অর্থনীতির বিশ্ব পরিব্রাজনের শুরুটাই হয়েছিল বিপৎসংকুল সমুদ্রে অজানার উদ্দেশে যাত্রা করে। তথ্য-প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের এই যুগে এসেও অর্থনীতিতে সমুদ্রের প্রভাব এতটুকু ম্লান হয়নি, বরং নানা মাত্রায় বিবর্তিত হয়ে নৌপরিবহন বৈশ্বিক অর্থনীতিকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে। তবে সমুদ্রে নৌপরিবহনের ঝুঁকিও কম নয়। সেই প্রাচীন কাল থেকেই জলদস্যুতা এবং সমুদ্রের রুদ্র রূপ নৌ বাণিজ্যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বারবার। তবে যত সময় গড়িয়েছে, সাগর-মহাসাগরে নিরাপত্তাঝুঁকির ধরন ও বিস্তৃতিও বেড়েছে। ঔপনিবেশিক শাসন বিস্তারের যুগে বিভিন্ন অঞ্চলে নৌ-সামরিক উত্তেজনা মাঝেমধ্যেই দেখা গেছে। গত শতকের বিশ্বযুদ্ধের সময়ও সমুদ্রগুলো ছিল অন্যতম রণক্ষেত্র।
আধুনিক যুগে সমুদ্র শিল্পের নিরাপত্তাঝুঁকি আরও বহুমাত্রিক রূপ ধারণ করেছে। যত সময় গড়াচ্ছে, সাগরের ওপর চাপ তত বাড়ছে। বিশ্বায়নের যুগে সমুদ্র বাণিজ্যের প্রসারের সুবাদে জাহাজ চলাচল বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে জাহাজে জাহাজে সংঘর্ষের ঘটনাও। অন্যদিকে সাপ্লাই চেইনের স্বাভাবিকতা বজায় রাখার স্বার্থে অনেক সময় বন্দরগুলোকে বাড়তি চাপ নিয়ে কাজ করতে হয়। অল্প সময়ে বেশি সংখ্যক জাহাজকে সেবা দিতে গিয়ে কখনো কখনো বন্দরে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের সময় দুর্ঘটনা ঘটে। আবার ব্যস্ত সূচির কারণে বেশি সংখ্যক জাহাজকে বন্দরে ডকিংয়ের সুযোগ দিতে গিয়ে মাঝেমধ্যে সংঘর্ষের খবরও পাওয়া যায়। এছাড়া কনটেইনারে করে অনেক সময় বিপজ্জনক রাসায়নিকসহ অন্যান্য দাহ্য পদার্থ পরিবহন করা হয়। কখনো কখনো এসব কনটেইনার বিস্ফোরিত হয়ে পুরো জাহাজে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ ধরনের দুর্ঘটনার প্রকোপও বেড়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে আরেকটি বড় নিরাপত্তা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে সাইবার অপরাধ। এখন হ্যাকাররা বিভিন্ন মেরিটাইম সার্ভিসের সিস্টেমে প্রবেশ করে এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়, সেটি অকার্যকর করে দেয় এবং তা পুনরায় সচল করার জন্য র্যানসমওয়্যার দাবি করে। আবার বিভিন্ন সংবেদনশীল তথ্য হাতিয়ে নিয়ে সেগুলোর বিনিময়েও মোটা অংকের অর্থ আদায় করে তারা।
এই যে মেরিটাইম খাতের নিরাপত্তা নিয়ে বহুমাত্রিক সব সংকট, তা কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা অঞ্চলের নয়। বরং তা সারা বিশ্বের জন্যই বড় চ্যালেঞ্জের নাম। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সমুদ্র নিরাপত্তা বাড়াতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আইনি বিধিবিধান চালু, নজরদারি বৃদ্ধিসহ অবশ্যপালনীয় বিভিন্ন সুরক্ষামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা গেছে। তারপরও মাঝেমধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের মাধ্যমে সমুদ্র শিল্পকে পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য প্রয়োজন সময়োপযোগী কর্মপরিকল্পনা ও নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ। আর তা হতে হবে সমন্বিতভাবে। এসব নিরাপত্তাঝুঁকির সমাধান না করা গেলে সময়ের প্রয়োজন মিটিয়ে একটি টেকসই সমুদ্র শিল্পের বাস্তবায়নও সম্ভব হবে না।
রাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দরও নিরাপত্তা বিষয়টিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাথে সমন্বয় করে বহির্নোঙরে নজরদারি জোরদার করেছে। একই সাথে ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (ভিটিএমআইএস) স্থাপনের মাধ্যমে বহির্নোঙরে প্রতিটি জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ ২৪/৭ নিরবচ্ছিন্নভাবে তদারকি করা হচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পাইরেসির হার শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে, যা ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও) সহ অন্যান্য সমুদ্র সংস্থার স্বীকৃতি লাভ করেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমায় এখন আর বড় ধরনের কোনো জলদস্যুতার ঘটনা ঘটে না। কালেভদ্রে যেসব ঘটনার খবর পাওয়া যায়, সেগুলোকে নিছক ছিঁচকে চুরি বলা চলে। তাও আবার সব খবরের যে সত্যতা থাকে, তাও নয়।
চট্টগ্রাম বন্দর ২০০৪ সালের ১ জুলাই থেকে ইন্টারন্যাশনাল শিপ অ্যান্ড পোর্ট ফ্যাসিলিটি সিকিউরিটি (আইএসপিএস) কোড বাস্তবায়ন ও দক্ষতার সাথে প্রতিপালন করে আসছে। তাছাড়া টু-স্টেজ গেট স্থাপন, ভ্রাম্যমাণ ভেহিকল দ্বারা কার্গো স্ক্যানিং সিস্টেম, সিসি ক্যামেরা ও ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম স্থাপনসহ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ব্যাপক সংস্কারের ফলে দেশে ও বিদেশে বন্দরের ভাবমূর্তি সমুন্নত হয়েছে। সমুদ্র শিল্পের নিরাপত্তাঝুঁকির বিস্তারিত নিয়ে এবারের মূল আয়োজন। প্রিয় পাঠক, আমরা চাই এ দেশের মেরিটাইম-চর্চাকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড় করাতে। বৈচিত্র্যময় আঙ্গিকে, সমৃদ্ধ কলেবরে বন্দরবার্তার পথচলা বাংলাদেশের মেরিটাইম খাতের বিকাশে আরও সহায়ক হবে-সেই প্রত্যাশা। সবাইকে শুভেচ্ছা।