সেই দিন হয়তো আর বেশি দেরি নেই, যখন বাণিজ্যিক এলাকাগুলোয় আর ব্যক্তিগত গাড়ির পার্কিং স্পটের প্রয়োজন হবে না। তাহলে কি মানুষ গাড়ি ব্যবহার করা ছেড়ে দেবে? না, তা নয়। আসলে প্রযুক্তির আশীর্বাদে এমন সুবিধা পাওয়া যাবে। ধরুন আপনি ব্যক্তিগত গাড়িতে করে আপনার অফিসে এসে নামলেন। তারপর আপনাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটি নিজে নিজেই আবার আপনার বাসায় ফিরে গেল। তাহলে তো আর আপনার অফিসের পার্কিং লটে গাড়িটি রাখার প্রয়োজন পড়ছে না।
আরেকটি পরিস্থিতির কথা বলা যাক। ধরা যাক একটি কারখানায় সার্বক্ষণিক উৎপাদন চালু রাখা প্রয়োজন অথবা উৎপাদনের পরিমাণ ও গুণগত মান দুটোই বাড়ানো দরকার। এক্ষেত্রে যে বিষয়টি মহৌষধের মতো কাজ করবে, সেটি হলো স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি। মান নিয়ন্ত্রণ, সূক্ষ্ম ও সংবেদনশীল পণ্য উৎপাদন ইত্যাদি কাজে এই প্রযুক্তির কার্যকারিতার কোনো জুড়ি নেই।
শিল্পোৎপাদন থেকে শুরু করে সেবাখাতÑসর্বত্রই বর্তমানে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। স্বয়ংচালিত গাড়ি অটোমোবাইল খাতে নতুন যুগের সূচনা করেছে। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সহায়তার মাধ্যমে অটোমেশন শিল্পবিপ্লবের পালে হাওয়া দিয়েছে। সমুদ্রশিল্পও এই প্রযুক্তির ব্যবহারে পিছিয়ে নেই।
বিশ্বায়নের এই যুগে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিসর বেড়েছে বহুগুণ। একই সঙ্গে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের চাপও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিপুল পরিমাণ পণ্য পরিবহনের জন্য একদিকে জাহাজের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনই বেড়েছে জাহাজের আকারও। এই দুই ধরনের বৃদ্ধিই বিশ্বের ব্যস্ততম বন্দরগুলোর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে।
যেকোনো বন্দরেরই পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের একটি নির্দিষ্ট সক্ষমতা রয়েছে। এর অতিরিক্ত আমদানি চাপ থাকলে জাহাজগুলোকে বাড়তি সময় বহির্নোঙরে অবস্থান করতে হয়। তাদের এই অপেক্ষার সময় যেন দীর্ঘ না হয়, সেই চেষ্টা করতে গিয়ে অনেক সময় বন্দরসেবার কার্যক্রমগুলো দ্রুত করতে হয়। আর এটি করতে গিয়ে মাঝেমধেই বিভিন্ন দুর্ঘটনা ঘটে। ডকিংয়ের সময় জাহাজের ধাক্কা লাগা এমনই এক দুর্ঘটনা।
জাহাজের চাপের কারণেই এখন অল্প জায়গায় অধিক সংখ্যক জাহাজকে ডকিংয়ের সুযোগ দিতে হয়। আবার জাহাজের বিশাল আকারের কারণেও ডকিং পজিশন ছোট হয়ে আসে। এই অল্প জায়গার মধ্যে জাহাজকে নিরাপদে ডকিং করা সহজ কাজ নয়। প্রথাগত ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে এটি করতে গিয়ে মানবিক ভুলের কারণে মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটে। কখনো জাহাজ গিয়ে বন্দরের স্থাপনাকে ধাক্কা দেয়, কখনো আবার পাশ্ববর্তী জাহাজকে। এই ধরনের সংঘর্ষ এড়ানোর ক্ষেত্রে কার্যকর সমাধান হতে পারে স্বয়ংক্রিয় ডকিং।
সমুদ্রশিল্পে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি
সমুদ্রশিল্পে অসামরিক বিভিন্ন কাজের পাশাপাশি এখন বিভিন্ন দেশে নৌ-সামরিক কার্যক্রমে ব্যবহার করা হচ্ছে স্বয়ংচালিত ডুবো ড্রোন, কেতাবি ভাষায় যাকে বলা হচ্ছে আনম্যানড আন্ডারওয়াটার ভেহিকল (ইউইউভি)। এটি হচ্ছে এক ধরনের খুদে সাবমেরিন, যার ভেতরে কোনো চালক থাকে না। প্রথম দিকে রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে মানুষ কর্তৃক দূরনিয়ন্ত্রিত থাকলেও বর্তমানে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। ফলে কিছু ইউইউভি এখন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে চলাচল করতে সক্ষম। ভেতরে বসানো কম্পিউটার ও সেন্সর দিয়ে এগুলো পরিচালিত হয়। অসামরিক খাতে পানির নিচের বিভিন্ন গবেষণা, অনুসন্ধান বা সার্ভিল্যান্সের কাজে ইউইউভি ব্যবহার করা হয়। আর নৌ-সামরিক খাতে ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন অপারেশনে এই ডুবো ড্রোনগুলোর ব্যবহার অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে।
সাগর পাড়ি দেওয়া বাণিজ্যিক জাহাজগুলোয় স্বয়ংক্রিয় নেভিগেশন ও প্রপালশন ব্যবস্থার ব্যবহার এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। অতিসম্প্রতি হুন্দাই হেভি ইন্ডাস্ট্রিজের তৈরি একটি এলএনজি ক্যারিয়ার স্বয়ংক্রিয় নেভিগেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়েছে। বড় আকারের কোনো বাণিজ্যিক জাহাজের এটাই প্রথম অত্যাধুনিক এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মহাসাগর পাড়ি দেওয়া।
প্রিজম কারেজ নামের ৯৭ হাজার ৫০০ ডিডব্লিউটি ধারণ ক্ষমতার এলএনজি ক্যারিয়ারটি তার যাত্রার অর্ধেকের বেশি পথ স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে অতিক্রম করেছে। শতাধিক জাহাজের সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘর্ষ এড়িয়ে প্রায় ৫ হাজার ৪০০ নটিক্যাল মাইল পথ সফলভাবে পাড়ি দিয়েছে ক্যারিয়ারটি। এর স্বয়ংক্রিয় নেভিগেশন সিস্টেম সরবরাহ করেছে হুন্দাইয়ের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি আভিকাস।
মাসখানেক আগে চীনে বাণিজ্যিক সেবা চালু করেছে বিশ্বের প্রথম স্বয়ংচালিত বৈদ্যুতিক কনটেইনার ফিডার শিপ ঝি ফেই। প্রায় ৮ হাজার ডিডব্লিউটির জাহাজটি ৩০০ টিইইউ কনটেইনার পরিবহন করতে সক্ষম। ঝি ফেইকে একটি ডেমোনস্ট্রেশন শিপ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। অর্থাৎ জাহাজটির সাফল্য ও বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের ওপর ভিত্তি করে স্বয়ংচালিত প্রযুক্তির উন্নয়ন ও গবেষণা কার্যক্রম চালাবেন চীনা গবেষকরা। ৩৮৪ ফুট দীর্ঘ ও প্রায় ৩২ ফুট গভীরতার ঝি ফেইয়ের প্রপালশনে ব্যবহার করা হয়েছে ডিসি ইলেকট্রিক সিস্টেম, যা দিয়ে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২ নটিক্যাল মাইল গতি তোলা যাবে। আর স্বাভাবিক অপারেশনে জাহাজটির গতি হবে ঘণ্টায় ৮ নটিক্যাল মাইল।
বিশ্বজুড়ে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে কনটেইনারের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। এর ফলে বন্দরগুলোর জন্য অন্যতম মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কনটেইনার রাখার স্থান সংকুলান করা। এমন পরিস্থিতিতে কনটেইনার ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করতে পরীক্ষামূলকভাবে সম্পূর্ণ নতুন রোবোটিক র্যাক সিস্টেম চালু করেছিল ডিপি ওয়ার্ল্ড। এই ট্রায়ালে প্রত্যাশার চেয়েও ভালো ফল পেয়েছে কোম্পানিটি। সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) জেবেল আলি টার্মিনালে ৮০০ কনটেইনার রাখার উপযোগী ‘বক্সবে’ নামের এই স্বয়ংক্রিয় র্যাক বসিয়েছে ডিপি ওয়ার্ল্ড।
স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির সুবিধা
এখন আসা যাক স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির সুবিধা কী, সেই প্রসঙ্গে। গত কয়েক দশকে মেরিটাইম খাতে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এসেছে খুব দ্রুত। এরই ধারাবাহিকতায় সমুদ্রশিল্পে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির নির্ভরতা বাড়ছে অনেক দ্রুতগতিতে। আর এই রূপান্তরের নেপথ্যে রয়েছে নিরাপত্তা, কার্যদক্ষতা ও পরিবেশগত সুবিধার মতো বিষয়গুলো।
কার্বন নিঃসরণ কমানোর ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি অনেক বেশি অবদান রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। সেটি কীভাবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুততর পজিশনিং এবং স্পিড অপ্টিমাইজেশনের এফিশিয়েন্সি বৃদ্ধি করার মাধ্যমে এই প্রযুক্তি জ্বালানি সাশ্রয়ে ভূমিকা রাখবে। আর জ্বালানি ব্যয় কমে যাওয়ার অর্থ কার্বন নিঃসরণও কমে যাওয়া। আরেকটি বিষয়-একটি জাহাজ যখন ডুবোচরের সঙ্গে ধাক্কা লাগা অথবা অন্য কোনো জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষের মতো দুর্ঘটনায় পতিত হয়, তখন সামুদ্রিক পরিবেশের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ার ঝুঁকি থাকে। স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি এই ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধের মাধ্যমে পরিবেশগত বিপর্যয় এড়ানোর ক্ষেত্রে কার্যকর মিকা রাখবে।
রয়েছে কিছু চ্যালেঞ্জ
সমুদ্র পরিবহন খাতে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির সর্বাত্মক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমেই বলা যায় আন্তর্জাতিক কিছু বিধিবিধান মেনে চলার বাধ্যবাধকতার কথা। সাগরে চলাচলের সময় জাহাজগুলোর সংঘর্ষ এড়ানোর লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে কনভেনশন অন দ্য ইন্টারন্যাশনাল রেগুলেশনস ফর প্রিভেনটিং কলিশনস অ্যাট সি (সিওএলআরইজি) গ্রহণ করে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও), যা বাস্তবায়িত হয় ১৯৭৭ সালে। এই কনভেনশন হলো আন্তর্জাতিক রুটগুলোয় জাহাজ চলাচলের জন্য কিছু অবশ্য পালনীয় বিধিবিধান। জাহাজের স্বয়ংক্রিয় নেভিগেশন সর্বজনীন করার ক্ষেত্রে এই কনভেনশনের শর্তগুলো প্রতিপালনের বিষয়টি প্রাথমিকভাবে বড় একটি চ্যালেঞ্জই বটে।
আরেকটি বড় প্রতিবন্ধকতা হলো জাতিসংঘের একটি বিধান। ১৯৮২ সালে গৃহীত ইউএন কনভেনশন অন দ্য ল’ অব দ্য সি অনুযায়ী প্রতিটি জাহাজের অবশ্যই একজন মাস্টার থাকতে হবে এবং তাকে অবশ্যই সর্বদা দায়িত্বরত থাকা আবশ্যক।
তবে সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জ, সেটি হলো সাইবার নিরাপত্তা। স্বয়ংচালিত জাহাজগুলোর স্বয়ংক্রিয় নেভিগেশন সিস্টেম যে সাইবার অপরাধীরা হ্যাক করবে না, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে জাহাজের ‘ভার্চুয়াল নিয়ন্ত্রণ’ হ্যাকারদের দখলে চলে যেতে পারে।
উদ্যোগে আশার আলো
আশার কথা হলো, স্বয়ংচালিত জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিধিবিধান-সংশ্লিষ্ট যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেগুলো দূর করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। গত বছরের মে মাসে আইএমওর মেরিটাইম সেফটি কমিটির (এমএসসি) ১০৩তম অধিবেশনে স্বয়ংক্রিয় নেভিগেশন প্রযুক্তি-সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা বিষয়গুলো নিয়ে পর্যালোচনা করা হয় এবং মেরিটাইম অটোনমাস সারফেস শিপস (এমএএসএস)-এর চলাচল নিয়ন্ত্রণে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনার পথ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এমএসসির এই উদ্যোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ফলাফল, সেটি হলো-স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির উন্নয়নের গতি যেন রুদ্ধ না হয়, সেই বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। অধিবেশনে এই প্রযুক্তির কয়েকটি ধরন (ডিগ্রি) বিবেচনায় নেওয়া হয়। সেগুলো হলোÑস্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির সুবিধাসম্পন্ন জাহাজ যেখানে ক্রু থাকবে এবং তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করবে (ডিগ্রি ওয়ান), দূরনিয়ন্ত্রিত জাহাজ যেখানে নাবিকরা জাহাজে অবস্থান করবে (ডিগ্রি টু), দূরনিয়ন্ত্রিত জাহাজ যেখানে কোনো নাবিক থাকবে না (ডিগ্রি থ্রি) এবং সম্পূর্ণ স্বয়ংচালিত জাহাজ (ডিগ্রি ফোর)।

বন্দর সুরক্ষায় স্বয়ংক্রিয় ডকিং
ঘটনা-১: ২০২১ সালের ৩ জুন। তাইওয়ানের বৃহত্তম বন্দর কাওসিউংয়ে ডকিংয়ের চেষ্টা করছিল ৩১৬ মিটার দীর্ঘ কনটেইনার জাহাজ ওওসিএল ডারবান। এ সময় জাহাজটি আগে থেকেই ডকিং করে থাকা ইয়ংহুং নামের অপর একটি জাহাজে ধাক্কা দেয়। সেই জাহাজটি আবার ধাক্কা দেয় বন্দরের একটি শিপ-টু-শোর গ্যান্ট্রি ক্রেনকে। ধাক্কা লেগে সেই ক্রেনটি পুরোপুরি ভেঙে পড়ে এবং পাশর্^বর্তী একটি ক্রেন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া ধসে পড়ে সাজিয়ে রাখা কয়েকটি কনটেইনার। এই ঘটনায় বন্দরের একজন কর্মী আহত হন এবং দুজন ক্রেন অপারেটর ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েন। পরে অবশ্য তাদের নিরাপদেই উদ্ধার করা হয়।
ঘটনা-২: এই ঘটনাটি একেবারেই সাম্প্রতিক। গত মে মাসে জ্যামাইকার ফ্যালমাউথ ক্রুজ শিপ পোর্টে ডকিংয়ের সময় কংক্রিটের তৈরি ছোট আকারের একটি মুরিং পাইলনকে ধাক্কা দেয় রয়েল ক্যারিবিয়ান ইন্টারন্যাশনালের দানবাকার প্রমোদতরী হারমোনি অব দ্য সিজ। এটি অবশ্য বড় কোনো দুর্ঘটনা ছিল না। এর কারণে হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি এবং জাহাজে টোল খাওয়া ও রং চটে যাওয়া ছাড়া বড় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
দুটি ঘটনা দুই জায়গার। কিন্তু ঘটনার ধরন ও কারণ অভিন্ন। দুটি দুর্ঘটনাই ঘটেছে ডকিংয়ের সময়, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশর্^বর্তী জাহাজ অথবা স্থাপনাকে ধাক্কা দেওয়ার মাধ্যমে। উভয় ঘটনারই কারণ মানবীয় ভুল।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ^জুড়ে প্রতি বছর প্রায় ৩ হাজার সামুদ্রিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, যার কারণে কোম্পানিগুলোর ২ হাজার কোটি ডলারের বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়। এসব দুর্ঘটনার তিন-চতুর্থাংশই ঘটে মানুষের ভুলের কারণে। স্বয়ংক্রিয় ডকিং ব্যবস্থা চালু হলে অন্তত জাহাজ বন্দরে ভেড়ার সময়কার দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা, এমনকি পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।
শিপিং খাতে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির সর্বাত্মক প্রয়োগ ঘটাতে হবে ধাপে ধাপে। এ কারণে প্রাথমিকভাবে জাহাজ চলাচল-সংশ্লিষ্ট কয়েকটি ছোট সেগমেন্টে এই প্রযুক্তি চালুর চেষ্টা করছে খাতসংশ্লিষ্টরা, যাতে করে বাড়তি নিরাপত্তা, পরিচালনগত কার্যদক্ষতার মতো তাৎক্ষণিক কিছু সুবিধা অর্জন করা সম্ভব হয়।
অর্থাৎ প্রাথমিকভাবে ডিগ্রি ওয়ান প্রযুক্তি বাস্তবায়নের দিকেই বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। আর এই ক্যাটাগরির প্রযুক্তির অন্যতম উদাহরণ হলো অটোনমাস ডকিং ও ডিপারচার। যেহেতু একটি জাহাজের যাত্রা শুরু ও শেষ হয় এই দুটি বিষয় দিয়ে, সেহেতু অটোনমাস ডকিং ও ডিপারচারকে বলা হচ্ছে স্বয়ংচালিত জাহাজ পরিচালন ব্যবস্থার মৌলিক দুটি ভিত্তি। ফলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিধিবিধানের কম্পøায়েন্স সম্পন্ন করে ডিগ্রি ফোর অর্থাৎ সম্পূর্ণ স্বয়ংচালিত প্রযুক্তি বাস্তবায়নের আগেই স্বয়ংক্রিয় ডকিংয়ের মতো প্রযুক্তির বহুল ব্যবহার দেখা যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বলা যায়, স্বয়ংচালিত জাহাজ চলাচল ব্যবস্থার মৌলিক ভিত্তি হতে যাচ্ছে স্বয়ংক্রিয় ডকিং।
অস্ট্রেলীয় মেরিন টেকনোলজি কোম্পানি মেরিন অটোনমাস ইনটেলিজেন্ট ডকিং (এমএআইডি) সম্প্রতি এমন একটি সিস্টেম ডেভেলপ করেছে; যেটি সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ডকিং ও পজিশনিংয়ের জন্য সহায়ক হবে। কোম্পানিটি এই প্রযুক্তির মেধাস্বত্ব সম্পন্ন পেটেন্টও করেছে।
এমএআইডি যে কেবল বাণিজ্যিক বন্দরে ডকিংয়ের ক্ষেত্রেই কাজে আসবে, তা নয়। বরং গভীর সমুদ্র তেল ও গ্যাস প্রকল্প, ক্রুজ শিল্প, প্রতিরক্ষা ও জননিরাপত্তায় নিয়োজিত মেরিন ভেসেলের ডকিং প্রভৃতি ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি যুগান্তকারী উন্নয়ন সাধন করবে। সেন্সর ও প্রপালশন সিস্টেমের ক্লোজড লুপ কন্ট্রোলের মাধ্যমে জাহাজের ডকিং ও পজিশনিং কার্যক্রমকে স্বয়ংক্রিয় করার সুযোগ করে দেবে এই প্রযুক্তি।
এখন আসা যাক এমএআইডির এই প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করে, সেই প্রসঙ্গে। মোটা দাগে বলা যায়, এটি দুটি উপায়ে কাজ করে। প্রথমত, এটি তার আশপাশের ভেসেলগুলোকে শনাক্ত করে। দ্বিতীয়ত, জাহাজ যেখানে ডকিং করতে হবে, সেই জায়গাটিও শনাক্ত করে এই প্রযুক্তি। এই দুটি বিষয় শনাক্ত করার পর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হয় যে, ডকিং লোকেশন জাহাজটিকে জায়গা দেওয়ার মতো যথেষ্ট বড় কিনা। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমেই একটি জাহাজ থেকে আরেকটি জাহাজের নিরাপদ দূরত্ব পরিমাপ করা হয়।
হারবার দিয়ে বন্দরে প্রবেশের সময় জাহাজের গতিপথে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকলে সেটি শনাক্ত করার পর এই প্রযুক্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাহাজকে থামিয়ে দেয় এবং সুযোগ থাকলে অন্য কোনো পথে ডকিং পজিশনের দিকে চালিত করে। এর ফলে যেকোনো ধরনের সংঘর্ষ এড়িয়ে নিয়ন্ত্রিত গতিতে জাহাজটি ডকিং করতে সমর্থ হয়। ডকের যত কাছাকাছি পৌঁছাবে, জাহাজের গতি তত কমবে এবং একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে পৌঁছানোর পর প্রযুক্তিটি জাহাজকে থামিয়ে দেবে ও সেই অবস্থানেই ধরে রাখবে। আর এসব কিছু হবে মানুষের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই।

উপসংহার
পুরো বিশ্বই এখন প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ওপর ভর করে এগিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় সমুদ্রশিল্প কেন পিছিয়ে থাকবে? স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে জ¦ালানি সাশ্রয়, দুর্ঘটনা প্রতিরোধের মতো বাড়তে কিছু সুযোগ-সুবিধা দেবে। এ কারণে শিল্পখাতটির অংশীজনরা ক্রমান্বয়ে তাদের কার্যক্রমে এই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াচ্ছে। প্রতিনিয়তই নতুন নতুন জাহাজে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি সংযোজন এবং সেগুলোর পরীক্ষামূলক ও বাণিজ্যিক যাত্রার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
যেহেতু প্রতিটি বাণিজ্যিক জাহাজকেই যাত্রার শুরু ও শেষে বন্দরের সেবা নিতে হয়, সেহেতু বন্দরকেন্দ্রিক কার্যক্রমেও অটোমেশনের প্রয়োগ না ঘটালে সার্বিকভাবে এই প্রযুক্তির সর্বোচ্চ উপযোগিতা থেকে বঞ্চিত হতে হবে। বন্দরে ডকিংয়ের ক্ষেত্রেও বিষয়টি সমানভাবে গুরুত্ববহ।
ডকিংয়ের সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা বন্দর ও জাহাজ উভয়ের জন্যই বড় ধরনের লোকসানের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যেহেতু স্বয়ংক্রিয় ডকিং প্রযুক্তি নিখুঁত পজিশনিং ও ম্যানুভারিংয়ের মাধ্যমে সংঘর্ষ এড়াতে সক্ষম, সেহেতু যত দ্রুত সম্ভব এই প্রযুক্তির ব্যবহার সর্বব্যাপী করা যাবে, লোকসানের পরিমাণও তত কমবে।