সেই তৃতীয় শতক থেকে নাবিকদের কাছে লিউজিয়াগ্যাং বন্দর নামে পরিচিত হলেও নব্বইয়ের দশকে এসে চীনের জিয়াংশু প্রদেশের ব্যস্ততম বন্দরটির নতুন নামকরণ হয় তাইচাং। নানটং বন্দর থেকে ৩৩ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণ-পূব এবং সাংহাই বন্দর থেকে উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত তাইচাং ইয়াংজি নদীব্যবস্থার অন্তর্গত বন্দর। উর্বর নদী মোহনার তীরে হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে মূলত কৃষিপণ্যের আমদানি-রপ্তানি করেছে তাইচাং। দিগন্ত বিস্তৃত কৃষিজমির কারণে নাম রাখা হয়েছিল তাইচাং, মান্ডারিন চাইনিজ ভাষায় যার অর্থ ‘সবুজ প্রকৃতি’। চাল, তেলবীজ, তুলা, গবাদিপশু এবং মৎস্যসম্পদ ছিল এখানকার প্রধান রপ্তানি পণ্য। সময়ের পালাবদলে প্রথমে শিল্পায়ন এবং পরবর্তীতে বিশ্বায়নের প্রভাবে ‘স্টেট ফার্স্ট ক্লাস পোর্ট অ্যান্ড কনটেইনার ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট’ মর্যাদা পাওয়া বন্দরটি বর্তমানে চীনের অন্যতম প্রধান বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্র।
সাংহাই ইন্টারন্যাশনাল শিপিং সেন্টারের উত্তর বাহু হিসেবে ট্রাংক লাইন কনটেইনার পোর্ট হয়ে কাজ করছে তাইচাং বন্দর। ইয়াংজি নদীর তীর বরাবর ৩৮.৮ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা অত্যাধুনিক গভীর ড্রাফটের বার্থসংবলিত বন্দরটির স্থিতিশীল শোরলাইন থাকায় কনটেইনার ট্রান্সশিপমেন্ট হাব পোর্ট হিসেবে বিশে^ অন্যতম আদর্শ অবস্থানে আছে। সর্বশেষ প্রকাশিত ২০২০ সালের ব্যস্ততম শত বন্দরের লয়েড’স তালিকায় এ বন্দরের অবস্থান ৩০তম। ১৯৯১ সালে গঠিত তাইচাং ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট জোন গঠনের পর অটোমোবাইল, মেশিনারি এবং ইলেকট্রনিকের মতো ভারী শিল্পে প্রচুর জার্মান বিনিয়োগ আসতে থাকে। উপযুক্ত সরকারি সহায়তা এবং নিরবচ্ছিন্ন সাপ্লাই চেইনের কল্যাণে অন্যান্য দেশের বৃহৎ শিপিং কোম্পানিগুলোও এখানে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। মূলত এ সময় থেকেই তাইচাং বন্দরের আধুনিকায়নের যাত্রা শুরু।
মূলত কনটেইনার বন্দর হলেও ড্রাই বাল্ক কার্গো এবং পেট্রোকেমিক্যাল পণ্যও হ্যান্ডল করে তাইচাং। মোট ৪৮টি বার্থ আছে এখানে, যার মধ্যে ২৪টিতে ১০ হাজার ডিডব্লিউটি ধারণক্ষমতার জাহাজ ভিড়তে পারে। বছরে ৭৬ মিলিয়ন টন কার্গো এবং ২.৩৫ মিলিয়ন টিইইউ কনটেইনারবাহী কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের সুবিধা আছে এখানে। মোট ২ হাজার ৮০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ১০টি কনটেইনার বার্থে ১২৫ হেক্টর কনটেইনার ইয়ার্ড, ৭.৫ হেক্টর বন্ডেড ওয়্যারহাউস এবং ২.৫ হেক্টর রপ্তানিমুখী পণ্যের ওয়্যারহাউসে ১৬টি কনটেইনার ক্রেন এবং ৪৭টি গ্যান্ট্রি ক্রেনের সাহায্যে বছরে মোট ৪.৩৫ মিলিয়ন টিইইউ কনটেইনার ওঠা-নামা করানো হয়। বন্দরে অ্যাপ্রোচ চ্যানেলে নেভিগেশনযোগ্য গভীরতা যেকোনো সময় অন্তত ১২.৫ মিটার হওয়ায় ৭০ হাজার ডিডব্লিউটি পর্যন্ত বাল্ক ভেসেল এবং চতুর্থ প্রজন্মের কনটেইনার জাহাজ প্রবেশ করতে সক্ষম। জোয়ারের সময় এ সক্ষমতা বেড়ে ২ লাখ ডিডব্লিউটি বাল্ক ক্যারিয়ার এবং পঞ্চম ও ষষ্ঠ প্রজন্মের কনটেইনার জাহাজে পৌঁছায়। মাসে গড়ে ৯০০টির কিছু বেশি কনটেইনার জাহাজ আসে তাইচাং বন্দরে।
২১টি বার্থ থেকে বাল্ক জাহাজকে সেবা দেওয়া হয় তাইচাংয়ে। যার মধ্যে আছে উগ্যাং আকরিক টার্মিনাল, জিউলং পেপার ব্রেক বাল্ক টার্মিনাল, ওয়ানফ্যাং ব্রেক বাল্ক টার্মিনাল, হুয়ানেং পাওয়ার প্লান্ট কোল টার্মিনাল এবং পরিবেশবান্ধব পাওয়ার প্লান্ট কোল টার্মিনাল। মোট ৪ কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘ্যরে বার্থগুলোতে বার্ষিক প্রায় ৭১ মিলিয়ন টন বাল্ক পণ্য হ্যান্ডল করা হচ্ছে।
পোর্ট অব তাইচাংয়ের পেট্রোকেমিক্যাল ডকগুলোর অপারেটর সংস্থা হলো মোবিল (চীনা), চ্যাংজিয়াং এবং ইয়ানহং পেট্রোকেমিক্যালস। মোট ১ হাজার ৩৫৪ মিটার বার্থে ৭.০৫ মিলিয়ন টন পেট্রোকেমিক্যাল দ্রব্য লোড-আনলোড করা যায়। সংরক্ষণ ট্যাংকের মোট ধারণক্ষমতা ৮ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার।
অন্তত পাঁচটি সমুদ্রগামী কনটেইনার শিপিং লাইন, ১৯টি অভ্যন্তরীণ কনটেইনার লাইন এবং ইয়াংজি নদী দিয়ে চলাচলকারী ৪৫টি ফিডার সার্ভিস কোম্পানির হোম পোর্ট তাইচাং। তাইওয়ান, কোরিয়া এবং জাপানের সাথে চারটি শর্ট-রেঞ্জ সার্ভিসও পরিচালিত হয় এখান থেকে।