বিশ্ববাণিজ্যে আজ প্রতিষ্ঠিত এক পরাশক্তি চীন। যত দিন যাচ্ছে, দেশটির আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিসর ততই বাড়ছে। এই ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যের স্বার্থেই দেশটিকে সমুদ্রবন্দর অবকাঠামো গড়ে তোলার দিকে নজর দিতে হচ্ছে। এই প্রচেষ্টারই ফসল শেনঝেন বন্দর।
এটি কিন্তু একক কোনো বন্দর নয়। বরং চীনের গুয়াংডং প্রদেশের শেনঝেন উপকূলজুড়ে বিস্তৃত ছোট-বড় কয়েকটি বন্দর নিয়ে এটি গড়ে উঠেছে। প্রকৃত অর্থে একে একটি বন্দর নেটওয়ার্ক বলা চলে। এর অধীনে ডা চ্যান বে, শিকাউ, চিওয়ান, মাওয়ান, ইয়ানতিয়ান, ডংজিয়াওতোউ, ফুইয়ং, শিয়াডং, শায়ুচোং ও নেইহে-তে বন্দর অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে।
পোর্ট অব শেনঝেনের বয়স খুব বেশি নয়। এর যাত্রা ১৯৮০ সালে। এটি গড়ে তুলতে ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার কোটি ইউয়ান (প্রায় ৯০০ কোটি ডলার)। গত ৩০ বছরে চীনের পরিবহন অবকাঠামো, বিদেশি বিনিয়োগ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সুসংহত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে শেনঝেন পোর্ট লজিস্টিকস।
তিন দশকে চীনের বৃহত্তম বন্দরগুলোর একটি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে শেনঝেন বন্দর। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় দেশের গি- পেরিয়ে বিশ্বের ব্যস্ততম বন্দরের তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছে বন্দরটি। টিইইউ (টোয়েন্টি ফুট ইকুইভ্যালেন্ট) হ্যান্ডলিংয়ের বিচারে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম কনটেইনার পোর্ট এটি।
শেনঝেন প্রায় ৪০টি শিপিং কোম্পানির হোমপোর্ট। মাসিক ভিত্তিতে এই বন্দরে ৫৬০টি জাহাজ নিয়মিত পোর্ট কল দিয়ে থাকে। এছাড়া পার্ল রিভার ডেল্টা অঞ্চলে আরও ২১টি ফিডার রুটে কার্গো পরিবহন করা হয় এই বন্দর থেকে। এই পার্ল রিভার ডেল্টা অঞ্চলের দক্ষিণাংশেই শেনঝেন বন্দরেরর অবস্থান। ২৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলজুড়ে বিস্তৃত এই বন্দর নেটওয়ার্ককে পূর্ব ও পশ্চিম-এই দুই অংশে ভাগ করেছে কোওলুন পেনিনসুলা।
বিশ্বের শতাধিক দেশের ৩০০টির বেশি বন্দরের সঙ্গে সমুদ্রপথে সংযুক্ত রয়েছে শেনঝেন বন্দর। ২৩০টি আন্তর্জাতিক কনটেইনার রুট এই বন্দর হয়ে গেছে। বন্দরের শিকাউ প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল থেকে হংকং, ম্যাকাউ ও ঝুহাইয়ের পথে দ্রুতগতির ফেরি চলাচল করে।
শেনঝেন বন্দরে সম্মিলিতভাবে ১৭০টির বেশি বার্থ রয়েছে। এর মধ্যে ৬৯টি বার্থের কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা অন্তত ১ লাখ টন। কনটেইনারবাহী জাহাজের জন্য রয়েছে ৪৪টি বার্থ। যাত্রীবাহী ফেরি বার্থ রয়েছে ১৮টি। নন-প্রডাকশন বার্থ রয়েছে ২৩টি। বন্দরটির বার্ষিক ট্রান্সশিপমেন্ট সক্ষমতা প্রায় ১৯ কোটি ৫০ লাখ টন ও ১ কোটি ৯০ লাখ টিইইউ কনটেইনার। বন্দরটিতে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
শেনঝেনের কনটেইনার টার্মিনালগুলোর মধ্যে ইয়ানতিয়ান ইন্টারন্যাশনাল কনটেইনার টার্মিনাল, চিওয়ান কনটেইনার টার্মিনাল, শিকাউ কনটেইনার টার্মিনাল অন্যতম। এছাড়া এই বন্দর নেটওয়ার্কের অধীনে রয়েছে চায়না মার্চেন্ট পোর্ট টার্মিনাল ও শেনঝেন হেইশিং টার্মিনাল। চিওয়ান ও শিকাউ টার্মিনালের অবস্থান বন্দরের পশ্চিম অংশে। আর শেনঝেনের ব্যস্ততম ইয়ানতিয়ান টার্মিনালের অবস্থান পূর্ব অংশে।
শেনঝেনের বিভিন্ন বন্দর ও টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে শেনঝেন ইয়ানতিয়ান পোর্ট হোল্ডিংস, শেনঝেন চিওয়ান হোয়ারফ হোল্ডিংসসহ আরও কয়েকটি অপারেটর। চায়না ট্রান্সপোর্টেশন হাব, কনটেইনার হাব, এইচপিএইচ গ্রুপ, চায়না মার্চেন্ট, হোয়ারফ ও মায়েরস্কের বিনিয়োগ রয়েছে এই বন্দরে। শেনঝেনে রয়েছে শতাধিক ওয়্যারহাউস অপারেটর। দুই হাজারের বেশি ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি এই বন্দরের গ্রাহকদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
চীনের উপকূলীয় পরিবহন ব্যবস্থা ও হংকংয়ের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দর নেটওয়ার্ক হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে শেনঝেনকে। বিশ্বমানের, আধুনিক, নিরাপদ, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব বন্দর হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এরই মধ্যে বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সেখানে নতুন ছয়টি বন্দর নির্মাণ করা হবে, যেগুলোর মাধ্যমে শেনঝেনের সঙ্গে হংকংয়ের কানেক্টিভিটি আরও বাড়বে।