মোম্বাসা বন্দর

মোম্বাসা বন্দরের অবস্থান আফ্রিকার অন্যতম প্রাচীন একটি পোতাশ্রয়ের কোলে। এর যাত্রা পর্তুগিজ অভিযাত্রীদের পা পড়ার অনেক আগেই। সে সময় মোম্বাসা দ্বীপের উত্তর দিকে ওল্ড পোর্ট নামের একটি বন্দর ছিল, যেটিতে আরবের বিশেষ ধরনের জাহাজ ডাও নিয়মিত পোর্ট কল দিত।

বিখ্যাত অভিযাত্রী ভাস্কো-দা-গামার দেখানো পথ অনুসরণ করে আফ্রিকার দক্ষিণ উপকূল ঘুরে এসে পর্তুগিজরা এশিয়ায় বাণিজ্য করত। মোম্বাসা দ্বীপে ভাস্কো-দা-গামার আগমনের পরপরই সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় ফোর্ট জিসাস। এই ফোর্টের ঠিক সামনেই ওল্ড পোর্টের অবস্থান ছিল।

আঠারো ও উনিশ শতকে পূর্ব আফ্রিকায় একাধিক ইউরোপীয় দেশের উপনিবেশ স্থাপন হয়। ১৮৯০-এর দশকে এই অঞ্চলটি দুটি ভাগে ভাগ হয়ে পড়ে। তানজানিয়ায় গড়ে ওঠে জার্মানির উপনিবেশ। আর কেনিয়া ও উগান্ডায় চালু হয় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন। সেই সময় মোম্বাসা পূর্ব আফ্রিকার বাণিজ্যের গেটওয়েতে পরিণত হয়। ফলে সেখানে বড় জাহাজের হ্যান্ডলিং ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পূর্ণাঙ্গ বন্দর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করেই ১৮৯৬ সালে দ্বীপের পশ্চিম দিকে একটি নতুন বন্দর প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রথমে একটি জেটি নিয়ে যাত্রা হয় সেই বন্দরের। পরে যোগ হয় আরও তিনটি জেটি।

আধুনিক মোম্বাসা বন্দরের যাত্রা অবশ্য গত শতাব্দীতে; ১৯২৬ সালে। সেই সময় দুটি গভীর পানির বার্থ নির্মাণ করা হয়। পরে ১৯৩১ সালে নির্মাণ করা হয় আরও তিনটি বার্থ। একই বছর চালু হয় শিমাঞ্জি অয়েল টার্মিনাল। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ চলাকালে ভারত মহাসাগরে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর রসদ পাঠানোর সুবিধার্থে ১৯৪৪ সালে নির্মাণ করা হয় আরও দুটি বার্থ।

১৯৬৩ সালে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে কেনিয়া। তার আগের দুই বছরে ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত হয় প্রতিবেশী তানজানিয়া ও উগান্ডা। ১৯৬৭ সালে এই তিন দেশ মিলে ইস্ট আফ্রিকান কমিউনিটিতে (ইএসি) যোগ দেয়। একই সঙ্গে তারা গঠন করে নতুন একটি কর্তৃপক্ষ-ইস্ট আফ্রিকান হারবার করপোরেশন। উদ্দেশ্য ছিল দারুসসালাম ও মোম্বাসা বন্দর এবং তাঙ্গা অয়েল পোর্ট পরিচালনা। এই কর্তৃপক্ষের অধীনে বন্দরগুলোর কার্যক্রমে প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়। কিন্তু ১৯৭৭ সালে ইএসি অবলুপ্ত হওয়ার পর কেনিয়ার বন্দরগুলো পরিচালনার দায়িত্ব নেয় সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৮ সালে গঠন করা হয় কেনিয়া পোর্ট অথরিটি (কেপিএ)। ১৯৮৬ সালে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা কেনিয়া কার্গো হ্যান্ডলিং লিমিটেডকে অধিগ্রহণের মাধ্যমে কেপিএর কার্যক্রমের ব্যপ্তি আরও বেড়ে যায়।

মোম্বাসা বন্দরে খাদ্যশস্য, সার, সিমেন্ট, সোডা অ্যাশের মতো ড্রাই বাল্ক এবং অপরিশোধিত জ¦ালানি, তেলজাত পণ্যের মতো লিকুইড বাল্ক হ্যান্ডলিংয়ের উপযোগী পর্যাপ্ত সরঞ্জাম রয়েছে। এছাড়া প্যাকেটজাত পণ্য, জেনারেল ব্রেক-বাল্ক, মোটর ভেহিকল, মেশিনারি ও কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য আধুনিক করে গড়ে তোলা হয়েছে বন্দরটিকে। সেখানে রয়েছে মোট ১৯টি গভীর পানির বার্থ, যার ছয়টি কনটেইনার জাহাজের জন্য।

মোম্বাসা বন্দরে মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটির সুবিধা রয়েছে। এটি সড়ক ও রেলপথের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন গন্তব্যের সঙ্গে যুক্ত। এমনকি পাশর্^বর্তী দেশ উগান্ডা, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো (ডিআরসি) ও দক্ষিণ সুদানের পণ্য বাণিজ্যেও অবদান রয়েছে মোম্বাসার।

উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় মোম্বাসা বন্দরে নির্মাণ হচ্ছে নতুন একটি কনটেইনার টার্মিনাল। মোম্বাসা পোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের অধীনে এটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে ঋণসহায়তা দিয়েছে জাপানের উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থা জাইকা। বর্তমানে বন্দরটির কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা ১৬ লাখ টিইইউ। নতুন টার্মিনালটি নির্মাণের ফলে এই সক্ষমতা ৪ লাখ ৫০ হাজার টিইইউ বৃদ্ধি পাবে।

সম্প্রতি মোম্বাসায় কেনিয়া শিপইয়ার্ডস লিমিটেডের (কেএসএল) নতুন একটি ইয়ার্ড স্থাপন ও কমিশনিং করেছে সরকার। নতুন এই ইয়ার্ডে ৪ হাজার টনের বেশি ধারণক্ষমতা ও ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে জাহাজ নির্মাণ ও সংস্কার করা সম্ভব হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here