মেরিটাইম ইন্ডাস্ট্রিতে নারী পেশাজীবীদের সংখ্যা এখন আর নগণ্য নয়। ইঞ্জিনরুম সহকারী, অসম সাহসী নাবিকের মতো তৃণমূল থেকে শুরু করে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শিপিং লাইন আর ব্যস্ততম বন্দরের প্রধান নির্বাহী পদে আজকের নারীরা উঠে এসেছেন নিজেদের পরিশ্রম আর যোগ্যতার গুণে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজতক তাঁদের সংখ্যা, ভূমিকা, নারী-পুরুষ অনুপাতবিষয়ক সার্বিক কোনো জরিপ হয়নি। সে অভাব মোচনে নৌপরিবহন এবং সমুদ্রচারী নারীদের অবস্থান সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও) এবং উইমেন ইন্টারন্যাশনাল শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউআইএসটিএ বা উইসটা)।
দেরিতে হলেও এই প্রথম শিপিংয়ের অভিভাবক সংস্থা আইএমও মেরিটাইম সেক্টরে কর্মরত নারীদের নিয়ে কেন্দ্রীয় কোনো জরিপ করছে। ‘উইমেন ইন মেরিটাইম-আইএমও অ্যান্ড উইসটা ইন্টারন্যাশনাল সার্ভে-২০২১’ শীর্ষক এ জরিপে ইন্ডাস্ট্রিতে নারীদের সংখ্যা, নারী-পুরুষ অনুপাত, কোন পদে তাঁদের অংশগ্রহণ কত, কোন ধরনের পদে তাঁরা তুলনামূলক পিছিয়ে আছেন, প্রতিষ্ঠান-দেশ-মহাদেশভিত্তিক সুযোগ-সুবিধা-অগ্রগতি-বৈষম্যের একটা সার্বিক চিত্র পাওয়া যাবে।
টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মেরিটাইম ইন্ডাস্ট্রিতে কীভাবে আরও বৈচিত্র্যময় জনশক্তি গড়ে তোলা যায়, সে জন্য বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এ সকল কার্যাবলির অংশ হিসেবে আয়োজিত এ জরিপে বৈচিত্র্য এবং লৈঙ্গিক সাম্য অর্জনে কতখানি এগোনো গেল, সেটাও পরিষ্কার বোঝা যাবে। উইসটা ইন্টারন্যাশনাল একটি অলাভজনক সংস্থা, যেটি মেরিটাইম ইন্ডাস্ট্রির তৃণমূলের পাশাপাশি নীতিনির্ধারণী এবং ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে। ১৯৭৮ সালে উইসটা ইন্টারন্যাশনালের জন্মের পর শুধু শিপিং নয়, সকল শিল্প খাতের নারীদের এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিশ^ব্যাপী নারী নির্বাহী এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সংস্থা হিসেবে বেশকিছু জোরালো পদক্ষেপ নিয়ে দ্রুতই কর্মজীবী নারীদের জন্য সর্বোচ্চ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ স্থানে উঠে আসে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে সকল ধরনের শিল্প ও বাণিজ্য খাত মিলিয়ে ৫৪ দেশের ৩ হাজার ৯০০-এরও বেশি নারী পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্ব করে এ সংগঠন।
মেরিটাইম খাতে বৈচিত্র্য আনয়ন এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে ২০২০ সালে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল আইএমও এবং উইসটা ইন্টারন্যাশনাল। নৌপরিবহন শিল্পের অপারেশন, বাণিজ্যিক এবং লজিস্টিক সেক্টরে নারীদের সমর্থন ও এ পেশাকে পুরুষের তুলনায় অধিকতর পরিবারকেন্দ্রিক নারীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলাই ছিল এ চুক্তির মূল উদ্দেশ্য। সে জন্য একটি পদ্ধতিগত কাঠামো দাঁড় করাতে হবে সবার আগে, আর তারই অংশ হিসেবে জরিপ শুরু হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে আইএমও মহাসচিব কিতাক লিম বলেন, যেকোনো ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো বৈচিত্র্য। সমাজের অর্ধেক অংশকে ক্ষমতায়িত করা গেলে যেমন অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হয়, তেমনি সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের পথে উঠে আসে রাষ্ট্র। মেরিটাইম সেক্টরের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীরা উঠে এলে আগের চেয়ে অনেক বেশি টেকসই উন্নয়ন দেখবে এ খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল শ্রেণির পেশাজীবী।
উইসটা ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট ডেসপিনা পানাইতোউ থিওডোসিউর মতে, যেকোনো উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ বা নীতি প্রণয়নের আগে এ ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য তথ্য থাকতে হবে। চরমভাবে পুরুষ শাসিত এ ইন্ডাস্ট্রির কোন কোন দিকে বেশি নজর দেওয়া প্রয়োজন তার একটি পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যাবে জরিপ করা হলে। গৃহীত পদক্ষেপ ও উন্নয়ন উদ্যোগকে সার্বিকভাবে ফলপ্রসূ করতে হলে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ শুরু করতে হবে এই জরিপ থেকেই। দুটি প্রভাবশালী বৈশি^ক সংস্থা এখানে যুক্ত থাকায় জরিপে অংশগ্রহণের হার, মেরিটাইম বিশ্ব গ্রহণযোগ্যতা বেশি পাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
২০১৯ সালে আইএমও সাধারণ সভায় গৃহীত রেজল্যুশন এ. ১১৪৭(৩১) অনুযায়ী মেরিটাইম সেক্টরে নারীর উপযুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় সদস্য দেশগুলো। এরই পথ ধরে পরের বছরের মেরিটাইম বর্ষের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয় ‘মেরিটাইম বিশে^ নারীর ক্ষমতায়ন’। জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) লক্ষ্য অর্জনের অন্যতম সহায়ক যে লিঙ্গসাম্য, অন্তত মেরিটাইম ইন্ডাস্ট্রিতে সেটি নিশ্চিত করার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে হবে এ জরিপ। এ ছাড়া জাতিসংঘ ঘোষিত জেন্ডার ইকুয়ালিটিবিষয়ক এসডিজি ফাইভ, সুষম শ্রমবণ্টনের এসডিজি এইট এবং অংশগ্রহণভিত্তিক এসডিজি সতেরো অর্জনেও সহায়ক হবে এ জরিপ।
আন্তর্জাতিক মেরিটাইম সংস্থার সকল সদস্য রাষ্ট্র ও সরকারি-স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, মেরিটাইম সেক্টরে কর্মরত পাবলিক এবং প্রাইভেট কোম্পানি, মেরিটাইম প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে আইএমও-উইসটা ইন্টারন্যাশনাল সার্ভে। তবে সদস্য দেশ এবং মেরিটাইম শিল্পের সাথে যুক্ত প্রতিষ্ঠান দুটি ভিন্ন ক্যাটাগরিতে জরিপে অংশ নিতে পারবে।
সুষ্ঠুভাবে জরিপ সম্পন্ন ও বিশ্লেষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ডাটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান আইএইচএস মারকিটকে। বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতি তিন বছরে একবার সার্ভের তথ্য হালনাগাদ করা হবে। এবারের জন্য প্রাথমিকভাবে জরিপে অংশগ্রহণ করার শেষ সময় ৩০ জুন ২০২১ পর্যন্ত থাকলেও তা ৩০ জুলাই পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয়েছে।