্যঘাত না ঘটে সেজন্য প্রতিদিন বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ও সপ্তাহে তিন দিন করে (শনি, সোম, বুধ ও রবি, মঙ্গল, বৃহস্পতি) দুই শিফটে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণার্থীদের প্রত্যেক একাডেমিক পরীক্ষার ফলাফল বিবরণী জমা দিতে হয় কমপ্লেক্সে। ফলাফল বিবেচনায় তা নেতিবাচক হলে ছয় মাস পর্যন্ত প্রশিক্ষণ থেকে বিরত রাখার বিধান রয়েছে। এছাড়া তাদের খেলাধুলা, পড়ালেখা ও স্বাস্থ্যের উন্নতিকল্পে নিয়মিত অভিভাবক সমাবেশের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ ও নির্দেশনা প্রদান করা হয়।

স্পোর্টস কমপ্লেক্সে ভর্তি হতে নির্দিষ্ট ফর্মে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান পূর্বক আবেদন করতে হয় আগ্রহীদের। এসময় দুই কপি ছবি, জন্ম নিবন্ধন সনদ ও বাবা মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দিতে হয়। যেসব তথ্যের ভিত্তিতে প্রশিক্ষণার্থীদের ব্যক্তিগত অনলাইন প্রোফাইল তৈরি করা হয়। প্রত্যেককে দেয়া হয় পরিচয় পত্র, যা পাঞ্চ করার মাধ্যমে অনুশীলনে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত হয়।

পথচলার দুইবছরে স্পোর্টস কমপ্লেক্সে যুক্ত হয়েছেন জাতীয় পর্যায়ের সুনামধন্য সাবেক ক্রীড়াবিদরা, যাদের হাত ধরে সাফল্যও ধরা দিয়েছে। প্রধান ক্রিকেট কোচ হিসেবে রয়েছেন জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড় আফতাব আহমেদ চৌধুরী ও ফুটবল প্রশিক্ষক হিসেবে রয়েছেন ঢাকা মোহামেডেনের সাবেক খেলোয়াড় জামাল উদ্দিন আহমেদ ফারুক। এছাড়া বাস্কেটবল ও ব্যাডমিন্টনে প্রশিক্ষণেও রয়েছে একজন করে প্রশিক্ষক। কমপ্লেক্সের খেলোয়াড় শাহরিয়ার আলম মাহিম ডাক পেয়েছেন অনূর্ধ্ব-১৪ ক্রিকেট দলের জাতীয় ক্যাম্পে। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপে কিশোরগঞ্জের আজিম উদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন কমপ্লেক্সের প্রশিক্ষণার্থী সানিয়া জাহান রিয়া। যিনি নিজ দলের অধিকাংশ খেলায় ম্যান অব দ্যা ম্যাচ নির্বাচিত হয়েছেন এবং ফাইনালে পুরষ্কার নিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। এছাড়া ক্রিকেটে চট্টগ্রাম জেলা অনূর্ধ্ব-১৪ দলে ১ জন, অনূর্ধ্ব-১৬ তে ২ জন ও অনূর্ধ্ব-১৮ তে ২ জন ডাক পেয়েছেন। চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা (সিজেকেএস) আয়োজিত লীগে বিভিন্ন দলের হয়ে খেলেছেন ১২ জন। ফুটবলে গত বছর সিজেকেএস আয়োজিত কিশোরলীগে অংশ নিয়ে নৈপূণ্যপূর্ণ খেলা প্রদর্শনের সুবাদে ১ জন জেলা দলে ডাক পেয়েছে। এবছর ডাক পেয়েছেন আরো ৩ জন। 

স্বল্প সময়ে সফলতার সাথে ‘চেয়ারম্যান’স কাপ’ শিরোনামে অনূর্ধ্ব-১৫ ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছে স্পোর্টস কমপ্লেক্স। এতে নগরীর আটটি প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেট একাডেমি অংশ নিয়েছে। কমপ্লেক্সের ক্রিকেট দল অংশগ্রহণ করে টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। আগামী বছরের শুরুতে আরো বড় আকারে অনূর্ধ্ব-১২ ও অনূর্ধ্ব-১৫ ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করতে যাচ্ছে স্পোর্টস কমপ্লেক্স।

স্পোর্টস কমপ্লেক্সকে আরো আধুনিক ও কলেবর বাড়াতে বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম খালেদ ইকবালের নির্দেশনায় বাস্কেটবল গ্রাউন্ড, লন টেনিস ও সুইমিং পুল তৈরির পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এছাড়া ক্রিকেট অনুশীলন ব্যবস্থা আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে ইংল্যান্ড থেকে আনা হচ্ছে বোলিং মেশিন। আগামীতে এ অঞ্চলে ক্রীড়া চর্চা ও ক্রীড়াবিদ তৈরির সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম হবে বন্দর স্পোর্টস কমপ্লেক্স তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। যে বন্দরকে কেন্দ্র করে বিস্তৃত হয়েছে চট্টগ্রাম শহর, সেই শহরের খেলাধুলা, সংস্কৃতিতে নেতৃত্বের আসনে বন্দরই থাকবে, সেটাই প্রত্যাশা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here