প্রযুক্তি

মানুষে মানুষে যোগাযোগের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু করোনাকালে মানুষ অনেক বেশি করে উপলব্ধি করেছে যে, যোগাযোগ ছাড়াও অনলাইনে অনেক কাজ খুব সহজে করা যায়। চাক্ষুস না দেখে দূর থেকে ভিডিও কলে রিমোট সার্ভে-ইন্সপেকশন, অনলাইনে মেরিটাইম শিক্ষা, ট্রেনিং, সেমিনার, সম্মেলন যে সম্ভব হতে পারে, ডিজিটাল টেকনোলজির কল্যাণে বছর দেখেছে শিপিং-বিশ্ব। ব্লকচেইন ব্যবহার করে ই-বিল অব ল্যাডিং, আর্থিক লেনদেন, স্মার্ট চুক্তিপত্র, এলসির ব্যবহার বেড়েছে। প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় ব্যয় আর সময়সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহ বেড়েছে বন্দর শিপিং কোম্পানিগুলোতে। প্রযুক্তির যে পরিবর্তন ধীরে ধীরে জায়গা করে নেওয়ার কথা ছিল, কোভিড-১৯ এক ধাক্কায় ডিজিটাইজেশনের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। মহামারি-উত্তর ‘নিউ নরমাল’ শিপিং বাণিজ্যে পেপারওয়ার্ক ব্যক্তিগত মোলাকাত কমাতে মুখ্য ভূমিকা রাখতে চলেছে প্রযুক্তি।

পরিবর্তনে, একসাথে

ই-বিল ব্যবহার করে স্মার্ট কনটেইনার প্রযুক্তির প্রসারে প্রথম শ্রেণির নয় কনটেইনার শিপিং কোম্পানি-এমএসসি, মায়েরস্ক, সিএমএ সিজিএম, হ্যাপাগ-লয়েড, ওশান নেটওয়ার্ক এক্সপ্রেস (ওয়ান), এভারগ্রিন, ইয়াং মিং, এইচএমএম এবং জেডআইএম (জিম) মিলে গড়ে তুলেছে নিরপেক্ষ, অলাভজনক সংস্থা ডিজিটাল কনটেইনার শিপিং অ্যাসোসিয়েশন (ডিসিএসএ)। আরেক উদ্যোগ, ট্রেডলেন্স ব্যবহার করে ব্লকচেইন-ভিত্তিক ডেটা প্লাটফর্মের পরিসীমা বাড়াতে এক ছাদের তলায় এসেছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশ্বের এই মুহূর্তে ভাসমান ওশান কনটেইনার কার্গোর প্রায় অর্ধেকের প্রতিটি ইউনিট সম্পর্কে বিস্তারিত ডেটা থাকছে ট্রেডলেন্স ডিজিটাল প্লাটফর্মে, যেখানে প্লাটফর্ম প্রোভাইডার হিসেবে ক্লাউড সেবা দিচ্ছে আইবিএম।

ডিজিটাল টুলসের ব্যবহার বেড়েছে

২০২০ সাল বুঝিয়ে দিয়েছে সশরীরে উপস্থিত না থেকেও সফলভাবে পরিদর্শন আর জরিপের কাজ করা সম্ভব। ডিএনভি জিএল, ব্যুরো ভেরিটাসের মতো ক্ল্যাসিফিকেশন সোসাইটি তাদের ইন্সপেকশন আর সার্ভের কাজ সেরেছে দূর-নিয়ন্ত্রিত স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে। অনলাইনে ভেসেল সার্ভের কাজ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করে সাপ্লাই চেইন নিরবচ্ছিন্ন রাখতে পোর্ট স্টেট কনট্রোল গাইডেন্স প্রকাশ করেছে ইউএস কোস্ট গার্ড। শিপিং সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে প্রশংসিত হয়েছে নাবিকদের সার্টিফিকেট অর্জন বা হালনাগাদ করতে ডিজিটাল সার্টিফিকেট প্রদানের উদ্যোগ। এ সময় সি ফেয়ারার সার্টিফিকেট কীভাবে দিতে হবে, এ ব্যাপারে নির্দেশনা প্রকাশ করেছে আইসিএস। সংক্রমণ এড়াতে জরুরি স্বাস্থ্যবিধি এবং অনবোর্ড অপারেশন-সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে নাবিকদের জন্য বিনামূল্যে ই-লার্নিং কোর্স চালু করেছে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএইচও)।

স্মার্ট ম্যাপ

ভাইরাস ছড়ানোর হার কতটা দ্রুত, কোন দেশ কতখানি আক্রান্ত সেটা বিস্তারিতভাবে অনুধাবন করা কখনই সম্ভব হতো না স্মার্ট ম্যাপিং সিস্টেম না থাকলে। এই রিপোর্ট লেখার সময় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১০ কোটির কিছু কম এবং মৃতের সংখ্যা ২১ লাখের কিছু বেশি দেখাচ্ছিল জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি নির্মিত ডিজিটাল ম্যাপ। আক্রান্ত ও মৃত-দুদিক থেকেই শীর্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নির্দিষ্ট ম্যাপ থাকায় কোন কোন দেশ বা নৌপথ এড়িয়ে যাওয়া উচিত, কোথায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল ও বাণিজ্য করা নিরাপদ, কোন বন্দর বা টার্মিনাল সচল আছে, কোনটি কবে খুলবে, অঞ্চলভিত্তিক কোয়ারেন্টিন বা লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে বিশ্বকে সচল রেখেছে এসব স্মার্ট প্যান্ডেমিক ম্যাপ।

থেমে থাকেনি সভা, সেমিনার, কর্মশালা, সম্মেলন

ব্যাপক আকারে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার প্রথম দিকেই পরিবর্তিত স্বাভাবিকে শিপিং ইন্ডাস্ট্রি ভার্চুয়াল আয়োজনের দিকে ঝুঁকে যায়। শারীরিক উপস্থিতিতে একে অপরের সাথে উষ্ণ সম্ভাষণ, সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে আলাপন ছাড়াই অনলাইনে চলেছে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর, বহুজাতিক সম্মেলন, আইএমওসহ শীর্ষ সব শিপিং সংস্থার সাধারণ সভা। এ সভা, সেমিনার, সম্মেলনে অংশ নিতে ব্যয় হতো বহু সময়, অর্থ। দিনের পর দিন কর্মস্থল, পরিবার থেকে দূরে থাকার বদলে এভাবে সম্মেলন করেও যে প্রায় একই প্রভাব রাখা সম্ভব, তা জানা গেল এ বছরই।

ওয়ার্ক ফ্রম হোম

সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মূল চাবিকাঠি হিসেবে পৃথিবীবাসী বেছে নিয়েছে বাসায় বসে অফিসের কাজ করা। ইন্টারনেটের ব্যাপকতা যে আসলে কতখানি সেটা বোঝা গেছে মহামারিতে। যদিও দীর্ঘদিনের সহকর্মী, চেনা কর্মপরিবেশ থেকে দূরে বসে কাজ করতে অস্বস্তি হলেও প্রায় সব সেক্টরের কাজই চলেছে অনলাইনে। হাবস্টাফ ব্লগচালিত জরিপ বলছে, ৮৪.৫ শতাংশ কোম্পানি করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ার পরও জরুরি প্রয়োজনে বাসায় থেকে কাজ চালিয়ে যেতে আগ্রহী। কিন্তু সেক্ষেত্রে ব্যক্তিগত কম্পিউটার ও নেটওয়ার্কে যথাযথ সাইবার নিরাপত্তার ব্যাপারটি প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায়।

তৎপর ছিল হ্যাকাররাও

শিপিং দুনিয়ার ‘বিগ ফোর’ সিএমএ সিজিএম, এপিএম-মায়ের্স্ক, এমএসসি এবং কসকো-সব কয়টি প্রতিষ্ঠান এ বছর সাইবার আক্রমণ ঠেকাতে ব্যস্ত ছিল। সিএমএ সিজিএমের লজিস্টিক বিভাগ দুদিন পুরোপুরি বন্ধ ছিল হ্যাকারদের কবলে পড়ে। এমএসসির কাস্টমার ফেসিং সিস্টেম ডাউন ছিল এক সপ্তাহ। অনলাইনে ব্যস্ততা বৃদ্ধির বছরে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাইবার হামলার কারণে। অক্টোবরে হামলা হয় জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান, নৌবাণিজ্যের নিয়ন্ত্রক সংস্থা খোদ আইএমওতে। কেবল জাহাজের অনবোর্ড নেটওয়ার্কে হামলা নয়, শোর-বেজড নেটওয়ার্ক ও আর্থিক লেনদেন-সংক্রান্ত তথ্যও নিরাপদ ছিল না হ্যাকারদের হাতে। অনলাইনে অপতৎপরতা ঠেকাতে শিপ অপারেটরদের জন্য সাইবার সিকিউরিটি গাইডলাইন ভার্সন ৪.০ প্রকাশ করেছে আইএমও, যা নতুন বছরের প্রথম দিন থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে। এ সংস্করণে আপডেটেড রিস্ক মডেল সংযুক্ত থাকায় নতুন ম্যালওয়্যার, ফিশিং মেইল, ভাইরাস, আইওটি-বেজড অ্যাটাক চিনতে সুবিধা হবে নাবিক-অপারেটর-শিপারদের।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here