সমুদ্রের রোমাঞ্চ অনুভব করেন না, এমন মানুষ বোধ হয় খুব বেশি পাওয়া যাবে না। তবে রাষ্ট্রের কাছে কেবলই সৌন্দর্যের ধারক বিশাল জলরাশি নয়, বরং এর গুরুত্ব আরও ব্যাপক ও বহুমাত্রিক। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনাময় এক অবলম্বন হতে পারে বিশাল এই জলরাশি। সমুদ্রভিত্তিক সুনীল অর্থনীতি উপকূলীয় দেশগুলোর জন্য অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দক্ষিণ সীমানায় থাকা বঙ্গোপসাগর সম্পদের জোগান নিয়ে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে।
বাংলাদেশ নামের বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই বদ্বীপ গড়ে উঠেছে যার কোল ঘেঁষে, সেই বঙ্গোপসাগর ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিবেচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের নদ-নদী ও সমুদ্র যে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হয়ে উঠতে পারে, তা অনেক আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে জলরাশি বাংলাদেশের অস্তিত্বের অংশ, সঠিক পরিকল্পনা না থাকলে অদূর ভবিষ্যতে তার সুরক্ষা বিনষ্ট হতে পারে এমন আশঙ্কা ছিল তার। সে কারণেই স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনসহ বিভিন্ন ঝুঁকি মোকাবিলায় শত ব্যস্ততা ও প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি সমুদ্রের উন্নয়নে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। নদী ও সমুদ্রসম্পদের উন্নয়নে সাহসিকতা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে অসাধ্য কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় মেরিটাইম ভিশনের স্থপতি।
সমুদ্র অর্থনীতির গুরুত্ব অনুধাবন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাশিয়া সরকারের সহায়তায় যুদ্ধবিধ্বস্ত চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেলের বিভিন্ন স্থানে নিমজ্জিত-অর্ধনিমজ্জিত জাহাজও অবিস্ফোরিত মাইন অপসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক সম্পদের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সমুদ্রসম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের জন্য বঙ্গবন্ধু সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদের ২ নম্বর ধারা অনুযায়ী সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত ‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪’ প্রণয়ন করেন।
সারা বিশ্বে নীতিনির্ধারকরা সমুদ্রসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য এ-সংক্রান্ত আইন প্রণয়নে আগ্রহী হয়েছিলেন মূলত নব্বইয়ের দশক ও এর পরবর্তী সময়ে। সেখানে বঙ্গবন্ধু এই উদ্যোগ নিয়েছে তারও আগে। যার ফলে আন্তর্জাতিক আইন ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অন দ্য ল’ অব দ্য সির (আনক্লস-থ্রি) আট বছর আগেই বাংলাদেশে টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট প্রণীত হয়েছিল।
১৯৭৪ সালে প্রণীত আইনটি বাংলাদেশের উপকূলীয় সামুদ্রিক সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা, জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, উপকূলীয় অঞ্চল ব্যবস্থাপনা, সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা, সমুদ্র পরিবহন, মৎস্যসম্পদ ও সামুদ্রিক সুশাসনের মতো বিষয়গুলো নির্ধারণ করা সহজতর করেছে। সবচেয়ে বড় কথা, আইনটি বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণাধীন সমুদ্রাঞ্চলকে কয়েকটি জোনে ভাগ করে এ-সংক্রান্ত সীমা নির্ধারণ, অধিকারের ব্যপ্তি, সুরক্ষা ও নিরাপত্তার রোডম্যাপ নির্ধারণ করে দিয়েছিল।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সমুদ্রভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিসর বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্টের প্রাসঙ্গিকতা। ফলস্বরূপ আইনটিকে সময়োপযোগী করতে ২০২১ সালে প্রণয়ন করা হয় টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট। এই সংশোধনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্রবিষয়ক জাতীয় আইনকে আইএমও প্রণীত আন্তর্জাতিক আইন আনক্লস-থ্রির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের সামুদ্রিক রূপরেখার ভিত
চুয়াত্তরের টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট নবীন বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণের রূপরেখা দিয়েছিল। বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের কতখানি অংশে সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, সেই অংশে দেশের স্বার্থ কীরূপ হবে এবং এই স্বার্থের সুরক্ষা হবে কীভাবে এসব বিষয় নির্ধারণে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল এই রূপরেখা। এতে করে বাংলাদেশের জন্য বহির্বিশ্বের চাপমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে নিজেদের সমুদ্রসীমার ব্যবস্থাপনার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। এক কথায় বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চলে সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা, বহির্বিশ্বের সাথে নিরবচ্ছিন্ন বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপন তথা দেশের সামুদ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির ভিত রচনা করেছিল এই আইন।
অ্যাক্টটিতে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমাকে কয়েকটি জোন বা অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো উপকূলীয় তটরেখা, টেরিটোরিয়াল জলসীমা, কন্টিগিউয়াস জোন, একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইজেড) ও মহীসোপান (কন্টিনেন্টাল শেলফ)।

টেরিটোরিয়াল ওয়াটার : উপকূলীয় তটরেখা থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল দূরত্ব পর্যন্ত এলাকা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জলসীমা (টেরিটোরিয়াল ওয়াটার)। এই সীমার মধ্যে বাংলাদেশ পূর্ণমাত্রায় সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে এবং সেখানে জাহাজ চলাচল, মৎস্য শিকার ও সম্পদ আহরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
কন্টিগিউয়াস জোন : টেরিটোরিয়াল সমুদ্রাঞ্চলের পর তটরেখা থেকে ২৪ নটিক্যাল মাইল দূরত্ব পর্যন্ত বিস্তৃত জলসীমাকে কন্টিগিউয়াস জোন ধরা হয়। অর্থাৎ এই জোনের বিস্তার ১২ নটিক্যাল মাইল। বাংলাদেশ সেখানে শুল্কায়ন, অভিবাসন ও পরিবেশগত সুরক্ষাবিষয়ক যেকোনো আইন প্রয়োগ করতে পারবে।
ইইজেড : তটরেখা থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল দূরত্ব পর্যন্ত সমুদ্রাঞ্চল বাংলাদেশের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইজেড) হিসেবে চিহ্নিত। অনেক সময় টেরিটোরিয়াল জোনের পর থেকেই ইইজেড শুরু বলে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ কন্টিগিউয়াস জোনকেও ইইজেডের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ হিসাবে ইইজেডের বিস্তার ১৮৮ নটিক্যাল মাইল। এখানকার সামুদ্রিক সব সম্পদের ওপর কেবল বাংলাদেশেরই সার্বভৌম অধিকার রয়েছে। টেকসই উপায়ে মৎস্যসম্পদ, জীবাশ্ম জ্বালানি ও অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ আহরণের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকা গতিশীল করার ক্ষেত্রে এই অঞ্চলটি কৌশলগত দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মহীসোপান : ইইজেডের পর তটরেখা থেকে ৩৫০ নটিক্যাল মাইল দূরত্ব পর্যন্ত সমুদ্রাঞ্চল হলো মহীসোপান। অর্থাৎ মহীসোপানের বিস্তার ১৫০ নটিক্যাল মাইল। মেরিটাইম জোনস অ্যাক্টের মাধ্যমে এই অঞ্চলে সাগরতলের যেকোনো প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের অধিকার পেয়েছে বাংলাদেশ।
টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট কেবল যে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমাই নির্ধারণ করেছিল, তা নয়। বরং এতে সম্পদ ব্যবস্থাপনা, সমুদ্র নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এটি কেবলই একটি অভ্যন্তরীণ আইন ব্যবস্থা ছিল না, একই সঙ্গে এটি ছিল দেশের সমুদ্রবিষয়ক কৌশলগত কূটনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। সমুদ্রে একটি দেশের সার্বভৌমত্বের সীমা নির্ধারণ করা থাকলে প্রতিবেশী দেশগুলো ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কূটনৈতিক ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক জোরদারের আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়, যা আঞ্চলিক শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট সেই সুযোগটিই করে দিয়েছিল।
এই যে সম্পদে পরিপূর্ণ একটি জলসীমা, তার সুরক্ষা, বিদেশি জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও টেকসই পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ সময়োপযোগী সব সমুদ্রনীতি গ্রহণ করে যাচ্ছে। আর এসব নীতির মূল ভিত্তিই হলো টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, যার প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রাগুলোর অন্যতম ছিল সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা। এই ভিতের সুবাদেই বাংলাদেশ বদ্বীপ মহাপরিকল্পনা-২১০০ এর মতো বিশদ রূপরেখা প্রণয়নের সুযোগ পাচ্ছি আমরা।
সাগর, তুমি কার?
সমুদ্রবিষয়ক আইনের প্রাথমিক ও প্রধান লক্ষ্য হলো সাগরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা। এই আইনের মাধ্যমে একটি উপকূলীয় রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সমুদ্রসীমা এবং সেই সমুদ্রসীমায় দেশটির অধিকার ও দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট হয়। আধুনিক যুগের গোড়ার দিকে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের রাজারা স্থলের পাশাপাশি জলেও আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় লিপ্ত থাকতেন। এতে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন সাম্রাজ্যের মধ্যে সংঘর্ষ লেগে যেত। এই দ্ব›দ্ব নিরসনে সাম্রাজ্যগুলোর সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সমুদ্র কারো নিয়ন্ত্রণে থাকা যুক্তিসংগত কি না, কিংবা যুক্তিসংগত হলে কোন অংশের নিয়ন্ত্রণ কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, সেই প্রশ্ন তৈরি হয়।
এই বিষয়ে ডাচ আইনজ্ঞ হুগো গ্রোশিয়াস ১৬০৯ সালে একটি বই প্রকাশ করেন, যার নাম মেয়ার লিবেরাম। এই শব্দযুগলের অর্থ মুক্ত সাগর বা সাগরের স্বাধীনতা। বইটিতে হুগো বলেন, সাগর কারও একক নিয়ন্ত্রণে থাকা উচিত নয়। বরং সাগরে সম্পদ সন্ধান, আহরণ ও বাণিজ্যের সুযোগ সবার জন্য সমান থাকা উচিত। মেয়ার লিবেরামে দুটি মূলনীতির কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো গভীর সাগর ব্যবহারের অধিকার সব দেশেরই থাকা উচিত এবং কোনো দেশ এর মালিকানা দাবি করতে পারবে না। মেয়ার লিবেরামের এই মুক্ত সাগরনীতি পরবর্তী চারশ বছর সমুদ্রবিষয়ক আইনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।
অবশ্য মেয়ার লিবেরামের কয়েক দশকের মধ্যে এর বিপরীত আরেকটি নীতি আত্মপ্রকাশ করে। ১৬৩৫ সালে ব্রিটিশ পণ্ডিত জন সেলডেন প্রকাশ করেন বই মেয়ার ক্লসাম, যার অর্থ সীমাবদ্ধ সাগর। রোমান যুগের মেয়ার নস্ট্রাম (আমাদের সাগর) নীতির সাথে জন সেলডেনের নীতির অনেকটা মিল ছিল। সেলডেন বলেন, ভূপৃষ্ঠের বেশিরভাগ অংশই যেমন কোনো-না কোনো রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তেমনি সাগরও নিয়ন্ত্রণাধীন থাকা উচিত। এর পেছনে তিনি যুক্তি দেখান, যেহেতু উপকূলীয় দেশগুলোকে জলদস্যুতার মতো সামুদ্রিক ঝুঁকির মোকাবিলা করতে হয়, সেহেতু এসব দেশের উপকূল-সংলগ্ন সমুদ্রে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অধিকার রয়েছে।
যা-ই হোক, মেয়ার লিবেরাম ও মেয়ার ক্লসাম এই দুই বিপরীত তত্তে¡র কারণে সমুদ্রে উপকূলীয় রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌম অধিকার নিয়ে চলে আসা দীর্ঘদিনের বিসংবাদ থেকেই গেল। পরবর্তী শতকগুলোয় এই সংকট নিরসনে বেশ কয়েক দফায় উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৮৫৬ সালের প্যারিস ডিক্লেয়ারেশনে প্রাইভেটিয়ারিং, নিরপেক্ষ পতাকা, নিরপেক্ষ পণ্য নির্ধারণসহ আরও কয়েকটি ইস্যুতে দ্বন্দ্ব নিরসনে কিছু সিদ্ধান্ত আসে। তবে সেই সিদ্ধান্তগুলো কোনো আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা নয়। কেবল ক্রাইমিয়া যুদ্ধে (১৮৫৩-১৮৫৬) বিবদমান দেশগুলোই এই চুক্তির প্রতি সমর্থন জানায়।
বিশ শতকের শুরুর দিকে বিভিন্ন দেশ তাদের সামুদ্রিক খনিজ ও মৎস্যসম্পদের মজুদ ও সর্বোচ্চ আহরণ নিশ্চিতকরণ এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণে তৎপরতা শুরু করে। এ লক্ষ্যে দেশগুলো নিজেদের সমুদ্রসীমারে পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা চালাতে থাকে। ১৯২০-এর দেশগুলো তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে তৎকালীন লিগ অব নেশনসে ধরনা দিতে থাকে। এই তৎপরতার ফল হিসেবে আসে বিখ্যাত ক্যানন শট রুল, যে আইনের মাধ্যমে উপকূলীয় দেশগুলোকে তটরেখা থেকে তিন নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সমুদ্রাঞ্চলে সার্বভৌম অধিকার দেওয়া হয়। আইনে বলা হয়, উপকূলীয় তটরেখা থেকে নিক্ষেপ করা কামানের গোলা সাগরে যত দূর যায়, সেই দূরত্ব পর্যন্ত অঞ্চল টেরিটোরিয়াল ওয়াটার হিসেবে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে একটি প্রমাণ দূরত্ব হিসেবে তিন নটিক্যাল মাইল গ্রহণ করা হয়। এই কামানের গোলার অতিক্রান্ত দূরত্বের কারণেই আইনটিকে ক্যানন শট রুল বলা হয়।
বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বিভিন্ন পেক্ষাপটে সাগরে দেশগুলোর সার্বভৌম অধিকার বৃদ্ধির দাবি জোরালো হতে থাকে। এ সময় সমুদ্রে মৎস্য আহরণকারী জাহাজগুলোর কাছ থেকে টোল আদায়, সামুদ্রিক খনিজ সম্পদ আহরণ ইত্যাদিকে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক বিবেচনা করা শুরু হয়। ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাদের টেরিটোরিয়াল জোনের বাইরে মহীসোপান অঞ্চলের সমুদ্র ও এর তলদেশের সব প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর অধিকার দাবি করে ঘোষণা দেয়। সেই প্রথম কোনো দেশ মহীসোপান অঞ্চলে নিজেদের অধিকারের দাবি জানায়। এর মাধ্যমে গভীর সাগরের সর্বজনীন ব্যবহার নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়। এই বিতর্ক আরও জোরালো হয়, যখন লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের দেখানো পথে হাঁটতে শুরু করে। তারা ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সমুদ্র অঞ্চলকে কয়েকটি জোনে ভাগ করে সেখানে নিজেদের অধিকারের দাবি জানায়। জোনগুলোর মধ্যে রয়েছে, টেরিটোরিয়াল সি, এপিকন্টিনেন্টাল সি, প্যাট্রিমোনিয়াল সি ইত্যাদি। ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে দাবি জানানোর এই ধারা চলছিল।
১৯৭১ সালে কেনিয়া প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে উপকূল থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সমুদ্র এলাকাকে একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইজেড) হিসেবে নির্ধারণের সর্বজনীন আইন প্রস্তাব করে। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সমুদ্র বিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি কনভেনশন গ্রহণে সম্মতি জানায়। শেষ পর্যন্ত ১৯৮২ সালে ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য সি (আনক্লস-থ্রি) গৃহীত হয় এবং ১৯৯৪ সালে তা বাস্তবায়িত হয়।
সমুদ্র অধিকার ও নৌ-আধিপত্যের পূর্বাপর
হিমালয়, কারাকোরাম ও হিন্দুকুশ এই তিন পর্বতশ্রেণি অতন্দ্র প্রহরীর মতো আগলে রেখেছে ভারতবর্ষকে। আর এই বিশাল ভূখণ্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অনাদিকাল থেকে প্রবহমান তিন বৃহৎ নদী পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার অববাহিকায় গড়ে ওঠা এক সমৃদ্ধ জনপদ এই বাংলা। হাজারো নদী আর বঙ্গোপসাগরের আশীর্বাদপুষ্ট এ অঞ্চলের শান্তি ও সমৃদ্ধিতে চিরকাল অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে নৌ-আধিপত্য।

ইতিহাস বলে, প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে সিন্ধু অববাহিকায় গড়ে ওঠা হরপ্পা সভ্যতার কালেই সমুদ্রপথে বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ ও বাণিজ্য বিস্তার ঘটে ভারতবর্ষের। প্রায় সমসাময়িক সময়ে এ অঞ্চলে নৌশক্তি চর্চারও বর্ণনা মেলে ইতিহাসের পাতায়। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের ভারতবর্ষ আক্রমণ ও বাংলার সীমান্ত থেকে নৌবহরসমেত ফিরে যাওয়ার কথা যেমন জানা যায়, তেমনি প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে বাংলার বুকে মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন বংশের রাজত্বকালেও নৌশক্তি সুসংহতকরণ প্রতিযোগিতার প্রমাণ পাওয়া যায়।
মধ্যযুগের প্রারম্ভে যখন বাংলায় প্রথম মুসলিম শাসকদের আবির্ভাব ঘটে, তখন বাংলাকে স্বাধীন সালতানাত ঘোষণার পাশাপাশি উন্নত নৌশক্তির জোরে বাংলা অভিমুখী দিল্লির আগ্রাসন বারবার প্রতিহত করেছেন এই অঞ্চলের প্রতাপশালী জমিদাররা। আবার বাংলায় মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নেপথ্যেও রয়েছে বাংলা সালতানাত ও বারো ভুঁইয়ার নৌ-প্রতিপত্তির অবসান।
সমুদ্রপথে একের পর এক ইউরোপীয় বণিকগোষ্ঠীর আগমনে বাংলার ইতিহাস মোড় নেয় ভিন্ন দিকে। আঠারো শতকে নৌশক্তিধর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলা তথা ভারতবর্ষে শুরু হয় ইংরেজ ঔপনিবেশিক যুগ। ব্রিটিশরাজের হাত ধরে ইতিহাসের বহু পথ পাড়ি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় রয়েল ইন্ডিয়ান নেভি। ইংরেজ নিয়ন্ত্রিত এই নৌবাহিনীতে কাজ করেছে হাজার হাজার বাঙালি।
কালক্রমে অবসান ঘটে ব্রিটিশ শাসনের। ভারতবর্ষ বিভক্ত হয় ভারত ও পাকিস্তান এই দুই দেশে। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ছেড়ে যাওয়ার সময় রয়েল ইন্ডিয়ান নেভি বিলুপ্ত হয়ে জন্ম নেয় ভারতীয় ও পাকিস্তান নৌবাহিনী। বৈষম্যের বেড়াজাল ভাঙতে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। একই সঙ্গে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।
বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনাময় সম্পদের আধার সার্বভৌম একটি দেশ। এই সম্পদের বড় একটি অংশ মজুদ বাংলাদেশের দক্ষিণের সীমানা নির্ধারণকারী বঙ্গোপসাগরে। বিশাল এই জলরাশির প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ন্যায্যতাভিত্তিক আহরণ নিশ্চিতকরণে প্রয়োজন সঠিক সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, যে কাজে স্বাধীনতা-পরবর্তী নবীন বাংলাদেশকে বেশ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। এ বিষয়ে পরিষ্কার কোনো আইনি পরিকাঠামো ছিল না সে সময়। এ কারণে নিজেদের সমুদ্রাঞ্চলের ওপর সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় একটি বিশদ আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট সেই প্রয়োজনীয়তারই প্রতিফলন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার দেশের সমুদ্রসম্পদের টেকসই ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছে। এর সঙ্গে দেশের সমুদ্র বাণিজ্যের প্রসার তো বরাবরই সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকারের বিষয়। এ দুটি বিষয়ই নিশ্চিত করতে হলে সমুদ্র নিরাপত্তার কোনো বিকল্প নেই। অন্য কোনো দেশ যেন আমাদের সমুদ্রসীমায় প্রবেশ করে সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যেতে না পারে, সেটি নজরদারিতে রাখতে হবে। সে সাথে দেশের জলসীমায় আসা বিদেশি জাহাজগুলোর নিরাপত্তার বিষয়টিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এসব নিরাপত্তামূলক কার্যক্রমের জন্য বাংলাদেশ নৌবাহিনীসহ আইন প্রয়োগকারী অন্যান্য সংস্থা সদাতৎপর। কিন্তু নিরাপত্তা নজরদারির কার্যক্ষেত্র নির্ধারণের জন্য তো নিজেদের সমুদ্রসীমা সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে জানতে হবে। টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট সেই সমুদ্রসীমাই সংজ্ঞায়িত করেছে।
বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের জন্য কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
বিশ্বের সবচেয়ে বড় উপসাগর বঙ্গোপসাগর ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের একটি প্রধান অংশ। পাশাপাশি এটি ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের সংযোগকারী হওয়ায় আঞ্চলিক ও কৌশলগতভাবে এর গুরুত্ব অনেক। মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া এমনকি স্থলবেষ্টিত ভুটান ও নেপালও বাণিজ্যিকভাবে এই জলরাশির সুবিধাভোগী। বঙ্গোপসাগর শুধু একটি সাগর নয়, বরং এটি বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও করপোরেট স্বার্থের প্রাণভোমরা।
সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্র অর্থনীতির জোয়ার ও ভূরাজনৈতিক পটপরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থনৈতিক গুরুত্বের কথা চিন্তা করলে দেখা যায়, বঙ্গোপসাগর শুধু ঐশ্বমণ্ডিত এক বিশাল লবণাক্ত জলরাশিই শুধু নয়, এটি ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ায় সম্ভাবনাময় একটি অবলম্বনও। এটি জীববৈচিত্র্যেপূর্ণ একটি বিশাল জলাধার। প্রবাল, মৎস্য প্রজনন অঞ্চল ও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল এই বৈচিত্র্য আরও বাড়িয়েছে।
সামুদ্রিক জলসীমা একটি দেশের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তা ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিলের একটি বক্তব্যেই স্পষ্ট। তিনি বলেছিলেন, যদি উন্মুক্ত সাগর ও ইউরোপ এই দুয়ের মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে ব্রিটেন অবশ্যই উন্মুক্ত সাগরকেই বেছে নেবে।
আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও ভূরাজনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। এটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত, যেখানে রয়েছে দুটি বিশাল অর্থনৈতিক জোট সার্ক ও আসিয়ান। স্বাভাবিকভাবেই এই দুই জোটের কৌশলগত পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ জুড়ে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। এই জলরাশির উপকূলবর্তী দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি প্রায় সাড়ে ৭ লাখ কোটি ডলার। আর সুবিধাভোগী দেশগুলো জিডিপিতে যোগ করেছে ৮১ হাজার কোটি ডলারের বেশি। এই অঞ্চলের সার্কভুক্ত দেশগুলোর আন্তঃবাণিজ্য তাদের মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের তুলনায় ৫ শতাংশ, আর আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর ক্ষেত্রে এ হার ২৫ শতাংশ।

সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনার কারণে বাংলাদেশের কাছে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বঙ্গোপসাগর। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ধনী দেশগুলোর তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি হবে অনেক ধীর। ফলে মহামারি-পরবর্তী বিশ্বের ধনী ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বৈষম্য অনেক বেড়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্যে সমুদ্রসম্পদ আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধি করাটা মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে ওঠায় সহায়ক ভূমিকা রাখবে। দেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা হলো তৈরি পোশাক রপ্তানি। এর মাধ্যমে বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো আয় হয় বাংলাদেশের। এদিকে সামুদ্রিক সম্পদের মধ্যে কেবল মাছ রপ্তানি থেকেই বছরে ১০-১২ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। অন্যান্য সম্পদ এর সঙ্গে যোগ হলে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা আরও বেড়ে যাবে।
অধিকার আদায়ে বাংলাদেশের বন্ধুর পথচলা
মেরিটাইম বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী নেতৃত্বের নিদর্শন হলো টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪। এর মাধ্যমে সমুদ্রবিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়নের আগেই নিজস্ব আইনপ্রণেতা গুটিকয়েক দেশের অন্যতম হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। এই অ্যাক্টে বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় তটরেখা থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় সমুদ্রসীমা, ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইজেড) ও ৩৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপান অঞ্চল হিসেবে দাবি করা হয়েছে। এই দাবিকৃত অঞ্চলের অধিকার বুঝে নিতে ২০০৯ সালের জুলাই এবং ২০১০ সালের জানুয়ারি ও মার্চে মিয়ানমারের সাথে তিন দফায় বৈঠক করেও কোনো সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এছাড়া ২০০৯ সালের মার্চ ও ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ভারতের সাথেও সমুদ্রসীমা নিয়ে দুই দফা বৈঠক হয়। এতে কোনো স্থায়ী সমাধান ছাড়াই বাংলাদেশের দাবিগুলো উপেক্ষিত থেকে যায়। বৈঠকগুলোয় বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন ভৌগোলিক ও ভূতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্যগুলোকে আমলে নিয়ে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের দাবি জানায়। অন্যদিকে মিয়ানমার ও ভারত সমদূরত্বের ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পক্ষে মত দেয়। সমুদ্রসীমা আইন এড়িয়ে দেশ দুটি বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যার বড় অংশকে নিজেদের বলে দাবি করে।
২০০১ সালের জুলাইয়ে আনক্লসের প্রতি অনুসমর্থন জানায় তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। ওই সময় থেকে পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০১১ সালের জুলাই নাগাদ মহীসোপানের দাবি জাতিসংঘের কাছে জমা দেওয়ার নিয়ম। সে লক্ষ্যে ২০১০ সালের মার্চে প্রথমবারের মতো বঙ্গোপসাগরে প্রয়োজনীয় সিসমিক ও ব্যাথিমেট্রিক জরিপের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়।
ভারত ও মিয়ানমার জাতিসংঘের কাছে তাদের মহীসোপানের দাবি পেশ করার পর বাংলাদেশের স্বার্থ হুমকির মুখে পড়ে। উভয় দেশের দাবি অনুযায়ী বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকা ১৩০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ত এবং বাংলাদেশের দাবি করা ইইজেডের বড় অংশ দেশ দুটির নিয়ন্ত্রণে চলে যেত। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার দ্রুতগতিতে এই বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর আনক্লসের অধীনে ভারত ও মিয়ানমারকে সালিশি নিষ্পত্তির নোটিস দেয়। এই উদ্যোগ গ্রহণের পর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার মামলাটি আনক্লসের আওতায় প্রতিষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ল অব দ্য সি (ইটলস) তে এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার মামলাটি স্থায়ী সালিশি আদালতে (পিসিআই) প্রেরণ করা হয়।
আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিয়ে ২০১২ সালের ১৪ মার্চ ইটলসের এবং বাংলাদেশ-ভারত বিরোধ নিয়ে ২০১৪ সালের ৭ জুলাই পিসিআইয়ের রায় বাংলাদেশের অনুকূলে যায়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চলের সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণ বুঝে পায়। তিন দশকের বেশি সময়ে বিরোধ নিষ্পত্তিতে ইটলসের বিচারিক এখতিয়ার মেনে নিতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে বিশেষ মতৈক্য হয়। এই ঐতিহাসিক রায় কেবল বাংলাদেশের অধিকারই প্রতিষ্ঠা করেনি, বরং বিশ্বসভায় বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে নতুন মর্যাদার আসনে অভিষিক্ত করেছে।
সুবর্ণজয়ন্তী : চিরভাস্বর উদ্যোগকে স্মরণের উপলক্ষ
টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট ১৯৭৪ প্রণয়নের ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। এ উপলক্ষে ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা, দেশি-বিদেশি কূটনীতিক, সমুদ্র খাতের বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধনী সেশনের পর সমুদ্রবিষয়ক সংস্থা, গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে ফিফটি ইয়ারস সেলিব্রেশন অব টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪ : সিগনিফিকেন্স অ্যান্ড ওয়ে ফরোয়ার্ড শীর্ষক একটি সেমিনার সেশনের আয়োজন করা হয়।
উদ্বোধনী সেশনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। সেমিনারে মূল প্রতিপাদ্যের ওপর বক্তব্য উপস্থাপন করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমুদ্রবিষয়ক ইউনিটের সচিব রিয়ার এডমিরাল (অব.) মো. খুরশীদ আলম। প্যানেল আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. লাইলুফার ইয়াসমিন ও অধ্যাপক রাশেদ উজ জামান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রিয়ার এডমিরাল এম মুসা।
প্রধান অতিথির বক্তৃতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনাদর্শের একটি বিশেষ দিক ছিল সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সমুদ্রভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এই রাজনৈতিক দর্শনের প্রকাশ বঙ্গবন্ধুর জীবৎকালে বহুবার হয়েছে। আর ৫০ বছর পরও যখন তার প্রণীত টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট সমানভাবে প্রাসঙ্গিক থাকে, তখন বোঝা যায় এটি কতটা বাস্তবভিত্তিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিল।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্টের ৫০ বছর পূর্তির এই মাহেন্দ্রক্ষণ আমাদের আইনটির তাৎপর্যের কথা বিশেষভাবে উপলব্ধি করায়। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এটি নিছক একটি আইন বা দলিল নয়, বরং একটি ভিত্তিপ্রস্তর, যা আমাদের সার্বভৌমত্বকে আরও দৃঢ় করেছে, আমাদের সামুদ্রিক সীমাকে আরও সুস্পষ্ট করেছে এবং এই অঞ্চলে আমাদের অধিকারকে সুসংহত করেছে। এই আইনের মাধ্যমে আমরা আমাদের সামুদ্রিক সম্পদ রক্ষা, সামুদ্রিক সীমানাভুক্ত এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ বৈশ্বিক মঞ্চে আমাদের অধিকার নিশ্চিত করার সক্ষমতা অর্জন করেছি।
বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং তার মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সমুদ্র অগ্রযাত্রার বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের বিষয়ে আলোকপাত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট প্রণয়নের দীর্ঘ আট বছর পর ১৯৮২ সালে আনক্লস-থ্রি প্রণয়নের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সকল দেশের জন্য একটি সমন্বিত দিকনির্দেশনামূলক বিধি প্রণয়ন করে। তবে আনক্লস-থ্রি প্রণয়নের পর বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য তৎকালীন সরকারসমূহ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে সমুদ্রসীমা ভাগাভাগি বিষয়ে অস্পষ্টতা ছিল। পরবর্তীতে বর্তমান সরকার বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির আলোকে বন্ধুত্বপূর্ণ উপায়ে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা সম্পর্কিত অস্পষ্টতা দূরীভূত করে। আমরা অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি এবং সফলভাবে মোকাবিলাও করেছি। এর ফলস্বরূপ ২০১২ ও ২০১৪ সালে বাংলাদেশ যথাক্রমে মিয়ানমার ও ভারতের সাথে সামুদ্রিক সীমানা নিষ্পত্তি করে।
প্যানেল সেশনে আলোচকরা বলেন, বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের তৃতীয় প্রতিবেশী। সমুদ্রপথে দক্ষিণ এশিয়ার গেটওয়ে হয়ে ওঠার সব সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। সমুদ্র বিজয়ের পর আমাদের জন্য সুযোগ এসেছে সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানোর। সমুদ্র বাণিজ্য, বন্দর ব্যবস্থাপনা, মৎস্য ও খনিজ সম্পদ আহরণ, ট্রান্সশিপমেন্ট-ট্রানজিট সেবা, অফশোর প্রকল্প ইত্যাদি বাংলাদেশের সুনীল অর্থনৈতিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠতে পারে।
আলোচকরা সুনীল অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে টেকসই করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সমুদ্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেন। তারা আরও বলেন, এই যে আমরা বঙ্গোপসাগরে আমাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে পরিকল্পনা সাজাতে পারছি, তার নেপথ্যে সবচেয়ে বড় অবদান রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী উদ্যোগ টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্টের। আইনটির সুবর্ণজয়ন্তীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমাদের সমুদ্র সার্বভৌমত্বের সুরক্ষা ও সুনীল অর্থনীতির সুরক্ষায় আরও বেশি প্রত্যয়ী হওয়ার শপথ গ্রহণ করতে হবে।
উপসংহার
টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট বাংলাদেশের নিজস্ব জলসীমায় সুশাসন প্রতিষ্ঠার আইনি কাঠামো তৈরি করে দিয়েছে। সামুদ্রিক কর্মকাণ্ড নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ও কার্যপরিধির একটি রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে এই অ্যাক্টে। দেশের সমুদ্র খাতে প্রযুক্তি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে দীর্ঘমেয়াদি সমুদ্রনীতি প্রণয়ণের জন্য যে মৌলিক ভিত্তি অনিবার্য ছিল, অ্যাক্টটি সেই ভিত্তি দিয়েছে। এছাড়া মেরিটাইম খাতে যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও সম্ভাবনা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আইনগত ভিত্তিও প্রতিষ্ঠিত করেছে এই অ্যাক্ট। দেশের সমুদ্র স্বার্থের সুরক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রভাব জোরদারের সুযোগ করে দিয়েছে টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট। ইইজেড ও মহীসোপান অঞ্চলে মৎস্য আহরণ ও সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সুবিধাদি আদায়ে দিয়েছে পথনির্দেশনা। জাতির পিতার দূরদর্শী নেতৃত্বে পাঁচ দশক আগে প্রণীত এই অ্যাক্টের প্রাসঙ্গিকতা এখনো বিদ্যমান। এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও বৈশ্বিকভাবে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান তৈরিতে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছে। আন্তর্জাতিক আদালতে রায়ের মাধ্যমে ২০১২ সালে মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্র বিজয়ের নেপথ্য শক্তি ছিল বঙ্গবন্ধুর টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্ব। এই বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্থলভাগের বাইরে জলসীমাতেও আরেক বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে।