সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, দক্ষতা আর প্রযুক্তিগত উন্নয়ন চট্টগ্রাম বন্দরকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে লক্ষ্য অর্জনের দিকে

মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট খাতকে সর্বোতভাবে টেকসই করে গড়ে তুলতে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পোর্ট কল অপটিমাইজেশনের ওপর বেশ জোর দেওয়া হচ্ছে। জাহাজগুলোকে যাত্রাপথে প্রয়োজনের খাতিরেই বিভিন্ন বন্দরে যাত্রাবিরতি দিতে হয়। কখনো শিডিউলের মধ্যে থেকে, আবার কখনো পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে। আবার বন্দরগুলোকেও একই সময়ে একাধিক জাহাজকে সেবা দিতে হয়। ফলে অনেক সময় দেখা যায়, ব্যস্ত বন্দরগুলোয় জাহাজের অপেক্ষমাণ থাকার সময়টা দীর্ঘতর হচ্ছে। এই সমস্যা নিরসনে পথ দেখাচ্ছে পোর্ট কল অপটিমাইজেশন। এটি শিপিং কোম্পানি, টার্মিনাল ও অন্য সেবাদানকারীদের পরিবেশগত বিরূপ প্রভাব কমানো এবং সুরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা উন্নতকরণের সুযোগ করে দেয়।

প্রথাগতভাবে এতদিন বন্দরগুলোয় ‘আগে আসলে আগে সেবা’ মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে সেবা দেওয়া হলেও এখন বিভিন্ন বন্দর কর্তৃপক্ষ পূর্বপ্রতিশ্রুত সময়ে সেবা প্রদানের নীতিতে হাঁটতে চাইছে। আর এই যুগান্তকারী পরিবর্তনের পরিকল্পনা সাজাতে বন্দর কর্তৃপক্ষগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ লাইফ লাইন হিসেবে কাজ করছে আগে থেকে অনুমান করার সক্ষমতা। পোর্ট কল অপটিমাইজেশনের একটি বড় সুবিধাই হলো প্রেডিক্টেবিলিটি বা অনুমেয়তা বৃদ্ধি, যা শিপিং কোম্পানিগুলোর শিডিউলিং ও প্ল্যানিংয়ে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। আর পোর্ট কল অপটিমাইজেশনের সাফল্য নির্ভর করে বন্দরের তথ্য ব্যবস্থাপনার ওপর। পোর্ট কল অপটিমাইজেশন ও কার্যকর তথ্য ব্যবস্থাপনা নিয়েই আমাদের এবারের মূল আয়োজন।

বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির চাহিদা পূরণে চট্টগ্রাম বন্দরকে প্রতিনিয়তই নিজের দক্ষতার পরিচয় দিতে হচ্ছে, বাড়াতে হচ্ছে সক্ষমতা। জনবলের সর্বোত্তম ব্যবহার আর প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হচ্ছে। সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, দক্ষতা আর প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জনের একাগ্রতা চট্টগ্রাম বন্দরকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ২০২০ সালের লয়েড’স লিস্টে চট্টগ্রাম বন্দর বিশ্বের শত ব্যস্ত বন্দরের মধ্যে ৫৮তম অবস্থানে রয়েছে। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়েও নতুন নতুন মাইলফলক পেরিয়ে যাচ্ছে। অতিমারির মতো বৈশ্বক সংকটকালেও থেমে থাকেনি বন্দরের অগ্রযাত্রা। বিগত ২০২০-২১ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর কনটেইনার, কার্গো ও জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের তিনটি সূচকেই প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। নানা সীমাবদ্ধতা নিয়েও এই সফলতা এমনি এমনি আসেনি, এর পেছনে রয়েছে একটি সুনির্দিষ্ট ও সুবিন্যস্ত কর্মপরিকল্পনা, তার যথাযথ বাস্তবায়ন এবং বন্দরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। আর এই কাজটিই করছে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি বা অ্যানুয়াল পারফরম্যান্স এগ্রিমেন্ট (এপিএ)।

সরকারি দপ্তর বা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি, ফলাফলধর্মী কাজে উৎসাহ প্রদান এবং কর্মদক্ষতা মূল্যায়নের মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কার্যসম্পাদন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির আওতায় এপিএ প্রবর্তন করে সরকার। প্রতিষ্ঠানের রূপকল্প, অভিলক্ষ্য ও কৌশলগত উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন এপিএর অগ্রাধিকারে থাকে। চট্টগ্রাম বন্দরের কৌশলগত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে যেসব বিষয়কে এপিএতে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, তার মধ্যে অন্যতম রূপকল্প-২০৪১, ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ ও এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা। মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ মনিটরিং ও কর্তৃপক্ষের নিরলস প্রচেষ্টায় সর্বশেষ অর্থবছরে (২০২০-২১) এপিএর ৭টি পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্য শতভাগ অর্জন করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এগুলো হলো সংরক্ষণ ড্রেজিং, কার্গো হ্যান্ডলিং, কনটেইনার হ্যান্ডলিং, ৩০ হাজার বর্গমিটার নতুন কনটেইনার ইয়ার্ড নির্মাণ, সার্ভিস জেটি নির্মাণ, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প। বিগত বছরগুলোতেও এপিএর লক্ষ্যমাত্রা পূরণের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর আধুনিক ও যুগোপযোগী হওয়ার চলমান প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে। পাশাপাশি ডিজিটাল ব্যবস্থা প্রচলন করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং দক্ষতা বাড়ানোও সম্ভব হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি নিয়ে বিস্তারিত রয়েছে বিশেষ রচনায়।

দেরিতে হলেও এই প্রথম শিপিংয়ের অভিভাবক সংস্থা আইএমও মেরিটাইম সেক্টরে কর্মরত নারীদের নিয়ে কেন্দ্রীয় কোনো জরিপ করছে। ‘উইমেন ইন মেরিটাইম-আইএমও অ্যান্ড উইসটা ইন্টারন্যাশনাল সার্ভে-২০২১’ শীর্ষক এ জরিপে ইন্ডাস্ট্রিতে নারীদের সংখ্যা, নারী-পুরুষ অনুপাত, কোন পদে তাঁদের অংশগ্রহণ কত, কোন ধরনের পদে তাঁরা তুলনামূলক পিছিয়ে আছেন, প্রতিষ্ঠান-দেশ-মহাদেশভিত্তিক সুযোগ-সুবিধা-অগ্রগতি-বৈষম্যের একটা সার্বিক চিত্র পাওয়া যাবে। টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মেরিটাইম ইন্ডাস্ট্রিতে কীভাবে আরও বৈচিত্র্যময় জনশক্তি গড়ে তোলা যায়, সে জন্য বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এ সকল কার্যাবলির অংশ হিসেবে আয়োজিত এ জরিপে বৈচিত্র্য এবং লৈঙ্গিক সাম্য অর্জনে কতখানি এগোনো গেল, সেটাও পরিষ্কার বোঝা যাবে। ‘অন্য আলো’ বিভাগে এ নিয়ে রয়েছে বিশেষ প্রতিবেদন।

প্রিয় পাঠক, আমরা চাই এ দেশের মেরিটাইম চর্চাকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে। বৈচিত্র্যময় আঙ্গিকে, সমৃদ্ধ কলেবরে বন্দরবার্তার পথচলা বাংলাদেশের মেরিটাইম খাতের বিকাশে আরও সহায়ক হবে- সেই প্রত্যাশা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here