ব্যবসা-বাণিজ্যের খাতিরে মানুষ ঠিক কবে থেকে সাগরকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে তা বলা মুশকিল। তবে মানবসভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই পণ্য পরিবহন ও যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে সমুদ্রপথের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। ইতিহাস ঘেঁটে খ্রিস্টের জন্মেরও সাত হাজার বছর আগে অর্থাৎ নব্যপ্রস্তর যুগে ইউরোপীয় নাবিকদের এজিয়ান সাগরে নৌবাণিজ্য পরিচালনার হদিস মিলেছে। স্থলপথের চেয়ে জলপথে পণ্য পরিবহন নিরাপদ, দ্রæত ও সাশ্রয়ী হওয়ায় খ্রিস্টপূর্ব তিন শতাব্দীতে বণিকেরা সমুদ্রবাণিজ্যে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রাচীনকালে গাছের গুঁড়ির সাথে পণ্য বেঁধে উপকূলের ধার ঘেঁষে সেগুলোকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বহন করা হতো। কালের পরিক্রমায় পণ্য পরিবহন পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। প্রযুক্তির অগ্রগতি ও অভিনব উপকরণের ব্যবহার বাণিজ্যপথের দূরত্ব ও পণ্যের পরিমাণ বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। উপকূল ছেড়ে সাগর মহাসাগরের গণ্ডি অতিক্রম করেছে নৌবাণিজ্য। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৮০ শতাংশের বেশি সমুদ্রপথে পরিবাহিত হয়। স্বল্প সময়ে নিরাপদে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পণ্য পরিবহনের মূল কারিগর কনটেইনার জাহাজ। কনটেইনার শিপিংয়ের বিবর্তন পণ্য পরিবহন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে আরও দক্ষ, সাশ্রয়ী ও সহজ করে তুলেছে।
কনটেইনার শিপিংয়ের গোড়ার কথা
বর্তমানে ৬ হাজার কনটেইনার জাহাজের বিশাল বাণিজ্যিক নৌবহর প্রতি বছর বিশ^জুড়ে আনুমানিক ২২ কোটি ৬০ লাখ কনটেইনার পরিবহন করে। মাত্র তিন শতাব্দী আগেও পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা এতটা সংগঠিত ছিল না। কনটেইনারাইজেশন প্রক্রিয়ার আগে কাঠের বাক্স, পিপে ও বস্তায় করে ব্রেক বাল্ক কার্গো হিসেবে পণ্য পরিবহন করা হতো। এর ফলে জাহাজের ডেক বা খোলের সংকীর্ণ জায়গায় পণ্য লোডিং, অফ-লোডিংয়ে শিপিং কোম্পানিগুলোকে অতিরিক্ত শ্রম, সময় ও অর্থ ব্যয় করতে হতো। যান্ত্রিক সহায়তা ছাড়া পণ্য ওঠা-নামা করা হতো বলে পণ্যবাহী জাহাজগুলো সে সময় সাগরের চেয়ে বেশি সময় বন্দরেই অতিবাহিত করত। অনিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থার দরুন তখন দুর্ঘটনা ও চুরির ঝুঁকিও ছিল বেশি। অক্ষত অবস্থায় খাদ্যদ্রব্য পরিবহন করতে শিপারদের সবচেয়ে বেশি বেগ পোহাতে হতো। নানাবিধ প্রতিকূলতা এড়িয়ে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে ব্যয় করতে হতো পণ্যমূল্যের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ।
১৮ শতকের শেষদিকে ইংল্যান্ডের কয়লা খনিগুলোকে ঘিরে সর্বপ্রথম কনটেইনারাইজেশনের উৎপত্তি ঘটে। ওরসলে ডেলফ থেকে ম্যানচেস্টারে কয়লা বহনের জন্য ১৭৬৬ সালে বক্স জাহাজ স্টারভেশনারের নকশা করেন জেমস ব্রিন্ডলে। স্টারভেশনার দশটি কাঠের কনটেইনার বহন করতে পারত। পরবর্তীতে ওয়াগনকে কনটেইনার হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ১৭৯৫ সালে লিটল ইটন গ্যাংওয়ে চালু করেন বেঞ্জামিন ওট্রাম। ঘোড়ায় টানা সেসব ওয়াগনকে সহজেই ডারবি ক্যানেলের বার্জে স্থানান্তর করা যেত, যা কনটেইনারের কাজ করত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত কনটেইনারবাহী জাহাজ সাধারণত বিলাসবহুল যাত্রীবাহী ট্রেনের মালপত্র বহনের কাজে ব্যবহার হতো। ১৯৩১ সালে বিশে^র প্রথম কনটেইনারবাহী জাহাজ অটোক্যারিয়ার চালু করে যুক্তরাজ্যের সাউদার্ন রেলওয়ে। কনটেইনার বহনের জন্য অটোক্যারিয়ারে ২১টি স্লট দেওয়া ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তেলবাহী ট্যাংকারগুলোকে কনটেইনার জাহাজে রূপান্তর করা হয়। পরবর্তীতে কনটেইনার বহনের উদ্দেশ্যে নির্মিত প্রথম জাহাজগুলো যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডস এবং ১৯৫১ সাল থেকে ডেনমার্কে কার্যক্রম শুরু করে। একই বছর যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল, ওয়াশিংটন ও আলাস্কায় এ ধরনের জাহাজগুলো কনটেইনার বহনের কাজ শুরু করে।
অধিকাংশ কনটেইনারের ধারণক্ষমতা অত্যন্ত কম থাকায় এই ধরনের জাহাজগুলো তখন তেমন সাফল্যের মুখ দেখেনি। সে সময় ৫২ শতাংশ কনটেইনারের আয়তন ছিল ৩ ঘনমিটারের চেয়েও কম। এছাড়া ইউরোপের কাঠের তৈরি কনটেইনারগুলোতে ত্রিপলের ঢাকনা ব্যবহার করায় রেল বা ট্রাকে লোডিংয়ের সময় অতিরিক্ত সরঞ্জামের প্রয়োজন পড়ত। এতে করে পণ্য পরিবহন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতো। ফ্যাক্টরি থেকে গন্তব্যে পৌঁছার উপযোগী ইন্টারমোডাল কনটেইনার নির্মাণের মাধ্যমে এ সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠে শিপিং খাত।
বাংলাদেশে কনটেইনার শিপিংয়ের ইতিবৃত্ত
বদ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত বাংলার নৌবাণিজ্য প্রাচীনকাল থেকেই বেশ সমৃদ্ধ। কর্ণফুলীর তীরবর্তী চট্টগ্রামে এই অঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক বন্দর অবস্থিত। আরব-পর্তুগিজ-ওলন্দাজ বণিকদের পর ব্রিটিশ আমলে ইউরোপীদের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন পরিচালনা করে চট্টগ্রাম। বন্দরটি সে সময় পোর্তে গ্রান্দে বা গ্র্যান্ড পোর্ট নামে সুপরিচিত ছিল। কালের পরিক্রমায় বন্দরের কাজের পরিধি বিস্তৃত হয়। দেশ স্বাধীনের পর চট্টগ্রাম বন্দরকে আন্তর্জাতিক বন্দরে পরিণত করার লক্ষ্যে মনোনিবেশ করে বাংলাদেশ সরকার।
স্বাধীন বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির প্রধান প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দরে শুরুর দিকে কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা ছিল না বললেই চলে। ১৯৭৭ সালের ২২ মার্চ চট্টগাম বন্দর দিয়ে প্রথম কনটেইনারবাহী জাহাজ এসএস টেনাসিটি এদেশে প্রবেশ করে। মাত্র ছয়টি কনটেইনার বহনকারী এ জাহাজের আগমণের পাঁচ দশকের ভেতর চট্টগ্রাম বন্দরের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পরিচালিত হয়। যার প্রায় পুরোটাই কনটেইনারাইজড পণ্য।
১৯৭০-এর দশকে বিশ^জুড়ে কনটেইনার জাহাজের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) সে সময় তিন টন ওজনবাহী পাঁচ-ছয়টি ক্রেন ব্যবহার করে পণ্য ওঠা-নামা করত। পরবর্তীতে রপ্তানি পণ্যের তালিকায় তৈরি পোশাকের অন্তর্ভুক্তিতে কনটেইনারের ব্যবহার ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। ১৯৮০-এর দশক থেকে বন্দরের অবকাঠামোগত পরিবর্তনে সচেষ্ট হয়ে ওঠে চবক। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৬ সালে চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনাল তৈরি করা হয়। দেশের প্রথম কনটেইনার টার্মিনালটিতে দুটি ডেডিকেটেড কনটেইনার জেটি রয়েছে।
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কনটেইনারের সংখ্যা বাড়তে থাকায় ২০০৭ সালে নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনালের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৩০ লাখ ৫০ হাজার টিইইউ কনটেইনার পরিবহন করা হয়। গত বছর ৪ হাজার ১০৩টি পণ্যবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়েছে এবং কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ প্রথমবারের মতো ১২ কোটি মেট্রিক টন ছাড়িয়ে গেছে। চলতি বছরের এপ্রিলে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু করলে চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মচাঞ্চল্য আরও বাড়বে। সৌদি আরবভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ২২ বছরের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের তৃতীয় এই টার্মিনালটির পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে। পিসিটি চালু হলে বছরে প্রায় সাড়ে চার লাখ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
চট্টগ্রামের পাশাপাশি মোংলা বন্দরের মাধ্যমেও কনটেইনার আনা-নেওয়া করছে বাংলাদেশ। পদ্মা সেতুর কল্যাণে বর্তমানে ঢাকার সবচেয়ে নিকটবর্তী বন্দরে পরিণত হয়েছে মোংলা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বন্দরটিতে ৮২৭টি বিদেশি জাহাজ আসে এবং ২৬ হাজার ৫৯০ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়। মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বর্তমানে ৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। অন্যদিকে আগামী জুনে আনুষ্ঠানিকভাবে পায়রা বন্দরের প্রথম টার্মিনাল চালু হলে বন্দরে একসঙ্গে তিনটি জাহাজ ভিড়তে পারবে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনাল এবং কক্সবাজারের মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে বিশাল আকারের কনটেইনার জাহাজ দেশে প্রবেশ করবে, যা কনটেইনারজাত পণ্যের আমদানি-রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করবে।
সময়ের সাথে সাথে দেশীয় বন্দরগুলো কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে দক্ষ হয়ে উঠলেও পণ্য পরিবহনে বিদেশি কনটেইনার জাহাজই একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করছে। একসময় বেসরকারি খাতে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজে কনটেইনার পরিবহন করত দেশীয় প্রতিষ্ঠান এইচআরসি শিপিং কোম্পানি ও কিউসি কনটেইনার লাইন। প্রতিষ্ঠান দুটি ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সালের ভেতর শিপিং ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়। পণ্য পরিবহনে এইচআরসি শিপিং কোম্পানি মালিকানাধীন ১০টি জাহাজ এবং কিউসি কনটেইনার লাইন মালিকানাধীন ৭টি জাহাজ ব্যবহার করত। তবে ২০০৭ সালে কিউসি কনটেইনার লাইন এবং ২০১০ সালে এইচআরসি শিপিং কোম্পানি ব্যবসা গুটিয়ে নিলে দেশের কনটেইনার শিপিং আবারও বিদেশি জাহাজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
দীর্ঘ দশ বছরের খরা কাটিয়ে ২০২০ সালে আবারও সাগরে ভাসে বাংলাদেশি মালিকানাধীন কনটেইনার জাহাজ। দুটি নিবন্ধিত জাহাজ নিয়ে সেই বছর কনটেইনার শিপিং শুরু করে কর্ণফুলী লিমিটেডের মালিকানাধীন এইচআর লাইনস। ব্যবসা শুরুর আড়াই বছরের মাথায় ছয়টি জাহাজ নিয়ে এইচআর লাইনস দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ কনটেইনার জাহাজ কোম্পানিতে পরিণত হয়। তথ্য বিশ্লেষক ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আলফালাইনারের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের শুরুতে বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি কনটেইনার জাহাজ অপারেটরের ভেতর এইচআর লাইনসের অবস্থান ছিল ৭৪তম। প্রতিষ্ঠানটির বহরে আরও দুটি জাহাজ সংযুক্তির প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। জাহাজ দুটি কার্যক্রম শুরু করলে এইচআর লাইনসের সক্ষমতা বেড়ে ১১ হাজার ৮৪০ টিইইউয়ে উন্নীত হবে।
ইন্টারমোডাল শিপিং কনটেইনার
ম্যাকলিন ট্রাকিং কোম্পানির মালিক মার্কিন ব্যবসায়ী ম্যালকম ম্যাকলিন বহু বছর ধরে দ্রæত ও দক্ষতার সাথে সম্পূর্ণ কার্গো ট্রাক থেকে জাহাজে লোড করার উপায় খুঁজছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৬ সালে ইন্টারমোডাল শিপিং কনটেইনার বা ফ্রেইট কনটেইনার আবিষ্কার করেন তিনি। তার এই যুগান্তকারী আবিষ্কার বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহনে অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধন করে। ইন্টারমোডাল শিপিং কনটেইনারের সাহায্যে আনলোড বা পুনরায় লোড করার ঝামেলা ছাড়াই ট্রাক, রেল, জাহাজসহ যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে একবারে পণ্য পরিবহন করা যায়। এতে করে শিপিং কোম্পানিগুলোর শ্রম, অর্থ ও খরচ যেমন সাশ্রয় হয় তেমনি পণ্যগুলো নিরাপদে, অক্ষত অবস্থায় গন্তব্যে পৌঁছে যায়।
কনটেইনার পরিমাপের একক
বিশ্বব্যাপী পণ্য পরিবহনকে সহজ ও গতিশীল করে তুলতে কনটেইনারের আকারকে দুটি সাধারণ এককে পরিমাপ হয়। প্রমাণ আকারের কনটেইনারের ব্যবহার ইন্টারমোডাল ট্রান্সপোর্টেশনে সহায়ক ভূমিকা রাখে। প্রথমত, নির্দিষ্ট আকারের কনটেইনার হওয়ার কারণে তা জাহাজে সারিবদ্ধ অবস্থায় রাখা সহজ হয়। তাছাড়া প্রমাণ একক ব্যবহারের ফলে জাহাজে কতগুলো কনটেইনার লোড করা হলো সেই হিসাব রাখতে সুবিধা হয়। অন্যদিকে নির্দিষ্ট আকারের কনটেইনার হওয়ায় সেগুলো সড়ক বা রেলপথে পরিবহনের উপযোগী ক্যারিয়ার তৈরি করাও সহজ হয়। ভিন্ন ভিন্ন আকারের কনটেইনার ব্যবহার করলে সড়ক বা রেলপথের ক্যারিয়ারগুলোর আকারও ভিন্ন হতো। এতে পণ্য লোডিং, আন-লোডিংয়ে অতিরিক্ত অর্থ, শ্রম ও সময় ব্যয় হতো।
টোয়েন্টি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট (টিইইউ)
টোয়েন্টি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট বা টিইইউ হলো কনটেইনার পরিবহনের একটি প্রমাণ ইউনিট। ২০ ফুট দীর্ঘ ধাতব ইন্টারমোডাল কনটেইনারগুলোই টিইইউ নামে পরিচিত। তবে এ ধরনের কনটেইনারগুলোর উচ্চতার কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। কনটেইনারগুলোর উচ্চতা সাধারণত ৪ ফুট ৩ ইঞ্চি থেকে ৯ ফুট ৬ ইঞ্চির মধ্যে হয়। তবে ৮ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার কনটেইনার সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। উচ্চতায় ভিন্নতা দেখা গেলে এ ধরনের কনটেইনার প্রস্থে ৮ ফুট হয়ে থাকে।
ফরটি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট (এফইইউ)
কনটেইনারের আরেকটি স্ট্যান্ডার্ড সাইজ হলো ৪০ ফুট দৈর্ঘ্য। দৈর্ঘ্যে দ্বিগুণ হলেও এগুলোর প্রস্থ টিইইউর সমান হয়। এই আকারের কনটেইনারগুলোকে ফরটি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট বা এফইইউ একক দিয়ে প্রকাশ করা হয়। সাধারণত একটি এফইইউ কনটেইনারকে দুটি টিইইউ কনটেইনারের সমান ধরা হয়।
জাহাজের রকমফের
গত আড়াইশ বছরে কনটেইনারের সাইজের সাথে পাল্লা দিয়ে কনটেইনারবাহী জাহাজের আকার-আয়তনেও নানাবিধ পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বায়নের এই যুগে কনটেইনার জাহাজগুলো ক্রমেই দানবাকৃতি ধারণ করছে। সাইজের ভিত্তিতে কনটেইনার জাহাজকে সাতটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে।
স্মল ফিডার
সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির কনটেইনার জাহাজগুলো স্মল ফিডার ক্যাটাগরির আওতাভুক্ত। এ ধরনের জাহাজের ধারণক্ষমতা সর্বোচ্চ ১ হাজার টিইইউ। এসব জাহাজ সাধারণত ছোট বন্দর থেকে স্বল্প পরিমাণ কার্গো ট্রান্সশিপমেন্ট হাবে মাদার শিপে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে।
ফিডার
১ হাজার থেকে ২ হাজার টিইইউ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন মাঝারি-আকৃতির ফ্রেইট শিপগুলো ফিডার নামে পরিচিত। স্মল ফিডারের মতো এ ধরনের জাহাজও অগভীর বা অভ্যন্তরীণ বন্দরের সঙ্গে বৃহদাকৃতির জাহাজের সংযোগ স্থাপন করে। বড় জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা নেই এমন বন্দর থেকে কার্গো সংগ্রহ করে মাদার শিপে পৌঁছে দেওয়াই ফিডারের কাজ। এ ধরনের জাহাজ দক্ষতার সাথে কনটেইনার লোডিং আনলোডিং করতে সক্ষম। যা একই সাথে বন্দরের কাজের গতি বাড়ায় এবং কনটেইনার পরিবহন দ্রুততর করে। স্বল্প দূরত্বে কার্যক্রম পরিচালনায় পারদর্শী কোম্পানিগুলোই সাধারণত ফিডার পরিচালনা করে।
ফিডারম্যাক্স
গড়ে ১৭০ থেকে ২০০ মিটার দীর্ঘ এবং ২ থেকে ৩ হাজার টিইইউ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন কনটেইনার জাহাজগুলো ফিডারম্যাক্স নামে পরিচিত। সংকীর্ণ প্রণালী এবং অগভীর জলপথে অধিক পরিমাণ কার্গো বহনের কাজে এ ধরনের জাহাজ ব্যবহার হয়। ফিডার ক্যাটাগরির সব জাহাজই সাধারণত কার্গো ক্রেন বহন করে থাকে।
পানাম্যাক্স
পানামা খাল বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বাণিজ্যপথ। মানবসৃষ্ট এই পথটি লক সিস্টেম ব্যবহার করে দুটি ভিন্ন উচ্চতায় থাকা আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে সংযোগ সৃষ্টি করেছে। ৮২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খাল অতিক্রম করতে পণ্যবাহী জাহাজগুলোকে একাধিক জল-কপাট পার হতে হয়। পানামা খাল কর্তৃপক্ষ (পিসিএ) অতিক্রমযোগ্য জাহাজের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তাবলি ও জাহাজের ড্রাফটের সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। যেসব জাহাজ পানামা খাল অতিক্রম করতে সক্ষম সেগুলোই পানাম্যাক্স ও নিওপানামাক্স ক্যাটাগরিভুক্ত। সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৩ মিটার ড্রাফটের পানাম্যাক্স জাহাজের দৈর্ঘ্য ৯৬৫ ফুট এবং প্রস্থ ১০৬ ফুট হয়ে থাকে। এ ধরনের জাহাজ ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার ১০০ টিইইউ কনটেইনার বহন করতে সক্ষম।
পোস্ট-পানাম্যাক্স
বর্তমান সময়ে নৌপথে পণ্য পরিবহনে বিশাল আকারের জাহাজের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। অত্যাধুনিক যেসব সুপারট্যাংকার বা কনটেইনার জাহাজ মূল পানামা খালের লকগুলো অতিক্রম করতে পারে না, সেগুলোকেই পোস্ট-পানাম্যাক্স বা ওভার-পানাম্যাক্স ক্যাটাগরিভুক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের জাহাজ ৫ হাজার ১০০ থেকে ১০ হাজার টিইইউ কনটেইনার বহন করতে পারে।
নিওপানাম্যাক্স
সময়ের সাথে সাথে পানামা খালের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। অতিরিক্ত জাহাজের চাপ সামাল দিতে পানামা খাল সম্প্রসারণ করেছে কর্তৃপক্ষ। বৃহদাকার জাহাজ চলাচলের সুবিধার জন্য ২০১৬ সালে নতুন লকগুলো খুলে দেয় পিসিএ। পানামা খালের বর্ধিত অংশ দিয়ে চলাচলের উপযোগী জাহাজগুলো নিওপানাম্যাক্স নামে পরিচিত। ১৫ দশমিক ২ মিটার ড্রাফটের নিওপানাম্যাক্স জাহাজগুলো ১২০০ ফুট দীর্ঘ এবং ১৬০ দশমিক ৭ ফুট প্রশস্ত হয়ে থাকে। দানবাকৃতির এসব জাহাজ ১০ হাজার থেকে সাড়ে ১৪ হাজার টিইইউ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন।
আল্ট্রা-লার্জ
বিগত তিন দশকে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যিক নৌবহরে বিশাল আকারের জাহাজ যুক্ত করার প্রবণতা বেড়েছে। অতিকায় আকৃতির এসব জাহাজ আল্ট্রা লার্জ কনটেইনার ভেসেল (ইউএলসিভি) ক্যাটাগরিভুক্ত। ১৫ দশমিক ২ মিটার বা তার চেয়েও গভীর ড্রাফটের এসব জাহাজ ১২০০ ফুট দীর্ঘ ও ১৬০ ফুটের বেশি প্রশস্ত হয়ে থাকে। ইউএলসিভির ধারণক্ষমতা সাড়ে ১৪ হাজার টিইইউরও অধিক। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বহরে ২৪ হাজার টিইইউর অতিকায় জাহাজ যুক্ত করছে মায়েরস্ক, ওয়ান, ওওসিএলের মতো শীর্ষস্থানীয় শিপিং কোম্পানিগুলো।
পণ্য পরিবহনের নিয়ম-নীতি
নিরাপদে পণ্য পরিবহন করাই কনটেইনারবাহী জাহাজের প্রধান কাজ। পণ্যকে অক্ষত অবস্থায় গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পণ্য পরিবহনকারীকে বেশকিছু নিয়ম-নীতি মেনে চলতে হয়।
কনটেইনার প্যাকিং
শিপিং কোম্পানিগুলো দুভাবে কনটেইনারে পণ্য লোড করে থাকে।
ফুল কনটেইনার লোড (এফএলসি)
এই ধরনের শিপমেন্টে একটি কনটেইনারের সমস্ত জায়গা জুড়ে একটি কার্গোই বহন করা হয়। এক্ষেত্রে কনটেইনারে থাকা কার্গো শিপারের মালিকানাধীন থাকে অর্থাৎ শিপার অন্য কারো সাথে কনটেইনারের জায়গা ভাগাভাগি করে নেয় না। এফএলসির ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার কোম্পানিগুলো কনটেইনার ইজারা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় শিপারের কাছে খালি কনটেইনার পাঠানো হয়। শিপার নিজ দায়িত্বে পণ্য লোড করে ক্যারিয়ার কোম্পানির দেওয়া সিল লাগিয়ে কনটেইনার বন্দরে পৌঁছে দেয়। ক্যারিয়ার কোম্পানি পরবর্তীতে জাহাজে কনটেইনার লোড করে গন্তব্যে নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে গন্তব্যে পৌঁছানোর পরও পণ্য অক্ষত থাকার নিশ্চয়তা প্রদান করার দায়িত্ব শিপারের।
লেস দ্যান ফুল কনটেইনার লোড (এলসিএল)
পরিবহনকৃত পণ্যের পরিমাণ যখন কনটেইনারের চেয়ে কম হয় তখন শিপার এলসিএল পন্থা অবলম্বন করে। এই পদ্ধতিতে শিপার অন্যান্য ছোট কার্গোর সঙ্গে মিলিতভাবে একটি কনটেইনার শেয়ার করে। একসাথে একাধিক শিপারের কার্গো বহন করা হয় বলে একে সম্মিলিত কনটেইনারও বলা হয়। এলসিএলের ক্ষেত্রে রপ্তানিকারক পণ্য কনটেইনার ফ্রেইট স্টেশনে (সিএফএস) পাঠিয়ে দেয় এবং অন্যান্য ব্যবসায়ীদের পণ্যের সাথে একত্রে সেটা কনটেইনারে লোড করা হয়। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর কনটেইনারে থাকা পণ্যগুলোকে ডিগ্রপিং প্রক্রিয়ায় পৃথক করে নিজ নিজ প্রাপকের কাছে পাঠানো হয়।
কনটেইনারের সুরক্ষা নিশ্চিতে করণীয়
জাহাজের কার্গো হোল্ড ও ডেকে করে কনটেইনার বহন করা হয়। ডেকে থাকা কনটেইনারগুলোকে উত্তাল সাগর, উচ্চ তাপমাত্রা, বৈরী আবহাওয়াসহ নানাবিধ প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়। এসব কনটেইনার সাগরে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি যেমন বেশি তেমনি এতে থাকা পণ্য অক্ষত অবস্থায় গন্তব্যে পৌঁছানোও বেশ কষ্টকর। এর ফলে এসব কনটেইনার নির্মাণে তাপ নিরোধক উপাদান ব্যবহারের পাশাপাশি সুরক্ষা নিশ্চিতে ক্যারিয়ার কোম্পানিকে বেশকিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়।
- ওজনের নির্ধারিত সীমারেখা মেনে সমস্ত কনটেইনারে পণ্য লোড করা।
- কনটেইনারের ভেতর পণ্যের ওজন সমানভাবে বণ্টন করা।
- ডেকের প্রতি বর্গফুটে যতটুকু ওজন বহনের অনুমোদন রয়েছে তা মেনে চলা।
- কনটেইনারের যেকোনো এক পাশে ভারী পণ্য লোড না করা।
- স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কনটেইনারের নিচের দিকে ভারী পণ্য লোড করা।
- ভারী পণ্য বাক্স বা ক্যারেটে করে কনটেইনারে লোড করা।
উপসংহার
দশটি কনটেইনারবাহী বক্স জাহাজ স্টারভেশনার থেকে ২৪ হাজার ৩৪৬ টিইইউ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন সর্ববৃহৎ জাহাজ এমএসসি এরিনার এই দীর্ঘ যাত্রায় পণ্য পরিবহনের গতি-প্রকৃতি যেমন বদলেছে তেমনি বদলে গেছে প্রতিকূলতার ধরন। বর্তমান সময়ে এক সাথে বিপুল পরিমাণ পণ্য বহনের সুবিধা প্রদান করলেও কনটেইনার শিপিং খাতকে লড়তে হচ্ছে ভ‚রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও বৈরী প্রকৃতির বিরুদ্ধে। ক্রমবর্ধমান প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে পণ্যের সাপ্লাই চেইন সমুন্নত রাখতে হলে ক্যারিয়ার কোম্পানি ও শিপারদের যথাযথ প্রস্তুতি ও প্যাকেজিং নিশ্চিত করার পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রির নিয়ম-কানুন যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে।