ইয়ানতাই বন্দর চীনের অন্যতম ব্যস্ত একটি সমুদ্রবন্দর। এর অবস্থান দেশটির শ্যানডং প্রদেশের উত্তরাঞ্চলীয় ইয়ানতাই শহরের উপকণ্ঠে। পীত সাগরের তীরে গড়ে ওঠা এই বন্দরটি বিশ্বের শীর্ষ ৫০ কনটেইনার পোর্টের একটি। বিখ্যাত লয়েড’স লিস্টের শীর্ষ ১০০ কনটেইনার পোর্টের তালিকায় এর অবস্থান ৪৯তম।
২০২২ সালে ইয়ানতাই বন্দরে মোট ৪১ লাখ ১৭ হাজার ৮০০ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ১২ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। ২০২১ সালে বন্দরটিতে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ ছিল ৩৬ লাখ ৫১ হাজার টিইইউ। সে বছর লয়েড’স লিস্টে বন্দরটির অবস্থান ছিল ৫২তম।
ইয়ানতাই শহরের পাশেই রয়েছে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট দারুণ একটি গভীর পানির পোতাশ্রয়। অনেক আগেই এই পোতাশ্রয়ে বন্দর ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। ইয়ানতাই শব্দের অর্থ হলো বাতিঘর। পনেরো শতকে এই এলাকায় জাপানি জলদস্যুদের বেশ উপদ্রব ছিল। সে সময় বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য উপকূলীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। এরই অংশ হিসেবে ইয়ানতাইয়ের একটি পাহাড়ে বাতিঘর ও পর্যবেক্ষণ টাওয়ার স্থাপন করা হয়।
১৮৬০ সাল পর্যন্ত ইয়ানতাইয়ের বন্দর অ্যাংলো-ফরাসি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। পরের বছর একটি চুক্তির মাধ্যমে বন্দরটিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ১৮৭৬ সালে ইয়ানতাই বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ব্রিটেন ও চীনের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়, যেটি জিফু কনভেনশন নামে পরিচিত। এই কনভেনশনের মাধ্যমে একটি ‘ট্রিটি পোর্ট’ হিসেবে নতুন করে যাত্রা করে ইয়ানতাই বন্দর।
ট্রিটি পোর্ট হলেও ইয়ানতাই বন্দরে কখনো কোনো উপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি, অথবা কনসেশন চুক্তির অধীনে বিদেশি কোনো পক্ষ সেখানে গিয়ে বন্দর পরিচালনা করেনি। অবশ্য সীমিত সংখ্যক বিদেশি বণিকরা ইয়ানতাইয়ে বসবাস করে বাণিজ্য পরিচালনা করতেন। উনিশ শতকের শেষের দিকে ইয়ানতাই বন্দর দিয়ে বাণিজ্যের পরিসর বাড়তে থাকে। সে সময় প্রচুর পরিমাণে রেশম, মটরশুঁটি ও অন্যান্য স্থানীয় উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি হতো বন্দর দিয়ে। বিপরীতে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আমদানি হতো উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পণ্য। এছাড়া শ্যানডংয়ের উত্তরাঞ্চল ও হেবেই প্রদেশের পূর্বাঞ্চলীয় কিছু বন্দরে পণ্য পরিবহনে ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট হিসেবেও ব্যবহার হতো ইয়ানতাই বন্দর।
১৮৯৮ সালে শ্যানডংয়ের দক্ষিণাঞ্চলে চিংদাও বন্দর প্রতিষ্ঠার পর ইয়ানতাইয়ে কার্গো হ্যান্ডলিং কিছুটা কমতে থাকে। বিশেষ করে ১৯০৪ সালে চিংদাওকে শ্যানডংয়ের রাজধানী জিনানের সঙ্গে সংযোগকারী রেল নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার পর প্রদেশটির সিংহভাগ রপ্তানি চিংদাও দিয়েই সম্পন্ন হতো। এর ফলে ইয়ানতাইসহ শ্যানডংয়ের উত্তরাঞ্চলীয় অন্যান্য বন্দরের কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে আসে। ১৯৫৬ সালে চিংদাওয়ের উত্তরের হুনান প্রদেশের লানচুনের সাথে রেল সংযোগ প্রতিষ্ঠার পর নতুন করে প্রাণ ফিরে পায় ইয়ানতাই বন্দর।
বর্তমানে বেইজিং ও তিয়ানজিনের মতো চীনের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর সাথে সহজ যোগাযোগ এবং কোরীয় উপদ্বীপ ও জাপানের সঙ্গে সমুদ্র যোগাযোগে সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে ইয়ানতাই বন্দরের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। দ্রুত আন্তর্জাতিক সমুদ্র পরিবহন খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট হয়ে উঠছে বন্দরটি। চীনের বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ এই বন্দর।
ইয়ানতাই বন্দরে প্রধানত কনটেইনারাইজড কার্গো হ্যান্ডলিং হয়। এর পাশাপাশি বাল্ক, ব্রেক বাল্ক, রো-রো ও জ্বালানি পণ্যও পরিবহন হয় এই বন্দর দিয়ে। বন্দরটিতে সর্বোচ্চ ১৭ মিটার গভীরতার কনটেইনার ও ব্রেক বাল্ক জাহাজ, ২০ মিটার ড্রাফটের বাল্ক ক্যারিয়ার এবং ১১ দশমিক ৩ মিটার ড্রাফটের ট্যাংকার ভিড়তে পারে। পুরো বন্দর এলাকা গড়ে উঠেছে পাঁচটি অংশ নিয়ে জিফু বে, ওয়েস্টার্ন পোর্ট, পেংলাই পোর্ট, লোংকোউ পোর্ট ও শৌগ্যাং পোর্ট। ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো ২০ কোটি টন কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের মাইলফলক অর্জন করে ইয়ানতাই বন্দর। চীনের দশম বন্দর হিসেবে এই সাফল্য দেখায় বন্দরটি।