সম্পাদকীয়

বিমাকারী, নিরাপত্তা সামগ্রী ও নিরাপত্তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, মধ্যস্থতাকারী এবং জলদস্যুদের ওপর লগ্নিকারীসহ আরও অনেক পক্ষই জলদস্যু অর্থনীতির জটিল মিথস্ক্রিয়ায় জড়িয়ে আছে

বৈশ্বিক নৌবাণিজ্য বিকাশের সাথে জলদস্যুতার ইতিহাসের রয়েছে ওতপ্রোত সম্পর্ক। সেই প্রাচীনকাল থেকেই সাগরের মূর্তিমান আতঙ্ক জলদস্যুরা। সে সময় এজিয়ান ও ভূমধ্যসাগরে চলাচলকারী জাহাজকে লক্ষ্য করে হামলা চালাত দস্যুরা। গ্রিক, রোমান ও কার্থাজিনিয়ানদের মতো ফিনিশিয়রাও একই সাথে বাণিজ্য ও দস্যুতার সঙ্গে যুক্ত ছিল। উত্তর দিক থেকে আগত ভাইকিং ও দক্ষিণ থেকে আগত মুররা মধ্য যুগে দস্যুবৃত্তিতে যুক্ত হয়। রেনেসাঁ ও রেনেসাঁ-পরবর্তী যুগে ইউরোপে বেশকিছু যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। সেসব যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী জাহাজের অনেক নাবিক কাজ হারিয়ে জলদস্যু দলে যোগ দেয়। পরবর্তীকালে জলদস্যুতা বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে যায়। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে দস্যুতার ধরন বদলেছে। চোরাচালান ও অবৈধ কার্যকলাপে জড়িত অপরাধী সংগঠনের সহযোগিতায় বিশ শতকের শেষ দশকে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং আফ্রিকার পশ্চিমাঞ্চলে সামুদ্রিক জলদস্যুতার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ২০০৮-০৯ সালে আফ্রিকা উপকূলে, বিশেষত সোমালিয়া উপকূলে জলদস্যু হামলার ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। মাঝে কয়েক বছর কমলেও ২০২৩ সালের শেষের দিকে মধ্যপ্রাচ্যে শুরু হওয়া যুদ্ধের জেরে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে লোহিত সাগর ও সুয়েজ খালের মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটি বাণিজ্যপথ। নৌপরিবহন খাতে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতার সুযোগে সোমালি জলদস্যুরা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। গত পাঁচ মাসে মাল্টার-পতাকাবাহী বাণিজ্যিক জাহাজ এমভি রুয়েন ও বাংলাদেশের পতাকাবাহী এমভি আবদুল্লাহসহ ছোট-বড় অন্তত ১৪টি নৌযান ছিনতাই করেছে সোমালি দস্যুরা। কয়লাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার পর মালিকপক্ষ ও বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় মাত্র ৩৩ দিনের মাথায় ২৩ জন নাবিক বন্দিদশা থেকে মুক্তি লাভ করেন। এর আগে ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর প্রায় ৪১ হাজার মেট্রিক টন নিকেলের আকরিক নিয়ে আরব সাগর পাড়ি দেওয়ার সময় দস্যুদের কবলে পড়ে বাংলাদেশি পতাকাবাহী বাণিজ্যিক জাহাজ এমভি জাহান মনি। মুক্তিপণ পাওয়ার পর ১৩ মার্চ ভোরে অর্থাৎ দীর্ঘ ১০০ দিন পর ২৬ জন জিম্মিসহ জাহাজটিকে মুক্ত করে দেয় জলদস্যুরা। জলদস্যু হামলা আচমকা বেড়ে যাওয়ায় নড়েচড়ে বসেছে বৈশ্বিক মেরিটাইম খাত। কোনো ধরনের রক্তপাত ছাড়াই নাবিকসহ জিম্মি জাহাজগুলো উদ্ধার করা গেলেও জলদস্যুদের তৎপরতা বৃদ্ধি-সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে।

বিস্তীর্ণ সাগরে যেকোনো নৌযানকে শতভাগ নিরাপত্তা প্রদান করা বর্তমানে প্রায় অসম্ভব। তা সত্তে¡ও আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে জলদস্যু দমনে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে প্রয়োজন অনুযায়ী সেসব উদ্যোগ হালনাগাদ করা হয়। আনক্লসের ১০০ থেকে ১১০ ধারায় জলদস্যুতা বিষয়ক আইনগুলোকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে আরব সাগর ও ভারত মহাসাগরে দস্যুদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ায় সোমালি জলদস্যুদের প্রতিহত করতে সাতটি রেজ্যুলেশন পাস করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। রেজ্যুলেশনে সোমালিয়ার জলসীমায় বিদেশি বিমান ও নৌবাহিনীকে প্রবেশ ও টহলের অনুমতি দেওয়া হয়। সেসঙ্গে ইউএস নেতৃত্বাধীন টাস্কফোর্স ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌ-অপারেশন আটলান্টাকে অনুমোদন দেওয়া হয়। হর্ন অব আফ্রিকা উপকূল থেকে ভারত উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে বর্তমানে প্রায় ২৫টি দেশের নৌবাহিনী উপস্থিত রয়েছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অঞ্চলটিতে নিরাপদ নৌ-চলাচলের জন্য এই নজরদারি এখনও অপ্রতুল।

ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরোর (আএমবি) সমীক্ষা অনুযায়ী, সমুদ্রে জলদস্যুতার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতি প্রতি বছর প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির মুখে পড়ে। রিসার্চঅ্যান্ডমার্কেট.কমের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে মেরিটাইম সেফটি মার্কেট ১ হাজার ৯৮৫ কোটি ডলার হলেও ২০২৪ সালে সেটা ২ হাজার ১১৮ কোটি ডলারে পরিণত হবে। বর্তমানে কোনো দেশ সরাসরি দস্যুবৃত্তির সঙ্গে না জড়ালেও বিমাকারী প্রতিষ্ঠান, নিরাপত্তা সামগ্রী উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান, নিরাপত্তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, মধ্যস্থতাকারী এবং জলদস্যুদের ওপর লগ্নিকারী ব্যক্তিসহ আরও অনেক পক্ষই জলদস্যু অর্থনীতির জটিল মিথস্ক্রিয়ায় জড়িয়ে আছে। জাহাজ মালিক ও শিপিং কোম্পানির সাথে পাল্লা দিয়ে দস্যুরাও নিজেদেরকে প্রযুক্তিগতভাবে অত্যাধুনিক করে তুলছে। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক নজরদারি এড়িয়ে তারা তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। এমন অবস্থায় জাহাজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানোর পাশাপাশি স্যাটেলাইট ও এআই প্রযুক্তির সাহায্যে ওই অঞ্চলে উপস্থিত নৌবাহিনী ও আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ও পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করে জলদস্যুতা কমিয়ে আনা যেতে পারে। সাগরে জলদস্যুতার আদ্যোপান্ত নিয়ে রয়েছে এবারের প্রধান রচনা। প্রিয় পাঠক, আমরা চাই এ দেশের মেরিটাইম চর্চাকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড় করাতে। বৈচিত্র্যময় আঙ্গিকে, সমৃদ্ধ কলেবরে বন্দরবার্তার পথচলা বাংলাদেশের মেরিটাইম খাতের বিকাশে আরও সহায়ক হবে সেই প্রত্যাশা। সবাইকে শুভেচ্ছা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here