সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচনকারী সাহিবগঞ্জ এমএমটি

রাইন নদীর উপনদী নিউয়ে মাসের তীরে অবস্থিত রটারডামকে বলা হয় ইউরোপের গেটওয়ে। আন্তঃসীমান্তীয় নদী হওয়ায় জলপথ পণ্য পরিবহনে নিউয়ে মাস ও রাইনের রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব। অভ্যন্তরীণ নদীপথের সঙ্গে যুক্ত থাকায় ইউরোপের পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের প্রাণভোমরা হিসেবে কাজ করে নেদারল্যান্ডসের রটারডাম বন্দর।

রাইনের সঙ্গে মিল রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার আরেকটি আন্তঃসীমান্তীয় নদীর। সেটি হলো গঙ্গা। আর এই নদীর তীরে অবস্থিত সাহেবগঞ্জের ভৌগোলিক অবস্থানগত গুরুত্বও অনেকটা রটারডামের মতো। কৌশলগত কারণে ভারত, নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশের মধ্যে পণ্য, জ্বালানি ইত্যাদি পরিবহনে ট্রানজিট হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সব সম্ভাবনা রয়েছে সাহিবগঞ্জ বন্দরের। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতেই সেখানে গড়ে তুলেছে একটি মাল্টিমোডাল টার্মিনাল (এমএমটি)।

মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটি কী?

সাধারণ অর্থে মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটি হলো যোগাযোগের একাধিক মাধ্যমের সম্মিলন। মাল্টিমোডাল হাব বলা হয় সেই জায়গাকে, যেখানে সড়ক, রেল, জল ও আকাশপথ-এগুলোর মধ্যে একাধিক উপায়ে যোগাযোগের ব্যবস্থা রয়েছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের ওপর চাপ বেড়েছে। অনেক সময় জাহাজ-সংকটে রপ্তানিমুখী পণ্যকে দিনের পর দিন বন্দরে পড়ে থাকতে হয়। আবার আমদানীকৃত পণ্য বন্দরে এসে পৌঁছালেও সেখান থেকে অভ্যন্তরীণ গন্তব্যে সেগুলো পরিবহনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের জটিলতায় পড়তে হয়। এ কারণে কেবল সমুদ্র ও জাহাজের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে এখন আর চলছে না। খাতসংশ্লিষ্টদের এখন চিন্তা করতে হচ্ছে কীভাবে আরও স্বল্প সময়ে ও স্বল্প খরচে গ্রাহকদের অভীষ্ট গন্তব্যে পণ্য পৌঁছে দেওয়া যায়।

এমন কিছু শিপিং রুট রয়েছে, যেখানে সমুদ্রপথে পণ্য পাঠাতে অনেকটা পথ ঘুরে যেতে হয়। এ কারণে সময় ও খরচ দুটোই বেশি লাগে। অথচ স্থলপথে, বিশেষ করে রেলপথে পণ্য পাঠাতে পারলে সময় ও ব্যয় সাশ্রয় হয়। এই তাড়না থেকেই চীন ও ইউরোপের মধ্যে গড়ে উঠেছে একাধিক ফ্রেইট রেলওয়ে নেটওয়ার্ক। চীন থেকে সুয়েজ খাল হয়ে ঘুরে ইউরোপে সমুদ্রপথে পণ্য পাঠাতে সময় লাগে এক থেকে দেড় মাস। ইউরেশিয়া হয়ে রেলপথে ১২ হাজার কিলোমিটার দূরত্বে পণ্য পাঠাতে সময় লাগে এর চেয়ে বেশ কম। এজন্য এখন অনেক শিপিং লাইনই এই রেল নেটওয়ার্কটিকে বেছে নিচ্ছে চীন থেকে ইউরোপে পণ্য পরিবহনের জন্য।

এমন অনেক অঞ্চল ও দেশ রয়েছে, যেখানে সমুদ্র অথবা নদীপথে সরাসরি যাওয়ার কোনো উপায় নেই। এসব জায়গায় পণ্য পৌঁছানোর জন্য নিকটবর্তী একটি ট্রানজিট পয়েন্ট থাকা দরকার। সমুদ্রপথে পণ্য এসে প্রথমে সেখানে খালাস হবে। পরবর্তীতে সড়ক বা রেলপথে পণ্যগুলো নির্দিষ্ট গন্তব্যে পাঠানো হবে। আবার কিছু জায়গায় নদীপথে পণ্য পরিবহনের উপায় থাকলেও বড় কোনো মাদার ভেসেল সেই পথে চলাচল করতে পারে না। ফলে এসব জায়গায় ছোট ফিডার ভেসেলে করে পণ্য পাঠাতে হয়। এসব কারণে একটি সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে সড়ক, রেল ও অভ্যন্তরীণ নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকা একান্ত জরুরি।

বিবিআইএন মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটি

দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় চারটি দেশ বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের মধ্যে বাণিজ্যে গতি আনার লক্ষ্যে বিবিআইএন উদ্যোগ নেওয়া হলেও দেশগুলোর মধ্যকার বাণিজ্যপ্রবাহকে ঠিক মসৃণ বলা যাবে না। কারণ এসব দেশের মধ্যে পণ্য পরিবহনে লজিস্টিকস ব্যয় অনেক বেশি পড়ে যায়। কারণ এই পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা অনেকটাই সড়ক নেটওয়ার্ক-নির্ভর, যা অনেক বেশি ব্যয়বহুল। অথচ এই অঞ্চলে নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল।

একটু দেরিতে হলেও বিবিআইএন দেশগুলোর সরকার এই গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছে। তারা বেশ কয়েকটি জলপথকে পুনরায় সচল করা ও পণ্য পরিবহনের চাপ সড়ক থেকে জলপথে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।

এ কথা প্রমাণিত যে, পরিবহনের জন্য জলপথ সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব একটি মাধ্যম। কিছু ক্ষেত্রে তা অন্যান্য মাধ্যমের চেয়ে বাড়তি সুবিধাও দিয়ে থাকে। নৌ-পরিবহন আঞ্চলিক লজিস্টিকস কার্যকারিতা বাড়ানোর ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে এসব সুবিধা পাওয়ার জন্য কিছু অবকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। বিশেষ করে মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটি গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। এতে করে একটি মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে ফ্রেইট মুভমেন্ট ও ট্রান্সফার সহজতর হয়। যেমন নদীপথে পণ্য এনে একটি মাল্টিমোডাল হাবে খালাস করে সেটি সড়ক বা রেল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নিকটবর্তী বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ গন্তবে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। আবার বিভিন্ন উৎস থেকে শিল্পোৎপাদিত অথবা খনিজ পণ্য সড়ক বা রেলপথে ট্রানজিট হাবে এনে সেখান থেকে নৌপথে অভীষ্ট গন্তব্যে পরিবহন করা যায়।

বিবিআইএন দেশগুলো এই মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটি ও ট্রানজিট হাব ব্যবস্থা কার্যকরভাবে গড়ে তুলতে পারলে তাদের মধ্যে আন্তঃবাণিজ্য আরও বেগবান হবে। আর এই কার্যক্রমের ফলে যে কর্মসংস্থান তৈরি হবে, তাতে আঞ্চলিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পালেও হাওয়া লাগবে।

অভ্যন্তরীণ জলপথের বিকাশে নজর ভারতের

যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য কার্যকর পরিবহন ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের চলাচলযোগ্য প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার অভ্যন্তরীণ নৌপথ পরিবহন খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমি অধিগ্রহণের চ্যালেঞ্জ, সড়ক অবকাঠামো নির্মাণের ক্রমবর্ধমান ব্যয়সহ বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে নরেন্দ্র মোদির কেন্দ্রীয় সরকার অভ্যন্তরীণ নৌপথের সম্ভাব্যতাকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

ন্যাশনাল ওয়াটারওয়েজ অ্যাক্ট, ২০১৬-এর অধীনে মোট ১১১টি অভ্যন্তরীণ নৌপথকে ‘জাতীয় নৌপথ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে মোদি প্রশাসন। সরকারের উদ্দেশ্য ভারতের অভ্যন্তরীণ জলপথকে অর্থনীতি ও পরিবেশবান্ধব এবং রেল ও সড়ক পরিবহনের পরিপূরক মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।

ভারতে আগে থেকে পাঁচটি জাতীয় জলপথ ছিল। এর সঙ্গে ২০১৬ সালে আরও ১০৬টি নৌপথকে জাতীয় জলপথ হিসেবে প্রস্তাব করা হয়। এর মধ্যে ১৩টি জাতীয় নৌপথ বর্তমানে শিপিং ও নেভিগেশনের জন্য চালু রয়েছে। সেগুলো হলো:

● জাতীয় জলপথ ১: গঙ্গা-ভাগীরথী-হুগলি নদী ব্যবস্থা (হলদিয়া-এলাহাবাদ)

● জাতীয় জলপথ ২: ব্রহ্মপুত্র নদী (ধুবড়ি-সাদিয়া)

● জাতীয় জলপথ ৩: পশ্চিম উপকূল খাল (কোট্টাপুরাম-কোল্লাম), চম্পাকারা ও শিল্পম-ল খাল

● জাতীয় জলপথ ৪ ফেজ ওয়ান: কৃষ্ণা নদীর বিজয়ওয়াড়া থেকে মুক্তিয়াল পর্যন্ত সম্প্রসারিত

● জাতীয় জলপথ ১০: আম্বা নদী

● জাতীয় জলপথ ৬৮: মান্দোভি-উসগাঁও সেতু থেকে আরব সাগর পর্যন্ত ৪১ কিলোমিটার বিস্তৃত

● জাতীয় জলপথ ৭৩: নর্মদা নদী

● জাতীয় জলপথ ৮৩: রাজপুরী ক্রিক

● জাতীয় জলপথ ৮৫: রেভডান্ডা ক্রিক-কু-লিকা নদী ব্যবস্থা

● জাতীয় জলপথ ৯১: শাস্ত্রী নদী-জয়গড় খাঁড়ি ব্যবস্থা

● জাতীয় জলপথ ৯৭ বা সুন্দরবন জলপথ: নামখানা থেকে পশ্চিমবঙ্গের আথারবাঙ্কি খাল

● জাতীয় জলপথ ১০০: তাপী নদী

● জাতীয় জলপথ ১১১: জুয়ারি-সানভোডেম ব্রিজ থেকে মারমুগাঁও বন্দর পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার বিস্তৃত

এর মধ্যে সাহিবগঞ্জ মাল্টিমোডাল টার্মিনাল জাতীয় জলপথ ১-এর অংশ। এটি অবশ্য বেশ পুরনো; ১৯৮৬ সালে চালু হওয়া একটি ওয়াটারওয়ে। ভারতের গঙ্গা ও তার শাখা ভাগীরথী ও হুগলি নদী ব্যবস্থা নিয়ে গড়ে ওঠা এই জলপথ হলদিয়া থেকে শুরু হয়ে এলাহাবাদ শহর পর্যন্ত চলে গেছে। জাতীয় জলপথ ১ মোট ১৬০০ কিলোমিটার দীর্ঘ। এই জলপথ ভারতের চারটি রাজ্যের মধ্য দিয়ে গেছে। এগুলো হলো পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খ-, বিহার ও উত্তর প্রদেশ। জলপথটিতে মোট ১৮টি টার্মিনাল রয়েছে। হলদিয়া থেকে পাটনা পর্যন্ত পণ্যবাহী বার্জ চলাচল করে। এই জলপথের গভীরতা ৩ মিটার রাখা সম্ভব হলে হলদিয়া থেকে এলাহাবাদ পর্যন্ত দেড় থেকে দুই হাজার টন ধারণক্ষমতার পণ্যবাহী বার্জ চলাচল করা সম্ভব হবে।

সাহিবগঞ্জ এমএমটিতে কনভেয়র বেল্টসহ অত্যাধুনিক সব সরঞ্জাম যুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে টার্মিনালটিতে দেড় থেকে দুই হাজার টন ধারণক্ষমতার দুটি জাহাজ একসঙ্গে বার্থিং করতে পারবে।

ভারতের দ্বিতীয় মাল্টিমোডাল টার্মিনাল

সাহিবগঞ্জ এমএমটির অবস্থান ঝাড়খণ্ডে। ১৮৭ একর জায়গার ওপর নির্মিত টার্মিনালটির প্রথম ফেজ এরই মধ্যে উদ্বোধন করা হয়েছে। এই ফেজের কার্গো হ্যান্ডলিং ক্ষমতা বার্ষিক ৩০ লাখ টন। টার্মিনালটিতে বাল্ক, ব্রেক বাল্ক ও কনটেইনার কার্গো হ্যান্ডলিং করা যায়। বারানসির পর সাহিবগঞ্জ হলো ভারতের দ্বিতীয় মাল্টিমোডাল টার্মিনাল। দুটোই গড়ে তোলা হয়েছে গঙ্গা নদীর তীরে।

ঝাড়খ- কয়লাশিল্পের জন্য বিখ্যাত। আর সাহিবগঞ্জ এমএমটি থেকে কয়লা খনিগুলোর দূরত্বও খুব বেশি নয়। ফলে কয়লাশিল্পের কাঁচামাল সহজে পরিবহনের জন্য টার্মিনালটির ভৌগোলিক অবস্থানগত গুরুত্ব অনেক বেশি। এর পাশাপাশি সার, সিমেন্ট, চিনি, স্টোন চিপ ও খাদ্যশস্য পরিবহনের কাজেও সহায়ক হবে এই টার্মিনাল।

২০১৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাহিবগঞ্জ মাল্টিমোডাল টার্মিনালের প্রথম ফেজের উদ্বোধন করেন। এই ফেজটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে। টার্মিনালের দ্বিতীয় ফেজ চালু হলে এর কার্গো হ্যান্ডলিং-সক্ষমতা বছরে ৫৫ লাখ টনে উন্নীত হবে।

চেন্নাইভিত্তিক কোম্পানি লারসেন অ্যান্ড তুব্রো টার্মিনালটি নির্মাণ করে। এতে ব্যয় হয় ২৯০ কোটি রুপি। সাহিবগঞ্জ এমএমটির সঙ্গে একটি রেল ও নবনির্মিত সড়ক নেটওয়ার্ক যুক্ত রয়েছে।

সাহিবগঞ্জ এমএমটিতে কনভেয়র বেল্টসহ অত্যাধুনিক সব সরঞ্জাম যুক্ত করা হয়েছে। কয়লাশিল্পের জন্য এই টার্মিনালে একটি পৃথক স্টক ইয়ার্ড ও ওয়্যারহাউস রয়েছে। বর্তমানে টার্মিনালটিতে দেড় থেকে দুই হাজার টন ধারণক্ষমতার দুটি জাহাজ একসঙ্গে বার্থিং করতে পারবে।

সাহিবগঞ্জ টার্মিনালের কাছে একটি ফ্রেইট ভিলেজ স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। প্রায় ৩০০ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হবে এই ভিলেজ। সেখানে প্যাকেজিং, ব্যাংকিং, আর্থিক সেবা, জাহাজ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সেবাসহ (যেমন-রিপেয়ারিং) বিস্তৃত পরিসরে ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিসের ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া শিল্প খাত-সংশ্লিষ্টরা এই ফ্রেইট ভিলেজে তাদের ইউনিট স্থাপনের সুযোগ পাবে।

সম্ভাবনার ট্রানজিট হাব

সাহিবগঞ্জ এমএমটির একটি ট্রানজিট হাব হিসেবে আত্মপ্রকাশের সব সম্ভাবনাই রয়েছে। এই টার্মিনাল দিয়ে ঝাড়খ- ও বিহারের শিল্প ও খনিজ পণ্যগুলো পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া হয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় পরিবহন করা সহজ হবে। এছাড়া ইন্দো-নেপাল বাণিজ্যের অধীনে নেপালে কার্গো পরিবহনেও সহায়ক ভূমিকা রাখবে এই টার্মিনাল। 

সাহিবগঞ্জ এমএমটির কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্যই এর সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রথমত, এর অবস্থান এমন জায়গায়, যার কাছাকাছি অনেকগুলো কয়লা ও পাথরের খনি রয়েছে। দ্বিতীয়ত, নেপালমুখী কার্গো খালাসে এই বন্দর সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। প্রথমে হলদিয়া ও কলকাতা থেকে কনটেইনারগুলো এনে সাহেবগঞ্জে খালাস করে পরবর্তীতে সেগুলো নেপালের বিরাটনগর ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোতে (আইসিডি) নেওয়া যেতে পারে।

সাহিবগঞ্জ মাল্টিমোডাল টার্মিনালের প্রথম ফেজের কার্গো হ্যান্ডলিং ক্ষমতা বার্ষিক ৩০ লাখ টন। টার্মিনালের দ্বিতীয় ফেজ চালু হলে এর কার্গো হ্যান্ডলিং-সক্ষমতা বছরে ৫৫ লাখ টনে উন্নীত হবে

রয়েছে চ্যালেঞ্জও

রটারডাম, মুম্বাই কিংবা চেন্নাইয়ের মতো ট্রানজিট হাবগুলো কিন্তু একটি জেলেপল্লি থেকে ধীরে ধীরে বন্দরনগরী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। বহুমুখী উন্নয়ন ছাড়া তাদের পক্ষে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাওয়ার হাউস হয়ে গড়ে ওঠা সম্ভব ছিল না। সাহেবগঞ্জের ক্ষেত্রেও ঠিক একই কথা প্রযোজ্য। ভারতের অন্যতম দরিদ্র একটি শহরকে একটি ট্রানজিট হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ উতরাতে হবে।

এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো দক্ষতা উন্নয়ন। পর্যাপ্ত সংখ্যক দক্ষ কর্মী ছাড়া একটি ইকোনমিক হাব গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আরেকটি যে বিষয়ে কাজ করতে হবে, সেটি হলো যোগাযোগ নেটওয়ার্কের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ।

ইতিবাচক বিষয় হলো, ভারত সরকার তাদের নীতি আয়োগের অধীনে ‘দ্য ট্রান্সফরমেশন অব অ্যাস্পিরেশনাল ডিস্ট্রিক্টস প্রোগ্রাম’ শীর্ষক যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তাতে ২৮টি রাজ্য থেকে বাছাইকৃত ১১৭টি জেলার মধ্যে সাহিবগঞ্জও রয়েছে। এই কর্মসূচির অধীনে বাছাইকৃত জেলাগুলোর দ্রুত উন্নয়নে কাজ করবে সরকার।

বাংলাদেশের জন্যও গুরুত্ববহ

আগেই বলা হয়েছে, সাহিবগঞ্জ এমএমটির মাধ্যমে ঝাড়খ- ও বিহার থেকে হলদিয়া হয়ে বাংলাদেশে সহজেই পণ্য পরিবহন করা যাবে। ফলে ভারত থেকে কয়লা, স্টোন চিপ, সার, খাদ্যশস্য ইত্যাদি আমদানিতে খরচ কমে যাবে।

২০২০ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ট্রানজিট চুক্তির বাস্তবায়ন হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী, চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে নিজেদের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসহ অন্য দেশগুলোয় পণ্য পরিবহন করতে পারবে ভারত। এক্ষেত্রে সাহিবগঞ্জ মাল্টিমোডাল টার্মিনাল গুরুত্বপূর্ণ একটি ট্রানজিট হাব হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।

বাংলাদেশ এরই মধ্যে ভুটানের সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) করেছে। নেপালের সঙ্গেও শিগগির পিটিএ স্বাক্ষর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই দুই দেশে সড়কপথের পাশাপাশি নৌপথেও পণ্য পরিবহন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি ট্রানজিট পয়েন্ট হবে সাহিবগঞ্জ এমএমটি।

অবস্থান ও কৌশলগত কারণে ভারত, নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশের মধ্যে পণ্য, জ্বালানি ইত্যাদি পরিবহনে ট্রানজিট হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সব সম্ভাবনা রয়েছে সাহেবগঞ্জ বন্দরের

উপসংহার

সারা বিশ্বই এখন মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। পরিবহনের কোনো একটি মাধ্যম অকেজো হয়ে পড়লে যেন সাপ্লাই চেইনের ওপর তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া না পড়ে, তা নিশ্চিতকরণে এর বিকল্পও অবশ্য নেই।

প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ভোক্তাচাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে সরবরাহকারীদের মূল্য ও সময়ের বিষয়টি মাথায় রাখতে হয়। ফলে কোন রুটে পণ্য পরিবহন করলে ব্যয় ও সময় কম লাগবে, তা এখন অন্যতম বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটি এক্ষেত্রে সেরা সমাধান দিতে পারে।

ভারতে পণ্য পরিবহনের জন্য অভ্যন্তরীণ জলপথের উন্নয়নে বেশ জোর দিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে নদীকেন্দ্রিক কয়েকটি মাল্টিমোডাল টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে তারা। সাহিবগঞ্জ এমএমটি তারই একটি। তুলনামূলক পিছিয়ে থাকা ঝাড়খ- ও বিহার রাজ্যের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের উন্নয়নে এই টার্মিনাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্লেষকরা আশা করছেন। তবে এই প্রত্যাশা পূরণে টার্মিনালটিকে কিছু বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে উঠতে হবে। সরকার যত দ্রুত এর দ্বিতীয় ফেজ চালুসহ উন্নয়নমূলক অন্যান্য প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে, টার্মিনালটির ট্রানজিট হাব হিসেবে কার্যকারিতা ও গুরুত্ব তত বেশি বাড়বে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here