অননুমেয় গতিপ্রকৃতির সমুদ্রে চলাচল করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিপদের মুখে পড়তে হয় জাহাজগুলোকে। উত্তাল সাগরে জাহাজডুবি, জাহাজ থেকে কনটেইনার সাগরে পড়ে যাওয়া, জাহাজে আগুন লেগে যাওয়া, জলদস্যুদের কবলে পড়া- এসব ঘটনা ঘটছে অহরহ। এছাড়া জাহাজ পৌঁছাতে বিলম্ব হওয়া, বন্দরে বার্থিংয়ের সুযোগ পেতে অপেক্ষমাণ থাকা, বন্দরে হ্যান্ডলিংয়ের সময় কার্গোর ক্ষয়ক্ষতি হওয়া, পণ্য হারিয়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণেও আর্থিক লোকসান গুনতে হয় উৎপাদক ও শিপিং অপারেটরদের। অনেক সময় সমুদ্রসংলগ্ন দেশগুলো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেও পণ্য পরিবহনে ঝুঁকি তৈরি হয়। এই যে এত ঝুঁকি নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করেই সচল রাখা হচ্ছে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন, সেই ঝুঁকি প্রশমনে কার্যকর ভূমিকা রাখে নৌ-বিমা। ক্ষয়ক্ষতি প্রশমনের এই নিশ্চয়তাটুকু না পেলে পাহাড়সম ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রে পণ্য পরিবহন সম্ভব হতো না।
বিভিন্ন দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকে সমুদ্র পরিবহন খাতকে সুরক্ষিত রাখার স্বার্থে আধুনিক কাঠামোর নৌ-বিমা প্রচলন হয়েছিল কয়েক শ বছর আগে। এই দীর্ঘ সময়ে বিমাসংশ্লিষ্ট অনেক ক্ষেত্রেই এসেছে পরিবর্তন। প্রথাগত ঝুঁকির পাশাপাশি সমুদ্র পরিবহন খাতে সাম্প্রতিক সময়ে নতুন একটি ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। সেটি হলো জ্বালানি রূপান্তর প্রক্রিয়ার ঝুঁকি। জলবায়ু পরিবর্তন সারা বিশ্বের জন্য আজ এক মাথাব্যথার নাম। এর থেকে মুক্তি পেতে যত দ্রুত সম্ভব গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। সমুদ্র পরিবহন কার্যক্রমকে কীভাবে নিঃসরণমুক্ত করা যায়, সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হচ্ছে, যার মধ্যে জ্বালানি রূপান্তর অন্যতম। ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি কার্যকর হওয়া আইএমওর গ্লোবাল সালফার ক্যাপ রেগুলেশনেও জাহাজের জ্বালানিতে সালফারের পরিমাণ ৩ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।
জ্বালানি রূপান্তরের এই প্রক্রিয়াটি খুব একটা সহজ কাজ নয়। রাতারাতি প্রচলিত জ্বালানি ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যবহার শুরু করা সম্ভব না। এর জন্য সবুজ জ্বালানিচালিত নতুন জাহাজ নির্মাণ করতে হবে অথবা বিদ্যমান জাহাজগুলোকে কনভারশন করতে হবে। এছাড়া পাইপলাইন স্থাপন, স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের মতো কাজে মোটা অংকের অবকাঠামো বিনিয়োগেরও প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু কেবল বিনিয়োগ এলেই তো চলবে না। বরং সেই বিনিয়োগের সুরক্ষাও চাই। জাহাজের মতো অফশোর ফার্মগুলোরও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়া জলদস্যুতার কারণে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ বেহাত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে সাম্প্রতিক সময়ে। এসব ফার্মের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বৃদ্ধির পাশাপাশি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এখন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিষয়টিও নৌ-বিমা খাতের পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে।
এতদিন নৌ-বিমা মূলত প্রথাগত ক্ষতিপূরণের ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে অতি সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্রে জাহাজ চলাচলের কারণে জলজ পরিবেশ কীরূপ দূষণের শিকার হচ্ছে, এর দায় কার ওপর বর্তাবে এবং ক্ষতিপূরণের অংক কত হবেÑ বিমা দাবি নিষ্পত্তির সময় এই বিষয়গুলোরও হিসাব-নিকাশ করা হচ্ছে। এছাড়া সমুদ্রসম্পদের সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার বিশেষ করে আন্তর্জাতিক জলসীমায় থাকা জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষাকে বেশ প্রাধান্য দিচ্ছে নৌ-বিমা খাতসংশ্লিষ্টরা। নৌ-বিমা ও এর ওপরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত রয়েছে এবারের প্রধান রচনায়। প্রিয় পাঠক, আমরা চাই এ দেশের মেরিটাইম-চর্চাকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড় করাতে। বৈচিত্র্যময় আঙ্গিকে, সমৃদ্ধ কলেবরে বন্দরবার্তার পথচলা বাংলাদেশের মেরিটাইম খাতের বিকাশে আরও সহায়ক হবেÑ সেই প্রত্যাশা। সবাইকে শুভেচ্ছা।