ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে শতবর্ষী আইরিশ পালতোলা জাহাজ ডিওয়াডেন

১৯১৭ সালে তিন মাস্তুলবিশিষ্ট স্কুনার (পালতোলা জাহাজ) ডি ওয়াডেন নির্মাণ করে নেদারল্যান্ডস। আইরিশ সাগরে দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় ধরে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার পর ডি ওয়াডেনকে ক্যানিং গ্রেভিং ড্রাইডকে প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়। বর্তমানে স্কুনারটি ভঙ্গুর এবং স্থানান্তরের অযোগ্য হয়ে পড়ায় সেটিকে ভেঙ্গে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মার্সিসাইড মেরিটাইম মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে ডাচরা বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলো। সে সময়ে স্বল্প দূরত্বের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে ডি ওয়াডেনসহ মোট তিনটি স্কুনার নির্মাণ করে দেশটি। ১৯২০-এর দশকের শুরুর দিকে স্বল্প দূরত্বের ইউরোপীয় বাণিজ্যের সাথে যুক্ত ছিলো ডি ওয়াডেন। ১৯২২ সালে একজন আইরিশ ব্যবসায়ীর কাছে স্কুনারটি বিক্রি করা হয়। এরপর ১৯২২ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত আইরিশ সাগরে নানাবিধ বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করে ডি ওয়াডেন। স্কুনারটি লিভারপুল এবং মার্সি নদী থেকে বিভিন্ন আইরিশ বন্দরে শস্যদানা, চীনামাটি, খনিজ আকরিক বিশেষত কয়লা পরিবহনের কাজে নিয়োজিত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আয়ারল্যান্ডে প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ডি ওয়াডেন।

১১৬ ফুট দৈর্ঘ্যের স্কুনারটিতে ছোট একটি মোটর থাকলেও এটি সবসময় পাল ও মোটরের সম্মিলিত শক্তিতে চলত। তবে ডি ওয়াডেন এমন ভাবে নকশা করা হয়েছিল যে, মোটরের সাহায্য ছাড়া এর হাল (জাহাজের যে অংশ পানির নিচে থাকে) ভালোভাবে পানিতে ভেসে থাকতো না। এই মোটরের সাহায্যে জাহাজটি ঘণ্টায় পাঁচ নটিক্যাল মাইল গতিতে ছুটতে পারত। মোটর স্কুনার হিসেবে ডি ওয়াডেনের তলদেশ ছিলো সমতল এবং এর ড্রাফট ছিলো ফাঁপা। যার ফলে এতে সর্বোচ্চ পরিমাণ কার্গো পরিবহন করা যেত এবং স্কুনারটি সহজেই ছোট আকারের পোতাশ্রয়ে প্রবেশ করতে পারতো। এছাড়া সহজে পণ্য উঠা-নামার জন্য স্কুনারটিতে প্রশস্ত হ্যাচ দেওয়া ছিল।

১৯৬০ দশকের গোড়ার দিকে অন্যান্য আধুনিক নৌযানের সামনে ডি ওয়াডেনের আবেদন ক্রমশ কমতে থাকে এবং এক সময় মোটরচালিত কোস্টার এর জায়গা দখল করে নেয়। স্কুনারটিকে সে সময় স্কটল্যান্ডের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। পরবর্তী বিশ বছর ডি ওয়াডেন সেখানে বালি পরিবহন থেকে শুরু করে জেলেদের আনা-নেওয়ার কাজ করে।

ক্যানিং গ্রেভিং ড্রাইডকে প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে ডি ওয়াডেনকে

মার্সিসাইড মেরিটাইম মিউজিয়াম ১৯৮৪ সালে জাহাজটি অধিগ্রহণ করে। ১৯৮৭ সালে ডি ওয়াডেনকে ক্যানিং গ্রেভিং ড্রাইডকে প্রদশর্নীর রাখা হয় এবং তখন থেকে জাহাজটি সেখানেই রয়েছে। দর্শণার্থীদের জন্য স্কুনারটির আদিরূপ ধরে রাখতে পরবর্তীতে পুনরুদ্ধার এবং সংরক্ষণের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। ১৯৯০ এর দশকে যাদুঘর কর্তৃপক্ষ দর্শনার্থীদের জন্য জাহাজটিতে শিক্ষামূলক অধিবেশন এবং ট্যুরের আয়োজন করে। বেশ কিছুদিন পর জাহাজটি সংরক্ষণের কথা বিবেচনা করে সেসব আয়োজন বন্ধ করে দেওয়া হয়।

আবহাওয়া এবং অন্যান্য পরিস্থিতির সংস্পর্ষে এসে ঐতিহাসিক এই স্কুনারটি দিনে দিনে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। যার ফলে যাদুঘর কর্তৃপক্ষ ডি ওয়াডেনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। এ-সংক্রান্ত একটি সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর যাদুঘর বোর্ড এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, স্কুনারটি মেরামত এবং রক্ষণাবেক্ষণ করতে যেই খরচ হবে সেটা মোটেও টেকসই হবে না। ২০২২ সালে যাদুঘর বোর্ড জাহাজটিকে স্থানান্তর বা পুনির্মাণের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু বিকল্প এসব পন্থা কার্যকর না হওয়ায় দুভার্গ্যজনকভাবে জাহাজটি লিভারপুলের জলসীমা থেকে চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে। তবে আশার কথা হলো, মার্সিসাইড মেরিটাইম মিউজিয়ামের নির্দেশনা অনুসরন করে ডি ওয়াডেনের ভেঙ্গে ফেলার গোটা প্রক্রিয়াটি রের্কড করবে লিভারপুল ন্যাশনাল মিউজিয়াম।

বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী, চলতি বছরের শেষ নাগাদ জাহাজটি ভেঙ্গে ফেলা হবে। লিভারপুলের সামুদ্রিক ইতিহাসে ডি ওয়াডেনের ঐতিহ্য ধরে রাখতে এর মৌখিক ইতিহাস ও স্মৃতিচারণ সংরক্ষেণের অনুরোধ করেছে যাদুঘর কর্তৃপক্ষ। ডি ওয়াডেনের বর্ণিল ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে জাহাজটিকে এমন ভাবে ভাঙ্গা হবে, যাতে করে এর গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো সংরক্ষণ করা যায় বা পুনরায় ব্যবহার করা যায়। জাহাজটি ভেঙ্গে ফেলার পর এর কোন কোন অংশ মেরিটাইম মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হবে বা অন্যান্য কোন কাজে সেগুলো ব্যবহার করা যাবে বর্তমানে সেই বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জাহাজের যেসব অংশ ভবিষ্যতে ব্যবহার করা যাবে না সেগুলোকে রিসাইকেল করা হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here