দুনিয়া কাঁপানো জলদস্যুরা

মানব সভ্যতায় সামুদ্রিক বাণিজ্যের ইতিহাস যত পুরনো দস্যুতার গল্পও ততটাই প্রাচীন। মানব ইতিহাসের প্রতিটি ধাপে জলদস্যুদের দুঃসাহসিক অভিযানের বর্ণনা রয়েছে। উত্তাল সাগরকে মুঠোয় পুরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার সেসব রোমহর্ষক গল্প আজও মানুষকে বিমোহিত করে। বর্তমান প্রজন্ম নির্ভার, ফুর্তিবাজ ক্যারিবীয় দস্যু ক্যাপ্টেন জ্যাক স্পারোর হাত ধরে জলদস্যুতার সাথে পরিচিত হয়েছে। দুনিয়াজুড়ে লাখো কোটি ভক্তের মন জয় করা কাল্পনিক চরিত্র জ্যাক স্পারো যতটা অমায়িক বাস্তবজগতের দস্যুরা ঠিক ততটাই ক্রুর। ক্রুরতাকে হাতিয়ার করে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সাত সাগর পাড়ি দেওয়া বাণিজ্যিক নৌবহরের সর্বস্ব লুট করত তারা। বন্দি নাবিকদের ওপর চালাত অকথ্য নির্যাতন। উপকূলবাসী থেকে শুরু করে শক্তিশালী রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র পর্যন্ত দস্যুদের দুর্ধর্ষতায় তটস্থ থাকত।

সাগরের বুকে দস্যুতার ইতিহাস অন্তত চার হাজার বছর পুরনো। প্রাচীনকাল থেকে প্রতিটি সমুদ্রগামী সভ্যতাই জলদস্যু আক্রমণে জর্জরিত হয়েছে। উপকূলীয় রাষ্ট্রগুলো বছরের পর বছর কঠোর হাতে জলদস্যু দমন করে আসছে। তবে পরিস্থিতিভেদে শাসকগোষ্ঠীকে দস্যুদের সাথে সহযোগিতা ও সহনশীলতার পন্থাও অবলম্বন করতে হয়েছে। কালের পরিক্রমায় সিসিলিয়ান, গ্রিক, চীনা, বারবারি, ক্যারিবীয় জলদস্যু থেকে শুরু করে হাল আমলের দক্ষিণ চীন সাগর, মালাক্কা প্রণালী, পশ্চিম আফ্রিকা এবং সোমালি দস্যুরা হয় রাষ্ট্রযন্ত্রের সহযোগিতায় না হয় রাষ্ট্রে শাসনতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছে।

দস্যুতার পালাক্রম

জলদস্যুতার ইতিহাসকে পর্যায়ক্রমে ভাগ করলে প্রথমেই লুক্কান দস্যুদের কথা উঠে আসবে। মিশরীয়, সুমেরীয়, গ্রিকসহ প্রাচীন আমলের সকল জাতিগোষ্ঠী জলদস্যুদের সঙ্গে লড়াই করলেও মিশরীয় নথিপত্রে দস্যুতার প্রথম লিখিত নজির পাওয়া যায়। মিশরীয় নথিপত্রে খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দের লুক্কান জলদস্যুদের হামলার বিবরণ উঠে এসেছে। তুরস্কের ভূমধ্যসাগীয় উপকূল থেকে পূর্ব ভূমধ্যসাগরের সাইপ্রাসে হামলা চালাত লুক্কান দস্যুরা।

পরবর্তীতে লুক্কানদের উত্তরসূরি হিসেবে জলদস্যুতার ইতিহাসে ছাপ রেখে যান রানী তেউতা। স্বামীর মৃত্যুর পর আনুমানিক ২৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২২৮/২২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত বলকান অঞ্চলের প্রাচীন দেশ ইলিরিয়া শাসন করেন তিনি। দস্যু রানী হিসেবে পরিচিত তেউতা সিসিলি, উপকূলীয় গ্রিক উপনিবেশ এবং রোমানদের ওপর হামলা চালায়। দুই বছরব্যাপী যুদ্ধ শেষে রোমান নৌবহরের কাছে নতি শিকার করেন রানী তেউতা। পরবর্তীতে খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকে গোটা ভূমধ্যসাগরে সিসিলিয়ান দুস্যদের তাণ্ডব চলে। রোমান সামরাজ্যের পতনের আগ পর্যন্ত সিসিলিয়ান দস্যুদের দৌরাত্ম্য অব্যাহত ছিল। পরবর্তী প্রায় এক হাজার বছর চীনা, টিউটনিক ও ভাইকিং দস্যুরা সুনীল সাগরের বুকে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।

ভাইকিংয়ের আতঙ্ক কাটতে না কাটতেই দৃশ্যপটে বারবারি দস্যুদের আগমন ঘটে। বারবারি জলদস্যুরা কয়েক শতাব্দী ধরে ভূমধ্যসাগর ও ইউরোপের উপকূলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিল। বাণিজ্যিক জাহাজ ও উপকূলীয় শহর ছিল তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু। বারবারি দস্যুরা গোটা ইউরোপে প্রায় ১৫ লাখ মানুষকে বন্দি করে। কিছু সংখ্যক বন্দির থেকে মুক্তিপণ আদায় করলেও অধিকাংশকে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করা হয়। ১৮৩০ সালে ফরাসিরা উত্তর আফ্রিকা আক্রমণ করায় বারবারি যুগের অবসান ঘটে।

১৫০০ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ইউরোপের ঔপনিবেশিক শাসন যখন ছড়িয়ে পড়ে তখন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে ক্যারিবীয় দস্যুদল। ইউরোপের পরাক্রমশালী রাষ্ট্র কর্তৃক জলদস্যুতা বৈধকরণ, নৌযুদ্ধে দক্ষ নাবিকদের দস্যুদলে যোগদান, জলদস্যু বন্দরের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ নানা কারণে দস্যুরা সে সময় বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। বুকেনিয়ার ও প্রাইভেটিয়াদের দুঃসাহসিক সব অভিযান সফল হওয়ায় সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে অষ্টাদশ শতকের ত্রিশের দশক পর্যন্ত সোনালি সময় পার করে দস্যুরা। জলদস্যুতার স্বর্ণযুগে প্রায় পাঁচ সহস্রারাধিক দস্যু পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ সব নৌপথে বিচরণ করে। ক্যারিবীয় অঞ্চলে উপনিবেশকারী পশ্চিম ইউরোপীয় ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর নৌবাহিনী ১৯ শতকের শুরুর দিকে জলদস্যু নিধনের অভিযান শুরু করে। নৌবাহিনীর ধরপাকড় ও বিচারের সম্মুখিন হয়ে ক্যারিবীয় জলদস্যুদের দাপট কমতে শুরু করে।

ক্যারিবীয়দের পতনের পর দীর্ঘ সময় সাগর পথে জলদস্যুতার দাপট কিছুটা স্তিমিত ছিল। ২১ শতকে গিনি উপসাগর, মালাক্কা প্রণালী, সুলু ও সেলেবস সাগর এবং ভারত মহাসাগরসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে জলদস্যুদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও টালমাটাল অর্থনীতির জেরে নতুন সহস্রারাব্দের শুরুতে এডেন উপসাগর ও ভারত মহাসাগরে সোমালি দস্যুদের তৎপরতা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। আন্তর্জাতিক মহলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ২০১০-এর দশকে সোমালি জলদস্যুতা নিয়ন্ত্রণে এলেও অতি সম্প্রতি তারা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

ইতিহাসে সাড়া জাগানো দস্যুদল

হাজার বছর ধরে ত্রাস সৃষ্টিকারী জলদস্যুদের ঘিরে মানুষের আকর্ষণ বরাবরই বেশ তীব্র। বিপদসংকুল সাগরে দুর্ধর্ষ ও রোমাঞ্চকর অভিযান পরিচালনা করে বেশকিছু জলদস্যু ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছে। তাদের ভয়াবহ কার্যক্রম ও গুপ্তধনের কিস্সা এখনো লোকমুখে ঘুরে ফেরে।

স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক

সমুদ্রপথে বিশ্বভ্রমণকারী দ্বিতীয় ব্যক্তি ফ্রান্সিস ড্রেক ১৫৪০ সালে ইংল্যান্ডের ডেভনশায়ারে জন্মগ্রহণ করেন। নিজ দেশে জাতীয় বীরের মর্যাদাপ্রাপ্ত ফ্রান্সিস ড্রেক গোটা বিশ্বের কাছে একজন লুটেরা জলদস্যু হিসেবেই পরিচিত। আটলান্টিক মহাসাগরে দাস ব্যবসার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। সে সময় ইংল্যান্ডের শাসনভার ছিল রানী প্রথম এলিজাবেথের হাতে। ভঙ্গুর অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চারে মরিয়া এলিজাবেথ জলদস্যুতাকে বৈধতা প্রদান করেন। রানীর প্রশ্রয়ে প্রাইভেটিয়ার বাহিনী তখন স্প্যানিশ বাণিজ্য বহরে লুটতরাজ চালাত। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় যেসব প্রাইভেটিয়ার লুটপাটের অভিযান চালাতেন ফ্রান্সিস ড্রেক ছিলেন তাদের অন্যতম। তিনি রানীর এতটাই বিশ্বাসভাজন ছিলেন যে, ১৫৭৭ সালে নতুন সমুদ্রপথ অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে পরিচালিত দুঃসাহসিক অভিযানের দায়িত্ব বর্তায় তার ওপর।

১৫৭৭ থেকে ১৫৮০ সাল পর্যন্ত চলমান সেই ঐতিহাসিক সমুদ্রযাত্রায় প্রথম ইংরেজ ক্যাপ্টেন হিসেবে পৃথিবীকে একপাক ঘুরে আসেন ড্রেক। রোমঞ্চকর সেই অভিযানে বহরের পাঁচটির ভেতর চারটি জাহাজ খোয়ালেও একাধিক স্প্যানিশ বন্দরে লুটপাট চালান তিনি। সেসঙ্গে বিপুল ধনসম্পদে ভরপুর একটি স্প্যানিশ জাহাজ আটক করেন ড্রেক। ড্রেকের ত্রাসে তটস্থ স্প্যানিশরা তার নাম দেয় ‘এল ড্রাকো’ বা দ্য ড্রাগন। অন্যদিকে ফ্রান্সিস ড্রেকের সাফল্যে উচ্ছ¡সিত রানী তৎক্ষণাৎ ‘নিজের খাস দস্যু’কে নাইট উপাধিতে ভ‚ষিত করেন। এই ঘটনার আট বছর পর স্পেনিয়ার্ডদের সাথে ব্রিটিশদের নৌযুদ্ধে স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক ভাইস এডমিরালের দায়িত্ব পালন করেন এবং স্প্যানিশ আরমাডাকে পরাজিত করেন। তবে রানী এলিজাবেথের সি ডগ বাহিনীর সবচেয়ে সফল প্রাইভেটিয়ার জীবনের শেষ অভিযানগুলোয় ব্যর্থ হন। ১৫৯৩ সালে রক্ত আমাশয়ে ভুগে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

ক্যাপ্টেন কিড

দস্যুতার অভিযোগে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলা উইলিয়াম কিড আদৌ কুখ্যাত জলদস্যু ছিলেন কি না তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, ইংরেজ প্রশাসন ও প্রাইভেটিয়ারদের দ্বন্দ্বে প্রাণ হারান তিনি। ১৬৫৪ সালে স্কটল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন উইলিয়াম কিড। শিক্ষানবিশ নাবিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করা কিড পরবর্তীতে ইংরেজ শাসিত নিউইয়র্ক সিটিতে থিতু হন। সে সময় প্রাইভেটিয়ার হিসেবে সাগরের বুকে দুঃসাহসী সব অভিযান চালান তিনি।

জলদস্যুতার স্বর্ণযুগে নিউইয়র্ক, ম্যাসাচুসেটস ও নিউ হ্যাম্পশায়ারে দস্যুদের দৌরাত্ম্য ক্রমেই বাড়তে থাকায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে ব্রিটিশ প্রশাসন। এমন অবস্থায় ১৬৯৫ সালে অত্র এলাকার গভর্নর রিচার্ড কুট দস্যু দমনে উইলিয়ামকে নিযুক্ত হতে বলেন। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগা কিড পরবর্তীতে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর অফিসারদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে যান। এছাড়া লাগাতার ব্যর্থ অভিযানে জেরবার হন তিনি। সে সময় বেশকিছু নাবিক কিডের জাহাজ অ্যাডভেঞ্চার গ্যালারি ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং থেকে যাওয়া সহযোগীদের সঙ্গে তার বিরোধের সৃষ্টি হয়। ওলন্দাজ বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালানোকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া মতবিরোধের জেরে ১৬৯৭ সালে কিডের গুলিতে প্রাণ হারায় তারই অধীনে থাকা এক নাবিক।

পালিয়ে যাওয়া নাবিকদের বদৌলতে ইংল্যান্ডে কিড তখন এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। দুর্ধর্ষ ও রোমাঞ্চরকর সব দস্যু অভিযান ও লুটপাটের আখ্যান ক্যাপ্টেন কিডকে ইংরেজদের কাছে উপকথায় পরিণত করে। ইংল্যান্ডে নিজের অবস্থান সম্পর্কে অজ্ঞাত কিড ১৬৯৮ সালে গুরুতর এক দোটানার মুখে পড়েন। ভারত থেকে আগত বিপুল ধনভাণ্ডার বোঝাই এক ফরাসি বাণিজ্য তরী কিডের জাহাজের কাছে এলে তার নাবিকেরা সেটা লুটপাটে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ফরাসি জাহাজটির নেতৃত্বে ছিলেন একজন ইংরেজ ক্যাপ্টেন। ইংরেজ ক্যাপ্টেনের জাহাজে লুটতরাজ চালানো দেশদ্রোহের শামিল বলে এর বিরোধিতা করেন কিড। তবে নিজ দলের নাবিকদের চাপের মুখে বাধ্য হয়ে জাহাজটির দখল নেন তিনি। যা তাকে ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছে একই সাথে জলদস্যু ও দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ১৬৯৯ সালে ক্যাপ্টেন কিডকে গ্রেপ্তার করেন গভর্নর কুট। প্রায় দুই বছর কারাভোগের পর ১৭০১ সালের ২৩ মে লন্ডনের ওয়াপিং এলাকার এক্সিকিউশন ডকে ক্যাপ্টেন কিডের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।

কিডের ফাঁসিকে ঘিরেও এক নাটকীয়তার সৃষ্টি হয়। প্রথম দফা ফাঁসির দড়ি ছিঁড়ে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। উপস্থিত জনতার একাংশের কাছে দড়ি ছিঁড়ে যাওয়ার ঘটনা দৈব সংকেত হিসেবে বিবেচিত হয়। তারা নির্দোষ কিডের মুক্তি কামনা করলেও সিদ্ধান্তে অনড় ব্রিটিশ প্রশাসন দ্বিতীয় দফায় কিডকে ফাঁসিতে ঝোলায়। দেশদ্রোহিতার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে দস্যুদের সচেতন করতে টেমস নদের টিলবুরি পয়েন্টে ক্যাপ্টেন কিডের মৃতদেহ প্রায় তিন বছর পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখা হয়।  

ব্ল্যাকবিয়ার্ড

জলদস্যুতার প্রসঙ্গ উঠলে অবশ্যম্ভাবীভাবে চলে আসে ব্ল্যাকবিয়ার্ডের নাম। প্রথম জীবনে অ্যাডওয়ার্ড টিচ নামে পরিচিত এই জলদস্যু ১৬৮০ সালে ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে জন্মগ্রহণ করেন। ১৭১৪ সালে স্প্যানিশ যুদ্ধ শেষ হলে আরও অনেক প্রাইভেটিয়ারের মতো টিচও জলদস্যু দলে যোগ দেন। ১৭১৬ থেকে ১৭১৮ মাত্র দুই বছর দস্যুবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও ব্ল্যাকবিয়ার্ডের দুর্ধর্ষতা বছরের পর বছর নাবিকদের মনে ভীতির সঞ্চার করেছে। ১৭১৭ সালে একটি ফরাসি জাহাজ দখল করে তাতে বিভিন্ন দেশের ৪০টি বিশালাকার কামান যুক্ত করেন তিনি। দখলকৃত জাহাজের নতুন নামকরণ (কুইন অ্যান’স রিভেঞ্জ) করে বিভীষিকার নতুন অধ্যায় শুরু করেন ব্ল্যাকবিয়ার্ড। ক্যারিবীয় ও আটলান্টিক মহাসাগরে লুটতরাজ চালিয়ে বিপুল ধনসম্পদের মালিক হন তিনি।

১৭১৮ সালে টানা চারদিন চার্লস্টন বন্দর নিজের দখলে রাখেন ব্ল্যাকবিয়ার্ড। এ সময় বন্দরে থাকা প্রতিটি জাহাজে লুটপাট চালানো হয়। পরবর্তীতে নর্থ ক্যারোলিনার গভর্নরের থেকে সাধারণ ক্ষমা আদায় করে অবসরে যান তিনি। অবসর থেকে পুনরায় দস্যুতায় ফিরে এলে পাইরেট হান্টারদের শিকার হন ব্ল্যাকবিয়ার্ড। ১৭১৮ সালের ২২ নভেম্বর উত্তর ক্যারোলিনার ওক্রাকোক দ্বীপে ১৯ জন সহযোগীসমেত মারা পড়েন তিনি। ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর এই দস্যু সবসময় নিজের শরীরে ছয়টি লোড করা পিস্তল, কোমরে কাটলাস ও হাতে মাস্কেট রাইফেল বহন করতেন। কথিত আছে, নাবিকদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টির লক্ষ্যে নিজের দাড়িগুলো পাকিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে রাখতেন তিনি। দাড়ি থেকে বের হওয়া কালো ধোঁয়াই তাকে ব্ল্যাকবিয়ার্ড নামে পরিচিত করে তোলে।

ক্যালিকো জ্যাক র‍্যাকহাম

ক্যালিকো জ্যাক র‍্যাকহামকে ছাড়া বিশ্বের দুর্ধর্ষ দস্যুর তালিকা অসম্পূর্ণ। ১৭১৮ সালে জলদস্যু চার্লস ভেইনের জাহাজে কোয়ার্টারমাস্টার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে র‍্যাকহাম। সে বছরই কাপুরুষতার অভিযোগে ভেইনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেন বনে যান তিনি। ক্যাপ্টেন হওয়ার পর র‍্যাকহাম ছোটখাটো বাণিজ্যিক জাহাজ লুট করেন। কিছুদিন এভাবে চলার পর নিজের প্রধান জাহাজ হিসেবে ১২ কামানবিশিষ্ট কিংস্টনকে বেছে নেন তিনি। দস্যুতার বছর পেরুতে না পেরুতেই কিউবার ইসলা দে লা পিনোসের কাছে লুণ্ঠিত ধনভাণ্ডারসমেত কিংস্টনকে খোয়াতে হয়। ১৭১৯ সালে ধরা পড়ার পর নাসাউয়ের গভর্নরের কাছে সাধারণ ক্ষমার আর্জি জানান র‍্যাকহাম। র‍্যাকহাম দাবি করেন, ভেইনের চাপে বাধ্য হয়ে তিনি দস্যুতায় জড়িয়েছেন। গভর্নরের ক্ষমা লাভের পর বন্দরে অবস্থান করেন তিনি। সে সময় তিনি নাবিক জেমস বনির স্ত্রী অ্যান বনির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যান। এর কিছুদিন পর জাহাজ চুরি করে অ্যান বনি ও অন্যান্য সহযোগীদের নিয়ে ফের সাগরে ভেসে পড়েন র‍্যাকহাম।

পুনরায় দস্যু অভিযান শুরুর পর পুরুষের ছদ্মবেশে থাকা নারী দস্যু মেরি রিড ক্যারিবীয় অঞ্চলে তার জাহাজে আটকা পড়ে। রিড র‍্যাকহামের দলে যুক্ত হওয়ার পর তার বাহিনীর দস্যুতার মাত্রা আরও তীব্রতর হয়। র‌্যাকহাম ও তার দুই নারী সহযোগীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাহামার গভর্নর তাদের গ্রেপ্তারের আদেশ দেন। দুই বছরে অসংখ্য জাহাজ লুণ্ঠন ও ধ্বংসকারী র‍্যাকহাম অবশেষে পুরো দলসহ পাইরেট হান্টার জনাথন বারনেটের কাছে ধরা পড়েন। নিজেদের অন্তঃসত্ত্বা দাবি করা অ্যান বনি ও মেরি রিড সেযাত্রা প্রাণে রক্ষা পেলেও ফাঁসিতে ঝোলেন র‍্যাকহাম।

বাহামা ও কিউবায় দস্যু অভিযান চালানো র‍্যাকহাম সবসময় ক্যালিকো কাপড়ের পোশাক পরতেন বলে লোকে তার নামের আগে ‘ক্যালিকো’ তকমা জুড়ে দেয়। ক্যালিকো কাপড়ের পাশাপাশি জলদস্যুদের চিহ্ন হিসেবে পরিচিত জলি রজার পতাকার জন্যও তিনি বিখ্যাত। কথিত আছে মড়ার খুলি ও তলোয়ার-সংবলিত হাড় হিম করা পতাকাটা র‍্যাকহামের মস্তিষ্কপ্রসূত। যদিও ইতিহাস ঘেঁটে এর কোনো অকাট্য প্রমাণ মেলেনি।

অ্যান বনি ও মেরি রিড

আইরিশ নারী অ্যান পুরুষশাসিত দস্যু দুনিয়ায় রীতিমতো দাপটের সাথে ছড়ি ঘুরিয়েছেন। ১৭১৮ সালে নাবিক জেমস বনির সাথে অ্যানের বিয়ে হয়। স্বামীর হাত ধরে জলদস্যুদের অভয়ারণ্যখ্যাত বাহামার নাসাউতে আসেন তিনি। এখানেই দুর্ধর্ষ দস্যু র‍্যাকহামের সাথে পরিচয় এবং প্রণয়। প্রেমিকের সান্নিধ্যে সামাজিক রীতি-নীতিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে জলদস্যুর খাতায় নাম লেখান তিনি। মজার ব্যাপার হলো, প্রেমের টানে স্বামীকে ছেড়ে দস্যুতায় জড়ালেও শেষ অবধি তার পদবি ধরে রেখেছিলেন অ্যান।

পুরুষের ছদ্মবেশে র‍্যাকহামের সঙ্গে ক্যারিবীয় অঞ্চলে ধ্বংসলীলা চালান অ্যান বনি। অ্যানের মতোই ছদ্মবেশধারী আরেক নারী দস্যু মেরি রিড র‍্যাকহামের হাতে আটক হন। জীবনযুদ্ধে পোড় খাওয়া মেরি কিশোরী বয়স থেকেই পুরুষের ছদ্মবেশকে রক্ষাকবজ হিসেবে ব্যবহার করতেন। নানা ঘাত-প্রতিঘাত শেষে ভালোবাসার মানুষের সাথে সুখের স্বপ্ন বোনা মেরির স্বপ্নভঙ্গ হতে দেরি হয়নি। স্বামীর অকাল মৃত্যুর পর ভাগ্য অন্বেষণে ওয়েস্ট ইন্ডিজগামী জাহাজে চেপে বসেন মেরি। জাহাজে দস্যু হামলা হলে সাগ্রহে তাদের দলে ভিড়ে যান তিনি। পরবর্তীতে ঘটনাচক্রে র‍্যাকহামের জাহাজে আটক হন। সেখানেও পরিচয় গোপন রেখে র‍্যাকহামের দলে যোগ দেন মেরি। ভাগ্যের ফেরে দস্যুতায় জড়িয়ে পড়া দুই নারীর মাঝে অচিরেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অ্যানের সঙ্গে বন্ধুত্বের সুবাদে তার কাছে নিজের আসল পরিচয় উন্মোচন করেন মেরি। আত্মপ্রত্যয়ী অ্যান ও মেরি নিজেদের কাক্সিক্ষত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ছিলেন দ্ব্যর্থহীন। যোদ্ধা ও নাবিক হিসেবে তাদের দক্ষতা রাতারাতি দুজনকে কিংবদন্তিতে পরিণত করে। তাদের মিলিত আগ্রাসন মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে একপর্যায়ে র‌্যাকহামের অন্যান্য ক্রুদের সাথে অ্যান ও মেরিও পাইরেট হান্টারের হাতে বন্দি হন। বিচারকার্য শুরু হওয়ার পর সকলের সামনে মেরির পরিচয় উন্মুক্ত হয়। বিচারে মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত অ্যান ফাঁসির মঞ্চ থেকে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে ভোজবাজির মতো উবে যাওয়া অ্যানের আর কোনো সন্ধান মেলেনি। অন্যদিকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার আগে কারাগারেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মেরি। সংক্ষিপ্ত দস্যুজীবনের পরিণতি যা-ই হোক না কেন, নারী দস্যু হিসেবে অ্যান ও মেরির সাহসিকতার আখ্যান এখনো কান পাতলে শোনা যায়।

চেং শি

জলদস্যুতার ইতিহাসে সবচেয়ে সফল দস্যুর মুকুটটিও ঝুলিতে পুরেছেন একজন নারী। পতিতাবৃত্তি থেকে দক্ষিণ চীন সাগরে ১৮০০ দস্যু জাহাজের নেতৃত্ব প্রদানকারী চেং শির জীবন কাহিনী যেন সিনেমার কাহিনীকেও হার মানায়। চীনের গুয়াংদন প্রদেশে ১৭৭৫ সালে শি ইয়াংয়ের জন্ম। শির ছেলেবেলা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা না গেলেও কথিত আছে কিশোরী বয়স থেকেই ডাকসাইটে সুন্দরী ছিলেন তিনি। চীনের দক্ষিণাঞ্চলের টানকা সম্প্রদায়ের শি দরিদ্রতার কারণে গুয়াংদনের ভাসমান পতিতালয়ে পতিতাবৃত্তি শুরু করেন। আর সেখানেই চীনের প্রবল প্রতাপশালী জলদস্যু চেং য়ি-এর সঙ্গে শিয়ের পরিচয়। শিয়ের সৌন্দর্যে মুগ্ধ পরিচয়ের অল্প কিছুদিনের মাথায় তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। ১৮০১ সালে য়ি এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন শি। তাদের বিয়ে নিয়ে নানা মতবাদ প্রচলিত থাকলেও একটা বিষয়ে দ্বিমত নেই। সুন্দরী শি আর দশজন সাধারণ নারীর মতো ঘরকন্নাতেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। জলদস্যু স্বামীর দস্যু অভিযানে কৌশলগত অংশীদারিত্ব ও লুটের মালে সমান মালিকানা লাভের শর্তে তাকে বিয়ে করেন শি।

বিয়ের পর য়ি কুখ্যাত ‘রেড ফ্ল্যাগ ফ্লিটের’ দস্যু অভিযান চালালেও এর ব্যবসায়িক দিক সামলানোর দায়িত্ব ছিল শির ওপর। নিজের ক্ষমতা জোরদার করতে প্রতিদ্বন্দ্বী জলদস্যু দলগুলোকে নিয়ে জোট গঠন করেন য়ি। জোটের বহরে তখন নাবিক সংখ্যা ছিল ৭০ হাজার। যেকোনো নৌবাহিনীকে টক্কর দেওয়ার মতো প্রতাপ জোট গঠনে য়ি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেও বুদ্ধিমতি শি এর নেপথ্যে ছিলেন। দক্ষিণ চীন সাগরে য়ি-এর ত্রাস যখন চরমে তখনই তার ওপর দুর্ভাগ্যের খড়গ নেমে আসে। ভিয়েতনাম উপকূলে ঝড়ের কবলে পড়ে প্রাণ হারান য়ি। বিয়ের ছয় বছরের মাথায় স্বামী হারানো শি এরপর থেকে ‘চেং শি’ বা চেংয়ের বিধবা নামে পরিচিতি লাভ করেন।

য়ি-এর আকস্মিক মৃত্যুর পর জোটের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শি। দায়িত্ব লাভের পর নিয়মকানুন কিছুটা সংস্কার করেন তিনি। লুটেরা জাহাজকে লুণ্ঠিত সম্পদের ২০ শতাংশ নিজেদের দখলে ও বাকি ৮০ শতাংশ দস্যুদের সামগ্রিক তহবিলে জমার দেওয়ার নির্দেশ দেন শি। সেসঙ্গে অবশ্য পালনীয় নিয়ম ভঙ্গ করলে দস্যুদের প্রথমে কান কাটা ও পরবর্তীতে ধড় থেকে মাথা আলাদা করার সাজা দিতেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, লুণ্ঠিত এলাকার নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতেও সচেষ্ট ভূমিকা পালন করেন শি। শর্তসাপেক্ষে সুন্দরী নারী বন্দিদের বিয়ে এবং বাকি নারীদের নিরাপদে মুক্ত করার সমন জারি করেন তিনি। পালকপুত্র চ্যাং পাওয়ের সহযোগিতায় সুচারুরূপে কর্মক্ষম দস্যু জোটটিকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দেন শি।

পাইরেট কুইন শিয়ের আধিপত্য গোটা অঞ্চলে এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে, তাকে নির্মূল করতে নড়েচড়ে বসে চীনা রাজবংশ। ব্রিটেন ও পর্তুগালের সহায়তা নিয়ে চীনা রাজবংশ শিকে পরাজিত করার চেষ্টা চালায়। শিয়ের ১৮০০ জাহাজের বিশাল বহরের কাছে ত্রিমুখী শক্তির আক্রমণ ধোপে টেকেনি। উল্টো সম্মিলিত রাজকীয় বাহিনীর ৬০টি জাহাজ দস্যুদের দখলে চলে যায়। শিকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়ে সমঝোতার পথে হাঁটে চীনা রাজবংশ। ধারণা করা হয়, জোটের ভেতর বাড়তে থাকা অন্তরদ্বন্দ্ব ও দস্যুজীবনের প্রতি অনাগ্রহের কারণে সমঝোতায় রাজি হন শি। সমঝোতা অনুযায়ী, লুটের মাল নিজের কাছে রাখার অনুমতি পেলেও তার অধীনে থাকা অঞ্চলগুলো রাজবংশের কাছে হস্তান্তর করেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, সমঝোতার ফলাফল হিসেবে পালকপুত্র চ্যাং পাওকে বিয়ে করেন শি। সমঝোতার পর তিনি লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান। ইতিহাস কাঁপানো এই দস্যুরানী ১৮৪৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

উপসংহার

প্রাচীন আমলে জলদস্যুতা অনেকটা ‘ওয়ান ম্যান শো’ হলেও কালের বিবর্তনে এর ধরন বদলেছে। আধুনিক যুগে জলদস্যু অভিযান অনেকটাই দলগত কাজে পরিণত হয়েছে। যার ফলে বিগত কয়েক দশকে সুনির্দিষ্ট কোনো দস্যুর নামে নতুন কোনো বীরোচিত আখ্যান রচিত হয়নি। হাল আমলে বাণিজ্যিক নৌবহরকে আতঙ্কে তটস্থ করে রাখা সোমালি দস্যুরাও দলবদ্ধভাবে পর্যায়ক্রমে কাজ করে। যার ফলে মোহাম্মদ আবদি হাসানের মতো সোমালি দস্যু আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারলেও ইতিহাসের পাতায় চেং শি বা ব্ল্যাকবিয়ার্ডের মতো অমরত্ব লাভ করেননি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here