সম্পাদকীয়

সময়ের চেয়েও এগিয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; ব্যতিক্রম ছিলেন না নদী ও সমুদ্রকেন্দ্রিক উন্নয়ন নিয়ে তাঁর ভাবনা ও প্রজ্ঞায়। নদী ও সমুদ্র সম্পদের উন্নয়নে সাহসিকতা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় বাংলাদেশের মেরিটাইম ভিশনের স্থপতি। পাঁচ দশক আগে তিনি টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪ প্রণয়ন করেন, যা পরবর্তীতে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের আঞ্চলিক জলসীমা ও সামুদ্রিক অঞ্চল নির্ধারণে প্রধান রূপকল্প হিসেবে ভূমিকা পালন করে। এই আইন সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য আইনি কাঠামোর পাশাপাশি সমুদ্র ও সামুদ্রিক সম্পদের ওপর অধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তৈরি করে। সামুদ্রিক দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও সমুদ্র বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্রেও এটি একটি রূপরেখা সৃষ্টি করে। এই আইনটি প্রতিবেশী দেশসমূহের সাথে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমুদ্রসম্পদের শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের পথপ্রদর্শক ছিল।

বঙ্গবন্ধু এ অঞ্চলের সমুদ্র আইনের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনসহ বিভিন্ন ঝুঁকি মোকাবিলায় শত ব্যস্ততা ও প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি সমুদ্রের উন্নয়নে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক সম্পদের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সমুদ্রসম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের জন্য বঙ্গবন্ধু সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদের ২ নম্বর ধারা অনুযায়ী সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪ প্রণয়ন করেন। এই সমুদ্র আইনের সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি আমাদের অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪ প্রণয়নের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী সেশনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনাদর্শের একটি বিশেষ দিক ছিল সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সমুদ্রভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এই রাজনৈতিক দর্শনের প্রকাশ বঙ্গবন্ধুর জীবৎকালে বহুবার হয়েছে। আর ৫০ বছর পরও যখন তার প্রণীত টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট সমানভাবে প্রাসঙ্গিক থাকে, তখন বোঝা যায় এটি কতটা বাস্তবভিত্তিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিল। একই সাথে আয়োজিত সেমিনারে আলোচকরা বলেন, বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের তৃতীয় প্রতিবেশী। সমুদ্রপথে দক্ষিণ এশিয়ার গেটওয়ে হয়ে ওঠার সব সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। সমুদ্র বিজয়ের পর আমাদের জন্য সুযোগ এসেছে সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানোর। সমুদ্র বাণিজ্য, বন্দর ব্যবস্থাপনা, মৎস্য ও খনিজ সম্পদ আহরণ, ট্রান্সশিপমেন্ট-ট্রানজিট সেবা, অফশোর প্রকল্প ইত্যাদি বাংলাদেশের সুনীল অর্থনৈতিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠতে পারে।

১৯৭৪ সালে প্রণীত আইনটি বাংলাদেশের উপকূলীয় সামুদ্রিক সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা, জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, উপক‚লীয় অঞ্চল ব্যবস্থাপনা, সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা, সমুদ্র পরিবহন, মৎস্যসম্পদ ও সামুদ্রিক সুশাসনের মতো বিষয়গুলো নির্ধারণ করা সহজতর করেছে। সবচেয়ে বড় কথা, আইনটি বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণাধীন সমুদ্রাঞ্চলের বিভিন্ন জোনের সীমা নির্ধারণ, অধিকারের ব্যপ্তি, সুরক্ষা ও নিরাপত্তার রোডম্যাপ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। এটি বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের কতখানি অংশে সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, সেই অংশে দেশের স্বার্থ কীরূপ হবে এবং এই স্বার্থের সুরক্ষা হবে কীভাবেÑএসব বিষয় নির্ধারণে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল। এতে করে বাংলাদেশের জন্য স্বাধীনভাবে নিজেদের সমুদ্রসীমার ব্যবস্থাপনার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। এক কথায় বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চলে সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা, বহির্বিশে^র সাথে নিরবচ্ছিন্ন বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপন তথা দেশের সামুদ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির ভিত রচনা করেছিল এই আইন। সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্র অর্থনীতির জোয়ার ও ভূরাজনৈতিক পটপরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থনৈতিক গুরুত্বের কথা চিন্তা করলে দেখা যায়, বঙ্গোপসাগর শুধু ঐশ^র্যমণ্ডিত এক বিশাল লবণাক্ত জলরাশিই শুধু নয়, এটি ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ায় সম্ভাবনাময় একটি অবলম্বনও। সুবর্ণজয়ন্তীতে এই সমুদ্র আইন নিয়ে বিস্তারিত রয়েছে প্রধান রচনায়।

প্রিয় পাঠক, আমরা চাই এ দেশের মেরিটাইম চর্চাকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড় করাতে। বৈচিত্র্যময় আঙ্গিকে, সমৃদ্ধ কলেবরে বন্দরবার্তার পথচলা বাংলাদেশের মেরিটাইম খাতের বিকাশে আরও সহায়ক হবে সেই প্রত্যাশা। সবাইকে শুভেচ্ছা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here